বসফোরাসের সোনালি কোমর জড়িয়ে সুফির চক্রনৃত্য
ভ্রমণ হচ্ছে, লিসা সেন্ট অবিন যুতসই বলেছেন, জীবনের সাথে ছিনালী করা (To flirt with life)। আবার আমাদের অনেকের অত্যন্ত প্রিয় লেখিকা নবনীতা দেবসেন মনে করেন, পর্যটন অনেকটা কৃষ্ণপ্রেম বা মাদকের মতো যার আকর্ষণ উপেক্ষা করা ভক্ত বা আসক্তের পক্ষে অনেকটাই দুঃসাধ্য। পর্যটন বিষয়ে আরেকটা উক্তি মনে পড়ছে—একজন ব্যক্তি যখন বুঝতে পারেন যে, তার জীবন মূল্যহীন, তখন তিনি হয় আত্মহত্যা করেন অথবা দেশভ্রমণ করেন। জীবনের সাথে শেষ ভৌগোলিক ফ্লার্ট করেছিলাম বছরখানেক আগে সিঙ্গাপুর আর ইন্দোনেশিয়া ঘুরে। বছরও ঘোরেনি অথচ এর মধ্যেই গালিভার সিন্ড্রোম মনের ওপর চেপে বসেছে আরব্য রজনীর দৈত্যের মতো—মন-মাঝি আঁকুপাঁকু করছে আবার বৈঠা ধরার। সিদ্ধান্ত নিলাম আত্মহত্যা করব, ঘাবড়াবেন না। অর্থনৈতিক হারাকিরি বা Lucrecide (Financial suicide) করে জগৎ সংসার দেখতে বেরিয়ে পড়ার ইচ্ছার কথা বলছি।
খেয়াল করলাম, ভ্রমণ পৌনঃপুনিকতায় আমার ট্রাভেল প্রোফাইলে গত কয়েক বছরে প্রাচ্য বেশ এগিয়ে গেছে—যদিও ভূ-পর্যটন শুরু করেছিলাম পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ দর্শন দিয়ে। প্রাচ্যতম দেশ অর্থাৎ জাপানও যখন দেখা হয়ে গেছে, এবার তাই নতুন প্যারামিটার এক্সপ্লোর করতে পছন্দের দেশ প্রতীচ্যের পড়শি তুরস্ক। তুরস্কের বাৎসরিক সেমিনার সিম্পোজিয়ামের লিস্ট দেখে গবেষণা প্রবন্ধের প্রতিপাদ্যসার পাঠালাম সেলজুক (তুর্কিরা উচ্চারণ করে ‘সেলচুক’) ইউনিভার্সিটিতে। সেলচুক বেছে নেওয়ার কারণ হলো এটা আল্লামা রুমীর শহর কোনিয়াতে অবস্থিত। আর বাড়তি পাওনা হলো গুরু-শিষ্যের (রুমী আর শেমসে তেবরিজ) শহর ইস্তাম্বুল থেকে প্রায় সাতশত কিলোমিটার দূরে। ফলে, চৌদ্দশত কিলোমিটার পথ আসা যাওয়াতেই তুরস্কের একটা বিশাল অংশ দেখা হয়ে যাবে। এই আসা যাওয়ার জন্য, প্রসঙ্গত বলা অসঙ্গত হবে না, বাষ্পীয় রথ বা হাওয়াই রথ নয়, আমার পক্ষপাত সরাসরি স্থল শকট অর্থাৎ বাসের দিকে। যুগপৎ রথদর্শন আর রম্ভা ফেরির চেষ্টা আর কি!
অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে সেলচুক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমন্ত্রণপত্র আসলো। আমার কর্মস্থল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জিও, এনওসি ইত্যাদি নিয়ে এজেন্সির মাধ্যমে তুর্কি ভিসার জন্য আবেদন করলাম। হাতে সময় একদম কম। এর মধ্যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসী আটক হওয়ায়, যারা তুরস্ককে তাদের রুট হিসেবে ব্যবহার করেছে, ঢাকাস্থ তুর্কি দূতাবাস আগের মতো আর বৈধ কাগজপত্র থাকলেই ভিসা ইস্যু করছেনা। তারা রয়ে-সয়ে ভিসা ইস্যু করাতে যাত্রার নির্ধারিত দিনের মাত্র দিন চারেক আগে ভিসা পেলাম। এই ফাঁকে তুর্কি দূতাবাসের ওয়েবসাইটে ঢু মেরে দেখলাম বাংলাদেশি অফিসিয়াল পাসপোর্টধারীরা বিনা ভিসায় (অর্থাৎ ভিসা অন এরাইভাল) দেশটি সফর করতে পারেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ দীর্ঘদিন ধরে অফিসিয়াল পাসপোর্ট দাবি করে আসছেন। এ সুবিধাটা থাকলে আমাদের শিক্ষক-গবেষকগণ কত হয়রানি আর অহেতুক বাড়তি খরচ থেকে বেঁচে যেতেন! যেমন, একেবারে শেষ সময়ে পাসপোর্ট হাতে পাওয়াতে শুধু বিমান ভাড়া বাবদ আমার বাড়তি খরচ হয়েছে ত্রিশ হাজার টাকা। ভিসা ফিস, এজেন্সি খরচ, হোটেল রিজার্ভেশন ইত্যাদিসহ অহেতুক পকেট থেকে বেরিয়ে গেছে প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক টাকা! অথচ আমার সরকারি পাসপোর্ট থাকলে এই টাকাটা দেশেই থেকে যেত। অবশ্য, সুইস ব্যাংকে যে গরিব দেশের অবৈধ ধনীরা মিলিয়ন-বিলিয়ন পাচার করে, সে দেশের জন্য এ আর এমন কী অর্থ!
