অন বেয়িং অ্যা রাইটার



ভি এস নাইপল

  • Font increase
  • Font Decrease

অনুবাদ আফসানা বেগম

সত্যিই জানি না কী করে আমি লেখক হয়ে উঠলাম। এই পেশায় অগ্রগতির পথে নির্দিষ্ট কিছু দিন-তারিখ আমি উল্লেখ করতে পারি বটে। কিন্তু তারপরেও পুরো বিষয়টি ধোঁয়া ধোঁয়াই রয়ে যাবে। কারণ প্রক্রিয়াটি রহস্যময়, যেমন ধরা যাক, লেখক হতে গেলে—সবচেয়ে প্রথমে থাকতে হবে লেখক হওয়ার বাসনা, নিজেকে অন্যদের থেকে পৃথক ভাবার কিংবা লেখক হিসেবে পরিচিত হওয়ার পরিকল্পনা। কী নিয়ে লিখব সেটা ভাবার অনেক অনেক আগেই ওই দৃঢ় ইচ্ছেটুকু থাকা জরুরি।

১৯৫০ সালে অক্সফোর্ডে প্রথম বর্ষে পড়ার সময়টা আমার মনে পড়ে, অনেক দূর হেঁটে যেতাম আমি, মনে পড়ে ওই রাস্তাগুলো, হেমন্তের ঝরা পাতা বিছানো, শুকনো পাতায় আলোড়ন তুলে গাড়ি আর ট্রাকগুলো দ্রুত ছুটে যেত—সেদিকে তাকিয়ে আমি ভাবতে থাকতাম কী নিয়ে লেখা যায়। লেখক হব বলে অক্সফোর্ডে ঢোকার চেষ্টায় স্কলারশিপ বাগানোর জন্য কতই না কষ্ট করেছি। কিন্তু তখন আমি খোদ অক্সফোর্ডে, অথচ জানি না কী নিয়ে লেখা শুরু করব। তখন যেন আমাকে কিছু তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল, নিশ্চিত জানি, লিখবার জন্য ওরকম হন্যে হয়ে না ঘুরলে আমার হয়তো কখনো লেখাই হতো না। মনের মধ্যে সেই ইচ্ছেটা লালন করে চলা ছিল যেমন আনন্দদায়ক তেমনই লোভনীয়—মস্কো থেকে ফিরে যাবার সময়ে নেপোলিয়নের সৈন্যদের জন্য যেমন লোভনীয় ছিল ঘুম।

একখানে বসে একটা বই লিখে ফেলার ব্যাপারটা আমার কাছে হঠাৎ খুব মেকি মনে হতো। আজ এত বছর পরেও সেই অনুভূতিটা আমাকে কখনো আচ্ছন্ন করে রাখে, আমি যখন একটা লেখা শুরু করি—তার মানেই হলো আমি কিছু সাজানো আর বানানো কাজের ব্যাপারে ভাবছি। মাথায় সব সময় কোনো নির্দিষ্ট কাহিনী বা ঘটনা থাকে না। আবার বলতে গেলে মাথায় অনেক কিছুই হয়তো থাকে; তেমন কিছু না ভেবেই আমি সম্পূর্ণ কল্পনা থেকে কোনো কাহিনীর শুরুটা লিখে ফেলি; লিখতে থাকি যতক্ষণ কোনো গন্তব্য না পাই—সেই সাজানো ঘটনার ভেতর দিয়ে এগোতে থাকি—একসময় সেটা আমাকে ঘায়েল করে ফেলে, আর তারপর আমার সারা জীবনের অর্জিত অভিজ্ঞতায় আমি অজানার উদ্দেশে রওনা দেই। আর এখনো এটাই সবচেয়ে রহস্যময়—সাজানো, বানানো, কৃত্রিম কতকগুলো বিষয়কে আশ্রয় করে একজনকে তার আত্মার, হৃদয়ের আর স্মৃতি ভাণ্ডারের গভীরতম অনুভূতি খুঁজে বের করতে হবে এবং তাকে স্পর্শও করতে হবে।

সাহিত্যের সবরকম ক্ষেত্রই আসলে কৃত্রিম, আর সেগুলো ক্রমাগত বদলে যেতে থাকে, বদলায় সংস্কৃতির নতুন ধারা আর আমেজের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে। ধরা যাক, সাহিত্য বোদ্ধা একজন মানুষ একটি মঞ্চনাটক লিখবে বলে ভাবল; তাকে তখন কিছু কল্পনা সাজাতে হবে যেটা বলতে গেলে আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না—কাহিনীটা বিভিন্ন দৃশ্যে আর ছোট ছোট পালায় ভাগ করে নিতে হবে; হয়তো সাদা কাগজে একের পর এক লাইন লিখে যেতে হবে না, কিন্তু অভিনেতার কাছে স্পষ্ট করে তুলতে পালার একেকটা অংশ বর্ণনা করতে হবে ঠিকই। মঞ্চনাটক লিখেছেন, এমন একজনের কাছে জেনেছি, নাটকের দৃশ্যের পর দৃশ্য সাজাতে গিয়ে তিনি নিজেকে সেই নাটকের সামনের সারিতে বসা একজন দর্শক হিসেবে কল্পনা করেন।

