কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ৪)
ঈশ্বর আমাদের হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন
[পূর্ব প্রকাশের পর] প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের জাতীয় সংসদ অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করার ঘোষণায় যেন বারুদে অগ্নিসংযোগ করা হলো। সংঘর্ষ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা আর আগুন ছড়িয়ে পড়ল সারা শহরে।
এক রাতে আমাদের গির্জার এক পুরোহিত আরেকটি গির্জাপরিবারের জন্য বিছানা, বালিশ, কাঁথা ইত্যাদি চাইতে এলো। তিনি আমাদের বলেন যে, বোমা আর মলোটোভ ককটেল বানানোর সময় বিস্ফোরণে তাদের পাহাড়ের পুরো ওপরের অংশটা জ্বলেপুড়ে গিয়েছিল।
পাকিস্তানি সেনারা ’দুর্বৃত্তদের’ (যারাই তাদের বিরোধিতা করত তাদেরকেই তারা দুর্বৃত্ত আখ্যা দিত) কব্জা করার জন্য অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। পাকিস্তানিরা স্বীকার করে যে, হাঙ্গামা থামাতে গিয়ে তারা ১৭২ জন মানুষকে হত্যা করতে বাধ্য হয়েছিল। লন্ডন অবজার্ভার পত্রিকার ঢাকা প্রতিনিধি অবশ্য এই সংখ্যাটিকে কেবল ঢাকা শহরেই ২০০০ বলে উল্লেখ করেন।
এইসব প্ররোচনা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা ঘোষণা করা থেকে বিরত থাকে। বরং, ৭ই মার্চ, জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেন। তিনি জনসাধারণকে আহ্বান করেন কেন্দ্রীয় কোষাগারে কোনো খাজনা কিংবা কর জমা না দিতে এবং কোনোভাবেই সেনাবাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা না করতে। তিনি রক্তপাত ও হত্যাযজ্ঞ থামানোরও আদেশ দেন। বাঙালি ও বিহারিদের মধ্যেকার দাঙ্গা ও সংঘর্ষ থামানোর জন্য তিনি এমনকি এটাও ঘোষণা করেন যে, “বাংলাদেশের অধিবাসী সবাই বাঙালি।”
দাঙ্গা এক পর্যায়ে থামে। ক্ষমতাসীনদের বিরোধিতায় পুলিশ কাজে যেতে অস্বীকার করলেও, অইনশৃঙ্খলা বজায় থাকে এবং রাস্তায় যানবাহনের চলাচল অব্যাহত থাকে।
ইয়াহিয়া খান ২৫শে মার্চকে জাতীয় সংসদ অধিবেশন বসার তারিখ হিসাবে নির্ধারণ করেন। শেখ মুজিব তাঁর অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা প্রদানে নিম্নোক্ত শর্তাবলি আরোপ করেন:
• সামরিক শাসন রদ করতে হবে।
• সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরে যেতে হবে।
• দেশের প্রধান শহরগুলোতে সামরিক বাহিনীর হাতে বাঙালি হত্যার তদন্ত করতে হবে।
• নবনির্বাচিত সাংসদদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
অসহযোগিতা আন্দোলন কার্যত দেশের বেসামরিক শাসনভার শেখ মুজিবের হাতেই অর্পণ করে, যদিও তিনি পাকিস্তানের অখণ্ডত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন তখনও, যা পূর্ব পাকিস্তানে অব্যাহত সেনা মোতায়েন সত্ত্বেও, বিভিন্ন আলাপ-আলোচনায় ও মধ্যস্থতাসভায় তাঁর অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রতিভাত হচ্ছিল। অবশ্য সার্বিক পরিস্থিতির পর্যালোচনায় এটা প্রতীয়মান ছিল যে, এইসব শান্তিআলোচনা স্রেফ লোকদেখানো ছিল; একটা সর্বাত্মক সামরিক দমনপীড়ন চালানোর জন্য যথেষ্টসংখ্যক সৈন্য আনতেই আসলে এই অপ্রয়োজনীয় সময়ক্ষেপণ।
মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমাদের বার্ষিক ফিল্ড কাউন্সিল মিটিংয়ের সময় আমরা অনেকটা সময় ব্যয় করি আপৎকালীন সময়ের নানাবিধ পরিকল্পনা করে।
