মেঘ রঙের পাহাড় : নেপাল-দার্জিলিং ভ্রমণ



খোরশেদ আলম
ছবি: লেখক

ছবি: লেখক

  • Font increase
  • Font Decrease

সড়ক পথে বাংলাদেশ থেকে নেপাল যাওয়ার ঝক্কি কম নয়। মধ্যবিত্তের পকেটের দিকে তাকিয়ে অন্যান্য ব্যয় বাদে রাহাখর্চা যা থাকে, তা দিয়ে বিশেষ কিছু হয় না। তাই এয়ারে যাওয়ার বিলাসিতা ছাড়তেই হলো। তাতে একদিক থেকে ভালোই হলো। কারণ ১৭ ঘণ্টার সবচে বড় জার্নি দার্জিলিং থেকে কাঠমুণ্ডুর ভৌগোলিক বৈচিত্র্যটা উপভোগ করলাম। যদিও সেটা চোখের দেখা। কেননা অনাত্মীয় বিদেশে স্বজন কই যে, মধ্যি পথে নেমে, একটু গা জুড়িয়ে নেব। প্রাইভেট কোম্পানির ট্যুরিস্ট ভ্রমণ, একবারেই ফরমায়েশি। রাস্তা তার মাপা, থাকা-খাওয়া-বিশ্রামটাও তাই আঁটসাঁট।

ভ্রমণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রথমবার ইংল্যান্ড গেলেন, ফিরে এসে তার ফিরিস্তি শোনালেন—“সেই প্রথম বয়সে যখন ইংলন্ডে গিয়েছিলুম, ঠিক মুসাফেরের মতো যাইনি। অর্থাৎ রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে বাহির থেকে চোখ বুলিয়ে যাওয়া বরাদ্দ ছিল না—ছিলেম অতিথির মতো, ঘরের মধ্যে প্রবেশ পেয়েছিলুম।” (রবীন্দ্র রচনাবলী, ১০ম, জন্ম শতবার্ষিক সংস্করণ, পৃ. ৩৪০)।

এ-রকম ভ্রমণে হৃদয় মন উৎসারিত হয়। জীবনের গভীর আকাঙ্ক্ষাগুলো সার্থকতার হাওয়া-প্রাপ্ত হয়। তবুও বলতে হয়—যা দেখেছি তার তুলনা নেই। একটা বিরাট ভূমিকম্প নেপালকে গুড়িয়ে দিয়ে গেছে। কিন্তু তার প্রাকৃতিক অপূর্ব শোভাকে এখনো এতটুকু টলাতে পারেনি বোধহয়। হিমালয় কন্যা যে-বিশাল ক্রোড়ে শুয়ে আছে, তাকে অতিক্রম করার সাধ্য কার? নেপালের পাহাড়-পর্বত-মেঘ, তাদের উচ্চতা, মেঘের লুটোপুটি, উপত্যকা, দর্শনীয় স্থান সত্যি অভূতপূর্ব। মনে পড়ছে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর তিব্বত প্রসঙ্গসহ দার্জিলিং ভ্রমণ-কথা। ‘সখা’, ‘সাথী’, ‘সন্দেশ’, ‘মুকুল’ পত্রিকায় বেরিয়েছিল সেসব। উপেন্দ্রকিশোরের আঁকা ছবি মনোহরণ করে। তাঁর রচনার সুখপাঠ্যতার নমুনা পেশ করা যায়—“পর্বতের কোলে মেঘের নিদ্রা দেখিতে বড়ই সুন্দর। চঞ্চল মেঘ সমস্ত দিন ধরিয়া ছুটাছুটি করে। তাই কি সন্ধ্যাকালে তাহার ঘুম পায়? ওই দ্যাখো, তাহারা কেমন শান্ত হইয়া পর্বতের গায়ে শুইয়া পড়িয়াছে। সমস্ত রাত্রি তাহারা ওই রূপ ভাবে কাটায়। সকালবেলা সূর্যের আলো তাহাদের গায়ে পড়িবামাত্র তাহাদের ঘুম ভাঙিয়া যায়।”

দার্জিলিং ও নেপাল সত্যিই পর্বত-মেঘের ক্রীড়াকৌতুক। বাংলাদেশ থেকে দার্জিলিং, তারপর নেপালের কাঠমুন্ডু থেকে পোখারা, সেখান থেকে আবার কাঠমুন্ডু হয়ে নাগরকোট-কোডারি-ভক্তপুর-ধূলিখেল—সেসব স্মৃতি ভোলার নয়।