আগেকার দিনে যখন রেডিও বা রেকর্ড ছিল না, ছাপানো কাগজ যে যুগে রাজত্ব করত, তখন কেউ চাইলে একটা কাহিনীকে এমনভাবে সাজাতে পারত যেন সেটি অনেকগুলো ভাগে ভাগ হয়ে যায় আর মাসের পর মাস ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে, এভাবে ভল্যিউমের পর ভল্যিউম হয়ে যেত। তারও আগে, লেখা হয়েছিল গীতিকবিতা অথবা গীতিনাট্য, কখনো ছন্দ মেলানো, কখনো আবার ছন্দবিহীন; এমনকি গীতিমহাকাব্যও।

এর সবকিছুই এখন আমাদের চোখে কৃত্রিম, কিন্তু আজকের আধুনিক উপন্যাসকে যেমন পাঠকের কাছে বাস্তব বলে মনে হয়, সে সময়ে গীতিনাট্যকেও দর্শকের কাছে তেমনই বাস্তব মনে হতো। প্রকৃতপক্ষে উপন্যাসমাত্রই কৃত্রিম, কৃত্রিম তার কাহিনীর সরলতা কিংবা জটিলতায়, বানানো দৃশ্যকল্পে, সাধারণ জীবনযাপনের ছন্দে কোনো সংকট এবং তার থেকে উত্থানের ধারাবাহিক বর্ণনায়। আমি আসলে খুব সরাসরি বলতে চাচ্ছি যে এই কৃত্রিমতার অনুভূতি লেখালেখির শুরু থেকেই আমার ভেতরে কাজ করত, যখন আমি লিখতে শুরু করতাম, ভাবতাম আমার জীবনের অভিজ্ঞতার কোন অংশকে সেই লেখার আওতায় কী করে ফেলা যায়—বলতে গেলে, নিজের স্মৃতির ভেতরে পাগলের মতো হাতড়ে বেড়াতাম, পইপই করে খুঁজতাম কী করে সাহিত্যের ওই ক্ষেত্রটিতে সাজানো ঘটনার আবহে আমার অর্জিত কোনো অভিজ্ঞতাকে মিলিয়ে দিতে পারি।

সাহিত্যের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট রূপে বিন্যাস বা নির্মাণের প্রয়োজন: অভিজ্ঞতাকে সেখানে মিশিয়ে দিতে হবে সাবলীলভাবে, যেন অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু কিছু কিছু নির্মানের ক্ষেত্রে, যেমন কাপড়চোপড়ের ফ্যাশনের ক্ষেত্রে এই কৃত্রিমতার ব্যাপারটা মাঝে মধ্যে চরমে পৌঁছায়। আর তখন সেখানে নিজস্ব অভিজ্ঞতার প্রতিফলনে তাকে আরও তীক্ষ্ণ করার পরিবর্তে অনেক বেশি কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়, গাঁজাখুরি কল্পনার ভারে বিষয়টি তখন হয়ে দাঁড়ায় একটা বোঝার মতো। ট্রলোপ (ইংরেজ ঔপন্যাসিক অ্যান্থনি ট্রলোপ - অনুবাদক) যেমন কাল্পনিক একটা পরিস্থিতির অবতারণা করতেন—তিনি ছিলেন রীতিমতো একজন সমাজ গবেষক, সমাজ এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের কর্মদক্ষতা সম্পর্কে তার জ্ঞান ছিল প্রখর, বলা যেতে পারে সেই জ্ঞানের গভীরতা ছিল ডিকেন্সের (ইংরেজ লেখক চার্লস ডিকেন্স। - অনুবাদক) চেয়েও বেশি, যেন এক মোহিনী শক্তি। অথচ ট্রলোপ, যিনি কিনা অকল্পনীয় পরিস্থিতি তৈরি করতেন, তাকে নিয়ে আমার এক ধরনের সমস্যা আছে, তার লেখার প্রারম্ভিক কয়েকটি পাতায় যে সামাজিক চিন্তা এবং দার্শনিক মতামতের পরিচয় পাওয়া যায়, তার সাথে মিলিয়ে পরে উদ্ভুত সেই জটিল পরিস্থিতির জট ধীরে ধীরে খোলা সহজ নয়। ঠাকরের (ভারতীয় বংশদ্ভূত ইংরেজি ভাষার সাহিত্যিক উইলিয়াম ঠাকরে। - অনুবাদক) লেখার বিষয়েও আমার একই কথা বলার আছে: পড়তে পড়তে এগুতে থাকলে মনে হয় বাচনভঙ্গিটি টিকিয়ে রাখার জোর চেষ্টা আর প্লটের জটিলতা যেন তার ঘাড়ে আলগা বোঝার মতো চেপে বসেছে।

বর্ণনামূলক সাহিত্য থেকে আনন্দ পাওয়ার ক্ষেত্রে বিগত প্রায় একশো বছরে আমাদের রুচির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। গত শতাব্দীর সমস্ত সাহিত্য, সিনেমা আর টেলিভিশনে প্রচারিত সব অনুষ্ঠান আমাদের রুচির পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করেছে। আজ একথা অনায়াসে বলতে পারি যে, ঊনিশ শতকের ইংরেজি ভাষার যেসব ঔপন্যাসিকেরা আমাকে উপন্যাস পড়ার প্রকৃত আনন্দ দেয়—যখন তাদের লেখার জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে মানুষের জীবন দেখা যায়, মানুষের সেই প্রতিকৃতি আমাকে উৎসাহিত করে—তবে দুঃখের বিষয় হলো, তাদের নিজেদের সময়ে সেই লেখকদের আদৌ ঔপন্যাসিক হিসেবে ভাবা হয়নি।

