মানষ্যেরা মইরা যায়



আবু মুস্তাফিজ
অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশার মা মরল বিষ খাইয়া আর হাফিজার আব্বা মরল নাড়ে প্যাঁছ নাইগা।

তখন চৈত মাস, আসি আসি করিতেছে। পুলাপান পাকড়া গুটার গুয়ায় খড়ছি গাঁইতা আর খড়ছির গুয়ায় মুরগের ফৈড় গাঁইতা আকাশে জোরে ঢেল দেয়। হুঁশ কইরা পাকড়া গুটা আকাশের এত উঁচায় উড়িয়া যায় যে তারে আর দেখা যায় না।

মুরগির বাচ্চার ন্যায় জুড়ায় জুড়ায় চোখ মেলিয়া আকাশ পানে চাইয়া থাকে পুলাপানরা। একটু পরেই মুরগের ফৈড় চড়কির ন্যায় ঘুরিতে ঘুরিতে নিচে নাইমা আসে। বড় মনোহর ভঙ্গিতে।

গোড়ান গ্রামের দুয়ারে দুয়ারে তখন এই খেলা চলে। বাতাসে সইষ্যার ঝাঁঝ, বাড়ি দেয় মাইনষ্যের নাকে মুখে। গিরস্ত বাড়ির দুয়ারভরা ধুবরি আর মাঘী সইষ্যার পালা। হুকা দেওয়া সইষ্যার জ্বালায় খালি পাওয়ে হাঁটন দায়। পুলাপানের নরোম পায়ে বিন্দা পড়ে।

উহঃ কইরা চিক্যার দেয় আজিজ মাস্টরের পুলা রানা। এহনো দুধ ছাড়ে নাই, কিন্তু ছাড়ার কথা আছিল আরো দুই বচ্ছর আগে। কিন্তু মাস্টরের বউর বছর ঘুরতেই আরেক গেদি অওয়ায় লাভ হইছে ড্যাকরার। বইনেরে কেনি মাইরা নিজেই ঝাঁপিয়া পড়ে মাওয়ের নধর বুনিতে।

এতক্ষণ ঘুমিয়াই আছিল, গাড়ি বারিন্দায় ফালিয়া রাখা জলচকিতে। পুলাপানের উলাউলিতে ঘুম ভাঙছে। চোকে দুই ডলা মাইরা দেকে তাগো দুয়ারে পুলাপানের মেলা।

জলচকিথন নাইমা নৈড় দিয়া দুয়ারে নামে। হইষ্যা কাঁটা নরোম পাওর পাতায় ঘাঁই মারে। উহঃ কইরা চিক্যার দেয় ছ্যাড়া। কিন্তু পুলাপানের উলাউলিতে সে চিক্যার হারিয়া যায়।

মাস্টরের পুলাও ট্যাটন কম না, খাড়াইতে নিজেরে সামলিয়া নেয়। ন্যাটা দিয়া বইয়্যা ডাইন পাওডারে বাঁও পাওয়ের উপরে তুইলা বরই কাঁটার ন্যায় সইষ্যার কাঁটা ঝাইড়া ফালাইতে ফালাইতে ফোত ফোত কইরা কাঁন্দে, নাকে হিদ জইম্যা থাকায়।

পুলাপানের উলাউলি কী নইয়া ঠাহর করিতে এট্টু টাইম লাগে রানার। সবার চোখ আকাশমুখী থাকায় সেও চোখ মেলিয়া আকাশ দেখে। একটা না, দুইডা না, ঝাঁকে ঝাঁকে মুরগের ফৈড় চড়কির ন্যায় ঘুরিতে ঘুরিতে নিচে নামিয়া আসিতেছে।

মাস্টরের পুলার জল টলমলা চোকে মুরগের ফৈড়ালা পাকড়া গুটার ছবি আয়নার ন্যায় ফুটিয়া উঠে।

চড়কি মাটিতে গড়াইয়া পড়িলে পুলাপান পাছড়াপাছড়ি করিয়া উহাদের কুড়াইয়া ফির‌্যা ছুঁড়িয়া মারে। উহারা উড়িয়া চলিয়া যায় আকাশে। জোড়ায় জোড়ায় চোখ উহাদের নাই হওয়া দেখে। ফের ফিরা আইলে চড়কির ঘূর্ণিতে ওগো চোকও ঘুরপাক খাইতে থাকে।

একটা চড়কি রানার সামনেই পড়ে। থাফা দিয়া সে তা ধইরা ফেলে। চড়কির মূল মালিক এট্টু দূরে খাঁড়িয়া মালিকানা হারানির আশঙ্কায় পড়ে। মাস্টরের পুলা বইলা কথা। চাইলেই কাইড়া নেওয়া যায় না। তাই দূরে খাঁড়িয়া কারবার দেখে।
চড়কি হাতে পাইয়া রানা সকল ব্যথা ব্যাদ্না ভুইলা লাফ দিয়া খাঁড়ায়। অন্যগো দেখাদেখি সেও উহা ছুঁড়িয়া মারে। কিন্তু চড়কি আকাশে না গিয়া মাথার দুই তিন হাত উপরে উঠিয়াই নামিয়া পড়ে।

