হ্বিটগেনস্টাইনের দিকে যাওয়া



হামীম কামরুল হক
অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

  • Font increase
  • Font Decrease

“ভাষা, বোঝাপড়া ও জ্ঞান—সবই অতল গহ্বরের ওপর পেতে দেওয়া পাতলা এক জাল।”—তিনি আমাদের অনুভব করিয়েছিলেন, তিনি ল্যুডভিগ হ্বিটগেনস্টাইন। জন্ম ও মৃত্যু দুটোই এই মাসে। জন্ম ২৬ এপ্রিল ১৮৮৯ এবং মৃত্যু ২৯ এপ্রিল ১৯৫১। ভাষা মানুষের শরীর কি মানুষের নানান যন্ত্রপ্রকৌশলের চেয়ে কম জটিল বিষয় নয়। ভাষা দিয়েই এফোঁড় ওফোঁড় করে দেওয়া যেতে পারে পরাতত্ত্ব, নৈতিকতা, ধর্মতত্ত্ব ইত্যাদি। মানুষ লুকিয়ে থাকে ভাষার পেছনে, এমনকি ঈশ্বর বা স্রষ্টাকেও খুঁজে পাওয়া যায় ভাষায়ই। ফলে ভাষা বিষয়টা মোটেও নিরীহ কোনো বিষয় নয়। এর রাজনীতি অর্থনীতিও ভয়ংকর, গূঢ় ও গভীর। ‘ট্র্যাকটেটাস’ ও ‘ফিলোসফিকাল ইনভেস্টিগেশনস’ তার মহান দুইটি কীর্তি হলেও তিনি আরো অনেক দুর্ধর্ষ বইপত্র লিখেছেন। ল্যুডভিগ হ্বিটগেনস্টাইনকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তার জন্ম এবং মৃত্যুদিন স্মরণে রেখে এই লেখা।

হ্বিটগেনস্টাইনকে এককথায় বলা যায় ‘ফ্রি স্পিরিট’—এক অন্তহীন স্বাধীনচেতনাসম্পন্ন মানবসত্তা—অন্তত আমি যতটুকু তাঁকে পাঠ করে ও তাঁর লেখা পড়ে বুঝতে পারি। বিচিত্র জীবনযাপন করেছেন। এক পরিস্থিতি থেকে আরেক পরিস্থিতিতে অনায়াসে যেন যেতে পারতেন। অস্ট্রিয়া থেকে ইংল্যান্ড, কখনো আমেরিকা, রাশিয়াতেও আরেকটু হলে ডেরা বেঁধে ফেলেছিলেন, নিজে কুটির বানিয়ে নির্জনে চলে গেছেন নরওয়েতে। বিচিত্র জীবন—বিচিত্র জীবিকার বহর—অধ্যাপনা থেকে বাগানের মালি, হাসপাতালের আরদালি থেকে ফের অধ্যাপক, আরো কত কী। পিতার সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়েছেন। হয়ে গেছেন কখনো পথের মানুষ, কখনো প্রাসাদের। তিনি যেন হারমেন হেসের আরেক সিদ্ধার্থ। জীবন যেন ঠিক খেলা নয়, লীলার মতো এসেছে ধরা দিয়েছে ছুটে গেছে। ভিয়েনা সার্কেলের সঙ্গে মিশে রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা’ নাটক পড়ে মুগ্ধ। পরে হয়ে গেছেন রবীন্দ্রভক্ত। আবার কোনো বৃত্তে থাকতে চাননি। মনে করতেন, দার্শনিক কোনো গোষ্ঠীর ভেতরে বেড়ে উঠতে পারে না। দার্শনিকতা কোনো দলবদ্ধ বিষয় নয়। আর তিনি তো দার্শনিক না হয়ে হতে যাচ্ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার কিন্তু সেদিকে যাওয়ার আগে রাসেলের কাছে প্রশ্ন করেছিলেন, “উইল ইয়ু প্লিজ টেল মি হোয়েদার আই অ্যাম এ কমপ্লিট ইডিয়ট অর নট?” রাসেল যদি বলতেন হ্বিটগেনস্টাইন একজন মাথামোটা নির্বোধ কেউ, তাহলে তিনি সোজা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ায় ফিরে যাবেন, আর যদি তা না হন তো দর্শনচর্চায় রত হবেন। বাঙালির মধ্যবিত্তের ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় সেকালে কি একালেও একথা কজন ভাবতে পারে যে, ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া বাদ দিয়ে কেউ দর্শন পড়তে চাইবে?

তিনি অস্ট্রিয়ার মানুষ, গুরুত্বপূর্ণ লেখাপত্র অনেকটাই মূলত জার্মান ভাষায়। দিয়েছেন ভাষণ, বলেছেন নানান কথাবার্তা। সেসব নিয়েও আলাদা আলাদা বই আছে। তবে তাঁকে যে তকমাটি দেওয়া হয় সেটি হলো ‘লিঙ্গুয়েস্টিক ফিলোসফি’র সবচেয়ে প্রখর ব্যক্তিদের একজন তিনি। তিনি এমন এক দর্শনের নির্দেশনাকারী যেখানে দর্শন ভাষা ও যুক্তি ছাড়িয়ে যায় না। ভাষার সীমানা ও যুক্তির সীমানা যতদূর তত দূর দর্শন। সক্রেটিস-প্লেটো শুরু করেছিলেন সংলাপে, পরে অনেকেই দর্শনকে নিয়ে গেছেন বচনে বা প্রবচনে। যেমন নিৎসে, যেমন হ্বিটগেনস্টাইনও। তবে ছকে ফেলে দেওয়ার লোক কি তিনি? তিনি তো উড়ালপঙ্খি।

