দূরত্ব-বিচ্ছিন্নতার ছবি এঁকে বিখ্যাত যিনি
করোনা-বাস্তবতার কারণে দূরত্ব ও বিচ্ছিন্নতা—এ বিষয়গুলো এখন মেনে চলার চেষ্টা করছেন সবাই। এডওয়ার্ড হপার নামে বিখ্যাত মার্কিন চিত্রশিল্পী বিশ শতকে দূরত্ব আর বিচ্ছিন্নতাকে উপজীব্য করে রাঙিয়ে তুলেছিলেন তাঁর ক্যানভাস। কেন তিনি এ ধরনের ছবি এঁকেছিলেন? ঘরবন্দী থাকার সময়ে এই প্রশ্নের তত্ত্ব-তালাশ।
করোনা-পরিস্থিতির কারণে আজ ‘স্যোশাল-ফিজিক্যাল ডিসটেন্সিং’ বা ‘সামাজিক-শারীরিক দূরত্ব’, ‘আইসোলেশন’ বা ‘বিচ্ছিন্নতা’—শব্দগুলো খুবই পরিচিত আমাদের কাছে। আজ থেকে বহু বছর আগেই মার্কিন চিত্রশিল্পী এডওয়ার্ড হপার (২২ জুলাই ১৮৮২-১৫ মে ১৯৬৭) বিখ্যাত ছিলেন সামাজিক-শারীরিক দূরত্ব-বিচ্ছিন্নতার ছবি আঁকার জন্য। বাস্তববাদী ধারার এই চিত্রকর বিশশতকের প্রথমার্ধে পরিত্যক্ত-ধ্বংসোন্মুখ-পতিত-বেওয়ারিশ নাগরিক জীবন ও সামাজিক-শারীরিক দূরত্ব-বিচ্ছিন্নতার ছবি কেন এঁকেছিলেন, তার তত্ত্ব তালাশ করতে বসলে শিল্প সমালোচকেরা বহুবিধ কারণ হয়তো বের করতে পারবেন। তবে বর্তমানের এই করোনা-উদ্ভূত বাস্তবতার কারণে এই শিল্পী আবারও মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছেন। প্রবলভাবে পুনরুত্থিত হয়েছে তাঁর চিত্রকর্ম। ইন্সটাগ্রাম ও টুইটারে তাঁর চিত্রকর্মগুলো শেয়ার হয়েছে, হচ্ছে অসংখ্যবার। যদিও তিনি অর্ধ শতক আগেই মর্ত্যলোক ছেড়েছেন এবং ইতিহাসের একদম ভিন্ন সময়ে জন্মেছিলেন।
হপার পরিত্যক্ত শহুরে ল্যান্ডস্কেপ এবং আইসোলেটেড ফিগারে, একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতাকে ধরেছেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের এই অতিমারি তাঁর শিল্পকর্মকে দিয়েছে অন্য এক দ্যোতনা, অন্য মাত্রা, অন্যরকম প্রাসঙ্গিকতা। বলা হচ্ছে, ‘আমরা সবাই এখন এডওয়ার্ড হপারের পেইন্টিং’। তিনি এখন হয়ে উঠেছেন কোয়ারেন্টাইন কালচারের ‘পোস্টার বয়’।
এই সময়ে এসে জনপরিসরে হপারের এই সাম্প্রতিক পুনরুত্থান আমাদের বর্তমান দুর্ভাগ্যজনক অবস্থার দিকেই চোখ ফেরায়। আমরা যখন অবাঞ্ছিত অতিথি ‘করোনাভাইরাস’ আমাদের বাড়ি ছেড়ে যাক এমন অপেক্ষায় দিন গুনছি, ঠিক তখনই আমরা দেখছি যে, পৃথিবীটাকে অদ্ভুতুড়েভাবে তাঁর কিছু চিত্রকর্ম—যেমন ‘হাউস বাই দ্য রেইলরোড’ (১৯২৫), ‘অটোম্যাট’ (১৯২৭), ‘রুম ইন নিউইয়র্ক’ (১৯৩২), ‘নাইটহকস’ (১৯৪২), ‘কেইপ কড মর্নিং’ (১৯৫০), ‘অফিস ইন আ স্মল সিটি’ (১৯৫৩), ‘সান ইন অ্যান এম্পটি রুম’ (১৯৬৩), ‘মর্নিং সান’ (১৯৫২) কিংবা ‘ইন্টারমিশন’ (১৯৬৩)—এসব চিত্রকর্মের মতো দেখাচ্ছে। হপারের অনেক ছবিতেই যেন এখনকার আমরা; ফাঁকা সিনেমা হলে বসে থাকা একাকী এক নারী দর্শক, বেদনাবিধুর এক মানুষ তার আধুনিক অ্যাপার্টমেন্টে, একাকী এক দোকানদার, এক ডিনার টেবিলে একে অপরের থেকে দূরত্বে বসে থাকা মানুষ—এ তো আমাদের বর্তমানেরই প্রতিচ্ছবি।