ইহা দেকিয়া চড়কির মূল মালিক খিক খিক করিয়া হাসে। আইগিয়া কাছে আইসা রানার হাত থিকা চড়কি নিয়া কহে, ওমনে না, এমনে। কইয়া মূল মালিক চড়কি আকাশে ছুড়িয়া মারে।

কিন্তু মালিকানা হাতছাড়া হইয়া যাওয়ায় রানা এইবার মাটিতে গড়ান দিয়া কান্দন শুরু করে। ব্যাপারটা আগেই বুঝবার পারছিল ছ্যাড়া। তাই নৈড় দিয়া পুলাপানের ভিড়ে ঢুইকা যাইতে দেরি করে না আর।

কিন্তু মাস্টরের পুলার গৈড় পাইরা কান্দনে অন্য পুলাপানও ডরাইয়া যায়। তারা চড়কি খেলা বাদ দিয়া পুব ভাগে পলাইয়া যায়।

পুব ভাগে বিরাট খেড়ের পালা, সেইখানে তারা পাহাড়ে চড়ার আমোদ নিয়া পালার উপরে উঠিতে থাকে। উপরে উঠিয়া লাফ দিয়া নিচে নামে।

নতুন এই খেলায় আমোদ আরো বেশি। তুমুল উত্তেজনা লইয়া পুলাপান পালার উপরে ওঠে এবং লাফ দিয়া নিচে নামিয়া পড়ে।

মাস্টরের পুলার গড়াগড়ি পাইড়া কান্দনটাই সার হয়, কেউ তারে ধরেও না, চড়কিও আনিয়া দেয় না। ফলে তার কান্দনডা আর জমে না। তাই কান্দন ভুইলা এক ফাঁকে চাইয়া দেখে তাগো দুয়ারে আর কেউ নাই। পুবভাগ থিকা উলাউলির আওয়াজ ভাসিয়া আসে।

কান্দন ভুইলা সে পুবভাগে দৌড় মারে। যাইয়া দেখে পুলাপান খেড়ের পালার মাথায় উঠিয়া লাফ দিয়া নিচে নামিয়া পড়িতেছে।

এই খেলাও তার মনে ধরে। সেও খেড়ের পালার পাহাড়ে উঠতে যায়। খেড়গুলারে চুলের মুঠির মতো ধইরা ধইরা ধীরে ধীরে উপরে উঠতে থাকতে থাকে। কিন্তু কিছু দূর উঠিয়াই চুলের মুঠি ছাড়িয়া দিলেই ছর ছর কইরা নিচে নাইমা আসে।

এ এক মজার খেলা। একবার ওঠা, আরেকবার নামা। বেশ কয়েকবার চেষ্টার পর রানাও পালার মাথায় উইঠা পড়ে। উইঠা তার দুনিয়াডারে কেমন ছোট ছোট লাগে। আকাশটা য্যান মাথার একটু উপরেই। এক লাফের জায়গায় দুই তিন লাফ দিলেই ধরা যাইব তারে।

পুব ভাগের চৌরি ঘরের চাল দেখা যায়। চালে শুইয়া আছে বরই গাছ, তার অসংখ্য ডাইলপালা, পাকা পাকা বরই। যা নিচ থিকা দেখা যায় না। শিমগাছ, তার বেগুনীফুলগুলা।

মাস্টরের পুলা চারপাশটা একটু একটু দেখতে থাকে, কিন্তু পারে না বেশিক্ষণ। পুলাপান হুড়াহুড়ি লাগাইয়া দেয়, তারা উপরে উইঠা জাম্প দিয়া নিচে নাইমা যায়।

দেখাদেখি মাস্টরের পোলাও জাম্পের প্রস্তুতি নেয়। ওয়ান টু থিরি। যেনবা অনন্তকাল শূন্যে থাকিয়া মুরগের ফৈড়ের ন্যায় মাটিতে গোত্তা খায়।

আর তখনই সে টের পায় তার বাঁও হাতটা বাঁইকা গেছে। কী এক অভাবিত বোধ তারে ঘিরিয়া ধরে, তার নিঃশ্বাস বন্ধ হইয়া আসে।

ম্যালাক্ষণ বাদে যখন সে নিশ্বাস নিতে পারে, তখন তার আর্তচিৎকারে পুব ভাগ হইতে মেহেদীর নানী ছুটিয়া আসে। কিছুদিন আগেই সে তার মেয়ে ও নাতি নাতকোরদিগকে দেখিতে দূরপাশা হইতে গোড়ান আসিয়াছে।

মেহেদীর নানী রানার বুক দুইয়া দিতে থাকে, সুরা পড়িতে পড়িতে। নিঃশ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক হইয়া আসিলে রানার চিৎকার বাড়িয়া চলে।