বাংলাদেশে অবস্থিত নেপাল দূতাবাস থেকে ভিসা নিয়ে যেতে হলো ভারতীয় দূতাবাসে। কারণটা ট্রানজিট ভিসা। একই রঙের চামড়া কিন্তু বাংলাদেশের মানুষকে ভারতে যেতে দিতে কত যে আপত্তি! ভিসা নিতে হলো রীতিমতো সাক্ষাৎকার দিয়ে। অবশ্য অফিসার খাতির কম করেননি। বললেন, “স্যার, আপনার সঙ্গে সহধর্মিনী যাচ্ছেন বুঝি? তা ভ্রমণ করবেন নেপাল? মানে এভারেস্ট যাবেন?” বললাম, “হ্যাঁ, মানে, কখনো যাইনি তো তাই?” ভেতরে ভয় ছিল; যদি একজনের ভিসা মিস হয়! তাহলে যাত্রা-ইস্তফা হবে ওখানেই। একটি কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললেন, “এখানে সই করুন, আর লিখে দিন ইনি আপনার স্ত্রী। মানে একসঙ্গে নেপালে যেতে চান।” মনে হচ্ছিল কাজীর কাছে বিয়ের কাবিন হয়েছিল প্রথমবার, এটা ঠিক দ্বিতীয়বার। অগত্যা বিলম্ব তফাৎ যাও। ঝড়ের গতিতে একখানা সই করে দিলাম। ফিরে আসার প্রতিশ্রুতিমূলক মুচলেকা প্রদান করলাম। অবশ্য ঐ দেশ থেকে আমাদের ফিরে আসা নিয়ে তিনি বিচলিত ছিলেন না! ভিসা অফিসারের মুখমণ্ডলে বিন্দুমাত্র টেনশানও পরিলক্ষিত হয়নি! ভয়টা কেবল আমাদের পক্ষ থেকেই অমূলক। একথা ভাবলে এখনো নিজের ভেতর কৌতুক অনুভব করি।

যাই হোক, নির্দিষ্ট তারিখে আমাদের যাত্রা আরম্ভ হলো। ট্যুরিস্ট টিমে সদস্য সংখ্যা ১৩-১৪ জন, নানা বয়সী। বাংলাদেশের বুড়িমারি সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করলাম। ইমিগ্রেশন, কাস্টমস-এর ঝাক্কিঝামেলা তো সাপের পাঁচ পা দেখা। যেন মঙ্গলগ্রহে যাচ্ছি, জীবনের সমস্ত রস ওখানেই শুষে নেবে। টাকাকড়ির বদলও করতে হবে। অনেকে বলল, “নিয়ে নিন, ওদিকে ঝামেলা হবে, এক্সচেঞ্জে বেশি দিতে হবে।” ওপারে বাসে করে প্রায় ২.৩০ ঘণ্টার মধ্যেই শিলিগুড়ি পৌঁছানো গেল। এদিকে হোটেলে দুপুরের খাবার বিশ্রাম সেরে, একখানা জিপগাড়ি ভাড়া করে দার্জিলিংয়ের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ। ও-জায়গায় আরো একবার গিয়েছিলাম। অভিজ্ঞতা যা বলে, স্বল্পতম সময়ের মধ্যে আবহাওয়ার এমন তড়িৎ পরিবর্তন আর কোথাও লক্ষ করিনি। আস্তে আস্তে গায়ে গরম কাপড় ওঠা শুরু হবে, চলবে দার্জিলিং পৌঁছে রাত্রি অবধি। কারণ রাত যত গভীর ঠান্ডার পরিমাণ ব্যস্তানুপাতিক। আর পানি, ওরে বাবা, বরফ গললেও এতটা ঠান্ডা নয়। এদিকে এমন পিচ্ছিল পানি যেন অবিরাম গ্লিসারিন সাপ্লাই করছে। মুহূর্তেই ঘন কুয়াশা এসে ভিজিয়ে দিয়ে যেতে পারে মুখ-চোখসহ সোয়েটার-জ্যাকেট-চাদরের উপরিভাগ। কখনো চলছে ঘন তুলার মতো মেঘের হুটোপুটি, অযথা ছোটাছুটি। মোটামুটি সন্ধ্যা হলেই দার্জিলিংয়ের দোকানপাট বন্ধ। ‘ম্যাল’ চত্বরটি সরগরম থাকে অনেকটা সময় ধরে। সেখানটায় বসা, বিশ্রাম, ঘোরাঘুরি, ছবি তোলা এবং এর কাছেই বিগবাজারে শপিংয়ে যাওয়া বেশ আনন্দের।

