আমেরিকান জীবনযাত্রাবিষয়ে ফ্র্যাঙ্ক কাপরার অনুজ্জ্বল দৃষ্টিভঙ্গি

  • পিটার ফয়েরহার্ড ।। অনুবাদ: মামুনুর রশিদ তানিম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

অলঙ্করণ: কাজী যুবাইর মাহমুদ

অলঙ্করণ: কাজী যুবাইর মাহমুদ

কাপরার সিনেমাগুলো খুব আশাবাদী এবং কখনো কখনো হালকামেজাজেরও বলে পরিচিত, তবে তার উপরিতলের নিচেই লুকিয়ে থাকে আমেরিকার দুর্নীতিপরায়ণতার অন্ধকার গল্প । 

১৮৯৭ সালের ১৮ই মে। সিসিলিতে ফ্রান্সেসকো রোজারিও কাপরা হিসেবে সেদিন ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন হলিউডের চলচ্চিত্র পরিচালক ফ্র্যাঙ্ক কাপরা। পাঁচ বছর বয়সে পরিবারসহ অভিবাসী হয়ে লস আনহেলেসে থিতু হন তিনি, এবং ৩০ এর দশকের সময়টাতে হলিউডে প্রভাব বিস্তার করার মতো উচ্চতায় পৌঁছে যান। 

বিজ্ঞাপন

কাপরার কাজবিষয়ে দুটো প্রধান সমালোচনামূলক অভিমত পাওয়া যায়। প্রথমত তাঁর সিনেমাগুলো “কাপরাকর্ন”, মার্কিন মফস্বল শহরের হিরোদের অপশক্তির বিরুদ্ধে দৃঢ়চিত্তে লড়ে জয়ী হওয়ার আবেগপ্রবণ গল্প। একজন রোনাল্ড রেগানের কথা বলা যায়, যিনি কাপরার সিনেমাগুলোকে দেখেছিলেন ব্যক্তির ক্ষমতার প্রশস্তিগাওয়া, আমেরিকার আশাবাদী জীবনের প্রতিচ্ছবি হিসাবে। 

আরেকটি অভিমত হলো, ‘মি. ডিডস গোজ টু টাউন’, ‘মি. স্মিথ গোজ টু ওয়াশিংটন’, ‘মিট জন ডো’, ‘ইট’স আ ওয়ান্ডারফুল লাইফ’ এর মতো কাপরার সিগনেচার সিনেমাগুলো আমেরিকান জীবনধারা বিষয়ে একটি অনুজ্জ্বল বার্তা বহন করে; যে-সমাজ দুর্নীতিগ্রস্ত, মতলববাজ লোকজনদের দ্বারা ‍নিরন্তর পদদলিত হয়, যেখানে গরীব এবং শ্রমিকশ্রেণীর মানুষেরা স্রেফ প্রাণধারণের জন্য কঠোর সংগ্রাম করে যায়। 

বিজ্ঞাপন

১৯৩৪ এর কমেডি হিট ‘ইট হ্যাপেন্ড ওয়ান নাইট’ এর বক্স অফিস সাফল্যের দৌলতে কলম্বিয়া পিকচার্স বিশাল অংক বগলদাবা করার পর, ১৯৩৬ থেকে ১৯৪৬ এর কালপর্বে কাপরা মোটামুটি তাঁর কাজে পূর্ণ স্বাধীনতাই পেয়েছেন। এবং এই সময়টাতেই তিনি তাঁর সর্বাপেক্ষা আলোচিত ওই চার সিনেমা নির্মাণ করেন, যেগুলোয় কর্পোরেট জগতের এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী লোকজনের বিরুদ্ধে নিঃসঙ্গ, আদর্শবান নায়কদের লড়তে দেখা যায়। ওই সিনেমাগুলোতে প্রতিভাত আমেরিকান জীবনধারা নিয়ে কাপরার সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি সেভাবে স্বীকৃতি পায়নি বলে তর্ক করেন, আমেরিকাবিষয়ক অধ্যয়নচর্চা গবেষক গ্লেন অ্যালান ফেল্পস্। কাপরা একদা বলেছিলেন, “আমি গাইতে চাই সেই স্বল্পবেতনের চাকুরেদের, প্রতারিত সাধারণদের, আজন্ম গরীবের গান... আমি বাজি ধরতে চাই বর্ণ এবং জন্মের কারণে প্রতিনিয়ত পিষ্ট হওয়াদের পক্ষে। সর্বোপরি, এই পৃথিবীর প্রেক্ষাগৃহের পর্দাগুলোতে আমি লড়ে যাব তাদের দাবিসমূহের বাস্তবায়নের জন্য।” 