রিচার্ড জেফারিসের (ইংরেজ লেখক, ১৮৪৮-১৮৮৭। - অনুবাদক) মতো লেখকদের কথা আমি প্রায়ই ভাবি, যার লেখায় খামারে কাজ করা মানুষদের জীবনযাত্রা এমন সূক্ষ্মভাবে উঠে আসে, তাদের সম্পর্কে তার জ্ঞান এত বিস্তৃত আর বর্ণনা এত প্রাঞ্জল যে মনে হয় সেই শ্রেণির সব মানুষের পুরো জীবনটাই উঠে এসেছে তার লেখায়। অথবা যদি উইলিয়াম হ্যাজলিটের (ইংরেজ লেখক, ১৭৭৮-১৮৩০। - অনুবাদক) কথা বলি, বা চার্লস ল্যাম্ব (ইংরেজ লেখক, ১৭৭৫-১৮৩৪। - অনুবাদক), তাদের টানটান বর্ণনা, আঁটোসাটো অথচ আবেগী বাক্য, খুব সাধারণ ব্যাপার কিন্তু নয়, হেলাফেলা করে লিখে তারা বিখ্যাত হননি। তারপর যদি বলি উইলিয়াম কবেটের কথা, তিনি সেই সাংবাদিক আর প্যামফলেট লেখক, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ব্যাপারে যার লেখাগুলো তীক্ষ্ণ, বিস্ময়কর গদ্যভঙ্গিমা, মাঝে মাঝে ভয়ানক সংস্কারের প্রতিজ্ঞা, গ্রাম্য মানুষদের জীবন, তাদের খাবারের অভ্যাস, সেখানকার রাস্তা, মাঠঘাট, এমনকি গ্রাম্য হোটেলের বর্ণনাও নিখুঁত তার। এই লেখকদের মধ্যে সবাই তাদের লেখার ধারায় সেই সময়ের উপন্যাসের ধারাটি বজায় রেখেছেন। নিজেদের প্রতিভার সাথে যুক্ত হয়েছে সময়ের প্রচলিত কাঠামো। তবে সেই কাঠামো ভেঙেচুরে প্রত্যেকে, পাঠককে যে যতটুকু আনন্দ দিতে পারেন সেভাবেই নির্মান করেছেন তাদের নিজস্ব ধারা।

কঠোর পরিশ্রমী প্রতি লেখককেই নিজস্ব ধারা তৈরি করতে হবে; আগে যা কিছু লেখা হয়েছে তাকেই আরেকটু বাড়িয়ে চড়িয়ে লেখার দায়িত্ব নিয়ে সে আসেনি। আর সেভাবেই সচেতন একজন লেখক তার নিজস্ব ধারাটির ব্যাপারে ভাববে, সিদ্ধান্ত নেবে; কারণ সে জানে তাকে কী করতে হবে। তবে সে অতীতে যা কিছু পড়েছে বা চর্চা করেছে তার প্রভাব তার লেখার উপরে চলে আসতেই পারে, ধারা সৃষ্টির সময়ে আগের সেই লেখকদের অভিজ্ঞতার ছায়া তার লেখায় পড়তে পারে, সুনির্দিষ্টভাবে নিজস্ব ধারা নির্মিত না-ও হতে পারে।

মৃত্যুর পরেও ফিলিপ লারকিন (ইংরেজ কবি, ১৯২২-১৯৮৫)—এখনো তার নিজস্ব এবং খুবই চমৎকার ধারা নিয়ে বেঁচে আছেন, বিশেষ করে তার শেষের দিকের লেখাগুলোর কথা যদি ধরা যায়। তিনি মনে করতেন সাহিত্যের ধারা এবং উপজীব্য বিষয় বস্তুত অদৃশ্য। ফিলিপ বেশ ধীরে কাজ করতেন, বলেছিলেন, “তুমি যখন কিনা আবিষ্কার করছো কী বলতে চাও, কিভাবে বলতে চাও, তাহলে সেজন্যে সময় তো লাগবেই।” কথাটি শুনতে যতটা সরল, তার অন্তর্নিহিত অর্থটি ততটাই গভীর। সাহিত্য সংগীতের মতো বিষয় নয়, এতে শুধু তরুণেরা আগ্রহী হবে তাও নয়; সাহিত্যকে কোনো নির্দিষ্ট বেড়াজালে ফেলাই যায় না। একজন লেখক যে জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা খুঁজে বেড়ান, ছড়িয়ে দিতে চান, সেটা সম্পূর্ণ সামাজিক এবং আবেগতাড়িত; এটা গুছিয়ে নিতে সময় লাগে, কিসের ভেতর দিয়ে তিনি যাচ্ছেন সেটা বুঝতে এবং পুরো প্রক্রিয়াটি সাজাতে তার জীবনের সিংহভাগ পেরিয়ে যেতে পারে। এই বিষয়টি কৌশলগত এবং নিবিড় তত্ত্বাবধান দাবি করে, কারণ এতকিছুর পরে পুরো অভিজ্ঞতাটি হারিয়ে গেলে চলবে না, ফলাফল যে আকৃতিতে আসার কথা ছিল, তা থেকে বেরিয়ে অন্য আকৃতি নিলে চলবে না। প্রতি লেখকের নিজস্ব রীতি বা ধারার পেছনে রয়েছে তার নিজস্ব অভিজ্ঞতার ছায়া।

