চন্দরপলের ভাই
একটা সাদা জামা আর কালো প্যান্ট; জামাটা ‘ইন’ করা। পায়ে আবার চকচকে একজোড়া জুতো। চোখে কুচকুচে কালো অন্ধ লোকেদের মতো একজোড়া চশমা।
সাজ পোশাকে নিজেকে ভদ্দরলোক করে তোলার চেষ্টায় কোনো ত্রুটি নেই। কিন্তু কলারে চোখ দিলেই কালসিটে দাগ দেখা যায়। সস্তা সাবান দিয়ে ঘসে ঘসে ঘাম আর ময়লার দাগ তোলার চেষ্টা হয়েছে; কাজ হয়নি।
বসার জায়গা দেখিয়ে দেওয়ার পরও ভদ্রলোক কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে রইলেন। আমার সামনে বসা ঠিক হবে কিনা, বুঝে উঠতে পারছেন না।
একটু ধমকের সুরেই বললাম, ‘বসুন না!’
এবার গদোগদো হয়ে বসে পড়লেন; সোফার পেছনে জামা লেগে যাওয়ার ভয়ে মনে হয় শিরদাড়া একেবারে খাড়া করে রোবটের মতো বসে রইলেন।
পাশের বইয়ের আলমারির দিকে তাকিয়ে আবার শুরু করলেন, “দাদা, আপনি কত পড়েন! আপনি তো পণ্ডিত মানুষ। আপনাকে একবার দেখার জন্য...”
এই ধরনের প্যানপ্যানানি শোনাটা খুব নতুন অভিজ্ঞতা নয়। তবে বাসায় বয়ে এসে সাধারণত এমন কেউ করে না। এই লোককেও বাসায় আনার এক বিন্দু ইচ্ছে ছিল না আমার। কিন্তু নিতান্ত বাধ্য হয়ে বাসায় আসার অনুমতি দিতে হয়েছে।
এই অনুমতিটা দেওয়ার কারণ হলেন সাবের মামুন।
মামুন ভাই আমার গুরুস্থানীয়। ঠিক একসাথে কখনো কাজ করিনি। কিন্তু সাংবাদিকতায় উনাকে আমি মান্য করেই চলি। উনার কোনো অনুরোধকে ‘না’ বলি না। সেই মামুন ভাই ফোন করে বললেন, “তোমার সাথে রাম চন্দ্র বলে একটা লোক দেখা করবে। ওনার সম্ভবত ইন্টারেস্টিং একটা গল্প আছে। শুনো।”
আজকাল গল্পের পেছনে আমি খুব একটা ছুটি না। গল্প এখন আমার হার্ডডিস্কে অনেক আছে। সেগুলো সাজিয়ে লিখলেই পয়সা আসে। গল্পের পয়সায় আমার ইদানীং জীবনও আগের চেয়ে বেশ বদলে গেছে। এখন সময়ের খুব দাম দিতে হয়। একঘণ্টা লিখলে কয়েক হাজার টাকার ব্যবস্থা হয়ে যায়। ফলে কাউকে ফালতু সময় দেওয়াটা কঠিন।
তারপরও মামুন ভাইয়ের অনুরোধ বলে লোকটাকে অফিসের ঠিকানা দিয়ে বললাম, “আসেন একদিন কথা বলি।”
কিন্তু উনারই ভাগ্য খারাপ, নাকি আমার ভাগ্য খারাপ; সেই সময়টায় কোমরের পুরোনো ব্যাথাটা আবার চাগাড় দিয়ে উঠল। এই ব্যাথাটা আমাকে অনেককাল ধরে ভোগাচ্ছে। ডাক্তাররা বলে পিএলডি। সোজা কথায় মেরুদণ্ডের ডিস্ক জায়গা থেকে সরে গেছে। ঢাকা থেকে দিল্লি; অনেক জায়গায় ট্রিটমেন্ট করিয়েছি। খুব লাভ হয়নি। মাঝে মাঝে ব্যাথাটা ফিরে এসে একেবারে পঙ্গু করে ফেলে। বিছানা থেকে ওঠা কঠিন হয়। এবার অবস্থা তত খারাপ না হলেও অফিস করতে পারছি না।
ঠিক এই সময় লোকটা ফোন দিল, “দাদা, আমি আপনার অফিসে এসেছি।” মেজাজটা এমন খারাপ হলো। বললাম, “এখন তো দেখা পাবেন না। আমি অসুস্থ বাসায় বসে আছি।” শিউরে ওঠার মতো করে বলল, “বলেন কী! তাহলে আপনাকে দেখতে আসি?”
