ভাদ্রপদী



মাহমুদ মেনন
অলঙ্করণ: কাজী যুবাইর মাহমুদ

অলঙ্করণ: কাজী যুবাইর মাহমুদ

  • Font increase
  • Font Decrease

এমন ঠ্যালা দরজা নাটক সিনেমায় অনেকবার দেখেছে সে। থানার ভিতরে ধর্ষণের দৃশ্যেই বেশি দেখেছে। থানার বড়কর্তা ধরে আনা মেয়েটিকে নিয়ে ভেতরে যান। এর কিছুক্ষণ পর দরজাটি ঠেলে শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বাইরে বের হয়ে আসেন। তখন তার চোখে মুখে থাকে লালসা মেটানোর অভিব্যক্তি। এরকম দরজার কপাটদুটো একটার সাথে অন্যটা লটকে যায় না। ধাক্কায় ক্যাচ শব্দে খোলে বটে, কিন্তু পরক্ষণেই দুটি কপাট নিজে নিজেই একটা অন্যটার সমান হয়ে থেমে থাকে। ওপাশটাকে আড়াল করে দেয়। তেমনই আড়াল করা ওপাশটা সামনে রেখে বসে আছে ভাদু।

সাহেদ তাকে নিয়ে এসেছে এখানে। লিফট থেকে নেমে লম্বা একটা করিডোর। সাহেদের বাহুবন্দি সে। একটি ভারী পাল্লার দরজার সামনে থামে তারা। পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে দরজায় কার্ড পাঞ্চ করে সাহেদ। ভেতরে ঢুকেই একটি বড় কামরা। যার চারিদিকটা ঘিরে ভারী সোফা বসানো। সোফার বটলগ্রিন রঙটা চোখ জুড়িয়ে দেয়। তারই একটিতে তাকে বসিয়ে সাহেদ বললো,‘দু-দণ্ড বসো। আমি জাস্ট একটা কাজ সেরে ফিরছি।’ বলেই ঠ্যালা দরজাটি ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেল। খানিকটা ঝাপটা-ঝাপটি করে তার সামনে ওপাশটাকে আড়াল করে থেমে থাকল দুটি কপাট।

দু-দণ্ড বলে সাহেদ এরই মধ্যে ঠিক ৪১ মিনিট কাটিয়ে দিয়েছে। তার ফেরার নাম নেই। এই সময়ে দরজাটি ঠেলে আরো একজন ভেতরে ঢুকেছে, দুই জন বের হয়ে গেছে। এদের সকলেরই পরিপাটি সাজ। ভেতরে যে লোকটি গেল তার চেহারাটি খেয়াল করতে পারেনি, তবে পেছন থেকে দেখে বেশভুশায় চোস্ত মনে হলো। দরজা ঠেলে ওপাশে ঢুকে যখন যাচ্ছিলেন, তখনই চোখে পড়ল শার্টের ওপর সাসপেন্ডার পরেছে লোকটি। তবে এদের কাউকে নিয়ে আজ ভাবতে চায় না সে। বরং ঘুরেফিরে দরজাটিই তার ভাবনার কেন্দ্রে এসে ঠেকছে। আচ্ছা, এমন দরজার নাম কী? এই দরজাও ঠেললে খোলে। তবে অন্য দরজাগুলো থেকে আলাদা। অন্য দরজা খোলার পর আবার ঠেলে কিংবা চাপ দিয়ে লাগাতে হয়। এই দরজাটিতে তা লাগে না। কী একটা ব্যাপার—দু হাতের ধাক্কায় খুলে ফেলো। ঢুকে পড়ো। আর লাগানোর বালাই নেই। স্প্রিংয়ের কব্জাই টেনে নিয়ে যাবে। বার কয়েক এদিক ওদিক করে দুটি কপাট থেমে যাবে নিজে নিজে। এরপর অন্য কেউ এসে একইরকম ধাক্কা দিয়ে খুলবে, অবলীলায় ঢুকে যাবে কিংবা বের হয়ে আসবে।

ভাদু। যার আসল নাম ভাদ্রপদী। তার এবার মনে হতে লাগল—তার নিজের জীবনটা এই দরজাটারই মতো। খুব সহজেই খুলে ফেলা যায়। চাইলেই চিচিং-ফাঁক। অসংখ্যবার খোলা হয় সে দরজা। কিন্তু কেউ আর সে দরজা আটকে দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। মনে মনে ভাবে দরজাটির একটা নাম সে দিতে পারে। কী হবে সে নাম—সহজ দরজা।

নাম ভাবতে ভাবতে কেটে গেল আরো ১৯মিনিট। কব্জি উল্টে সময় দেখে নিল ঘড়িতে। এখন ঠিক ৪টা ২৭ বাজে। তার দামি ব্র্যান্ডেড ঘড়িটি সময় দেয় ঠিক ঠিক। সময়টা তার মেপেও চলতে হয়। তার মতো মেয়েদের জন্য সময় মেপে চলাটাই সবচেয়ে বেশি জরুরি। সাহেদ যখন ‘দু-দণ্ড বসো’ বলে ভেতরে চলে গেল, তখন সে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেছিল ৩টা ২৭। এবার একটু উদ্বিগ্ন বোধ করছে। কিছুটা মেজাজ খারাপও। রাতে ক্লায়েন্ট আছে। সূর্য ডোবার পর তার কাজ বাড়ে। সন্ধ্যা অবধি সাহেদের সাথে কাটাবে এই প্ল্যানটাই পাকা ছিল। একান্ত কিছুটা সময় কাটাবে বলেও ঠিক করে রেখেছে সে। ভেবে রেখেছে, বিকেলের দিকটা সাহেদের। ওকে নিয়ে যাবে নিজের ছোট্ট ভাড়া করা ফ্লাটে। নিজেকে উজার করে দিয়ে ভালোবাসবে ভালোমানুষ ছেলেটিরে। আহা! কী একটা শান্ত চেহারা! বুদ্ধিদীপ্তও! ভাবে সে।

সাহেদের সাথে যেদিন প্রথম দেখা হয় সেদিনটার কথা মনে করে ফিক করে হেসে ফেলে ভাদু। ভাদু মানে ভাদ্রপদী। তবে তাকে ভাদু নামে আর কেউ ডাকে না। সে নিজেই শুধু কখনো কখনো নিজেকে ভাদু ডাকে। বাবা যতদিন বেঁচেছিলেন, একমাত্র বাবাই তাকে ভাদু ডাকতেন। মা ডাকতেন সোনাটা। বাবার দেওয়া নামটি মায়ের পছন্দ ছিল না। মা আধুনিকা। মেয়ের একটা আধুনিক নাম চাই। ফলে ভরা ভাদরের পূর্ণিমা তিথিতে জন্ম নেওয়ায় বাবার দেওয়া ভাদ্রপদী নামটি মায়ের দেওয়া সোনাটায় চাপা পড়তে সময় নেয়নি। ফলে সোনাটাই তার নাম। এই নামেই পরিচয়। সোনাটা ইসলাম।