সাহিত্যে কোন ধারাকে অনুসরণ করব, তাতে কী ধরণের শব্দের ব্যবহার করব, এসব নিয়ে আমি বরাবরই বেশ সতর্ক ছিলাম, কারণ কাজের শুরুতেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম, যে সাহিত্য আমি এতদিন ধরে জেনেছি, পড়েছি আর যে সাহিত্য আমি সৃষ্টি করতে চাই, মনের ভেতরে লালন করি, এই দুইয়ের মধ্যে একটা তফাৎ আছে। আমার অতীতের ভালো লাগা আর যে বিন্দুতে আমি পৌঁছতে চাই তার মধ্যে আছে এক ধরনের অনৈক্য। এই সাধারণ ব্যাপারটা অনুধাবনের পরপরই আমার কাছে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গেল যে প্রচলিত সাহিত্যের অন্ধ অনুকরণের কোনো মানে নেই। 

জেমস জয়েস (আইরিশ কবি এবং ঔপন্যাসিক, ১৮৮২-১৭৪১। - অনুবাদক) তার প্রথমদিককার একটি লেখায় নিজের অস্বস্তির কথা উল্লেখ করেছিলেন—অথবা বলতে চেয়েছিলেন ইংরেজি সাহিত্যে তার গুরুর কথা, “আজ আমি এবং আমরা যে ভাষায় কথা বলি, তিনিও সেই ভাষায়ই বলতেন। বাড়ি, ঈশ্বর, পানশালা, প্রভু, এই শব্দগুলো তার থেকে আমার ঠোঁটে কি খুবই অন্যভাবে উচ্চারিত হয়! আমি তার মতো করে কথা না বলে থাকতে পারি না, তার আত্মাকে না ছুঁয়ে আমি লিখতে পারি না...তার ভাষার কারুকাজের ওপরে আমার হৃদয় অস্থির ঘোরাফেরা করতে থাকে।”

জেমস জয়েস ছিলেন স্বকীয়ত্বের ব্যাপারে নিরিক্ষায় পটু—লেখার বস্তুগত বিষয় থেকে তার লেখনীর ধারা পৃথক দিশায় প্রবাহিত হতো। অবশ্য এখানে আমি জেমস জয়েসের ভাষা বা শব্দের ব্যবহার নিয়ে কথা বলছি না। ইংরেজি সাহিত্য পড়তে গিয়ে আমি ভাষাগত সমস্যা বোধ করিনি—ভাষা তো ভাষার মতোই। কিন্তু একটি বিষয়ে আমি বরাবর ভাবতাম, শব্দের ব্যবহারিক অর্থের ব্যাপারে, একই শব্দ স্থান ভেদে কতরকম অর্থ প্রকাশ করতে পারে। বাগান, বাড়ি, গাছপালা, মালি, জায়গা-জমি, এসব শব্দকে ইংল্যান্ডের একজন যেভাবে বোঝে, ত্রিনিদাদের একজনের কাছে সেগুলো কতই না আলাদাভাবে ধরা দেয়। ত্রিনিদাদের ব্যক্তির কাছে হয়তো এসবের মানে ক্ষেতখামার, কৃষিকাজের কারণে একসাথে বসবাসরত গুচ্ছ পরিবার। এখন প্রশ্ন হলো, আমার নিজের কাছে যে শব্দ যে অর্থ প্রকাশ করে তা দিয়ে তবে কী করে আমি সঠিকভাবে, সততার সাথে যা লিখতে চাই তার সবটা ব্যক্ত করতে পারব? সবখানের সব পাঠক কি আমার সেই লেখা তাদের অতীতের পঠিত সাহিত্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে একইভাবে গ্রহণ করতে পারবে? আমার মনে হতো জীবনে আমি যা দেখেছি তাকেই উপস্থাপন করতে হবে, আর এভাবেই নিজেকে লেখক বা উপস্থাপক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারব; আমাকে সবকিছু সবিস্তারে বর্ণনা করে যেতে হবে। আমার লেখক হওয়ার পথে এই কাজটিই আমি বিভিন্নভাবে করতে চেষ্টা করেছি। প্রাথমিকভাবে, বছরদুয়েক পরিশ্রমের পরে আমি একটি লেখা শেষ করেছিলাম, যা শেষ পর্যন্ত আমার মনে হয়েছিল, যা বলতে চাই, যেভাবে বলতে চাই তা যেন বলে উঠতে পেরেছি।

আমার লক্ষ্য ছিল সত্যের অনুসন্ধান, নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতার আলোকে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা, লেখকের প্রতিচ্ছবির ভেতর দিয়ে সত্যের উৎস খোঁজা। কিন্তু সেই লেখাটি যখন শেষ করেছিলাম, তারপরেও দেখলাম লেখা তৈরির পুরো প্রক্রিয়াটি বরাবরের মতোই আমার কাছে রহস্যময় রয়ে গেল।

ফরাসি সমালোচক সান্তে ব্যুভে ভাবতেন একজন লেখকের ব্যাক্তিগত জীবন আলোচনা করলে তার লেখার ধারার কারণ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়। সান্তে ব্যুভের ধারণার আক্রমণাত্মক বিরোধিতা করে অদ্ভুত এক বই প্রকাশ করেছিলেন প্রুস্ত (ফরাসি ঔপন্যাসিক মার্সেল প্রুস্ত। - অনুবাদক)। বইটি ছিল একেবারে ব্যতিক্রমী এক সৃষ্টি, একেবারে নতুন ধরণের এবং চমকপ্রদ, কিছুটা আত্মজীবনী, কিছুটা সাহিত্য সমালোচনা আর কিছুটা আবার কল্পকাহিনী, বইটির নাম ছিল সান্তে ব্যুভের বিরুদ্ধে। সেই বইয়ে সমালোচনা করা হয়েছিল বস্তত একজন সমালোচকের, একই সাথে তুলে ধরা হয়েছিল লেখার প্রতি একজন লেখকের টান, বর্ণিত হয়েছিল লেখকের নিজস্বতা এবং তার সৃষ্টির কৃত্রিমতার স্বরূপ।

