সাভানায় শরণার্থীদের করোনাক্রান্ত ঈদ



মঈনুস সুলতান
অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

  • Font increase
  • Font Decrease

ঈদ উপলক্ষে পারিবারিক পরিসরে আমি রান্নাবান্না করছি প্রায় দুই যুগের মতো, কিন্তু এ শিল্পে আমার কামিয়াবি হাসিল হয়েছে স্বল্প, খাবার পরিবেশন করতে গিয়ে বিব্রত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে প্রচুর। হাল ছাড়িনি, কিন্তু আজ ভোরবিহানে সেমাই রান্না করতে গিয়ে যে হালত হয়েছে, তাকে সফলতা বলার কোনো কায়দা নেই। আজকের এ করোনাক্রান্ত ঈদে আমি সাভানা শহরের আরো দুয়েকজন সমমনা মানুষের সঙ্গে মিলেঝুলে—পৃথিবীর হরেক দেশ থেকে নানাবিধ যুদ্ধ কিংবা সামাজিক সংঘাতে বাস্তুচ্যুত হয়ে এখানে এসে রিসেটেল্ড হওয়া কয়েকটি রেফিউজি পরিবারকে খাবার পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি। আমার স্পেসিফিক দায়িত্ব হচ্ছে ফিস কাবাব ও সেমাই প্রস্তুত করা। টুনা মাছের কাবাবগুলো আকৃতিতে বটবৃক্ষের ঝরা-পাতার মতো দেখালেও তা স্বাদে হয়েছে উমদা। এ নিয়ে হীনমন্যতার কোনো কারণ নেই, তবে বিপত্তি ঘটেছে সেমাইকে জর্দায় রূপান্তরিত করতে গিয়ে। তা চটকে হান্ডির তলায় এমন চেরা-চ্যাপ্টা লেগে সেঁটে আছে যে, চিমটা দিয়ে টেনেও তা বর্তনে উপস্থাপন করার কোনো কুদরত থাকেনি। বিপদগ্রস্ত হয়ে টেলিফোনে কন্যা কাজরিকে মুশকিল আসান করতে এত্তেলা দিই। পরিস্থিতি যে কতটা খতরনাক—তা বোঝানোর জন্য টেক্সট্ ম্যাসেজের সাথে যুক্ত করি, হান্ডির তলদেশের ফটোগ্রাফ। মেয়ে আমোদ পেয়ে জবাবে জানায়—জকড়িমকড়ি লাগা সেমাইগুলোকে দেখাচ্ছে আরবি হরফে ক্যালিওগ্রাফি করে লেখা ঈদ মোবারকের মতো। আমি বিলা হয়ে সেলফোন সরিয়ে রাখি।

যুক্তরাষ্ট্রে ভাইরাস সংক্রমণে মৃত্যুর হার লাখের দিকে আগাচ্ছে। বিষয়টিকে আমলে না এনে মূলত রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের সক্রিয় উৎসাহে হরেক রাজ্যের গভর্নররা লকডাউন তুলে নিয়েছেন। আমাদের রাজ্য জর্জিয়ার গভর্নর আরেক কাঠি সরস, তিনি মৃত্যুর হারকে ডেটা মেনিপুলেশনের মারপ্যাঁচে কম করে দেখিয়ে চেষ্টা করছেন—মুভি থিয়েটার, স্টেডিয়াম, সমুদ্রসৈকত ও স্কুলগুলো খুলে দিতে। দোকানপাট বেশ কিছু খুলে গেছে বটে, তবে আমার মতো যে সব নাগরিক—হয় বয়সের ভারে পরিশ্রান্ত অথবা নানাবিধ রোগেশোকে আক্রান্ত, স্বাস্থ্য বিভাগের তরফ থেকে তাদের গ্রোসারি শপ ইত্যাদিতে যেতে জোরেশোরে নিষেধ করা হচ্ছে। তো এ পরিস্থিতিতে চাইলেই আমি কোনো দোকানে গিয়ে সেমাইয়ের বিকল্প অন্য কোনো মিষ্টান্ন কিনে আনতে পারি না। কাজরি পরবর্তী টেক্সটে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয়। আমি অপেক্ষা করি, দেখা যাক কী হয়...।

ড্রাইভওয়েতে এসে থামে ফেডএক্স-এর মালামাল সরবরাহ করা গাড়ি। মাস্ক পরা ড্রাইভার একটি গিফট প্যাকেট সিঁড়িতে রেখে ফিরে যান। বুঝতে পারি, কাজরির কাছ থেকে এসেছে ঈদের উপহার। অ্যালকোহল রাব দিয়ে ঘঁষামাজা করে সাবধানে বাক্সটি খুলি। বেরিয়ে আসে গোলাপজলের সুন্দর একটি শিশি। চটজলদি তা সাবানজলে চুবিয়ে গামছা দিয়ে মুছে-টুছে অপেন করি। পুরো আঙিনা ভরে ওঠে পুষ্পের চনমনে খোশবুতে। কাজরির কাছ থেকে টেক্সট্ আসে ফের। জানতে পারি, সে জখমি সেমাইয়ের বিকল্প রাইস পুডিং নিয়ে আসছে। আমি জলদি করে খাবারের কৌটা ও তার ঈদোপহারের প্যাকেট ড্রাইভওয়েতে এনে রাখি। আমাদের মেয়ে কাছেই বসবাস করছে, তার কোনো কোনো বান্ধবী করোনার ব্যাপক বিস্তারে এক্সপোজড্ হয়েছে, তাই আমরা আজকাল সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। আমাদের হাটবাজার করতে সে সহায়তা যোগাচ্ছে, তবে দৈহিকভাবে কাছে আসছে না, আমরা বাতচিত করছি কেতাবি কায়দায় ছয় ফুট দূরত্ব বহাল রেখে।

সড়কের পাশে গাড়ি পার্ক করে কাজরি ড্রাইভওয়েতে এনে রাখে রাইস পুডিংয়ের সওদা। ঈদোপহারের প্যাকেট খুলে সাবানজলে ভিজে নেতানো ফ্লোরাল হেয়ার ক্লিপের দিকে নজর দিয়ে সে চোখ কুঁচকে তাকায়। আমি উপহারটি বিশদভাবে ধোয়াপাকলা করে জীবাণুমুক্ত করার জন্য ‘স্যারি’ বলি। ‘নো প্রবলেম, বাপি, ইটস্ আ কুল ঈদ গিফট... ইট উইল ড্রাই সুন..।’ সে খাবারের প্যাকেট হাতে নিয়ে গাড়ির দিকে হেঁটে যেতে যেতে ঘাড় ফিরিয়ে বলে, ‘ঈদ মোবারক।’ আমি মনে মনে হিসাব কষি, আর কতদিন আমাদের পারিবারিক পরিসরে জারি থাকবে সামাজিক দূরত্ব?

বেলা পনে-এগারটা হতে চলল, মিসেস নিয়ামা ইবরিম এখনো এসে পৌঁছেননি, তাঁর দশটা পনেরতে এসে পৌঁছার কথা, তাই বিরক্ত লাগে। ওয়েস্ট আফ্রিকার ঘানা থেকে অনেক বছর আগে অভিবাসী হয়ে এসে এদেশে সেটেল্ড হওয়া মিসেস ইবরিম হাইস্কুলের ক্যাফেটেরিয়াতে কুক হিসাবে কাজ করেন। পার্টি-পর্বে তিনি পারিশ্রমিকের বিনিময়ে প্রস্তুত করে দেন আফ্রিকান ডিশ। রান্নার হাতটি তাঁর চমৎকার, তবে সময় মতো কোথাও এসে পৌঁছানোর স্বভাবটি এখনো আয়ত্ত করে উঠতে পারেননি। আজকের ঈদ-খাবারের আয়োজনে তিনি ওয়েস্ট আফ্রিকান কেতার জলোপ রাইস রান্না করে নিয়ে আসছেন। তিনি এসে না পৌঁছানো অব্দি কিছু করা যাবে না।

আমি ড্রাইভওয়েতে আগুপিছু পায়চারি করতে করতে মিসেস নিয়ামা ইবরিমের বিষয়টা নিয়ে ভাবি। সাভানা শহরকে বিষয়বস্তু করে কিছু একটা লেখার প্রয়াশে আমি মাস কয়েক আগে তাঁকে অনানুষ্ঠানিকভাবে ইন্টারভিউ করি। তাঁর জীবনের কিছু ঘটনা নোটবুকে ইন ডিটেইলস্ টুকে রেখেছিলাম। আমার স্টাডিতে খুঁজলে হয়তো খাতাটি পাওয়া যাবে। বাগিচার বড়সড় গাছটিতে ফুটেছে গোলাপি বর্ণের অজস্র পাউডার পাফ ফুল। একটি মকিং বার্ড পাতায় ডানা ঘষে সুরেলা কণ্ঠে ছড়াচ্ছে সুইট টিউন। নোটবুকে টুকে রাখা কিছু কিছু তথ্য ফিরে আসে আমার করোটিতে। সেপ্টেম্বর এলেভেনের ঘটনাটি ঘটার মাস খানেক আগে নববধূ হিসাবে সাভানা শহরে এসেছিলেন মিসেস ইবরিম। তাঁর স্বামী ডক্টর আবদু ইবরিম জর্জিয়া সাদার্ন ইউনিভারসিটিতে পোস্ট ডক্টরেল ফেলো হিসাবে কাজ করছিলেন। বিয়ের পর ভিসার প্রতীক্ষায় প্রায় তিন বছর নিয়ামা ইবরিম বাস করেছিলেন ঘানার রাজধানী আক্রায় তাঁর পিতা-মাতার বসতবাড়িতে। এখানে এসেই হাল ধরেছিলেন সংসারের। ঈদের পর দিন ছিল তাঁদের বিবাহবার্ষিকী।

ততদিনে যুক্তরাষ্ট্রে ঘটে গেছে সেপ্টেম্বর এলেভেনের ট্র্যাজিডি। এর প্রতিক্রিয়ায় কোনো কোনো জায়গায় ভিন্ন গাত্রবর্ণের আমেরিকান মুসলমানদের হেরাস করার বিচ্ছিন্ন কিছু ব্যাপার ঘটতে শুরু হয়েছে। ঈদের আগে চানরাতে সাভানার শহরের ইসলামিক সেন্টার নামক ছোট্ট মসজিদটিকে কে বা কারা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। তো স্ত্রী নিয়ামাকে ঘরে একা রেখে ডক্টর ইবরিম মসজিদ প্রাঙ্গণে গিয়ে অন্যান্য মুসলমানদের সাথে হাত লাগান জ্বলাপোড়া ছাই ইত্যাদি পয়পরিষ্কারের কাজে। ড্রাইভওয়েতে খাটানো হয় চাঁদোয়া, তার তলায় বিছানার চাদর বিছিয়ে অন্যান্যদের সঙ্গে ডক্টর ইবরিম পুলিশ প্রহরায় আদায় করেন ঈদের নামাজ। তারপর তিনি ঘরে না ফিরে ঈদের বাহারে ধড়াচূড়া ও টুপি পরে চলে যান শৌখিন শপিং সেন্টারে। ওখানে বিবাহবার্ষিকীর রাতে নববধূর জন্য একটি ব্যক্তিগত উপহার কিনে নিয়ে হেঁটে হেঁটে চেষ্টা করছিলেন ট্যাক্সি পাওয়ার। ছুটন্ত গাড়ির জানালা দিয়ে ফায়ার করা গুলির আঘাতে তিনি নিহত হন।

মিসেস নিয়ামা ইবরিমের গাড়ি ঠিক এগারটা বাইশে এসে ড্রাইভওয়েতে থামে। ফুলের মোটিফ আঁকা বাহারে হেজাব পরে এসেছেন তিনি। নিজেই টেনে নামান কার্ডবোর্ডের ভারী বাক্সটি। আমাকে ঈদ মোবারক বলে হাতের ইশারায় ব্যাকসিটে রাখা গান ভায়োলেন্স বিরোধী প্লেকার্ডটি দেখিয়ে ড্রাইভিং সিটে ফিরে গিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেন। আমি তাঁর অপস্রিয়মাণ টেইল লাইটের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি। তাঁর দিনযাপন সম্পর্কে আমি তেমন কিছু জানি না। এক যুগের নববধূটি হালফিল প্রৌঢ়ত্ব অতিক্রম করে পড়েছেন বয়সের ভাটিতে। ঘানায় আর ফিরে যাননি নিয়ামা, সাভানাতেই থিতু হয়েছেন। কোনো পুরুষ পার্টনার জুটেছে কী—না জেনে বলা মুশকিল। তবে বিদেশ বিভূঁইয়ে নিহত ডক্টর ইবরিমের স্মৃতিকে তিনি জিইয়ে রেখেছেন। প্রতি ঈদে মৃত স্বামীর প্রিয় খাবার—টমেটো সচে সব্জি মেশানো জলোফ রাইস প্রচুর পরিমাণে রান্না করে মসজিদে এনে বিতরণ করেন মুসল্লিদের মধ্যে। তারপর ডক্টর ইবরিমের গুলিবিদ্ধ ফটোগ্রাফ সাঁটা একটি প্লেকার্ড নিয়ে গিয়ে দাঁড়ান বন্দুকের দোকানের সামনে, নীরবে প্রতিবাদ করেন, নিরপরাধ মানুষকে অস্ত্রাঘাতে হত্যা করার বিরুদ্ধে। সাভানা শহরে সয়ংক্রিয় অস্ত্র বিক্রি হয় প্রচুর। গান ভায়োলেন্সে প্রতিবছর মৃত্যু হয় অনেক মানুষের। মাঝেসাজে এখানে আয়োজিত হয় বন্দুক সংক্রান্ত ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, এ সব অ্যাক্টিভিটির পয়লা কাতারে প্লেকার্ড হাতে দেখা যায় বিধবা নিয়ামা ইবরিমকে।

সাভানা শহরটি সরকারি উদ্যোগে খুলে দেওয়ার তোড়জোড় চলছে, কিন্তু মুসল্লিদের ব্যাপক অংশ বয়স্ক বিধায় মসজিদে এবার ঈদের জামাত হয়নি। তাই ডক্টর ইবরিমের ইয়াদগারিতে প্রস্তুত জলোফ রাইস নাইমা রেফিউজিদের সেবার জন্য ডোনেট করে দিলেন। ক্যাটারিং সার্ভিসে কাজ করা মহিলা ইনি, স্টাইরোফোমের বক্সে জলোপ রাইস এর সঙ্গে প্লাস্টিকের চামচ, কাঁটা ও ন্যাপকিন দিয়ে সমস্ত কিছু পেশাদারি যত্নে পুরে দিয়েছেন পলিথিনের আলাদা আলাদা ব্যাগে। আমি গ্লাভস্ পরে তাতে ফিস কাবাব ও রাইস পুডিং রাখতে যাই। খাবার বিতরণে দেরি হয়ে যাচ্ছে, বড্ড অস্থির লাগে। জোসেফ মরগ্যানকে রিং করবো কিনা—ভাবি। সুহৃদ মরগ্যান আমাকে লিফট দিয়ে খাবার বিতরণে সহায়তা করার কথা দিয়েছেন। তিনি এখনো এসে পৌঁছাননি কেন? বেজায় টেনশন লাগে। আমার কব্জিতে ইনজুরির জন্য আমি ড্রাইভ করতে পারছি না। নিয়মিত পেইন কিলার নিতে হচ্ছে। প্বার্শ-প্রতিক্রিয়ায় আমার মধ্যে ধৈর্যটা কমে গেছে, সাথে সাথে বেড়েছে টেলিফোনে বেফজুল কথাবার্তা বলার প্রবণতা।

