মিসরের মহামারি বিষয়ক কবিতা

  • ভাব-তর্জমা: মঈনুস সুলতান
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

মিসরে শত বছরের ব্যবধানে সংঘটিত দুটি স্বতস্ত্র মহামারি নিয়ে লেখা কবিতা দুটির রচয়িতা কবিদের নিবাস ছিল ইরাক ও সিরিয়া অঞ্চলে। তবে তাঁদের জীবনের কিছুকাল তাঁরা কাটিয়েছিলেন মিসরে।



কলেরা
নাজিক আল মালাইকা

কেবল মাত্র উঠছে সুরুজ,
ভোরের তুমুল নীরবতায় আমি পদযাত্রীদের পায়ের শব্দ শোনার চেষ্টা করি
আলোয় রাঙা হচ্ছে মিনার... ক্রমশ ঝলমলিয়ে উঠছে প্রাসাদের বুরুজ।
কান পেতে শোনো... তাকিয়ে দ্যাখো... মৃদুপায়ে হেঁটে যাচ্ছে ভোরের মিছিল,
দশ..বিশ..পঞ্চাশ.. বিষাদের বিষে নীল
জনপদ হয়েছে ছারখার,
লাশগুলো পড়ে আছে বেপানহ্ বেশুমার।
এদের তিরোধানে ঝরছে না অশ্রু কোনো শোকগাঁথায়
হচ্ছে না কেউ অন্যমনস্ক মুহূর্তের মৌনতায়,
মৃত্যুর অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর হয় মানবতা
কলেরা যেন তৈরি করে সামাজিক শাস্তির নিত্য নতুন প্রথা,
এমনকি গোরখাদকেরা মহামারির কাছে করেছে আত্মসমর্পণ
করুণভাবে মোয়াজ্জিনেরও হয়েছে মরণ;
কে এবার দেবে জানাজার দাওয়াত,
মিসর—হে স্বদেশ আমার
মৃত্যুর প্রবল প্রতিশোধে স্বপ্নসৌধ ভেঙে হলো যে চুরমার।

[প্রেক্ষাপট: ইরাকের কবি নাজিক আল মালাইকা (১৯২৩-২০০৭) কালেরা শিরোনামে কবিতাটি রচনা করেছিলেন ১৯৪৭ সালে মিসরে কলেরা সংক্রমণের প্রেক্ষাপটে। বিংশ শতাব্দীর এ ভয়ংকর মহামারিতে মৃত্যু হয়েছিল দশ সহস্রাধিক মানুষের। এ সময় মিসর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল সারা পৃথিবী থেকে। বিষয়বস্তু ও প্রকরণের দিক থেকে কবিতাটিকে সনাতনী ধারার কাব্য-ঐতিহ্যে বিশেষ এক ব্যতিক্রম বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। ‘পোয়েট্রি অব আরব উইম্যান: আ কনটেমপোরারি এনথোলজি’ থেকে চয়ন করা এ কবিতাটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন নাথালি হিন্দালের সহায়তায় হোসাইন হাদাউয়ে।]


 

বিজ্ঞাপন

নিশিরাতের আগন্তুক
আল মুতান্নাবি

রজনীর গাঢ় অন্ধকারে—
আসে সে... আসে চুপিসারে,
এসে দাঁড়ায়... অবগুণ্ঠিত... দাঁড়ায় আমার শিয়রে
বাড়িয়ে দিই আমি তার দিকে বিছানার চাদর ও বালিশ,
বাস করে পুরো রাত জুড়ে সে আমার হাড় ও পাঁজরে
জ্বরের ঘোরে ঘেমে-নেয়ে আমি কেবলই করি নিশপিশ।
চামড়া কুঁচকে শরীর আমার এমন দুমড়ে মুচড়ে উঠেছে যে
ধারণ করতে পারে না তা আমাদের যুগল নিঃশ্বাস,
হরেক উপসর্গে ছড়াতে থাকে সন্ত্রাস,
ফিরে যাওয়ার সময় আমাকে সে সযত্নে করায় গোসল
যেন বা সঙ্গোপনে সেরেছি আমরা দৈহিক অন্তরঙ্গতা
পড়ে থাকি—চোখেমুখে ফোটে বিশ্রামের কপট ছল।

মনে হয়—তাড়িয়ে দিয়েছে তাকে ভোরের অরুণিমা
তুমুল আলোয় পরাক্রান্ত প্রবল,
অতিক্রম করে সহনের সকল সীমা
দু-চোখের কোষগুলো তার অশ্রুতে হয়ে ওঠে সজল,

বিজ্ঞাপন

কেটেছে যে মুহূর্ত কয়েক... যুগল প্রণয়ে ঝরেছে বৃষ্টি
তর্পণ করি স্মৃতি তার নিরাবেগে নিষ্কাম,
ভুলতে পারি না প্রেমাষ্পদের সে নিষ্পলক দৃষ্টি
জানি না, কী হবে এ যাত্রায়—কী আমার পরিণাম।

[প্রেক্ষাপট: ইরাকি-সিরিয়ান কবি আল মুতান্নাবি রচিত ‘নিশিরাতের আগন্তুক’ শিরোনামের কবিতাটিকে আরবি ধ্রুপদী ধারার কাব্যকলায় মাস্টারপিস হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। কবিতাটিতে রূপক হিসাবে বর্ণিত হয়ছে—লাজুক এক প্রেমাষ্পদের কথা, যে নিশিরাতের আবডালে চলে আসে রুগ্ন কবির শষ্যাপাশে। ছত্রে ছত্রে পাঠক যেন অনুভব করে রহস্যময় এক আগন্তুকের উপস্থিতি, পাশাপাশি প্রবাহমান বর্ণনা তৈরি করে ঘামে নেয়ে ওঠা জ্বরতপ্ত মানুষের বিকার-বিভ্রান্ত মানসিক অবস্থা। কবিতাটি ‘অ্যারাবিয়ান মেডিসিন: দ্যা ফ্রিৎসপ্যাট্রিক লেকচার্স’ গ্রন্থ থেকে চয়ন করা হয়েছে।]