আলোর দরজা খুলে সবার নগ্নতা ছড়িয়ে পড়ছে
পরপার মাতৃভূমি যার
অস্তিত্বের ধূলি থেকে বেরিয়ে এসেছি।
প্রশ্ন আর উত্তরের বিষণ্ন বিক্ষোভ
তাড়িত করে না আর। একটা চড়ুই
যেভাবে প্রশান্ত রঙে নিজের ভাষায়
বাতাসে অঙ্কন করে কিচির মিচির
কিছু কিছু মানুষ হয়তো সেরকম।
বিনম্র আস্থায়
জীবনের দিকে ঝুঁকে থাকা
অম্লান সঙ্গীত।
সবাই শোনে না সেই গান।
ফলবান বৃক্ষের আমূল আরতি
নিয়ে টিকে থাকে তারা; শেকড় সঙ্কটে
ভোগে না কোথাও। ফুলে ফলে
সুগন্ধ স্বাদের বুক
ছড়িয়ে দিয়েই তারা সুখী।
আজান ধ্বনিত হলে মসজিদে যায়।
শিজদার বিকীর্ণ জোছনা
সমস্ত শরীরে মেখে
নিজেকে বানিয়ে রাখে লাশ।
তবু বয়ে চলা এক বিশীর্ণ রেখায়
দূর্বাকুঁড়ি খালের পানিতে
দলবদ্ধ হাঁসের সাঁতারে
তাদের নিহিত সুখ
চিরদিন লিপিবদ্ধ হয়।
ওদের শরীরে পাখি ওড়ে;
বোবা পশুদের নীরবতা
ভাষার প্রপাত হয়ে
ঝরে পড়ে মনের ওপর।
বহুদূর প্রোথিত শেকড়
নিজের ভিতরে নিয়ে পত্রল হৃদয়ে
ওরা গাছ; ছায়ার আশ্বাসে
পৃথিবী নাড়িয়ে দেয়
বাতাসের নম্র প্রেরণায়।
টুনটুনি পাখিটির চঞ্চল সঙ্কেতে
লেবুপাতা যেভাবে সবুজ স্থিরতায়
পরিণয় হয়ে ওঠে মহামিলনের
আল-আমিনের
নতুন রিক্সায় আমি ঘূর্ণিত চাকার
সূর্যকে সেভাবে দেখি; স্পন্দিত আলোর
দিকে ধাবমান ওর ধৈর্য;
ধৈর্য হলো পূর্ণ মনোযোগসহ
জীবনের কাছাকাছি থাকা।
যা-কিনা অশেষ গন্তব্যের
দিকে শেষ পর্যন্ত পৌঁছায়।
এই সংক্রমিত সময়ের
নিসিক্ত ডানায় শ্রমক্লান্ত জীবনের
লৌকিক প্রতিভা নিয়ে কোথায় পৌঁছুতে
চায় আল-আমিন? শান্তির
স্বপক্ষে ভাঙতে গিয়ে লোহার শকট
দূর্বাকুঁড়ি খালের জীবন
ওর ভালো লেগেছে; আকাশ
তন্দ্রাঘোর একাকীত্বে যখন ডাকবে
চলে যাবে মেঘের কব্জায়। বৃষ্টি হবে।
ঝরবে নির্ঝর! তবু প্রাণ-তাড়নার
একটা নিরীহ ভাটফুল
সাদা জীবনের দিকে হঠাৎ এগিয়ে এলে
একদিন আমাকেও সে বলেছে:
‘পৃথিবী আমার দেশ নয়।
হঠাৎ সফর।
প্রেমের অঙ্গনে
পরপার মাতৃভূমি যার
তার কোনো ভয় নাই; পথের সঞ্চয়
সামান্য হলেই চলে যায়।’
যখন মুহূর্তগুলো তরবারি
পথ এক সমাদৃত সুতা;
পা তার টেনে নেওয়ার সুঁই।
এভাবে সেলাই করি
হাঁটার বুননে রাখা গতির জীবন।
আজ পথে পথে
আশঙ্কার মর্ম-কোলাহল
বাতাসে জমছে। মাস্ক-পরা মানুষের
মুখোশ-আদল চিরায়ত
সত্যের সামনে খুলে গেছে বলে
এখন কেবলি ভাবি,
এইযে শরীর, এই দেহ-বর্ম
একটা মৃন্ময় পর্দা; চরিত্র আয়না
ছাড়া কিছু নয়।
আলোর দরজা খুলে সবার নগ্নতা
ছড়িয়ে পড়ছে। শূন্য অন্দরে অশ্রুত
পোকার পঙ্কিল কিলবিল।
লাশ পড়ে থাকে; সম্পর্কের
প্রবল প্রাণের চেয়ে অপ্রিয় মাছির
ভন ভন অনেক কাছের।
জাতি, রাষ্ট্রপুঞ্জ বলে যা-কিছু ভেবেছি
নিয়ত আশ্রয় এতকাল
নিষ্ফল সঙ্ঘের এইসব মৃত চরাচরে
পুঁজির পাথরে চাপা মানুষ আসলে
অসাম্য-ছত্রাক। ক্ষমতার
নির্দয় দেয়াল-ঘেঁষা ত্যক্ত পরজীবী।
তবে কি আমিও এক
দুনিয়াবিরাগ হাহাকার?
