জীবনের কলরবের অপেক্ষায়

  • সঞ্জয় দে
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

আমাদের বাড়ির খুব কাছেই একটা পার্ক। এর চারদিকে বাঁধানো পথ। সেই পথটিকে দুধার থেকে জাপটে ধরার চেষ্টা করে প্রুস আর উইলো গাছের ঋজু প্রশাখা। আজ সকালে সেখানে হাঁটতে গেলাম। প্রায় দু সপ্তাহ ধরেই হাঁটতে যাবার ইচ্ছে থাকলেও হয়ে উঠছিল না। কারণটা—বৃষ্টি। ইলশেগুড়ি বৃষ্টিও নয় একেবারে মুষলধারে বর্ষণ। আমার বাড়ির টালির চালে লাগানো সোলার প্যানেলে সেই বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা একসাথে ঝরে কারণে সৃষ্টি হয় এক অদ্ভুত ঐকতান। আমি সেই তানে এতোটাই বিমুগ্ধ হয়ে কান পেতে থাকি যে, বাকি সব কাজ শিকেয় ওঠে।

সেই পার্কের পথটিতে আজ আমি ছাড়া আর কেউ নেই। সাধারণত এমনটা কখনো হয় না। সব সময়েই এখানে কারো না কারো উপস্থিতি থাকে। সকালের দিক হলে থাকে চাইনিজ বুড়িদের একটা ছোট্ট দল। তাদের দলনেত্রী তার ঝুলিতে করে আনা রেডিওটি চালিয়ে পার্কের বাকি সবাইকে শোনান প্রাচ্যদেশীয় সঙ্গীত। সেই সঙ্গীতের তালে তালে বাকি সবাই ফুরফুরে হাওয়ায় উৎফুল্ল হয়ে ওঠা অবস্থায় যখন হাঁটে, তখন সেই দলটি মত্ত থাকে শারীরিক নানা কসরতে। দু একজন আবার পার্কের মাঝখানে ঘাসের জমিনে উঠে পোষা কুকুরের চেইন খুলে দিয়ে চিৎকার করে বলে, ‘রান মাই বয়, রান।’ কুকুরগুলো বন্ধনহীনতার আনন্দ পেয়ে এমন ছুট লাগায়, ভ্রম হয়—তারা পার্কের অপর ধারে থাকা কারুর ওপর হামলে পড়তে যাচ্ছে। কিন্তু ওরা ওদের সীমানা জানে। তাই পার্কের শেষ মাথায় গিয়েই গাড়ির হার্ড ব্রেকের মতো করে থেমে যায়। তারপর মনিবের দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকায়, যার অর্থ হলো—নাউ হোয়াট?

বিজ্ঞাপন

আজ সেই কুকুরগুলোও উধাও। তার বদলে আছে একপাল পিঁপড়ে। ওরা দলবেঁধে সড়কের এপার থেকে ওপারে যাচ্ছে। সুনসান সড়ক বলে মনুষ্য পদতলে পিষে মরার খুব একটা ভয় নেই। সেই মুহূর্তে আমি পার্কের ঘাসে ঢাকা জমিনের দিকে নজর করে দেখি এক অদ্ভুত দৃশ্য।

এমনিতে এই পার্কের চারধারে অসংখ্য কাঠবিড়ালির বসত হলেও ওরা সহজে দেখা দেয় না। কখনো কখনো এ পাড়া থেকে ও পাড়ায় যাবার প্রয়োজন হলে লেজ তুলে ভোঁ দৌড় লাগায়। পেছন থেকে কেবল দেখা যায়—ওদের বাদামি লেজের খানিকটা। সেই লজ্জাবনত প্রাণীদের এক বিশাল দল আজ পার্কে রোদ পোহাচ্ছে। একেবারে সমুদ্রতটে পেতে রাখা বেঞ্চে সৌখিন গৃহী মানুষেরা যেভাবে সূর্যের দিকে মুখ করে শুয়ে থাকে, অনেকটা সেই ভঙ্গিতে। তাদের এই শুয়ে থাকার মাঝেও আছে এক অদ্ভুত জ্যামিতিক বিন্যাস। এখানে-ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নেই ওরা। বরং অপর পক্ষের ওপর আক্রমণ হানতে উদ্যত পরাক্রমশালী রাজার সৈন্যবাহিনীর মতোই তারা শুয়ে আছে কয়েকটি সরল রেখায়, একই দিকে মুখ করে।