“এই ধ্যান ধারণা”—প্রুস্ত বলেন (সিলভিয়া টনসেন্ড ওয়ার্নারের অনুবাদে)—আর তিনি বলছিলেন সান্তে ব্যুভের ধ্যান ধারণা সম্পর্কে—“শিক্ষাদীক্ষার মাধ্যমে আমরা জীবনে যা অর্জন করি সেসব যেন তার মধ্যে নেই, জানেনও না যে একটি লেখা একজন মানুষ লেখে তার নিজের চরিত্রের বাইরে দাঁড়িয়ে, আপন চরিত্র হলো যেখানে আমরা আমাদের নিজস্ব অভ্যাস, নিজস্ব দোষগুণের চর্চা করি।” আর তার কয়েক পাতা পরে সেখানেই প্রুস্ত আরো যোগ করেছেন: “লেখকের লেখনীর উপলক্ষ যাচাই করলে বোঝা যায় যে তার সৃষ্টিতে রয়েছে ভাসা-ভাসা ব্যাপারস্যাপার বা শূন্যতার চেয়েও বেশি কিছু, অথচ তার ব্যক্তিগত জীবনে নিশ্চয়ই রয়ে গেছে আরো গভীর বা জটিলতর কোনো ঘটনা, একজনের একান্ত জীবনের যাবতীয় অর্জন থেকে নিংড়ানো নির্যাসটুকু সে তার লেখায় ঢালতে পারে, একাকিত্বে লেখক সেই লেখাটি সাজিয়ে নেয় কেবল নিজের জন্য, পরবর্তী কালে তা জনসমক্ষে প্রকাশ পায়। নিজের জীবনে মানুষ যা কিছু চর্চা করে—যেমন অন্যের সাথে কথোপকথনের সময়ে, যতই পরিশুদ্ধ করে বলুক না কেন.. —তা নিজের অবচেতন মনের অগভীর কথাবার্তাই মাত্র, সেসব কথা কিছুতেই ব্যক্তির ভেতরকার সেই লালিত অনুভূতি নয় যা কিনা পৃথিবীর আর সব কিছুকে একদিকে সরিয়ে রেখে লিখে ফেলা যায়, যা কিনা লেখা যায় আপন মনে পৃথিবীর এমাথা-ওমাথা পরিভ্রমণ করতে করতে।”

এটা অবশ্য কৌতুহল উদ্দীপক—তবে কিছুতেই বিস্ময়কর নয় যে, লেখকের লেখক সত্তা নিয়ে প্রায় একই ধরনের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন আরেক বিখ্যাত লেখক, সমরসেট মম। তার বিখ্যাত কল্পকাহিনী কেকস আর অ্যালি-তে অতুলনীয় টমাস হার্ডি চরিত্র সৃষ্টি করতে গিয়ে, একটার পর একটা আকস্মিক ঘটনার অবতারণা করে (যার জন্য অবশ্য তিনি বেশ সমালোচনার মুখেও পড়েছিলেন) দেখিয়েছেন যে ওয়েসেক্সের বিয়োগান্তক কাহিনী রচয়িতা একজন ঔপন্যাসিকের নিজস্ব জীবন কত অদ্ভুতভাবে সাধারণ হতে পারে, আর এজন্যেই লেখালেখির বিষয়টা রহস্যময়। “আমার এমনটাই মনে হয়”—মম পরিশেষে বলেন—“একজন লেখকের ভেতরের মানুষটা, যে তার মৃত্যু পর্যন্ত থাকে অচেনা এবং একাকি, কিন্তু সেই ভেতরের মানুষটা, যে সবার অজান্তে জীবন যাপন করেছিল, তার ছায়ামূর্তি অথবা আত্মা, স্বরচিত সমস্ত বইগুলো এবং তার নিজস্ব জীবনের মাঝখানে কোথাও অদৃশ্য হয়ে ঘোরাফেরা করতে থাকে, আর দুটো পুতুল সত্তার বিয়োগান্তক পরিণতি দেখে শ্লেষের হাসি হাসে...”

(২৩ এপ্রিল, ১৯৮৭, নিউ ইয়র্ক বুক রিভিউ)

ভি এস নাইপল
১৯৩২ সালের ১৭ অগাস্ট বিদ্যাধর সূর্যপ্রসাদ নাইপল জন্মেছিলেন ত্রিনিদাদে। নোবেল বিজয়ী এই লেখক একাধারে ত্রিনিদাদ এবং ইংল্যান্ডের নাগরিক। তিনি ইংরেজি ভাষায় উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনী এবং প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তিনি প্রায় পঞ্চাশ বছর ব্যাপী লেখালেখি করেছেন এবং ফিকশন, নন-ফিকশন মিলিয়ে তার বইয়ের সংখ্যা তিরিশের বেশি। তার বিখ্যাত রচনার মধ্যে রয়েছে, এ হাউজ অফ মিস্টার বিশ্বাস, ইন এ ফ্রি স্টেট, এ বেন্ড ইন দ্য রিভার, দ্য এনিগমা অফ অ্যারাইভাল, এ ওয়ে ইন দ্য ওয়ার্ল্ড, আরলি ত্রিনিদাদ নভেলস।