সেই সোনাটা নাম ধরেই সাহেদের সাথে তার পরিচয়। সেটি ছিল থার্টিফার্স্ট নাইট। নাইটক্লাবে পার্টিটা কেবল জমে উঠেছে। সোনাটা-লারা-ডেইজিরা পুরো ফ্লোর মাতিয়ে তুলেছে উদ্দাম নৃত্যানন্দে। স্বল্পবসনা ত্রয়ী বেশ যৌনাবেদন ছড়াচ্ছিল। এমন সময়েই কথা উঠল ফ্লোরে নামের আদ্যাক্ষর মিলিয়ে পুরুষ-নারী নাচবে। যে যারটা মিলিয়ে নিল। নাচের ফ্লোরে ঢেউ তুলল। কিন্তু সোনাটা তার নামের আদ্যাক্ষরের সাথে মিল হয় এমন কাউকে পাচ্ছিল না। বেশ খানিকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে বারের এককোনে নিজেকে আড়াল করে বসেছিল যে ছেলেটি, তার কাছে নাম জানতে চাইলে জানা গেল সে সাহেদ। ব্যাস আর যায় কোথা হৈহৈ করে কয়েকজন ছুটে গেল। আর অনেকটা চ্যাংদোলা করে তাকে নিয়ে এলো ড্যান্সফ্লোরে। সোনাটার তর সইছিল না। ছেলেটিকে বাহুতে জড়াল। কিন্তু তার মুখ ততক্ষণে পাংশু হয়ে আছে। আর প্রচণ্ড ঘেমে গেছে। একটু পরেই অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে গেল। ব্যাস পুরো পার্টি পণ্ড। হৈচৈ পড়ে গেল। একপাশে সরিয়ে নেওয়া হলো সাহেদকে। চোখে মুখে পানি ছেটানো হলো। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। পার্টি তো আর থেমে থাকবে না। সুতরাং তাকে পাশের একটি রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। ব্যাস সবাই আবার ডান্সফ্লোরে উদ্দাম নৃত্যে মেতেছে। সোনাটা দেখল তার নাচের পার্টনার নেই। সে আস্তে করে পাশের রুমটিতে ঢুকে পড়ল। দেখল সাহেদ নামের ছেলেটি তখনও অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। তার খুব মায়া হলো। সোনাটার আড়ালে যে ভাদ্রপদী, তারই আড়ালে যে মায়াভরা মন, এই মায়া সেজন্য কি? নাকি স্রেফ নাচের ফ্লোরে সে নেই। এ নিয়ে কথা হবে। এখানে তারা এসেছে নাচের বিনিময়ে পয়সা পাবে। তো, সে যদি না নাচে! আর ওরা যদি তাকে পয়সা না দেয়! সুতরাং এই ছেলেকে জাগাতেই হবে! এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে হঠাৎ একটা কাণ্ড করে বসল সে। কাজটি সে কেন করেছিল আজও ভেবে পায় না। প্রথম দিকে এমন একটা কাজ করার জন্য নিজেকে ধিক্কারও দিত সে। বিশেষ করে যখন তার মধ্য থেকে সোনাটা বিদায় নেয়, ভাদু দখল করে নেয় তার পুরোটা, তখন।

এই সোনাটা আর ভাদুর লড়াইয়ে কখনো সোনাটা জেতে, কখনো ভাদু। সেরাতে সোনাটার জয় হয়েছিল বলেই সে কাণ্ডটি করে, তা নয়—মনের গভীর থেকে আজও উপলব্ধি করে—ভাদুই তাকে দিয়ে কাজটি করিয়েছে। আর সে কারণে যখন সে একা হতো, শুধুই ভাদু হয়ে থাকত, মরমে মরে যেত। এমন কাজ সে তো সোনাটার পক্ষেই করা সম্ভব। ভাদু হয়ে সে কী করে কাজটা করল ইত্যাদি।

এখন অবশ্য মাসদুয়েক ধরে বিষয়টি নিয়ে যখন ভাবে, এক ধরনের রোমান্সই বোধ করে। এইক্ষণে এই ঠ্যালা দরজার এপাশে বসে, ওপাশে সাহেদকে আড়াল করে রেখে ভাদু ভাবে কী শুভক্ষণে কাজটা সে করে ফেলেছিল। যা তার জীবনকে এক সুন্দরের পথই হয়তো দেখিয়েছে। কিংবা দেখাতে চলেছে। জীবনটাকে নিয়ে তার নতুন একটা ভাবনাও তৈরি হয়েছে...। থার্টিফার্স্টের সেই রাতে নাচের পেমেন্টটা সে পায়নি। সে নিয়ে এতদিন ক্ষেদ কম ছিল না সোনাটার। এক রাতের ডান্সে হাজার পাঁচেক টাকা পেত, তার পুরোটাই গচ্চা।
ভাদুর মনে পড়ছে, চুমুটাতে কাজ হয়েছিল। এক চুমুতেই জ্ঞান ফিরল ছেলেটির। চোখদুটি বড় বড় করে তাকিয়ে দেখল এক অপ্সরা তার মুখের ওপর ঝুঁকে আছে। তার রুজমাখা গোলাপী গাল। মাসকারায় আঁকা দুটি বড় চোখ, কড়া লিপস্টিকে রাঙা দুটি ঠোঁট। সে লিপস্টিট কিছুটা ঠোঁটে লেপ্টে আছে মেয়েটির নিজেরই ঠোঁটে। তাতে তাকে আরো অপরূপ লাগছে। এবার নিজের অজান্তেই সাহেদ নিজের হাতের উল্টো দিক দিয়ে নিজের ঠোঁটের ওপর ঘষল। আর চোখের সামনে হাত এনে দেখল কড়া লাল রঙ তার কব্জির কাছে লেগে আছে। সাদা শার্টের হাতায়ও লেগেছে কিছুটা। তখনও ঘোর কাটেনি সাহেদের। তার নাসিকারন্ধ্র তখন ভরে আছে সুগন্ধির তীব্রতায়। তার ঘোরলাগা চোখদুটি গোল করে এদিক ওদিক তাকাল। স্বল্পবসনা সোনাটা তখনও সাহেদের বুকের ওপর ঝুঁকে। সুডোল বক্ষযুগলে চোখ পড়তেই আরেক দফা জ্ঞান হারাল সে।

সোনাটা বুঝে গেল ঘটনাটি কী ঘটেছে। সে দ্রুত নিজেকে তুলে নিল সাহেদের গায়ের ওপর থেকে। সে আরো বুঝে নিল এই রাতে তার আর নাচা হবে না। পয়সাও হয়তো মিলবে না। রুম থেকে বেরিয়ে দ্রুত চেঞ্জ রুমে গিয়ে নিজের কাপড়গুলো পরে ফেলল। আবার ছুটে এলো সাহেদের রুমে। এবার দেখতে পেল সাহেদের চোখ খোলা। তবে চাহুনিতে তখনও ঘোর। কিছুক্ষণ পর সাদা শার্ট নেভিব্লু প্যান্ট পরা ভীষণ স্মার্ট ছেলেটিকে বগলদাবা করে ক্লাব থেকে বাইরে চলে গেল কালো রঙের হিজাব পরা একটি মেয়ে। যার নাম সোনাটা। যার অপর নাম ভাদ্রপদী। যার জন্ম হয়েছিল ভাদ্রের ভরা পূর্ণিমায়। যার বাবা তাকে ভাদু নামে ডাকতেন। আর সে নিজেও নিজেকে কখনো কখনো ভাদু নামেই ডাকে। কেউ বুঝতেই পারল না এই দ্রুতপায়ে ছেলেটির হাত ধরে সোনাটা নয় ভাদুই বের হয়ে গেল।

বটলগ্রিন রঙের নরম গদির সোফায় শরীরটা গলিয়ে দেওয়া একটা আরাম আরাম ভাব নিয়ে বসে থাকা ভাদু সে রাতের কথাগুলো ভেবে সত্যিই ফিক করে হেসে দিল। মনের কথাটাই মুখে উচ্চারিত হলো—আহা বেচারা!

তবে যতই বেচারা হোক, সাহেদের ওপর এবার রাগই লাগছে ভাদুর। আজকের দিনটিতে সে সোনাটা হতে মোটেই চায়নি। আজ সে ভাদুই থাকতে চেয়েছে। ভোর থেকে তার ভাদুময় দিনটি যেভাবে শুরু হয়েছিল এবং এগুচ্ছিল তাতে সে ভীষণ খুশি। বিকেলটাও সে ভাদুময় করেই রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু এখানে এসে সাহেদ সেই যে ঠ্যালা দরজা ঠেলে ঢুকল। আর তো বেরুনোর নাম নেই। কত দেরি হবে তার? বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা যে ঘনিয়ে এলো।

দরজাটির দিকে দৃষ্টি ঘন করে তাকায় ভাদু। ভাবে এই বুঝি খুলে যাবে। বের হয়ে আসবে সাহেদ। তাকে বাহুবন্দী করে বলবে—চলো। নিচে সাহেদের মোটরবাইকটি রয়েছে। সেটিতে তারা দ্রুতই পৌঁছে যাবে শান্তিনগরের ফ্লাটে।