বিজ্ঞাপন

হঠাৎ কোথা থেকে যেন এক ঝলক হাওয়া ভেসে আসে। এ শহরে ঋতুচক্র আবর্তিত হয় একটু ভিন্ন রূপে। শীতের পর বসন্ত নয়, বরং এখানে ঘনঘোর বর্ষার পর নিশ্চুপ প্রগলভতায় চুপি চুপি হানা দেয় বসন্তের কমলা রোদ। পথের পাশের রুক্ষ ঢালু জমিতে ঘুমিয়ে থাকা আইস প্ল্যান্টের ঝোপগুলো বেগুনী ফুলের পাপড়ি মেলে রঙের বাসরে চারদিক সাজায়। বাতাসে থাকে ফুলের রেণুর তাজা গন্ধ। আর সেই ঘ্রাণে মৌমাছিরা মাতাল হয়ে গুনগুন করে ঘুরে বেড়ায়। এর সঙ্গে থাকে তাজা, কবোষ্ণ হাওয়া—যে হাওয়া এই মুহূর্তে আমাকে ভাসিয়ে দিল। মিষ্টি সুরভিত হাওয়ায় স্নান করে আমার চোখ যায় পার্কের কোণের শিশুমঞ্চের দিকে। বালির ভেতরে জেগে থাকা কয়েকটি স্লিপার আর লোহার স্প্রিঙের সাথে আটকে থাকা খেলনা গাড়ি। নিশ্চল। নিঝুম। যেন সেই চেরনোবিলের ঘটনায় পরিত্যক্ত শহর প্রিপায়েতের শিশু পার্ক। যে পার্কটি মনে করিয়ে দেয়, এক সময়ে হয়তো সেখানেও শিশুদের কোলাহল ছিল। আজ নেই। তারা সবাই কোথাও যেন পালিয়ে গেছে। আর প্রবাহমান সময়ের অন্য সীমায় এই পার্কের স্লিপারকে দেখছি ধীরে ধীরে গ্রাস করা শুরু করেছে শৈবালের পাতলা স্তর। আমি ভাবতে থাকি, এই পার্কটিও কি তেমনিভাবে একদিন পরিণত হবে শৈবাল আর মরিচার অভয়ারণ্যে?

তবে দেখলাম শিশুরা না থাকলেও একজন মানুষ অন্তত আছেন এখানে। একে আগে খেয়াল করিনি। সিকামোর গাছের ছায়ায় লেপটে থাকায় তিনি হয়তো আমার দৃষ্টিসীমায় কোনো কম্পন তৈরি করেননি। ইনি একজন গৃহহীন মানুষ। ভবঘুরে। সাথে একটি সাইকেল। পুরো সংসারটি এতেই চাপিয়ে ঘোরেন। সাইকেলটি গাছের কাণ্ডে ঠেস দিয়ে তিনি বসে আছেন গাছের ছায়ায়। ভাবখানা এমন—সাইকেলে করে বিশ্ব পরিভ্রমণের এক পর্যায়ে এখানে এসে দু দণ্ড জিরিয়ে নিচ্ছেন। গায়ে ময়লাটে জ্যাকেট। মাথায় উদ্ভ্রান্ত চুল। গালের বাদামি দাড়িগুলো নেমে এসেছে বুক অবধি। চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে। সে দৃষ্টি অবাঙময়। যেন তার কিছুই বলবার নেই, এ জগতের কিছুই তার শুনবার নেই; পৃথিবীর ব্যথাতুর কান্না স্পর্শ করার কোনো ইচ্ছেই তার এ মুহূর্তে নেই। যোগী পুরুষের মতো তিনি ধ্যানস্থ ভঙ্গিতে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন দূরের গাছের শাখামূলের কাছে থাকা একটি গোল্ডফিঞ্ছ পাখির দিকে।