বাংলাদেশে হ্বিটগেনস্টাইনকে প্রথম পাই ২০০০ সালে, মঈন চৌধুরীর লেখা ‘হ্বিটগেনেস্টাইনের দর্শন: ভাষা, চিন্তা, বিশ্ব ও বাস্তবতার স্বরূপ’ নামের একেবারে ছোট্ট একটি বইতে। বইটি মাত্র ২৪ পৃষ্ঠার। প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। মঈন চৌধুরী একেবারেই একটি উপক্রমণিকামূলক কাজ করেছিলেন, মানে ‘ইন্ট্রোডিউসিং হ্বিটগেনস্টাইন’। এতে একেবারে তার সম্পর্কে প্রাথমিক কিছু ধারণা তিনি হাজির করেছিলেন, তবে বইটির মূল অংশজুড়ে ছিল ‘ট্রাকটেটাস’ থেকে অনুবাদ। বিচ্ছিন্নভাবে করা ওই অনুবাদঅংশটি পড়ে যেটুকু বোঝা গিয়েছিল, তাতে মনে হয়েছিল বস্তু, বাস্তবতা, জগৎ ভাষায় আসলে কতটুকু ধারণ করা যায়। আর সেজন্য যুক্তিকাঠামো কতটুকু কার্যকর হতে পারে। এছাড়া ভাষার সীমা, চিত্রের ভূমিকা ও ভাষার স্ফটিকীকরণ, সবমিলিয়ে স্পষ্টকরণ।

‘ট্রাকটেটাসে’র নানান মন্তব্যসমূহ থেকে নানান সময় চমকে চমকে ওঠা আর ভাবা সাহিত্যের ক্ষেত্রে হ্বিটগেনস্টাইন আসলে কিভাবে কাজে লাগে, সবচেয়ে বড় কথা উপন্যাস লিখতে। ‘বিশ্বই সব, এই হচ্ছে ঘটনা।’ বা বিশ্ব হলো সত্য ঘটনার সমষ্টি, বস্তুর সমষ্টি নয়।’—এ পর্যন্ত মগজ সহজভাবে নিতে পারে। ‘মগজে’র সঙ্গে ‘সহজে’র একটা সম্পর্ক আছে, মগজ কঠিন বিষয়কে সহজ করে নিতে পারে যদি মগজের সেই সক্ষমতা থাকে; কিন্তু দ্রুতই বুঝে নিতে হয় এই সহজ সূত্রে হ্বিটগেনস্টাইন টান দিলেন অনেক গভীরে। এতই গভীরে যে তা আমার মতো মানুষের জন্য অতল হয়ে ওঠে।

এর ভেতরে তার দিকে আরো আগ্রহ জাগে। পুরোনো বইয়ের দোকানে ‘দ্য ব্লু অ্যান্ড দ্যা ব্রাউন বুক’ পাই; ২০০৬ সাল তখন। এরপর বাংলা একাডেমি থেকে পাওয়া যায়, আফজালুল বাসারের অনুবাদে ‘ট্রাকটেটাস’। এটি ২০০১ সালে প্রকাশিত হলেও আমি পেয়েছি ২০১১ সালে। আর টের পাই হ্বিটগেনস্টাইনের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে শুরু হয়ে যায় ভাষার খেলা। ভাষার খেলা অবশ্য সেই অ্যারিস্টটলের পোয়েটিক্স থেকে শুরু, পরে জানি, যে-কারণে জেমস জয়েস বারবার অ্যারিস্টটলের পোয়েটিক্স পড়তেন। জীবনকে ভাষার খেলায় নিতে পারার কাজটি যেভাবে দার্শনিক করেন, সেভাবে লেখক করেন না—এটিই হ্বিটগেনস্টাইন থেকে অনুভূত হতে থাকে। এরপর ২০১৩ সালে পেয়ে যাই তার ‘ফিলোসফিক্যাল ইনভেস্টিগেশান’। বিপুল অর্থমূল্যের সেই বই। কিন্তু পেয়ে হাত ছাড়া করার কথা চিন্তাও করিনি। কারণ হ্বিটগেনস্টাইনের মূল যে দুটো বই ‘ট্রাকটেটাস’ ও এই ‘ফিলোসফিক্যাল ইনভেস্টিগেশান’—এছাড়া তো তাঁকে জানা বোঝার উপায় এই বাংলাদেশে বসে তখন আর ছিল না। যদিও পরে জানি, তার আরো কতকগুলি বই আছে—যার প্রায় সবই এখন ইন্টারনেটে পিডিএফে পাওয়া যায়। এছাড়াও তার সম্পর্কে ছোটবড় নানান বইপত্র একে একে জোগাড় হতে থাকে। অক্সফোর্ডের কিছু, আইকন বুকস থেকে প্রকাশিত তাঁকে নিয়ে বই পাই, পাওয়া হয় কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনার তুষার কান্তি সরকার, শেফালী মৈত্র ও ইন্দ্রাণী সান্যাল সম্পাদিত ‘হ্বিটগেনস্টাইন: জগৎ, ভাষা ও চিন্তন’ বইটি। এটি পাওয়ার ভেতর দিয়ে বাংলায় তাঁকে চর্চার একটি কার্যকর বই পাওয়া গেল। উল্লিখিত বইপত্র থেকে তাঁকে যতটুকু ধরতে পারা গেল, তাই বর্তমানে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

আমরা জানি, দর্শনচর্চাকারীর লক্ষ্য হলো জগৎটাকে বোঝা, জীবনকে বোঝা। একজন ঔপন্যাসিকের কাজও জগৎ ও এর মানুষকে বোঝা। আরো আগে জেনেছিলাম, দর্শনের কাজ হলো অস্তিত্বের স্বরূপ সন্ধান ও জীবনের সম্ভাবনাগুলি দেখানো। অল্পস্বল্প দর্শন বিষয়ক বইপত্র পড়ে এইটুকুই আমার মগজ নিতে পেরেছিল। এর ভেতরে হ্বিটগেনস্টাইন করেছেন কী, ভাষার কাজের জায়গাটির সন্ধান দিয়ে চিন্তার স্পষ্টতা ও জীবনের সম্ভবনাগুলি দেখাতে লাগলেন আমাকে।