সারোকিন সেকেজির কাছ থেকে টেক্সট্ আসে। ইরানের নারী সারোকিন মরগ্যান সাহেবের সংসার করছেন অনেক দিন ধরে। বছর তিনেক হলো এ বয়স্ক নারী মারাত্মক রকমের বাত ও অন্যান্য ব্যাধিতে পঙ্গু প্রায়। চলাফেরা করেন চাকাওয়ালা ওয়াকার ঠেলে ঠেলে, তবে এখনো প্রতি ঈদে খরিদ করেন কয়েক জোড়া হাইহিল স্যান্ডেল। তাঁদের ভিক্টোরিয়ান স্টাইলের বাড়ির একটি স্বতন্ত্র কামরা জুড়ে রাখা আছে শতাধিক হাইহিলের কালেকশন। টেক্সটে সারোকিন আমাকে টেলিফোন করার পার্মিশন চেয়েছেন। এ মহিলার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হলে ইনি অনুমতি ছাড়াই আমার ডান হাতে চুমো খেয়ে খোশআমদেদ জানান। তো এ মুহূর্তে রিং করার জন্য এত আদব-কায়দা করছেন কেন? তাঁর অনুরাগ-ঋদ্ধ স্বামী মরগ্যান সাহেবের তো আমার বাড়িতে এসে পৌঁছানোর কথা? তিনি আসেননি কেন? মেজাজ খাট্টা হয়ে ওঠে।

রোদের তাপ বাড়ছে, আমি বাগানের ছাতাটি খুলে দিয়ে তার নিচে গিয়ে বসি। মরগ্যান সাহেবের প্রচুর বয়স হলেও তিনি শারীরিকভাবে সক্ষম আছেন। আমাদের ত্রাণ তৎপরতায় তিনি সাহায্য করছেন বিগতভাবে। পেশায় মানুষটি প্রকৌশলী, আর্লি রিটায়ারমেন্ট নিয়ে কয়েক বছর কন্সট্রাকশন ওয়ার্কের কন্টাকটারিও করেছেন। রেজা শাহ পাহলবির রাজত্বের শেষ দিকে ইনি ইরানে যান নগর নির্মাণে সহায়তা করতে। তখন বিবাহিত হয়েছিলেন সারোকিনের সঙ্গে। ফার্সি বলেন ভালোই। ধর্মে মুসলমান নন, তবে কলেমা জানেন, হাফিজ ও শেখ সাদির কিছু গজল ও কসিদা মুখস্থ করে রেখেছেন। মরগ্যান সাহেবের বিত্ত প্রচুর, পার্সিয়ান গালিচা সংগ্রহ করে চিত্ত বিনোদন করে থাকেন। তাঁর বসতবাড়ির ড্রয়িংরুমটিকে কার্পেটের দোকানের মতো দেখায়।

আমার বিরক্তি বাড়ে। টেক্সটের জবাব না দিয়ে সারোকিনকে সরাসরি রিং করি। তিনি প্রচুর সময় নিয়ে আমাকে ঈদ মোবারক জানিয়ে বলেন, কাজরির জন্য নিজ হাতে তৈরি করেছেন পার্সিয়ান রাইস ও শিসকাবাব প্রভৃতি। মহিলা কেবলই কথা বলছেন, থামেন না, ঠিক বুঝতে পারি না, তাঁর স্বামী মরগ্যান কোথায় গুম হলেন? গরমের মৌসুমে ঈদ হলে কী ধরনের আতর ইস্তেমাল করতে হয়—তার বিশদ বর্ণনা দিয়ে অতঃপর সারোকিন জানান, স্বামীকে তিনি একটু আগে পাঠিয়েছেন শপিং মলে খেলনা কিনতে। গেল রাতে মরগ্যান টেলিফোনে জানতে চেয়েছিলেন রেফিউজিদের নির্দ্দিষ্ট কোনো চাহিদা আছে কিনা। আমি জবাব দিয়েছিলাম, পাঁচটি পরিবারে আছে ছোট ছোট শিশু। আমরা সপ্তাহ খানেক আগে তাদের অ্যাপার্টমেন্টে ফুড ব্যাংক থেকে জোগাড় করা খাবার-দাবার পৌঁছে দিয়েছি বটে, কিন্তু ঈদে শিশুদের জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা করতে পারিনি। মরগ্যানের সেলফোনে চার্জ ছিল না, তাই তাঁর হয়ে সারোকিন অ্যাপোলজি চান। বুঝতে পারি শিশুদের জন্য কিছু কেনা যায়নি—এ তথ্যের প্রতিক্রিয়ায় সারোকিন মরগ্যানকে শপিংমলে পাঠিয়েছেন খেলনা কিনতে। বয়সের নিরিখে মরগ্যান সাহেব আমার মতো হাই-রিস্ক ক্যাটাগরিতে পড়েন। খোদা-না-খাস্তা তাঁর কিছু হলে জগত-সংসারে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হব সবচেয়ে বেশি।

আমাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। ড্রাইভওয়েতে এসে থামে মরগ্যানের গাড়ি। কাচের হেড-শিল্ডের সাথে পলিথিনের স্বচ্ছ সুরক্ষা গাউন পরে এসেছেন। সাথে করে খেলনা ছাড়াও তিনি নিয়ে এসেছেন প্রতিটি রেফিউজি পরিবারদের জন্য দুই রকমের কাবাব ও ফলমূলে পূর্ণ আলাদা আলাদা শপিংব্যাগ। কাজরির জন্য পার্সিয়ান রাইসের ডিশের ওপর সেলোফোনে মোড়া ফুলের তোড়াসহ আস্ত একটি বাস্কেট নামিয়ে দিয়ে আমাকে গাড়িতে উঠতে ইশারা দেন। আমরা কথাবার্তা তেমন বলি না, তবে মরগ্যানের অনুরোধে আমি টেলিফোন স্ক্রিনে তাঁর লেখা একটি ফেসবুক পোস্টিং পড়ি।

পোস্টিংয়ে তিনি নগরীর চেনা মুখ—রাজ্যসভার এক আইনপ্রণেতা সম্পর্কে নাম উল্লেখ না করে আলোচনা করেছেন। রিপাবলিকান এ রাজনীতিবিদ করোনা সংক্রমণের প্রথম থেকে তার মিডিয়া চ্যানেলে প্রচার করে আসছেন যে, ভাইরাসের বিস্তৃতি হচ্ছে আদতে বিদেশ থেকে আগত অভিবাসী—বিশেষ করে চীনাদের আমেরিকার অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র বিশেষ। তিনি সামাজিক দূরত্ব যে ভ্রান্ত একটি আইডিয়া—তা নিয়ে তৈরি করেছেন প্রচার ভিডিও। সামাজিক দূরত্বের নীতিমালাকে অগ্রাহ্য করে নিজ মালিকানাধীন কন্সট্রাকশন কোম্পানিতে শ্রমিকদের মাস্ক ও ডিসইনফেকশন লোশন ইত্যাদি সরবরাহ না করে কাজে বাধ্য করেছেন। আইনসভায় ইনি কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান-আমেরিকানদের শহরতলীতে ভাইরাস টেস্টিং সেন্টার স্থাপন করার বিরোধিতা করেন। দরিদ্র কর্মচারীদের বেকার ভাতা বাতিলের প্রস্তাবও উত্থাপন করেছেন। আইনপ্রণেতা মরগ্যান সাহেবের প্রতিবেশি হিসাবে একই পাড়ায় বাস করছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সামাজিক দূরত্ব বহাল রেখে তার পরিবারকে আইসোলেশনে নিয়ে রক্ষা করছেন। এক দিকে ভাইরাস টেস্টিংয়ের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর বিরোধিতা করছেন, অন্য দিকে ইনি তার নিরাপত্তারক্ষী ও ব্যক্তিগত স্টাফদের প্রতি সপ্তাহে টেস্ট করাচ্ছেন। আমি পোস্টিং পড়া শেষ করে চোখ তুলে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকাই। ড্রাইভ করতে করতে তিনি মুখোশটি সামান্য নামিয়ে এ আইনপ্রণেতা সম্পর্কে মন্তব্য করেন, ‘ফার্সিতে এ ধরনের আচরণকে বলা হয় মুনাফিকি।’ লবজটির সঙ্গে আমি পরিচিত, ফেসবুকে আইনপ্রণেতার নাম উল্লেখ না করে আলোচনা করে ফায়দা কী—ঠিক বুঝতে পারি না। পাশাপাশি বসেও আমরা দুজনে কমবেশি মুখে মাস্ক বজায় রাখছি। এ হালতে গুছিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা মুশকিল। ভাবি পরে একসময় টেলিফোন করে এ ব্যাপারে ফলোআপ করতে হবে।

যাত্রাপথে ট্র্যাফিক নেই একেবারে, তবে আমরা কথাবার্তা বলছি না, তাই দীর্ঘ মনে হয়। আমরা এ মুহূর্তে রওয়ানা হয়েছি সাভানা শহর থেকে খানিকটা দূরে আইল অব হোপ নামে ব্রিজে সংযুক্ত একটি আইল্যান্ডের দিকে। ওখানকার বিশাল একটি ম্যানসনে একাকী বাস করছেন ইরাকের অভিবাসী চিত্রকর আহাদ কালাব। ছবি আঁকার হাত তাঁর দুর্দান্ত। এ দেশে সেটেল্ড হয়ে চিত্রকলা বিক্রি করে দিন গোজরান করছিলেন। সংক্রমণের সংবাদ চাউর হওয়ার সপ্তাহ দিন আগে ইনি অত্যন্ত বিত্তশালী একজন মানুষের বিরাট একটি ম্যানসনের বলরুমে দেয়াল-জোড়া ফ্রেস্কো আঁকার কমিশন পান। বিত্তবান বাস করেন লস এঞ্জেলসে। বছরে একবার ক্রিসমাসের সময় ফিরে এসে বলরুমে আয়োজন করেন নিউইয়ার্স পার্টি। তারপর পুরো বছর ম্যানসনটি খালি পড়ে থাকে। আহাদ কালাবের গাড়ি-টাড়ি নেই। প্রতিদিন সাভানা থেকে আইল অব হোপে গিয়ে ছবি আঁকার কাজ করাটা মুশকিল। তাই তাকে ম্যানসনের বাগিচায় এক কামরায় গেস্ট-কটেজে থাকতে দেওয়া হয়। মাত্র কয়েকদিন কাজ করার পর কালাবের শরীরে ফুটে ওঠে করোনার আলামত। জ্বর, কাশি ও মাথা ধরা। তাঁর হেল্থ ইনস্যুরেন্স নেই, সিম্পটনও মাইল্ড, তাই তিনি গেস্ট-কটেজে নিজেকে আইসোলেটেড করে রাখছেন।

নগরীর এখানে ওখানে আহাদ কালাবের প্রদর্শনী হয়েছে কয়েকবার। তাঁর সঙ্গে একবার অন্তরঙ্গভাবে বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তাও বলেছি। কথা দিয়েছিলাম, তাঁকে নিয়ে লিখব, লিখতেও বসেছিলাম, কিন্তু শেষ করতে পারিনি। ধর্ম বিশ্বাসে কালাব ইয়াজিদি। যতটা জেনেছি, ইয়াজিদি হচ্ছে দজলা-ফোরাত অঞ্চলের অতি প্রাচীন একটি একেশ্বরবাদী ধর্মমত। এদের সাথে কারবালায় নবী (দঃ)-এর দৌহিত্রের সঙ্গে নির্মম আচরণ করা মোয়াবিয়ার পুত্র ইয়াজিদের কোনো সম্পর্ক নেই। এদের উপাসনা পদ্ধতির সঙ্গে সুফি তরিকার রীতি-রিচ্যুয়েলের মিল আছে। এরা কথা বলেন কারমানজি ভাষায়, অনেকেই দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে আরবি জবানটাও জানেন। পালন করেন ঈদ ও শবেবরাত।

আহাদ কালাব ইরাকের নিনেভ অঞ্চলের শেখান শহরের মানুষ। সম্প্রতি ইসলামিক স্টেটের যোদ্ধারা অত্র এলাকা দখল করে নিলে প্রায় চল্লিশ হাজার ইয়াজিদি হয়ে পড়ে বাস্তুহারা। এদের ‘কুফফার’ ফতোয়া দিয়ে ইসলামিক স্টেটের যোদ্ধারা হত্যা করে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ। একই সাথে তাদের হাতে মালে গনিমত হিসাবে বন্দী হন প্রায় ৭০০০ জন নারী। এদের কাউকে কাউকে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করা হয়। অনুগতদের নিকাহ প্রথার মাধ্যমে উপপত্নি হিসাবে যোদ্ধা পুরুষদের সংসার করার অনুমতি দেওয়া হয়। যারা ধর্মান্তরিত হতে আপত্তি জানায়, তাদের কাউকে কাউকে সেক্স-স্লেভ হিসাবে বিক্রি করে দেওয়া হয় সিরিয়ার হিউম্যান ট্র্যাফিকারদের কাছে।

আহাদ কালাব ও তাঁর স্ত্রী জাবিলা কালাব আরো হাজার খানেক ইয়াজিদির সঙ্গে বন্দী হয়েছিলেন ইসলামিক স্টেটের যোদ্ধাদের হাতে। তাদের মাউন্ট শিনজারের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় কুর্দি গেরিলাদের আক্রমণে কিছু বন্দীকে পেছনে ফেলে ইসলামিক স্টেটের যোদ্ধারা উঠে যায় পর্বতের দুর্গম হাইড আউটে। আহাদ কালাব কুর্দি গেরিলাদের সহায়তায় লেবাননে পালিয়ে এসে, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অতঃপর রেফিউজি কেটাগরিতে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হওয়ার সুযোগ পান।

