সত্য ও কল্যাণের দেবী মিনার্ভা আর তার মায়ের গল্প
হাসপাতালে অজ্ঞাত পরিচয়ের মিনার্ভার অবস্থাটা কোনোভাবেই নজরে পড়ার মতো ছিল না। তার প্রথম কারণ হলো তার প্যারালাইসিসের ধরন; ঘাড় থেকে পা পর্যন্ত প্রায় পুরোটাই অবশ শরীর ছিল তার। আবার যারা বাচ্চা পালক নিতে আসে, তারাও মিনার্ভাকে দেখে আপ্লুত হতো না। কেননা ওর বয়স তখন ছিল পাঁচ কিংবা ছয়ের মতো। একজন নবজাতকের যতখানি সৌন্দর্য আর সম্ভাবনা থাকে তা তো আর ওর মধ্যে নেই! তাই কে-ই-বা আর পালক নেবে ওকে! কারো নজরেই পরত না সে! তাই তো সে সাত মাস যাবত প্রায় অচ্ছুত অবস্থায় পড়ে ছিল হাসপাতালের ফ্লোরে। শুয়ে থাকতে থাকতে ঘা হয়ে গিয়েছিল পিছনটায়। না ছিল নিয়মিত গোসল, না ছিল পরিচ্ছন্নতার দায় কারো। দগদগে ঘা, নিশ্চল শরীর, হাসপাতালের নোংরা ফ্লোর, মশা মাছির ভনভনানি—এতসব অসম্ভবনার মধ্যে, সম্ভবনা ছিল একটাই—সেটা হলো ওর ডান হাত। ডান হাতটা নাড়াতে পারত সে এক-আধটু। তাই তো হাসপাতালের আয়ারা খাবারটা মেখে দিয়ে যেত। মিনার্ভা ওর আধা অবশ ডান হাতটা এপাশ ওপাশ করে টলতে টলতে কোনো রকমে চামচে করে খাবারটা ঢোকাত মুখে। খাবারটা দেওয়া হতো একটা ভারী মাটির হাড়িতে। যেন নড়বড়ে ওই হাতের নড়াচড়ায় প্লেটের দায়িত্ব নেওয়া হাড়ির খাবারটা না পড়ে যায়।
বেঁচে থাকবার কী ভয়ানক আকুতি! মিনার্ভার বেঁচে থাকার এই আকুতির কি এখানটাতেই শুরু? না না ভুল হলো; ওর সম্পর্কে যতদূর জানা যায়, সাতমাস আগে আরো একবার মৃত্যু হার মেনেছিল ওর কাছে। যখন ওকে পাওয়া যায় শহীদ মিনারের সামনে। কেউ জানে না কী ধরনের এক্সিডেন্ট হয়েছিল ওর। নার্স আর আয়াদের কাছ থেকে জানা যায়, খুব জখম ছিল গায়ে। কে বা কারা মেরে অজ্ঞান করে ফেলে রেখে যায় শহীদ মিনারের কাছে। স্থানীয় লোকজন ধরাধরি করে দিয়ে যায় সরকারি এই হাসপাতালে। সরকারি হাসপাতাল; কোনো রোগীকেই ফিরিয়ে দেয় না তারা। তাই তো ওরা মিনার্ভাকে ভর্তি করাতে বাধ্য; যদিও ওর জ্ঞান ছিল না, টাকা ছিল না, আর ছিল না কোনো আত্মীয় স্বজন। কত নিখোঁজ স্বজনকেই তো এই হাসপাতালে খুঁজতে আসে লোকে। ওকে কিন্তু কেউ খুঁজতেও আসেনি কখনো। সেই অবস্থাতেই ওর অপারেশন হয়। অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে আইসিইউতে অজ্ঞান অবস্থায় থাকতে হয় পুরো একমাস। এই একমাসেও একটিবারের জন্যও মিনার্ভার কোনো আত্মীয় আসেনি খোঁজ নিতে। একমাস পরে ওর জ্ঞান ফিরে আসে। তখন বোঝা গেল, বেচারি কথাও বলতে পারে না। ও কি জন্ম থেকেই বোবা? নাকি কোনো পাশবিক অত্যাচারে সে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে তা জানা যায়নি কখনো। অথবা, এমন কি হতে পারে যে সে বোবা ছিল বলেই হয়তো তার ওপর অত্যাচার করা সহজ হয়েছে? একই কারণে হয়তো কেউ খুঁজতেও আসেনি তাকে?