নিজের ছোট্ট ফ্ল্যাটটি সুন্দর করে সাজিয়েছে সে। এক বেডরুমের ফ্ল্যাটটি ভাড়ায় নেওয়া। কিন্তু নিজের মতো করেই সাজিয়ে নিয়েছে। সে সাজে আধুনিকতা নয়, আছে সৌন্দর্যের ধ্রুপদী বিন্যাস। বাবার পুরোনো হারমোনিয়ামটিই একমাত্র, যা সে মায়ের কাছ থেকে চেয়ে এনেছে। সেটি রাখা থাকে এককোনে। মাঝে মাঝে যখন কোনো কাজ থাকে না, মানে ক্লায়েন্ট থাকে না, ভাদ্রপদী ঘরেই কাটায়। টুকটাক রান্না করে খেয়ে নেয়। আর হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গায়। আপনমনে সে গাইতে থাকে নিজের পছন্দের গান—আজ জোসনা রাতে সবাই গেছে বনে। বেছে বেছে জোসনার গান গাইতেই তার ভালো লাগে। জোসনা তিথিতেই যে তার জন্ম। সে যে ভাদ্রপদী।

ভাদু ভাবে এসব গানেই সে আসলে নিজেকে খুঁজে পায়। আসলেই কি পায়? এই প্রশ্ন যেন সে নিজেকেই নিজে করে। এসব প্রশ্ন সোনাটার কাছে ভাদুর কিংবা ভাদুর কাছে সোনাটার চলতেই থাকে। কখনো কখনো যখন একা একা বসে থাকে, ভাবে, তখন এই সোনাটা আর ভাদুর লড়াইটা চলতে থাকে। সোনাটার স্বপ্নে গিয়ে ভাদু বাধা দিতে চায়। আবার ভাদুর স্বপ্নে এসে ধরা দিতে চায় সোনাটা। তবে এখন তার মনের মনিকোঠায় কেবল সোনাটা আর ভাদু এই দুইয়ের নয় তৃতীয় একটি নাম... সাহেদ উঁকি ঝুঁকি মারছে। ভেবে রেখেছিল আর আজ বিকেলে তৃতীয় এই ব্যক্তিটিকে পাকাপোক্ত করে দলে ভিড়িয়ে নেবে। আর সময় সুযোগ মতো সোনাটাকে বিদায় করে দিয়ে সে ভাদু হয়ে যাবে। শুধুই ভাদু। ভাদ্রপদী। সে যদি হয় ভরা পূর্ণিমার তিথি, সাহেদ হবে সেই তিথিতে পূর্ণিমার চাঁদ।

ভাবনায় আবারও আসে সেই রাতটি। সেই যে রাত ১০টার দিকে কালো হিজাবে নিজেকে আড়াল করে, সাদা শার্ট, নেভি ব্লু প্যান্ট পরা—টল ডার্ক অ্যান্ড হ্যান্ডসাম ছেলেটিকে অনেকটা বগলদাবা করে টেনে-হিচড়ে উবারে চেপে ছুটেছিল, সে রাতেও তার ইচ্ছা হয়েছিল—নিয়ে যাবে ছেলেটিরে নিজের ফ্লাটে। কাউকে কখনো নেয়নি, নেয়ও না। কিন্তু এই ছেলেটিকে দেখে তার কেনো যেন মনে হয়েছিল একে নেওয়া যায়। কিংবা একেই নেওয়া যায়। কিন্তু গাড়ি যখন মহাখালি ফ্লাইওভারে তখনই ঘোর কাটল সাহেদের। সে জানাল রাত দুটোয় তার ফ্লাইট। বাবা-মাসহ তারা রাতে আমেরিকা যাচ্ছে। তারা আমেরিকায় থাকে। ঢাকায় থার্টিফার্স্ট নাইটের অনেক গল্প শুনেছে, কেমন তা দেখতেই নিজে নিজে গুগল করে এই ক্লাবে এসে ঢুকেছিল, ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে দিয়ে সরাসরি এয়ারপোর্টে যাবে। বাকিরা লাগেজ নিয়ে পৌঁছুবে। তখন আর সময় নেই।

ভাদুর ভেতরের সোনাটা কিংবা সোনাটার ভেতরের ভাদুই তখন জানাল তারা আর কোথাও নয় এয়ারপোর্টের দিকেই যাচ্ছে। নিজের ফ্ল্যাটে নয়, মায়ের ছেলেটিকে মায়ের কাছে পৌঁছে দেওয়াই তার কাজ। ফলে উবারের ড্রাইভার জাহাঙ্গীর গেট থেকে ইউটার্ন নিয়ে ছুটল এয়ারপোর্টের দিকে। পৌঁছতে সময় নিল না। থ্যাংক ইউ বলে সাহেদ নেমে দ্রুত এগিয়ে গেল আর্চওয়ের দিকে। আর সাহেদ নামতেই ভাদুর ভেতরের সোনাটা ভীষণভাবে বিরক্ত হয়ে উঠল। রাতের কামাই মাটি। উবার ছুটল উল্টোপথে। ওয়েস্টিনের দিকটাতে এই রাতেই একবার ঢুঁ মারতে পারে। রাতেও হুটহাট দুয়েকটা কাজ পাওয়া যায়। তাতে কিছুটা হলেও ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যাবে।

এই সোনাটা আর ভাদুর লড়াইটা মাঝে মাঝে বেশ ভালোই উপভোগ করে সে। কে যে কাকে কখন জিতে নেয়, সেটার ওপর তার নিজেরও খুব একটা নিয়ন্ত্রণ থাকে না। হঠাৎ দেখে ভাদুর ওপর সোনাটা ওভারপাওয়ার করছে। আবার কখনো কখনো সোনাটার ওপর ভাদু।

এই যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো আর তার ভেতর থেকে গোটা দিনের ভাদু এখন পলায়নপর। সোনাটা এসে ভর করতে শুরু করেছে। তাতে সাহেদের ওপর বিরক্তিটাই প্রকট হয়ে উঠেছে।

সাহেদ ঢাকায় এসেছে দুই সপ্তাহ হলো। বলেছে স্রেফ তার সঙ্গে দেখা করতেই পৃথিবীর অপর পিঠ থেকে উড়ে এসেছে সে। এতে ভাদু ভীষণ খুশি হয়েছে। এর আগেই তাদের মধ্যে ফেসবুকে যোগাযোগ হয়েছে। সাহেদই মূলত তাকে খুঁজে নিয়েছে। জানিয়েছে ইমেজ সার্চিংয়ের মাধ্যমে সে তাকে খুঁজে বের করেছে ভার্চুয়াল জগতে।

সে রাতে উবারের গাড়িটি যখন এয়ারপোর্টের দিকে সাঁই সাঁই করে এগুচ্ছিল তখন সাহেদ যেনো তার নিজস্বতায় ফিরেছে। বারবার ধন্যবাদের বন্যায় ভাসিয়ে দিচ্ছিল সোনাটাকে। বলছিল, আজ জীবনকে সে নতুন করে চিনেছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। সাধারণত কারো সেলফি তোলার আহ্বানে সাড়া দেয় না সোনাটা। ভাদুও নয়। কিন্তু গাড়িটি যখন বনানী ফ্লাইওভার দিয়ে যাচ্ছিল সাহেদ তার পকেট থেকে মোবাইল ফোনটি বের করে পট করে একটি সেলফি তুলে নিল। কাউকে না বলে ছবি তোলাটা অভদ্রতা। ছেলেটা নাকি আমেরিকায় থাকে। এই সামান্য বিষয়টা কী সে জানে না! বিরক্ত হয় সোনাটা। সেলফি তোলাটা তার পছন্দ নয়। তবে যা কিছুই বলল তা মনে মনে। প্রকাশ্যে কিছু বলল না। আর ভাদু, যার সেলফিতে ভীষণ অ্যালার্জিই বলা চলে, সেও কোনো আপত্তি করল না। নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রেখেই সাহেদ সেলফিটি তুলে নিয়েছিল। তো সেই সেলফি থেকেই সোনাটার ইমেজ সার্চ করে তার সন্ধান বের করে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায় সাহেদ। সোনাটা তা সহজেই গ্রহণও করে। টল-ডার্ক-হ্যান্ডসাম ছেলেটিকে না করার শক্তি তার ছিল না। বস্তুত কারোরই ছিল না। না সোনাটার, না ভাদুর। এরপর কত কী যে চলে। কথা বলাবলি, ছবি চালাচালি। কত ছাইপাশ—আবোল তাবোল। এসব নিয়েও সোনাটার সাথে ভাদুকে কম লড়তে হয়নি।