আমাদের মিশনটি দলগত কাজে বিশ্বাস ও তার চর্চাও করে। আমরা যে-কোনো সমস্যা বা পরিস্থিতিতে একটা সম্মিলিত সিদ্ধান্তে না পৌঁছানো পর্যন্ত তার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকি। তবে এটা ছিল একেবারেই ভিন্ন পরিস্থিতি। অমরা অনুভব করি যে, দেশে থাকা কিংবা দেশত্যাগ করার সিদ্ধান্তটি সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তি কিংবা পরিবারের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত; কাউকেই থাকার জন্য জোর করা হবে না, আবার কেউ চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলে তাকেও পালিয়ে যাবার অপবাদ দেওয়া হবে না।
মালুমঘাট হাসপাতালের বিশাল মিশনারিদল নৌকা করে সাগরে গিয়ে অপেক্ষমাণ উদ্ধারকারী সমুদ্রগামী জাহাজের মাধ্যমে, অথবা প্রতিবেশী দেশ বার্মার ভেতর দিয়ে জরুরি নির্গমনের কথাও ভেবে রাখে।
আমরা যারা চিটাগাংয়ে বসবাসকারী বিদেশি নাগরিকগোষ্ঠীর সদস্য ছিলাম তাদের কাছে এই মর্মে চিঠি আসে, আমরা যদি দেশত্যাগ করতে ইচ্ছুক হই, তাহলে যেন একটি নির্দিষ্ট পাহাড়শীর্ষে অবস্থিত চত্বরে গিয়ে রাজকীয় বিমানবাহিনীর বিমানের জন্য অপেক্ষা করি।
২১শে মার্চ, রবিবার রাতে আমরা চিটাগাংয়ের কর্মীরা একত্রিত হই আমাদের পরিকল্পনাবিষয়ে আলাপ আলোচনা করার জন্য। আর কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই গুর্গানস পরিবারের ছুটিতে যাবার কথা ছিল। তাঁরা যুক্তি দেখান যে, এই প্লেনটা ধরাই তাঁদের জন্য সবচেয়ে ভালো হবে। জিন গুর্গানস চলে গেলে রিড মিনিখই হবেন মিশনের একমাত্র পুরুষ সদস্য—ফলে তাঁর যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। লিন সিলভারনেইল, যার সঙ্গে আমি শহরের কেন্দ্রস্থলে একটি বাসা ভাড়া করে থাকতাম, এবং আমি, আমরা কেউই বাক্সপ্যাটরা বেঁধে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেওয়ার তাড়না বোধ করিনি। আমরা তিনজন তাই থাকার পক্ষে ভোট দিই।
২৩শে মার্চ—পাকিস্তান দিবস! সরকারিভাবে এই দিনটি ছিল পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা ও অগ্রযাত্রা উদযাপনের জন্য নির্ধারিত, তবে এবার তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে নিহতদের স্মরণ করাটাও। বাংলাদেশের লাল, সবুজ আর সোনালি রঙের জাতীয় পতাকাখানি সেদিন শহরের সব বাড়ি, দোকানপাট ও গাড়িতে গাড়িতে উড়ছিল। কেবল ঢাকা বেতারকেন্দ্র আর সরকারি দপ্তরগুলোতে ছিল চাঁদতারার সমাহার।
পাকিস্তানের অখণ্ডতাকে অটুট রাখার লক্ষ্যে ওই একই দিনে এম ভি সোয়াত নামে একটি পাকিস্তানি জাহাজ প্রাণসংহারী অস্ত্রশস্ত্রে বোঝাই হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করে। অস্ত্রবাহী জাহাজ ভেড়ার খবরটা দ্রুত শহরময় চাওর হয়ে যায়, আর লোকজন ক্ষোভে ফেটে পড়ে। উৎপাটিত বৃক্ষ, আলকাতরার খালি ড্রাম, সিমেন্টের চাঙর, পরিত্যক্ত গাড়ি—হাতের কাছে যা পাওয়া গেছে তা-ই রাস্তায় ফেলে সৈন্য ও অস্ত্রসমূহ ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়ার পথে ব্যারিকেড দেওয়া হয়। হাজার হাজার বাঙালি লাঠিসোটা নিয়ে বন্দর অভিমুখে যাত্রা করে অস্ত্রখালাস ঠেকানোর উদ্দেশ্যে। এটা বাস্তবিক একটি শোচনীয় দৃশ্য ছিল—এমন বিপুল সাহস পাশাপাশি প্রস্তুতি ও শৃঙ্খলার এমন সামগ্রিক অভাব!