হৃদয় আমার বাড়ি;
বিষণ্নতা অধিবাসী তার?
উদাসীনতার মাঠ থেকে
দর্শনের উন্মুক্ত প্রান্তরে
দেখছি মৃত্যুর লোকালয়?
কিছু কিছু লগ্ন আছে
যখন মুহূর্তগুলো তরবারি।
ধারালো প্রান্তের দিকে কঠোর হলেই
মানুষ নিজেই কাটা পড়ে।
অথচ সামান্য পাখি
এক মুঠো বিনীত শরীর
উদ্ধত বাতাসে রেখে
গাছের ডালেই বসে থাকে
গভীর সঙ্কেতে একা একা।
অনন্তের সবুজ দয়ায়
তুষ্টির বিপক্ষে নেই সরল পাতাও।
বৃষ্টি-ভেজা বিড়ালের একান্ত জগৎ
নিভৃতির পরম আলোয়
কোন ইশারায় জেগে থাকে?
নত বেদনায়
সকল সঙ্কটে নিরুত্তাপ?
তবুও মানুষ ভালো;
অহং বিছিয়ে রেখে পায়ের তলায়
প্রবল আত্মার কেউ কেউ
নিজের আগুনে পুড়ে
মাটির শরীরে ছাই হয়।
স্বর্ণ ও পাথর একাকার করে দিয়ে
পৃথিবীকে বস্তুর অধিক
ভাবতে পারে না; তারা জানে:
এখানে গোলাপ আছে। কাঁটার নির্ঘণ্টে
বিঁধে গেলে সুগন্ধ দেবে না পারাপার।
আমি বহুদিন শিবগঞ্জের পুরনো
কামার শালায় শ্রমসিক্ত মানুষের
ঘামের ঝিলিক দেখে
চিনেছি শান্তির করাঘাত;
পথের উপান্তে হেঁটে হেঁটে
দেখেছি, অপূর্ব যাতনায় টিকে আছে
অনেক নিরন্ন বাড়িঘর।
যেন ম্যাচ বাক্সের সাজানো খেলনায়
সময়ের নিজস্ব উদ্বেগ
ধুলোর ওপরে রেখে চলে গেছে কেউ।
এরাচ গাছের শীর্ষে বসে
ধ্যনস্থ শকুন তার পরাহত মৃত্যুর খবর
দুপুর গড়িয়ে ফেলে যায়।
দু’মুঠো অভাব ছাড়া সোনার আকর
কোনোখানে নাই। তবু সুখের সুবর্ণ
বাড়িটি উন্মুক্ত রাখা এদের সামনে।
আল্লার নিবিষ্ট রঙ জলে মেখে
ওরাই গোসল করে প্রত্যেক বর্ষায়।
রঙে রঙে একাকার
ঘনীভূত সাম্যের সময়
অন্তর্গত জুলুমের বিবর্ণ কাফির
রঙিন হবে না কোনোদিন।
এই তো সেদিন বিদ্যাগঞ্জের উত্তরে
বিপুল সবজি ক্ষেতে চেয়ে চেয়ে দেখি
কৃষকের নরম হৃদয়
সবুজ আলোয় ছেয়ে আছে।
হাসির ভুবনে তারা স্যানিটাইজার।
জীবানু মুক্তির সৌর সঞ্চালন
উন্মুক্ত মনের কোণে
জমিয়ে রেখেছে সারাদিন।
তাদের নিবিষ্ট আত্মা জাতিসংঘ নয়।
শান্তির সৌরভ; শুধু অভাব দিগন্তে
এলে ওরা দৌড়ায়। কখনো ছুঁতে পারে না জীবন।
তবু পরিচিত এক প্রীতির সকাল
নিজের ভিতরে রেখে আক্রান্ত কালের
সমস্ত বিদ্বেষ ভুলে গেছে।
সবাই মিশছে দ্বিধাহীন।
আহা! এত প্রীতিময় গল্পে ভরা সহজ মানুষ।
নাকি আজ সংক্রমিত পাপের পর্বতে
শুধু আত্মহত্যার বিপুল অন্ধকার
লোকালয়ে ফিরছে এখন?