সস্ত্রীক ভ্রমণরত লেখক

“শল (শাল) লিজিয়ে ভাইসাব।”—দোকানিদের আন্তরিক বচন। কেউ কেউ হাতে হাতেই ফেরি করে শাল আর চা পাতার প্যাকেট বিক্রি করতে আসে। তাদের বিক্রি করার কৌশল সম্মোহিত করে ফেলতে পারে যে-কাউকেই। ধরাশায়ী ট্যুরিস্টরা একটু বেশি দামেই লোকাল দার্জিলিং চায়ের প্যাকেট কেনে। এদিকে অদূরেই অবস্থিত একটি বৌদ্ধ স্বর্ণমন্দির, পাহাড়ি ঢালু পথের সিঁড়ি বেয়ে সেখানে উঠতে হয়। অন্যদিকে আর একটি বৃহৎ বুদ্ধিস্ট মনাস্ট্রি কাছেই। বড় বড় ঘণ্টা আর গোল গোল গম্বুজগুলো দাঁড়িয়ে আছে সদর্পে। দার্জিলিংয়ের সুদৃশ্য স্থাপত্যশৈলীর বাড়িগুলোর বারান্দা নাম না জানা ফুলে ফুলে সজ্জিত। বাহারি এই ফুলগুলো দেখে সত্যি আশ্চর্য হতে হয়!

দার্জিলিংয়ের ‘ম্যাল’ চত্বর থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা খুবই স্পষ্ট। খুব কাছে মনে হলেও দূরত্ব ১৫০ কিলোমিটারের কম নয়। দার্জিলিং যাবার আগেই পথে পড়বে ছোট ছোট পাহাড়ি জনপদ, শহর। কখনো কালো মেঘে ছেয়ে যাওয়া, কখনো অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে কুয়াশাময় পথ। উঁচু নিচু পাহাড়ি পথ, আশপাশের দৃশ্য, সারি সারি গাছ সৌন্দর্যপিয়াসী মনকে পাগলপাড়া করবেই। দার্জিলিং যাবার পথেই মিরিক, কর্সিয়াং। কুয়াশা-মেঘের অপূর্ব দোস্তি সেখানেও মোহনীয়তা তৈরি করে। বিশেষ করে মিরিকের লেক। উঁচু পাহাড়ের কোলে এমন লেক বিরল। সেই সঙ্গে সিমসাম এই শহরটাও মজার। উইলো আর ঘন পাইন বন, পাহাড়ের ঢালুতে চা-বাগানের ঘনত্ব অতিক্রম করে এমন একটি শহর প্রকৃতির উদরে ঠাঁই নিয়েছে, লেকে ঢোকার পূর্বে ঠাহর করার উপায় নেই। পথের ধারেই কিছু খাবারের দোকানে বিক্রি হচ্ছে ‘মমো’—এখানকার ঐতিহ্যবাহী খাবার। এদিকে পানীয় বলতে ‘আপেল জুস’ না খেলে অসম্পূর্ণতাই থেকে যায়। তাদের নিজেদের বাগান থেকেই সংগৃহীত হয় এই আপেল। দার্জিলিংয়ের ‘র-টি’র কথা কী আর বলার! ওখানকার চায়ের বিশেষ ঘ্রাণটা সাইকোলজিক্যাল কিনা জানি না। তবে স্বাদটা বোধ হয় আলাদাই। সরাসরি রোদে শুকানো পাতার দার্জিলিং-টি কফিকেও যেন হার মানায়। এর স্বাদটা এখনো জিভে লেগে আছে।

দার্জিলিংয়ের হোটেলে রাত কাটিয়ে পরদিন ভোরের আলো না ফুটতেই ছুটতে হলো টাইগার হিল। একটি জিপগাড়ি ভাড়া করে সবাই রওনা হলাম টাইগার হিল বরাবর। সূর্য সেখানে আলাদা প্রত্যয়। ওখানকার সূর্যোদয় না দেখলে বোঝা যাবে না মেঘ আর সূর্যের আলো কতটা খেলা তৈরি করতে পারে। যেন মেঘের চাদর বিছানো রয়েছে পৃথিবীময়। সেই চাদর উড়ছে কমলা-লাল-সাদার অপূর্ব বর্ণালীতে। বাতাসে সমুদ্রের অথৈ ঢেউয়ের মতো সেই চাদর বিস্তৃত ভুবন জুড়ে দোল খাচ্ছে। এমন দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করা প্রায় অসম্ভব। অনুভবের গহন-গভীরতা দিয়ে তাকে বিস্মিত বোধে পরিমাপ করতে হয়। পৃথিবী সেখানে অধরা কিন্তু তার মাধুরী চোখের সামনে দৃশ্যমান।