মেজাজটা ক্রমেই খিঁচড়ে যাচ্ছে। অনেক্ষণ ধরে ঠ্যালা দরজাটির দিকে তাকিয়ে সে। দরজাটির মাঝের অংশ দিয়েই ওপাশটা আড়াল করা। নিচের দিক থেকে ওদিকটার মেঝেতে অনেকটা দেখা যায়। কড়া নীল রঙের কার্পেট বিছানো। একটি দুটো আসবাবের খানিকটা অংশ চোখে পড়ে। উপরের ফাঁকা থেকেও চোখে পড়ে একটি ঝাড়বাতির কিছুটা অংশ। ব্যাস এই। মাঝে দুই দিক থেকে আসা দুটি কপাট। ঠিক সমান হয়ে এমনভাবে লেগে আছে যে ফাঁক গলিয়ে কিছু দেখা যায় না। ভাদু জানে, সামান্য ধাক্কাতেই দরজাটি খুলে যাবে। একটি অতি সহজ দরজা, যা চাইলেই খুলে ফেলা যায়। কিন্তু সেই দরজাটিই তার থেকে আড়াল করে রেখেছে সাহেদকে। হঠাৎ মনে হলো এই দুটি সামান্য কপাট যেন তার কাছ থেকে একটা পৃথিবীকে আড়াল করে রেখেছে। যে পৃথিবীটি গত কিছুদিন ধরে সে সাজিয়েছে। যে পৃথিবীটি হয়ে উঠেছিল ভাদুর। কিংবা বলা চলে, ভাদু ও সাহেদের।

দু সপ্তাহ আগে সাহেদ যখন তাকে জানাল সে দেশে আসছে। এবং শুধু তারই জন্য। তখন থেকেই সে তাদের জন্য এই নতুন পৃথিবীটি সাজাতে শুরু করেছে। আর এই দুই সপ্তাহে পৃথিবীটা অনেকটা সাজিয়েও ফেলেছে। এখনো তার নিজের পেশা সে ছাড়েনি বটে, তবে আজ বিকেলেই সে সিদ্ধান্তটিও পাকাপাকি নিয়ে নেবে বলেই মনোস্থির করে রেখেছে। এখন কেন যেন তার মনে হচ্ছে দুই সপ্তাহ ধরে যে পৃথিবীটা সে সাজিয়েছে ওই সহজ দরজাটির ওপারে সেটিই ঢাকা পড়ে আছে।

আচ্ছা! করছেটা কী সাহেদ, ওপাশে? প্রশ্ন তার মনে। গত প্রায় দেড়ঘণ্টায় রুমটি থেকে আর কেউ বের হয়নি, কেউ ঢোকেওনি। যে ভবনটিতে তারা উঠেছে তাতে লিফটে ঠিক কততলায় উঠেছে তাও সে মনে করতে পারছে না। মনে করবে কী করে? আসলে সে দেখেওনি সাহেদ ঠিক কততলার বাটনটি চাপ দিয়েছিল। মাথাটা ক্রমেই ফাঁকা হয়ে আসছে।

ঠিক তখনই দরজাটি খুলে গেল এক ধাক্কায়। একটা রোগা পাতলা কিশোর বয়সী ছেলে তার কাছে এগিয়ে এসে অদ্ভুত একটা ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, আপনারে ভিত্রে ডাহে।

সাহেদ কোথায়?

ক্যাডায় সাহেদ?

যার সাথে আমি এসেছি।

সবাই ভিত্রেই আছে। আপনারে যাইতে কইছে। তয় সাহেদ নামে কেউ নাই। আপনারে যে নিয়া আইছে হের নাম জিম।

মানে কী?

ছেলেটির ফ্যাসফ্যাসে স্বর, আর তাকানো ভঙ্গি তার ভালো লাগল না। এক নিমিষে মাথা ঝিম ধরে গেল ভাদুর। তবে সে কেবল ভাদুই নয়। সে সোনাটাও। যে সোনাটা সাহসী। কিছুটা বিপদের আচ করলেও ভাবল এমন বিপদে কম পড়তে হয়নি তাকে। কত মন্ত্রী-এমপি দেখে এলো, কী আর হবে। মনে মনে একটু হাসলও সে। ভাবল বাহ! বেশতো তার নিজের মতো এই ছেলেটারও দুটো নাম। সাহেদ আর জিম।

ভাবতে ভাবতে সামনে এগুলো। সহজ দরজা ঠেলে আগে আগে ঢুকল ছেলেটি। আর তার নাকের ডগায় ঝপাট করে কপাটদুটো আটকে গেল। এ এমন এক দরজা ভেতরে যেতে হলে নিজেকেই ঠেলে যেতে হবে। ভাদুও ঢুকল, সহজ দরজার আলগা কপাট ঠেলে।

কে ঢুকল? ভাদু নাকি সোনাটা? সে নিজেও বুঝতে পারল না। তবে কিশোর ছেলেটি তার লিকলিকে পা ফেলে কিছুটা সামনে এগিয়ে গেছে। নীল মোটা কার্পেটে তার খালি পা অনেকটা দেবে দেবে যাচ্ছে। হিল পরে থাকলেও সেই কার্পেটে নিঃশব্দেই এগুচ্ছে সোনাটাও। বড় হলঘরে নিচে কার্পেট আর উপরে একটার পর একটা বড় ঝাড়বাতি ছাড়া আর কিছু তেমন নেই। ঠিক সামনে একটি টেবিল পাতা। তাতে গোটা তিনেক চেয়ার। বাকিটা ফাঁকা। হলওয়ে পার করে একটি কাচের দরজা ঠেলে ছেলেটি বলল, যান।

যাব?

হ যান, সবাই ভিত্রে আছে!

ছেলেটির কথা বলার ভঙ্গি ভীষণ বিরক্তিকর। কষে চড় লাগিয়ে দিতে ইচ্ছা হলো তার। সেটা না করে বিরক্তি নিয়েই ভিতরে ঢুকল সে। আর ঢুকতেই দরজাটি বন্ধ হয়ে গেল অটো সেন্সরে। কট করে দরজা বন্ধ হওয়ার একটি শব্দ এসে বুকে ধাক্কা দিল। সোনাটা দেখল জনা চারেক লোক একটি টেবিল ঘিরে বসে আছে। তাদের মধ্যে দুই জন সাদা চামড়ার বিদেশি। সামার ব্লেজার পরা। একজন দেশি। ভদ্রবেশি মধ্যবয়সী। চেক প্যান্ট, গোলাপি শার্টের ওপর সাসপেন্ডার পরে আছেন। সোনাটা বুঝতে পারল—একেই সে ঢুকতে দেখেছে। আর কেমন যেন চেনা চেনা মনে হলো। আর চিনেও ফেলল। থার্টিফার্স্ট নাইটে যে ব্যক্তি ডান্স ফ্লোরে নামের আদ্যাক্ষর মিলিয়ে যুগলনাচ করার ঘোষণা দিয়েছিলেন ইনি সেই জন। অপরজন সাহেদ। সে পরে আছে থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট ও টি-শার্ট। কিছুক্ষণ আগে যে পোশাকে ছিল সে পোশাকে নয়, একদম ঘরোয়া পোশাকে। এতে ভাদুর ঝিমধরা ভাবটি তীব্র হলো। ঠিক তখনই পেছন থেকে সাসপেন্ডার পরা লোকটা এগিয়ে এসে কুৎসিতভাবে জড়িয়ে ধরল তাকে। এমন কিছুর জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না সোনাটা। ভাদু তো নয়ই। আর ঘোর কাটলে, কি হচ্ছে বুঝে ওঠার আগেই আবিষ্কার করল টেবিলের ওপরে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে। শাড়িটা তার গায়ে নেই। আলোচনা হচ্ছে বাকি চার জনে।