শেখ মুজিবের আদেশে বন্দরশ্রমিকেরা অস্ত্র খালাস করতে অস্বীকার করলে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের এই কাজ করতে বাধ্য করা হয়। “যে-কোনো মূল্যে এই অস্ত্র খালাস করতেই হবে,” পশ্চিম পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ারেকে এই কথা বলতে শোনা গিয়েছিল। আর সেই মূল্য শোধ করা হয়েছিল বৈকি—বাঙালির রক্তে। সেদিন বন্দরে কত মানুষ মারা গিয়েছিল আর কতজন আহত হয়েছিল তার সংখ্যা কেউ কোনোদিন জানবে না।
জাহাজের ক্যাপ্টেন নিজেই ছিলেন বাঙালি। তিনি তাঁর নিজের মানুষেরই ধ্বংস বয়ে আনছেন তাঁর জাহাজে করে এই ভাবনা তাঁকে নিশ্চয়ই তাড়া করে ফিরছিল সর্বক্ষণ! বন্দরে পৌঁছানোর পর তিনি নিজেকে তাঁর কামরার শৌচাগারে আটকে রাখেন। তিনদিন পর বন্দরে সমাগত জনতার করুণার ওপর নিজেকে ছেড়ে দিয়ে তিনি বলেন, “আসুন, যদি চান, আমাকে হত্যা করুন আপনারা।” বন্ধুরা তাঁকে উদ্ধার করে যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিরাপদে লুকিয়ে রাখেন।
২৬শে মার্চ সকালে জেগে উঠে আমরা শুনি চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবের ডাকা অসহযোগ আন্দোলনের প্রসঙ্গে এই দিনটিকে উল্লেখ করা হচ্ছিল, “সংগ্রামের গৌরবময় পঁচিশতম দিন” হিসাবে। আমরা যা জানতাম না, এবং জানিনিও আরো বহু সপ্তাহ ধরে যে, ঢাকায় সেই ‘গৌরবময় সংগ্রাম’-এর ইতি হয়েছিল—অন্তত সাময়িকভাবে। টাইম ম্যাগাজিনের ৫ই এপ্রিলের সংখ্যায় ২৫শে মার্চের রাতটিকে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছিল:
ঢাকায় ট্যাংক ও ট্রাকভর্তি বেয়নেটধারী সৈন্যরা আল্লাহু আকবর ও পাকিস্তান জিন্দাবাদ ধ্বনি দিতে দিতে বেরিয়ে আসছিল তাদের ঘাঁটি থেকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হওয়িৎজার ট্যাংক থেকে ছোড়া কামান ও রকেটের গোলায় ঢাকার একাধিক অঞ্চল কেঁপে উঠেছিল। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের ঝনঝনানির মধ্যে শোনা যাচ্ছিল গ্রেনেডের শব্দ, আর কালো ধোঁয়ার উঁচু স্তম্ভ শহরের মাথা ছাড়িয়ে উঠছিল ক্রমশ।
পরবর্তী সংস্করণ, ১২ই এপ্রিলের টাইম পত্রিকায় আরো বিশদভাবে লেখা হয়।
ঢাকা শহরের ওপর দিয়ে ট্যাংক গড়িয়ে চলে বাড়িঘর গুড়ো করে দিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে সৈন্যরা ঘুমন্ত ছাত্রদের হত্যা করে নির্বিচারে। নিউমার্কেটের সামনে উর্দুভাষী সৈন্যেরা বাঙালি নগরবাসীদের আত্মসমর্পণের হুকুম জারি করে এবং তারা তাতে তিলমাত্র দেরি করলে সঙ্গেসঙ্গে গুলি করে মেরে ফেলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণকবরে, পুরনো ঢাকায় এবং মিউনিসিপালিটির ময়লার ডিপোতে লাশের স্তূপ পড়ে থাকতে দেখা যায়।
কিন্তু আমরা চট্টগ্রামে এসবের কিছুই জানতে পারিনি। সকাল পৌনে নয়টায় ঢাকা বেতারকেন্দ্র থেকে জাতীয় সংগীত বেজে হঠাৎ করেই তা বন্ধ হয়ে যায়। চট্টগ্রাম কেন্দ্র থেকে কেবল রেকর্ড করা গান শোনা যাচ্ছিল।
