আমিষ
সিতেশ বাবুর একটা মুদির দোকান। দোকানে নিত্যকার দরকারি কিছু জিনিস আছে; খুব বেশি না। সাথে এক কোনায় কয়টা মিষ্টি রাখা থাকে। মুদির দোকানে এরকম মিষ্টির আয়োজন খুব একটা দেখা যায় না।
প্রতি বুধবার দুপুর বেলা সিতেশ বাবুর সাথে আমার দেখা হয়। আমি তিনটে সাঁকো পার হয়ে ধানসাগর ইউনিয়নে যাই কিস্তি আদায় করতে। আমার অফিস রায়েন্দাতে; শরনখোলা উপজেলা। রায়েন্দা থেকে ধানসাগর এক বিরাট ঝক্কির পথ। পাকা রাস্তা খুব একটা নেই বললেই চলে। বেশিরভাগ মাটির ঢেলা ওঠা মাটির রাস্তা। এই রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালানো এই যুদ্ধ করার নামান্তর।
তিন নম্বর সাঁকো পার হয়ে সিতেশ বাবুর দোকান। দোকানটা দেখলে স্বস্তি হয়—চলে এসেছি। কিস্তি আদায় করতে ঢোকার সময় দোকানে বসি না। শুধু একটা হাক দেই, ‘কেমন আছেন, সিতেশদা?’
দাদা মিনমিনে গলায় জবাব দেয়, ‘আছি আর কী? আপনি চললেন?’
‘হ। আসি ঘুরে।’
একটা সমিতির কিস্তি আদায় করে যখন এই দোকান অবধি আবার ফিরে আসি, তখন শরীর আর চলে না। খিদেয় পেটের মধ্যে হইচই শুরু হয়। এই সময়টা সিতেশ বাবুর দোকানে একটু বসি। দুটো মিষ্টি খাই, এক গ্লাস পানি খাই। সিতেশ বাবুর সাথে সুখ-দুঃখের কিছু আলাপ হয়।
সিতেশ বাবুর তিন কূলে কেউ নেই। ছেলে মেয়ে কখনোই ছিল না। স্ত্রী মারা গেছেন, তাও অনেকদিন হলো। ভাই-বন্ধু কিছু নেই। এই দোকানের পেছনেই একটা দোচালা টিনের ঘরে তার বসত। নিরামিষাশী ও একাহারি মানুষ। সকালে চিড়ে, রাতে ফলমুল এবং দুপুরে নিজের রান্না করা ভাত ও শাকশবজি।
সকাল বেলা এসে দোকান খুলে বসেন। পনের দিনে একবার রায়েন্দা গিয়ে কিছু জিনিসপত্র কিনে আনেন দোকানের জন্য। মতি ময়রা রোজ সকালে রায়েন্দা যাওয়ার সময় কয়টা মিষ্টি দিয়ে যায়। সারাদিন বেচাকেনা খুব একটা হয় না। আজকাল লোকেরা এরকম মোড়ের মুদি দোকান থেকে খুব একটা কেনাকাটা করে না। রায়েন্দা বাজারে গেলেই সারি সারি বড় দোকান; সেখান থেকেই লোকেরা কেনাকাটা করে আসে। তারপরও সিতেশ বাবুর পৈত্রিক দোকান তাকে খোলা রাখতে হয়। অন্তত নিজের প্রয়োজনটা এই দোকান থেকে মিটে যায়।
সিতেশদার একটার সঙ্গী হলো নবা পাগলা। নবা পাগলা কোথাকার মানুষ কেউ জানে না। সারাদিন একটা ময়লা কাপড় পড়ে রায়েন্দা বাজারে ঘুরে বেড়ায়। সন্ধে হলে সিতেশন বাবুর বারান্দায় এসে ঘুমায়। সিতেশ বাবুও ওকে রাতে টুকটাক খেতে দেন। লোকে বলে, দু জনে নাকি গল্প গুজবও করে।
এর মধ্যে আমি সিতেশ বাবুর মনে হয় ব্যতিক্রমী কাস্টমার। আমাকে মাঝে মাঝেই একটু বেশী যত্ন করেন। আজ যেমন মিষ্টি খাওয়া শেষ হতে বললেন, ‘আরেকটা মিষ্টি খান, দাদা।’
‘নাহ। দুটোতেই পেট ভরে গেছে।’
‘খান। এটার দাম দিতে হবে না।’
‘কেন, কোনো উপলক্ষ আছে?’