মুহূর্তের জন্যে আমার মনে হয়, আমি এই লোকটির মতো ভাবলেশহীন হতে চাই। চারিদিকে মৃত্যুর কথা শুনে ক্লান্ত আমি। অবসন্ন। এই ক্লান্তি আর অবসন্নতা আমার রাতের ঘুমে দুঃস্বপ্ন হয়ে ধরা দেয় আজকাল। সেই প্রখ্যাত সুইডিশ চলচ্চিত্র নির্মাতা ইঙ্গমার বার্গম্যানের ‘বুনো স্ট্রবেরি’ ছবিটির প্রারম্ভিক দৃশ্যের মতো। ছবির নাম ভূমিকায় থাকা বুড়ো প্রফেসর স্বপ্নে দেখেন—একাকী এক নগরের পথ ধরে হাঁটছেন। কিন্তু কী আশ্চর্য! তিনি ছাড়া সেই রোদপ্লাবিত নগরে আর কেউ নেই। তিনি মানুষ খোঁজেন, প্রাণের সন্ধানে এদিক-ওদিক তাকান। হঠাৎ একটি লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পেছন থেকে এগিয়ে যান। কিন্তু ঘাড়ে হাত রাখতেই সেই মানুষরূপী মূর্তি ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ে। এরপর সহসাই দেখেন—একটি কফিনবাহী ঘোড়ার শকট এগিয়ে আসছে। সহিস নেই। যেন কেউ দূর থেকে ঘোড়ার বুকে অদৃশ্য চাবুক মেরে গাড়িটিকে চালাচ্ছে। গাড়িটি চকিতে একটা লাইটপোস্টে আটকে যায়। কফিনটি ছিটকে পড়ে মাটিতে। তিনি এগিয়ে গেলে কফিনের ডালা থেকে একটি হাত এসে তাকে জাপটে ধরে। এটুকু দেখার পর প্রফেসরের ঘুম ভেঙে যায়। বিশ্বের বুকে হামলে পড়া এই করোনার থাবাকে আমার মনে হয় সেই কফিনের জ্যান্ত হাত। আমাদের দিকে অলক্ষ্যে হাত বাড়িয়ে জাপটে ধরতে চাইছে। কখনো পারছে। কখনো পারছে না। পারুক আর নাই পারুক, ঠিক অমন একটা অশরীরী হাতের ভয়ে শহরের সড়কগুলো আজ বিজন, প্রাণের জন্যে বুভুক্ষু।

ইঙ্গমার বার্গম্যানের বুনো স্ট্রবেরি সিনেমার প্রারম্ভিক দৃশ্য

যারা এই পার্ক কিংবা সড়ককে পরিত্যাগ করে নিজেদেরকে স্বেচ্ছাবন্দী করেছেন, তাদেরকেই-বা দোষ দিই কী করে? মহামারি তো এমনই। যেখানে যায়, যখন যায়, পারমাণবিক বোমার হল্কার মতো সবকিছুকে গ্রাস করে নেয়। আতঙ্কগ্রস্ত মানুষের পালাবার পথ থাকে না। শবের পাহাড় জমিয়ে তবেই ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয় মহামারির ঘূর্ণিবায়ু। যে প্রজন্ম সেই বায়ুর ঝাপটার মাঝে পতিত হয়, তারা হয়তো দুর্ভাগা। কিন্তু মানব ইতিহাসে সেই দুর্ভাগা প্রজন্ম তো এসেছে বারে বারে। নিয়তির অমোঘ ইশারায়। মহামারির এই করাল থাবার শিরশিরে ইঙ্গিত বহুকাল আগে পেয়েছিলাম মনটেনিগ্রতে। কোটর শহরে। পুরনো দুর্গে ঘেরা সে শহরে নানা গলি-ঘুপচি পেরিয়ে প্রদোষ বেলায় ঢুকেছিলাম কুমারি মা মেরীর এক চার্চে। ভেতরটা কেমন গুমোট। পোড়া মোম আর ধূপের গন্ধের সাথে স্যাঁতস্যাঁতে এক ভাব যুক্ত হয়ে সেই ভেতরকার পরিবেশকে দিয়েছে প্রাচীনতার আভাস। চার্চের বাঁ দিকের দেয়ালে লেপটে থাকা এক মার্বেল স্লেটে লিখে রাখা কয়েক ছত্র বাণী পড়ে তো আমি হতভম্ব। স্তব্ধ। চতুর্দশ শতকের কোনো এক সময়ে প্লেগ এসে হানা দিয়েছিল এ শহরে। মোটামুটি পুরো শহরটিকেই গিলে খায় প্লেগ। যারা প্রাণ হারালেন তাদেরকে পরে সমাধিস্থ করা হয় এই চার্চের বেসলট পাথরের মেঝেটির তলে। আশা ছিল, মরজগতে হেরে গেলেও মেরীর আশীর্বাদে তাঁর হাত ধরে মৃতেরা হয়তো স্বর্গের দরজা অবধি পৌঁছুতে পারবেন। পুরোটা পড়ে আমার আতংকে নীল হয়ে যাবার দশা! অর্থাৎ আমি যেখানটায় দাঁড়িয়ে আছি, ঠিক তার নিচেই হয়তো আছে কোনো কফিন? কফিনের ভেতর ঝুরঝুরে হলদেটে কঙ্কাল? ছিটকে বেরিয়ে এসেছিলাম সেই চার্চ থেকে।

