করোনাকালের মেঘদূত
পূর্বমেঘ
তোমার জন্য কুরচি ফুলের অধ্যায়, মেঘ
নিবেদন করা হলো অর্ঘ রূপে;
পর্বত-নিতম্ব থেকে সভ্যতার দেহ-পল্লবীর দিকে
রওনা হও গো ধুম জ্যোতি জল বায়ু সহযোগে তুমি;
অভিভূত করে দাও ফ্যাকাশে চোখগুলোকে
নগরজুড়ে বুনছে যারা পরিতাপমালা।
তোমার জন্য বিহঙ্গদলের সুধাসঙ্গীত আর আছে
শোকে বুনন প্রিয়ার প্রতীক্ষিত মুখ দর্শনের ভাগ্য।
রওনা করো হে মেঘ, কালো সামিয়ানা আকাশের।
যাও, দেখবে গম্ভীরা নদী নাই, আছে বদ্ধ জলের সাঁতার
তার ওপর বেড়াচ্ছে রাজহাঁসের গ্রীবার মতো
আবর্জনা, ভেবে নিয়ো একে গম্ভীরা সঙ্গীত।
বিত্তশস্যে ভরা এক আবন্ধা শস্য-শহর,
তুমি কিন্তু নতজানু জলসিঞ্চন করো না অর্থের নিকট
প্রিয়া তবে পাবে না যজ্ঞের বিরহগাঁথার শৃঙ্গমালা;
পাবে না রামগিরিতে গুমড়ে ওঠা শোকের নামতা।
তুমি পূর্বদিকে যাবে সোজা, গিয়ে পাবে অবিকল
ইন্দ্রধনু পর্বতাদি, বরফাচ্ছাদনময় ধাঁধার মতো দালান,
জৌলুসের যাতায়াত পাবে উজ্জয়নী নগর যেমন
নর্তকীর মতো স্টিট লাইট আছে দাঁড়িয়ে পথে পথে
যেন সবই নির্দয় কুবেরের হৃদয়হীন ঐশ্বর্য
পাবে শৃঙ্গরূপ বাড়ি, কিন্তু চোখ দিয়ো না শার্সিতে
আটকা পড়বে তবে শৃঙ্গারে সমর্পিত শরীরে।
পাবে পথজুড়ে জুঁইচাপা বা কদম, দাঁড়িয়ে তবে
ঘ্রাণ নিয়ো, নিয়ে নেবে প্রিয়ার সুগন্ধী বারতা তোমাকে;
দেবদারু অরণ্যের মতো পাবে মানুষের সমারোহ
ভয় পেয়ো না তাতে, ভেবো না প্রিয়াকে পারবে না চিনতে
তার হাসির ঐশ্বর্য দেখে তুমি চমকে উঠে বলবে
তোমাকে চিনে গেছি গো শোকের বৈভববতী।
তোমার বিদ্যুতে মেঘ, ভয় পাইয়ে দিয়ো না
প্রেমিকযুগলদের, এ নগরে তোমার ঝলক
নিষ্প্রয়োজন, বরং কিছুক্ষণ বৃষ্টি হয়ে ঝরো,
বালিকাদের অধর বৃষ্টির ফোঁটায় সিক্ত করে
দিয়ো অগণন ধারাপাতে, আলিঙ্গনে ফুটুক প্রেম।
তবে ফেলো না ফুরিয়ে দেহখানি একদম
জলসংগ্রহে যেয়ো সরে নগর-গহ্বর থেকে—
অপূর্ব নাম সব নদী বেয়ে নিয়ে এসো ধারা;
জলে পূর্ণ করো সুখে তোমার গতরখানি।
এই বিশালায় পদ্ম নাই, আছে ভাগাড়ের তীব্র গন্ধ
তবে পাবে রমণীর দেহের ঘ্রাণের আকর।
বিদিশা নয় এ হয়ে ওঠে বিবমিষা নগরী কখনো
মানসযাত্রী বলাকা ভেবো, তোমাতে যজ্ঞের বাজি;
আর আমি যজ্ঞ হৃদয়, আমার কালিদাসের হৃদয়
আমার হৃদয় যেন সিনকানের হৃদয় হয়ে যায়;
মহাভারতে আমাকে পাবে না, পাবে যাতকে,
তোমাকে মেঘ পাঠাচ্ছি কাকদূতের শহরে
তুমি যজ্ঞ-দূত, তুমি নিগূঢ় মনোহর মুরতি।
সরল বস্তিতে যারা থাকে এখানে, তাদের
দেখেই বুঝবে এরা আসলে কৃষির পুত্র
আচ্ছাদনহীন কান্না এখানে দিনের মতো
আলো ছড়ায়, থমকে যেয়ো না কিন্তু তাতে।