‘আজ চড়ক ষষ্ঠী তো। বাবা বেচে থাকতে লোকজন খাওয়াতেন। আমি তো পারি না। এই আপনাকে একটা মিষ্টি খাইয়ে ব্রাহ্মণসেবা করি।’
আরেকটা মিষ্টি খাই। হাত ধুতে ধুতে প্রশ্ন করি, ‘সিতেশ দা, দোকানে মিষ্টি রাখেন কেন? আপনার তো মিষ্টির দোকান না?’
‘মিষ্টি হলো দোকানের লক্ষ্মী। আবার বাবা তো ময়রা ছিলেন। এখানে ছিল ওনার মিষ্টির দোকান। আমি তো ছোটবেলা থেকেই উচ্ছনে যাওয়া। ময়রার কাজ শিখিনি। তারপরও বাবার লক্ষ্মীটা ধরে রেখেছি।’
বেশিক্ষণ বসে সিতেশ বাবুর গল্প শোনা হয় না। তাড়াতাড়ি প্যাডেল চালিয়ে রায়েন্দা যেতে হবে। অফিসে গিয়ে হিসেব মেলাতে হবে। কিছু টাকার ঝামেলা হলে সেটা পকেট থেকে দিতে হবে। এরপর আজকে আবার আমার বাজার করার কথা। আমি এই সপ্তাহে মেস ম্যানেজার।
আমাদের অফিস আর মেস একসাথেই। একটা দোতলা বাড়ির পুরো একতলাটা আমাদের ভাড়া নেওয়া। ঢুকেই প্রশস্ত জায়গাটা অফিস। আর তার পাশের দুটো রুমে আমরা ৬ জন কর্মী থাকি। রান্নাঘর আছে। খালা এসে দুই বেলা রান্না করে দিয়ে যায়। ম্যানেজার স্যার একটু দূরে একটা বাসা ভাড়া করে থাকেন। তার বৌ-বাচ্চাও এখানে থাকে।
অফিসে ঢুকতে হয় ঠিক সকাল সাড়ে সাতটায়। আটটার মধ্যে ফিল্ডে বের হয়ে যেতে হয়। প্রতিদিন ৩-৪টে সমিতির কালেকশন করে ফিরতে ফিরতে চারটে বাজে। এরপর দুটো খেয়ে বসতে হয় হিসেব নিয়ে। হিসেব শেষ করতে করতে রাত ৮টা। তারপর শরীরে আর কিছু শক্তি থাকে না। রাতে খাওয়ার পর বিনোদন বলতে টুয়েন্টি নাইন খেলা। আমার রুমেই বসে আড্ডা। শরিফ আর প্রশান্ত ঘুমকাতুরে। ওরা তাস খেলায় বসতে চায় না। আমরা বাকি চারজন রাত ১২টা-১টা পর্যন্ত চালিয়ে যাই।
আজ অবশ্য আমার রুটিন একটু আলাদা। অফিসে গিয়ে খেয়েই ছুটতে হবে বাজারে। মেস ম্যানেজারের রোজকার কাজ এটা। সেখান থেকে ফিরে তবে হিসাব মিলানো। কিন্তু আজ অফিসে ফিরতেই কাদির ভাই বলল, ‘আজ আর বাজারে যেতে হবে না।’
কাদির ভাই আমাদের সিনিয়র ক্রেডিট অফিসার। আমাদের তো বটেই, আমাদের ম্যানেজার স্যারের চেয়েও সিনিয়র। চাকরিতে আছে অনেকদিন হলো। কিন্তু কিছুতেই হিসেব নিকেশের খেলায় পেরে ওঠে না। তাই এখন পর্যন্ত প্রমোশন পায়নি। ওই ক্রেডিট অফিসার হয়েই আটকে আছে।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাজার যেতে হবে না কেনো? রান্না ঘরে মাছ মাংস কিছু নাই।’
‘আছে আছে। রাতা মোরগ আছে।’
‘মোরগ এলো কোত্থেকে?’