দার্জিলিং-ভ্রমণ শেষে নেপালের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হলো। দার্জিলিং থেকে ১৭ ঘণ্টার টানা জার্নি শেষে কাঠমুন্ডু শহর। জীবনে এত লম্বা বাস জার্নি করিনি। ভারত সীমান্তে কাঁকর ভিটা পার হয়ে নেপাল প্রবেশ গেট। ইমিগ্রেশনের ঝক্কি পোহাতে হলো বাংলাদেশি বলে। ভারতীয়দের আসতে-যেতে বাধা নেই। তাদের কাছে ভারত-নেপাল যেন আলাদা কিছু নয়। তবে সময়ের অপচয় হলো না। ওদিকে নেপালে প্রবেশ করেই ওখানকার বাস স্টপেজের একটি বাসে ৯ জন যাত্রী ওঠা গেল। বাকিদেরকে তারা একটি প্রাইভেট কারে পৌঁছে দিল পরের স্টপেজে। কী এক অদ্ভুত নিয়মে টিমের নয়জনের বেশি একসঙ্গে ওঠা নিষেধ। কিন্তু প্রাইভেট কারটি ধরা পড়ল। কী কারণে ধরা পড়ল বুঝলাম না। চুক্তি ভঙ্গ করে পরের স্ট্যান্ডে বাসে ওঠার দায়ে জরিমানা গুনল ট্যুরিস্ট কোম্পানি। নেপালিদেরই চাল কিনা বুঝে উঠতে পারলাম না। এদিকে বাস চলছে মধ্যম গতিতে। আমাদের দেশের মতো হিনো লাক্সারি চেয়ার কোচ ২০০৯ সালের নেপালেও বিরল। ইন্ডিয়ান লোকাল-মেড ঝক্কর-মক্কর বড় গাড়িগুলোই তখনও তাদের ভরসা। এদিকে পাহাড় পর্বতময় নেপালে নেই ট্রেন লাইন। কিন্তু স্থলপথের ঐ সীমান্ত থেকে অন্তত ৮ ঘণ্টারও বেশি দূরত্বে সমতলভূমি। এটাই নেপালের উর্বর ‘তরাই’ অঞ্চল। এখানকার উৎপাদিত ফসলেই নাকি পুরো নেপালের খাদ্য। কাঁকর ভিটার আশেপাশেই মেচি নদী। চারু মজুমদারের নারিকেলবাড়ি-খড়িবাড়ি নকশাল অঞ্চলও এই সীমান্তে। ইতিহাসের বাঁকটা মনের মধ্যে ভেসে উঠল।