বস্তু ও বাস্তবতা কী করে জীবন গড়ে দেয়, বা মেটেরিয়াল ও রিয়ালের সংযোগ কোথায়—এ নিয়ে মার্কসবাদের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে, কিন্তু আমি যদ্দূর বুঝতে পারি হ্বিটগেনস্টাইন তার জগতের ব্যাখ্যার জন্য ভিন্ন খুঁটিতে বোধের দড়িটা বাঁধতে চেয়েছেন। তার খুব চালু উক্তি হলো, যা ট্রাকটেটাসেই আছে, যা দিয়ে তিনি মূলত ‘ট্রাকটেটাসে’র আপাত ইতি টেনেছেন। তিনি ১, ১.২, ১.২৩...৪, ৪.১ এভাবে (এর মন্তব্যগুলি দিয়ে তো ‘ট্রাকটেটাস’ গড়া, যেগুলিকে আমরা আয়াতও বলতে পারি) বিন্যাস করেছেন, এর শেষ আয়াত হলো ৭, যেখানে বলছেন, “আমরা যে বিষয়ে আদৌ বলতে পারি না, অবশ্যই সে বিষয়ে নীরব থাকতে হবে।” কিন্তু এ দিয়েই কি ‘ট্রাকটেটাস’ শেষ হয়ে যায়? কত না বিষয় এসেছে তার এই বইতে। বলাবাহুল্য, জীবদ্দশায় তিনি এই একটি মাত্র বইয়ের প্রকাশনা দেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু দেখা যায় পরবর্তীকালে তার প্রকাশিত আরো কিছু বইতে যেমন এর ভেতরে সবচেয়ে বিখ্যাত যেটি যে ‘ফিলোসফিক্যাল ইনভেস্টিগেশান’, তাতে ঠিক ‘ট্রাকটেটাসে’র জায়গায় পড়ে থাকেননি। তবে দর্শনের সাহায্য মানে ভাষার সাহায্যে যে জগৎকে পুরো ব্যাখ্যা করা যায় না—সেটিরও তো আভাস দিয়ে গেছেন তিনি। যে-তিনি ভাষার ভেতরে এত স্পষ্টতার অভিমুখে আমাদের নিয়ে যান, তিনিই বলেন যে, “জগতের মানে জগতের বাইরে বিরাজ করে।” তখন ফের চমকে উঠতে হয়। (একসময় কানে এসেছিল যে বৈজ্ঞানিক আবদুস সালামের চেষ্টা ছিল প্রাণ জগতের বাইরে থেকে এসেছে এটা বের করার, কিন্তু সেটি প্রমাণ করার আগে তিনি গত হলেন।) হ্বিটগেনস্টাইনের কথায় তাই ধাক্কা লাগে। প্রাণ তো প্রাণ, এর তো একটা বস্তুগত দিক আছে; কিন্তু জগতের ‘মানে’ জগতের বাইরে বিরাজ করে—এটা একটা বিরাট গোলকধাঁধায় আমাদের ফেলে দেয় না কি? তাহলে ভাষা দিয়ে জগতের আর কতটুকু ধরা যাবে, যেখানে মানেটাই জগতের বাইরে? আর জীবন? আর মানুষকে, যে মানুষকে নিয়ে লেখকের কাজ, একজন গল্পকার ও ঔপন্যাসিকের কাজ? এখানে থমকে যেতে হয়, তাহলে মনে হয় জীবনের ক্ষেত্রে জীবিকার ক্ষেত্রে হ্বিটগেনস্টাইন যেমন এক মুক্ত স্বাধীন ছিলেন, কোথাও আটকে পড়তে চাইতেন না, সেরকম করে তিনি তার ভাবনাকে মুক্ত করে দিলেন, তার ভাবনাকে বেঁধে দিতে চাইলেন না? কারণ তিনি দর্শনকে (দেকার্তীয় ও তার সমকালের চল অনুযায়ী যা অনেক দিন রাজত্ব করেছিল দর্শনের জগতে) ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা মুক্ত করেছিলেন, ‘আমি’-র প্রাধান্যহীন করে কান্ট ও হেগেলের অসমাপ্ত কাজকে সম্পূর্ণতা দিলেন বলে উল্লেখ করা হয়, সেই তিনিই তো একটি বস্তু ও বাস্তবতা, যুক্তি, চিন্তা পেরিয়ে জগৎকে আমাদের সামনে রেখে গেছেন আরো অনুসন্ধানের জন্য। বিষয়টি যেন এমন, আমার দ্বারা এটুকু করার ছিল, বাকিটুকু তোমরা তোমাদের মতো করে করে নিও, তাই কি?

আরো প্রশ্ন তো হাজির হয়। আসলে প্রাচীন কাল ছিল প্রশ্নহীন বিশ্বাসের, আধুনিক কাল হলো প্রশ্ন ও উত্তরের, আর উত্তরাধুনিককাল হলো প্রশ্নই হয়ে ওঠে প্রশ্নের জবাব—এমন একটা জায়গায় আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরা যারা অবস্থান করছি, সেখানে হ্বিটগেনস্টাইন তো কিছু বিষয় আমাদের কাছে হাজির করেছেন। বা উস্কে দিয়েছেন এমন কিছু যেখানে তাঁকে চর্চার যৌক্তিকতা তৈরি হয়। আমরা যেমন ফার্দিনান্দ দ্যা স্যোসুরের ক্ষেত্রে জানি তিনি শব্দকে তার পরিপ্রেক্ষিত থেকে বুঝে নেওয়ার জন্য বলেছেন, ঠিক তেমন হ্বিটগেনস্টাইন বলেছেন কোনো কিছুকে বুঝতে হলে ‘যাপনের প্রেক্ষাপটে’ বুঝতে হবে। তিনি সহজ একটি দিক হাজির করেছিলেন এভাবে যে, যদি সিংহ কথা বলতে পারত তাহলে কি আমরা তার ভাষা বুঝতে পারতাম? সিংহের ভাষা বুঝতে হবে সিংহের যাপনের পরিপ্রেক্ষিতে। এখানে এসে ফের মনে হলো হ্বিটগেনস্টাইন তো তাহলে যে কথাগুলি আসলে জগৎকে বোঝার মূল কথা সেই কথাগুলিই নিজের মতো করে বলে গিয়েছেন। ফলে তার সঙ্গে অনেকের তফাত থাকলেও মিলও বিপুল। জগৎ, চিন্তা ও ভাষা-র পরম্পরায় কোনটা কোনটাকে মেনে চলবে খেলাটা কেবল তিনি যেভাবে যা হাজির করেছেন। তাতে আমরা আমাদের মতো টের পাই যে জগৎ থেকে চিন্তা তৈরি হবে, তারপর চিন্তা থেকে ভাষা? নাকি উল্টোটা ভাষা তৈরি হলে তবে চিন্তা আর চিন্তা তৈরি হলে পরে জগৎকে বোঝা যায়। আমরা শিশুর ভাষা দিয়ে তো বিষয়টি দেখে নিতে পারি। তার ভাষা শেখা থেকে তার করা নানান প্রশ্নের ভিত্তিতে আমরা জগতের আরেকটি চেহারা পাই। একটি শিশু বা প্রতিটি শিশু তার মতো করে তার আশপাশকে চিনতে চেষ্টা করে, তার চিন্তা শক্তি যতটুকু সেসময় সে ধারণ করে। যদিও হ্বিটগেনস্টাইন দেখান তিনটিই সংযুক্ত।

