মৃত পত্র
লাইব্রেরির তালা খোলা হয়নি বহুকাল। ঢোকার আগে মরচে ধরা তালাটা ভেঙে ফেলতে হয়েছে। জেলা প্রশাসনকে এই সম্পত্তি ব্যবহারের জন্য হস্তান্তর করা হলেও বিগত ডিসিদের কেউই এই ভাঙা জমিদার বাড়ি ব্যবহারের ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
সে নিজে আগ বাড়িয়ে বহুবার মনে করিয়ে দিয়েছে; কাজ হয়নি কোনো। তারপর থেকে সে একা একাই আসে এখানে।
কালের কামড়ে ঝরঝরে হয়ে পড়া একদার কাচারিঘরটার বারান্দায় ঝুম ধরে বসে থাকে। আর বালিয়াটির ছোট জমিদার বাবু নবাকান্ত রায়কে দেখে, কখনো দহলিজে, কখনো কাছারিঘরের বারান্দায়, কিংবা কখনো বাঁধানো দিঘির পৈঠায়, গম্ভীর হয়ে বসে আছে। কথা হয় না কোনো তাদের। কথা হওয়ার জোও নেই। মৃতেরা জীবিতের সঙ্গে কথা বলে না। আর সেও এ ব্যাপারে নিশ্চিত না যে, জমিদার পুত্র নবাকান্তকে সে সত্যিই দেখে, না সবই সে কল্পনায় বানিয়ে নেয়। তবে একটা ব্যাপার বানানো না। একদম না। কেউ বিশ্বাস করুক আর নাই করুক, এটা সত্যি; জমিদার নবাকান্তের জন্য সে এ বাড়ি আসে না। সে আসে শুধু একটা আওয়াজের টানে। কখনো এ আওয়াজ শুধুই নূপুরের, আবার কখনো তা চুড়ির মিহি রিনিঝিনি।
অদ্ভুত সচল এ আওয়াজ, বেশিরভাগ সময়ই আসে ভিতর বাড়ি থেকে। প্রথমে। তারপর তা বাড়ির বিভিন্ন দিক থেকে আসতে শুরু করে। যেন মনে হয় চঞ্চল ত্রস্ত পায়ে কেউ ছোটাছুটি করছে পুরো বাড়িময়।
সে কাছারিঘর সংলগ্ন পুরনো লাইব্রেরিঘরটার পৈঠার ধাপে বসে থাকে, উৎকর্ণ হয়ে। ক্ষণ গুনে, কখন আসবে সে!
প্রথম যেদিন এ ঘটনাটা ঘটল, প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিল সে। এবং ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে বাড়ি ফিরে এসেই জ্বরে পড়ল সে। উথালপাথাল জ্বর। চার-পাঁচ দিন পর জ্বর সারল।
তারপর হাঁটতে শুরু করার পর, আবার সে কোন অদৃশ্য সুতোর টানে পায়ে পায়ে এসে হাজির হয়ে গেল জমিদার বাড়ি।
তখন সে নিজেও বিস্ময় নিয়ে ভাবে; এই আকর্ষণ কিসের! কিসের এই অমোঘ টান! নেশার মতো! তার ব্যাখ্যাতীত।
আর কোনো ভয়ডর নেই তার। জমিদার পুত্র নবাকান্ত রায় তাকে দেখে কি দেখে না, এসব ভেবে আর বিচলিত হয় না সে। আর নূপুরের নিক্বণও এখন আর তাকে চমকে দিয়েই হারিয়ে যায় না, পালিয়ে যায় না নিমেষেই, বরং তার চারপাশ দিয়েই ঝুমুর ঝুমুর শব্দ তুলে নিশঙ্ক হেঁটে যায় সে, কোন অশরীরী। কখনো কখনো নিঃশ্বাস ফেলার মতো তার একেবারে কানের কাছে এসেও খিলখিল করে হাসে সে। তার হাসি প্রতিধ্বনিত হয় নীরব জমিদার বাড়ির জনহীন মাঠ, দহলিজে। কিন্তু শরীর নিয়ে ওই নিক্কণী কখনোই অবয়ব পায় না। সে আশায় থাকে। শুধু আশায় আশায়ই অপেক্ষা তার। নবাকান্তের মতো এও হয়তো একদিন শরীর ধারণ করে তার সামনে মানুষ রূপে এসে দাঁড়াবে! চমকে দেবে তাকে।