তুমি এগোতে থাকবে, পুচ্ছ পুচ্ছ কথাঢেউ
গুচ্ছ গুচ্ছ প্রহসন ডিঙ্গিয়ে যেতে থাকবে তুমি
পাবে কুরুক্ষেত্র, কাওরানবাজার বা গুলিস্থান
নামে চেনে, তবে কুরুক্ষেত্র বলো না সহসা, তবে
তোমার কালো মস্তক হয়ে যেতে পারে গুম;
ঝুম ঝুম বৃষ্টিসুরে গান ধরে বরং যেতে থাকো;
মনে রেখো বন্ধু যজ্ঞ তোমার স্কন্ধে রেখেছে প্রেমগাথা।
উত্তর মেঘ
অলকা অথবা ঢাকা তাতে তফাত নাই কোনো
দেখবে মেঘ, জানালা ধরে কত চোখ অপেক্ষায়।
বালিকা হৃদয় থেকে পাওয়া শব্দ ফেলে নিচে
বালক কুড়িয়ে রেখে দেয় তা বুক পকেটে;
তারপর সে শহরজুড়ে শব্দ-মুগ্ধতার ফাঁদে
গ্লাস ভর্তি জীবনকে পান করে মাতাল ঘুরে বেড়ায়।
শোনো মেঘ, কৃষ্ণতনু মেঘ, লীলাকমল, কুন্দকে
যেয়ো না খুঁজতে, বৃষ্টি-শহর খুলে দেয় বুকের বোতাম,
জারুল রঙে চমকে দেয়, ফোটে কারবালার মতো
লাল কৃষ্ণচূড়া। বেলি, শিউলি আছে, আছে বালিকার
মাতাল করা চুলের ঘ্রাণ। পেলে মনে হবে
এ বহুপুষ্পের এক কুঞ্জবন; বৈভ্রাজ-রমনা।
আর বিশাল বাগান এক শহরজুড়ে, নিয়তির মতো
এক বহুরূপ হর্ন-বাগানে ঢুকে পড়বে তুমি।
এ শহরে নানা ভঙ্গিমায় ফুটপাতে পথে কাচঘেরা
ঘরে অন্ন গিলে, কিন্তু প্রেমময় চুম্বন অপ্রকাশিত।
নাগরিকেরা অশ্লীলভাবে বাসের হ্যান্ডেল ধরে ঝুলে
তো বালক বালিকার কোমর জড়িয়ে ধরা নিষিদ্ধ;
তুমি যাচ্ছো সে শহরে মেঘ।
ভয় পেয়ো না উড্ডীন হৃদয়ের মেঘ
মিনোয়ান নাবিকের মতো ছড়িয়ে পড়ো শহরজুড়ে
পাবে তবে কুয়াশার গল্প, কাঁপা কাঁপা অধরের হ্রদ
যেন পাশাপাশি দুটি আপনঘটনা, বহুদিন ধরে
শহর আঁকছে অজন্তার নাম না জানা শিল্পীর মতো।
পাবে মাইলের পর মাইল ছড়িয়ে পড়া দিনলিপি,
যেখানে আছে সবুজ গাছের মতো সারি সারি
দাঁড়িয়ে থাকা চাহনি আর কথা ও নীরবতা।
এ গল্পটি কার হতে পারে তুমি জানো মেঘ, আর
আশ্চর্য হয়ে দেখবে শহর এই গল্পকে তার বুকের
ভাঁজে রেখে দিয়েছে, যেমন জোসিফিনের উদ্যানের
চারা জেনে রেখে দিত শক্রসেনারা পরম মমতায়।
এ শহরে ভোর নামে শিউলির মতো শুভ্রতা নিয়ে;
দেখবে মোড়গুলো পুষ্পরাজিতে পূর্ণ হচ্ছে একে একে
মনে হবে তুমি কালিদাসের কালেই আছো, হবে
পরক্ষণে এক বিষণ্ণতার আঁকড়ে নিমজ্জিত তুমি;
ভাববে, পৌঁছে গেছো রোমের রোজ-মেনিয়ার পেটে;
কত-পাপড়ি প্রতিদিন খুন হচ্ছে শুভ্র-সকালের মোড়ে
যেন পুষ্পসমাধি, পৃষ্পস্নান, পুষ্পনির্যাস, পৃষ্পকাম
একটি খুনি শহরের পারভার্সানে নিজেকে বিসর্জন দিচ্ছে।
ভীষণ কোলাহলের শহরে একটি মুখ ভেসে যায়;
শব্দ ভেঙেচুরে মুগ্ধতার কিশলয় রচিত হতে থাকে ।
মেঘ তুমি তাকে চিনবে কিভাবে বলো...