হপারের সবচেয়ে বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘নাইটহকস’-এ দেখা যায়, রাতে আলোকিত এক ডিনারে চার খাবারক্রেতা ও একজন ওয়েটার। এটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে আঁকা। ওয়েটার এবং বাইরের জগতের সঙ্গে মানুষগুলোর বিচ্ছিন্নতা-সংযোগহীনতা ওই যুদ্ধকালীন সময়ে সৃষ্ট মানুষের অন্তর্গত বোধেরই এক বহিঃপ্রকাশ। করোনাকালীন সময়ে মানুষের অনুভূতির সঙ্গে ‘নাইটহকস’ যেন তাই একীভূত হয়ে গেছে। একীভূত হয়ে গেছে কফি হাতে একাকী বসে থাকা নারীর ‘অটোম্যাট’ চিত্রকর্মটিও।
হপারের অসম্ভব ভক্ত ছিলেন বিশ্বনন্দিত ইংরেজ চলচ্চিত্রকার আলফ্রেড হিচকক। ১৯২৫ সালে হপারের আঁকা ‘দ্য হাউস বাই দ্য রেইলরোড’ ছবিটি দ্বারা অনুপ্রাণিত হন তিনি। হপার এ ছবিতে রেলের রাস্তা দিয়ে বিচ্ছিন্ন এক অদ্ভুত পুরনো বাড়ি এঁকেছেন। এতে তখনকার প্রেক্ষিতে পরিবর্তিত হতে যাওয়া আমেরিকা প্রতিফলিত হয়েছে। সেখানে পুরনো বাড়িগুলো পরিত্যক্ত হয়ে যাচ্ছে, আর প্রবেশ করছে রেললাইন। উন্নয়ন নাটকীয়ভাবে বদলে দিচ্ছে আশপাশ। ছবিতে দেখা যায়, আঁকা বাড়িটি বিচ্ছিন্ন ও নির্জন।
এই ছবির অনুপ্রেরণায় হিচকক তাঁর ১৯৬০ সালের পৃথিবীবিখ্যাত হরর ক্ল্যাসিক ‘সাইকো’ চলচ্চিত্রে স্থান দেন ‘বেইটস ম্যানসন’কে। বলা দরকার, হপারের ছবিটি আঁকার সময়ের যে ধারণা—উন্নয়ন আসলে বিচ্ছিন্নতার একটি উপাদান—সেটি হিচককের ‘সাইকো’র সময়েও প্রাসঙ্গিক ছিল, যেখানে বিচ্ছিন্ন-নিঃসঙ্গ-নিভৃত নির্জনতায় একজন মানুষের উন্মাদনা সুতীব্র হয়ে ওঠে। আর এখন এই অতিমারির স্বেচ্ছা কিংবা মেনে নেওয়া বন্দীত্বে বিষয়টি তো আরো বেশি মূর্তমান।
হপারের এই মনস্তাত্ত্বিক চিত্রকর্মগুলোর সময়কাল ১৯২০-৫০ এর দশক জুড়ে। ছবিগুলো একরকম অস্বস্তির শিহরণ জাগায় এবং ‘একটি জাতির আর্ট তখনই মহত্তম হয়ে ওঠে যখন তাতে তার মানুষের চরিত্রের প্রতিফলন থাকে’—শিল্পীর এই দর্শনকে মূর্তমান করে তোলে।
হপার তাঁর সময়ের সামষ্টিক বোধকে ধারণ করার পাশাপাশি কিন্তু নিজের অজান্তেই বর্তমানের বৈশ্বিক অতিমারির অন্তর্নিহিত বোধকেও ধারণ করেছেন।
কিছুদিন আগেও আমরা অনেকেই অত্যন্ত দ্রুতগতির এক খ্যাপাটে পৃথিবীতে কাজকর্ম করেছি, দিনযাপন করেছি, যেখানে জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল অত্যধিক ক্যাফেইন, অনিঃশেষ সুযোগসুবিধা, জনসমাগম, গণপরিবহন ইত্যাদি। আর আজ আমরা অনেকেই হয়তো একাকী, সোফায়-বিছানায় শুয়ে-বসে অফিস করছি। এটি আক্ষরিক অর্থেই হপারের ৭০ বছর বয়সে আঁকা ছবি ‘মর্নিং সান’-এর নারীটির মতো। করোনাকালের সময়টা আমরা যে কতটা নগণ্য ও ক্ষুদ্র, পদে পদে তা মনে করিয়ে দিচ্ছে। এখন