অচেনা পঁচিশে বৈশাখ
-
-
|

ছবি: বার্তা২৪.কম
চির নতুনে ডাক দিয়ে প্রতিবছরের মতো এসেছে পঁচিশে বৈশাখ। কিন্তু আজকে ১৪২৭ বঙ্গাব্দের পঁচিশে বৈশাখ বড় অচেনা। উৎসব বিহীন। কিছুটা নিঃসঙ্গ ও বেদনার্ত। বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে মৃত্যু ও রোগাক্লিষ্ট পৃথিবীতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অনন্য পুরুষ, কথা-ছন্দ-সুরের মহানায়ক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের [(বাংলা ২৫ বৈশাখ, ১২৬৮-২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮), (খ্রিস্টীয় ৭ মে, ১৮৬১-৭ আগস্ট, ১৯৪১)] ১৫৯তম জন্মবার্ষিকী এসেছে অভাবনীয় নৈশব্দকে সঙ্গী করে।
বাংলাদেশের তাপিত ও পীড়িত পঁচিশে বৈশাখে প্রাণের মুক্তধারার মতো জন্মেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১২৬৮ বঙ্গাব্দের (১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দ) পঁচিশে বৈশাখ উত্তর কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুরবাড়িতে কবির জন্ম। রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী বাংলার, বাঙালির চিরায়ত সাংস্কৃতিক উৎযাপনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও করোনার কারণে বরাবরের মতো আনন্দঘন পরিবেশে পালিত হবে না কবিগুরুর জন্মদিনের উৎসব। সার্ধশতবর্ষ পেরুনো মহাকবির জন্মতিথি এমন অচেনা ও অভাবনীয় রূপে আর আসেনি, যেমনটি ঘটলো পঁচিশে বৈশাখ ১৪২৭ বঙ্গাব্দ তথা ২০২০ সালে।
রবীন্দ্রনাথের রচনা সম্ভার বহুমাত্রিক, বিশাল বিপুল, বৈচিত্র্যময়। সাহিত্যের প্রায়-সকল ক্ষেত্র ও শাখা তার অবাধ বিচরণে, মোহন স্পর্শে ও উজ্জ্বল উপস্থিতিতে ঋদ্ধ-সমৃদ্ধ। বিস্ময়কর সৃজনী প্রতিভা দিয়ে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা সাহিত্যকে। তার কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, নাটক, সংগীত, শিশুতোষ রচনা, পত্র-সাহিত্য বাংলা সাহিত্যের অমর সংযোজন, যার মধ্যে রয়েছে:
৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্য সংকলন। তদুপরি, তার মোট ৯৫টি ছোটগল্প এবং ১৯১৫টি গান যথাক্রমে 'গল্পগুচ্ছ' ও 'গীতবিতান' সংকলনে অন্তর্ভুক্ত। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত ও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২টি খণ্ডে 'রবীন্দ্র রচনাবলী' নামে প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের সময় পত্র-সাহিত্য ১৯ খণ্ডে 'চিঠিপত্র' সংকলনে ও অন্য চারটি পৃথক গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর রচনা বিশ্বের প্রায়-সকল ভাষায় অনূদিত হয়ে প্রকাশ পেয়েছে।
এশিয়ার মধ্যে রবীন্দ্রনাথই প্রথম, যিনি ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলী কাব্যগ্রন্থের জন্য নোবেল পুরস্কার পান, যা বিশ্বসাহিত্যে বাংলা ভাষার গৌরবময় সম্মান বৃদ্ধি করে এবং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির আলোকচ্ছটা বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়।
বহুমাত্রিক রবীন্দ্রনাথ এতকিছুর পরেও শেষ জীবনে স্বকীয় নান্দনিক ভাবনায় সমৃদ্ধ করেছেন চিত্রকলাকেও। একাধিক চিত্রকর্মে তিনি রেখেছেন শিল্প-নন্দনের অনুপম দৃষ্টান্ত। শিল্পবোধের ক্ষেত্রেও তিনি স্বাতন্ত্র্যবোধ ও অনন্যতায় দীপ্ত।
গানে, লেখায়, কর্মে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছেন সৃষ্টির আলোয় আলোয় পরিপূর্ণ এক অনিন্দ্য জগৎ। জগতের আলো ও অন্ধকার, আনন্দ ও বিষাদ, মানুষ ও সমাজের নানা বিন্যাস তিনি অঙ্কন করেছেন কথায় ও সুরে। বাঙালি জীবনের অনেকাংশ জুড়েই রবীন্দ্রনাথের অবস্থান। আর বাংলা সাহিত্যের তিন মহাস্তম্ভের মধ্যমণি তিনি, যার অগ্রে মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং পশ্চাতে কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে তিনি সম্মিলিত ভাবে নির্মাণ করেছেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সার্বভৌম আধুনিক দিগন্ত।
কীর্তিময় জীবনে সাহিত্য-সংস্কৃতির বাইরেও কর্ম প্রবণ রবীন্দ্রনাথ গতিময়তায় জ্যোতিতে উদ্ভাসিত। ঔপনিবেশিক যুগের শ্লথগতি ও শতবিঘ্ন উপেক্ষা কিংবা কবুল করে তিনি ভ্রমণ করেছেন বিশ্বের সব কয়টি মহাদেশ, অতিক্রম করেছেন জগতের সকল সাগর ও মহাসাগর।
এমনকি, তার ঘটনাবহুল জীবনে দেখা পাওয়া যায় সাংগঠনিক কাজ ও সামাজিক উদ্যোগের একাধিক উদাহরণ। কৃষক ও পল্লি উন্নয়নের কথা ভেবে তিনি চালু করেছিলেন কৃষিঋণ-ব্যবস্থা। শিক্ষা নিয়ে ভেবেছেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়।
জীবন ও কর্মের এতোটাই বিপুলতার মধ্যে তিনি মিশেছেন জন থেকে জনে। প্রেমে ও বিরহে আকণ্ঠ পান করেছেন জীবনের সবটুকু সুধা। জন্মের আনন্দকে সৃষ্টি ও নির্মাণের স্রোতে ছড়িয়ে দিয়েছেন বাংলার, বাঙালির জীবনের সর্বব্যাপ্ত অঙ্গনে। ব্যক্তিগত দুঃখ-যাতনাকেও আত্মস্থ করেছেন অন্তর্গত নিভৃতিতে এবং শোকে ও বিষাদে আত্মমগ্ন হয়েও, সুতীব্র বেদনার জল ছুঁয়েও, বিনির্মাণ করেছেন বর্ণময় সৃজনের আভায় রাঙানো এক নান্দনিক ভুবন।
রবীন্দ্রনাথের অসামান্য ও অননুকরণীয় কৃতিত্ব হলো 'দুখের তিমিরে' তিনি জ্বালিয়েছেন 'মঙ্গল আলোক', 'হাসির ছটা' দিয়ে ঢেকেছেন 'অশ্রুজল'। কর্ম ও সৃষ্টির হিমালয়তুল্য বিশালতায় গৌরবান্বিত করেছেন জীবনকে। জীবনের সকল অপ্রাপ্তি, বিষাদ ও বেদনাকে রূপান্তরিত করেছেন প্রাপ্তি, সৃষ্টি ও নির্মাণের আলোকময়-আনন্দযজ্ঞে।
ফলে, করোনার কারণে পঁচিশে বৈশাখ অচেনা, অভূতপূর্ব ও অভাবনীয় হলেও, তিনি রবীন্দ্রনাথ আমাদের চিরচেনা, চিরসখা।
আরো পড়ুন: বেদনার্ত রবীন্দ্রনাথ