গদ্যত্রয়ী
জীবাণু
আদি এককোষী থেকে ক্রমে ক্রমে এই যে পূর্ণবিকশিত মানবপ্রজাতি, তার হৃৎপদ্ম, মৌচাকমণ্ডিত ফুসফুস, নিউরনসজ্জিত গোলার্ধচিহ্নিত মগজপিণ্ড...অঙ্গপ্রত্যঙ্গের স্পন্দমান স্থাপত্য আর তাদের অত্যাধুনিক ক্রিয়াবিধি, জটিল অ্যালগরিদম—সবই কোটি-কোটি বছরের ধীর-অথচ-নিরবচ্ছিন্ন বিবর্তনের ফসল।
সমস্ত গ্রহের ওপর, গ্রহের আকাশ বাতাস সাগর পাহাড় অরণ্য, সমস্ত জড় জীব অণুজীবের ওপর মানবের একচ্ছত্র আধিপত্য, এমনকি অন্য গ্রহ-উপগ্রহের দিকেও ধাবমান তার দাপট।
অথচ কী আশ্চর্য! না-জড়-না-জীব, এমনকি অণুজীবও নয়, এমনই এক ক্ষুদ্রস্য ক্ষুদ্র জীবাণু হঠাৎ কোত্থেকে উদয় হয়ে মুহূর্তে বহুগুণিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সর্বাধিক বিকশিত এই জীবদেহে, লাফিয়ে লাফিয়ে দেহ থেকে দেহান্তরে। অত্যুন্নত জ্ঞানবুদ্ধি কৃৎকৌশল জারিজুরি বাহাদুরি কোনো কিছু দিয়েই ঠেকানো যাচ্ছে না অদৃশ্য জীবাণুবাহিনীকে। দেহকে করে দিচ্ছে বিদেহনগর পার।
কী এক ভয়ংকর অসহায় অবস্থায় পড়েছে মানুষ এই আধুনিক বিশ্বে!
ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া
অরণ্য, আবাদ সব সাবাড় করতে করতে বুশফায়ারের মতো অপ্রতিরোধ্য গতিতে ধেয়ে চলেছে নগরসভ্যতা। অবশ্য ভোগবাদী মানুষের সীমাহীন স্বার্থপরতায়, অবিমৃষ্যকারিতায়, এমনিতেই একদিন থমকে যেতে বাধ্য হবে এই নির্বিচার আগ্রাসন, প্রকৃতির নিয়মেই। তখন অরণ্য শুরু করবে পাল্টা ধাওয়া। গাছপালা পশুপাখি মার্চ করে এগিয়ে যাবে নগরের দিকে।
এই তো একদিন জঙ্গল ও আবাদিভূমি সাফ করে, পশুপাখিকে তাড়িয়ে দিয়ে গড়া হয়েছিল চেরনোবিল পারমাণবিক নগরী। আজ আবার জঙ্গল ও পশুপাখি দখল নিয়েছে এলাকাটির। এখন সেখানে পাকা সড়ক দিয়ে হাঁটে ধূসর নেকড়ে, বুনো ঘোড়া, রাঙা খেঁকশিয়াল, বনকুকুর...। গজিয়ে-ওঠা সব গাছপালায় আর পরিত্যক্ত সব ফ্ল্যাটবাড়ির বিভিন্ন ফ্ল্যাটে বাস করে রকমারি পাখি ও পতঙ্গ আর নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণী—অরণ্যসমাজে প্রচলিত শ্রেণি-পেশা-আকৃতি-অবস্থান-ও-মর্যাদা মোতাবেক।
মা ও পালক মা
আর কত সন্তানের ভার সামলাতে পারে একা এক মা! কোত্থেকে, কিভাবেই-বা জোটাবে এত-এত পোষ্যের আহার, বাসস্থান, শক্তি, জ্বালানি, গ্যাসোলিন! তার ওপর সন্তানদের এত অত্যাচার, আজগবি সব আবদার—কাঁহাতক আর সহ্য হয় মায়ের! ক্রমে জ্বর বেড়ে যায় তার, পুড়তে থাকে শরীর। নিরুপায় মা তাই মাঝে-মধ্যে ভীষণ চটে গিয়ে প্রহার করে সন্তানদের, বাঁধিয়ে দেয় হুলুস্থুল দুর্যোগ দুর্বিপাক।
মা যদি আর না-ই নিতে পারে এত পোষ্যের ভরণপোষণ দায়ভার, পোষ্যরাই-বা কী করবে! তাই তারাও খুঁজছে পাওয়া যায় কিনা কোনো পালকমাতার সন্ধান। শোনা যায়, আছে একজন, দূরে, নিঃসন্তান। তবে বেশ রুক্ষ ও রুদ্র প্রকৃতির, চরমভাবাপন্ন।
কিন্তু একবার যদি তার কাছে যেতে পারে, অন্তত কিছু সন্তান, ফেলে তো আর দিতে পারবে না; ক্ষমাঘেন্না করে নিশ্চয়ই আশ্রয় দেবে কোলে।
তখন সন্তানদের প্রথম কাজ হবে ফল্গু জাগিয়ে তোলা বাৎসল্যরসের, জাগিয়ে তোলা হরিৎ-শ্যামল মায়া, পালক মায়ের রুক্ষ দেহে ও মনে।