নানু আমার নানু কী হইছে আপনের? বলিয়া মেহেদীর নানী রানার বাঁও হাত দেখিয়া চমক্যা উঠে। সে হাতটারে সোজা করিতে চায় কিন্তু পারে না, উপরন্তু উহা ফুলিয়া উঠিতে থাকে।

শুনিয়া আজিজ মাস্টর স্কুল হইতে ছুটিয়া আসে। আইসা দেখে পুত্রর বাঁও হাত ফুলিয়া ঢোল হইয়া গেছে। তাহারে জলচৌকিতে শুয়াইয়া মাথায় পানি ঢালিতেছে, তার চাচাত ভাই হুমায়ুনের শ্বাশুড়ি, মেহেদীর নানী। উৎসাহী পুলাপান গোল হইয়া তাহাই দেখিতেছে, কোনোরূপ গোল না করিয়া।

আজিজ মাস্টর সময় নষ্ট না করিয়া একখানা বাঁশ কাটিয়া বাতি বানাইয়া তাহা দিয়া পুত্রর হাত যথাসম্ভব শক্ত করিয়া বাঁধিয়া দেয়।

সন্ধ্যায় অফিসথন রানার আম্মা আসিয়া আরেক দাবার চিকরাচিকরি শুরু করে। আব্বা আপনের কী হইছে? কী হইছে আপনের? আমার সোনা আব্বা, আপনে কিসের নিগ্যা খেড়ের পালায় উঠছিলেন? বইলা হাউমাউ কইরা কান্দে।

আজিজ মাস্টর জলচৌকিতে বইসা থাকে, গ্রামের লোকেরা তারে ঘিরিয়া থাকে, নানা কথা জিগাশ করে। সে কিছুর জব দেয়, কিছুর দেয় না। গ্রামের লোকেরা তার থমভাব বুঝিয়া নিজেরাও থম মারিয়া থাকে। কেহবা আবার নিজেরা নিজেরা প্যাচালে মগ্ন হইয়া পড়ে।

সারা রাইত কোনোভাবে কাটতে না কাটতেই সক্কাল বেলা তিনজনে ম্যালা করে মির্জাপুরে, কুমুদিনী হাসপাতালে।

হাসপাতালে ম্যালা মানুষ, সবাই অপরিচিত। তারই মাঝে একটা লোকে আজিজ মাস্টররে ডাকে, দুলা ভাই কেমুন আছেন?

আজিজ মাস্টর আইগিয়া যায়, আপনে এইখানে?

রানার আম্মা রানারে কয়, হাফিজার আব্বা।

হাফিজার আব্বা কয়, আমার ওসুক, ডাক্টারেরা কইছে, নাড়ে প্যাঁচ নাগছে।

আজিজ মাস্টর আহারে কইয়া সহমর্মিতা প্রকাশ করে।

হাফিজার আব্বা আরো জিগায়, আমনে এনু কিসের নিগা আইছেন?

আর কইয়েন না, আপনের ভাইগনার হাত ভাঙছে। কইয়া আজিজ মাস্টর তাড়াহুড়া করে, আসি তাইলে? যাওয়ার সুমে দেখা করুমনে।

ঠিকাছে দুলাভাই, কইয়া হাফিজার আব্বা খালি গতরে নিস্পৃহ দৃষ্টিতে বসিয়া থাকে। তার নাড়ের প্যাঁচ ছোটার আশায়।

অপারেশন থিয়েটারে আজিজ মাস্টরের পুলা কেউরে কাছে ঘেঁষপার দেয় না। প্রথমে নাত্তি মারে নার্সরে। পরে এক শিক্ষানবিস ডাক্টার তারে ধরবার আইলে তারেও নাত্তি মাইরা বসে। ডাক্টার পিছিয়া যাওয়ায় নাত্তিডা অল্পের নিগা নাগে না।

এমতাবস্থায় ডাক্টার নার্সেরা একজন আরেকজনের মুখি তাকাবুকি করে। তখন মূল সার্জন হাতে একটা ফোরসেপ তুলিয়া লয় আর মুখ দিয়া চুক চুক শব্দ করিয়া মাস্টরের পুলার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

ছুরিমুখি তাকাইয়াই মাস্টরের পুলার হাতপাও ছোড়াছুড়ি বন্ধ হইয়া যায়, ডরাইয়া স্থির হইয়া পড়ে। আর এই সুযোগে কেউ একজন তার মুখে ক্লোরোফর্মের মাস্কটা লাগাইয়া দেয়।

মাস্টরের পুলা অন্য পৃথিবীতে চলিয়া যায়, যে পৃথিবীতে পাকড়া গোটা মুরগের ফৈর হইয়া উড়িয়া চলে।

রানাও মুরগের ফৈড়ের ন্যায় উড়তে উড়তে এক আকাশ হইতে আরেক আকাশে যাইতে থাহে। তারপর একটা গভীর জঙ্গলে নামিয়া পড়ে। জঙ্গলের ভিতর দিয়া যাইতে যাইতে হঠাৎ একটা সুরঙ্গ দেখিতে পায়।

