সুখলালের স্বপ্ন ও তৃতীয় চরিত্র
তুই কাঁদছিস কেনে? তোর কে মরিছে?—তারাবানুর ফাঁকা অন্তঃসারশূন্য দিন-দুনিয়ায় সে ছাড়া যে অন্য কেউ নেই সুখলালের তা অজানা নয়।
তারপরও সে যখন ‘তোর কে মরিছে’ বলে বারান্দা থেকে বিরক্ত হয়ে উঠোনের দিকে হাঁটতে থাকে তখন তারাবানুর কান্নার উচ্চস্বর তাকে যেন পিছন থেকে ঝাপটে ধরে।
সুখলালের ভালো লাগে না কান্নার এই ঘ্যান ঘ্যানানি—যা তাকে আজকাল কারণে অকারণে যখন তখন জড়িয়ে ধরে। সে কাধ থেকে মাছি তাড়ানোর মতো কান্না তাড়াতে সচেষ্ট হলে তারাবানুর কণ্ঠ কিছুটা নিস্তেজ হয়ে আসে, এমন মনে হয় তার।
সে ঘাড় ঘুরিয়ে দ্যাখে যে, তারাবানু আঁচলের গিঁট খুলে পান মুখে পুরছে অর্থাৎ কান্নায় আপাত বিরতি।
অতএব এখন নিশ্চিন্তে ডেরায় ফিরতে পারে সুখলাল।
সে পাশ ঘেঁষে বসে। তারাবানু সরে যায়।
সুখলাল আবার বলে, তুই কাঁদছিস কেনে? তোর কে মরিছে?
তারাবানুর মুখে পান এবং দৃষ্টি তার সন্ধ্যা পরবর্তী রাত্রির আকাশে স্থির থাকায় শুনেও না শোনার ভান করে।
একদম মুখ্যু সুখ্যু মানুষ যে নয় তারাবানু এবং সেই যুগে ‘ফাইভ কেলাসে’র বিদ্যাবুদ্ধি তার পেটে মজুদ আছে সুখলালের তা অজানা নয়। আর এই বিদ্যার জোরেই তারাবানুর ঠোঁট থেকে ‘মানুষ মরলেই বুঝি মাইনসে কান্দে’—এমত পাল্টা প্রশ্নটি কানের গলিপথ দিয়ে ঢুকে পড়লেও সুখলালের বিরক্তির নাব্যতা হ্রাস পায় না এতটুকু। উল্টো আকাশের দিকে স্থিত তারাবানুর চোখে অভিমানের সঙ্গে কিছুটা ক্ষোভও যুক্ত হতে দ্যাখে সে।
মৃত্যুই যে মানুষের কান্নার একমাত্র কারণ নয়, অন্য হাজারটা কারণও যে থাকতে পারে সুখলাল সে কথা বোঝার মানুষ নয় বলে মোটেই বিস্মিত নয় তারাবানু। মর্দ মাইনষে মাইয়া লোকের কান্নার কী বুঝবে!
তারাবানুর কিছুই বোঝে না সুখলাল।
এই যে একটানা তিনদিন নিঁখোজ থাকার পর আজ সন্ধ্যার আলো-আঁধারে আস্ত একখানা মাইয়া মানুষ নিয়া বারান্দার সামনে এসে দাঁড়াল সুখলাল তা দেখে তারাবানুর বুকের ভিতরের গুমরে ওঠা কান্না আর্তনাদের মতো লাফিয়ে পড়তেই পারে, স্বাভাবিক।
তারাবানু সুখলালের সঙ্গে ঝুলে আছে ২৬/২৭ বছর। এই ঝুলে থাকা জীবনকে সে মাচানে লাউ কিংবা করল্লার ঝুলে থাকার মতো মনে করে। তবে এ নিয়ে অতৃপ্তি নেই তার। বরং এই ঝুলে থাকার অবলম্বনটুকু যে তার আছে এতেই তারাবানু অনেক তৃপ্ত।
দুই.
