হিটলার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ইসলাম



ফজল হাসান

  • Font increase
  • Font Decrease

এ কথা সর্বজনস্বীকৃত যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্যর্থ নায়ক হিটলার। ভাগ্যিস, হিটলার ব্যর্থ হয়েছিলেন এবং তিনি অভিসন্ধি কামাল করতে পারেননি। নইলে তামাম দুনিয়ায় ইহুদি নিধনের পরে মুসলমানদের যে কী হতো, তা বলা মুশকিল। তবে মন্দ হওয়ার আশঙ্কাই ছিল বেশি। সে বিষয়ে আলোচনার আগে ইসলাম এবং মুসলমান সম্পর্কে হিটলারের মনোভাব এবং অভিসন্ধি কী ও কেমন ছিল, তা নিয়ে খানিকটা উল্লেখ করা প্রয়োজন।

শুরুতেই ইসলাম এবং মুসলমান সম্পর্কে হিটলারের একটা প্রচলিত মন্তব্য বিশেষভাবে উল্লেখ করছি। তিনি বলেছিলেন, ‘একমাত্র ধর্ম হিসাবে আমি ইসলামকে সম্মান করি। একমাত্র পয়গম্বর যাকে আমি শ্রদ্ধা করি এবং যার সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করি, তিনি নবী মোহাম্মদ’ (সাঃ)। হিটলারের এই মন্তব্যের আড়ালে তিনটি প্রশ্ন নিহিত আছে। প্রথমত হিটলারের উপরোক্ত মন্তব্য কি সত্যি? দ্বিতীয়ত তিনি যা বলেছেন (আদৌ যদি বলে থকেন), তা কি আসলেই বিশ্বাস করতেন? এবং তৃতীয়ত যুদ্ধের কৌশল এবং অধ্যুষিত দেশ থেকে, বিশেষ করে তুরস্ক, সৈন্যবাহিনীর সাহায্য ও সহযোগিতা পাওয়ার গোপন চক্রান্ত ছিল? তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই হিটলার এবং ইসলাম ও মুসলমান সম্পর্কে একটা প্রশ্ন চাউর হয়ে আছে। তা হলো—হিটলার কি ইসলাম দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন এবং ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি তার মনোভাব কেমন ছিল? মুসলমানদের সঙ্গে হিটলারের আঁতাত এবং হিটলারের সঙ্গে মুসলমানদের সহযোগিতার মূল কারণ জানতে হলে এক ধাপ পেছনে ফিরে যেতে হবে।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Aug/05/1533471381786.png
১৩তম এসএস ডিভিশনের এক সৈন্য ইসলাম ও ইহুদিবাদ বিষয়ক পুস্তিকা হাতে

নাৎসি বাহিনীর ‘ব্যাপক গণহত্যা’ (হল্যাকাস্ট) এবং ইসলাম ও মুসলমান প্রসঙ্গে দুটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথমত ‘ব্যাপক গণহত্যা’ চলার সময় মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল, এবং দ্বিতীয়ত যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে, এমনকি বর্তমান সময় পর্যন্ত, ‘ব্যাপক গণহত্যা’ সম্পর্কে মুসলমানদের ধারণা কী এবং কেমন আছে।