দুনিয়াজুড়ে শুধু পরিসংখ্যানিক বিশ্লেষণ এবং ‘বিগ ড্যাটা’র রমরমা, মানুষের জীবনকে যা কিছু সংখ্যায় রূপান্তরিত করেছে। বৈশ্বিক মহামারিতে ‘মর্নিং সান’ ছবির বিছানায় স্থির হয়ে বসে থাকা নারীটির মতো কিংবা ‘কেইপ কড মর্নিং’-এর বে-উইন্ডো দিয়ে সকালের সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় বাইরে গভীরভাবে তাকিয়ে থাকা নারীর মতোই আমরা যেন জালে আটকা পড়েছি ছোট্ট এক মাছের মতো, প্রকৃতির দাক্ষিণ্যে, যাতে আমাদের ন্যূনতম নিয়ন্ত্রণ নেই।
হপারের ছবিতে পাই প্রশান্তি, কোলাহলশূন্যতা ও স্তব্ধতা। বিষণ্ণতার জন্য তাঁর অধিকাংশ আলোচিত চিত্রকর্ম মানসিক রোগাক্রান্তদের অন্তর্জগতের কথাও বলে। আর এই মানসিক অসুস্থতা এই করোনাকালের অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক একটা বিষয়। আমরা এখন ভীত, আতঙ্কিত, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় মানসিকভাবে অনেকটা পক্ষাঘাতগ্রস্তের মতো দিন পার করছি। এমন এক সময়ে বাস করছি, যাকে বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থা ‘বার্ন আউট’ সংস্কৃতি নাম দিয়েছে এবং এই সংস্থাটি গত বছর দাবি করেছিল, এটি বৈশ্বিক মহামারির জন্ম দেবে, এবং সেটিই সত্যি হয়েছে। অনেকটা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই আমরা অতি আগ্রাসী এবং গোপনে অনিষ্টকর এক অতি ছোঁয়াচে ভাইরাসের কারণে ঘরে ঠাঁই নিতে বাধ্য হয়েছি, বাধ্য হয়েছি নিজেদেরকে শান্ত ও স্থিত করতে।
কাকতালীয়ভাবে আমাদের ইতিহাসের যুগ শিল্পী হপারের পার করা সময়ের প্রতিধ্বনি তুলতে শুরু করেছে। তিনি পেয়েছিলেন ১৯১৮-এর স্প্যানিশ ফ্লু, ১৯৩০-এর ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’জনিত তীব্র অর্থনৈতিক মন্দা, আর দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ। হপার একটা ভয়ের ও অনিশ্চিত পৃথিবীতে বাস করছিলেন, যা তাঁকে বাধ্য করেছিল অশান্ত পরিবেশে একাকী চরিত্র আঁকতে। আমরাও এখন প্রতিনিয়ত এক ভীতিকর-আতঙ্কিত সময় পার করছি। ইতিহাসের এক বিপজ্জনক সংকটের সাক্ষী হতে চলেছি আমরা।
হপারের কাছে আধুনিক জীবন অবন্ধুজনোচিতের চূড়ান্ত। তাঁর চরিত্রগুলোর দূরত্ব-বিচ্ছিন্নতা-একাকিত্বের জন্য কোনো অতিমারির দরকার পড়েনি। কাচের বড় জানালা ঘেরা, উঁচু নাগরিক দালানের স্বয়ংসম্পূর্ণ অ্যাপার্টমেন্টে বাস করা মানুষজন, নির্জন এলাকার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা গ্যাস-স্টেশন—মোটকথা, আধুনিক নগর ও ল্যান্ডস্কেপের নির্মাণই তাঁর কাছে অসম্ভব নিঃসঙ্গতা তৈরির যন্ত্রের মতো। তাঁর চরিত্রগুলোর নিজেদের মধ্যে বিনিময়ের যেন তেমন কিছু নেই। বিচ্ছিন্ন, একাকী, স্বপছন্দের-স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষদের নিয়ে হপারের যে ভয়ংকর কল্পনা-দর্শন, তা আমরা সবাই হয়তো একরকম এড়িয়ে যেতে পারি। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, তা এখন আমাদের করতে হবে একে-অন্যের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে। এবং আমরা এও জানি, সবাই নিজ বাড়িতে একদম ঠিকঠাক আছে—এটি বর্তমান ভাইরাস অতিমারির একদম শূন্যগর্ভ এক প্রোপাগান্ডা।