এই সময় কে যানি তারে ডাকে, আব্বা ওঠেন ওঠেন... আপনের হাত ভালো হইয়া গেছে।

রানার উঠতে ইচ্ছা করে না। সে সুড়ঙ্গের ভিতরেই থাকিতে চায়। কিন্তু আজিজ মাস্টর ছাড়ে না, আব্বা দেখেন দেখেন, আপনের নিগা কতডি চলকেট আনছি।

চলকেট নাকি আজিজ মাস্টরের ধাক্কাধাক্কি রানারে সুড়ঙ্গ হইতে টানিয়া আনে। উঠিয়া দেখে সে একখানা স্ট্রেচারে শুইয়া আছে। তার বাঁও হাতে প্লাস্টার করা, খালি গা। তার শরম করে।

রানার মা তার এক হাতে জামাটা পরায়, বাঁও হাত গজ দিয়া গলার সাথে ঝুলাইনা।

রানারে কোলে লইয়া আজিজ মাস্টর হাসপাতাল থিকা বাইরয়। নিচতালায় আইসা হাফিজার আব্বার নগে ফের দেখা হয়।

দুলাভাই আমার নিগা দুয়া কইরেন। ছলছল চোখে চাইয়া থাকে হাফিজার আব্বা। তার ফর্শা শইল শুকাইয়া দড়ি হইয়া গেছে পরাই।

হাসপাতালের সামনে শিশু গাছ, কৃষ্ণচূড়ারা ছায়া বিছাইয়া রাখাইয়া আছে। আজিজ মাস্টর রিকশা নেয়। তাহাদে পুলা আর বউরে লইয়া ম্যালা করে মির্জাপুর বাসট্যান্ডে। রানার বাঁও হাত ঝুইলা থাকে বুকের কাছে।

গাড়ি ঘোড়ার ন্যায় দৌড়ায়। চৈত মাসের গরমে যাত্রীরা বাসাত না থাকায় জুবজুবিয়া ঘামে। কাটবডি বাসের নগে রাস্তার গাছেরাও দৌড়ায়।

পাকুল্যা বাজারে আইসা গাড়ি থামে। আজিজ মাস্টার নাইমা পড়ে, স্ত্রী পুত্রসহ।
তাহাদে বিাজার থিক্যা এক সের গুল্লা কিনে, রসগুল্লা। বউরে কয়, খাবা?

বউ কয়, না, থাইগ্গাছে। বাইত্তে যাইয়া খামুনি।

পুত্ররে জিগাশ করে, আব্বা আমনে একটা খাবেন?

রানার সুড়ঙ্গের ধ্যান্দাটা এখনো ছাড়ে নাই, খুন খুন কইরা কান্দে।

ফলে আজিজ মাস্টর নিজেই কয়, এহ বাইত্তে তো আইসা পড়ছি, আবর কান্দন কিসের?

রানা তেমু খুন খুন কইরা কান্দে। তার আম্মা তারে কোলে নিয়া বসে। আর কানে কানে কয়, কাইলকা নানীগইত্তে যামু। কান্দে নাছে।

নানীর বাড়ি যাওনের কথা শুইনা রানার চোখের সুড়ঙ্গে ঝিলিক মারে। তার খুন খুন কান্দন বন্ধ হইতে থাকে।

নানীগইত্তে যাইয়া শোনে হাফিজার আব্বা মইরা গেছে। পরের দিন তার লাশ আসে, তালাইয়ে মোড়া।

বিশার মাও আরো সপ্তাহানি আগেই মইরা গেছে।

রানা তার আম্মার কোলে বইসা দুধ খায়, না ভাঙ্গা হাত দিয়া বুনি ছানতে ছানতে। রানার আম্মার উঁকুণ বাইছা দেয় বিশার চাচতো বোইন সালেহা।

হইছিল কী, বিষ খাইল যে? রানার আম্মা জিগাশ করে।

প্যাট বাজছিল।

এল্লা! কস কী? ওই বুইড়া বেঠির!

হ, ওইডাই তো কইতাছে মাইনষ্যে।

তা ক্যারা বাজাইছিল?

চারাবাড়ির এক ছ্যারা। কামলা দিবার আইছিল ওগো বাইত্তে। এর মধ্যেই ঘটনা ঘইটা গেছে। বিশা রাইতে উইঠা বাঁশছুফে হাগবার যাইয়া মাওরে ওই ছ্যারার নগে দেখছে।

তারবাদে?

তারবাদে আর কী? পুলায় মায়ের নগে রাগ কইরা ঘরে দিছে ঝাঁপ, আর খুলে না। বিশার মাও দুয়ারে খাড়িয়া কান্দে। কিন্তু পুলায় আর ঝাঁপ খুলে না যে খুলেই না।

হুম।

ছ্যাড়ারই বা দুষ কী? কয়দিন পরে করব বিয়া, মার এই কীত্তিকলাপ কি সইয়া পারে?