‘শরীফ নিয়ে এসেছে।’
এবার বোঝা গেল।
এই কাণ্ড প্রায়ই হয়। কোনো সদস্য কিস্তি দিতে না পারলে বাকি সদস্যরা মিলে তার কিছু একটা বিক্রি করে টাকা আদায় করে। এই কিছু একটার মধ্যে মুরগি থাকলে সেটা কম দামে পাওয়া যায়। মুরগির বাজারদর যাই হোক, এ কিস্তির টাকার বিনিময়ে সেটা পাওয়া যায়। মানে ৬-৭শ টাকার মুরগি দুই আড়াই শ টাকায়। আর সেক্ষেত্রে আমরা ওটাকে আবার কিনে মেসে নিয়ে আসি। অল্প খরচে একটা ভালো খাওয়া হয়ে যায়।
এই প্রায় ফ্রি পাওয়া মুরগির জোরে আজ মেসে ফিস্ট লেগে গেল। হিসাব শেষ করে প্রশান্ত আর রফিক খালার সাথে হাত লাগাল।
রাতে ভারী খাওয়া আর গভীর রাত পর্যন্ত তাস পেটাতে গিয়ে সকালে ঘুম থেকে উঠতে হয়ে গেল দেরি। সাড়ে সাতটায় ম্যানেজার স্যার অফিসে ঢুকে দেখেন, আমরা কেউ নেই। তাড়াহুড়ো করে ইন-টিন করে অফিসে ঢুকে দেখি স্যার জরিমানার স্লিপ হাতে নিয়ে বসে আছেন—৫০ টাকা করে জরিমানা প্রত্যেকের। দিনটা শুরুই হলো যাচ্ছেতাইভাবে।
মনে হলো, এমন মুরগি খাওয়ার চেয়ে সিতেশ বাবুর মতো নিরামিশাষী হয়ে যাওয়াও ভালো। আচ্ছা, ভালো কথা। সিতেশ বাবুকে এটা জিজ্ঞেস করতে হবে—উনি নিরামিষ কেন খান?
পরের বুধবার সমিতি শেষ করে দোকান পর্যন্ত আসতে আসতে অনেক দেরি হয়ে গেল। ঝটপট দুটো মিষ্টি খেয়ে উঠে পড়ছিলাম। সিতেশ বাবুই যেচে বললেন, ‘একটু বসে যান। এতটা পথ সাইকেল চালায়ে যাবেন আবার।’
‘না, দাদা। আজ দেরি হয়ে গেল।
‘আরেহ। একটু দেরিতে আর কী হবে।’
ঠিক তখনই প্রশ্নটা মনে পড়ে গেল, ‘আচ্ছা, সিতেশদা, আপনি নিরামিষ খান কেন?’
‘বাবা ছোটবেলায় দীক্ষা দিয়ে দিয়েছিলেন। গুরুর নিষেধ আছে আমিষ খাওয়ায়।’
‘এর আগে খেতেন?’
‘মাছ খেতাম। মা আমার জন্য জোগাড় করতেন। কিন্তু মাংসটা সেভাবে কখনো খাওয়া হয়নি।’
‘কখনো লোভ হয়নি?’
‘নাহ। এখন তো মাছ-মাংস দেখলে খারাপ লাগে।’
‘বাজারে যে যান, হোটেলে রান্না করা মাছ মাংস দেখলে বমি আসে?’