ইসলামি স্টেটের সঙ্গে কুর্দিদের যুদ্ধজনিত গোলযোগে আহাদ কালাব বিচ্ছিন্ন হন তাঁর স্ত্রী জাবিলা কালাবের সঙ্গে। অনেক চেষ্টা করেও জাবিলার অদৃষ্টে কী ঘটেছে—কোনো খোঁজ পাননি তিনি। কিছু দিন আগে সাভানা শহরে হয়ে গেছে তাঁর একটি একক প্রদর্শনী। তাঁর আঁকা অনেকগুলো চিত্রে আবছাভাবে ফুটে উঠেছে জাবিলার মুখচ্ছবি। পত্রিকায় ভালো রিভিউ হয়েছে, কিছু চিত্রকলা বিক্রিও হয়েছে। অন্তরঙ্গ আলাপে জানতে চেয়েছিলাম তাঁর প্রতিক্রিয়া। চোখের জল মুছে বলেছিলেন, ‘আই আর্নড সাম মানি বাই সেলিং দ্য পেইনটিংস্, বাট...ইউ নো...ডিডন্ট গেট ব্যাক মাই লাভ।’

যে ম্যানসনের গেস্ট-কটেজে এ মুহূর্তে আইসোলেশনে আছেন কালাব, ওখানে স্থলপথে যেতে পড়ে একটি ট্রেইলার পার্ক, যেখানে ক্যারিবিয়ান ক্রুজে গিয়ে যে কয়েকজন মানুষ সংক্রমিত হয়েছিলেন কোভিড-১৯-এ, তাঁরা আইসোলেশনে বাস করছেন। অন্য উপায় হচ্ছে, নোনা জলবাহী লেগুনে নৌকা বেয়ে গিয়ে ওঠা ম্যানসনের পেছন দিকে জেটিতে। মরগ্যান আইল অব হোপের বোট ডক করার জেটির দিকে ড্রাইভ করতে করতে কালাবের সঙ্গে সেলফোনে কথা বলে নেন। গাড়িটি পার্ক করে খাবারের ব্যাগ হাতে আমরা জেটিতে আসি। ওখানে বাঁধা নানা আকারের অনেকগুলো বোট। খানিক খুঁজে আমরা চারজন বসার উপযোগী একটি ছোট্ট নৌকা লকেট করি। মরগ্যান কালাবের দেওয়া কোড ব্যবহার করে খুলে ফেলেন লক। লেগুনের জলে ভাসছে ম্যালার্ড জাতীয় হাঁস। চতুর্দিক এমন সুনশান হয়ে আছে যে, ইঞ্জিন স্টার্ট করতে ইচ্ছা হয় না। মরগ্যান ঢিমেতালে বৈঠা ফেলেন। যেতে যেতে দেখি দুপাশে নলখাগড়ার মতো দীর্ঘ ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে ধ্যানস্থ হয়ে বসে আছে শ্বেতশুভ্র সারস।

জেটিতে বোট ভিড়িয়ে আমরা সিঁড়ি দিয়ে উঠি। বাগান পেরিয়ে ম্যানসনটির চকমিলান আকার-আয়তন দেখে আমার চোখ দুটি ছানাবড়া হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। জেটির লাগোয়া বোট-হাউসে নোঙর করে রাখা একটি শৌখিন ত্রিমারান বোট, পাশেই ঢেউয়ে মৃদু মৃদু দুলছে বর্ণাঢ্য সিপ্লেন। দেখতে পাই, সেলফোন কানে লাগিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন কালাব। আমরা বোট-হাউসের বারান্দায় খাবারের ব্যাগটি রাখি। বেশ দূরে দাঁড়িয়ে তিনি হাত নেড়ে সেলফোনে ঈদ মোবারক বলেন। মরগ্যান লাউড স্পিকার অন করেন। জানতে পারি, তিনি সুস্থ হয়ে উঠছেন, চলাফেরা করতে পারেন, তবে সারাক্ষণ বড় দুর্বল লাগে। যে বলরুমের দেয়ালে তিনি ফ্রেস্কো আঁকতে শুরু করেছিলেন—তা আকারে এত বড় যে, পার্টি-পর্বে ওখানে শত খানেক গেস্ট এন্টারটেন করা যায়। বিশাল পরিসরের ফ্রেস্কোটি শেষ করতে সময় লাগবে। অসুবিধা কিছু নেই। ম্যানসনের কেয়ার টেকার তাঁকে প্রায়োজনে আরো মাস-দেড়মাস গেস্ট-কটেজে থাকার অনুমতি দিয়েছেন। ডিপ ফ্রিজে খাবার-দাবারও আছে যথেষ্ট। আমাদের দেখতে পেয়ে কালাব এত খুশি হয়েছেন যে, ইশারায় আলিঙ্গনের ভঙ্গি করে গেয়ে ওঠেন ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের পালা-পার্বণে গীত একটি জনপ্রিয় গানের দুটি কলি।

আইল অব হোপ থেকে সাভানা শহরে ফিরে ডাউন টাউনের দিকে ড্রাইভ করতে গিয়ে কী ভেবে মরগ্যান ঢুকে পড়েন একটি গলিতে। দুটি ব্লক পেরিয়ে আমরা চলে আসি ছোট্ট একটি শপিং কমপ্লেক্সের কাছে। মারণাস্ত্র বিক্রির দোকান ‘গান স্মিত’র সামনের পেভমেন্ট তিনি গাড়িটি দাঁড় করান। বন্দুকের দোকানে ক্রেতাদের ভিড়। সামাজিক দূরত্বের প্রয়োজনে একসাথে মাত্র দুজন ক্রেতাকে দোকানে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে। বাকিরা সারি দিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছেন তাদের পালা আসার। খানিক দূরে পার্কিংলটে মারণাস্ত্র ব্যবহার বিরোধী প্লেকার্ড হাতে একাকী দাঁড়িয়ে মাস্কে মুখ ঢাকা হেজাব পরা মিসেস নিয়ামা ইবরিম। আমরা তাঁর সমর্থনে নিরাপদ দূরে দাঁড়িয়ে রুমাল নাড়ি। কয়েকজন বন্দুক খরিদ করনেওয়ালা যুবক ঘাড় ফিরিয়ে আমাদের দিকে তাকান। দুজন আঙুল নিচু করে অশ্লীলভাবে ইশারা করেন। গাড়িতে ফিরতে ফিরতে ভাবি অত্র এলাকায় যেভাবে মারণাস্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে—আমার জীবদ্দশায় কি এ প্রবণতার অবসান ঘটবে?

আমাদের পরবর্তী গন্তব্য হয় জর্জিয়া সাদার্ন ইউনিভারসিটির পেছন দিককার দরিদ্র জনগোষ্ঠী অধ্যুসিত পল্লীতে। ওখানে বাস করছেন কেম্বোডিয়া থেকে অভিবাসী হয়ে আগত বয়োবৃদ্ধ চাম দম্পতি। সপ্তাখানেক আগে মিসেস লেবু-কে চাম তাঁর পক্ষাঘাতে স্থবির স্বামী মি. ফাটেল সান চামকে ঘরে একা রেখে উবার চড়ে গ্রোসারি শপিংয়ে গিয়েছিলেন। বাজার সওদা নিয়ে দোকান থেকে বেরোতেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ছবি আঁকা টিশার্ট পরা এক শ্বেতাঙ্গ মুণ্ডিত মস্তক যুবক ‘এক্সকিউজ মি...’ বলে তাঁকে থামায়। তারপর কেশে তাঁর শরীরে থুতু ফেলে চিৎকার করে বলে, ‘ইউ ফাকেন চায়নিজ, ইউ ব্রট করোনা ভাইরাস হিয়ার...গো ব্যাক টু ইয়োর আগলি হোম।’ আমি নিরীহ এ বৃদ্ধার হেরাসমেন্টের কাহিনী বর্ণনা করে স্থানীয় পত্রিকায় চিঠি লিখেছিলাম, পত্রটি ছাপেনি। মরগ্যান সাহেব পত্রিকার অ্যাডভাইজারি বোর্ডে আছেন, আমি তাঁকে গতকাল বিষয়টি অবহিত করি। তিনি ড্রাইভ করতে করতে ঘটনাটি ফের ব্যাখ্যা করতে বলেন। বিরক্ত হয়ে আমি বলি, মহিলা প্রথমত চায়নিজ নন। আর চায়নিজরা যে আমেরিকাতে ভাইরাস পাঠিয়েছে, তারও কোনো প্রমাণ নেই। গবেষকরা নিউইয়র্কে আক্রান্তদের শরীর থেকে নেওয়া জীবাণু পরীক্ষা করে বলছেন এগুলো এসেছে ইউরোপ থেকে। তো ভাইরাসের বিষয়-আশয় যাই হোক চাম পরিবার অভিবাসী হয়ে এদেশে এসেছে মূলত আমেরিকার যুদ্ধনীতির কারণে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের জামানায় যুক্তরাষ্ট্রের কার্পেট বম্বিংয়ে কেম্বেডিয়ার কমপঙচনঙ এলাকায় অবস্থিত তাঁদের পুরো গ্রামটি জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে গিয়েছিল। এ কারণে বাস্তুহারা হয়ে পুরো এগারো বছর চাম পরিবার কাটান থাইল্যান্ডের শরণার্থী ক্যাম্পে। তারপর কপালগুণে রেফিউজি ক্যাটাগরিতে অভিবাসী হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকেন।

মরগ্যান এবার জানতে চান, ‘ডু ইউ নো এনিথিং আবাউট দিস কাপোলস্ কালচারেল ব্যাকগ্রাউন্ড? সম্পাদক ঠিক বুঝতে পারেননি চাম শব্দটি, কেম্বোডিয়ার মানুষজনকে খেমার বলে না? আমি জবাব দিই, কেম্বোডিয়ার মূলধারার মানুষজনের নৃতাত্ত্বিক পরিচিতি হচ্ছে খেমার। এরা বৌদ্ধ, অনুশীলন করে তারাবাদা সম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাস। চামরা মুসলমান, সংখ্যালঘু, এরা খেমার মুসলিম বলেও পরিচিত।’

মরগ্যানের পরবর্তী প্রশ্ন হয়, ‘দেশে এসে অভিবাসী হওয়ার আগে এঁনারা কী ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন? ডু ইউ হ্যাভ অ্যানি আইডিয়া?’ কেন জানি আমার বিরক্তি আরেক দফা বাড়ে, তবে জবাব দেই, ‘মিসেস লেবু-কে চাম তারুণ্যে ছিলেন নৃত্যশিল্পী। নমপেনের রাজদরবারে তিনি একবার নৃত্য উপস্থাপন করেছিলেন। তাঁর স্বামী মি. ফাটেল সান চাম ছিলেন হাইস্কুলের শিক্ষক। এঁরা খেমার ভাষায় কথা বলেন বটে, তবে এঁদের নিজস্ব ভাষার নাম হচ্ছে খা-খা। এ ভাষার লিখনশৈলী আজকাল আর কেউ ব্যবহার করে না, ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ফাটেল সান চাম হচ্ছেন খা-খা ভাষার একজন বিশেষজ্ঞ।’ মরগ্যান এবার আসল কথায় এসে বলেন, ‘আমাদের ছোট্ট শহরের নাগরিক বৈচিত্রে এরা যুক্ত করছেন নতুন একটি এলিমেন্ট। সম্পাদক এদের সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে চান। চিঠি নয়, তুমি এঁদের নিয়ে একটি ফিচার-স্টোরি করতে পারবে কি? ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড...দু-তিনটি ছবি লাগবে কিন্তু।’ গাড়ি এসে থামে চাম দম্পতির ঘরের সামনে। ইঞ্জিন অফ করে দিয়ে মরগ্যান প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকান, আমি জবাব দিই, ‘আই উইল থিংক আবাউট দিস...আজ থাক, এ নিয়ে পরে কথা বলব। ও-কে।’

ঘরের বারান্দায় চুপচাপ বসে আছেন মিসেস লেবু-কে চাম। আমি হাত নাড়ি, তিনি চোখ তুলে তাকান, কিন্তু কিছু বলেন না। আঙিনায় ঘাস ও আগাছা বেড়ে জংলা হয়ে ওঠছে। ট্র্যাশ বিনের চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা বর্জ বোঝাই আবর্জনার একাধিক ব্যাগ। মিসেস লেবু-কে চাম উঠে দাঁড়ান, তিনি কোমর সিধে করতে প্রচুর সময় নেন, টিপয় থেকে তুলে চশমাটিও চোখে লাগান। আমি কুঁজো ভঙ্গিতে এক-পা, দু-পা করে এগিয়ে আসা বৃদ্ধার দিকে তাকাই। মাস তিনকে আগে আমি একবার তাঁদের খোঁজ নিতে এ বাড়িতে এসেছিলাম। তখন মিসেস লেবু-কে চাম আমাকে তাঁদের ফ্যামিলি অ্যালবামটি দেখিয়ে ছিলেন, ওখানে আমি সটিন-রেশম ও ব্রোকেডে ঝলমলে নৃত্যের ট্র্যাডিশন্যাল পোশাক পরা যে তরুণীর ফটোগ্রাফ দেখেছি, তার সঙ্গে আমার দিকে এগিয়ে আসা কুঁচকানো ত্বক কুঁজো বৃদ্ধার কোনো মিল দেখতে পাই না।

মিসেস লেবু-কে চাম আমার কাছে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দেন। সচেতন হই যে, এ মুহূর্তে সামাজিক দূরত্ব বহাল রাখা সম্ভব হবে না। দ্বিধা ঝেড়ে আমি তাঁর হাত স্পর্শ করি। মৃদু হেসে জানতে চান, কী ধরনের খাবার নিয়ে এসেছি? কাবাবে হাড়গোড় কিছু নেই জানতে পেরে খুশি হন, বলেন, ‘মাই হাজবেন্ড লাভ মিট, কিন্তু চামরা মৎস্যজীবী, অনেকে বাস করে নদী বা দারিয়ার কিনারায়, ঈদে আমরা নারকেলের দুধ দিয়ে চিংড়ি মাছ রান্না করি।’ মরগ্যান এগিয়ে এসে মাথা ঝুঁকিয়ে বাঁও করে পরিচিত হন। তিনি আবর্জনার ব্যাগগুলো তুলে ট্র্যাশ বিনে রাখার অনুমতি চান। মিসেস লেবু-কে মাথা হেলিয়ে সম্মতি দিয়ে তাঁর কোমরের দিকে ইঙ্গিত করেন। বুঝতে পারি, এ বৃদ্ধাও বাত-ব্যাধির আরেক ভিকটিম। আমি খাবারের ব্যাগটি নিয়ে সিঁড়ির উপর রাখি। মিসেস লেবু-কে আফসোস করে বলেন, ‘গ্রোসারিতে চিংড়ি মাছ ছিল প্রচুর, কিন্তু যে ব্যাগের দাম মাস খানেক আগে ছিল নয় ডলার, তা বেড়ে হয়েছে সাতাইশ ডলার, এত দাম দিয়ে কিছু কেনা যায় নাকি?’ অতঃপর তিনি জানান যে, তাঁরা অপেক্ষা করে আছেন সরকারের পাঠানো স্টিমুলাস চেকটি পাওয়ার। করোনা সংক্রমণজনিত মন্দায় অর্থনীতিকে জিইয়ে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস নাগরিকদের জন-প্রতি ১,২০০ ডলারের চেক পাঠানোর অনুমোদন দিয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসনের অব্যবস্থাপনায় অনেকে চেক পেয়েছেন, অনেকে পাননি। অনেক বছরের পুরানো অভিবাসী চাম দম্পতি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। চেক পাওয়ার হক তাঁদের আছে। চেক আমি নিজেও পাইনি, আমার জানাশোনা আরো অনেকেও পাননি। পরিস্থিতি যেভাবে চূড়ান্ত অব্যবস্থাপনার দিকে আগাচ্ছে, কী বলব, বৃদ্ধাকে কোনো ভরসা দিতে পারি না। খিন্ন মনে বিদায় নিয়ে ফিরে আসি গাড়িতে।