তাতো ঠিকই।

হেই রাইতেই বিষ খায় বিশার মাও। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই শ্যাষ। পরে ডাক্তাররা কয়, হ্যার প্যাটে বাচ্চা আছে, এক মাসের।

আহারে।

রানা দুধ খাইতে খাইতে সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়া হাঁটতে হাঁটতে মুরগের ফৈড়ের ন্যায় আকাশে উড়িতে থাকে।

   

দুই দেশের রং মিলেছে এক দেয়ালে



মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, ব্যাংকক, থাইল্যান্ড
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

রঙের শহর, হাসির শহর ব্যাংকক। দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ করা শহর ব্যাংকক। ব্যাংককের প্রাণকেন্দ্র সিয়ামেই রয়েছে ব্যাংকক র্আট এন্ড কালচারাল সেন্টার (বিএসিসি)। বাংলাদেশ থেকে যারা ব্যাংককে বেড়াতে যান, তারা যদি এমবিকে মলের পাশ দিয়ে স্কাই ওয়াক হয়ে তৃতীয় তলায় প্রবেশ করেন তাহলে হাতের ডানে চোখ ফেললেই দেখতে পাবেন বাংলাদেশের রঙের খেলা আর জীবনযাত্রার চিত্র।

স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে গত ২৬ র্মাচ থেকে ব্যাংককের র্আট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ ও থাই চিত্রশিল্পীদের অংশগ্রহণে ‘ড্রীম অব কালারস’ বা ‘রঙের স্বপ্ন’ র্শীষক চিত্র প্রর্দশনী। ‘কানেক্টিং টু ল্যান্ডস এন্ড টুপিপলস’ স্লোগানকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের নিমিত্তেই এই আয়োজন।


তৃতীয় তলার করিডোর ধরে হাঁটতেই চোখে পড়বে শিল্পী মুস্তাফিজুল হকের নিহঙ্গ। ওয়াসি পেপারের ওপর জাপানি ধরনের চিত্রকর্মের জন্য প্রসিদ্ধ তিনি। ক্যানভাসের ওপর আর্কিলিকের চিত্রকর্ম ‘হর্স’ মনযোগ আকর্ষন করছিল দর্শনার্থীদের। তার চিত্রকর্মের বড় বৈশিষ্ট্য নাটকীয়তা এবং বিষয়ের গভীর উপস্থিতি।

নগরের জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলতে শিল্পী কামাল উদ্দিনের জুড়ি নেই। তবে এখানে ব্যক্তির পোর্ট্রেট নয় বরং পেস্টেলে তবলার রং ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী।

আবার থামাসাত বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রকলার শিক্ষক খাজোনসাক মাহাকুন্নাওয়ানের তুলিতে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নগরের জীবন। রিকশার সঙ্গে যাত্রীদের ছুটে চলা। সময়কে যেন পাশ কাটিয়ে ছুটে চলছে তার চিত্রকর্ম।


ঢাকার গ্যালারি চিত্রকের ১৮ জন শিল্পী এবং থামাসাত ইউনিভার্সিটির ফাইন অ্যান্ড এপ্লাইড আর্টস বিভাগের ৪ জন শিল্পীর যৌথ অংশগ্রহণে চলছে এই আয়োজন। চলবে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত। গত ২৬ মার্চ চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন থাইল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহা. আব্দুল হাই।

চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন নিয়ে তিনি বলেন, দুটি দেশের ভূমি আর মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে এনেছে এই আয়োজন। চিত্রকর্মের মাধ্যমে যে যোগাযোগ সেটা শুধু বাহ্যিক নয়, বরং আত্মার যোগাযোগ। শুধু দেশকে চেনায় না, বরং সেখানকার জীবনযাত্রার ধারণা দেয়, মানুষকে কাছে নিয়ে আসে।


ব্যাংককের বাংলাদেশ দূতাবাসের এই চিত্রপ্রদর্শনীতে রফিকুন্নবী, আব্দুস সাকুর শাহ, সৈয়দ আবুল বার্ক আলভি, শেখ আফজাল, মাহফুজুর রহমান, সুমনা হক, মুনিরুজ্জামান, জহির উদ্দিন, কনক চাপা চাকমা, বিপাশা হায়াত, মোহাম্মদ ইউনুস, সুলেখা চৌধুরী, রেজাউন নবী, কামাল উদ্দিন, পারভীন জামান, সুমন ওয়াহিদ, মোস্তাফিজুল হক, আহমেদ সামসুদ্দোহার চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে।

এছাড়াও থাইল্যান্ডের চিত্রশিল্পী খাওজনসাক মাহাকুন্নাওয়ান, ওয়ারাপান সামপাও, জিরাতচায়া ওয়ানচান, প্রারুনরপ প্রিউসোপির চিত্রকর্মও স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে।