আমরা জানি, হ্বিটগেনস্টাইন ‘মন’ নিয়েও গভীরভাবে ভেবেছেন। ফ্রয়েড ও তিনি প্রায় সমসাময়িক, আর দুজনেই অস্ট্রিয়ার মানুষ। ফ্রয়েড সাইকোঅ্যানালিসিস দিয়ে যেভাবে মানুষকে বুঝতে চেয়েছেন, হ্বিটগেনস্টাইন সেখানে তার ভাষা-দর্শন দিয়ে জগৎ-জীবন বোঝার জন্য বস্তু ও বাস্তবতার বিন্যাসকে লক্ষ্য করতেই তো বললেন। দুজনের তুলনামূলক আলোচনা করলে দেখা যায়, যে হ্বিটগেনস্টাইন আমাদের উপলব্ধি করান যে, ভাষা, বোঝাপড়া ও জানা বা জ্ঞান এক অতল গহ্বরের ওপরে পাতা পাতলা জাল ছাড়া আর কিছুই না। সেই জালটি সরিয়ে নিলে আমরা কোন যে অতলে তলিয়ে যেতে পারি—ফলে ভাষা, বোঝাপড়া ও জানার সীমানা আমাদের নির্ধারণ করে নিতে হয়। নইলে সমূহ সর্বনাশ ঘটে যেতে পারে।

একটি মানুষের বেঁচে থাকাকে, তার আবেগ-অনুভূতি, তার মমতা-নির্মমতাকে বোঝার ক্ষেত্রে এভাবে হ্বিটগেনস্টাইন আমাদের সহায়তা করেন বোধ করি। সেদিক থেকে ভাষার খেলা মানে জীবনের খেলা। কথার পেছনে যে মানুষ লুকিয়ে থাকে, লুকিয়ে থাকে তার অতল বা নির্জ্ঞান, সেদিকেও নিয়ে যান হ্বিটগেনস্টাইন। জীবন থেকে বিজ্ঞানে, বিজ্ঞান থেকে অভিজ্ঞতায়, বিশ্লেষণ, প্রয়োগ, ভাষা ও চিন্তার সীমা সসীম ও অসীম—কত দিকে ঘুরিয়ে আনেন তিনি। ‘ট্রাকটেটাস’ ও ‘ফিলোসফিক্যাল ইনভেস্টিগেশান’ বই দুটোকে ধারাবাহিক পড়ায় যেমন এক ধরনের পাঠ, তেমন হলো, এর নির্ঘণ্টে গিয়ে নানান বিষয় সম্পর্কে কোথায় কী বলেছেন, সেভাবেও আবার পড়া যায়, মানে জীবন, জীবিকা, অভিজ্ঞতা, দৈনন্দিন ভাষা ব্যবহার, সত্য, বিজ্ঞান, মনস্তত্ত্ব ইত্যাদি কত কত বিষয়ই না আছে।

ফলে হ্বিটগেনস্টাইনের কাছে যাওয়া ও তাঁকে চর্চা করার মানে এক ভ্রাম্যমাণ মন ও মস্তিস্কের সন্ধান পাওয়া। কারণ তাঁকেও তো বুঝতে হবে তার যাপনের পরিপ্রেক্ষিতে, যেখান থেকে তিনি তার পথনির্দেশক গটলব ফ্রেগে ও শিক্ষক বার্ট্রান্ড রাসেলকে পেরিয়ে হয়ে উঠলেন এক ও অনন্য হ্বিটগেনস্টাইন।

   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসবিদ-দার্শনিক মুঈন উদ-দীন আহমদ খান জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন এক মনীষীর নাম। বাংলাদেশের বিদ্যাবৃত্তে ক্লাসিক্যাল চরিত্রের শেষ দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। ২৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার) ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। 

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান (১৮ এপ্রিল, ১৯২৫-২৮ মার্চ, ২০২১) নির্জলা তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের খোঁজে সুদীর্ঘ জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চার কষ্টসাধ্য দিনগুলো অতিবাহিত করেন নি। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের সত্য সন্ধান শুধু তথ্য আর যুক্তি ভিত্তিক নয়। প্রকৃত ইতিহাস মূলত ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাসের পুনর্গঠন, কল্পনা, সমকালীন পর্যালোচনা ও ইনটুইশনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সান্নিধ্যে এলে সবাই এই সত্য টের পেতেন যে, ইতিহাস প্রধানত দর্শন ও সাহিত্যের সমধর্মীতায় বর্তমানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণের এবং দিকনির্দেশনা দেওয়ার অপরিহার্য মাধ্যম। তাঁর স্বকীয় চিন্তার দ্যুতিতে তিনি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা চর্চা ও গবেষণায় একটি বিশিষ্ট ধারার প্রতিভূ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং একটি পুরো জীবন সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাচর্চার ধ্যানজ্ঞানে যাপন করেছেন। আর চট্টগ্রামের নিরিখে তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা কাঠামোর আদি নির্মাতাদের অন্যতম। যেমনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র ড. আবদুল করিম ছিলেন ইতিহাসচর্চার প্রতিষ্ঠাতা, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইংরেজির, ড. আর. আই চৌধুরী রাজনীতি বিজ্ঞানের, তেমনিভাবে তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবদ্ধ বিদ্যাচর্চা ধারার সূচনাকারী। চট্টগ্রামের আধুনিক উচ্চশিক্ষা বিস্তারের আদি মুঘলদের একজন ছিলেন তিনি।  