দু’খণ্ডে প্রকাশিত হিটলারের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ Mein Kampf পড়লে বোঝা যায় যে, আসলে শুরু থেকেই ইসলাম এবং মুসলমানের প্রতি তাঁর মনের ভেতর অন্যরকম অভিসন্ধি ছিল। যেমন (১) হিটলারের প্রয়োজন ছিল অটোম্যান (তুর্কি) শাসকের সর্বাঙ্গীন সহযোগিতা এবং তাদের কুখ্যাত সাঁজোয়া বাহিনীর সাহায্য, (২) হিটলার দুটি বিশেষ কারণে সৌদি রাজতন্ত্রকে প্রচণ্ডভাবে ঘৃণা করতেন। এগুলো ছিল—মিত্র বাহিনীর দেশগুলো সমস্ত তেল নিত সৌদি আরব থেকে এবং সৌদি আরব ছিল মিত্র বাহিনীর হাতের পুতুল, অর্থাৎ ‘পাপেট’। এছাড়া ইসলামের শক্ত ঘাঁটি হিসাবে সৌদি আরব স্বীকৃত, (৩) ইরাকের সাহায্য ও সহযোগিতার প্রয়োজন ছিল। তার প্রধান কারণ ছিল রাশিয়ার কাছাকাছি ইরাকি সীমান্তে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করা, (৪) হিটলার বিশ্বাস করতেন তিনি আর্য (ইন্দো-ইউরোপিয়ান) জাতির উত্তরসূরী, এবং (৫) হিটলারের শত্রু ছিল ইহুদি, যারা মুসলমানদেরও শত্রু। তাই এসব কারণে হয়তো তিনি তেল উৎপাদনকারী মুসলমান রাষ্ট্রের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। হিটলারের এসব অভিসন্ধি বাস্তবায়নের জন্য নাৎসি বাহিনী বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং কর্মসূচি নিয়েছিল। এখানে কিছু উদাহরণ তুলে ধরছি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে হিটলার তার সেনাপতিদের বলেছিলেন, ‘আমরা দূর-প্রাচ্যে (ফার ইস্ট) এবং আরবে গণ্ডগোল বাঁধিয়ে রাখব। আমরা নিজেদের মানুষ ভাবব এবং ওদেরকে মনে করব অর্ধেক উল্লুক (হাফ এপস্), যারা চাবুকের আঘাত পাওয়ার যোগ্য।’ হিটলারের এই মন্তব্যের পেছনে তাঁর নাক-উঁচু ভাব কাজ করেছে। তিনি এবং নাৎসি বাহিনীর সামরিক বাহিনীর সকল উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা মনে করতেন জার্মান হলো মানব বিবর্তনের শ্রেষ্ঠ জাতি। তাই তাদের নৈতিক কর্তব্য দুনিয়া থেকে অন্য ধর্মাম্বলীদের সমূলে নির্মূল করা।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Aug/05/1533471588322.jpg
মুফতি হাজি মোহাম্মেদ আল-হোসেইনি (বামে)

সন্দেহ নেই, সমগ্র মুসলিম জাহানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে প্রভাব পড়েছিল। জাপানি সৈন্যদের দক্ষিণপূর্ব এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকা, বলকান এলাকা এবং ক্রিমিয়া ও ককেশাস অঞ্চলে ইতালিয়ান ও জার্মান সামরিক বাহিনীর আগ্রাসী আক্রমণের জন্য মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলো প্রথম সারির যুদ্ধ-এলাকায় পরিণত হয়েছিল। এছাড়া একই সময়ে ব্রিটিশ, ফরাসি এবং ডাচ সাম্রাজ্য অথবা সোভিয়েত শাসিত দেশগুলোতে অগণিত মুসলমান যুদ্ধের আওতায় পড়ে। তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে বার্লিনের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং সামরিক বাহিনীর প্রধানরা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, তাদের জন্য রাজনৈতিক এবং কৌশলগত কারণে ইসলাম, তথা মুসলমানের সাহায্য এবং সহযোগিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পরবর্তীতে নাৎসি বাহিনী ব্রিটিশ রাজতন্ত্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইহুদিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার জন্য মুসলমান অধ্যুষিত দেশের সঙ্গে আঁতাত করে। এছাড়া মুসলমানদের মন জয় করার জন্য নাৎসি জার্মানরা বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন এবং কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। সেগুলোর মধ্যে বার্লিন থেকে শর্ট ওয়েভ রেডিওতে আরবি এবং ফারসি ভাষায় বিভিন্ন প্রচারণামূলক অনু্ষ্ঠান সম্প্রসারণ ছিল অন্যতম। তবে নাৎসি বাহিনীর প্রতি সহানুভূতি এবং সমর্থনের চেয়ে অধিকাংশ মুসলমানের ভেতর গড়ে উঠেছিল মূলত ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব। যাহোক, মুসলমানদের সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ করে নাৎসি বাহিনী দুটি আলাদা ডিভিশন তৈরি করেছিল। এগুলো ছিল আলবেনিয়ার মুসলমানদের নিয়ে স্ক্যান্ডারবার্গ ডিভিশন এবং বসনিয়ার মুসলমানদের নিয়ে হ্যানশার ডিভিশন। তবে চেচনিয়া থেকে উজবেকিস্তান পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক মুসলমান সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করেছিল। এসব মুসলমান সৈন্যরা স্তালিনগ্রাদ, ওয়ারশ, মিলান এবং বার্লিন রক্ষার জন্য নিয়োজিত ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে নাৎসি বাহিনী অনুধাবন করতে পেরেছিল যে, সোভিয়েত এবং বলকান এলাকার মুসলমান সৈন্যরা সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহী ছিল না। পরে নাৎসি বাহিনী হ্যানশার ডিভিশন বিলুপ্ত করে।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Aug/05/1533470053684.png
নাৎসি মুসলমানদের নিয়ে গঠিত হ্যানশার ডিভিশন প্রদর্শনকালে মুফতি আল-হোসেইনি