জৌলশঘেরা শহরে মিথ্যা সোনালি আভার মতো ফোটে;
ভুল করো না, ফুটপাতে, বৃক্ষপল্লবে কান পাতো;
নেরুদার কবিতা যেন, তীব্র একজোড়া প্রেমময় চোখ
দেখবে কী এক বিহ্বলতার আঁকছে মেঘময় দিন;
সে বুনে যাচ্ছে ভ্যান গগের মতো পরাবাস্তব রঙ;
আর তার হাসি থেকে ঝরে পড়ছে রবি ঠাকুরের
ঘোরগ্রস্ত স্নিগ্ধ-সুর, ডাকো তাকে উপমার জংশন।
সুতরাং মেঘ, তুমি তাকে চিনে নিতে পারবেই
নিদানকালে অস্থির প্রিয়া, যার অধরউপকূলে
নৌকার মতো একটি তিল জায়গা করে নিয়েছে;
যার বক্ষ কাঠগোলাপের ঘ্রাণময় উদ্যান, বুঝলে;
সে ফোর্ড ম্যাডক্স ফোর্ডের উপন্যাসের মতো শ্রেষ্ঠা
অথচ পড়া হয়নি, আমি তাকে খুঁজে বেড়াই চরাচর।
পড়েছে অপূর্ব এক মুহূর্ত কেটে বানানো জামা;
আর পড়ে আছে অপেক্ষা, কানে দুল বানিয়ে।
তুমি তার কাছে যাও আর বলো যজ্ঞের বেদনা;
বলো যজ্ঞের বেদনা ফুটে ভরে গেছে এক বিরাট উপত্যকা।
মেঘ যাও সরোবর পেরিয়ে তার সীমারেখায়;
টের পাবে এক আচানক শুভ্র-সবুজের সূচ
বুনে যাচ্ছে ফুল-পাখি-নিসর্গের দিনলিপি।
সে যদি থাকে নিদ্রায় তবে থেমো, দিয়ো উঁকি
তার বাগানে, একটি বিকাল পাবে, তাতে ফুটেছে
লাল, নীল মুহূর্তরা, ফুটে আছে মনোহর কথাফুল;
পাবে একটি সন্ধ্যাবৃক্ষও, সেখানে ফুটেছে হাসির পালক;
সে হাসির রঙ চিনতে তুমি পড়ে যাবে গোলাকধাঁধায়;
আলো-আঁধারের একটা সান্ধ্যভাষা সেখানে দীপ্যমান;
অনেক সময় তুমি এখানে কাটিয়ে দিতে পারো।
আর যদি দেখো সঙ্গীদের নিয়ে সে গাইছে কোরাস;
তবে তা যজ্ঞের জন্য শোক, স্যাফো যেন শোনাচ্ছে
অনন্ত বিরহগাথা, চিত্রকল্পের, উপমা-উৎপ্রেক্ষার।
হে বিশালাক্ষী স্ফটিক, যজ্ঞ-বন্ধু, ভালোবাসা তোমাকে
তুমি কীর্তন আমার, তুমি একমাত্র বার্তাবাহ;
নিদানকালের বন্ধু, যাও, যাও, অনন্তবীথিকা
যজ্ঞ হৃদয়ের, পৌঁছে দাও প্রিয়ার নিকট
বেদনাহুত হৃদয়ের অনির্বাপিত শোকগাথা।