ব্যাংকক আর্ট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে সকাল থেকেই বিভিন্ন বয়সী শিল্প প্রিয় মানুষের আনাগোনা থাকে। সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই প্রদর্শনী উপভোগ করতে পারছেন দর্শনার্থীরা।

;

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসবিদ-দার্শনিক মুঈন উদ-দীন আহমদ খান জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন এক মনীষীর নাম। বাংলাদেশের বিদ্যাবৃত্তে ক্লাসিক্যাল চরিত্রের শেষ দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। ২৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার) ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। 

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান (১৮ এপ্রিল, ১৯২৫-২৮ মার্চ, ২০২১) নির্জলা তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের খোঁজে সুদীর্ঘ জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চার কষ্টসাধ্য দিনগুলো অতিবাহিত করেন নি। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের সত্য সন্ধান শুধু তথ্য আর যুক্তি ভিত্তিক নয়। প্রকৃত ইতিহাস মূলত ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাসের পুনর্গঠন, কল্পনা, সমকালীন পর্যালোচনা ও ইনটুইশনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সান্নিধ্যে এলে সবাই এই সত্য টের পেতেন যে, ইতিহাস প্রধানত দর্শন ও সাহিত্যের সমধর্মীতায় বর্তমানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণের এবং দিকনির্দেশনা দেওয়ার অপরিহার্য মাধ্যম। তাঁর স্বকীয় চিন্তার দ্যুতিতে তিনি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা চর্চা ও গবেষণায় একটি বিশিষ্ট ধারার প্রতিভূ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং একটি পুরো জীবন সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাচর্চার ধ্যানজ্ঞানে যাপন করেছেন। আর চট্টগ্রামের নিরিখে তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা কাঠামোর আদি নির্মাতাদের অন্যতম। যেমনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র ড. আবদুল করিম ছিলেন ইতিহাসচর্চার প্রতিষ্ঠাতা, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইংরেজির, ড. আর. আই চৌধুরী রাজনীতি বিজ্ঞানের, তেমনিভাবে তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবদ্ধ বিদ্যাচর্চা ধারার সূচনাকারী। চট্টগ্রামের আধুনিক উচ্চশিক্ষা বিস্তারের আদি মুঘলদের একজন ছিলেন তিনি।  

তিনি ছিলেন আড়ম্বরহীন জ্ঞানসাধক। নিজস্ব বিদ্যাবলয়ের বাইরে তাঁর কোনও আত্মপ্রচার বা আত্মগরিমা ছিল না। যদিও তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা তাঁর আশেপাশে খুব বেশি ছিল না, তথাটি যারা তাঁর রচনা খেয়াল করে পড়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে কিংবা অনানুষ্ঠানিক পরিসরে আলাপ, আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্কের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন, কত ভাষা, কত বিষয়, কত তত্ত্ব ও তথ্যাদি সম্পর্কে অনায়াস দক্ষতা ও পা-িত্য ছিল প্রাচ্যদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের এই জ্ঞানতাপসের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের আদিবাস আর পুরনো চট্টগ্রাম শহরের রুমঘাটা থেকে এই মান্যবর জ্ঞানবৃদ্ধের কাছ থেকে বিচ্যুরিত দীপ্তি কিছু কিছু অনুভব স্পর্শ করেছে দেশে-বিদেশে তাঁর কর্ম ও গবেষণা ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

তাঁর জ্ঞান, গবেষণা, মনীষা, বুদ্ধির দীপ্তি, বহু ভাষায় পারঙ্গমতা তাঁর সমকালে অন্য কারও মধ্যে বিশেষ পরিলক্ষিত হয় নি। বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চায় প্রবাদপ্রতীম ড. আহমদ হাসান দানি যে তিনজন ছাত্রকে গবেষণায় প্রণোদিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান তাঁদের একজন। অন্য দুইজন হলেন আবদুল করিম ও মোহর আলী। এই তিনজনই বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় সত্যিকারের মৌলিক অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে প্রথম বিভাগ, স্বর্ণপদক, ফেলোশিপ ও বৃত্তি লাভ করেন একজন মেধাবী ছাত্র রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর তিনি মোটেই থেমে থাকেন নি। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ফিরে এসে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানির তত্ত্বাবধানে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ বিষয়ে পথপ্রদর্শনকারী পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ফেলোশিপ লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলের ‘ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ রাজনীতি বিজ্ঞানের ‘সেমিনার ইন ফিল্ড ওয়ার্ক কোর্স’ অধ্যয়ন করেন। তিনি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রখ্যাত প-িত, ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের সান্নিধ্যে এসে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হন। যে কারণে, পরবর্তী জীবনে তিনি ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, বিশেষত এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের ক্ষেত্রেও নিজের অবদান রাখেন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থীদের ছাড়াও তাঁর মূল-বিষয়ের বাইরের লোকজনকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন নেতৃস্থানীয় শিক্ষক যথাক্রমে মর্শন বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান বদিউর রহমান এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন শব্বির আহমদ তাঁর অধীনে পিএউচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