তিনি ছিলেন আড়ম্বরহীন জ্ঞানসাধক। নিজস্ব বিদ্যাবলয়ের বাইরে তাঁর কোনও আত্মপ্রচার বা আত্মগরিমা ছিল না। যদিও তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা তাঁর আশেপাশে খুব বেশি ছিল না, তথাটি যারা তাঁর রচনা খেয়াল করে পড়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে কিংবা অনানুষ্ঠানিক পরিসরে আলাপ, আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্কের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন, কত ভাষা, কত বিষয়, কত তত্ত্ব ও তথ্যাদি সম্পর্কে অনায়াস দক্ষতা ও পা-িত্য ছিল প্রাচ্যদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের এই জ্ঞানতাপসের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের আদিবাস আর পুরনো চট্টগ্রাম শহরের রুমঘাটা থেকে এই মান্যবর জ্ঞানবৃদ্ধের কাছ থেকে বিচ্যুরিত দীপ্তি কিছু কিছু অনুভব স্পর্শ করেছে দেশে-বিদেশে তাঁর কর্ম ও গবেষণা ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

তাঁর জ্ঞান, গবেষণা, মনীষা, বুদ্ধির দীপ্তি, বহু ভাষায় পারঙ্গমতা তাঁর সমকালে অন্য কারও মধ্যে বিশেষ পরিলক্ষিত হয় নি। বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চায় প্রবাদপ্রতীম ড. আহমদ হাসান দানি যে তিনজন ছাত্রকে গবেষণায় প্রণোদিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান তাঁদের একজন। অন্য দুইজন হলেন আবদুল করিম ও মোহর আলী। এই তিনজনই বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় সত্যিকারের মৌলিক অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে প্রথম বিভাগ, স্বর্ণপদক, ফেলোশিপ ও বৃত্তি লাভ করেন একজন মেধাবী ছাত্র রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর তিনি মোটেই থেমে থাকেন নি। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ফিরে এসে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানির তত্ত্বাবধানে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ বিষয়ে পথপ্রদর্শনকারী পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ফেলোশিপ লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলের ‘ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ রাজনীতি বিজ্ঞানের ‘সেমিনার ইন ফিল্ড ওয়ার্ক কোর্স’ অধ্যয়ন করেন। তিনি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রখ্যাত প-িত, ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের সান্নিধ্যে এসে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হন। যে কারণে, পরবর্তী জীবনে তিনি ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, বিশেষত এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের ক্ষেত্রেও নিজের অবদান রাখেন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থীদের ছাড়াও তাঁর মূল-বিষয়ের বাইরের লোকজনকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন নেতৃস্থানীয় শিক্ষক যথাক্রমে মর্শন বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান বদিউর রহমান এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন শব্বির আহমদ তাঁর অধীনে পিএউচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

গবেষণা তত্ত্বাবধানে তিনি ছিলেন প্রচ- রকমের শুদ্ধতাবাদী। একটি প্রকৃষ্ট গবেষণার জন্য ¯œাতকোত্তর ও এমফিল পর্যায়ের গবেষকদেরও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত করতেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে গবেষক হিসাবে স্বাধীনভাবে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তাঁর সাথে গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড. আফম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, “তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর অনুমোদন নিয়ে কলকাতা, লক্ষেœৗ, দিল্লি, তুঘলকাবাদ, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, মক্কা ও মদিনা সফর করি।” কোনও মতে একটি ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার অসৎ পন্থার বিপরীতে গবেষণাকে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর করতে তিনি ছিলেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শুদ্ধতম তত্ত্বাবধায়ক। শেষজীবনে তাঁর সঙ্গে বা পরামর্শে যারা গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মানস গঠনে ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নির্মাণে তিনি শ্রমবিমুখ ছিলেন না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা বই-পুস্তক পর্যালোচনায় লিপ্ত হতেন। এমন চিত্র আমি নিজে তাঁর বাসভবনে উপস্থিত কালে লক্ষ্য করেছি। কখনও নবাগত গবেষকদের তিনি অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে পাঠাতেন। তাঁর রেফারেন্সে একাধিক তরুণ গবেষক আমার কাছে এসে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাঁর রেফারেন্সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা সম্পন্ন করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ত ও প্রণোদনাদাতা রূপে ছিলেন নিরলস।   

কঠোর তথ্যনিষ্ঠা ও শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের প্রতিটি রচনায়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলো যে কারণে একই সাথে পাঠকপ্রিয় এবং অ্যাকাডেমিক জ্ঞান ভা-ারে মণি-মুক্তা তুল্য। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব ফরায়েজি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’ একটি পথিকৃৎ গবেষণা, যা ‘বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে। যে ফরায়েজি আন্দোলনকে ওয়াহাবি আন্দোলন বা তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া নামেই সবাই জানতো, তিনি তাঁর বহুমাত্রিক চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত করেন।  ফারায়েজি আন্দোলন যে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম ও আদি প্রচেষ্টা, তিনিই সর্বপ্রথম তা প্রমাণ করেন। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উত্থিত এই আন্দোলনের গণমুখী চরিত্র, ঔপনিবেশিকবাদ বিরোধী বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু মানসিকতার বিষয়াবলী তিনি ঐতিহাসিক তথ্য ও ধর্মতাত্ত্বিক মাত্রায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে উপস্থাপন করেন। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও বৃহৎ ক্যানভাসে গবেষণার কৃতিত্বে তিনি এই বিষয়ে এবং ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বিনির্মাণের পথিকৃৎ প্রাণিত স্বরূপে সর্বমহলে সম্মানীত হয়েছেন। 