‘নট ব্যাড,’ বলল দুই বিদেশির মধ্যে আকাশি রঙা সামারকোট পরা জন।

‘ইয়াহ! বাট উই নিড টু টেক অ্যা মেজারমেন্ট,’ বলল অপর বিদেশি।

‘রাইট!’ বলে সক্রিয় হলো সাহেদ। তার হাতে একটি মেজারিং টেপ। ঝুকে পড়ল সোনাটার দিকে। প্রথমে তার বুক মাপল। মুখে বলল, ‘থার্টি ফাইভ।’ এরপর কোমর—টুয়েন্টি সিক্স। আর নিতম্বের দিকটায় আবার থার্টি ফাইভ।

‘ওন্ট গো,’ বলল অফ হোয়াইট সামার কোট পরা বিদেশিটি।

সাসপেন্ডার টেনে ধরে কেতা দুরস্ত বাঙালিটি বলল, ‘হোয়ায়াই... হোয়াটস রং। শি ইজ ফাইন। উই হ্যাভ বিন চেজিং হার সিন্স কোয়ায়েট অ্যা লং। শি ইজ পারফেক্ট অব দ্য পারফেক্টস।’

‘ইউ নো ম্যান, ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড ইজ থার্টি ফাইভ-টুয়েন্টি ফাইভ-থার্টি ফাইভ। ওয়ান ইঞ্চ ফ্যাটার।’

কী হচ্ছে এসব, তার কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারল সোনাটা। বুঝতে পারল কোনো ইন্টারন্যাশনাল চক্রের খপ্পরে পড়েছে সে। অন্ধকার জগতের খবরাখবর কিছুটা সে পায়। আগেও শুনেছে, ঢাকায় এমন একটি চক্র কাজ করছে। বুঝে নিল, হয়তো তার জন্য বিদেশি ক্লায়েন্ট খোঁজা হচ্ছে। নয়তো হতে পারে আন্তর্জাতিক বাজারেই তাকে চালান করে দেবে এরা। সাহেদকে নিয়ে গড়া নতুন স্বপ্নের পৃথিবীটা তখন আর দেখতেই পাচ্ছে না সে। ভেতরের ভাদুটা কিছুক্ষণ লড়াই করে সোনাটার সাথে পেরেই উঠল না। ফলে প্রতিবাদ কিছু হলো না। বরং সোনাটা ভাবল দেশের বাজারের চেয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে বিকোলে তাতে মন্দ কী? সুতরাং চুপ করে থাকাই ভালো। দেখি না কী হয়!

সাসপেন্ডারওয়ালা এবার দুই বিদেশির কাঁধে দুই হাত রেখে দুজনকে ‘কামওন মেন’ বলে একসাথে ধাক্কা মেরে একটু দূরে সরিয়ে নিয়ে গেল। এরপর তারা ফিসফিস করে কী যেন বলল। আর একটু পরেই হাসি হাসি মুখ করে ফিরে এলো।

‘ওহ ইটস ফ্রি!’ বলে নীলরঙা সামারকোটধারী নিমেষেই কোটটি খুলে ফেলল। আর অল্প সময়ই নিল পুরো বিবস্ত্র হতে। এমনটার জন্য আদৌ প্রস্তুত ছিল না ভাদু। তাই আলগোছে টেবিল থেকে নেমে পড়ল সে। কিন্ত সোনাটা এতে অভ্যস্ত। সুতরাং লেট ইট গো। কিউতে দ্বিতীয় ছিল সাসপেন্ডারধারী বাংলাদেশিটি। হ্যাংলাটা যতটা না আসল কাজের কাজী—তার চেয়ে নোংরামো বেশি। একবার ভাবল দেয় থুথু ছিটিয়ে লোকটির মুখে। কিন্তু না! সোনাটার সামনে তখন বিদেশ বিভূঁইয়ের স্বপ্ন। রেড লাইট জোন। পোল ডান্স। ন্যুড ক্লাব। কত কিছু শুনেছে। সেখানে নাকি সোনালি-রুপালি জীবন। শরীর নয়, স্বপ্ন নিয়েই ভাবছে সে। এদিকে চার জনের মধ্যে তৃতীয়জন হয়ে দ্বিতীয় বিদেশিটি যখন তার ওপর চড়াও হলো তখন সে জ্ঞান হারাল। জ্ঞানের তোয়াক্কাও করছিল না সোনাটা। তার কাছে রূপালি স্বপ্নটাই বড় হয়ে থাকল। কিছুক্ষণ পর যখন জ্ঞান যখন ফিরল তখন সাহেদ কিংবা সাহেদবেশী জিম তার উপরে। এবার তার মনে এলো সেই রাতটির কথা। থার্টিফার্স্টের সেই রাত। কিন্তু সে স্মৃতি ক্রমেই তার ম্লান হয়ে গেল। বরং টের পেল গত দিন সাতেক ধরে যে নতুন জগতটি সে মনে মনে সাজিয়েছে, সোনাটা থেকে পুরোপুরি ভাদু হয়ে যাওয়ার স্বপ্নভরা সেই জগত, যাতে সাহেদও ছিল, সেই পুরো জগতটিই জগদ্দলের মতো তার ওপর চেপে বসেছে। হঠাৎ এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়ে কাকে যেন খুঁজতে লাগল। কাকে খুঁজছে সে? ভাদুকে? ভাদ্রপদী। ভাদ্রের ভরা পূর্ণিমায় যার জন্ম। ঘোলা চোখেই কাচের দরজা ভেদ করে সে দেখতে পেল সামনের সেই সহজ ঠ্যালা দরজাটি ঠেলে ভাদ্রপদী বের হয়ে গেল। এখানে পড়ে রইল শুধুই সোনাটা। এতদিন পেটের তাগিদে, নিজের ইচ্ছায় যে কাজটি সে করে এসেছে তাতে তার ক্ষেদ ছিল না। ভয়ও ছিল না। ভাদুকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাখত নিজের কাছে। সুযোগ মতো ভাদু হয়ে যেত। কিন্তু আজ এই সন্ধ্যায় সোনাটার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের স্বপ্নের কাছে ভাদ্রপদীর সুন্দর স্বপ্নটার যখন চূড়ান্ত পরাজয় হয়ে গেল তখন দরজা ঠেলে চিরদিনের মতোই কী চলে গেল ভাদ্রপদী?

সে কথা ভাবতেই শিউরে উঠল সোনাটা। নিজেকে ভীষণ কলঙ্কিত বোধ করতে লাগল সে। ভাদ্রপদীকে সে আর কোনোদিনই ফিরে পাবে না। চার-চারটি পিশাচের ক্ষুধা মিটিয়ে তখনও যেটুকু বোধ ও দৃষ্টিশক্তি তার অবশিষ্ট তা দিয়ে সে আবছা দেখতে পেল, সহজ দরজার কপাট দুটো তখনও নড়ছে। বার কয়েক ঝাপটিয়ে পুরোপুরি সমান হয়ে স্থির হয়ে গেল। আর আড়াল করে দিল ওপাশটা। এপাশটায় তার জন্য পড়ে রইল নতুন এক অন্ধকার জগত। আরেকবার জ্ঞান হারাল সোনাটা। হ্যাঁ সোনাটাই।

আর ভাদ্রপদী! সে চলে গেল ভবনটির ছাদে। দেখল ভাদ্রমাসের পূর্ণিমার তিথিতে গোল একটি চাঁদ পূব আকাশে ভীষণ আলো ছড়াচ্ছে। ‘বাবা আমি আসছি’—বলে ঝাঁপ দিল সেই জোছনায়। সেই থেকে ভাদ্রপদী নামের আর কেউ থাকল না। খবর বেরুলো—কলগার্ল সোনাটার আত্মহত্যা।

   

গড়তে চান বই পড়ার অভ্যাস?