গবেষণা তত্ত্বাবধানে তিনি ছিলেন প্রচ- রকমের শুদ্ধতাবাদী। একটি প্রকৃষ্ট গবেষণার জন্য ¯œাতকোত্তর ও এমফিল পর্যায়ের গবেষকদেরও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত করতেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে গবেষক হিসাবে স্বাধীনভাবে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তাঁর সাথে গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড. আফম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, “তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর অনুমোদন নিয়ে কলকাতা, লক্ষেœৗ, দিল্লি, তুঘলকাবাদ, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, মক্কা ও মদিনা সফর করি।” কোনও মতে একটি ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার অসৎ পন্থার বিপরীতে গবেষণাকে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর করতে তিনি ছিলেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শুদ্ধতম তত্ত্বাবধায়ক। শেষজীবনে তাঁর সঙ্গে বা পরামর্শে যারা গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মানস গঠনে ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নির্মাণে তিনি শ্রমবিমুখ ছিলেন না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা বই-পুস্তক পর্যালোচনায় লিপ্ত হতেন। এমন চিত্র আমি নিজে তাঁর বাসভবনে উপস্থিত কালে লক্ষ্য করেছি। কখনও নবাগত গবেষকদের তিনি অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে পাঠাতেন। তাঁর রেফারেন্সে একাধিক তরুণ গবেষক আমার কাছে এসে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাঁর রেফারেন্সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা সম্পন্ন করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ত ও প্রণোদনাদাতা রূপে ছিলেন নিরলস।   

কঠোর তথ্যনিষ্ঠা ও শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের প্রতিটি রচনায়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলো যে কারণে একই সাথে পাঠকপ্রিয় এবং অ্যাকাডেমিক জ্ঞান ভা-ারে মণি-মুক্তা তুল্য। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব ফরায়েজি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’ একটি পথিকৃৎ গবেষণা, যা ‘বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে। যে ফরায়েজি আন্দোলনকে ওয়াহাবি আন্দোলন বা তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া নামেই সবাই জানতো, তিনি তাঁর বহুমাত্রিক চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত করেন।  ফারায়েজি আন্দোলন যে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম ও আদি প্রচেষ্টা, তিনিই সর্বপ্রথম তা প্রমাণ করেন। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উত্থিত এই আন্দোলনের গণমুখী চরিত্র, ঔপনিবেশিকবাদ বিরোধী বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু মানসিকতার বিষয়াবলী তিনি ঐতিহাসিক তথ্য ও ধর্মতাত্ত্বিক মাত্রায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে উপস্থাপন করেন। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও বৃহৎ ক্যানভাসে গবেষণার কৃতিত্বে তিনি এই বিষয়ে এবং ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বিনির্মাণের পথিকৃৎ প্রাণিত স্বরূপে সর্বমহলে সম্মানীত হয়েছেন। 

পরবর্তীতে প্রকাশিত মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের গ্রন্থ ও প্রবন্ধে তিনি তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ রেখেছেন। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর লেখায় দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি বহুবিদ্যার প্রকাশ ঘটেছে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও গবেষণার বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাধারাকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করার প্রয়াস। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী দার্শনিকদের মতো সংলাপ-প্রবণ ব্যক্তিত্ব। কেউ আগ্রহী হলে কিংবা কারো প্রতি তিনি আগ্রহী হলে তাঁকে বা তাঁদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতেন। তিনি তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো বইয়ের পাতার শুকনো অক্ষরে বন্দি ছিলেন না, জ্ঞানবৃত্তের মানুষের সঙ্গে প্রাণবন্ত সংলাপ ও সংশ্লেষের মাধ্যমে সদা জীবন্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে তো বটেই, বৃহৎ বঙ্গদেশে খুব কম সংখ্যক প-িতই এমন ছিলেন, যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অন্যকে প্রণোদিত করার ক্ষমতা ধারণ করতেন। ঢাকায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং চট্টগ্রামে ড. আবদুল করিম, ড. আর. আই. চৌধুরী ছাড়া কম প-িতই ছিলেন, যারা শিক্ষার্থীদের প্রাণিত করার ক্ষেত্রে মনীষী মুঈন উদ-দীন খানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য।