পরবর্তীতে প্রকাশিত মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের গ্রন্থ ও প্রবন্ধে তিনি তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ রেখেছেন। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর লেখায় দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি বহুবিদ্যার প্রকাশ ঘটেছে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও গবেষণার বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাধারাকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করার প্রয়াস। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী দার্শনিকদের মতো সংলাপ-প্রবণ ব্যক্তিত্ব। কেউ আগ্রহী হলে কিংবা কারো প্রতি তিনি আগ্রহী হলে তাঁকে বা তাঁদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতেন। তিনি তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো বইয়ের পাতার শুকনো অক্ষরে বন্দি ছিলেন না, জ্ঞানবৃত্তের মানুষের সঙ্গে প্রাণবন্ত সংলাপ ও সংশ্লেষের মাধ্যমে সদা জীবন্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে তো বটেই, বৃহৎ বঙ্গদেশে খুব কম সংখ্যক প-িতই এমন ছিলেন, যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অন্যকে প্রণোদিত করার ক্ষমতা ধারণ করতেন। ঢাকায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং চট্টগ্রামে ড. আবদুল করিম, ড. আর. আই. চৌধুরী ছাড়া কম প-িতই ছিলেন, যারা শিক্ষার্থীদের প্রাণিত করার ক্ষেত্রে মনীষী মুঈন উদ-দীন খানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য।

জ্ঞানের সঞ্চার ও বিস্তারে তাঁর অসীম কষ্ট সহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও বিনয় তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের প্রাচীন জ্ঞানতাপসের আধুনিক প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমি তা স্পষ্টভাবে অনুভব করি। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। এবং বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন আমার চেয়ে কয়েক প্রজন্ম অগ্রগামী। তথাপি অশীতিপর বয়সে এসেও তিনি আমার কোনও লেখার প্রতি আগ্রহী হলে নিজে ফোন করে জানিয়েছেন। ডেকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং বিষয়টিকে তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে আরও সমৃদ্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেসব আলোচনায় জ্ঞানতত্ত্ব ও তুলনামূলক দর্শন সম্পর্কে তাঁর অতলস্পর্শী পা-িতের দীপ্তিমান প্রভার আঁচ পাওয়ার বিরল সুযোগ আমার হয়েছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছিল, বহু তরুণকে তিনি গবেষণার দিক-নির্দেশনা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দিতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মধ্যে পথ প্রদর্শনের একটি বিরল গুণ ছিল। আর ছিল জ্ঞানকে অকাতরে ছড়িয়ে দেওয়ার উদার মানসিকতা, যা আজকের অ্যাকাডেমিক প্রতিযোগিতার পঙ্কিল ও সঙ্কীর্ণমনা ধারার প্রেক্ষিতে অকল্পনীয় বিষয়। বড় মন ও মুক্ত মানসিকতার কারণে তিনি ‘বাংলাদেশের লিলিপুট প-িতদের সমাবেশে’ মহীরূহ-সম ব্যক্তিত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের মতো বিটপী ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যপটে রেখে আজকের ক্ষুদ্রতর পরিসরে আলোচনা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানের ঊন-মানুষ ও ঊন-মানসিকতার পরিম-লে তাঁর মতো বড় মানুষের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। তিনি এবং তাঁর সমগোত্রীয়রা শেষ মুঘলের মতো দৃশ্যপট থেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু রেখে গিয়েছেন ধ্রুপদী ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্বের দীপ্তি ও বিভা। তিনি ছিলেন প্রথম প্রজন্মের আধুনিক বাঙালির হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সকল অগ্রণী প-িত, গবেষক ও শিক্ষাব্রতীগণের শ্রেষ্ঠতম ও উজ্জ্বল প্রতিনিধি, যারা  জাগতিক প্রাপ্তির আশায় জ্ঞানের সাধনা করেন নি। জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার নিতান্ত আবশ্যক পরিসীমার বাইরেও তাঁরা সচরাচর যান নি। তাঁদের নিতান্ত আবশ্যক বস্তুর তালিকায় সর্বাগ্রে ছিল জ্ঞানচর্চা, বিদ্যার্জন ও গ্রন্থপাঠ। বিষয় ভিত্তিক প্রয়োজনীয় বইয়ের বাইরেও অন্য বিষয় সংক্রান্ত রচনা তাঁরা পড়তেন আনন্দ ও কৌতূহল নিবৃত্তির সুতীব্র আকর্ষণে। কারও কারও পুস্তক সংগ্রহ আর রোজগারের মধ্যে কোনও ভারসাম্য থাকতো না। জাগতিক উন্নতির বিষয়গুলোকে তাঁরা তুচ্ছ বিবেচনা করে অবজ্ঞা করেছেন। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর মতে, “যে জীবনে বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা বিরল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ সত্যিই সারস্বত-কর্মে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বর্তমানের বিশ্লেষণপ্রবণ গবেষণার ধারা তখনও প্রবল হয় নি। কিন্তু অনেক গবেষণাই গভীর পা-িত্যের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতো।” মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান সম্পর্কে এই বক্তব্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আত্মমগ্ন ধ্যানীর মতো সারা জীবন তিনি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থেকে গভীর পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু নিজেই নন, প্রণোদিত করেছেন পরবর্তী বেশ কিছু প্রজন্মের উৎসাহী তরুণদের, যাদের অনেকেই বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত রয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে ইতিহাসের আরেক মহান সাধক যদুনাথ সরকারের কিছু কিছু বিষয় তুলনীয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রবল পরিশ্রম, জ্ঞান তৃষ্ণা এবং অনুসন্ধান। যদুনাথের বিশ্লেষণের নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বিতর্ক থাকার পরেও ইতিহাসচর্চায় তিনি সর্বজনমান্য আচার্য। তিনি নিজের কর্ম ও জীবন আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতেন: “পথের প্রান্তরে করি নাই খেলা/শুধু বাজায়েছি বসি সারাবেলা/ছিন্নতন্ত্রী বীণা।” মনীষী প্রফেসর ড. মুইন উদ-দীন আহমদ খানও সারাজীবন জ্ঞানচর্চার বাঁশরী বাজিয়েছেন। একটি আস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের মাধ্যমে। বিদ্যার্চচাকে পেশাগত পরিম-লে জিম্মি না করে জীবন ও যাপনের মূলমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সব কিছুই তিনি করেছেন নিজের সুমৃত্তিকা ও মানুষকে কেন্দ্র করেই। জীবনের পর্বে পর্বে নানা দেশে, নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তিনি অবশেষে ফিরে এসে আলোকিত করেছেন প্রিয় মাটির প্রিয় মানুষদের, প্রিয় জনপদকে। জীবনের দিনগুলোর মতোই মৃত্যুর পরেও তিনি আলোর দিশারী হয়ে দেদীপ্যমান রয়েছেন জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যামুখী অভিযাত্রীদের চৈতন্যের মর্মমূলে।  