মরগ্যান ডিসইনফেকশনের শিশিটি বাড়িয়ে দেন। আমি লোশন দিয়ে হাত পরিষ্কার করে গাড়িতে উঠি। তিনি স্টার্ট দিতে দিতে বলেন, ‘লেটস্ কাম ব্যাক টু দিস হাউস টুমরো। আমি পর্টেবল লনমোয়ার নিয়ে আসব। তুমি বৃদ্ধাকে রিং করে পার্মিশন নিয়ে রাখো। আমি তাঁর অঙিনার আগাছাময় ঘাসগুলো কেটে দিতে চাই।’

মাথায় একটি আইডিয়া খেলে যায়। চাম দম্পতির ড্রয়িংরুমে সাজিয়ে রাখা আছে খা-খা ভাষায় লেখা তালপাতার কয়েকটি পুঁথিপত্র। মিসেস লেবু-কের নৃত্যের পোশাক পরা যুবতী বয়সের একটি ছবির কপির সাথে তালপাতার পুঁথিপত্রের দুটি ছবি তুলে নিতে পারলে—স্থানীয় পত্রিকার জন্য অনায়াসে একটি ফিচার দাঁড় করানো যায়। আমি সম্ভাবনা নিয়ে ভাবি, কিন্তু ভেতর থেকে সায় পাই না। ত্রাণকাজের হিল্লা ধরে আমার একটি লেখার প্রয়োজনে এ দম্পতির ব্যক্তিগত সম্পদকে ব্যবহার করব, কাজটা কি নৈতিকভাবে সঠিক হবে?

আমরা যে রেফিউজি পরিবারদের খাবার দিতে যাচ্ছি, তাঁরা বাস করছেন শহর থেকে সামান্য দূরে—সস্তা হাউজিং ফেসিলিটিতে। মরগ্যান অই দিকে টার্ন নেন। সিগনালের লাল বাতিতে থামতেই মি. ইদ্রিসা বেনী ইসামের কাছ থেকে টেলিফোন আসে। তাঁরা অপেক্ষা করছেন। মরোক্ক থেকে অনেক বছর আগে অভিবাসী হয়ে এদেশে আসা মি. ইদ্রিসার ছেলে আবদেল বেনী ইসামের মৃত্যু হয়েছে সম্প্রতি কারাগারে, সম্ভবত করোনাক্রান্ত হয়ে। মরগ্যান ড্রাইভ করতে করতে মি. ইদ্রিসা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান। মরোক্কর তানজিয়ার্স অঞ্চলের মানুষ ইনি। রাজবন্দী হয়ে সাত বছর কাটিয়েছেন ওই দেশের একটি কুখ্যাত কারাগারে। তারপর রাজা পঞ্চম মোহাম্মদের সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি পেয়ে কিভাবে যেন ইমিগ্রেশন নিয়ে এদেশে আসেন। এক সময়ে ফুটপাতে দোকান সাজিয়ে সাভানা নগরীতে আগত পর্যটকদের কাছে বিক্রি করতেন—মরোক্কর কুটিরশিল্পজাত পণ্য। বয়সের কারণে আজকাল আর দোকানটি ম্যানেজ করতে পারেন না। গেল ঈদেও মসজিদ-ভিত্তিক পার্টিতে তিনি নিয়ে এসেছিলেন সবচেয়ে মজাদার কুসকুস। এবারকার দুর্বিপাকে খাবারের অনটনে ভুগছেন মি. ইদ্রিসার পরিবার। তাঁরা স্টিমুলাস চেকও পাননি। তাঁর ছেলে আবদেল বেনী ইসাম কাজ করত একটি শপিংমলে। ওখানকার একটি দোকানের কিছু সৌখিন পণ্য খোয়া গেলে সিসি টিভির সূত্র ধরে গ্রেফতার হয় আবদেলসহ আরো দুটি শ্বেতাঙ্গ তরুণ। মামলায় লইয়ারের আইনি মারপ্যাঁচে শ্বেতাঙ্গ ছেলে দুটি ছাড়া পায়। কিন্তু লইয়ার জোগাড় করার মতো আর্থিক সঙ্গতি মি. ইদ্রিসার ছিল না। তাই, সম্ভবত মিথ্যা মামলায় তাঁর সন্তান আবদেল চার বছর মেয়াদের সাজা পায়। কারাগার থেকে টেলিফোন করে সে জ্বর-কফ-কাশি ও শ্বাসকষ্টে ভোগার সংবাদ তাঁর পিতাকে জানায়। কারাগারে এ সময় আরো অনেক কয়েদির শরীরে ফুটে উঠেছিল এ ধরনের রোগলক্ষণ। বেশ কয়েক জন কয়েদির মৃত্যু হয় অবশেষে। টেস্টিংয়ের কোনো ব্যবস্থা ছিল না, তাই নিশ্চিত করে বলার কোনো উপায় নেই যে, এরা মারা গেছেন করোনা সংক্রমণে। আবদেলের মৃত্যুর আগে মি. ইদ্রিসা সন্তানের সঙ্গে দেখা করার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু কারাগারের ভিজিট আওয়ার বাতিল করা হয়েছিল। অতঃপর মি. ইদ্রিসা কারা-কতৃপক্ষের অনুমতি চেয়েছিলেন, যাতে ছেলেকে টেলিফোনে তওবা পড়াতে পারেন। তাঁকে এ ধর্মীয় অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হয়।

আমরা এসে পৌঁছি সস্তা হাউজিং ফেসিলিটিতে। পেভমেন্টের পাশে একটি বেঞ্চে চুপচাপ বসে আছেন মি. ইদ্রিসা। আমাদের সালামের আলেক দেন তিনি, হাসেন, হাত নাড়েন, কিন্তু কিছু বলেন না। লাঠি হাতে অন্যমনস্ক হালতে বসা মরোক্কান কেতার অজানুলম্বিত সফেদ পোশাকপরা মানুষটিকে চিন্তামগ্ন সুফি-দরবেশের মতো দেখায়। আমরা খাবারের প্যাকেটগুলো পাশের আরেকটি বেঞ্চে রাখি। তিনি হাত তুলে আমাদের আশ্বস্ত করে বলেন, রেফিউজিদের অ্যাপার্টমেন্টগুলোর দোরগোড়ায় খাবার পৌঁছে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। সোমালিয়ার শরণার্থী আহমদ গুদ একটু পর এসে অ্যাপার্টমেন্টগুলোতে খাবার ক্যারি করে পৌঁছে দেবে।

একটু দোনামোনা করে অবশেষে বলেই ফেলি, ‘মি. ইদ্রিসা, আই অ্যাম সো স্যারি...সিনসিয়ার কনডোলেন্সসেস্ ফর ইয়োর সন’স ডেথ।’ বোবাদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তিনি আমাকে তাঁর ছেলের মাগফেরাতের জন্য মোনাজাত করতে বলেন। আমি তাঁকে প্রতিশ্রুতি দিই—ঘরে ফিরে প্রার্থনা করব। মরগ্যান এগিয়ে এসে বিনীতভাবে বলেন, ‘আমি ধর্মে মুসলমান নই, তবে ইসলাম ধর্মের প্রতি আমার শ্রদ্ধা আছে। আপনি যদি অনুমতি দেন, আমি আপনার ছেলের জন্য প্রার্থনা করতে চাই।’ ঘাড় হেলিয়ে মি. ইদ্রিসা সম্মতি দেন। মি. মরগ্যান দুহাত তুলে প্রার্থনা করেন, আমি ও ইদ্রিসা আমিন বলে দোয়ায় শরিক হই।

সোমালিয়া থেকে আগত দীর্ঘদেহী নওজোয়ান আহমদ গুদ এসে আমাদের ঈদ মোবারক বলে। ছেলেটি শহরের একটি বারবার সেলুনে চুল কাটার কাজ করত। প্রায় দুইমাস লকডাউনের পর শহরের সেলুন ইত্যাদি খুলেছে। জানতে চাই, ‘হাউ ইজ ইয়োর জব গোয়িং? কাজে গিয়েছিলে কি?’ নেতিবাচকভাবে হাত উল্টিয়ে আহমদ জানায়, গেল কয়েকদিন ধরে সেলুন খুলেছে, তবে এখনো কাস্টমাররা সেলুনে আসতে সাহস পাচ্ছে না। সে প্রতিদিন একবার করে সেলুনে হাজিরা দিচ্ছে, কিন্তু চুল কাটার লোকজন না আসলে মাথাওয়ারি পারিশ্রমিক পাওয়ার কোনো উপায় নেই। আমি দূরত্ব বজায় রেখে খেলনাগুলো খাবারের সাথে কোন কোন অ্যাপর্টমেন্টে পৌঁছে দিতে হবে তা বুঝিয়ে বলি। আহমদ একটি ঝুড়িতে প্যাকেটগুলো তুলছে। আমি এক পা সামনে গিয়ে জানতে চাই, ‘হাউ ইজ ইয়োর ফাদার মি. মোহাম্মদ গুদ?’ সে ‘আই উইল আনসার ইউ ইন আ মিনিট,’ বলে ইশারায় জানায় প্যাকেটগুলো গুছিয়ে নিয়ে সে আমাকে জবাব দিচ্ছে। আমি এ সুযোগে সংক্ষিপ্তভাবে মরগ্যানকে তার বাবা মোহাম্মদ গুদের করোনাক্রান্ত হয়ে সেরে ওঠার ঘটনাটি জানাই। ডাক্তাররা প্রায় আশি বছরের এ বৃদ্ধের রিকভার করার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। পুরো চার সপ্তাহ যুঁজে যেন জাদুবলে তিনি রিকভার করেন। হাসপাতাল থেকে তাঁর রিলিজের দিন নার্স ও ডাক্তাররা জড়ো হয়ে হাততালি দিয়ে তাঁর সুস্থ হওয়ার বিষয়টি সেলিব্রেট করে। ঘটনাটি আমিও প্রত্যক্ষ করি স্যোশাল মিডিয়ায়। ঝুড়িতে প্যাকেটগুলো গুছিয়ে আহমদ গুদ বলে, ‘মাই ফাদার সেন্ড ইউ আ ম্যাসেজ মি. সুলতান। তুমি যে খাবার দিয়ে গিয়েছিলে, শুকনা বিস্কিটগুলো বাবার পছন্দ হয়নি। তিনি খেতে চাচ্ছেন এক পেয়ালা দুধ।’ আমি দুধ পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিই। আহমদ গুদ আতরের ছোট্ট একটি শিশি বের করে তাতে তুলা গুঁজতে গুঁজতে বলে, ‘বাবা তোমাদের জন্য সামান্য আতর পাঠিয়েছেন।’ সচেতন হয়ে উঠি যে, আহমদ গুদের হাত থেকে আতর নিলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সামাজিক দূরত্বের নীতিমালা, আমি ও মরগ্যান পরস্পরের দিকে তাকাই, কিছু বলি না, অতঃপর খোশবুদার তুলা নাকে দিতে দিতে ভাবি—ঈদের দিন না হয় সামাজিক দূরত্বের সামান্য ব্যতিক্রমই হলো।

অসুস্থ ‘তিলোত্তমা’র কাছে কী সেবা চান আপনি!



প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত, প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম

ছবি: সংগৃহীত, প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

জুলাই ১৩, ২০২৪ সালের ভোর পাঁচটায় শুরু হয়েছিল এক তুমুল বৃষ্টি। রাজধানী ঢাকার বেশিরভাগ মানুষ তখনও গভীর ঘুমে।

এ সময়টা ঘোর বর্ষাকাল। সে কারণে ভারী বৃষ্টিপাত হতেই পারে। তাই, অ্যালার্ম শুনেও আরেকটু ঘুমিয়ে নিই বলে যারা কিছুটা দেরিতে উঠে অফিসে যাবেন বলে আটটার দিকে পথে নেমেছেন, তাদের চক্ষু সেদিন চড়কগাছ‍!

সকাল ৯টা পর্যন্ত বৃষ্টি থামেনি। একটানা চার ঘণ্টার মুষলধারার পতনে ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার ২৬ থেকে ৩০টি বড় রাস্তা একসঙ্গে ডুবে গেছে।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, এই ‘ডোবা’ সেই ডোবা নয়! রাস্তায় ১-২ ঘণ্টা জ্যামে দাঁড়িয়ে থাকার পর অনেক গাড়ির ইঞ্জিনে পানি ঢুকে পড়ায় অচল হয়ে যানজট অসহনীয় করে তুলেছিল সেদিন। সংবাদে টেলিভিশনের ভিডিওচিত্র দেখেও তাই-ই মনে হচ্ছিল।

সে এক অতি ভয়ঙ্কর অবস্থা সারাদিন জুড়ে। যেখানে চোখ যায়, সেখানেই মনে হয়, প্লাবন বয়ে যাচ্ছে। নটরডেম কলেজের পাশের রাস্তায় পার্কিং করা কারের শুধু ছাদটা দেখা যাচ্ছে। মালিক গাড়িতে উঠতে গিয়ে হতবাক হয়ে পড়েছেন।

নিউমার্কেটের প্রধান গলিতে বুকসমান পানি। দোকানকার মালিকেরা যারা বাসা থেকে ডুবন্ত নিউমার্কেটের ছবি দেখে দৌড়ে এস মাল সরানোর চেষ্টা করেছিলেন, তারা অনেকে এসে দেখেন দোকানের তালা ঘোলা-ময়লা পানিতে ডুবে অচেনা হয়ে গেছে। মালপত্র ভিজে গছে। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে পর্যন্ত সেই মালামাল সরাতে পারেননি।

কোথায় নেবেন! বেরুনোর সব রাস্তায় থৈ থৈ পানি! ভ্যান, যানবাহন কিছুই ঢোকানো যাবে না! এখানে জলের যানবাহন নেই। কলের গাড়ি জমানো বৃষ্টির বুকসমান জলে চলার পথ খুঁজে পায়নি কোথাও।

গ্রীন রোডে অনেকগুলো প্রাইভেট হাসপাতাল। সেখানে আগত রোগীদের অবস্থা খুবই করুণভাবে চিত্রিত হয়ে সংবাদে ঠাঁই নিয়েছে সেদিন। ডুবন্ত রিকশাভ্যানে নারী রোগীকে শুইয়ে নিয়ে ঠেলে চলছেন রোগীর আত্মীয়-স্বজনেরা। পাশের ভবনের কৌতূহলী মানুষ শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে ‘আহারে’ বলে অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। ভাগ্যিস! শুক্রবার হওয়ায় সেদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা ছিল না।

এদিন পথে যারই নেমেছেন, তারাই দুর্ভোগে পড়ে গিয়েছেন। বাইকারদের অনেকের ইঞ্জিনে পানি ঢুকে স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেছে। পেটের ধান্ধায় যারা ব্যাটারিরিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন, তাদের বাহন অচল হয়ে যাওয়ায় সেগুলো ঠেলে অন্যখানে সরিয়ে নেওয়ার কোনো উপায় ছিল না।

চিৎকার করে কেউ কেউ বলছিলেন- ‘আমাদের ট্যাক্স, ভ্যাট আদায়ের সময় যারা নিয়ম দেখায়, যারা জরিমানা আদায় করে তারা এখন ঘরে বসে টিভিতে আমাদের কষ্ট দেখে তামাশা করছে! এই তিলোত্তমা নগরে নাগরিক সুবিধা কি সামান্য বৃষ্টির পানিতে ডুবে থাকবে’!

