আমেরিকান চলচ্চিত্রে বর্ণ-বিদ্বেষ
ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের শার্লটসভিলে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের মিছিলের ঠিক বছর এক পরে, ২০১৮ সালের আগস্টের ১০ তারিখে, স্পাইক লি’র সিনেমা ‘ব্ল্যাকক্ল্যান্সম্যান’ প্রথমবারের মতো প্রদর্শিত হয়েছিল আমেরিকায়। সিনেমাটির অন্তিম পরিণতিমূলক কিছু দৃশ্যে অনুনাদ পাওয়া যায় ডি. ডব্লিউ. গ্রিফিথের সম্পাদনা স্টাইলের, যিনি কোনো দৃশ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করতে গল্পের উপাদানসমূহের মধ্যে ক্রস-কাটিং কৌশলের প্রবর্তক ছিলেন। একই স্টাইলে লি-ও আগে-পিছে করে দুটি দৃশ্যের মাঝে সমন্বয় ঘটান যেখানে স্বয়ং গ্রিফিথেরই ১৯১৫ সালের সিনেমা ‘দ্য বার্থ অফ আ নেশন’ একটি মুখ্য ভূমিকা রাখে।
একটি দৃশ্যে দেখা যায়; গ্র্যান্ড উইজার্ড ডেভিড ডিউক (টোফার গ্রেইস) কর্তৃক আয়োজিত কু ক্লাক্স ক্লানের ব্রত অনুষ্ঠান সম্পূর্ণতা পাচ্ছে, আধুনিক ক্লান সৃষ্টিতে মদদ দান করা গ্রিফিথের ওই সিনেমার, হৈ-হুল্লোড়ে পূর্ণ একটি প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে। আরেকটি দৃশ্যে দেখা যায়, জেরোমি টার্নার (হ্যারি বেলাফন্তে) ১৯১৬ সালে সংঘটিত, তার বন্ধু জেসি ওয়াশিংটনের আইনবহির্ভূত নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বর্ণনা করছেন ঘরভর্তি আফ্রিকান-আমেরিকান শিক্ষার্থীদের কাছে। টেক্সাসের ওয়াকো শহরে, যেখানে আমি তিন দশক ধরে শিক্ষাদান করেছি, সেই শহরে ১৬ হাজার মানুষের সামনে জেসি ওয়াশিংটনকে নপুংসক করে, পুড়িয়ে, যন্ত্রণাদায়ক এক মৃত্যু দেওয়া হয়েছিল। জেরোমি ‘দ্য বার্থ অফ আ নেশন’ চলচ্চিত্রটিকেই এমন ভয়ঙ্কর, প্রকাশ্য সহিংসতার কারণ হিসেবে উদ্ধৃত করেন। এবং প্রকৃতপক্ষে তেমনটিই ছিল।
এই দুটি দৃশ্যই প্রমাণ করে বর্ণ, সহিংসতা এবং পরিচিতির ধারণা রূপায়ণে বা নববলে বলীয়ান করতে একটি চলচ্চিত্র কতখানি শক্তিধর হয়ে উঠতে পারে। জেমস বল্ডউইন যেমনটি বলেন, “ক্যামেরার ওই ভাষা, আমাদের স্বপ্নের ভাষা।” এবং অবশ্যই, দুঃস্বপ্নেরও ভাষা।
কিন্তু লি-র সিনেমায় আমরা এও দেখি; কিভাবে বাঁধাধরা নিয়মের বিরুদ্ধে চলচ্চিত্র আমাদের ধাক্কা দিতে পারে, শক্তির মুখে সত্য বলতে পারে, এবং ঘৃণার দিকে নয় বরং বোধশক্তির সম্মুখে দর্শককে ধাবিত করতে পারে। যদিও এর গল্প বিন্যস্ত হয়েছে ১৯৭০-এ, কিন্তু শেষ দৃশ্যে ব্ল্যাকক্লান্সম্যান তার সহিংসতা এবং বর্ণবাদের সাথে আমেরিকার দূরবর্তী অতীতের সংযুক্ততা এবং তার (চলচ্চিত্রের) বর্তমানের সাথে আমাদের বর্তমানের সংযুক্ততা স্থাপন করে (যেমনটি সমালোচক অলিভার জোনস লিখেছেন, “হ্যাঁ, এটি একটি পিরিয়ড সিনেমা; কিন্তু বিষয়টি হলো সেই সময় এখন, তখন, সামনে এবং সবসময়ই থাকবে।”)। লি আমাদের এও স্মরণ করিয়ে দেন, সিনেমা ভয়ঙ্কর বার্তা যেমন বহন করতে পারে, তেমনি আশার আলোও দেখাতে পারে।