যে দেশে ‘মাছের মতোই থাকে শিশুর আড়ত’ সেই দেশে মিনার্ভারা কই যাবে? হাঁটতে পারে না, কথা বলতে পারে না, শরীর নড়াতে পারে না, সেবা প্রতিষ্ঠানের গায়ে হাজার হাজার টাকা ছুড়ে দিতে পারে না—কই যাবে তারা? তার না আছে বর্তমান, না আছে সম্ভাবনা। নেহায়েতই মারা যায়নি অথবা আমরা এতখানি নিষ্ঠুর এখনো হয়ে উঠিনি যে এমন একটা সম্ভাবনাহীন বাচ্চাকে মেরেই ফেলব, তাই হয়তো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আইসিইউ থেকে তাকে ওয়ার্ডে রেখে যায়। ওয়ার্ডে মানে যে মিনার্ভা বিছানা পেয়েছিল তা তো না; এমন কি ঘরের মধ্যে ফ্লোরও না। সে পড়ে ছিল বারান্দার ফ্লোরে। এই, ঠিক এইভাবেই পড়ে ছিল পুরো সাতটা মাস।
এই সাতমাসে হাসপাতালে বহু লোক এসেছিল তাদের নিখোঁজ আত্মীয়ের খোঁজে। আরো বহু লোক এসেছিল পিতা মাতাহীন, স্বজনহীন অজ্ঞাত বাচ্চাদেরকে পালক নিতে। কিন্তু ওর দিকে কেউ তাকায় না। মিনার্ভার এখন যিনি মা, তিনিও কিন্তু ওর জন্য হাসপাতালে যাননি। তিনি গিয়েছিলেন আরেকটি অভিবাবকহীন নবজাতককে দেখতে। সাংবাদিক হিসেবে এই ফেলে যাওয়া বাচ্চাদের খবর তিনি আগে আগেই পেয়ে যান। কিন্তু সুস্থ নবজাতকের চাহিদা বেশি; নিঃসন্তান দম্পতিরা চট জলদিই নিয়ে যান তাদের। তাই নার্স তাঁকে বুদ্ধি করে মিনার্ভার কথা বলেছিলেন। না না, মানে ঠিক পালক নিতে বলেননি। শুধু অনুরোধ করেছিলেন যেন প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করে এমন কোনো প্রতিষ্ঠানে এই বাচ্চাটাকে পাঠানো যায়। মিনার্ভার মায়েরও একই ভাবনা ছিল; তিনি ভাবছিলেন একটু সুস্থ করে ওকে কিভাবে কোনো এক হোমে বা ওর বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া যায়।
বাড়ি খোঁজার গল্প থেকেই মিনার্ভার সাথে তার মায়ের দেখা সাক্ষাতের শুরু। দগদগে ঘা দেখে শিউরে উঠেছিলেন প্রথম দিন। হাসপাতালদের আয়াদের অর্থের বিনিময়ে অনুরোধ করেন যত্ন নিতে; গোসল করাতে আর শরীরটাকে নিয়ম করে এপাশ ওপাশ করাতে। সেই থেকে প্রায় দশ-বারোদিন ওকে প্রত্যেকদিন গোসল করানো হতো, শরীর উল্টে পাল্টে দেওয়া হতো যেন ঘায়ের জায়গাটা আলো বাতাস পায়। পিছনের ঘা-টাও শুকিয়ে আসছিল তাই। আর অন্যদিকে মায়ের চলতে থাকে অন্য সংগ্রাম। একদিকে ওর সেবা যত্ন নিশ্চিত করা, আট ঘণ্টার অফিস করা, আর চব্বিশ ঘণ্টার বাসার দায়িত্ব। উপরন্তু মেডিকেল হিস্ট্রি খোঁজা, ওর পরিবারের খোঁজখবর নেওয়া, একই সাথে খোঁজা কোনো হোম আছে কিনা যাদের কাছে ও থাকতে পারবে। ডাক্তারদের দ্বারে দ্বারে ঘোরা শুরু হলো ওর হিস্ট্রি খোঁজার তাগিদে। কোনোভাবে যদি বের করা যায় কী হয়েছিল, কিভাবে এলো ও এখানে, কী ধরনের একসিডেন্ট হয়েছিল, কথা কি কখনোই বলতে পারত নাকি পারত না। যে দেশে শয়ে শয়ে শিশুরা নির্যাতিত হয় প্রতিনিয়ত, সে দেশে এই সব ধরনের আশঙ্কা করতে না চাইলেও তো চলে আসে মনে।