যাক, শেষ মুহূর্তে সব প্রস্তুতি তড়িঘড়ি সম্পন্ন করে একুশে অক্টোবর ভোর ছয়টায় টার্কিশ এয়ার লাইন্সে করে ইস্তাম্বুলের উদ্দেশ্য ঢাকা ত্যাগ করি। অনেক বেশি ভাড়া সত্ত্বেও তুর্কি ন্যাশনাল ক্যারিয়ার পছন্দ করার মূল কারণ হলো এতে সরাসরি ঢাকা থেকে সাত ঘণ্টায় ইস্তাম্বুল পৌঁছা যায়। অন্য এয়ার লাইন্স যেমন সৌদি বা কুয়েত এয়ারে অনেক কম খরচে যাওয়া যায় কিন্তু তাতে জেদ্দা বা কুয়েতে ট্রানজিট নিয়ে কানেক্টিং ফ্লাইট ধরতে হবে যা বেশ ঝামেলাপূর্ণ আর সময় সাপেক্ষ। তুরস্কে আমার অবস্থানের মেয়াদ ছিল দশদিন। এই সময়ে অফিসিয়াল প্রোগ্রামে উপস্থিতিসহ তুরস্কের মতো একটা বিশাল দেশ দেখা প্রায় অসম্ভব। ইউরোপীয় মানদণ্ডে আন্তঃমহাদেশীয় এই প্রজাতন্ত্র কত প্রকাণ্ড তা ধারণা করতে একটি হিসাব দিয়ে রাখি—তুরস্কের আয়তন ইউরোপের পাওয়ার হাউজ যুক্তরাজ্য, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম এবং সুইজারল্যান্ডের সমন্বিত আয়তনের চাইতেও বেশি! বিশালায়তন তুরস্ক, আহমেদ দাভোটুগ্লু যথার্থ বলেছেন, একটি ইউরোপীয় দেশ, এশীয় দেশ, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ—এটি আবার বলকান আর ককেশীয় অঞ্চলের দেশ, কৃষ্ণ আর কাস্পিয়ান সাগরেরও দেশ। এই বহুমাত্রিক বৈচিত্র্যপূর্ণভূমিতে দশদিনে যতটুকু বতুতাগিরি করে দর্শনানন্দ লাভ করেছি তা সরলরৈখিকভাবে বয়ান না করে ঘটনাক্রম হিসেবে পাঠকদের সাথে ভাগ করে নেওয়ার প্রয়াস রাখছি।
ইস্তাম্বুল গ্র্যান্ড এয়ারপোর্টে
টার্কিশ এয়ারে বেশ আয়েশেই যথাসময়ে ইস্তাম্বুলের ঝাঁ চকচকে নুতন এয়ারপোর্টে অবতরণ করি। দিনটি ছিল রৌদ্রস্নাত। টার্মিনাল থেকে ইমিগ্রেশন, পথ দেখি শেষই হয় না। অবশ্য, বিরক্ত লাগেনি মোটেই। পরে জেনেছি, বারো বিলিয়ন ডলারের এই IGA (Istanbul Grand Airport) যার আয়তন প্রায় ঊনিশ হাজার একর (পনেরোটা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের সমান!) বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিমান বন্দর। এর আগে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিমান বন্দর ছিল যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টা হার্টসফিল্ড-জ্যাকসন বিমান বন্দর যার বাৎসরিক যাত্রী হ্যান্ডলিং ক্যাপাসিটি ১১০ মিলিয়ন। ২০২৫ সালে IGA এর সবগুলো টার্মিনাল চালু হলে এর ক্যাপাসিটি হবে ২০০ মিলিয়ন! অবশ্য, তুরস্কের আগের প্রিমিয়ার বিমান বন্দরটিও, যার নাম আতাতুর্ক বিমান বন্দর, ৭০ মিলিয়ন যাত্রী পরিবহন করে বিশ্বের ব্যস্ততম বন্দরের একটি ছিল।