মোঃ শরীফুল ইসলাম, নিউজরুম এডিটর, বার্তা২৪.কম
বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতার বিকাশের জন্য বই পড়ুন

বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতার বিকাশের জন্য বই পড়ুন

  • Font increase
  • Font Decrease

লাইব্রেরিগুলো আজকাল ফাঁকা পড়ে থাকে। ক্যাম্পাসের আড্ডায় বই, সে বড়ই হাস্যকর! বই পড়ার মতো সময় হয়ে ওঠে না কারোরই! আমাদের বর্তমান সময়টা কেড়ে নিয়েছে মোবাইল আর ইন্টারনেট। অথচ বই পড়ার গুরুত্ব কমবেশ সকলেরই জানা।

মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য বই কতটা জরুরি সেটা আমাদের অজানা নয়। কিন্তু একটি বই পড়ার জন্য যে সময় প্রয়োজন, প্রয়োজন উপযুক্ত স্থান। সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো, সঠিক বই নির্বাচন।

বই পড়া শুরুর ক্ষেত্রে নতুন পাঠকরা নানান সমস্যার সম্মুখীন হন। এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে না পেরে অনেকের আর বই পড়াই হয় না। আজকের আলোচনায় আমরা জানব কীভাবে একটি বই পাঠ করা যায়, গড়ে তোলা যায় বই পড়ার অভ্যাস।

সময়: বই পড়ার কথা বললেই সবাই এক বাক্যে বলবে, ‘সময় নেই!’ সময় নিয়ে আমাদের অভিযোগের বড় কারণ হলো, নিজের কাজগুলো গুছিয়ে না করা। প্রতিদিন মাত্র ২০-৩০ মিনিট সময় দিয়েই কিন্তু গড়ে তোলা যায় বই পড়ার অভ্যাস। সময় না পাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হলো ইন্টারনেট আর সোশ্যাল মিডিয়া। তাই, সকাল কিংবা সন্ধ্যা হাতের ফোনটা দূরে সরিয়ে কিছুক্ষণের জন্য বসে যান বই নিয়ে।

পরিবেশ: উপযুক্ত পরিবেশ বই পড়ার মনোযোগ বাড়িয়ে দেয়। জানালার পাশে, বেলকনিতে কিংবা বাসার ছাদে বই পড়ার স্থানটি যেন হয় নির্জন এবং শান্ত। আজকাল বিভিন্ন পার্কে ‘নীরব বই পাঠ কর্মসূচি’ দেখা যায়। চাইলে যোগ দিতে পারেন তাঁদের দলেও। বই পড়ার পাশাপাশি পরিচয় হবে বইপ্রেমী মানুষদের সাথে।

বই নির্বাচন: বই পড়ার ক্ষেত্রে ইচ্ছে যেমন জরুরি তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সঠিক বই নির্বাচন। এক্ষেত্রে নিজের ভালো লাগাকে প্রাধান্য দিন। যেসব গল্প আপনাকে আকর্ষণ করে শুরুতে সেই বইগুলোকেই আপনার পাঠ্য তালিকায় রাখুন। 

পাঠাগার: পাঠাগারে গেলেই যে বই পড়তেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। বইয়ের সাথে সময় কাটালে এক সময় সেটা ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে হবে। আর ছুঁয়ে দেখতে গিয়ে কখন যে দু’য়েক পাতা পড়ে ফেলবেন, নিজেই টের পাবেন না! তাই বই পড়ার অভ্যাস গড়তে চলে যান পাঠাগারে। বই না পড়ুন, অন্তত সুন্দর সুন্দর ছবি তোলা তো হবে!

সোশ্যাল মিডিয়া: আমরা সবকিছুতেই সোশ্যাল মিডিয়াকে দায়ী করি। অথচ সোশ্যাল মিডিয়ার সুষ্ঠু ব্যবহার আপনার অভ্যাস গড়ার বড় সহায়ক। ফেসবুকে সাহিত্য তথা বই বিষয়ক বিভিন্ন গ্রুপ রয়েছে। যেখানে বিভিন্ন বই নিয়ে আলোচনা হয়, হয় বই বিষয়ক আড্ডাও। এসব গ্রুপে যুক্ত হয়ে বাড়াতে পারেন বইয়ের সাথে নিজের সম্পৃক্ততা।

ধারাবাহিকতা: বলা হয়ে থাকে টানা ২১ দিন কোনো কাজ করলে সেটা অভ্যাসে পরিণত হয়। বই পড়ার ক্ষেত্রেও তা ব্যতিক্রম নয়। অভ্যাস গড়তে হলে ধরে রাখতে হবে ধারাবাহিকতা। সামান্য হলেও প্রতিদিন পড়ুন। এই ধারাবাহিকতায় আপনার বই পড়াকে অভ্যাসে পরিণত করবে। 

বই পড়ার অভ্যাস রাতারাতি তৈরি হবে না। এজন্য প্রয়োজন ধৈর্য্য এবং অধ্যাবসায়। নতুন পাঠকদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, কিছুদূর পড়ার পর বইটি আর ভালো লাগে না। এক্ষেত্রে ধৈর্য্যহারা হওয়া যাবে। জোর করে সে বই পড়ার প্রয়োজন নেই।

বই মানুষের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়ায়। বই পড়ার অভ্যাস গড়তে পারলে জীবনে উন্নতি সাধন অবধারিত। একাডেমিক পড়ার বাইরেও বইয়ের বিশাল একটি জগত রয়েছে। সেই জগতে মানুষ জানার জন্য পড়ে, পড়ে জ্ঞান অর্জনের জন্য। বই পড়লে মানসিক চাপ হ্রাস পায়, হয় মস্তিস্কের ব্যায়াম, বাড়ে শব্দ ভান্ডার ও স্মৃতি শক্তি। বই পাঠকের চিন্তার জগতকে বিস্তৃত করে, বৃদ্ধি করে বিশ্লেষণ ক্ষমতা। বই পড়ার মাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতার বিকাশ হয়। তাই বই হোক প্রত্যেক মানুষের উত্তম বন্ধু এবং বইয়ের সঙ্গে হোক আমাদের মিতালি।

;

মায়ের সমাধির খোঁজে



মহীবুল আজিজ
মায়ের সমাধির খোঁজে

মায়ের সমাধির খোঁজে

  • Font increase
  • Font Decrease

কন্ডাক্টরকে বললাম, এখানে নামিয়ে দিন,
এখানে এই মিয়াপাড়ায় আমি নামবো—
মিয়াপাড়া কবরস্থানে শুয়ে আছে আমার মা।
মায়ের কবর দেখতে এলাম আটান্ন বছর পরে,
জ্যাঠা বলেছিলেন, গেট দিয়ে ঢুকে ডানদিকে একটু গেলে
একটা গোলাপ গাছ ঘেঁষে কবরটা,
কবরের আগে আমাকে গোলাপ গাছ খুঁজতে হয়—
জ্যাঠা চলে গেছেন তা-ও বত্রিশ বছর।
ডানদিকে ঘুরতেই জড়িয়ে ধরে তাজা গোলাপের ঘ্রাণ,
পাশাপাশি চারটা কবর, চারটাতেই গোলাপের পাহারা;
এত কবর এত কবর, কবরে ভর্তি কবরস্থান—
কোথায় শেষ শয্যা নিয়েছিলেন আমার মা!
হাওয়ায় পাতা দোলে গোলাপের, চারটাই একসঙ্গে,
চারটা গাছ থেকেই মুখবাড়ানো গোলাপ ডাক দেয়—
এইখানে এইখানে এইখানে—কোন্খানে!
উবু হবো কবরের মাটি নিতে
কিন্তু চারটাই ডানদিকে, চারটাই গোলাপের পাশে,
প্রতিটি কবর থেকে একটি একটি মুঠো নিয়ে
পলিথিনের চারটে ব্যাগে রাখি।
একবার মনে হয় প্রথমটাতে,
তারপর মনে হয় দ্বিতীয়টাতে,
আবার মনে হয় তৃতীয়টাতে
এবং মনে হয় চতুর্থটাতে সন্ধান রয়েছে মায়ের।
মা সুপ্ত থেকে যান অনির্দিষ্ট মাটিতে ,
তবে কোন্ মানবের মাটি ধরে রাখি বুকের কাছে!
ঠিক তখন বিস্ময়ের মতন একটি ফুটন্ত গোলাপ
গাছ থেকে ঝরে পড়ে দ্বিতীয় কবরে,
সংশয়ী মন বলে, তবে কী গোলাপই বার্তাবহ মায়ের!
অদৃষ্টে অবিশ্বাসী মন দোলে সংশয়ে,
তখন আরেকটি গোলাপ ঝরে পড়ে চতুর্থ কবরে।
অর্থাৎ দুই যোগ দুইয়ে এসে আমার আর হিসেব মেলে না,
জ্যাঠা বলেছিলেন, কবরটা গেটের ডানদিকে ঘুরতেই
এবং গোলাপের পাশে।
বত্রিশ বছরে চতুর্গুণ হয়েছে গোলাপ
কিন্তু এক ও অবিভাজ্য আমার মা’কে
এই গোলাপের কারণেই খুঁজে পাই না আমি—
ফিরে আসি শুধু গোলাপের ঘ্রাণ নিয়ে।