“নাহ। সে দরকার নেই। আমি সুস্থ হয়ে আপনাকে ফোন দেব।”
সে কিছুতেই ছাড়ল না। সাতক্ষীরা থেকে শুধু নাকি আমার সাথে দেখা করবে বলেই এসেছে। হোটেলে বেশি দিন থাকা সমস্যা। এসব বলে বাসার ঠিকানা নিল।
লোকটার ধান্দা ঠিক বুঝতে পারছি না। শুধু নিজের গল্প শোনানোর জন্য এত আগ্রহের কারণ বোঝা গেল না। সামনে এসে বসার পর থেকে তার কোনো গল্প আছে বলেই মনে হচ্ছে না। শুধু আমাকে ইমপ্রেস করার জন্য তৈলাক্ত কথাবার্তা বলে চলেছে।
একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, “আপনার কী যেন বলার আছে, বলছিলেন? কী একটা গল্প...”
“দাদা, আপনাকে আর কী গল্প বলব? আপনি তো গল্পের রাজা।”
“সে থাক। আপনি বলেন, কী বলতে চান।”
“আসলে আমার একটা পরিচয় ছিল।”
“কী পরিচয়?”
এবার বিনয়ে আরও গলে গিয়ে বলল, “আজ্ঞে আমার নাম রাম চন্দ্র পাল। আমি চন্দরপলের ভাই।”
“কার ভাই!”—প্রথমটা বুঝতে পারলাম না, উনি কী বলতে চান।
“আজ্ঞে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটসম্যান শিবনারায়ন চন্দরপলের ভাই।”
পিঠের ভেতর ব্যথায় কট কট করছে। মেজাজটা এমন খারাপ হলো। মামুন ভাই এই মাল পাঠিয়েছে আমার কাছে। নামের শেষে পাল আছে বলে একটা গল্প ফেঁদে বসেছে। তারপরও বিরক্তিটা প্রকাশ না করেই বললাম, “কীরকম ভাই? আপনার জন্ম কী গায়নাতে?”
“না, না, দাদা। আমি খাটি সাতক্ষীরার ছেলে। উনি আমার জ্ঞাতি ভাই।”
যাক, একেবারে আপন ভাই বলে দাবি করেনি। ব্যথাটা একটু কম মনে হচ্ছে। গল্পটা শোনা যাক। পরে কাজে লাগতে পারে। বললাম, “কিভাবে জানলেন, উনি আপনার ভাই?”
“আজ্ঞে, আমাদের দুজনের ঠাকুরদাদার বাবা একজন। ওনার ঠাকুরদাদা সাতক্ষীরা থেকে কলকাতা হয়ে গায়নায় চলে গেছেন। আমার ঠাকুরদার তিন ছেলে। আমার বাবা ও ছোট কাকা সাতক্ষীরায়। আর এক কাকা কলকাতায়। কলকাতার কাকাদের সাথে ওনাদের যোগাযোগ ছিল।”
“আপনি কখনো যোগাযোগের চেষ্টা করেননি?”
“আজ্ঞে করেছি। উনি একবার ঢাকায় খেলতে এসেছিলেন। আমি দেখা করার চেষ্টা করেছি। পারিনি।”
“তো এখন কী চান?”
“উনার সাথে যোগাযোগ করতে চাই।”
“আপনার কলকাতার কাকাকে বলেন, যোগাযোগ করিয়ে দেবে।”
এবার লোকটা একটু মাথাটা নিচু করে বলল, “ওই কাকা আর বেঁচে নেই। কাকাতো ভাইয়েদের ঠিকানা জানি না।”
একটু খেলাতে ইচ্ছে করল লোকটাকে, “তো চন্দরপলের সাথে যোগাযোগ করে আপনার লাভ কী? অর্থ সাহায্য চান?”
জিভ কেটে রামবাবু বললেন, “না, না। আমার ছেলেটাকে উনার সাথে একটু দেখা করাতাম। ঠিক উনার মতো ব্যাট করে।”
“ও বাবা। আপনার ছেলে আবার ক্রিকেটও খেলে?”