২৬/২৭ বছরের এই ঝুলে থাকা জীবনে কখনোই সুখলালকে বাইরের মাইয়া মানুষ ঘরে ওঠাতে দ্যাখেনি তারাবানু। এই প্রথম।
কান্না এবং ‘তোর কে মরিছে’ সংলাপযুক্ত এই সান্ধ্য-নাটকের পুরো দৃশ্যে সুখলাল ও তারাবানু ছাড়াও আরো একজন, একটি মেয়ে চরিত্রকে দ্যাখা গেল বারান্দার কোনে নিস্তেজ, নিরুদ্বেগ, প্রায় ভাবলেশহীন দাঁড়িয়ে থাকতে। পরিবেশ ও প্রকৃতি জুড়ে রাত্রির অন্ধকার কিছুটা গাঢ় থাকায় এবং তার মুখটি দ্যাখা যায় না বিধায় নির্বাক নিশ্চুপ প্রায় অস্তিত্বহীন এক ছায়ার কাঠামো মনে হয় তাকে।
এবং অকস্মাৎ ছায়া চরিত্রটি নড়ে উঠলে সুখলালের স্মরণ হয়, হ্যাঁ, আজ বিকেলের শেষ মাথায় অর্থাৎ সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে এই মেয়েটিকে নিয়ে সে গ্রামে পা রেখেছিল। কান্নাকাটির ভিতর এখন তার বারান্দায় স্থির একটি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি।
তা কতক্ষণ আর দাঁড়িয়ে থাকা যায়!
রক্তমাংসহীন ছায়াও তো দুলে ওঠে, নড়ে চড়ে ওঠে। সুখলাল কি দ্যাখেনি? দেখেছে।
...একবার ভাটির দিকে যাবার সময় ভরা পূর্ণিমার আকাশে দেখেছিল চার পরীর নৃত্য! হাতে হাত ধরে তারা নেচে চলেছে স্বর্গের উদ্যানে। তাদের শরীর থেকে বিচ্ছুরিত আলোয় উতলা হয়ে উঠেছিল আগুনমুখোর ঘোলা জল। রক্তহিম হয়ে গিয়েছিল সুখলালের। হাত থেকে খসে গিয়েছিল বৈঠা। পরদিন তাকে জাগিয়ে তুলল ভোর-বেলাকার রোদ। সারারাত সে শুয়েছিল পাটাতনের ওপর। ভোরবেলা চোখ খুলে দ্যাখে, কোথায় চাঁদ আর কোথায় জ্যোৎস্না। তার বৈঠা নিয়ে উধাও চার পরী!
আর এই গল্প, স্বর্গোদ্যানে চার পরীর নৃত্যের গল্প কতভাবে যে কত মানুষকে বলেছে সে, বিশ্বাস হয়নি কারো।
স্মিত হেসে ‘গঞ্জিকার মাত্রা বোধহয় বাড়িয়ে দিয়েছে সুখলাল’—এমন মন্তব্যও করেছে কেউ কেউ।
কিন্তু যে যাই বলুক, সুখলাল তো জানে, সে দেখেছে ভরা পূর্ণিমার রাতে আকাশ জুড়ে চার পরী হাতে হাত ধরে নেচে চলেছে...।
আর একবার অমাবস্যার রাতে হঠাৎ কদম শেখের ‘মাইজ্জা মাইয়াডা’, ফতি, মরার ঠিক তিনদিন পর, ঢালুর দিকে নেমে যাচ্ছিল সুখলাল, বুড়াগৌরাঙ্গ পার হয়ে চরকাজলের দিকে সামান্য এগিয়েছে মাত্র, দ্যাখে, আলোর ফিতার মতো ‘মরা মাইয়াডা উইড়া আইতাছে’ নদীর পাঁচ ফুট উপর দিয়ে—ভয় পায় না সুখলাল। এইসব দৃশ্য তার ঢের দ্যাখা আছে। ‘উইড়া আসা মাইয়াডা’ নৌকার ছইয়ের ওপর বসেও যেন বসে না, ‘হেরপর আন্ধার খায়ি ফেলে তারে’।
তিন.
চোখ বুজে আসে সুখলালের। বৈঠা এবার হাতের মধ্যেই স্থির থাকে। ফসকে যায় না। এই গল্প সে আর কাউকে বলে না। সাহস নেই সুখলালের।
‘দিনকাল বড় খারাপ যাতিছে। অহন মুখ সেলাই করনের টাইম। বেশি ফরফর করলে নিজের উড়ালের কামখানা পাক্কা অইয়া যাইব।’—সুখলাল বোঝে এসব। আর বোঝে বলেই এই শেষোক্ত গল্পটি থেকে নিজেকে দূরে রাখে। যেন সে কিছুই দ্যাখেনি। ‘কদম শেখের মাইয়াডারে সে উড়িতে দেখিছে’—এই সত্য সে মাথা থেকে, তার মনের অরণ্য অঞ্চল থেকে তাড়িয়ে দিতে চায়। কিন্তু সত্য, হোক তা বাস্তব কিংবা অলৌকিক, হীরের টুকরো হয়ে দিনের আলোতেও চর্মচক্ষে ধরা দ্যায়।
...কদম শেখের মেয়েটিকে শবেবরাতের রাতে ধরে নিয়ে যায় শহর থেকে গ্রামে আসা এমপি সাহেবের পুত্র। দুদিন পর তার লাশ পাওয়া যায় ছোটবাইশদার কাছে এক চড়ায়।
এ ধরনের ঘটনা-পরবর্তী সময়ে সাধারণত যে কথাগুলো কারণ হিসেবে চাউর করে দেওয়া হয় কদম শেখের মেয়ের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলো না।
১. মেয়েটির বরাতে এরকম মর্মান্তিক পরিণতির কথা লেখা ছিল...