সেদিন সেই চার্চ থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসার উপায় থাকলেও বর্তমানের বাস্তবতা থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসি কী করে? ফাউচি নামক এক মৃদুভাষী বিজ্ঞানী প্রতিদিন হোয়াইট হাউসের সবুজ বাগানে দাঁড়িয়ে যে স্পষ্ট কথাগুলো বলেন, সেগুলো তো সেই বাস্তবতাকেই আরো বেশি করে চিনিয়ে দেয়। জলদ গম্ভীর স্বরে বলা তার কথাগুলো মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে কোনো ছলাকলা করে না, বরং যেন বলে দেয়—প্রস্তুত হও। ফাউচি তো বটেই, বিশ্বের তাবৎ সংবাদপত্রকে আমার আজকাল মনে হয় সেই মেডুসা রাক্ষসীর মতো। ক্যারাভাজিও যে রাক্ষুসিকে এঁকেছিলেন নিজের সমস্ত শিল্পী সত্তা দিয়ে। পুরাণে আছে, সর্প দিয়ে মস্তকমণ্ডিত এই রাক্ষুসি যার দিকে সরাসরি তাকাত, সে-ই প্রাণকে বিদায় জানিয়ে প্রস্তরীভূত হতো। ইহলোকের প্রতি মমতাসম্পন্ন মানুষেরা তাই এই রাক্ষুসির দিকে তাকাত আড়চোখে, নয়তো দর্পণের প্রতিচ্ছবিতে চোখ রেখে। আমি সেভাবেই এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করি এখনকার সকল খবর, সকল দুঃসংবাদ।

এভাবে এড়িয়ে গিয়ে আমি আসলে কী প্রত্যাশা করি? কিংবা আমার অবচেতন মন কী খুঁজে পেতে চায়? আমার সেই প্রত্যাশার এক ঝলক সন্ধান আমি কিন্তু পেয়ে যাই পার্কে তিন পাক হাঁটার পরপরই। হঠাৎ দেখি, পার্কের পাশে অনেকটা খাড়া উঠে যাওয়া যে পাহাড়সারি, সেগুলোতে দুটো ঝোপ দুলছে। অকস্মাৎ সেখান থেকে বেরিয়ে আসে দু বালক। একজনের মাথায় সেই রোমান সৈনিকদের মতো ঝুটা শিরস্ত্রাণ। অন্যজনের হাতে নকল বন্দুক। ওরা একজন অপরজনকে তাড়া করছে। হয়তো ওদের একজন ভালো মানুষ, অন্যজন মন্দ মানুষের ভূমিকায় খেলা করছে। হাসতে হাসতে দুজনেই উঠে যায় পাহাড় বেয়ে। ওদের কল্লোলে দুলে ওঠে উইলো গাছের ঝোপের পত্রমণ্ডলী।

আমি বেশ আনন্দ দিয়ে ওদের প্রস্থান দেখি। কিছুটা হলেও মনুষ্য কলরবের সন্ধান পাওয়ায় বেশ ফুরফুরে হয়ে ওঠে আমার মন।