চলচ্চিত্র এবং অন্যান্য মিডিয়া যে, ধর্মান্ধতা এবং বিদ্বেষ ছড়ানোর একটি শক্তিতে পরিণত হয়েছে, তা আমাদের পরিষ্কার চোখেই দৃষ্টিগোচর হয়। আত্মা বিনাশকারী পুরাকথাগুলো চাইলেই আমরা চিহ্নিত এবং প্রত্যাখ্যান করতে পারি। খুঁজে নিতে পারি আত্মার শুদ্ধি ঘটানো পুরাকথাগুলোকে। বর্ণবিদ্বেষী, বাঁধাধরা বা অতি মামুলি উপাদানগুলো চিনেই আমরা একটি সিনেমা দেখতে পারি; এবং ব্যাখ্যা করার দাবি জানিয়েই আমরা এমন সকল গল্প খুঁজতে পারি, যেগুলো প্রতিটি চরিত্রের বৈচিত্রতা এবং মানবিকতাকে আলিঙ্গন করে।
ব্ল্যাকক্লান্সম্যান সিনেমায় যেমন, তেমন আমাদের ইতিহাসেও, বর্ণ এবং মিডিয়া ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত। গত শতক ধরেই বর্ণবিদ্বেষীরা এই সিনেমা মাধ্যমটিকে ব্যবহার করেছে গৎবাঁধা বিষয়গুলোকে স্থায়ীভাবে জিঁইয়ে রাখতে এবং পক্ষপাতদুষ্ট ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করতে। তারা শ্বেতাঙ্গ বাস্তবতাকেই একমাত্র বাস্তবতা বলে চিত্রিত করেছে। তবে দ্বিতীয় একটি পর্যায় শুরু হয়, যখন চেতনাসম্পন্ন কিছু শ্বেতাঙ্গ চলচ্চিত্রকারেরা বর্ণবিদ্বেষের প্রবৃত্তিকে চিহ্নিত করে এবং তাদের বলা গল্পগুলোতে পরিবর্তনের উপায় অন্বেষণ করে। বাদবাকি শ্বেতাঙ্গ চলচ্চিত্রকারেরা, কালোদের জীবনকে আরো অর্থবহ এবং প্রতিনিধিত্বমূলক উপায়ে চিত্রণের চেষ্টা করতে গিয়ে তৃতীয় একটি পর্যায়ের সূচনা করে।
পরবর্তীকালে, চতুর্থ পর্যায়ে কালোরা নিজেরাই বলতে শুরু করে নিজেদের গল্প এবং রূপায়ণ করতে থাকে নিজেদের জীবনধারা। পঞ্চম ধাপে, হলিউডের চলচ্চিত্রগুলো হালকাভাবে বহুসংস্কৃতির একটি ধারণা প্রদর্শন করে যেখানে বর্ণ সম্বন্ধীয় ভিন্নতাকে অনিবার্য বলে ধরে নেওয়া হয়। অবশেষে আমরা পৌঁছাই ষষ্ঠ ধাপে, যেখানে, ব্ল্যাকক্লান্সম্যানের মতোই, মূলধারার দর্শকদের জন্য কালোরঙের লোকদের দ্বারা নির্মিত সিনেমাগুলো অতীতের ক্ষতিকর সব পুরাকথাকে উল্টিয়ে দিচ্ছে, আমেরিকান সংস্কৃতির বিপদজনক গল্পগুলোকে অস্বীকার করছে। এমনকি হলিউডের গল্পবয়ানের ধরন এবং কৌশলগুলোকে, সেগুলোর ওপরই বাঁকিয়ে দিচ্ছে যাতে করে ওগুলো সচেতনতা এবং সমন্বয়সাধনের অস্ত্র হিসেবে প্রবর্তিত হয়।
একজন মধ্যবয়সী শ্বেতাঙ্গ হিসেবে “পুনরুজ্জীবিত” শব্দটির বিশ্বাসযোগ্য ব্যবহার করতে পারাটা বেশ কষ্টসাধ্যই হবে আমার পক্ষে, তথাপি আমাদের বর্তমান সময় এবং জিজ্ঞাসাবাদের যে দায়িত্বভার অচিরেই আমরা নিতে যাচ্ছি তার সংযুক্ততা বোঝার জন্য এটি একটি চূড়ান্ত ধারণা। স্পাইক লি এটি জানতেন। এরিকা বাদু, ট্রেভন মার্টিন এবং কালো জীবন মূল্যবান বাণীর পূর্বেই তাঁর সিনেমাগুলো আমাদের ডাকছিল ঘুম ভেঙে উঠতে। এই ডাকই ‘স্কুল ডেইজ’ (১৯৮৮)-এর শেষ লাইন এবং ‘ডু দ্য রাইট থিং’ (১৯৮৯)-এর প্রথম লাইন। গোটা ব্ল্যাকক্লান্সম্যান জুড়েই এই ডাক প্রতিধ্বনিত হয়।