কথা হলো- এই ‘তিলোত্তমা’ কী দেবে তোমায় আমায়! তার কি-বা দেবার আছে! রাজধানী ঢাকাকে বিশেষণ দিয়ে রূপসীর টোলপড়া গালের তিলের সঙ্গে তুলনা করা হয়। এর সৌন্দর্যের মোহে কবি-সাহিত্যকরা কত শত ছড়া-কবিতা লিখেন দিনরাত।

কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর কত মূল্যবান প্রসাধনী কিনে সাজানোর চেষ্টা করেন এর দেহকে। এর একই অঙ্গে উত্তর-দক্ষিণে কত বাহারি আলো শোভা পায়‍ কিন্তু দিনশেষে এত মেকাপ ‘রিমুভ’ করে ঘুমুতে যাওয়া উপায় নেই তার। এজন্য সে নিজেই নিজের সহ্যগুণ হারিয়ে ‘ভালনেরাবল’ বা ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। কিন্তু সেদিকে কারো কোনো নজর নেই।

তবুও প্রতিদিন নতুন নতুন ফেসপাউডার, কাজল, ভারী ভারী গহনা পরানো হচ্ছে। তিলোত্তমার বুক চিরে এত ভারী গহনা পরানোর ফলে এর বুক দুরু দুরু করছে। কানের গহনা কখন কান ছিঁড়ে পড়বে, তার নিরাপত্তা নেই। এর প্রাকৃতিক পঞ্চন্দ্রিয় এখন বন্ধ হয়ে গেছে! এসব কথা আক্ষেপ করে বলছিলন এক প্রবীণ ঢাকাবাসী। তাঁর কাছে ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার প্রাকৃতিক পঞ্চন্দ্রিয় বন্ধ হওয়ার কথা হঠাৎ আঁতকে উঠে জিজ্ঞাসা করলাম- সেটা কেমন!

মানুষের প্রাকৃতিক পঞ্চন্দ্রিয় বন্ধ হয়ে গেলে যদি দ্রুত চিকিৎসা করানো না যায়, তাহলে তার মৃত্যু অনিবার্য! তবে ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার পঞ্চন্দ্রিয় বন্ধ হলো কীভাবে! তিনি জানালেন, ধরুন, এর বাতাসের মান বছরের ১০ মাসই অস্বাস্থ্যকর থাকে। পথে হাঁটতে গেলে নাক, চোখ দিয়ে গরম পানি ঝরে। এখন বর্ষাকাল তাই বায়ুতে একটা স্বস্তি। এর মুখ খোলা। কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, যা দিয়ে প্রতিদিন নতুন নতুন মানুষ, ছাত্র, বেকার, ভাসমান মানুষ ঢুকছে। কেউ একবার ঢুকলে আর বের হতে চায় না।

তবে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো- এর নিচের ইন্দ্রিয় দুটো বর্ষাকালে হঠাৎ করে অকেজো হয়ে পড়ে। যেমন- ধরুন, ভূগর্ভস্থ সুয়্যারেজ লাইন ও নর্দমাগুলোর কথা। এই দুটি ‘তিলোত্তমা’র অতি গুরুত্বপূর্ণ ইন্দ্রিয়। জুলাই ১৩, ২০২৪ তারিখ চার ঘণ্টার বৃষ্টির পানি যদি বাধাহীনভাবে সব নর্দমা দিয়ে বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়তো, তাহলে কি এই ভয়ঙ্কর জলজট হতো!

কিন্তু ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার অতি গুরুত্বপূর্ণ ইন্দ্রিয় সদৃশ নর্দমাগুলোর মুখ বন্ধ হয়ে পড়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান এর নর্দমাগুলোর ভেতরে পাইপ বসিয়ে এর স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে। ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার উন্নয়ন কাজে এত বেশি প্রতিষ্ঠান জড়িত, তা গুনে শেষ করা যাবে না। তাদের মধ্যে কাজের সমন্বয় নেই। কে কখন কাটলো, কে ঢেকে রাখলো, আর কে নর্দমাগুলোর ভেতরে পাইপ বসিয়ে পানি প্রবাহ বন্ধ করে দিলো, তা ঠিকমতো হিসাব রাখার মতো সময় সুযোগ নেই কর্পোরেশনগুলোর।

সুতরাং একটু বৃষ্টি হলেই প্লাষ্টিক, মাটি, কাপড়ের টুকরো, কিচেন গার্বেজ ইত্যাদি দিয়ে এর নিচের ইন্দ্রিয় বা ময়লা নিষ্কাশনের নর্দমা বর্ষাকালে হঠাৎ করে অকেজো হয়ে পড়ে; যার নেতিবাচক প্রভাব এসে পড়ে রাজপথে, অলিতে-গলিতে, বাড়িতে, মার্কেটে। নগরের সব জায়গার সব কার্যক্রম হঠাৎ থৈ থৈ পানিতে সয়লাব হয়ে যায়।

এজন্য কর্পোরেশনগুলোর সার্বক্ষণিক ওয়াচটিম ও মটিভেশন কর্মসূচি থাকা দরকার। একেকটি সার্বক্ষণিক ওয়াচটিমের এক-দুইজন সদস্য একেকটি এলাকার ১০টি করে নর্দমার প্রবাহ পরিষ্কার আছে কিনা তা নজরদারিতে রাখলে এই জলাবদ্ধতা সহজেই নিরাময় করা যাবে!

জাপানের ট্রাফিক যেমন অফিসে বসেই রাস্তার চলন্ত গাড়ি ওয়াচ করে মাসিক বেতন বিলের সঙ্গে জরিমানার বিল কেটে ধরিয়ে দেয় তদ্রুপ আমাদের সিটি কর্পোরেশনের নর্দমা ওয়াচ টিমের দৈনন্দিন কার্যকলাপ সিসি ক্যামেরা ও ড্রোন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ করে জরিমানার বিধান করা যেতে পারে।

‘তিলোত্তমা’ ঢাকার নির্মাণ কাজ সারাবছর জুড়ে চলে। কখনো শেষ হয় না। নির্মাতারা রাস্তার পার্শ্বে বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রী, নুড়িপাথর বর্জ্য ফেলে স্তূপ করে রাখে। একটু বৃষ্টি হলে সেগুলো গড়িয়ে কাছাকাছির ড্রেন বন্ধ করে দেয়। বিভিন্ন পার্ক, পথঘাটের খোলা রেস্টুরেন্টে হরদম পলিথিন প্যাকেটে খাদ্যসামগ্রী বিক্রি হয়। ফুটপাতের দোকান, দর্জিপাড়া ইত্যাদি থেকে প্লাষ্টিক ব্যাগ ও বেশি শক্ত বর্জ্য নর্দমার মধ্যে ফেলা হয়ে থাকে। ওয়াচটিমের মাধ্যমে সেগুলো নিয়মিত সরিয়ে ড্রেনের ময়লা পানির গতিপ্রবাহ দেখে প্রতিদিন রিপোর্ট নেওয়ার নিয়ম থাকা উচিত।
হয়ত অনেক নিয়ম-কানুন হাতে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ‘তিলোত্তমা’র রাস্তায় যেখানে-সেখানে কাগজ, পলিথিন, ইটের টুকরা, আবর্জনার ছড়াছড়ি দেখে এসব কাজের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তাইতো মনে হয়, মাত্র একবেলা বৃষ্টির পানিতে কেন এই বন্যা! গেল অর্থবছরে ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে সাতশ পঞ্চাশ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে বলে একটি জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম হয়েছে। তবু কেন নগর জুড়ে ভয়াবহ জলাব্ধতার দুর্ভোগ কিছুদিন পর পর ঘাড়ে চাপে! এর দায়ভার কার!

‘তিলোত্তমা’ ঢাকা যানজট, জলজট ইত্যাদিতে নিজেই পঙ্গু হয়ে অসাড় হয়ে পড়েছে। বুয়েটের আবাসিকের মতো জায়গায় নগর পরিকল্পনাবিদদের কোয়ার্টারের নিচতলাবাসী এবার জলজটকে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। তারা কেউ কেউ পাম্প দিয়ে ঘরের পানি সেচে বাইরে ফেলার চেষ্টা করেছেন। কেউ সারারাত ঘুমাতে পারেননি। তাদের জন্যও উন্নত নাগরিক সেবা সে রাতে শূন্যের কোটায় নেমে গিয়েছিল।

‘তিলোত্তমা’ ঢাকায় প্রায় প্রতিবছর এই জায়গায় বার বার কাটাছেঁড়া করায় অতি উন্নয়নের ভারে সে ন্যুজ্ব হয়ে পড়েছে। যেমনটি ঘটেছিল পপ তারকা মাইকেল জ্যাকসনের বেলায়। তাঁর দেহের বিভিন্ন অঙ্গে এত বেশি প্লাস্টিক সার্জারি করা হয়েছিল যে, তিনি একসময় চরম হতাশ হয়ে ওষুধ গ্রহণ ছেড়ে দিয়ে একা একা বাঁচার জন্য নিঃসঙ্গ থাকতে চেয়েছেন। তবুও শেষ রক্ষা হয়নি তার। এখন থেকে আমাদের ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার অঙ্গে আর কাটাছেঁড়া না করাটাই উত্তম।

অসুস্থ ‘তিলোত্তমা’র ওপর একসঙ্গে অনেক ব্যাধি ভর করেছে। এ অবস্থায় তার কাছে আর কী নতুন সেবা চাওয়ার আছে আমাদের! তাই, ‘তিলোত্তমা’র ওপর আর শল্য চিকিৎসা না চাপিয়ে উল্লিখিত টোটকা দাওয়াই দিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর আছে বলে মনে হয় না!

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। E-mail: [email protected]

;

সাহিত্য পত্রিকা 'কথার কাগজ'র আত্মপ্রকাশ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সাহিত্য পত্রিকা 'কথার কাগজ'র আত্মপ্রকাশ

ছবি: সাহিত্য পত্রিকা 'কথার কাগজ'র আত্মপ্রকাশ

  • Font increase
  • Font Decrease

শ্রাবণ সংখ্যা আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে শিল্প ও সাহিত্যের ছোট পত্রিকা 'কথার কাগজ'-এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলো।

শুক্রবার (১২ জুলাই) বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মিলনায়তনে 'কথার কাগজ' শ্রাবণ সংখ্যার মোড়ক উন্মোচন করা হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক শাহানারা স্বপ্না, কথাসাহিত্যিক ফরিদুল ইসলাম নির্ঝর, স্টুডেন্ট ওয়েজ প্রকাশনীর প্রকাশক মাশফিক তন্ময়, কথার কাগজের প্রধান সম্পাদক কেতন শেখ, নির্বাহী সম্পাদক অয়ন আব্দুল্লাহ প্রমুখ। পত্রিকাটির বার্ষিক শ্রাবণ, কার্তিক ও ফাল্গুন তিনটি সংখ্যায় প্রকাশ হবে।

মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে কথার কাগজের প্রধান সম্পাদক কেতন শেখ বলেন, 'করোনাকালীন ২০২০ সালে কথার কাগজের জন্ম। সে সময় কয়েকজন প্রবাসী আর দেশি লেখক অনলাইনে ব্লগের মাধ্যমে কথার কাগজের লেখালেখি শুরু করি। তরুণ সাহি- ত্যিকদের সঙ্গে প্রবীণ সাহিত্যিকদের লেখালেখির একটি প্ল্যাটফর্ম হয়ে দাঁড়ায় কথার কাগজ।

প্রকাশক মাশফিক তন্ময় বলেন, 'এক সময় সাহিত্য আন্দোলনের প্রধান বাহন ছিল ছোট পত্রিকা বা লিটলম্যাগ। কিন্তু নানা সংকটে লিটলম্যাগের কলেবর ছোট হয়ে গেছে। প্রকাশকরা অনেকেই অর্থসংকটে তাদের প্রকাশনা বন্ধ করে দিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে অনলাইনের এই যুগে ছাপা কাগজে কথার কাগজের যাত্রা তরুণ লেখকদের অনুপ্রেরণা জোগাবে।'

শাহানারা স্বপ্না বলেন, 'আশা করি, পত্রিকাটি অনেক দূর এগিয়ে যাবে। শ্রাবণ সংখ্যার প্রথম দর্শনে মনে হচ্ছে এটি পাঠকদের সাহিত্যের খোরাক জোগাবে।'

ফরিদুল ইসলাম নির্ঝর বলেন, 'মানুষের ভাষার প্রতি টান থাকলে দেশ ও দেশের বাইরে থেকে কাজ করা যায়, এর উদাহরণ কথার কাগজ। সম্পাদকম- গুলীর তিনজনই দেশের বাইরে থেকে এর যাত্রা শুরু করেন। আজকে দেশে এসেই তারা পত্রিকাটির ছাপা সংস্করণের মোড়ক উন্মোচন করলেন।'

সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান বলেন, 'আমাদের তরুণরা বিদেশ চলে যাচ্ছে, আর ফিরছে না। তবে কথার কাগজের সঙ্গে জড়িতরা বিদেশ থেকে সাহিত্য আর দেশের টানে ফিরে এসেছেন। অনলাইনের যুগে যখন অনেক পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, এ অবস্থায় তারা কথার কাগজের প্রিন্ট ভার্সন নিয়ে এসেছেন। এটি অনেক ভালো লাগার।' নতুন পত্রিকাটি টিকিয়ে রাখতে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

;

লেখক শেখ হাসিনা কোটিপতি হওয়ার পথে!