আমাদের বন্ধু মিস্টার ও মিসেস টমাস দাশ সেদিন বেড়াতে এসেছিলেন। প্রাক্তন স্কুলশিক্ষয়িত্রী মিসেস দাশ ছিলেন লিন সিলভারনেইলের দেশি সহকর্মী। লিন, একজন নার্স, যে ভাষাতত্ত্বের প্রাথমিক জ্ঞান আয়ত্ত করেছিল, গত চারবছর ধরে বাইবেল অনুবাদ করছিল। সে মূল গ্রিক থেকে নিউ টেস্টামেন্টের বিভিন্ন পুস্তকের সহজ ইংরেজি সংস্করণ তৈরি করছিল। মিসেস দাশ ছিলেন তার বাঙালি সহযোগী। লিনের ইংরেজি অনুবাদ অবলম্বনে তিনি বাংলা নিউ টেস্টামেন্টের প্রথম খসড়া রচনা করছিলেন।
তবে মিসেস দাশ কাজ করতে আসেননি। তিনি এবং তাঁর দেবতুল্য স্বামী আমাদেরকে আসন্ন বিপদ সম্পর্কে সাবধান করতে এসেছিলেন। আমরা একসঙ্গে আলোচনা করি, গান গাই ও প্রার্থনায় যোগ দিই। মিসেস দাশ আমাদেরকে একটি নতুন গান শেখান, চমৎকার এক ভারতীয় সুরে গাঁথা এই গানখানি:
হে যিশু, তুমি আমার;
আমার জীবন বাঁচাও হে যিশু।
পাপী যারা তারা তাঁর কাছে যাবে;
প্রভু আমাকে ত্রাণ দাও।
নদী গভীর, নৌকা ছোটো,
প্রভু পার করো আমায়।
তোমাতেই জয়ী আমি,
এসো প্রভু, আমাকে শক্তি দাও।
আমাদের সবারই প্রভুর দেওয়া শক্তি দরকার, কেননা নদী ছিল গভীর আর নৌকাখানি ছোট।
বন্ধুরা থাকতে থাকতেই আমরা রেডিয়ো খুলি রাত দশটার খবর শুনব বলে। তার পরিবর্তে আমরা সামরিক শাসনের পনেরোটি নির্দেশনার ঘোষণা শুনি। তার মধ্যে ছিল:
পাঁচজনের বেশি মানুষ একসঙ্গে জমায়েত হতে পারবে না।
কোনো রাজনৈতিক সভা করা যাবে না।
সেনাদপ্তরে সকল অস্ত্র জমা দিতে হবে।
সকল ছাপা কিংবা অনুলিপি করার যন্ত্রও সেনাদপ্তরে জমা দিতে হবে।
সবাইকে দ্রুত কাজে যোগ দিতে হবে। ইত্যাদি, ইত্যাদি।
এই নির্দেশগুলো যখন আমরা ইংরেজিতে অনুবাদ করছিলাম তখনও বাইরে রাস্তায় বাঙালিদেরকে প্রতিবাদ করতে শুনছিলাম। দাশদম্পতি তাড়াতাড়ি বিদায় নেন নিরাপদে বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য। তাঁরা চলে গেলে আমরা গাড়ি রাখার জায়গাটায় তাকিয়ে দেখি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আমলের পুরনো ট্রাকের ওপর লোকেরা জড়ো হচ্ছে। লাঠিসোটা হাতে তরুণে ঠাসা ট্রাকগুলো বেরিয়ে যাবার সময় চারপাশ জয়বাংলা ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। সেই চিৎকৃত জয়ধ্বনির জন্ম হয়ে গিয়েছিল নয় মাস আগেই।
রিড তাঁর কোনার বাড়ি থেকে হেঁটে আসেন আমাদের ঘরে। “তোমরা সবশেষ নির্দেশগুলোর কথা শুনেছো?” তিনি জিজ্ঞেস করেন। “এসব কিন্তু ভালো মনে হচ্ছে না।”
“আপনি যদি আমাদের এখানে থাকেন তাহলে আমরা একটু নিরাপদ বোধ করব।” আমি কবুল করি।
“ঠিক আছে, আমি কিছুদিনের জন্য থাকব, কিন্তু আমার পক্ষে তো অনির্দিষ্টকাল ধরে থাকা সম্ভব নয়।” তিনি জবাব দেন।
সেই শুক্রবার রাতে আটটা বাজার আগে আগে আমরা রেডিয়ো খুলি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের জাতির উদ্দেশে ভাষণ শোনার জন্য।
