জৈবপদার্থ
সেবার ভয়ানক বন্যা হয়। ভেসে যায় দেশের উত্তরাঞ্চলের ব্যাপক অংশ। ঘরে ঘরে হাহাকার, মৃত্যুযন্ত্রণা, শোক, ক্ষুধা—সব একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ে মানুষকে নিঃশেষ করে দিতে। সংবাদপত্র আর টিভি প্রতিদিন ভরে ওঠে ক্ষয়ক্ষতি আর ত্রাণের বিবরণে। রাজধানী থেকে শতশত স্বেচ্ছাসেবী ঝোলাভরা ত্রাণ নিয়ে নেমে পড়ে মানুষ বাঁচানোর মিশনে।
এইরকম সময়েই এই গল্পটার শুরু। আর পাত্র উত্তরাঞ্চলের এক ছোট্ট জনপদের স্থানীয় চেয়ারম্যান। এই লোকটির নির্বাচনী এলাকাও প্লাবিত হয়েছিল প্রবল বন্যায়। আর মানুষও নিঃশেষ হচ্ছিল দিনের পর দিন।
ব্যাপারটা বেশ ভাবিয়ে তুলল চেয়ারম্যানকে। বন্যায় আর সবার যে ক্ষতিই হোক—তার যে একটা বিশেষ ক্ষতি হচ্ছে সবকিছুর অগোচরে, সেটা সামলাতে কোনো ত্রাণ তৎপরতাই যথেষ্ট না। এই বিশেষ ক্ষতিটা হলো—মানুষের মৃত্যু তার ভোটার সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে। তার নিজের এলাকার মানুষের ভোটেই এতদিন প্রতিদ্বন্দ্বীদের হারাত সে। এই অস্ত্র বুঝি আর তার হাতে রইল না। খাবার না থাকলে ত্রাণ দিয়ে খাবারের পরিমাণ বাড়ানো যায়। কিন্তু মানুষ—তাকে বাড়ানোর উপায় কী? এদিকে নির্বাচনেরও আর বেশি দেরি নেই।
সমস্যাটা হারাম করে দিল তার রাতের ঘুম। এদিকে এলাকার বন্যায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তার বউ আর মেয়ে তৈরি করেছে ত্রাণ কমিটি। চেয়ারম্যান ভেবেছিল, এই ত্রাণ কমিটির প্রধান অতিথি হয়ে কর্তব্য পালনে এলাকায় সাড়া ফেলে দেবে সে। কিন্তু ভোটার কমে যাওয়ার সমস্যাটা তাকে তো সেই কাজ করতে দিলই না, বরং ত্রাণের নাম শুনলে এখন তার মেজাজ খারাপ হয়। বউ আর মেয়ে তাকে বারবার বোঝাল, যারা বেঁচে আছে—তাদের বাঁচিয়ে না রাখলে ভোট আরো কমে যাবে। কিন্তু তবু তার মন গলছিল না এইসব কথায়। শেষে অনেক গা মোড়ামুড়ি আর যুক্তিতর্কের লড়াইয়ের পর চেয়ারম্যান ত্রাণ কমিটির কাজে যুক্ত হলো।
কিন্তু মন থাকে না যেই কাজে, সেটা হয়ও না ভালোভাবে। চেয়ারম্যানের মনে হলো এতদিন ধরে বিভিন্ন কৌশলে পাওয়া টাকাগুলি শুধুশুধু খরচ হয়ে যাচ্ছে কিছু অহেতুক কাজে। ব্যাপারটা মেনে নিতে একটুও ভালো লাগলো না তার। তারপর একদিন এক দীর্ঘ ত্রাণ অভিযান শেষে বাড়িতে ফিরে সে ঘোষণা দিল, অনেক হয়েছে। বউ আর মেয়েকেও সে ধমকে দিল এই বলে—তার টাকায় ছাতা পড়েনি। আর যেই টাকা খরচ হয়েছে এই কয়দিনের ত্রাণ অভিযানে—বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের বাজেট হিসাবে পাওয়া টাকা থেকে সেটা তুলে নেওয়ারও পরিকল্পনা করল সে।
কিন্তু কয়েকদিন পরেই এক ভয়াবহ খবর নিয়ে চেয়ারম্যানের কাছে হাজির হলো পরিষদের অ্যাকাউন্টেন্ট। জানাল, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি এসেছে—প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় শেষ হওয়ার কারণে অসমাপ্ত প্রকল্পগুলির বাজেট বরাদ্দ ফেরত দিতে হবে।
মাথায় যেন বাজ পড়ল চেয়ারম্যানের। বাজেট বরাদ্দের অনেক টাকাই তো বাষ্প হয়ে উড়ে গেছে বিভিন্ন আকাশে। এখন তাদের আবার ঘনীভবন করে ফেরত আনাটা প্রায় অসম্ভব। অবশ্য তাদের অধিকাংশ গেছে তার পকেটেই। কিন্তু তারপরও পাওয়া টাকাগুলিকে হাতছাড়া হতে দিতে কে চায়। বিকল্প একটা পথ বের করতে হবে—এই ভেবে অ্যাকাউন্টেন্টকে একটা বুদ্ধি খুঁজতে বলল চেয়ারম্যান।
উপরওয়ালার নির্দেশে বুদ্ধি খুঁজতে মাথার মাঠে নেমে পড়ল অ্যাকাউন্টেন্ট। কিন্তু কোথায় কী? সব বুদ্ধি যেন এই দুঃসময়ে তার সাথে পলামুঞ্জি খেলতে শুরু করল এবং তার বিপর্যস্ত অবস্থা দেখে মজাও নিতে শুরু করল একই সময়ে। অ্যাকাউন্টেন্টের এখন দিন কাটে না রাত কাটে না। এদিকে চেয়ারম্যানও ঘনঘন তাগাদা দিচ্ছে।