নতুন ডিসিকে অনেক বলেকয়েই তবে, লাইব্রেরিঘরের বইপত্রগুলো পরখ করে দেখার অনুমতি পেয়েছে সে। মায়, ঠিক হয়েছে ভালো মূল্যবান কোনো সংগ্ৰহ তার চোখে পড়লে যেন জানায়। প্রয়োজনে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেবে জেলা প্রশাসন।
দুরু দুরু বুকে ধূলিধূসর লাইব্রেরির ভেতরে ঢোকে সে। আর তারপর থেকেই, দুনিয়া আরেক দফা ওলটপালট হয়ে যায় তার। প্রতিদিন নিজের মধ্যে আত্মস্থ, ভূতগ্ৰস্তের মতো সে ফিরে ফিরে যায়। সব নাওয়াখাওয়া ভুলে, নিত্যদিনের কোনো কিছুই আর তার নিয়মে থাকে না।
এক রাতে, মোটা জীর্ণ এক বইয়ের ভেতর থেকে টুক করে তার পায়ের কাছে গড়িয়ে পড়ল এক টুকরো কাগজ। ঝুঁকে কাগজটা তুলে নিয়ে সে দেখল, একটা চিঠি। পুরনো, তুলট কাগজের মতো কোনো কাগজে লেখা কারো চিঠি। আসল রঙ হারিয়ে কবেই বিবর্ণ, হলুদ।
কত পুরনো? নবাকান্তের সময়ের? না আরো আগের?
গোটা গোটা অক্ষর! কোনো মেয়ের হাতের লেখা বুঝি! ঠাহর করে সে। চিঠির একেবারে নিচের দিকে আলতা দিয়ে প্রায় অস্পষ্ট টিপসইয়ের মতো একটা ছাপ। কোন আঙুলের বোঝার উপায় নেই। লাল আলতার রঙ বহু আগেই শুকিয়ে রক্তের মতো কালচে হয়ে গেছে। অবশ্য আলতাই কিনা তাই বা নিশ্চিত করে বলে কিভাবে!
দিন যায়। লাইব্রেরির ধুলোমাখা তাকে, নানা বইয়ের ভাঁজে ভাঁজে আরো চিঠি খুঁজে পেতে শুরু করে সে। পুরনো হলদে খামে ভরা চিঠি। কোনোদিন তা পোস্ট করা হয়নি প্রাপককে। লেখা হয়েছে কিন্তু প্রাপকের কাছে পৌঁছায়নি কখনোই।
যত্ন করে চিঠিগুলো বাড়ি নিয়ে এলো। কোনো এক নারীর আবেগমথিত চিঠি তার দয়িতকে লেখা। এ চিঠি নিয়ে কী করবে সে! ভেবে পেল না।
এ চিঠির জন্য এখন আর কেউ তো অপেক্ষা করে নেই, এসব চিঠির মালিক বা যাকে উদ্দেশ্য করে লেখা, দুজনের কেউই আর বেঁচে নেই। কোনো ঠিকানাতেও এ চিঠি আর পাঠানোর নয়!
এসব এখন মৃত চিঠি।
চিঠিগুলো পড়া শুরু করেই চমকাল সে, ভীষণরকম। চিঠি যেন কথা বলছে তার সঙ্গে। মনে হলো, প্রতিটা চিঠিই অসম্ভব জীবন্ত।
চিঠিগুলো আর লাইব্রেরিতে ফিরিয়ে নিয়ে গেল না সে, আবার অপ্রয়োজনীয় বিবেচনায় ছিঁড়ে নষ্টও করল না।
বরং প্রত্যেক রাতে একটা করে চিঠি খামে ভরে, গায়ে নতুন ডাকটিকিট লাগিয়ে অফিসে যাওয়ার পথে ডাকবাক্সে ফেলে দিয়ে যায়।
এরপর প্রতিদিন ডাকপিয়ন তার জন্য চিঠি নিয়ে আসে!