তিনি ১৯৭১ সালে বুকার এবং ২০০১ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। নোবেল কমিটি পুরস্কারের আয়োজনে উল্লেখ করে, ‘তার লেখা ভুলে যাওয়া ইতিহাসকে নতুন আঙ্গিকে আমাদের সামনের তুলে ধরার প্রয়াস পায়।’ সেখানে আরো বলা হয়, ‘আধুনিক মানসিতাই তার লেখায় ঐতিহ্যের মোড়কে ঢাকা।’    

উপন্যাস, প্রবন্ধ এবং ভ্রমণ কাহিনী, প্রত্যেকটিই তার কলমে হয়ে উঠেছে অসামান্য। তবে ১৫৬৬ থেকে ১৫৬৮ সালের মধ্যে রচিত তার রম্য উপন্যাস আরলি ত্রিনিদাদ তাকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা এনে দেয়।

ইন্ডিয়া থেকে অভিবাসী হয়ে তাঁর পরিবার ত্রিনিদাদে গিয়ে বসবাস শুরু করেছিল। তাঁর বাবা ছিলেন ত্রিনিদাদ গার্ডিয়ান পত্রিকার সাংবাদিক। তারা ভারতীয় ব্রাহ্মণ পরিবার হলেও ধীরে ধীরে বাড়িতে ধর্মীয় নীতি আর কঠোর নিয়মকানুনের ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়। বাড়িতেও তারা ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করতেন।

ভি এস নাইপল তার কল্পকাহিনী এবং ভ্রমণ কাহিনীতে তৃতীয় বিশ্বকে কর্কশ এবং আবেগবিহীনভাবে তুলে ধরেছেন বলে সমালোচিত হয়েছিলেন।

২০১৮ সালের ১২ অগাস্ট, লন্ডনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

   

শ্রীপুরের কাওরাইদে নজরুল উৎসব শনিবার



ডেস্ক রিপোর্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ কালি নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ‘ভাগ হয়নিকো নজরুল’ শীর্ষক নজরুল উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে শনিবার। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের আয়োজনে এবং নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর সহযোগিতায় এই উৎসবে সেমিনার, আবৃত্তি ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতীয় কবির বর্ণাঢ্য জীবন ও সাহিত্যকে তুলে ধরা হবে।

নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর অন্যতম ট্রাস্টি আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক জানান, আয়োজনের শুরুতে শনিবার দুপুর ২টায় সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সুনীল কান্তি দে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক ড. সাইম রানা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস ও ছায়ানট (কলকাতা)’র সভাপতি সোমঋতা মল্লিক।

তিনি আরও জানান, বিকেলে আয়োজনে নজরুলের জাগরণী কবিতা ও গান পরিবেশন করবেন দেশের বরেণ্য শিল্পীরা। আবৃত্তি করবেন-টিটো মুন্সী ও সীমা ইসলাম। নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করবেন শিল্পী ফেরদৌস আরা, সালাউদ্দিন আহমেদসহ অনেকে। সমাপনী পর্বে প্রধান অতিথি থাকবেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে সমাপনী অনুষ্ঠানে থাকবেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার।

‘দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে নজরুল চর্চা বেগবান করতে এই উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। এবছর কবি নজরুলের ১২৫তম জন্মবর্ষ। এই বছরটি নজরুলচর্চার জন্য খুবই সবিশেষ। উৎসবে দুই দেশের বিশিষ্ট লেখক ও গবেষকদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে সাময়িকী। সাম্য, মানবতা ও জাগরণের যে বাণী কবি সৃষ্টি করে গেছেন, সমকালীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজের জন্য তা আলোকবর্তিকা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নজরুলের এই আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে দিতেই আমাদের এই প্রচেষ্টা’-বলেন আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক। 

;

শিশু নজরুল



এ এফ এম হায়াতুল্লাহ
কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত। এটি বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনের দিক দিয়ে বহুগুণ বড় একটি দেশ। বহুজাতির বহু মানুষের বাস সে দেশে। ঐ দেশ অনেকগুলো প্রদেশে বিভক্ত। এই প্রদেশগুলোকে বাংলা ভাষায় রাজ্য বলে অভিহিত করা হয়। এই ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত তদানীন্তন বাংলা প্রদেশের পূর্বাঞ্চল আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর পশ্চিমাঞ্চল ‘পশ্চিম বঙ্গ’ নামে ভারতের অন্তর্গত রয়ে গেছে।

এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার অধীন আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত জামুরিয়া থানার অন্তর্ভুক্ত চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে এবং ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ তারিখে জন্মলাভের পর একটি শিশুর কাজী নজরুল ইসলাম নাম রাখেন যে পিতা তার নাম কাজী ফকির আহমদ। আর যে মায়ের কোলে তিনি জন্মান তার নাম জাহেদা খাতুন। এই শিশুটির জন্মের আগে এই পিতামাতার আর-ও ৪ জন সন্তান জন্মের সময়ই মারা গিয়েছিল। শুধু তাদের প্রথম সন্তান কাজী সাহেবজানের বয়স তখন ১০ বছর। অর্থাৎ কাজী নজরুলের সর্বজ্যেষ্ঠ বড় ভাই শিশু কাজী নজরুলের চাইতে ১০ বছরের বড় ছিলেন। নজরুলের পর তার আর-ও একজন ভাই ও বোনের জন্ম হয়েছিল। ভাইটির নাম ছিল কাজী আলী হোসেন এবং বোনটির নাম ছিল উম্মে কুলসুম।