১১-০৯-২০২৩

;

অর্ধেক রিয়েল, অর্ধেক ভুল



শরীফুল আলম
অর্ধেক রিয়েল, অর্ধেক ভুল

অর্ধেক রিয়েল, অর্ধেক ভুল

  • Font increase
  • Font Decrease

 

আমি সীজার হতে চাইনি
তবুও তুমি ক্লিওপেট্রাই থেকে গেলে
অহেতুক লড়াইয়ে তুমি জয়ী হতে চেয়েছিলে
সম্ভবত একেই পরিযায়ী প্রেম বলে
আলো আঁধারীর খেলা বলে
স্বপ্ন আর জেগে থাকা বলে ,
সমাপ্তি কিম্বা বিবিধ, তা সে যাই হউক
এই সহজ কথাটি
আমরা কেউ কাউকে সহজ ভাবে বলতে পারিনি
অথচ তুমি ফ্রিজিডেয়ারটি বন্ধ করে রাখলে
আর বললে, "নোটেড ",

নিউইয়র্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
হ্যাঁ, এটাই সত্যি
তুমি লৌহশৃংখলে অনুজ্জ্বল এক ডিমলাইট
সুচারু মোহের অভাবে তুমি প্রমত্তা নদী
বাবুই পাখীর বাসার ন্যায় তুমি ঝুলে থাক আমার স্বপ্নে
যা হতে পারতো নির্মল এক সবুজের প্রান্তর ।

তুমি ওঁত পেতে থাকা বাঁশপাতার ফাঁকে পূর্ণিমা
আমি তোলপাড় করে ছুটে চলা এক্সপ্রেস ট্রেন
দলছুট শালিক,
আজ কোন বৈভব নেই
ভালোবাসাবাসি নেই ,
কবিতাও ইদানিং প্রিয় লাগেনা
তবু স্নায়ুরা জেগে থাকে
মনে হয় হলুদ পাতায় যেন ক্লোরোফিল
আমিও প্রবণতায় ফিরে যাই সাইবেরিয়া ।

আনচান মনে কত আকুলতা
কালবৈশাখীর তান্ডব
যেন বাতাসে কাঁপন ধরে,
এসো সখা,
এই শ্রাবণে আবার রিডিজাইন করি,
স্যাটেলাইটে প্যারালাল বার্তা পাঠাই
ভুলে যাই অর্ধেক রিয়েল আর অর্ধেক ভুল
প্লাবনে অবাধ্য ঢেউয়ের উছ্বল ।

________________________________________

 ৯ সেপ্টেম্বর । ২০২৩।
নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।

 

;

পাট পাতার পেলকা সজনে শাকের শোলকা



প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

সোনালী আঁশ বা পাটের দেশ বাংলাদেশ। এক সময় আমাদের প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল পাট। পাটোয়ারী পরিবারগুলো তো বটেই মৌসুমি পাটের ব্যবসায়ীরাও সমাজে মযার্দা পেত। কারণ, যারা পাটের ব্যবসা করতেন তাদের হাতে থাকতো প্রচুর টাকা। তখন পাটকলে যারা চাকরি করতেন তাদের পরিবারেরও অনেক সচ্ছলতা ছিল। নাইলন ও পলিথিনের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হলে পাটের গুরুত্ব কমে যেতে শুরু করে। পাটের চট, রশি, শাড়ি আজকাল কেউ ব্যবহার করতে চায় না। দেশের বন্ধ হয়ে যাওয়া পাটকলগুলোর বড় বড় যন্ত্রপাতি মরিচা ধরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তবে প্রতি বছর গ্রীষ্মের শুরুতে পাট শাকের চাহিদা বেড়ে যায়।

কারণ, পাট পাতার বহুবিধ গুণ। পাট শাক তেতো ও মিষ্টি দুটোই সমভাবে মানুষের কাছে প্রিয়। পাট শাক দিয়ে তৈরি এক ধরণের জনপ্রিয় খাবারের নাম ‘পেলকা’। এই পেলকা ভাজা চালের গুঁড়ো, খাবার সোডা, কাঁঠালবিচি, গোটা রসুন ও কাঁচা মরিচ দিয়ে মিশিয়ে তৈরি করে সাদা ভাতের সাথে পরিবেশন করা হয়ে থাকে। এই রান্নায় নানা ধরণের মশলা ব্যবহার করা হয়। যেগুলো বেশিরভাগ ঘরে তৈরি ভাজা উপকরণের ঢেঁকিছাটা সুগন্ধি গুঁড়ো বা শিলপাটায় পেষানো মিহি মশলা। সাধারণত: পেলকা ও শোলকা রান্নার আগে সরিষা, মেথি, ধনে, মৌরি, কালোজিরা ইত্যাদি ভেজে এই বিশেষ মশলা তৈরি করা হয়। সবকিছুর সংমিশ্রণে ভারী স্যুপের মতো করে সবুজ রংঙের এই রান্না সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। যার ফলে পেলকার স্বাদ হয় খুবই অনন্য ও লোভনীয়।

অনেকে পাটের মৌসুমে পেলকা খাওয়ার লোভে শহর থেকে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে এই বিশেষ রান্নার আয়োজন করতে বায়না ধরে থাকেন। অনেকে পাট শাকের শুকতানি তৈরি করে শুকিয়ে সারা বছরের ভেষজ খাবার হিসেবে যত্ন সহকারে ঘরে সংরক্ষণ করেন। গ্রামের অনেকের কাছে পাট শাকের শুকতানি ভেজা পানি নানা রোগের মহাষৌধ হিসেবে বিবেচিত। অধুনা শহরের বহুতল ছাদ বাগানে পাট শাকের আবাদ করতে দেখা যাচ্ছে।

আরেকটি বিশেষ খাবারের নাম শোলকা। যেটি কচি সজনে পাতা দিয়ে তৈরি কর হয়। পাট শাকের তৈরি পেলকা মৌসুমি রান্না। কিন্তু সজনে পাতার তৈরি শোলকা সারা বছরব্যাপী রান্না করে খাওয়া যায়। বিশেষ করে বারোমাসী সজনে গাছ বাড়িতে থাকলে তো কোন কথাই নেই।

তবে কালের স্রোতে সৌখিন এসব খাবার হারিয়ে যেতে বসেছে। ব্যস্ত কর্মজীবি মানুষ আজকাল সামনে যা পায় তাই ঝট্পট খেয়ে নিতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। পেলকা ও শোলকা রান্নার মতো সময় ও ধৈর্য্যধারণ করার ক্ষমতা আজকাল গ্রামীণ গৃহবধূদেরও নেই। বাজার থেকে পাট শাক কিনে কোন শহুরে পরিবারে রান্না হলে বাচ্চারা সেটা তিতা বলে খেতে চায় না। কিন্তু বিদেশি তিতো চকোলেটযুক্ত দামি চকোপাই বা আইসক্রীম তাদের কাছে খুবই প্রিয়।

এভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে পাট পাতা ও সজনে পাতা দিয়ে তৈরি জনপ্রিয় খাবার দুটো। কিন্তু অবাধ ইন্টারনেটের এই যুগে আবারো পাট ও সজনে পাতা দিয়ে তৈরি বিশেষ খাবার নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়েছে। কচি পাট পাতা দিয়ে তৈরি হচ্ছে শক্তিবর্ধক ভেষজ ওষুধ ও টনিক। আর সজনে পাতা ‘সুপার ফুডের’ তালিকায় নিজের নাম লিখিয়ে সারা বিশ্বে আলোড়ন তৈরি করে ফেলেছে।