লোকটা আমার কথার শ্লেষটা ধরতে পারল না। বলল, “ক্রিকেট আমিও খেলতাম। আমি ফাস্ট বোলার ছিলাম। সাতক্ষীরা জেলা দলেও খেলেছি। তবে আমার ছেলে অনেক বড় ব্যাটসম্যান হবে।”
“কত বয়স তার?”
“এই ১৭ হলো।”
“তো আপনার ছেলেকে বড় ক্রিকেটার বানাতে চন্দরপল লাগবে কেন? ঢাকায় কোনো ক্লাবে দেন।”
“ঢাকায় এনে খেলানোর সামর্থ্য আমার নেই, দাদা।”
এতক্ষণে সেই আসল কথায় এলো। মানে, চন্দরপলের কাছ থেকে টাকা খসাবে। এসব লোক আত্মীয়তার কথা শুনলে কিছু দিতেও পারে। এবার বিরক্ত লাগছে। বললাম, “ঠিক আছে। আমার সাথে তো চন্দরপলের যোগাযোগ নেই। কখনো মেইল অ্যাড্রেস বের করতে পারলে আপনাকে জানাব।”
লোকটা খুব খুশি। বলল, “আমার মোবাইল নম্বর রেখে যাই?”
“যান।”
ব্যাপারটা এখানেই শেষ হতে পারত। অন্তত আমি ভেবেছিলাম, এখানে শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু এসব গল্পের কোত্থেকে একটা লেজ বের হয়ে যায়। সেই লেজটা বের হলো বিপিএলের সময়। চট্টগ্রামের হয়ে খেলতে এলো চন্দরপল। আমার পত্রিকা থেকে অ্যাসাইনমেন্ট হলো, চন্দরপলের একটা ইন্টারভিউ করা।
চট্টগ্রামের মালিকপক্ষের সাথে ভালো সম্পর্ক ছিল। সেই সুবাদে সময়ও পেয়ে গেলাম। শেরাটন হোটেলে গিয়ে চন্দরপলকে ধরলাম।
উপমহাদেশীয় বংশোদ্ভূত বলে কিনা, একটু বাড়তি সময় দিল। তার ব্যাটিং স্ট্যান্স, লম্বা সময় ধরে ক্রিকেট চালানো, লারার সাথে জুটি, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেট এবং ছেলে ত্যাগনারায়নকে নিয়ে লম্বা ইন্টারভিউ হলো। শেষ দিকে অবশ্য একটু তাড়া দিচ্ছিল। তারপরও ইন্টারভিউ ভালো হলো।
ধন্যবাদ দিয়ে ঠিক ওঠার সময় মনে পড়ল রামবাবুর কথা। কথার ছলে ব্যাপারটা তুললাম, “শিব, বাংলাদেশে কী তোমাদের কোনো রিলেটিভ আছে?”
“তুমি জানলে কী করে?”
“এর মাঝে আমার কাছে একজন এসেছিল।”
চন্দরপল ট্রেনিংয়ের কথা ভুলে গেল। আবার সোফায় বসে পড়ল, “দ্যাখো, আমি জানতাম, আমার পূর্বপুরুষ কলকাতা থেকে গেছে। কিন্তু ইদানীং আমার এক রিলেটিভ বলল, আমাদের আদি বাড়ি নাকি বাংলাদেশে। এখন এখানে কি আমাদের কেউ আছে?”
“তাহলে হতে পারে, ভদ্রলোক সত্যি বলেছে। তুমি যোগাযোগ করতে চাও?”
“চাই। তুমি পারলে একটু দেখা করার ব্যবস্থা করো।”
এতদিন ব্যাপারটাকে পাত্তা দিইনি। এবার পাত্তা দিতে হলো। চন্দরপল লিজেন্ডারি ব্যাটসম্যান। তার অনুরোধ তো ফেলা যায় না। কিন্তু সমস্যা হলো, সেই রামবাবুকে খুঁজে পাব কোথায়?
মামুন ভাইকে ফোন দিলাম; উনি বললেন, কোনো নম্বর উনার কাছে নেই। বাসায় গিয়ে খুঁজলাম; পেলাম না। বিপিএল শেষ হওয়ার দুদিন আগে চন্দরপলই ফোন করল, “তুমি কি আমার ওই রিলেটিভকে পেয়েছিলে?”