মন খারাপ করে এক সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে অ্যাকাউন্টেন্ট দেখল তার মেয়ে উচ্চকণ্ঠে স্কুলের পড়া মুখস্ত করছে। পড়ার বিষয় জৈবপদার্থ। হাতমুখ ধুতে ধুতে অ্যাকাউন্টেন্ট শুনল মেয়ে পড়ছে জৈবপদার্থ গলে পচে মাটিতে মিশে যায় এবং গাছপালার খাদ্য হয়। মানুষও যে একটা জৈবপদার্থ—এটাও সে জানল মেয়ের উচ্চস্বরের কারণে। সাথেসাথেই তার মাথায় ঝিলিক দিয়ে উঠল একটা সুস্পষ্ট বুদ্ধি। এবং সেই বুদ্ধি তাকে দেখাল চেয়ারম্যানের সমস্যা সমাধানের পথ।
পরদিন সে চেয়ারম্যানের কাছে গিয়ে বলল সব ধরনের ত্রাণ তৎপরতা বন্ধ করে দিতে এবং প্রকল্পের টাকাও তহবিল ভেঙেই সরকারকে ফিরিয়ে দিতে বলল। চেয়ারম্যান এই প্রস্তাব শুনে প্রথমে অ্যাকাউন্টেন্টকে গালাগালি করল পাগল বলে। কিন্তু শেষে প্রস্তাব দুইটাই মেনে নিল অ্যাকাউন্টেন্টের অতীতের বিভিন্ন কারিশমার কথা মনে করে এবং জলে পড়ার পর আঁকড়ে ধরার মতো একটা খড়কুটাও পাচ্ছে না দেখে।
২.
বন্যা শেষ। চেয়ারম্যানের ভোটারের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। এদিকে বন্যার্তদের জীবন বাঁচানোর তাগিদ ঘরে ঘরে হারিয়ে যাওয়া মানুষের শোকের স্তূপকে অগ্রাহ্য করে বেরিয়ে এসেছে সদ্য পলি পড়া জমি চাষাবাদের জন্য। এছাড়া আর উপায়ই বা কী। মৃত্যুর চেয়ে জীবনের হা যে অনেক বড়।
ওদিকে চেয়ারম্যানের তর আর সইছে না। ভোটার কমে যাওয়ার শোক তো আছেই, প্রকল্পগুলির বাজেট ফিরিয়ে দেওয়ায় শূন্য তহবিলও তার দিকে চেয়ে হাসছে সবসময়। এদিকে অ্যাকাউন্টেন্ট খালি অপেক্ষা করতে বলছে, দেখাচ্ছে সবুরের মেওয়া খাবার লোভ। কিন্তু দুঃশ্চিন্তায় যে তার ক্ষুধাই লাগে না—মেওয়া খাবে কখন। তবে চেয়ারম্যানকে অপছন্দের অপেক্ষার মধ্যে আটকে রাখলেও অ্যাকাউন্টেন্ট নিজে কিন্তু শুধু অপেক্ষা করে কাটাচ্ছিল না তার দিনগুলি। চারদিকে লোক লাগিয়ে বন্যায় জীবন হারানো মানুষজনের মৃতদেহ সংগ্রহ করে সে পুঁতে দিচ্ছিল এলাকার জমিগুলির নিচে।
বন্যায় পড়া পলি আর অ্যাকাউন্টেন্টের পুঁতে দেওয়া মানুষজনের মৃতদেহের জৈবপদার্থের গুণে সেবার ফসল ফলল বিপুল পরিমাণে। এবং সেই ফসল ফলার খবর ছড়িয়ে পড়ল রাজধানীসহ সারাদেশে। কৃষিবিভাগ অনেক পরিসংখ্যান আর গবেষণাপত্র ঘেঁটে আবিষ্কার করল এমন ফলন নিকট অতীতে কখনো হয়নি। ফলে তারা সরকারের কাছে সুপারিশ করল সঠিক নেতৃত্ব দেবার জন্য এলাকার চেয়ারম্যানকে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার দিতে। আর সরকারও তো কৃতিত্ব নেবার জন্য এরকম খবরের খোঁজে থাকে সারাবছর। তাই কৃষিবিভাগের সুপারিশটা পাবার সাথেসাথে ঘোষণা করে দিল—কৃষিক্ষেত্রের উন্নয়নে মূল্যবান ভূমিকা রাখার জন্য এবছর সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার দেয়া হবে ওই এলাকার চেয়ারম্যানকে। কৃষিমন্ত্রীও যে কোনো সভা সমাবেশে একথা জানাতে ভুলল না যে, এই উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে তার সরকারের সঠিক ব্যবস্থাপনার কারণেই।
যথাসময়ে চেয়ারম্যানের গলায় ঝুলল রাষ্ট্রীয় পুরস্কার এবং আরো নজির সৃষ্টির জন্য তাকে ঢালাওভাবে দেওয়া হলো বিভিন্ন প্রকল্প—যাদের বাজেটের পরিমাণ অকল্পনীয়। এসব প্রকল্পের মেয়াদও নির্দিষ্ট ছিল না।
চেয়ারম্যানও আজকাল তার যে কোনো বক্তৃতায় জৈবপদার্থের গুণাগুণ এবং সবুরের মেওয়ার স্বাদের উদাহরণ দিতে কোনো ভুল করে না।