যুদ্ধকালীন জার্মান সরকার পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় বিপুল সংখ্যক মসজিদ এবং মাদ্রাসা পুনরায় নির্মাণের আদেশ জারি করে, যা সোভিয়েত সৈন্য বাহিনী ভেঙে ফেলেছিল। সেইসব এলাকার অনেক মুসলমানকে জার্মান সৈন্য বাহিনী নিজেদের দলে অন্তর্ভুক্ত করেছিল। এছাড়া মুসলমানেরা যাতে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে পালন করতে পারে, তার জন্য অনুকূল পরিবেশ এবং আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা, যেমন হালাল খাবার-দাবারের আয়োজন করা, সৃষ্টি করেছিল। কোরানশরিফ এবং ইসলামের অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে ‘জিহাদ’ হিসাবে ব্যবহার করে। এসব সুযোগ দেওয়ার যুক্তি হিসাবে নাৎসি বাহিনীর জেনারেল হাইনরিখ হিমলার বলেছিল, ‘ইসলামের বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই। তাদেরকে সহজে বেহেশতে পাওয়ার উপায় হিসাবে আমার দল উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়েছে। মুসলমান সৈনিকদের জন্য এটাই হলো বাস্তব এবং উত্তম পন্থা।’ এছাড়া ১৯৪২ সালে উত্তর আফ্রিকার মরুভূমিতে লিফলেট বিতরণ করে। সেখানে লেখা ছিল, ‘ইসলামের প্রধান শত্রু ইংরেজ, আমেরিকাবাসি, ইহুদি এবং তাদের মিত্ররা। যুদ্ধে জার্মান জিতবে, ইনশাআল্লাহ্।’

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Aug/05/1533469901177.jpg
হিটলারের সাথে নাৎসি বাহিনীর জেনারেল হাইনরিখ হিমলার (ডানে)

নাৎসি বাহিনীর আরেক পন্থা ছিল হিটলারের সঙ্গে জেরুজালেমের (আল কুদস্) তৎকালীন মুফতি হাজি মোহাম্মেদ আল-হোসেইনির মধ্য সরাসরি সাক্ষাৎ এবং আলোচনার ব্যবস্থা করা, যা ১৯৪১ সালের ২১ নভেম্বর ঘটেছিল [প্রচ্ছদ ছবিতে সেদিনের মিটিং]। সেই আলোচনার পরে মুফতি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, সমগ্র আরব জাতি জার্মানির বন্ধু। বিনিময়ে হিটলার অভয় দিয়েছিলেন, জার্মান সৈনিকেরা যখন ককেশাসের দক্ষিণাঞ্চল দখল করবে, তখন ব্রিটিশদের কবল থেকে আরবরা স্বাধীনতা অর্জন করবে। উল্লেখ্য, বসনিয়ার মুসলমানদের নিয়ে গঠিত সৈন্য বাহিনী গড়ার পেছনে মুফতি আল-হোসেইনির ভূমিকা ছিল সর্বাগ্রে। তবে মুফতির প্রধান কাজ ছিল নাৎসি বাহিনীর সঙ্গে সোভিয়েত এবং বলকান এলাকায় আরব মুসলমানদের সার্বিক সহযোগিতা নিশ্চিত করা। এসব প্রচারণার জন্য তিনি নাৎসি বাহিনীর রেডিও স্টেশন ব্যবহার করার অনুমতি পেয়েছিলেন। মুফতি আল-হোসেইনি ছাড়াও আরেকজন আরব রাজনীতিবিদ নাৎসি বাহিনীর মদদ যুগিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন অ্যাঙ্গলো-ইরাকি যুদ্ধের অন্যতম সমর নায়ক এবং পরবর্তীতে ইরাকের প্রধানমন্ত্রী রশীদ আলী আল-গিলানী। তিনি ব্রিটিশ-সমর্থিত আবদুল্লাহকে সেনা বিদ্রোহের মধ্যমে উৎখাত করে ক্ষমতা লাভ করেন। হিটলারকে পূর্ণ সমর্থন করে তিনি ১৯৪১ সালের ২৩ মে এক বিবৃতি প্রদান করেন এবং সেখনে তিনি বলেছেন, ‘ইংরেজদের বিরুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যে আরব স্বাধীনতা সংগ্রাম আমাদের স্বাভাবিক মৈত্রীবন্ধন।’ এসব ক্ষমতাসীন মুসলমান নেতারা নাৎসি বাহিনীর দর্শন ও রাজনৈতিক বিশ্বাসের ওপর ভরসা করে নিজেরা অলৌকিকভাবে লাভবান হয়েছিলেন। ‘বাথ পার্টি’ (কঠিনভাবে সেক্যুলার, কিন্তু উৎপত্তি হয়েছিল মুসলমান অধ্যুষিত পরিবেশে) উজ্জ্বল উদাহরণ। নাৎসিদের প্ররোচনায় এই ‘বাথ পার্টি’ আত্মপ্রকাশ করেছিল এবং কট্টর ইসলামিক মিলিট্যান্ট তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Aug/05/1533470343029.png
হিটলারের সাথে রশীদ আলী আল-গিলানী (ডানে)