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম  সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;

তোমার বীণায় সুর ছিল



প্রদীপ্তকুমার স্যানাল
দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘দিল্লী চলো, চলো দিল্লী’ সুভাষকণ্ঠে আটত্রিশ কোটি আশি লক্ষ হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর যেন এই মুহূর্তে পাচ্ছি আবার শুনতে। দিল্লীর মাটিতে স্বাধীন বাংলার প্রথম রাষ্ট্রপতি পা দিলেন-অবিস্মরণীয় সেই মুহূর্তে শুনি বিস্ময়কর অভিভাষণ, ভারতের আকাশে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত সাড়ে সাত কোটির কণ্ঠস্বর একটি কণ্ঠে। মুজিবর রহমান ..সেই নাম। আমি জানি, নামমাত্র নয় সেই নাম; সমস্ত বাঙালীর সংগ্রামের নামান্তর সে নাম আমাদের আগামীকালের ইতিহাস গড়বে।

লন্ডনের হোটেলে ছিন্নবেশে পা দিয়েছিলেন তিনি যাঁর নির্দেশে বীণা তুলে নিয়েছে ছিন্নকণ্ঠ, মানুষ শুনেছে মৃত্যুর গর্জন সঙ্গীতের মতো। সেই নেতার গলায় স্বাধীন বাংলার প্রথম বরমাল্য তুলে দেওয়ার মহত্তম সৌভাগ্যের অধিকারী আমরা। ভারতবর্ষ তাঁর ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছে কণায় কণায়। এই মুহূর্তে সমস্ত কিছুর রং বদলে গেছে। এপারের মানুষও উন্মাদ হয়েছে ওপারের মানুষের উদ্বেল হওয়ার মুহূর্তে।

স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি থেকে-যে বিপ্লবী বীর এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে অগ্রসর প্রথম পদাতিক মুজিব (?) তুমি আমাদের ..চিত্তের প্রণতি গ্রহণ করো। তোমার মুখে ‘আমার সোনার বাংলা তোমায় ভালোবাসি’ বাংলার জাতীয় সঙ্গীত হল..। কত আন্দোলনে যে বাংলা ভাষা প্রাণ ফিরে পেয়েছিল তা প্রাণবন্ত হল দিল্লীর জনসভায় তোমার অভিভাষণের জোযারে। দেশবন্ধুর মৃত্যুহীন প্রাণ নেতাজী, আর সেই প্রাণের নিঃসীম স্পন্দন তোমার নেতৃত্বের অঙ্গে অঙ্গে।

শেখ মুজিব তাঁর বক্তৃতায় বলেছেনঃ আমি মানুষ, আমি বাঙালী, আমি মুসলমান। বাঙালীর হৃদয় থেকে উৎসারিত যত কথা যত ভাব সব নেতার একটি ঘোষণায় সুস্পষ্ট চেহারা নিয়েছে। এর চেয়ে সত্য ভাষণ আর কি হতে পারে! সবার উপরে মানুষ সত্য-মনুষ্যত্বের দাবী সবার আগে। মানুষের বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠায় পৌঁছবার লক্ষ্যে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তার প্রথম পর্যায় সমাপ্তির মুখে। এর চেয়ে সত্যোন্মুক্ত বাণী নেতৃত্বের জবানীতে আর কি হতে পারে? সর্ব প্রথম মানবমুক্তি তার পর অন্য প্রয়োজন। ভাই শেখ সাহেব তাঁর ভাষণের প্রথমেই বলেছেন, প্রতিহিংসার নয় ক্ষমার ক্ষমা সুন্দর মুখকে বাঙালী নিভৃতেও ফুটিয়ে তোলার কথা। এই অন্যায় অবিচারের তুলনা বিরল, দুর্ঘটনায় পরিসমাপ্তির সন্ধিক্ষণে শত্রুকে ক্ষমা করার ঔদার্যে মহিমান্বিত প্রসন্নোক্তি আর কবে কোথায় শোনা গেছে? দেশের মানুষকে কবে কোথায় কোন নেতৃত্বের অভয়বাণী যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই শোনাতে পেরেছে শান্তির ললিতবাণী। তাই মনুষ্যত্বের কথা, মানুষের কথা ওঁর মুখে মানায়। অসহযোগ আন্দোলন পূর্ণতম সাফল্যকে সর্বাত্মক মুক্তির আগমন মুহূর্তে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ দেওয়া যাঁর নেতৃত্বে সম্ভব সেই নেতার মুখেই মানায় শান্তির বাণী। দুর্বলের মুখে শান্তির প্রয়াস হাস্যকর নয় শুধু অট্টহাসিকরও বটে।

বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম শুরু হওয়ার পরেই-বিভিন্ন মুখে শুনেছি এর নানা বিশ্লেষণ, বৃহত্তর হিসেব নিকেশ। তবু যা একবারও শুনিনি, একটি মানুষের মুখেও যে সত্য উক্তি একবারের জন্যও শোনা যায়নি, তা হল, এ সংগ্রাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর সংগ্রাম, এ সংগ্রাম বাঙালীর জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম। সেই দুর্ণিবার জাতীয়তাবোধকে ইজমের ধোঁয়ায় অন্ধকারে যদি বিপথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত তবে ইয়াহিয়া চক্রের পক্ষেও সম্ভব ছিল এ যুদ্ধ জয় করা। বাঙালীয়ানাই বাঙালীর সবচেয়ে উজ্জ্বল সত্য চরিত্রচিত্র। তাই দিল্লীর জনসভায় মুজিবের কম্বুকণ্ঠে যখন শুনিঃ