যাক, ওসমানীয় সাম্রাজ্যের মুকুট ইস্তাম্বুলের অর্জনের নূতন পালকটির সুলতানি মাত্রার শানশওকত দেখতে দেখতে ইমিগ্রেশন শেষ করে বাইরে চলে আসি। বলে রাখি, এখানেও ‘দরিদ্রভার্যা সার্বজনীন ভ্রাতৃবধু’ নীতির প্রায়োগিক দিকটি পুনঃঅবলোকন করি। ইমিগ্রেশন কাউন্টারের তুর্কি দূহিতা বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেখে বেশ সতর্কতার সাথে কাগজপত্র নিরীক্ষণ করে, তার সিনিয়রের সাথে কথা বলে পাসপোর্টে সিল মারে। ইতর আদম-হাওয়া ব্যাপারীরা বাংলাদেশের ভালে চিরস্থায়ী কলঙ্ক-তিলক পড়িয়ে দিয়েছে।
বাংলার নবাবজাদে, ঠিকানা ফিন্দিকজাদে
আল্লাহর অশেষ রহমতে বিশ্বের যেসব দেশে গিয়েছি, প্রায় সবখানেই কিছু উন্নত-হৃদয় মানুষ পেয়ে গেছি যাদের আন্তরিকতায় আমার বিভূঁইয়ে অবস্থান স্বস্তিদায়ক আর স্মরণীয় হয়েছে। যেমন, জাপানে পেয়েছিলাম ড. সুমনকে। সুমন কানাজাওয়াকে আমার জন্য চট্টগ্রাম বানিয়ে ফেলেছিলেন। থাইল্যান্ডে দিদার ভাইয়ের সঙ্গ সফরটাকে একেবারে রমণীয় করে তুলেছিল। কুয়ালালামপুরে অবস্থানকালীন ড. শামীম হামিদী আর তার পত্নীর আতিথ্য-উষ্ণতায় মনেই হয়নি বৈদেশে আছি। আর সিঙ্গাপুরে তো একেবারে ঘরের ছেলে জয়নালের সার্বিক তদারকিতে ছিলাম। শ্বেতদ্বীপের লন্ডনে তো রীতিমতো তারকাপুন্জের (Galacticos) আলোয় উদ্ভাসিত ছিলাম। নেপাল-ভারতে গিয়েছিলাম প্রিয় শিক্ষক, সহকর্মী আর শিক্ষার্থীদের আমুদে দলের সাথে। একমাত্র ইন্দোনেশিয়াতে ঘুরেছি যাকে বলে, Alone, all alone।
তো, তুরস্কেও আসার আগে বেশ কজন দেশি তরুণ তুর্কির সাথে যোগাযোগ করে এসেছি। তাদেরই একজন চটপটে, করিৎকর্মা যুবক হেলালী। IGA থেকেই বেশ চড়া দামে Vodafone-এর দশদিনের একটি ট্যুরিস্টপ্যাকেজ কিনি ফলে যোগাযোগের কোনো সমস্যা হচ্ছিল না। Havaist Bus-এ চেপে মাত্র পনেরো লিরা দিয়ে চলে আসি আক্সারাই মেট্রো স্টেশন। এত উন্নত বাস আর ততোধিক উন্নত সার্ভিস মাত্র ২৩০ টাকায় বাংলাদেশে কষ্ট-কল্পনার বিষয়। স্টেশনের নাম মনে রাখার জন্য আমার নিমোনিক কোড ছিল ‘মোগলসরাই- আকশারাই’। বেশ খোশ মেজাজে আক্সারাই এসে পেয়ে গেলাম তালেবে এলেম হেলালীকে। সেখান থেকে দৃষ্টিনন্দন একটা পার্ক পেরিয়ে ফিন্দিকজাদে—আমার ডেরা হোটেল ইলচুক আর হেলালিদের তুর্কি-মঞ্জিল।
হোটেলে ওঠার আগে সামনে বার্গার কিংয়ের আউটলেটে দুজনে উদরপূর্তি করলাম। সত্যিকারের মোগল হয়ে হেলালী আমাকে কার্ডে হাত দিতে দিল না। উপরন্তু, রাতের খাবারও তার বাসায় খেতে হলো। ডিনার শেষে রীতিমতো দলবলের এসকর্ট নিয়ে ইলচুক হোটেলে উঠি। নিজেকে মনে হচ্ছিল হাসান আল বলকিয়ার ক্ষুদ্র ভ্রাত! রাত এগারোটার পর নিশাচর হেলালী হোটেল লবি থেকে কল দিল—স্যার আসেন, আপনাকে রাতের ইস্তাম্বুল দেখাব। আমি যেন এই আহ্বানের ইন্তেজারই করছিলাম। ফলে উৎসাহের উত্তাপে অক্টোবরের শীত চাপা পড়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে, তুর্কি চোষ্য-চর্ব্য আস্বাদন আর বিখ্যাত ‘চায়ে’ পান করে হোটেলে ফিরে রাজসিক ঘুম। এক সুখনিদ্রায় রজনী পার! [চলবে]