চারটি সিনেমার কাঠামো অনেকটা একই : আমেরিকার মফস্বলের এক সাধাসিধে যুবক বর্ণচোরা, দুর্নীতিগ্রস্ত অভিজাতদের স্বার্থরক্ষাকারী কোনো বৃহৎ প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির মুখোমুখি হয়। এবং অবশেষে, আদর্শেরই জয় হয়। ফেল্পস্ লিখেছেন, “তাঁর চোখে আমেরিকা একেবারে সোজাসাপ্টাভাবেই ধনিকগোষ্ঠী দ্বারা শাসিত একটি দেশ।” কাপরার ক্রোধ সচরাচর মিডিয়ার দিকেই তর্জনী উঁচিয়ে থাকত। মি. স্মিথ ছবিতে সাংবাদিকদের দেখা যায় দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিকে সমর্থন করতে। মিট জন ডো’তে দেখি, এক ধান্দাবাজ প্রভাবশালী পত্রিকামালিক তার পত্রিকার নীতিবাক্য, “মুক্ত জনগণের জন্য মুক্ত গণমাধ্যম”কে পাল্টে দিতে, “অবাধ যুগের অবাধ পত্রিকা”য় ইট’স আ ওয়ান্ডারফুল লাইফ ছবিটিকে এখন বিবেচনা করা হয় ছুটির দিনের অলস দুপুরে বসে টেলিভিশনে দেখার মতো একটি মজাদার সিনেমা হিসাবে। কিন্তু মুক্তিকালে এই সিনেমা বক্স অফিসে তেমন সফল ছিল না। সমালোচকগণ চিহ্নিত করেন, ছোট শহরের ব্যাংকার সম্প্রদায়কে সাধারণ মানুষের শোষণকারী হিসেবে চিত্রিত করা এই সিনেমা কর্তৃক যুদ্ধপরবর্তী মার্কিন আশাবাদের মুখে চুনকালি মেখে দেওয়াটাই ছিল এর কারণ। 

মি. স্মিথ তুলনামূলকভাবে ভালো করেছিল বক্স অফিসে। কিন্তু ওয়াশিংটনের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের জন্য আয়োজিত সিনেমার প্রথম প্রদর্শনীতে, ক্ষমতার দালালেরা এর বিরুদ্ধে আপত্তি তুলেছিলেন, যাদের মাঝে ছিলেন কংগ্রেস সদস্য স্যাম রেবার্ন এবং সিনেটর আলবেন বার্কলি। জোসেফ কেনেডি, গ্রেট ব্রিটেনে তখনকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত, এই সিনেমা যাতে ইউরোপে প্রদর্শন না করা হয় তার তদবির করেন, কেননা তিনি ভয় পেয়েছিলেন, সিনেমাতে দেখানো আমেরিকান রাজনীতির নেতিবাচক চিত্র আসন্ন যুদ্ধের মিত্রদের নিরাশ করতে পারে। কিন্তু ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট আবার পছন্দ করেছিলেন সিনেমাটি। তিনি, রাজনৈতিক কর্তাদের নাগপাশ ভেঙে বেরিয়ে আসা এই সিনেমার নায়ক এবং পত্রিকাঅলাদের নেতিবাচক উপস্থাপনার সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করেছিলেন। 

“কাপরাকর্ন” ধারণাটি কাপরার সিনেমাগুলোর আশাবাদী সমাপ্তি থেকেই সম্ভবত এসেছে বলে চিহ্নিত করেন ফেল্পস্। আত্মহত্যার অভিপ্রায়সহ নানা কঠিন বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে নিঃসঙ্গ নায়ককেই সবসময় জয়লাভ করতে দেখা যায় সিনেমার শেষে। এ-জাতীয় সমাপ্তির জন্য ফেল্পস্ মূলত দোষেন ‘হেইস কোড’কেই, যে-কোড তখন হলিউডকে রীতিমতো নিয়ন্ত্রণ করত। এই কোড অনুযায়ী, সিনেমায় চিত্রিত যে কোনো দুষ্টশক্তিকেই পরাজিত দেখাতে হতো ছবির সমাপ্তিতে, আর কাপরাও জানতেন, সাধারণ দর্শক তখনও বিষণ্ণ, নেতিবাচক কোনো পরিণতি মেনে নেওয়ার পক্ষপাতী ছিল না মোটেও। 

বক্স অফিসের সঙ্গে অনুকূল সম্পর্ক স্থাপন করতে না পারায়, কাপরা নিজেই সময়ের অনেক আগে অবসর নিয়েছিলেন হলিউড থেকে। তবে আমেরিকান জীবনধারার অন্ধকার উপস্থাপনার সঙ্গে স্বচ্ছন্দ পরবর্তী প্রজন্মের সদস্যদের কাছে জনপ্রিয় হয়েই বেঁচে থাকে তাঁর সিনেমা।