আবদুল হামিদ মাহবুব
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখালেখির হাত খুব ভালো। তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী হননি তখনই তার একাধিক বই প্রকাশ হয়েছে। সম্ভবত তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই ‘ওরা টোকাই কেন’। ঢাকার আগামী প্রকাশনী থেকে বইখানা বের হয়েছিল। ওই প্রকাশনী থেকে আমারও দু’খানা ছড়ার বই প্রকাশ হয়। ১৯৯১ সালে আমার ‘ডিমের ভিতর হাতি’ যখন প্রকাশ হচ্ছিলো তখন আগামী প্রকাশনীর কর্ণধার ওসমান গনি ভাই শেখ হাসিনার ‘ওরা টোকাই কেন’ এককপি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন।

বইখানা প্রথম না দ্বিতীয় সংস্করণের ছিলো সেটা মনে নেই। ওই বই কয়েকটি নিবন্ধের সংকলন। অধিকাংশ নিবন্ধেই শেখ হাসিনা তাঁর ভিতরের যন্ত্রণার কথা লিখেছিলেন। লিখেছিলেন দেশ ও রাজনীতি নিয়ে তাঁর পরিকল্পনার কিছু কিছু ইঙ্গিত। পড়েছিলাম তো অনেক আগে। তারপরও লেখাগুলোর অনেক বিষয় মনে রয়ে গেছে। প্রতিটি নিবন্ধ পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমার পারিবারিক ছোট লাইব্রেরিতে বইখানা গোছিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু আজ যখন ওই বই খোঁজতে লাগলাম, পেলাম না। অনুমান হচ্ছে আমার বইচোর কোন বন্ধু হয়তো এই বইখানা মেরে দিয়েছেন। অথবা বন্যা অতঙ্কে কয়েকেবার বাসার বইগুলো টানাটানি করার কারণে কোথাও হয়ত খুইয়ে ফেলেছি। তবে আমার ধারণা এই বইয়ের ক্ষেত্রে প্রথমটি ঘটেছে।

প্রধানমন্ত্রীর অনেক বইয়ের মতো ‘ওরা টোকাই কেন’ নিশ্চয়ই বহুল প্রচারিত হয়েছিল, বেরিয়েছিল অনেক অনেক সংস্করণ। আর বই সমূহের রয়্যারিটিও তিনি হাজার হাজার টাকা পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এমন প্রাপ্তি ঘটে থাকলে, আমি একজন লেখক হিসাবে অবশ্যই পুলকিত হই। আমি দেখেছি সেই ১৯৯১ সালের পর থেকে আগামী প্রকাশনীর প্রকাশনা ব্যবসারও অনেক উন্নতি হয়েছে। ব্যবসার উন্নতি ঘটার অর্থ প্রকাশকের উন্নতি ঘটা। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি আগামী প্রকাশনীর কর্ণধার ওসমান গনি ভাইয়ের আর্থিক অবস্থা অনেক অনেক ভালো হয়েছে।

পূর্বে দেখতাম একুশের বইমেলায় আগামী প্রকাশনী ছোট্ট স্টল নিত। এখন প্যাভিলিয়ন নেয়। লাখ লাখ টাকা খরচ করে প্যাভিলিয়নের অঙ্গসজ্জা করা হয়। নিশ্চয় বইয়ের ব্যবসা ভালো হয়। সেকারণেই বইমেলার প্যাভিলিয়ন তৈরিতে বিনিয়োগও বেশি করেন। প্রতিবছরই আগামী প্রকাশনীর কোন না কোন বই কেনার জন্য পাঠকের লাইন পড়ে। পাঠক যখন যে কোন লেখকের বই কেনে, সেটা দেখে আমি একজন লেখক হিসাবে আনন্দিত হই। বইয়ের ব্যবসার উন্নতি হোক। প্রকাশকরা ভালো লাভ করুন, আমি মনে প্রাণে সেটা চাই।

অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, প্রকাশকের লাভ হলে আমার মতো মফস্বলের লেখকরা কি লাভমান হই? অবশ্যই যৌক্তিক প্রশ্ন। এর জবাব খুব সংক্ষিপ্ত। প্রকাশকরা যখন বই প্রকাশ করে লাভের মুখ দেখবেন, তখন তারা নতুন নতুন বই প্রকাশে আগ্রহী হবেন। নতুবা আমাদের মতো লেখকদের প্রকাশককে উল্টো টাকা দিয়ে বই প্রকাশ করিয়ে নিতে হবে। এবং আমরা অনেকেই সেটা করছিও।

অনেকে আবার এও বলেন ডিজিটালের এই যুগে এখন আর কেউ বই কিনে পড়ে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে টুকটাক পড়েই তাদের পড়া শেষ করেন। সেই কারণে লেখকরা গাঁটের টাকা খরচ করে বই প্রকাশ করলেও সেগুলো বিক্রি হয় না। আমি এই অপবাদটা মানতে নারাজ। কারণ আমি দেখেছি কেবল ফেব্রুয়ারি মাসেই বইমেলা চলাকালে শত শত কোটি টাকার বই বিক্রি হয়। আর যারা পড়ুয়া, তারা সারা বছরই খোঁজে খোঁজে রকমারি, প্রথমা, আগামী, শ্রাবণ, ইউপিএলসহ বিভিন্ন আনলাইন বই বিক্রয় প্রতিষ্ঠান থেকে বই আনান।

আমি মফস্বলের একটি শহরে থাকি। আমাদেরে শহরে বইয়ের দোকান আছে অনেক। সেগুলোতে স্কুল কলেজের পাঠ্য ও গাইড বই ছাড়া অন্য বই খুব কমই দেখা যায়। সৃজনশীল বলুন আর মননশীল বলুন, সেইরকম বইয়ের দোকান খুব একটা নাই। আমাদের শহরে প্রকাশনা ব্যবসার সাথে ‘কোরাস’ নামে একটি দোকান চালান বই পাগল এক যুবক মুজাহিদ আহমদ। তাঁর কোরাসেই আমাদের মত পাঠকের উপযোগী কিছু কিছু বই আসে। কিন্তু সবসময় কোরাসও আমাদের মতো পাঠকদের চাহিদার যোগান দিতে পারে না। তারপরও মন্দের ভালো হিসাবে দোকানটি টিকে আছে, টিকে থাক্।

আমাকে প্রায়ই অর্ডার করে ‘রকমারি’ থেকে বই আনাতে হয়। আমার আনানো বই ছাড়িয়ে আনার জন্য আমি নিজে প্রায়ই কুরিয়ার অফিসে যাই। আমি যেদিনই কুরিয়ার অফিসে গিয়েছি, দেখেছি কেবল আমার বই নয়, আমার মতো আরও অন্তত বিশ থেকে পঁচিশ জনের বইয়ের প্যাকেট এসেছে। কুরিয়ার অফিসের লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জেনেছি, প্রতিদিনই এভাবে কিছু না কিছু বই নানাজনের নামে আসে। আর আমার নিজের চোখে দেখাটাকেওতো বিশ্বাস করতে হবে। মানুষ যদি বই নাই পড়বে তবে কেনো রকমারি কিংবা অনলাইনের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে এতো এতো বইয়ের প্যাকেট আসবে? আমি বলবো বইয়ের পাঠক মোটেই কমেনি বরংচ বেড়েছে।

শুরু করেছিলাম আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বইয়ের প্রসঙ্গ দিয়ে। বই প্রসঙ্গেই বলতে গিয়ে অন্য প্রসঙ্গও এসে গেল। আমাদের শহরের সেই যে ‘কোরাসে’র কথা বলেছি; ক’দিন আগে এক দুপুরবেলা কোরাসে গিয়ে বই দেখছি। এসময় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুইজন প্রধান শিক্ষক কোরাসে এসে ঢুকলেন। তাদের দু’জনের হাতেই বেশ বড় সাইজের চারখানা করে বই। ওই দুই প্রধান শিক্ষক আমার পূর্ব পরিচিত। তাদের হাতে বই দেখে আমি উৎফুল্ল হলাম। কি বই? কোথা থেকে আনলেন? এমন প্রশ্ন করে বইগুলো দেখতে চাইলাম। দু’জনই ক্ষোভ প্রকাশ করে আমার সামনে টেবিলের উপর ধাম্ ধাম্ করে বইগুলো রাখলেন। একজন বললেন, ‘‘আমাদের বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের পড়ার জন্য এই বইগুলো নগদ চব্বিশ’ টাকা দিয়ে কিনে এনেছি। বলুন ছাত্ররা এই বই পড়তে পারবে? তারা কি কিছু বুঝবে?’’ অন্য প্রধান শিক্ষকের চেহারায় তখনও বিরক্তি রয়ে গেছে। তিনি বললেন, ‘বইগুলো দেখুন, আপনি লেখক মানুষ, আপনিও কিছু বলুন।’

আমি তাদের আনা বইয়ের দিকে মনোযোগ দিলাম। দেখি চার চার আটখানা বই, দুটি বিষয় নিয়ে করা হয়েছে। প্রচ্ছদে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ছবি। বইগুলোর লেখক আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একটি বইয়ের নাম ‘সকলের তরে সকলে আমরা’। এই বইয়ে প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ ও ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত যে ভাষণগুলো দিয়েছেন সেগুলোর বাংলা ও ইংরেজি সংকলন। অপর বইয়ের নাম ‘আহ্বান’। এই বই করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত জাতির উদ্দেশে যেসব ভাষণ দিয়েছেন সেগুলো সংকলিত করে।

দু’খানা বইয়ের-ই কাগজ, ছাপা, বাঁধাই খুবই উন্নত মানের। প্রতি কপি বইয়ের মূল্য ছয়শত টাকা। প্রত্যেকটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লাইব্রেরির জন্য প্রতিটি বইয়ের দুই কপি করে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস বিক্রি করেছে। প্রধান শিক্ষকরা এই বইগুলো কিনে নিতে বাধ্য। চারখানা বইয়ের জন্য প্রধান শিক্ষকদের দুই হাজার চারশত টাকা করে অফিসের সংশ্লিষ্ট ক্লার্কের কাছে পরিশোধ করতে হয়েছে। বুঝতে পারি টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে বলেই এই দুই প্রধান শিক্ষক ক্ষুব্ধ। আমি শিক্ষকদের অনুমতি নিয়েই একটি বিদ্যালয়ের জন্য আনা চারখানা বইয়ের ছবি উঠিয়ে নিলাম। এই সময় কোরাসের কর্ণধার মুজাহিদ আহমদ বললো, ‘ভাই, আমি এমন একখান বই প্রকাশের অনুমতি পেলে কোটিপতি হয়ে যেতাম।’

আমি ওই দুই প্রধান শিক্ষককে উদ্দেশ্য করে বললাম; ‘প্রধানমন্ত্রীর বই প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাচ্ছে, এটাতো আনন্দের বিষয়। কিন্তু আমারও প্রশ্ন হচ্ছে বইগুলো কি প্রাথমিকের ছাত্রছাত্রীদের জন্য উপযোগি? আর প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রিয় এইসব ভাষণ বই আকারে করাটা তো সরকারি খরচেই হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, উচ্চ বিদ্যালয় ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লাইব্রেরিগুলোতে দিতে হলে বিনামূল্যে দেওয়ার কথা। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ সংকলন টাকার বিনিময়ে কিনতে হবে কেনো?’

তখন একজন বললেন; ‘ভাই, এই বই রাষ্ট্রিয় ভাবে হয়নি। ব্যবসার জন্য প্রধানমন্ত্রীর আশপাশের এক দু’জন প্রকাশনীর মাধ্যমে প্রকাশ করে আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তারা কোটি কোটি টাকা কামাই করে নিচ্ছেন।’ উনার কথায় আমি বইয়ের প্রথম দিকের পাতা উল্টালাম। ঠিকইতো প্রকাশক ‘জিনিয়াস পাবলিকেশন্স’-এর মো. হাবিবুর রহমান। দু’খানা বইয়েরই গ্রন্থনা ও সম্পাদনা মো. নজরুল ইসলাম, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার (সচিব)। খেয়াল করে দেখলাম বই দু’খানার কপিরাইট শেখ হাসিনা। বুঝতে পারি যে এই বইগুলোর যে রয়্যালিটি আসবে সেটা আমাদের প্রধানমন্ত্রীই পাবেন।

এখন একটা হিসাব করে দেখি। বাংলাদেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৬শ ২০টি। এই বই যখন প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে বাধ্যতামূলক কিনতেই হবে, তা হলে ৪ কপি করে বই বিক্রি হবে উল্লেখিত বিদ্যালয়গুলোতে ২ লাখ ৬২ হাজার ৪শ ৮০ কপি। এই বইয়ের মূল্য থেকে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের হাতে টাকা আসবে ১৫ কোটি ৭৪ লাখ ৮৮হাজার। বইয়ের কপিরাইট অনুযায়ী শতকরা ১৫ ভাগ রয়্যালিটি নিলেও আমাদের প্রধানমন্ত্রী পাবেন ২ কোটি ৩৬ লাখ ২৩ হাজার ২শ টাকা। হিসাবে কিন্তু আমার মাথা ঘুরে গেছে। বই থেকে এমন অঙ্কের রয়্যারিটি এদেশে আগে কেউ পেয়েছেন কি না আমি জানি না।

আর এটাতো আমি কেবল প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বিক্রির হিসাব দিলাম। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লাইব্রেরির জন্য যখন বাধ্যতামুলক করা হয়েছে, তবে তো উচ্চ বিদ্যালয়, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়েও এই বইগুলো এভাবেই বিক্রি হবে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যুক্ত করলে আরো কতো কতো হাজার বেড়ে যাবে। আমি হিসাব বাড়ালে অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারি।

আমার ঘরেও একজন প্রধান শিক্ষক আছেন। লেখাটার পূর্ণতার জন্য তার কাছে কিছু তথ্য জানতে চেয়েছিলাম। তিনি খ্যাক্ করে উঠে বললেন, ‘স্কুল আমি চালাই। আমার স্কুলের জন্য কখন কি ভাবে কি কিনবো না কিনবো সেটা তোমাকে বলবো কেনো?’ দেখলাম ঘাটাতে গেলে আবার কি থেকে কি হয়ে যায়। তাই কথা না বাড়িয়ে লেখা শেষ করার দিকেই মনোযোগ রাখলাম।