ডাক্তাররা একটা সময় পর বিরক্তও হয়ে উঠছিলেন মায়ের ওপর। সব মিলিয়ে খুব বেশি কিছু জানা যায়নি মিনার্ভার অতীত সম্পর্কে। এমনকি ও আগে থেকেই প্যারালাইজড ছিল, নাকি বীভৎস কোনো ঘটনায় এমন হয়েছে—তাও জানা যায়নি হাসপাতাল থেকে। আর জানা যাবেই বা কিভাবে? প্রত্যেকদিন পাঁচশোর মতো মিনার্ভা আসে এই হাসপাতালে। সেখানে এক মিনার্ভা; প্রায় নির্জীব এবং সম্ভাবনাহীন। তাও আবার সাত আটমাস আগের কথা! কে-ই-বা জানে আর কারই বা দায় পড়েছে ওতখানি মনে রাখার! এ তো গেল অতীতের কথা। তার ওপর আবার যোগ হয় বর্তমানের আরেক সংগ্রাম। ব্যক্তি হিসেবে দত্তক নেওয়ার হাজার হ্যাপা; কাগজ পত্র, প্রমাণ সবুদ জোগাড় করো। তার উদ্দেশ্য কী, আরো তিনটা বাচ্চা থাকতে কেন এমন একজনকে নিবে, ইত্যাদি হেন তেন আমলাতান্ত্রিক বিষয়াদি। বাচ্চা যদি পেয়েও যায় কিভাবে ওকে বাসায় রেখে সে আটঘণ্টা অফিস করবে তার চিন্তা! এর মধ্যেই তার সাথে যোগাযোগ হয় সাভারের এক পুনর্বাসন কেন্দ্রের, যারা বাচ্চাকে তাদের স্কুল হোস্টেলে রাখতে আগ্রহী হয়। তবে তার থাকা খাওয়ার খরচ একটা বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। মা এই সুযোগটাকে কাজে লাগায়; সে মিনার্ভার সকল খরচ দিবে এই শর্তে প্রতিষ্ঠানটি রাজি হয় মেয়েটাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দত্তক নিতে।
এভাবেই যখন মিনার্ভা এক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আরেক পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে চলে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই সে এক মিরাকল ঘটায়। বন্ধনটা নিশ্চয়ই তৈরি হচ্ছিল প্রতিদিনই একটু একটু করে। দশ-বারোদিনের সেবা-যত্ন আর আদর পেয়ে কিছু একটা বিরাট পরিবর্তন হয় মিনার্ভার মধ্যে। এবারও অধিকার প্রতিষ্ঠা করার কৃতিত্ব মিনার্ভাকেই দিতে চান তার মা। কেননা, সাত আট মাস ধরে কোনো কথা বলতে না পারা মিনার্ভা গলার সব শক্তি জড়ো করে তাঁকে ‘মা’ বলে ডেকে ওঠে। সেই থেকে মিনার্ভাকে শুধুমাত্র একটা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে ছেড়ে আসা হয়ে ওঠে না সেই মায়ের। সেই থেকেই সে তিন সন্তান থেকে চার সন্তানের মা হয়ে ওঠেন।
পেছনের গল্প
লেখকের পিএইচডির গবেষণার বিষয় হিসেবে মারিয়া সালামের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। কালের কণ্ঠের সাংবাদিক, গল্পকার আর খুব ভালো বক্তা মারিয়া সালামের আরেকটা বড় পরিচয় হলো তিনি মিনার্ভার মা।
মোট ২৮ জন মায়ের, যাদের কিনা প্রত্যেকের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সম্পন্ন বাচ্চা আছে, সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। প্রত্যেকটা মায়ের গল্পই অসাধারণ। তাদের গল্প শুধু মাত্র প্রতিবন্ধকতা সম্পন্ন বাচ্চা নিয়ে কষ্ট সহ্য করার গল্প নয়; বরং একেকটা যুদ্ধের গল্প আর একেকটা যুদ্ধে জেতার গল্প!