ওরা জানে, জীবন একটা গুহামুখ।
মৃত্যুই চিচিং ফাক; সমাগত সত্যের প্রান্তর
একদিন আলোর সম্মুখে খুলে দেবে।
ভয় নাই, তবু ভয় নাই।
মানুষ নিজেই বড় একটা পৃথিবী
অনেক পৃথিবী ছুঁয়ে থাকে।
ঘরভর্তি গান
পালক পতন মানে। ক্ষরণ সত্তার
নিবেদিত ডানা, ঝরবেই।
আজ স্পর্শক্ষয়, দূরে মনুষ্য প্রান্তরে
মুছে গেছে সবুজ প্রীতির কোলাকুলি।
চরাচরে হাঁচির শব্দের ভূত-ভয়।
তবু নভোবন
মেঘের নিঃশ্বাসে
পৃথিবীতে নাম লিখে স্মরণ-বৃষ্টির।
মুখ মনে পড়ে। ভেজা ভেজা মুখ।
নিজের হাতের সঙ্গে
নিজের বৈরিতা, অবিশ্বাস।
যেন গুপ্ত ঘাত এক বিষের প্রলেপ
মাখিয়ে রেখেছি নিজে নিজে।
আমার আত্মার নিরাময়ঘন
ওইসব মুখের উদ্যানে জলগন্ধে
ধুয়ে যেতে থাকি। ভাবি,
আমি এক আদিম উদ্ভিদ। গুল্মলতা পরিচয়।
লতিয়ে উঠতে চাই গহনে গহনে চিরকাল।
ধূম্রল কুহক থেকে দূরে
মির্জা মান্নানের বাড়ি। বাড়ির উঠোনে
সঙ্গরত পাখির ভুবন। কমলার
নরম পাতায় সূর্য দরদ ঢালছে।
যতদূর চোখ যায় ফসলের সবুজ স্বরাজ
দিগন্তের গীতল পশ্চিমে
উবু হয়ে আছে। যেন নামাজ পড়ছে।
দূর থেকে দেখা যায় গাছের তাওয়াফ।
মাঝে ওর ঘর। ঘরভর্তি গান।
যে-গান লুকিয়ে রাখে পাখি
নিঝুম নীড়ের বুকে,
একাকার সুরের পাতায়।
মানুষ মূলত গাছ; শূন্য বেয়ে ওঠে।
মৃত্যুবীজ পুঁতে রাখা
জন্মের সময়। মন হলো ডালপালা।
আকাশ অবধি যার আঁকুপাঁকু
বড়জোর মেঘ দেখে; বৃষ্টির নিকুঞ্জে মুখ ধোয়।
দূরের গ্রহের বুকে মাথা রেখে ঘুমুতে পারে না।
পায়ের শেকড় এসে মানুষ পর্যন্ত
থামে; ওইখানে সুখ। হৃদয় প্রস্তুত হাতে হাতে।
তাই মির্জা মান্নান হাঁসের মাংস খেতে
ডাক দেয়। হৃদয়ের বাড়া ভাতে
ভালোবাসা ফেরাতে পারি না।
জাগ্রত আত্মার দিকে
লুফে নিই সকল দাওয়াত।
ওর বউ পরিবেশনার
অন্তস্থ বিদ্যায় গান ঢালে;
গানের শরীরে
পাখির প্রহর আমি খাই।
ভালোবাসা নিজেই খাদক।
তার পেটে হজম হয়েছি বারবার।