আমরা যারা লেখক আমাদের মধ্যে একটা কথা প্রচলিত আছে যে, প্রকাশকরা লেখকদের ঠকান। তারা ঠিক মতো লেখকের পাওনা রয়্যালিটি পরিশোধ করেন না। তাই বলে কি প্রধানমন্ত্রীকে ‘জিনিয়াস পাবলিকেশন্স’-এর মো. হাবিবুর রহমান ঠকানোর সাহস করবেন? নিশ্চয় না। এই ভরসাতেই বলতেই পারি বই বিক্রির অর্থে আমাদের লেখক শেখ হাসিনা কোটিপতি হবার পথে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, ছড়াকার

ইমেইল: [email protected]

;

দশ টাকার শোক



মনি হায়দার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

প্রায় পনেরো মিনিট ধরে মানিব্যাগটা উল্টেপাল্টে দ্যাখে রজব আলী।

মানিব্যাগটা খুব পছন্দ হয়েছে তার। বিশেষ করে মানিব্যাগটার বাদামি রংটা। ব্যাগটা চামড়ার তৈরি। রজব আলী নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শোকে। বোঝা যায় না কোন্ পশুর চামড়ায় মানিব্যাগটা তৈরি হয়েছে। মানিব্যাগটার ভেতরে অনেকগুলো ছোট ছোট কুঠরি। রজব আলী কল্পনায় দেখতে পায়- মানিব্যাগটার ভিতরে রাখা টাকায় ভেতরের কুঠুরিগুলো ভরে উঠেছে।

ব্যাগটা প্যান্টের পকেটে নিয়ে যখন হাঁটবে পিছটা ফুলে যাবে, মুহূর্তেই শরীরের কোষে কোষে একটা অন্যরকম অহমিকা অনুভব করে সে।

ভাই, মানিব্যাগটার দাম কতো ? রজব আলী মানিব্যাগঅলাকে জিজ্ঞেস করে।

ব্যাগঅলা রজব আলীর উপর মনে মনে চটে উঠেছে। সেই কতোক্ষণ থেকে ব্যাগটা উল্পেপাল্টে দেখছে। কেনার কথা বলছে না। অথচ রজব আলীর দেখার মধ্যে দুটো ব্যাগ সে বিক্রি করেছে। ফুটপাতের জিনিস এতক্ষণ নাড়াচাড়া কেউ করে না। ব্যাগঅলা রাগ করে কিছু বলতেও পারে না। যদি কেনে ?

আপনি নেবেন ? রজব আলীর দাম জিজ্ঞাসায় ব্যাগঅলা পাল্ট প্রশ্ন ছোড়ে। কারণ রজব আলীকে দেখে তার মনে হয় না এই লোক মানিব্যাগ কিনবে।

রজব আলী একটি বহুজাতিক কোম্পানির অফিসের পিওন। পরনের পোশাকে ঐ বহুজাতিক কোম্পানির পরিচয় আছে। ব্যাগঅলার ধারণা এইসব লোকজন সাধারণত মানিব্যাগ-ট্যাগ কেনে না। তাদের সামান্য টাকা আয়, কোনোভাবে সেই পয়সায় মানিব্যাগ কেনার মানসিকতা বা প্রয়োজনীয়তাও থাকে না।
নেবো।

ইতোমধ্যে ব্যাগঅলার সামনে দামি প্যান্টশার্ট পরা একজন ভদ্রলোক এসেছে। সঙ্গে তন্বী তরুণী। তাদের আসায় চারপাশের আবহাওয়ায় বিদেশী সেন্টের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। ভদ্রলোকের কাছে রজব আলী অযাচিতভাবে হেরে যায়। বাস্তবতার কারণে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়াতে হয় তাকে।

তন্বী তরুণী ও ভদ্রলোক মিলে কয়েকটা মানিব্যাগ দেখে। বাছাই করে। অবশেষে তন্বীয় কথানুযায়ী ভদ্রলোক তিনশো পঁচিশ টাকায় একটা মানিব্যাগ নিয়ে চলে গেলো। মাত্র তিন-চার মিনিটের মধ্যে তারা মানিব্যাগ দেখলো, দাম করলো, কিনলো এবং চলেও গেলো। অথচ রজব আলী বিশ-পঁচিশ মিনিচের মধ্যে মধ্যে দামটাও জানতে পারলো না ! তারা চলে যাওয়ার পর রজব আলী ব্যাগঅলার কাছে যায়।

বললেন না কতো দাম ?

রজব আলীর দিকে আড়চোখে তাকায়, মানিব্যাগ আপনার পছন্দ হয়েছে?

পছন্দ না হলে দাম জিজ্ঞেস করবো কেনো ?

একশো আশি টাকা।

একশো আশি টাকা। রজব আলী মুখ থেকে বিপন্ন শব্দগুলো বের হয়।

বিরক্তি প্রকাশ করে ব্যাগঅলা, অবাক হওয়ার কি আছে? আপনার সামনেই তো দেখলেন তিনশো পঁচিশ টাকায় একটা মানিব্যাগ বিক্রি করেছি। ঠিক আছে আপনি ঐ সোয়াশ টাকাই দেন।
সোয়াশ টাকা একটা মানিব্যাগের দাম ! রজব আলীর বিস্ময় কোনো বাঁধা মানে না।

ব্যাগঅলা বুঝতে পারে রজব আলী এতো টাকায় ব্যাগ কিনবে না। সবাইতো ঐ টাকাঅলা ভদ্রলোক নয়, বেশি দাম-দর না করেই তাদের হাকানো দামেই কিনবে। রজব আলীরা তো মানিব্যাগই কেনে না। সেখানে রজব আলী যে কিনতে এসেছে সেটাই অনেক। ব্যাগঅলা মানিব্যাগ বিক্রি করলেও তার পকেটে মানিব্যাগ থাকে না। নিজের সঙ্গে রজব আলীর সাদৃশ্য দেখতে পায় ব্যাগঅলা। একই কাতারের ঠেলা-গুতা খাওয়া মানুষ তারা। লোকটাকে ঠকিয়ে লাভ নেই। হয়তো অনেক আশা করে সারা জীবনে একবার একটা মানিব্যাগ কিনতে এসেছে।

আপনি সত্যিই কি মানিব্যাগটা কিনবেন ? নরম কণ্ঠে ব্যাগঅলা জানতে চায়।

কিনবো বলেই তো পছন্দ করেছি। দাম জানতে চাইছি।

তাহলে শোনেন ভাই, অনেক্ষণ ধরে আপনি মানিব্যাগটা দেখছেন, ফাইনাল কথা বলে দিচ্ছি, মানিব্যাগটা আপনি আশি টাকায় নিতে পারবেন। আশি টাকার এক টাকা কমেও বিক্রি করবো না।
রজব আলীর এই মুহূর্তে ব্যাগঅলাকে খুব কাছের মানুষ মনে হয়। কোথায় একশো আশি টাকা, সেখান থেকে একশত পঁচিশ এবং সবশেষে পুরো শতকই নেই; কেবল আশি টাকা। সে পকেট থেকে টাকা বের করে দিয়ে মানিব্যাগটা পকেটে রাখে। মানিব্যাগটা পকেটে রাখার সঙ্গে সঙ্গে রজব আলী নিজেকে একজন দামি মানুষ ভাবে। তার পকেটেও অনেকের মতো মানিব্যাগ আছে।

দীর্ঘদিনের একটা আকাক্ষা, একটা স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলো রজব আলীর। মানিব্যাগ কেনার একটা সিগারেট কেনে। সাধারণত সে সিগারেট টানে না। কিন্তু এই মুহূর্তে একটা সিগারেট টানার ইচ্ছে হলো তার। না, কেবল সিগারেটই নয়, একটা ঝাল দেওয়া পানও কিনলো এবং মুখে দিয়ে পরম আয়াসে চিবুতে লাগলো। সিগারেটটা ধরিয়ে পান চিবুতে চিবুতে রজব আলী একটা রিকশায় উঠলো। পর পর তিনটি কাজ সে করলো-যা সে খুবই কম করে। সিগারেট টানা, পান খাওয়া এবং রিকশায় করে বাসায় ফেরা। তার জীবনেএকটুকুই শ্রেষ্ঠ বিলাসিতা। রিকশা ছুটে চলেছে।

রজব আলীর মাথার কোষে, যেখানে স্বপ্ন বিলাসী বা ইচ্ছের রক্তকণিকা থাকে- সেখানে মানিব্যাগ কেনার শখ জাগলো প্রায় মাস তিনেক আগে। সে, অফিসের বড় সাহেবের ব্যক্তিগত পিওন। চা, চিনি, সিগারেট থেকে শুরু করে যা কিছু দরকার সবই আনে রজব আলী। দীর্ঘদিনের চাকরির কারণে সে বড় সাহেবের খুব বিশ্বস্ত ও অনুরাগী। অফিসে প্রতিদিন অনেক মেহমান আসে।

নানান কিসিমের মানুষের আনাগোনা বড় সাহেবের কাছে। এইসব মেহমান আসলেই বড় সাহেব বেল টিপে রুমের বাইরে হাতলবিহীন চেয়ারে অপেক্ষায় থাকা রজব আলীকে ডাকেন। রজব আলী ত্রস্ত খরগোশের মতো ভেতরে ঢোকে। কিন্তু ঢুকেই খরগোশের মতো মাথা উঁচু রাখতে পারে না। কোথাকার কোন এক অদৃশ্য অপরিমেয় শক্তি এসে তার মাথাটাকে নিচু করে দেয়।

তার দাঁড়ানো পর বড় সাহেব বড় অবহেলায়, নিপুণ নৈপুণ্যে, গাম্ভীর্যের কৌশলী পারম্পর্যে অবলীলায় প্যান্টের ডান দিক থেকে মোগল সম্রাটদের ক্ষমতায় মানিব্যাগটা বের করে টেবিলে রাখেন। মেহমানবৃন্দ গভীর অভিনিবেশে বড় সাহেবের কর্মকান্ড দেখতে থাকেন। মানিব্যাগটা টেবিলে রেখেই বড় সাহেব টেবিলের অন্যপ্রান্তে রাখা দামি সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে পরম আদরে রাখেন এবং তৎক্ষণাৎ লাইটার জ্বালিয়ে সিগারেট টানেন আয়েসের সঙ্গে।

সিগারেটে দু’-দিনটি টান দিয়ে দুই ঠোঁটের মাঝখানে আটকে রেখে মানিব্যাগটা তোলেন ডান হাতে। মানিব্যাগটা টাকার কারণে সবসময় পোয়াতি নারীর মতো ফুলে থাকে। বড় সাহেবের মানিব্যাগে টাকাগুলো অধস্তন, পরাধীনভাবে নিবিড় শুয়ে থাকতে পছন্দ করে। একহাজার, পাঁচশ, একশ, পঞ্চাশ টাকার অসংখ্য নোট সাজানো পাশাপাশি। দেখতে কতো ভালো লাগে ! রজব আলী দেখে। দেখেই তার আনন্দ।

বাম হাতে মানিব্যাগটা ধরে ডান হাতের দুই আঙ্গুলে বড় সাহেব বেশ কয়েকটা নোট বের করেন। একটা নোট রজব আলীর দিকে বাড়িয়ে দেন, শীগগির নাস্তা নিয়ে আয়।

রজব আলী বিনয়ের সঙ্গে টাকাটা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। এবং নাস্তার আয়োজনে নিদারুণভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এইভাবেই রুটিন চলছিলো। হঠাৎ মাস তিনেক আগে রজব আলীর মাথায় এই প্রশ্নটা উঁকি দেয়- বড় সাহেবের গাড়ি বাড়ি টাকা মান-সম্মান ক্ষমতা আছে। রজব আলীর কিছুই নেই। কিন্তু একটা মানিব্যাগতো থাকতে পারে। আর যাই হোক বড় সাহেবের মতো মানিব্যাগ থেকে সেও টাকা বের করে বাস কন্ডাকটর, চালের দোকানদার, মাছঅলা, ডালঅলাদের দিতে পারবে।

এই ভাবনা, স্বপ্ন এবং কল্পনার পথ ধরে কয়েকমাস যাবৎ রজব আলী চেষ্টা করে আসছে একটা মানিব্যাগ কেনার। নানা কারণে হয়ে ওঠেনি। বৌয়ের শরীর খারাপ- ডাক্তারের টাকা দেওয়া, ছেলেমেয়েদের স্কুলের বেতন, বই খাতা কেনা- যাবতীয় সাংসারিক কাজের চাপে মানিব্যাগ কেনা সম্ভব হয়নি। আজকে সে বেতন পেয়েছে। এবং সমস্ত চাপ উপেক্ষা করে রজব আলী মানিব্যাগটা কিনেই ফেললো। আসলে কখনো কখনো একটু-আধটু রিস্ক নিতেই হয়। নইলে ছোটখাট স্বাদ-আহ্লাদ পূরণ হবার নয়।

রিকশায় বসেই সে জামার বুক পকেট থেকে বেতনের বাকি টাকাগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে মানিব্যাগে। মানিব্যাগটার পেট ফুলে যায়। হাতে নিয়ে তার দারুণ ভালো লাগে। কিছুক্ষণ হাতে রাখার পর রজব আলী মানিব্যাগটাকে পিছনে প্যান্টের পকেটে রাখে। ঘাড় ঘুরিয়ে সে প্যান্টের পিছন দিকটা ফিরে ফিরে দ্যাখে- কতোটা ফুলে উঠলো ? তেমন না। যেভাবে বড় সাহেবের পিছন দিকটা ফুলে থাকে, সে রকম নয়। রজব আলীর মনটা খারাপ হয়ে গেলো।

রিকশা বাসার কাছে আসলে সে ভাড়া মিটিয়ে নেমে যায়। তার মনের মধ্যে ছোট সুখের একটা ছোট পাখি ডানা মেলেছে। গানের সুর ভাজতে ভাজতে রজব আলী দেড় কামরার স্যাঁতস্যাঁতে বাসায় ঢোকে। সে ঢুকলো সংসারে, তাতে সংসারের কিছু যায় আসে না। সংসারটা তার কাছে সীমাহীন অন্ধগলির মোড়। যেখানে অভাব দারিদ্র ক্ষুধার চাহিদা কুমিরের হা মেলে থাকে, সেখানে তার মতো একজন রজব আলীর আসা না আসায় কিছুই যায় আসে না। রজব আলী স্ত্রী মকবুলা বেগম চতুর্থ সন্তান, যার বয়স মাত্র তিনমাস তাকে মাই খাওয়াচ্ছে।

অন্যান্যরা মেঝেতে জটলা পাকাচ্ছে একটা পুরোনো ক্যারামের গুটি নিয়ে। মকুবলা বেগম ঘাড় ফিরিয়ে রজব আলীকে একবার দেখে আবার মাই দিতে থাকে। রজব আলী কি করবে ভেবে পায় না। সাধারণত বেতন নিয়ে বাসায় ফিরলে তরিতরকারি, চাল, ডাল, লবণ, তেল, সাবান, দুই এক প্যাকেট সস্তা বিস্কুট সঙ্গে নিয়ে আসে রজব আলী। আজকে একবারে অন্যরকম একটা জিনিস এসেছে- যার প্রতি তার নিজের মমতা অনেক। সংসারে অন্যদের প্রতিক্রিয়া কি হবে বুঝতে পারছে না।

শুনছো ? রজব আলী স্ত্রীকে ডাকছে।

কনিষ্ঠতম সন্তানের মুখ থেকে মাই সরাতে সরাতে সাড়া দেয় মকবুলা বেগম, কি ?