একজন জাপানিজ গবেষক আফ্রিকা থেকে সজনে পাতা এনে গবেষণা করে এই মিরাক্কেল শাক থেকে ‘মরিঙ্গা পাউডার’ তৈরি করে এর বহুবিধ গুণ প্রচার করেছিলেন। সজনে গাছকে তিনি অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য উদ্ভিদ হিসেবে জানতেন। কিন্তু বাংলাদেশে ‘ড্রামস্টিক ট্রি’বা সজনে গাছ এত সহজলভ্য এবং এতটাই সুপরিচিত যে তিনি সেটা জানতে পেরে ভীষণ অবাক হয়েছিলেন। সজনে পাতা নামক ‘সুপার ফুডের’প্রতি আমাদের দেশের মানুষের অজ্ঞতা ও অবহেলা তাকে খুবই বিস্মিত করে তুলেছিল।

সজনে পাতা নামক ‘সুপার ফুডের’ প্রচার ও এর চাহিদার দিকে লক্ষ্য করে আজকাল সজনে বাগান তৈরির হিড়িক পড়ে গেছে। সজনে বাগান কেন্দ্রিক কারখানা গড়ে উঠেছে। সেসব কারখনায় মহিলা শ্রমিক সহ অনেকের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে সজনে পাতার পাউডার—এর ব্যাপক গুণকীর্তন চালু থাকায় বাজারে এর চাহিদা বেড়ে গেছে বহুগুণ।

প্রচারে প্রসার—এই তত্ত্ব যেন সজনে পাতাকে আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। সাইবার জগতের এই বিরাট সাড়া আমাদের সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যে তেমন কোন জাগরণ তৈরি করেছে কবলে মনে হচ্ছে না। আগেকার দিনে পাট পাতা ও সজনে পাতা দিয়ে নানাব্যঞ্জন রান্না করা হতো। পরিবারের সদস্যরা সেগুলো মজা করে খেতেন। তাই তখন এত রোগ—বালাই হতো না। এটি মূলত: একটি সাধারণ প্রচলণ অথচ গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ।

আজকাল মানুষ কৃত্রিম খাবারের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। বিভিন্ন ক্ষতিকর কেমিক্যাল ও বাহারি রং মেশানো খাবার পাতে না হলে আধুনিক মানুষের মন ভরে না। আধুনিক মশলার মধ্যে আসলে কি কি উপাদান মিশ্রিত রয়েছে তা যাচাই করা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। ভেজালের এই যুগে বিএসটিআই—এর প্রতীক লাগানো কতকিছুই হরদম জব্দ করে জরিমানা করা হচ্ছে।

অন্যদিকে উন্নয়নের অতিপ্রচার দেখে বিদেশিরা বাংলাদেশের দিকে ঘন ঘন তাকানো শুরু করেছে। তবে ঋণ ও ক্ষমতা লাভের জন্য তাদের দিকে আমরা আরো বেশি করে তাকিয়ে থাকি। এই পরনির্ভরশীলতা আমাদেরকে আরো বেশি পঙ্গু করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এবছর দেশের একদিকে দারুণ খরা, অন্যদিকে হঠাৎ বন্যা শুরু হয়েছে। কেউ বষার্কালে গভীর নলকূপের পানিতে সেচ দিয়ে রোপা আমন ধানের চারা লাগাচ্ছে আবার কারো বীজতলা তলিয়ে গেছে ঢলের পানিতে। এরই মাঝে এডিস মশা দেশের সব জেলায় সংক্রমণ ছড়িয়ে দেয়ায় সেপ্টেম্বর ০৫, ২০২৩ পর্যন্ত রেকর্ড সংখ্যাক ৬৫৭ জন মারা গেছেন। মফস্বলের হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসার সুযোগ না পেয়ে জীবন বাঁচাতে হন্যে হয়ে ছুটে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকার দিকে।

ঢাকায় গিয়ে হাসপাতালের বেডে জায়গা না পেয়ে মেঝে, বারান্দায়, ওয়েটিং রুমে মাদুর পেতে রোগী নিয়ে শুয়ে আছেন। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে যখন কোন জটিল রোগীর জন্য জরুরি ভিত্তিতে রক্তের প্রয়োজন তখন। মফস্বল থেকে আসা অধিকাংশ রোগীর আত্মীয়—স্বজন রক্ত দেয়ার ব্যাপারে সজাগ নন। রক্ত দেয়ার কথা শুনলেই তারা অনেকে আঁৎকে উঠেন। কেউ কেউ কান্নাকাটি শুরু করে দেন। এছাড়া বাইরে থেকে রক্ত সংগ্রহ, খরচ বহন ইত্যাদির জন্য তারা মোটেও প্রস্তুত নন।

এরই মাঝে রাজপথের একটি লেনে একটি বিরোধী রাজনৈতিক দলের মিছিলের লম্বা লাইন যখন ৪—৫ মাইল লম্বা হচ্ছে তখন পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি নিয়ে সরকারি দলও অপর দিকের বাকি লেনটি দখল করে মিছিল শুরু করে দিচ্ছে। ডেঙ্গুর হটস্পট রাজধানী ঢাকায় সারা দেশ থেকে ভাড়ায় মানুষ ডেকে এনে সম্মেলন ও মিছিল করাচ্ছে সরকারি দলও! এর ফলে প্রতিটি জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে ভয়াবহ ডেঙ্গু।

অন্যদিকে দেশে কেউ যেন কিছকেইু ঠিকমতো পাত্তা দিতে চাচ্ছে না। স্থানীয় জনগণের উপলব্ধিকে পাত্তা না দেয়া আমাদের দেশজ উন্নয়ন অবনমনের প্রধান কারণ বা অন্তরায় হিসেবে আবিভূর্ত হয়েছে। এদেশে কেউ তার নিজের দোষ সহজে স্বীকার করতে অভ্যস্ত নয়। তাই মিথ্যা-জালিয়াতির বেসাতিতে বিপদ বেড়েই চলেছে চারদিকে। সেজন্য অতিদ্রুত পারস্পরিক দোষারোপ ও পরনির্ভরশীলতা পরিহার করে দেশজ তথ্য-উপাত্ত ভিত্তিক গবেষণা করে, দেশজ সম্পদ রক্ষা করতে হবে।

আমরা যখন ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞা মেনে ঘুমিয়ে থাকি তখন অন্যেরা এসে ধরে উজাড় করে দেয়। আমরা যখন জাল ফেলি তখন নদী মাছশূন্য। বিদেশি লুটেরাদের হাতে উজাড় হচ্ছে জাতীয় মৎস্য সম্পদ। ইলিশ মাছের শুধু এক ভিডিও সব ইউটিউবারদের ‘তুমি সুড়ংঙ্গে’ ছড়াছড়ি। অথচ ইলিশের এই ভরা মৌসুমে কাঁচাবাজার ইলিশ শূন্য। বাড়ছে অবৈধ রোহিঙ্গা অভিবাসীদের ফুলে ফেঁপে উঠা সংখ্যার মতো বিষফোঁড়া। মিয়ানমার থেকে পাচার হয়ে ইয়াবা আসা বন্ধ হলে শুধু কক্সবাজার জেলাতেই দশ হাজার মানুষ বেকার হয়ে যাবে বলে ভাষ্য দেন কোন বিচারক!

খুব দ্রুত আধুনিক হবার জন্য শোলকা পেলকার মতো দেশজ খাবার ত্যাগ করে যখন দুর্বল শরীর নিয়ে কালাতিপাত করছি ঠিক তখন জাপানিজ গবেষকের উদ্ভাবিত সজনে পাতার পাউডার আমাদেরকে নবজীবন দান করতে পারবে বলে সেই আশায় সেদিকে হন্যে হয়ে দৌড়াচ্ছি। তবে শোলকা—পেলকার মতো দেশজ খাবার গ্রহণ করে মেরুদণ্ড সোজা করে চলতে শুরু না করলে বৈশ্বিক উজানের হঠাৎ ঢল এসে সাতকানিয়ার নতুন রেললাইন বাঁকা করে দেয়ার মতো ঘটনা আরো ঘন ঘন জেঁকে বসতে থাকবে বৈ—কি?

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

 

;