২. মহান সৃষ্টিকর্তার নির্দেশেই তার জীবনের ইতি এভাবে ঘটে...
৩. আল্লার মাল আল্লায় লইয়া গ্যাছে...
৪. বুড়াগৌড়াঙ্গ’র বুড়ো বয়সে ভীমরতি হয়েছে বলেই মেয়েটিকে ভাসিয়ে নিয়ে গ্যাছে...
এমপি সাহেবের লোকেরা অতঃপর প্রায় পুরো দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে এই চারটি আপাত যুক্তিগ্রাহ্য কারণ চাউর করে দেওয়ার পরপরই ঘটনার এখানেই পরিসমাপ্তি ঘটে। এবং এ নিয়ে আর কাউকে উচ্চবাচ্য করতে দ্যাখা যায় না।
সুখলাল অতঃপর সাব্যস্ত করে রাতের আলোয় দেখা সত্য তুলে আনবে না দিনের আলোয়। সে কাউকে বলবে না, এমনকি তারাবানুকেও নয়। সে বরং মাথা থেকে তাড়িয়ে দেবে কদম শেখের ‘মাইজ্জা মাইয়াডা’র কথা কিন্তু তাড়াতে চাইলেই কি তাড়ানো যায়!
যখন মাল-সামান বোঝাই করে ভাটির দিকে নামে সুখলাল তখন ছৈলাতলা, আড়ভাঙ্গা, তিত্কাটা, বুড়িরচর, ছৈলাবুইন্না, আঙুলকাটা, গিলাতলি, আনড়াগাছি, হরিণবাড়িয়া আর দেউলির বাতাসের ভিতর, নদীর জলস্রোত, আকাশ, দূরের নক্ষত্র ও বনভূমির ভিতর কদম শেখের ‘মাইজ্জা মাইয়াডা’র উপস্থিতি যেন স্পষ্ট দেখতে পায় সে।
চার.
গভীর রাতে ঘুমের ভান করে পরে আছে তারাবানু। ছায়ার মতো নিশব্দে হোগল পাতার বিছানায় তার পাশে এসে শোয় সুখলাল। তারাবানুর কোনো সারাশব্দ নেই দেখে গলায় আদুরে হাত রাখে সুখলাল। মুহূর্তেই হাতখানা ফিরে আসে তার কাছে।
পুনরায় রাখে। পুনরায় ফিরিয়ে দ্যায় তারাবানু। সুখলাল দমে যায় না। পুরুষ মাইনষের দমে গেলে কি চলে! একটু সময় নিয়ে তারাবানুর গলায় হাত রাখে সে, আলতো করে জড়িয়ে ধরে নিজের দিকে ফেরাতে চেষ্টা করলে কাজ হয় তৃতীয় দফায়।
মাইয়াডা কেডা?
পাশ ফিরে তারাবানু প্রশ্ন করলে আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে সুখলাল—অরে মুই খুইজ্জা পাইছি তারা। ও কদম শেখের মাইজ্জা মাইয়াডা, ফতি। অয় আমারে বাজান বলি ডাকিছে, বাজান।
অন্ধকারে ঝট করে উঠে বসে তারাবানু। সহসা বুঝে উঠতে পারে না সে! কী করে একটা ‘মরা মাইয়া’রে নিয়ে এসেছে সুখলাল!
অরে ঘরে লয়ি আয়। আন্ধারে খাড়া করি রাখিসনি, আন্ধার অরে গিলি ফেলবি আবার।
কথা বলে না তারাবানু, নিঃশব্দে উঠে বাইরে আসে সে।
এসে দেখে বারান্দার এক কোনে খুঁটির সঙ্গে হেলান দেওয়া একটি ছায়া, স্থির অনড়, তারাবানু অন্ধকারে সেই ছায়ার দিকে অর্থহীন এগিয়ে যেতে থাকে...।
পিছনে হাজার বছরের অপেক্ষা নিয়ে চিৎ হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে সুখলাল।
আর এই নিরুপদ্রপ ঘুমের মধ্যেই সে দেখতে পায়, মুলিবাঁশের ছাউনি বেড়ার ফাঁকফোকর দিয়ে তাদের ছাপড়া ঘরে ক্রমাগত ঢুকে যাচ্ছে চাঁদ।