একটা জিনিস এনেছি।

মকবুলা বেগম সরাসরি তাকায় রজব আলীর দিকে, কি এনেছো ?

অদ্ভুত একটা হাসি রজব আলীল ঠোঁটে, একটা মানিব্যাগ।

দ্রুত ব্যাগটা বের করে মকবুলা বেগমের হাতে দেয় রজব আলী। ব্যাগটা হাতে নিয়ে কয়েক মুহূর্ত স্থানুর মতো বসে থাকে মকবুলা বেগম। একবার কোটরের চোখ দিয়ে তাকায় রজব আলীর দিকে। দৃষ্টি ফিরিয়েই ব্যাগটা অবহেলায় রেখে দেয় সে, মানিব্যাগ ফুটাতে কে বলেছে তোমাকে! বেতন পেয়েছো আজ না ?

বেতন পেলে আর মাথা ঠিক থাকে না। মকবুলা বেগমের লং প্লে রেকর্ড বাজা আরম্ভ হলো, বাসায় কিছু নাই। অফিসে যাবার সময় বললাম, ফিরে আসার সময় ছোট বাচ্চাটার জন্য এক কৌটা দুধ এনো। বড় ছেলেটার খাতা পেন্সিল নেই- নিয়ে এসো। তার কোনো খবর নেই। উনি নিয়ে এলেন মানিব্যাগ। ছেলেমেয়ে বৌয়ের মুখে তিন বেলা ভাত জোটাতে পারে না, উনি মানিব্যাগ কিনে ভদ্দরলোক হয়েছেন! কানার আবার স্বপ্ন দেখার শখ!

রজব আলীর মন শরীর স্বপ্ন আকাক্ষাগুলো শাঁখের করাতে কাটছে এখন। হায়, সংসারের জন্য ব্যক্তিগত দুই-একটা স্বপ্নও কি পূরণ করা যাবে না ! সকাল থেকে রাত পর্যন্ততো সংসারের সুখের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। সামান্য একটা মানিব্যাগের জন্য স্ত্রী এমনভাবে শ্লেষের কথা বলে-একেক সময় মনে হয় রজব আলী আত্মহত্যা করে। পারে না।

স্ত্রীর শান দেওয়া কথার বান থেকে আপাতত রক্ষা পাবার জন্য না খেয়ে বাইরে চলে আসে রজব আলী। এভাবেই সে অক্ষমতার জ্বালা, বেদনা ও ক্ষরণকে তাড়িয়ে থাকার চেষ্টা করে। রাস্তায় দোকানে এখানে সেখানে ঘন্টাখানেক ঘোরাঘুরি করে আবার মকবুলা বেগমের সংসারেই ফিরে আসে। পরের দিন রজব আলী যথারীতি অফিসে।

অফিসের লোকজনের কাছে মানিব্যাগটা দেখায়। কেউ দেখে, কেউ আগ্রহবোধ করে না।

বল তো বারেক, অফিসের আরেকজন পিওনকে ডেকে জিজ্ঞেস করে রজব আলী- মানিব্যাগটা কেমন হয়েছে ?

বারেক মানিব্যাগটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে- ভালো। খুব ভালো হয়েছে। কতো টাকায় কিনেছো ?
প্রচ্ছন্ন গর্ব রজব আলীর, তুই বল।

আমি কেমনে বলবো ?
অনুমানে।
বারেক কয়েক মুহূর্ত ভেবে বলে, ত্রিশ-চল্লিশ টাকা।

তোর বাপের মাথা! ধমকে ওঠে রজব আলী। এ রকম একটা মানিব্যাগ জীবনে চোখে দেখেছিস ? কেমন রং এটার ! ভেতরে কতোগুলো ঘর আছে জানিস ! একহাজার, পাঁচশ, একশো, পঞ্চাশ টাকার নোট রাখার আলাদা আলাদা জায়গা আছে। তাছাড়া এই ব্যাগটা বিদেশী। দেশী না।

তোমার মানিব্যাগের যতো দামই থাক, তুমি বাপ তুলে কথা বলবে ? বারেকের আত্মসম্মানে সামান্য ঘা লাগে।

বলবো না, হাজার বার বলবো। এতো শখ করে একশ টাকা দিয়ে একটা মানিব্যাগ কিনলাম। আর তুই কিনা বলিস মাত্র ত্রিশ-চল্লিশ টাকায় কিনেছি ! জানিস, এই রকম মানিব্যাগ আছে আমাদের বড় সাহেবের।

হতেই পারে। আমার তো মানিব্যাগ নেই। কখনো ছিলোও না। তাই দাম জানি না। কিন্ত তুমি একটা একশো টাকা মানিব্যাগে জন্য বাবা তুলে কথা বলতে পারো না-

বারেক যখন মানিব্যাগ সংক্রান্ত তর্কে হেরে যাচ্ছিলো, তখনই বড় সাহেব অফিসে ঢোকেন সঙ্গে কয়েকজন বন্ধু মেহমান নিয়ে। বারেক চট্ করে সরে যায়। রজব আলী দ্রুত দরজা খুলে দাঁড়ায়। বড় সাহেব সঙ্গীদের নিয়ে রুমে ঢোকেন। রজব আলীকে চা আনতে বলেন বড় সাহেব। শুরু হয় রজব আলীর দৌড়।

কয়েকদিন পর বড় সাহেব অফিসে কয়েকজন ক্লায়েন্টের সামনে বসে রজব আলীকে ডাকেন, রজব আলী?

জ্বী স্যার ?
তোমার হয়েছে কি ?

রজব আলী ভেবে পায় না তার কোথায় কখন কি হয়েছে ? ডানে বামে উপরে নিচে তাকায় সে, কই স্যার-কিছু হয় নাইতো।
তোমার হাতে মানিব্যাগ কেনো ?

এই কথার কি জবাব দেবে রজব আলী? হঠাৎ মগজের কোষ কোনো কাজ করে না। সে বুঝে উঠতে পারে না- তার হাতে মানিব্যাগ থাকলে বড় সাহেবের অসুবিধা কি ? কক্ষের সবাই রজব আলীর দিকে চেয়ে আছে। এক অনিশ্চয়তার মুখোমুখি। হঠাৎ রজব আলী উপলব্ধি করতে পারে- মানিব্যাগটা থাকার কথা প্যান্টের পকেটে। হাতে নয়। এবং তার আরো মনে পড়লো মানিব্যাগটা কেনার পর থেকে, বিশেষ করে অফিস করার সময় মানিব্যাগটা কারণে-অকারণে তার হাতেই থাকে। কেন থাকে ?

সে কি সবাইকে তার সদ্য কেনা মানিব্যাগটি দেখিয়ে তৃপ্তি পেতে চায় ? যা প্রকারান্তরে অক্ষম অথর্ব মানুষের করুণ মনোবিকৃতি ? নিশ্চয়ই তার অবস্থা দেখে বড় সাহেব, তার পরিষদবর্গ, অফিসের লোকজন হাসছে। রজব আলী নিমিষে নিজেকে বায়ুশূন্য ফাটা একটা পরিত্যাক্ত বেলুন হিসাবে নিজেকে আবিষ্কার করে। লজ্জায় বালুর সঙ্গে সে মিশে যেতে চাইছে। কিন্তু মানুষের পক্ষে মুশকিল হচ্ছে- সে ইচ্ছে করলেই বালু বা বায়ুর সঙ্গে মিশে যেতে পারে না। মানুষ হিসাবে তাকে অনড় ও অবিচল থাকতে হয়।

বড় সাহেবের মুখে অদ্ভুত হাসি- রজব ?

জ্বী স্যার ?
মানিব্যাগটা কবে কিনেছো ?

রজব আলী জবাব দেয় না। দিতে পারে না। ভেতরের কে একজন যেন রজব আলীকে থামিয়ে দিয়েছে। যে রজব আলীর ওষ্ঠ জিহ্বা কণ্ঠ ভেতরের ক্ষুধিত শক্তিকে পাথর বানিয়ে জমাট করে রেখেছে। প্রাণপণে চেষ্টা করছে কথা বলতে। পারছে না। সে মাথাটা নিচু করে দাঁড়িয়ে। কথা বলছো না কেন ? বড় সাহেবের কণ্ঠে এখন কর্তৃত্ব ও অপমানের সুর।

ঢোক গিলে জবাব দেয় রজব আলী- কয়েক দিন আগে।

কতো টাকায় ?

একশ টাকা।

তাই নাকি ! দেখি, বড় সাহেব হাত বাড়ান।

রজব আলী সারা জীবনের সমস্ত অভিশাপ নিজের মাথায় ঢালে-কেন সে মানিব্যাগ কিনতে গেলো ? কিনলোই যদি তাহলে পকেটে না রেখে হাতে রাখার প্রয়োজন হলো কেন ? দেখাতে চেয়েছিলো বড় সাহেবকে ? বড় সাহেবের মানিব্যাগ থাকলে পারলে তার থাকবে না কেন ? প্রতিযোগিতা ? কি অসম প্রতিযোগিতা ? কি ভয়ংকর গ্লানিকর পরাজয় !

কই দাও, বড় সাহেবের হাতটা তখনো বাড়ানো। নিন।

রজব আলী ব্যাগটা দিয়ে বেরিয়ে যেতে চায়।

কোথায় যাও? তোমার মানিব্যাগ নিয়ে যাও-

আর যেতে পারে না সে কক্ষের বাইরে। কক্ষের ভিতরে রজব আলীর শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। বড় সাহেব মানিব্যাগটাকে উল্টেপাল্টে দেখেন। কক্ষের অন্যান্য সবাই বড় সাহেবের হাতের ব্যাগটাকে তীর্যক চোখে দেখছে। কেউ কেউ হাসছে। সে হাসির ভেতরে লুকিয়ে আছে তীক্ষ্ন কাঁটা। কাঁটায় বিষ। যা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পান করছে রজব আলী। এছাড়া তার উপায়ও নেই।

রজব আলী !

বড় সাহেবের ডাকে চোখ তুলে তাকায় সে, স্যার!

নাও তোমার মানিব্যাগ। ব্যাগটা ভালোই কিনেছো।

হাত বাড়িয়ে ব্যাগটি নিয়ে রজব আলী দরজা খুলে নিমিষে বাইরে চলে আসে। দরজা দ্বিতীয়বার বন্ধ করতে পারে না, তার আগেই বড় সাহেব এবং অন্যান্যদের হাসির ছুরি তীব্র অপমানে রজব আলীর কান এবং মর্মের মূলে আঘাত হানে। মনে হচ্ছে তাদের হাসির হলকা তাকে শান দেয়া ছুরির মতো কাটছে। আর রজব আলী নিজের রক্তে ভেসে যাচ্ছে।

রজব আলী মানিব্যাগ আর হাতে রাখে না। প্যান্টের পকেটেই রাখে। মাস শেষে মানিব্যাগের ছোট্ট খোপে খুচরো কয়েকটা মাত্র টাকা দেখতে পায় রজব আলী। মানিব্যাগে টাকা নেই, একটা পরিত্যাক্ত রুমালের মতো মনে হয় মানিব্যাগটাকে। এবং রজব আলী বুঝতে পারে- বড় সাহেবের মতো মানুষদের সঙ্গে রজব আলীরা কোনদিন, কোনোকালে পাল্লা দিয়ে টিকতে পারবে না।

মাস শেষ, রজব আলীর মানিব্যাগের টাকাও শেষ। অথচ বড় সাহেবের মানিব্যাগে মাসের প্রথম দিকে যতো টাকা ছিলো বা থাকে, এখনো সে রকমই আছে। কমে না। বরং বাড়ে। তাহাদের টাকা বাড়তেই থাকে। বাড়বে আমৃতকাল।

দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে রজব আলী।

দীর্ঘনিঃশ্বাস এবং পুঞ্জিভূত ক্ষোভ নিয়ে নিত্যদিনের স্বাভাবিক জীবনযাপন চালিয়ে যাচ্ছে রজব আলী। প্রতিদিনের জীবনাচারের সঙ্গে রজব আলী বেশ মানিয়ে নিয়েছে। মানিব্যাগটা তার সঙ্গে থাকছে প্রতিদিনকার মতো- যেমন তার পকেটে থাকছে একটি রুমাল, একটি চিরুনি।

মাসের প্রথম দিকে মানিব্যাগটা ভরা থাকে, মাঝখানের দিকে কমতে কমতে টাকা অর্ধেকেরও কমে এসে পৌঁছে এবং এই কমার গতিটা বলবৎ থাকে গাণিতিক হারে।

মাসের শেষের দিকে রজব আলী মানিব্যাগ বহন করার আর কোন যুক্তি খুঁজে পায় না। কারণ ব্যাগের তলায় পাঁচ-দশটা টাকা পড়ে থাকে বড় অযত্নে, বড় অবহেলায়। কখনো কখনো রজব আলীর মনে হয়- মানিব্যাগটা বোধহয় তাকেই উপহাস করছে। মাস খানেক পরে একদিন।

রজব আলী অফিস থেকে ফিরছে। মাস শেষের দিকে। বাসে প্রচুর ভিড়। বাসে ওঠা মানে জন্তুর খাঁচায় ওঠা। জীবন যে কতো অবাঞ্ছিত, বাসে উঠেই সেটা বুঝতে পারে রজব আলী।

বাস থেকে নেমেই হাত দেয় প্যান্টের পকেটে। পকেটটা খালি, বুকটা ধড়াস ধড়াস করে, মানিব্যাগটা নেই ! এতো সাবধানে থাকার পরও মানিব্যাগটা নিয়ে গেলো?

রজব আলী কয়েক মুহূর্ত স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। মানিব্যাগটা পকেটমার নিয়ে গ্যাছে। রজব আলী মানিব্যাগটার জন্য ভাবছে না। ভাবছে মানিব্যাগের সর্বশেষ পুরোনো ময়লা দশটি টাকা...। ওই দশ টাকা থাকলে আরো দুই দিন বাস ভাড়া দিয়ে অফিসে আসা-যাওয়া করতে পারতাম।

;