‘নাহ। অতটা শুচিবাই নেই। আমার মনে হয়, দরকার হলে রান্নাও করতে পারব।’
আজ আর বসার সময় নেই। আকাশে মেঘ। যাওয়ার পথে বৃষ্টিতে ধরবে বলে মনে হচ্ছে।
অফিসে গিয়েই একটা সুখবর পেলাম। সুখবর বলতে সুখবর—রীতিমতো প্রমোশন! ম্যানেজার স্যার ডাকলেন, ‘আপনার চিঠি আছে।’
আমি ভাবলাম, বড় কোনো জরিমানা। এই মাসে কয়েক দিন লেট হয়েছে অফিসে ঢুকতে। জরিমানা হতেই পারে। ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘নতুন জরিমানা নাকি, স্যার।’
স্যার একটু হেসে বললেন, ‘খুলে দেখেন।’
খুলেই চোখটা বড় বড় হয়ে গেল। এই কয় মাসের চাকরিতে প্রমোশন পেয়ে যাব, এটা কল্পনা করতে পারিনি। তবে প্রমোশনের আরেকটা দিক আছে। বদলি হয়েছে। সেটাও অবশ্য আমার জন্য দারুণ হয়েছে। বাড়ির পাশের থানা মোরেলগঞ্জে পোস্টিং হয়েছে। সামনের মাসের এক তারিখ জয়েন করতে হবে।
মানে, হাতে আর দুটো সপ্তাহ আছে। এই সপ্তাহে আমার সমিতিগুলোতে শেষ কালেকশন। পরের সপ্তাহে। আমার সাথে অন্য কেউ যাবে কালেকশনে। তার আগে আমার কাজ হলো সমিতিগুলো ক্লিয়ার করে ফেলা। কোথাও খেলাপি থাকতে দেওয়া যাবে না। তাতে রিপোর্ট খারাপ হবে।
প্রতিদিনই এই খেলাপির শেষ দেখে অফিসে ফিরতে দেরি হতে থাকল। কিন্তু বুধবার দেরিটা কল্পনাকেও ছাড়িয়ে গেল। এক বিধবা মহিলা কিছুতেই তার কিস্তির টাকা দিতে পারছিল না। তার ছেলে নাকি ভ্যান নিয়ে দুদিন হয় বেরিয়েছে; আর কোনো খোঁজ নেই।
তার বাড়িতে বিক্রি করার মতো কিছুও পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত একটা ভাঙা খাট যতক্ষণে বিক্রি করে কিস্তি আদায় হলো, ততক্ষণে সন্ধে হয়ে গেছে। শরীরে আর এতটুকু শক্তি নেই। সিতেশ বাবুর দোকানে এসে অভ্যেসবশেই দুটো মিষ্টি খেলাম, এক গ্লাস পানি খেলাম।
সাথে সাথে ওঠার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সিতেশ বাবু বললেন, ‘একটু বসে যান। বৃষ্টি আসছে।’
অনেকক্ষণ ধরেই বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, মেঘ ডাকলে। তারপরও বললাম, ‘দেখি, বৃষ্টির আগে চলে যেতে পারি কিনা।’
‘পারবেন না।’
বলতে বলতে ঝুম বৃষ্টি নামল। চরাচর যেন ডুবে যেতে শুরু করল। রাত আটটা বাজে, বৃষ্টি থামার লক্ষণ নেই। এই কাদা পথে এখন সাইকেল নিয়ে যাওয়া যাবে না। এখন উপায়?
সিতেশ বাবু বললেন, ‘রাতটা এখানেই কাটিয়ে যান। আমার সাথে যা হয় একটু খেয়ে নেবেন।’
দোকান বন্ধ করে এক দৌড়ে বাড়ির ভেতর ঢুকলেন সিতেশ বাবু; আমিও পেছন পেছন। সিতেশ বাবু রান্না চড়ালেন। খানিকটা সময় তার পাশে বসে রান্না দেখি আর গল্প করি। কাল রাতে খেয়েছি। আর এখনো পেটে ভাত পড়েনি। সিতেশ বাবু বললেন, ‘আপনার জন্য ভাত চড়িয়ে দিলাম। আপনার তো মাছ-মাংস ছাড়া কষ্ট হবে।’
আমি হাসলাম, ‘তা হবে। আমার মেসে আজ মাংস ছিল।’
‘আচ্ছা দেখি মাংস জোগাড় করা যায় কিনা। কী মাংস খাবেন?’
‘এখন আপনি মাংস পাবেন কোথায়?’
‘দেখি না। আপনি বলেন?’
‘আমার যে ক্ষুধা লেগেছে, মানুষের মাংস হলেও খেতে পারব।’
‘বুঝতে পেরেছি।’
একটু ঝিমুনি এসেছিলো। সিতেশ বাবু খাওয়ার জন্য ডাকলেন। উঠে গিয়ে দেখি আসলেই মাংসের ব্যবস্থা করে ফেলেছেন ভদ্রলোক। লাল টকটকে মাংসের ঝোল। অনভ্যস্থ হাতে মশলা বেশি দিয়ে ফেলেছেন।
সৌজন্য করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মাংস পেলেন কোথায়?’
‘পেলাম আর কি।’
‘কিসের মাংস।’
একটু তো তো করে সিতেশ বাবু বললেন, ‘মানুষের।’
‘মানে!’
‘ওই যে আপনি বললেন, মানুষের মাংস হলেও চলবে। তাই নবা পাগলাকে কেটে রান্না করে ফেললাম। আপনি আরো কয়েকবার খেতে পারবেন।’