শুধু আফ্রিকান আমেরিকানগণ নন, সকল আমেরিকানকেই সজাগ হতে বলা হয়েছিল, অভিনিবেশ করতে বলা হয়েছিল, নতুন আতসকাচের মাঝ দিয়ে দেখতে বলা হয়েছিল। আমরা কী দেখতে পছন্দ করি অথবা কী দেখতে আমাদের প্রণোদিত করা হয় তার বিরুদ্ধে সত্যিকার অর্থেই কী চলছে তা দেখতে বলা হয়েছিল। আরেকজন মধ্যবয়সী শ্বেতাঙ্গ, ডেভিড ব্রুকস এটিকে নিরূপণ করেন এভাবে: “জেগে ওঠা মানে, আমূলগতভাবে সচেতন হওয়া এবং স্বাভাবিকভাবেই ভীতু হওয়া। জেগে ওঠা মানে, ক্ষমতার গঠনপ্রণালীতে যে পচন পরিব্যাপ্ত হচ্ছে তা নিয়ে অবগত থাকা।” তবে সৌভাগ্যক্রমে, একশ বছরের হলিউড ফিল্মমেকিংয়ের গল্প এবং ছবিগুলোতে বিদ্বেষ এবং ধর্মান্ধতা কতখানি, সে-তদন্ত চালালে আমরা যা খুঁজে পাব, তা শুধুমাত্র পচন নয় বরং এরচেয়ে বেশি কিছু—অগ্রবর্তী হওয়ার একটি পথ।
ফেব্রুয়ারি ২০১৮-তে, ওয়াশিংটন ন্যাশনাল ক্যাথেড্রালে ‘গেট আউট’ সিনেমার একটি প্রদর্শনীর পর মঞ্চে বর্ণ, সিনেমা এবং আরোগ্যলাভ বিষয়ক আলাপচারিতার অংশ ছিলাম আমি এবং ‘দ্য আটলান্টিক’ ম্যাগাজিনের লেখক ভান নিউকার্ক। সিনেমাটি নিয়ে তার ভূমিকায় ভান কথা বলেন, ক্যাথেড্রালের পালপিটে দাঁড়িয়ে ‘মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রে’র জীবনের শেষ রবিবারের হিতোপদেশ নিয়ে:
“একদিক থেকে এটি ছিল একটি মানসম্পন্ন পারমার্থিক পরীক্ষা। তিনি বাইবেলের একটি শাস্ত্র দিয়েই আরম্ভ করেছিলেন। কিন্তু এরপর তিনি বলতে শুরু করেছিলেন রিপ ভ্যান উইংকলের গল্প, যেই লোক টানা ২০ বছর ঘুমানোর পর জেগে ওঠে। সে লোক ঘুমিয়ে পড়েছিল যখন আমেরিকা শাসিত হতো একজন ভাঁড় কর্তৃক এবং জেগে উঠেছিল বিপ্লবের পরবর্তীকালে।
কিং জুনিয়র, মহৎ আন্দোলনের সময়ে কী করে সজাগ থাকতে হয় সে-সম্বন্ধে মানুষকে নির্দেশনা দিতে গিয়ে একটি দৃষ্টান্তস্বরূপ এই উদাহারণটি ব্যবহার করেছিলেন। কিভাবে জাগ্রত থাকতে হবে, তা নিয়ে তিনি কথা বলেছিলেন বলে অনেকেই অভিমত প্রদান করেন। কিন্তু তুমি যদি সজাগ হওয়ার প্রক্রিয়ায় থাকো, তবে কিভাবে তুমি বর্ণ সম্পর্কে সচেতনতার জন্ম দেবে নিজের মাঝে এবং কিভাবে সেই ধাপে পৌঁছাবে যেখানে তুমি তোমার জীবন, বর্ণ এবং অ-বিদ্বেষী হয়ে ওঠার সাথে সংকটপূর্ণভাবেই নিযুক্ত হবে তা নিয়েও কথা বলেছিলেন তিনি।”
১৯১৫ হতে বর্তমানের আমেরিকান সিনেমার বর্ণবিদ্বেষের প্রকৃতিতে অনুসন্ধান চালানো দ্বারা, মঙ্গলকরকে আলিঙ্গন এবং ক্ষতিকর অতিকথাকে অনাবৃত এবং প্রত্যাখ্যান দ্বারা, এই চলচ্চিত্রগুলো কিভাবে বর্ণ এবং কুসংস্কারের প্রয়োজনীয় আলাপের দিকে ধাবিত করতে পারে (এবং করেছে) তা উপলব্ধি দ্বারা, এবং এই গোটা প্রক্রিয়ায় অ-বর্ণবিদ্বেষী হয়ে ওঠার চেষ্টা দ্বারা আমরা আমাদের অতীতের ‘বার্থ অফ আ নেশন’দের এবং বর্তমানের শার্লটসভিলের নিও-নাৎসিদের আত্মশুদ্ধির প্রস্তাব জানাতে পারি।
ডক্টর. কিংয়ের লক্ষ্য ছিল এমন একটি আমেরিকা, এমন একটি পৃথিবী, যেথায় মানুষকে গায়ের রঙ দ্বারা নয় বরং চরিত্রের বিষয়বস্তু দ্বারা পরিমাপ করা হবে—সে-লক্ষ্য অধরাই রয়ে গেল। তথাপি এটি এমন একটি লক্ষ্য যা সর্বোচ্চ অনুসন্ধানের দাবি রাখে, এবং অদ্ভুতভাবেই সত্য, আমাদের প্রায়শই বর্ণবাদী এই সাহিত্য এবং সংস্কৃতি হয়তোবা উন্নতির অভিমুখে এই যাত্রার একটি অংশ হতে পারে।