উল্টোদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে উত্তর আফ্রিকা, ভারত এবং অখণ্ড সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে অনেক মুসলমান সৈনিক মিত্র শক্তির পক্ষে অংশগ্রহণ করেছিল। তারা বিভিন্ন রণক্ষেত্রে, বিশেষ করে এল-আলামিন, মন্টে ক্যাসিনো, ফ্রান্সের প্রভেন্স উপকূল এলাকা এবং স্তালিনগ্রাদে, অংশগ্রহণ করে ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করেছিলেন। এছাড়া মুসলমানরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে অনেক মুসলমান নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইহুদিদের জীবন বাঁচিয়েছিলেন। মিত্র বাহিনীকে সাহায্য এবং সহযোগিতা করার প্রসঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গুপ্তচর রানী হিসাবে সমগ্র বিশ্বে পরিচিত নূর ইনায়েত খানের কথা উল্লেখ না করলেই নয় । তিনি (মৃত্যু ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৪৪) ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত এবং টিপু সুলতানের বংশধর। নূর ইনায়েত খান ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে অধিকৃত ফ্রান্সে রেডিও অপারেটর হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন। একসময় জার্মান গেস্টাপো তাঁকে অনুসরণ করে। সেই সময় ফরাসি সেনা কর্মকর্তারা তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে। অবশেষে গুপ্তচর বৃত্তির দায়ে তিনি নাৎসি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। পরবর্তীতে তাঁর ফাঁসি হয়।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Aug/05/1533470548273.jpeg
টিপু সুলতানের বংশধর নূর ইনায়েত খানকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলায় নাৎসি বাহিনী

যদিও নাৎসি জার্মানির শাসনামলে (১৯৩৩-১৯৪৫) আরব বিশ্বের নেতাদের সঙ্গে নাৎসিদের সম্পর্ক ছিল অবজ্ঞা, অপপ্রচার, সহযোগিতা এবং অনেক সময় আরবদের তুলনায় নিজেদের উপরে তোলার প্রবণতা, কিন্তু এসব অম্ল-মধুর সম্পর্ক থাকার পরেও দুই মেরুর মধ্যে রাজনৈতিক এবং সামরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।  তবে অনেক পণ্ডিত এবং ইতিহাসবিদ মনে করেন, হিটলার ইসলাম ও মুসলমানদের তুরুপের তাস হিসাবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। আবার অন্যদিকে অনেকে আরেক ধাপ এগিয়ে আছে। তারা মনে করে, হিটলার পরাজিত না হলে ইহুদিদের খতম করে মুসলমানদের ধরতেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার পরাজিত না হলে কী হতো, এখন তা এখন হলফ করে বলা মুশকিল। তবে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত বিচার-বিশ্লেষণ করে মোটামুটি অনুমান করা যেতে পারে। হিটলারের অভিসন্ধির সত্যিটা কখনোই থলের বিড়াল হয়ে বেরিয়ে আসবে না। বরং অধরাই থেকে যাবে।

[লেখকঅস্ট্রেলিয়ার অভিবাসি এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তা]

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;