শিশু নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদ বই-পুস্তক পড়তে পারতেন। তিনি স্থানীয় মসজিদ ও মাজারের সেবা করতেন। রাজ্য শাসকগণ কর্তৃক বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ অর্থাৎ বিচারকগণ উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতেন। মুসলমান সমাজ থেকে বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাজী বলা হত। মুসলমান সমাজে কাজীগণ অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হতেন। নজরুল ইসলাম এইরূপ সম্মানিত পরিবারে জন্মপ্রাপ্ত এক শিশু। তাই জন্মের পর ক্রমশ বেড়ে উঠার পর্যায়ে তিনি পারিবারিকসূত্রেই ভাল-মন্দের পার্থক্য করার এবং হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হয়ে সকলকে সমভাবে ভালবাসার গুণাবলি অর্জন করেন।

মানবজাতির ইতিহাসে যে-সমস্ত মহাপুরুষ বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের অধিকাংশই শৈশব থেকে নানারূপ দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়ে সেগুলো জয় করে মহত্ত্ব অর্জন করেছেন। তাদের কেউই একদিনে বড় হয়ে যাননি কিংবা বেড়ে-ও উঠেন নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জন্মানোর আগেই পিতাকে হারিয়েছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে হারিয়েছিলেন জন্মদাত্রী মাকেও। নজরুল তার পিতাকে হারান নয় বছর বয়সে ১৯০৮ সালে। পিতা তাকে গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলেন। তখনকার দিনে পড়াশোনা করার জন্যে সরকারি ব্যবস্থা ছিলনা। বাংলাদেশের তখন জন্ম হয়নি।

বিশেষ ভঙ্গিমায় হাবিলদার নজরুল

নজরুলের জন্মভূমি বাংলা প্রদেশ ভারতবর্ষের একটি রাজ্য যা ছিল বিদেশী ব্রিটিশ শাসনাধীন তথা পরাধীন। ব্রিটিশ শাসকরা এদেশের সাধারণ মানুষ তথা প্রজাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেনি। কারণ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সচেতন হয়ে উঠে-তাদের আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয়-তারা পরাধীন থাকতে চায় না-স্বাধীনতার প্রত্যাশী হয়। বিদেশী শাসক ব্রিটিশরা সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত না করায় জনসাধারণ সম্মিলিতভাবে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করত। সেই প্রতিষ্ঠানে প্রধানত মাতৃভাষা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হত। এইসব প্রতিষ্ঠান মক্তব নামে পরিচিত হত। এগুলো পরিচালনার ব্যয় অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতন মক্তব প্রতিষ্ঠারাই দান, সাহায্য ও অনুদান সংগ্রহ করার মাধ্যমে নির্বাহ করতেন। গ্রামীণ একটি মক্তবে নজরুলের পাঠগ্রহণ শুরু। তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর।

একবার কিছু শোনে ও দেখেই তিনি তা মনে রাখতে পারতেন। কিন্তু শিশুসুলভ সকল প্রকার চঞ্চলতা-ও তাঁর ছিল। পিতৃবিয়োগের পর সেই চঞ্চলতার যেন ছেদ পড়ল। তার মেধাগুণে তিনি হয়ে উঠলেন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে সেই মক্তবেরই শিক্ষক। একজন শিশু শিক্ষক। এক শিশু পড়াতে লাগলেন অন্য শিশুকে। উদ্দেশ্য নিজের অর্জিত জ্ঞান ও বিদ্যা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া। কিছু দেয়ার মাধ্যমে আনন্দ লাভ-যে আনন্দ মহৎ।

তার ভেতরে ছিল এক ভবঘুরে মন। মক্তব ছেড়ে ভর্তি হলেন উচ্চ বিদ্যালয়ে-মাথরুন নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে। স্থিত হলেন না সেখানে। গ্রামীণ নিসর্গ, প্রকৃতি, ঋতুচক্র যেমন তার মনকে প্রভাবিত করে, অজানাকে জানার এবং অচেনাকে চেনার নিরন্তর কৌতূহল-ও তাকে আন্দোলিত করে। ঘরছাড়া স্বভাবের এই শিশু অন্য সকল মানুষের জীবন ও সংগ্রামের রহস্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ঘর তাকে বাঁধতে পারে না। বিশাল আকাশকেই তার মনে হয় তার মাথার ওপরে খাঁচার মত উপুড় হয়ে তাকে আটকে রেখেছে। তাই তিনি মনে মনে ‘ভূলোক, গোলোক ও দ্যুলোক’ ছাড়াতে চাইতেন কেবলÑনিজেকে মুক্ত করতে চাইতেন। মনের আহ্বানে সাড়া দিতেন, গান শোনাতেন, শুনে শুনে গাইতেন।

তারই পরিক্রমায় গ্রামীণ লোক-নাট্য ‘লেটো’ গানের দলে যোগ দিলেন। সেখানেও তার দলপতি উস্তাদ শেখ চকোর গোদা ও বাসুদেব তাকে সেরাদের ‘সেরা’ বলে স্বীকৃতি দিলেন। তিনি শুধু লেটোর দলে গানই গাইলেন না। গানের পালা রচনা করলেন। ‘ মেঘনাদ বধ’, ‘হাতেম তাই’ ‘চাষার সঙ’, ‘আকবর বাদশা’ প্রভৃতি পালা রচনা করতে যেয়ে হিন্দু পুরাণ রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, বেদ যেমন পড়লেন, তেমনি পড়লেন কোরান-হাদিস, ইতিহাস-কাব্য প্রভৃতি। মক্তব-বিদ্যালয় ছেড়ে হয়ে গেলেন প্রকৃতির ছাত্র।