সেই অনেক আগে থেকেই ছবিতে ছবিতে হপার যে বার্তা দিয়েছেন তা হলো আধুনিক জীবন হতে পারে ভীষণরকম একাকিত্বের। তাঁর চরিত্রগুলো ডিনার টেবিলে কিংবা রেস্টুরেন্টে যেমন বিচ্ছিন্ন, তেমনি তাদের অ্যাপার্টমেন্টের জানালায়ও। এই ব্যাপারে তিনি আধুনিকতাবাদী শিল্পকলার প্রতিনিধিত্ব করেন। বিশ্বখ্যাত নরওয়ের এক্সপ্রেশনিস্ট বা অভিব্যক্তিবাদী চিত্রশিল্পী এডওয়ার্ড মুঙ্কও তাঁর বিকট নিশাস্বপ্নের মতো ‘ইভিনিং অন কার্ল জোহান স্ট্রিট’ নামে ১৮৯২ সালে আঁকা ছবিতে দেখিয়েছেন, একটা জটলাও কী ভীষণরকম নিঃসঙ্গ জায়গা হতে পারে।
সত্যি বলতে, একাকিত্ব সমসাময়িক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, বিশেষত ব্যক্তি যখন বড় শহরের বাসিন্দা। এই কারণেই আমাদের সবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতি এত আসক্তি। এটি অন্যের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ স্থাপনের একটা মাধ্যম যেমন, তেমনি ভেতরের আশঙ্কা, অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগ মুখোশে লুকিয়ে রাখবার অন্তর্জালিক আবরণও বটে।
আমরা এখন নিজেদের বিচ্ছিন্নতা আড়াল করে একরকম ভালোই আছি। হপারের মতো শিল্পীরা এই বিচ্ছিন্নতাকেই আধুনিক অবস্থার নির্ণায়ক বলেছেন। স্বাভাবিক সময়ে আমরা ক্যাফেতেও একা বসি, পার্থক্য এটুকুই; যদিও এখন হাতে থাকে আমাদের ‘সামাজিক’ সত্তার প্রতীক সেলফোন। বাস্তবতা হলো, আধুনিকতা জনসাধারণকে নাগরিক জীবনযাত্রার দিকে ঠেলে দিয়েছে, যা একসময়কার প্রথা ‘যূথবদ্ধতা’কে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছে। আমরা মুক্তি-স্বাধীনতা চেয়েছি বলেই নিঃসঙ্গতাকে বেছে নিয়েছি। কিন্তু হপারের চিত্রকর্ম একটা কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি করেছে আমাদের—আধুনিক জীবনের স্বাধীনতাই যদি চলে যায় তবে একাকিত্ব ছাড়া আর কী বাকি রইল?
করোনা-বাস্তবতায় আশঙ্কা-উদ্বেগের প্রতীক হয়ে ওঠা হপারের চিত্রকর্ম আবার একইসঙ্গে কিছুটা হয়তো স্বস্তির বাতাসও বইয়ে দিতে পারছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যত বেশি তাঁর ছবিগুলো ভাগাভাগি হচ্ছে, ততই আমরা মনে করতে পারছি, এই করোনাকালে আমরা সবাই একই তরণীর যাত্রী, সবাই ফেসবুক-টুইটার ঘেঁটে চলছি, মানব অস্তিত্বের ভবিতব্য নিয়ে আলোড়িত হচ্ছি সবাই আমরা কমবেশি।