হঠাৎ রাস্তায় আমরা একটা জোরালো গুঞ্জনের শব্দ শুনতে পাই। আমরা ভেবেছিলাম এটা আরো বুঝি নতুন কোনো নির্দেশ প্রচার-করা লাউডস্পিকারের শব্দ। বারান্দা দিয়ে দেখি, যে-বাড়িতেই রেডিয়ো রয়েছে তার সামনে লোকের জটলা। আমরা আমাদের রেডিয়োর ডায়াল ঘোরাই যতক্ষণ না বাইরের রেডিয়োগুলোর শব্দের সঙ্গে আমাদেরটা মিলেমিশে এক হয়ে যায়। তখন আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণার কথা শুনতে পাই।
তিনি জনগণের উদ্দেশে বলছিলেন: “আপনাদের হাতে যাকিছু অস্ত্র আছে তা নিয়েই ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসুন। যে-কোনো মূল্যে শত্রুর মোকাবিলা করুন, এদেশের পবিত্র মাটি থেকে শেষ শত্রুটিও নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত।”
আমরা জানতাম না যে, এটা ছিল একটা পূর্বে ধারণকৃত টেপ। কারণ এর আগের রাতেই, আলাপ আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর, মধ্যরাতে ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করেন। অনেক পরে আমরা একটা গুজব শুনেছিলাম যে, সেদিন তার মালামালের সঙ্গে একজন রাজনৈতিক বন্দীকেও বহন করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তিনি আর কেউ নন, শেখ মুজিবুর রহমান।
ঠিক সময়েই ইয়াহিয়া তাঁর ভাষণ শুরু করেন। কিছু ভূমিকা সেরে তিনি শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার শুরু করেন।
“এই লোকটি ও তার দল পাকিস্তানের শত্রু। এই অপরাধকে আমরা বিনা শাস্তিতে যেতে দেব না। আমরা কিছু ক্ষমতালোলুপ, দেশদ্রোহী গোষ্ঠীকে আমাদের দেশটিকে ধ্বংস করে দিয়ে এর ১২ কোটি লোকের ভাগ্য নিয়ে খেলতে দেব না।”
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবকে একজন বিশ্বাসঘাতক বলেন। তিনি বলেন যে, তিনি নিজে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানে আসতে চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু মুজিব যুক্তির কথা শুনতে সম্মত ছিলেন না। তিনি তখন পুরো আওয়ামী লীগকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। (এটার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে, নিক্সন নির্বাচনে জয়ী হওয়াতে তাঁর রিপাবলিকান পার্টিকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা।)
আমি রাত এগারোটার দিকে শোয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম যখন ভয়েস অভ আমেরিকা খবরে বলে, “শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানকে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করেছেন এবং তার নামকরণ করেছেন বাংলাদেশ।” [চলবে]
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ৩)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ২)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১)