জ্ঞানের সঞ্চার ও বিস্তারে তাঁর অসীম কষ্ট সহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও বিনয় তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের প্রাচীন জ্ঞানতাপসের আধুনিক প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমি তা স্পষ্টভাবে অনুভব করি। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। এবং বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন আমার চেয়ে কয়েক প্রজন্ম অগ্রগামী। তথাপি অশীতিপর বয়সে এসেও তিনি আমার কোনও লেখার প্রতি আগ্রহী হলে নিজে ফোন করে জানিয়েছেন। ডেকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং বিষয়টিকে তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে আরও সমৃদ্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেসব আলোচনায় জ্ঞানতত্ত্ব ও তুলনামূলক দর্শন সম্পর্কে তাঁর অতলস্পর্শী পা-িতের দীপ্তিমান প্রভার আঁচ পাওয়ার বিরল সুযোগ আমার হয়েছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছিল, বহু তরুণকে তিনি গবেষণার দিক-নির্দেশনা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দিতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মধ্যে পথ প্রদর্শনের একটি বিরল গুণ ছিল। আর ছিল জ্ঞানকে অকাতরে ছড়িয়ে দেওয়ার উদার মানসিকতা, যা আজকের অ্যাকাডেমিক প্রতিযোগিতার পঙ্কিল ও সঙ্কীর্ণমনা ধারার প্রেক্ষিতে অকল্পনীয় বিষয়। বড় মন ও মুক্ত মানসিকতার কারণে তিনি ‘বাংলাদেশের লিলিপুট প-িতদের সমাবেশে’ মহীরূহ-সম ব্যক্তিত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের মতো বিটপী ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যপটে রেখে আজকের ক্ষুদ্রতর পরিসরে আলোচনা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানের ঊন-মানুষ ও ঊন-মানসিকতার পরিম-লে তাঁর মতো বড় মানুষের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। তিনি এবং তাঁর সমগোত্রীয়রা শেষ মুঘলের মতো দৃশ্যপট থেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু রেখে গিয়েছেন ধ্রুপদী ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্বের দীপ্তি ও বিভা। তিনি ছিলেন প্রথম প্রজন্মের আধুনিক বাঙালির হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সকল অগ্রণী প-িত, গবেষক ও শিক্ষাব্রতীগণের শ্রেষ্ঠতম ও উজ্জ্বল প্রতিনিধি, যারা  জাগতিক প্রাপ্তির আশায় জ্ঞানের সাধনা করেন নি। জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার নিতান্ত আবশ্যক পরিসীমার বাইরেও তাঁরা সচরাচর যান নি। তাঁদের নিতান্ত আবশ্যক বস্তুর তালিকায় সর্বাগ্রে ছিল জ্ঞানচর্চা, বিদ্যার্জন ও গ্রন্থপাঠ। বিষয় ভিত্তিক প্রয়োজনীয় বইয়ের বাইরেও অন্য বিষয় সংক্রান্ত রচনা তাঁরা পড়তেন আনন্দ ও কৌতূহল নিবৃত্তির সুতীব্র আকর্ষণে। কারও কারও পুস্তক সংগ্রহ আর রোজগারের মধ্যে কোনও ভারসাম্য থাকতো না। জাগতিক উন্নতির বিষয়গুলোকে তাঁরা তুচ্ছ বিবেচনা করে অবজ্ঞা করেছেন। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর মতে, “যে জীবনে বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা বিরল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ সত্যিই সারস্বত-কর্মে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বর্তমানের বিশ্লেষণপ্রবণ গবেষণার ধারা তখনও প্রবল হয় নি। কিন্তু অনেক গবেষণাই গভীর পা-িত্যের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতো।” মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান সম্পর্কে এই বক্তব্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আত্মমগ্ন ধ্যানীর মতো সারা জীবন তিনি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থেকে গভীর পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু নিজেই নন, প্রণোদিত করেছেন পরবর্তী বেশ কিছু প্রজন্মের উৎসাহী তরুণদের, যাদের অনেকেই বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত রয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে ইতিহাসের আরেক মহান সাধক যদুনাথ সরকারের কিছু কিছু বিষয় তুলনীয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রবল পরিশ্রম, জ্ঞান তৃষ্ণা এবং অনুসন্ধান। যদুনাথের বিশ্লেষণের নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বিতর্ক থাকার পরেও ইতিহাসচর্চায় তিনি সর্বজনমান্য আচার্য। তিনি নিজের কর্ম ও জীবন আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতেন: “পথের প্রান্তরে করি নাই খেলা/শুধু বাজায়েছি বসি সারাবেলা/ছিন্নতন্ত্রী বীণা।” মনীষী প্রফেসর ড. মুইন উদ-দীন আহমদ খানও সারাজীবন জ্ঞানচর্চার বাঁশরী বাজিয়েছেন। একটি আস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের মাধ্যমে। বিদ্যার্চচাকে পেশাগত পরিম-লে জিম্মি না করে জীবন ও যাপনের মূলমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সব কিছুই তিনি করেছেন নিজের সুমৃত্তিকা ও মানুষকে কেন্দ্র করেই। জীবনের পর্বে পর্বে নানা দেশে, নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তিনি অবশেষে ফিরে এসে আলোকিত করেছেন প্রিয় মাটির প্রিয় মানুষদের, প্রিয় জনপদকে। জীবনের দিনগুলোর মতোই মৃত্যুর পরেও তিনি আলোর দিশারী হয়ে দেদীপ্যমান রয়েছেন জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যামুখী অভিযাত্রীদের চৈতন্যের মর্মমূলে।  

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম  সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;