কিন্তু আগুন যে ছাই চাপা থাকে না। প্রতিভার আগুনের শিখা দেখে ফেললেন পুলিশের এক দারোগা, যিনি নিজেও কাজী বংশের সন্তান, রফিজুল্লাহ। চাকরি করেন আসানসোলে। কিন্তু তার জন্মস্থান ময়মনসিংহ জেলা। নি:সন্তান রফিজুল্লাহ মায়ায় পড়ে গেলেন শিশু নজরুলের। নিয়ে এলেন জন্মস্থান ময়মনসিংহে। ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে ভর্তি করে দিলেন দরিরামপুর হাই স্কুলে। কেমন ছিলেন তিনি এখানে ? জন্মভিটা চুরুলিয়া থেকে কয়েকশত কিলোমিটার দূরে-মাতৃআঁচল ছিন্ন পিতৃহীন শিশু! সহপাঠীরা কেউ লিখে রাখেন নি।

১৯১১ সনে ময়মনসিংহে আনীত হয়ে থাকলে পেরিয়ে গেছে একশত তের বছর। সহপাঠীদের কেউ বেঁচেও নেই। কিন্তু বেঁচে আছে নানারূপ গল্প ও কল্পনা। বড় বড় মানুষদের নিয়ে এমনই হয়। তাদেরকে কেন্দ্র করে অনেক কাহিনী তৈরী করা হয়। মানুষ জীবনের গল্প শুনতে ভালবাসে। তাই জীবন নিয়ে গল্প তৈরী হয় কিন্তু তা জীবনের অংশ না-ও হতে পারে। কেউ বলেন নজরুল ময়মনসিংহের ত্রিশালে এক বছর ছিলেন, কেউ বলেন দেড় বছর, কেউবা দু’বছর। প্রথমে ছিলেন কাজী রফিজুল্লাহ’র বাড়ি। এরপরে ছিলেন ত্রিশালের নামাপাড়ায় বিচুতিয়া বেপারির বাড়ি। এই দু’বাড়িতে থাকা নিয়ে অবশ্য কোন বিতর্ক নেই। কিন্তু তর্ক আছে তার প্রস্থান নিয়ে।

কেউ বলেন তিনি স্কুল-শিক্ষকের কাছে সুবিচার না পেয়ে, কেউ বলেন অভিমান করে চলে গিয়েছিলেন। তবে তিনি কাউকে না বলেই চলে গিয়েছিলেন এটাই প্রতিষ্ঠিত মত। কিন্তু গেলেন কোথায় ? সেই জন্মস্থানে। তবে এবার চুরুলিয়া থেকে বেশ দূরে রাণীগঞ্জের শিহাড়সোল সরকারি স্কুলে সরকারি বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হলেন অষ্টম শ্রেণিতে। ১৯১৫ সন। পড়াশোনা করলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। দশম শ্রেণি পর্যন্ত একটানা। নজরুলের চঞ্চলমতি, ঘরছাড়া ও ভবঘুরে স্বভাবের জন্যে যেন বেমানান। প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হলেন।

মেধাবী বলেই নিয়মিত মাসিক ৭ টাকা বৃত্তি পেতেন। ঐ সময়ের হিসাবে মাসিক ৭ টাকা অনেক টাকা। মাসিক ৩ থেকে ৪ টাকায় সকল প্রকার থাকা-খাওয়ার ব্যয় মিটিয়ে অনায়সে চলা যেত। দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে এন্ট্রান্স বা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার কথা। সে প্রস্তুতি চলছে। নিচ্ছেন-ও। হঠাৎ ব্রিটিশ শাসকদল কর্তৃক যুদ্ধযাত্রার ডাক। কিন্তু প্রলোভন দেখানো হলো যে ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জিততে পারলে ভারতবর্ষকে মুক্ত করে দিয়ে যাবে। জন্মাবধি স্বাধীনতা ও মুক্তি-প্রত্যাশীর হৃদয়ে নাড়া দিল। তিনি সাড়া দেবেন কিনা দোদুল্যমান। কিন্তু কপট ব্রিটিশ জাতি বাঙালিকে উত্তোজিত করার নিমিত্ত অপবাদ ছড়ালো যে বাঙালিরা ভীরু।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকার কবিভবনে নজরুল

তারা লড়তে, সংগ্রাম করতে, যুদ্ধে যেতে ভয় পায়। স্বল্পকাল পরের (১৯১৭ সালের মাত্র চার বছর পর লিখিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ১৯২১ সনে) বিদ্রোহী কবির রক্ত ক্ষোভে নেচে উঠলো। কে রুখে তার মুক্তির আকাক্সক্ষা! বাঙালি সেনাদের নিয়ে গঠিত ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে নাম লিখিয়ে বাস্তব যুদ্ধযাত্রা করলেন। গন্তব্য করাচি। ১৯১৭-১৯১৯ সাল অব্দি কঠোর সৈনিক জীবন। সুকঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যেই সাধারণ সৈনিক থেকে হাবিলদার পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পাশাপাশি আরবি-ফার্সি সাহিত্যে অধ্যয়নসহ সঙ্গীতে ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য মহাকালের এক অবিস্মরণীয় কবি-শিল্পী হিসেবে নিজেকে নির্মাণের ক্ষেত্রে করাচির জীবনই ছিল এক সাজঘর। যুদ্ধযাত্রার পূর্ব পর্যন্ত নজরুল শিশু। কিন্তু যুদ্ধফেরত নজরুল এক পরিপূর্ণ তরুণ ও চিরকালীন শিল্পী-যার মন ও মানস শিশুর মত আজীবন নিষ্পাপ।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট 

;

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;