“এখনো পাইনি। তবে চেষ্টা করছি।”
চন্দরপলের ভাগ্য বলতে হবে। ঠিক সেদিন বিকেলে একটা ফোন এলো। একটা ছেলে ফোন দিয়ে বলল, “স্যার, আমার নাম শিবু পাল। আপনার সাথে একটু দেখা করতে চাই।”
“কেন বলেন তো?”
“আজ্ঞে, আমার বাবা রাম চন্দ পাল। ওই যে...”
“বুঝতে পেরেছি, বুঝতে পেরেছি। আপনি কোথায় বলেন।”
“আজ্ঞে, আমি তো বিসিবির অ্যাকাডেমি মাঠে প্র্যাকটিস করি। এবার অনুর্ধ্ব-১৮ দলে ডাক পেয়েছি।”
“কাল সকালে থাকবেন ওখানে?”
“জ্বি, থাকব।”
“থাকেন।”
চন্দরপলকে ফোন দিয়ে বললাম। ওদেরও সকালে ঢাকায় প্র্যাকটিস। সেও খুব খুশি। সকাল সকাল আমার ফটোগ্রাফারকে নিয়ে পৌঁছে গেলাম মাঠে—ভালো একটা স্টোরি হবে। দুই চন্দরপলের সাক্ষাত।
মাঠে গিয়ে দেখি চন্দরপল একটা ছেলের সাথে কথা বলছে। আমাকে দেখে সে নিজেই হাত তুলে ডাকল। কাছে যেতে বলল, “এই যে, আমার ভাইয়ের ছেলে শিবু। তুমি আসার আগে দেখা হয়ে গেল।”
নাটকটা দেখতে পেলাম না। তারপরও স্টোরি জমবে। দুজনের সাথে কথাবার্তা বলে বেশ দাঁড়াল গল্পটা। শিবুকে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার বাবা কোথায়? এলে দেখা করতে পারতেন।”
শিবু মাথা নিচু করে বলল, “বাবা নেই। গত বছর হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছেন।”
চন্দরপলও আফসোস করল। ভাইয়ের সাথে দেখা হলো না। বেশ মধুরেন সমাপয়েত হলো।
রাতে স্টোরিটা শেষ করে জমা দেব। ঠিক তখনই শিবুর ফোন, “দাদা, আপনি কী আমাদের নিয়ে লিখে ফেলেছেন?”
“হ্যাঁ। কাল ছাপা হবে তো।”
“দাদা, লেখাটা দিয়েন না।”
“কেন বলো তো?”
“দাদা, চন্দরপল আমাদের কেউ হয় না।”
“মানে?”
“মানে, দাদা এটা বাবার একটা চাল ছিল। সে আমাদের পাল পদবী ব্যবহার করে চন্দরপলের কাছে পৌঁছাতে চেয়েছিল।”
“বলো কী! এটা তো প্রতারণা।”
“হ্যাঁ। তাই গল্পটা ছাপবেন না।”
খানিকটা সময় ঝিম মেরে বসে রইলাম। তারপর মনে হলো, চন্দরপলকে এটা জানানো দরকার। ফোন করলাম। ও-ই আগে বলল, “আমি জানি, তুমি কী বলবে।”
“তুমি কী করে জানলে?”
“শিবু আমাকে সব খুলে বলেছে।”
“যাক। এই ছেলেটার ওপর রাগ রেখো না।”
“নাহ। ওর ওপর রাগ করব কেন? আমি তো ওকে গায়নায় নিয়ে যাব ট্রেনিং করাতে।”
“বলো কী? কেন? ও তো তোমার কেউ না।”
“নিশ্চয়ই ও আমার কিছু হয়।”
“কিভাবে? আবার কী বলছো?”
“দ্যাখো, ছেলেটাকে ওর বাবা কী বলেছে, আমি জানি না। তবে আমি নিশ্চিত, ও আমার আত্মীয়।”
“কিভাবে নিশ্চিত হলে।”
“স্ট্যান্স দেখে। ওই স্ট্যান্স আমাদের বংশের কারো ছাড়া হতেই পারে না।”