‘‘আমি জানতাম না আবার আপনাদের মধ্যে ফিরে আসতে পারব। আমি ওদের বলেছিলাম তোমরা আমাকে মারতে চাও, মেরে ফেল। শুধু আমার লাশটা বাংলাদেশে আমার বাঙালীদের কাছে ফিরিয়ে দিও।’’

তখন তাঁকে শুধু বাংলা বলব, না, সমস্ত মানুষের দুঃখে তার নেতার কণ্ঠে একে বেদনার করুণ বিপ্রলম্ভ বলব। তবু এত ভালবাসা, এত ¯েœহসিক্ত আনন্দের নির্ভরতা বাঙালীর জাতীয়তাবোধ ছাড়া আর কোন পথে আসা সম্ভব। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সঙ্গীতের এই প্রথম লাইনেই বঙ্গহৃদয় সোনা হয়ে গেছে। এই গান মুখে নিয়ে বাঙালী প্রাণ দিয়েছে। তবু এই সংগ্রামকে যদি বাঙালী জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম না বলি, তবে মিথ্যা ভাষণের ফল আমাদের পেতেই হবে। বাঙালীর বাঁচারও বটে মরারও বটে একমাত্র প্রশ্ন তার ভাষা। এ সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মুহূর্তে। বাঙালীর সবচেয়ে কোমল সবচেয়ে নিভৃত মর্মকোষ তার ভাষা। সেই কোমল স্থানেই আঘাত করে শাসনচক্র চেয়েছিল বাঙালীকে নিশ্চিহ্ন করতে। বেদনায় বিক্ষত বাঙালী হৃদয় কঠিনতম প্রতিজ্ঞায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সে প্রতিজ্ঞা সফল হয়েছে। সেই সফলতার উৎসে বাঙালীর সবচেয়ে প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ। বাঙালী কবি। তাই কবিতাই তাকে রক্তাক্ত করেছে, করেছে সুজলা সুফলা।

এমন কঠোরে, কোমলে, আনন্দ বেদনায়, হাসিকান্নার হীরাপান্নায় আর কোন দেশের ইতিহাস হয়ে আছে গাঁথা। ধর্ম নিয়ে অধর্মের রাজনীতি করার পুরণো পথ পরিত্যাগ করেছে বাংলাদেশ। দুর্দিনে অশ্রুজলধারায় বাঙালীর চেতনা থেকে ধর্মান্ধতার ক্লেদ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। বাঙালী মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ অথবা খৃষ্টান এসব কিছুই নয়। বাঙালীর একমাত্র পরিচয় যে বাঙালী। এই সত্যটুকু বাঙালীকে বুঝে নিতে রক্তের মূল্য দিতে হয়েছে বারংবার। যতদিন বাঙালী হিন্দু, মুসলমান অথবা বৌদ্ধ, খৃষ্টান ছিল, ততদিন জঙ্গীশাহীর শোষণের থাবাও ছিল অপ্রতিহত শক্তিতে উদ্যত। যে মুহুর্তে বাঙালীর মুখ থেকে খসে পড়েছে ধর্মীয় বাধানিষেধের মিথ্যে মুখোশ সেই ক্ষণ থেকেই শোষণে কায়েমী সিংহাসন বাংলার মাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেল। কারণ এই ধর্মীয় বাধানিষেধকে সম্বল করেই দীর্ঘদিনের শোষণে পাক জঙ্গীচক্র বাংলার মানুষকে নিঃস্ব করেছে, সব কিছু লুঠে নিয়েছে বাংলার বুক থেকে। রক্তস্নাত বাংলা আজ শোষণহীন, বাঙালীর আজ একটি মাত্র পরিচয় সে-বাঙালী।

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক এবং সবার বড় কথা সে আজ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। মুসলিম ইতিহাসে এ এক বিরাট নজির। ধর্ম আজ বাংলাদেশে ব্যক্তিগত বিষয় ছাড়া কিছুই নয়। তার নেতার কণ্ঠেও আজ এরই প্রতিধ্বনি। বাংলাদেশের সাথে ভারতবর্ষের পরবর্তীকালে কি সম্পর্ক দাঁড়াবে তা এই প্রথম দিনেও সুস্পষ্ট। বাংলা এবং ভারতের নীতি এক এবং সে নীতি দুর্ণীতির মুলোচ্ছেদ। বাংলাদেশের পাশে বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে এগুতে পেরে, পৃথিবীর পৃথিবীর মহত্তম স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশে একমাত্র সাহায্যদাতা হিসেবে থাকতে পেরে ভারতবর্ষ বিশ্বের শক্তির ভারসাম্য সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। অন্যের কৃপাকণায় বেঁচে থাকার দুর্দিন আজ ভারতবর্ষের সৌভাগ্যের ঊষা লগ্নে অপসৃত। মুজিবের কণ্ঠে কৃতজ্ঞতার সহৃদয় সম্ভাষণ ভারতবর্ষের মানুষকে ঘিরে, ইন্দিরাকে ঘিরে। বাংলাদেশ তার চরম দুর্ভাগ্যের মধ্যে ভারতবর্ষকে যে বন্ধুত্বের মর্যাদায় বসিয়েছে তা ক্ষুন্ন হওয়া কোন চক্রান্তেই সম্ভব নয় আর।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সাফল্যের দ্বারে উপনীত করার প্রতিটি পদক্ষেপে নেতা মুজিব পেয়েছেন নেতাজীর ভাব নির্দেশ। আমরা আজ গর্বিত। বাংলার মানুষের দুঃখের বটে সুখেরও বটে সমান অংশীদার ভারতবর্ষ। মুজিবের নেতৃত্বে নেতাজীর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে আসমুদ্র হিমাচল। (নিবন্ধে প্রদীপ্তকুমার স্যানাল ব্যবহৃত বানানরীতি অবিকৃত রাখা হয়েছে)।

প্রথম প্রকাশ: রবিবারের বসুমতী সাময়িকী, ১৬ই জানুয়ারি ১৯৭২; দৈনিক বসুমতী

সংগ্রহ ও সম্পাদনা: আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

;