লোকাল নেপালে মেয়েরাই সব

আমাদের গাড়িটি এগিয়ে চলছে। দিনের শেষে রাত। কিন্তু বড় রাস্তার আশেপাশে কোথাও ভালো খাবার হোটেল এমনকি বিশ্রামাগার মেলাও দায়। মনে হচ্ছে গোটা পরিবেশটাতেই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। হোটেলে আলুর (অতিরিক্ত ঝোলের) তরকারি, সামান্য সব্জি, রুটি (চাপাতি), কখনো আধাসিদ্ধ ভাত—এসবই আনাড়ি পরিবেশকদের হাতে পরিবেশন করা। ধুলোমলিন চেহারার বেচারা পরিবেশকদের আচরণে সভ্যতার ছিটেফোঁটাও নেই। ভালো প্রক্ষালন স্থান নেই রাস্তার পাশে কোথাও। যারা বিমানে গিয়ে কাঠমুন্ডু-পোখারার উজ্জ্বল হোটেলগুলোতে অবস্থান করেন তারা এই নেপালের কিছুই জানেন না বলতে গেলে। গভীর রাতেও বাস স্টপেজগুলোতে নারীরা দিব্যি দোকানি হয়ে বসে রয়েছে। চা-বিস্কুটের সরবরাহ চলছে। দিনের বেলায় বাচ্চাকাচ্চারা সঙ্গেই রয়েছে। মনে হচ্ছে তাদের স্বামীরা ঘুমঘুম চোখে আশপাশে ঘুরঘুর করছে। তাদের কাউকে কাউকে বাচ্চা কোলে দাঁড়িয়ে বা বসে থাকতে লক্ষ করা গেল। অভিজ্ঞ ট্যুরিস্ট কোম্পানির ব্যক্তিটি জানালেন, লোকাল নেপালে মেয়েরাই সব। পুরুষরা নাকি খায় দায় ঘুমায়, মদ্যপান করে নেশায় বুদ হয়ে থাকে। কৃষি খামারেও নারীদের আধিপত্য। যেন পুরো সংসারটা তারাই সামলাচ্ছে, পুরুষ সেখানে নিমিত্ত মাত্র। পথের আশপাশেই চমৎকার সব ক্ষেত খামার। অনেক দূর জার্নি করার পর আস্তে আস্তে পাহাড়ি অঞ্চল শুরু হয়। এই পাহাড়ের শরীর অপূর্ব সুন্দর শৈলিতে সাজানো। চা বাগানসহ বিচিত্র ফসল সেখানে ঢালুময় বিস্তার তৈরি করেছে। সেইসব ঢালু ক্ষেতখামারের মধ্য দিয়ে দূর থেকে দৃষ্ট সরু গলি পথগুলো হাঁটা পায়ের ছাপেই তৈরি হয়ে গেছে। সেসব পথ সৌন্দর্যকে আরো খানিকটা বাড়িয়ে তুলেছে। পথে যেতেই স্থানীয় নেপালীদের সমবেত ধর্মীয় কৃত্য হিসেবে নাচ দেখার সৌভাগ্য হলো।

নেপালীদের সমবেত ধর্মীয় নাচ

কিন্তু এই অপূর্ব সুন্দরের মধ্যখানেও লোকাল নেপালিদের খিটমিটে মেজাজ মন খারাপ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। গাড়ি থামলে কোথাও চা খেতে বসি কিংবা দাঁড়িয়ে থাকি। বড় টিনের গ্লাসে চা সরবরাহ হয়। কিন্তু চা খেতে চাইলেও তাদের মেজাজ খটমটে, এমনকি বিল দিতে গেলেও। দু চারজন কর্মী পুরুষের জন্যই বোধ হয় এই মেজাজসমূহ পথেঘাটে ছড়ানো। যাই হোক, ম্যারাথন জার্নি শেষে কাঠমুন্ডু পৌঁছানো গেল। কাঠমুন্ডু মূলত ভ্যালি বা উপত্যকা। চারদিকে তার পাহাড়বেষ্টিত, মাঝখানে শহর। কাঠমুন্ডু ঢোকার সময়ই অনেক বিস্তৃত মনে হয়েছে। কিন্তু অপেক্ষাকৃত কম খাড়া পাহাড়গুলোর ভূ-দৃশ্য মনে লেগে আছে এখনো। পাহাড়ি মূল বড় রাস্তাটির সৌন্দর্য অতুলনীয়। এই রাস্তার বাঁকসমূহ বাস থেকে একবার ওপরে একবার নিচে দৃশ্যমান হয়। কেননা পথটা অনেকখানি ঘুরে ঘুরে দেখি একই জায়গায় রয়েছে, শুধু উচ্চতা বদল হয়েছে। কতদূর ওপরে উঠলাম ঠিক বোঝা গেল না। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথগুলো পেরিয়ে মূল শহরে পৌঁছানো গেল। ‘থমেল’ ওখানকার শহরের প্রাণকেন্দ্র। থমেলে অবস্থিত হোটেল তিব্বতে আসন গাড়লাম। মনোমুগ্ধকর হোটেলের রিসিপশন হাউসটি ট্রেডিশনাল নেপালি স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি। সেখানকার অভ্যর্থনার উষ্ণতাও চোখে পড়ার মতো। কাঠমুন্ডুতে উঁচু মন্দির ‘শম্ভুনাথ’। শম্ভুনাথ মন্দিরের আলাদা বিশালত্ব বা মাহাত্ম্য আছে। বৌদ্ধমন্দিরটির অভ্যন্তরের আয়োজন বাড়তি মোহনীয়তায় ভাস্বর। সিদ্ধার্থ গৌতমের বিচিত্র মূর্তি, দোকানে থরে থরে সাজিয়ে রাখা বুদ্ধ যেন চিরকালের আত্মীয়।

আমরা মূলত দুবার কাঠমুন্ডু প্রবেশ করি। শেষবার পোখারা ও নাগরকোট ভ্রমণ শেষে এই তিব্বত হোটেলেই অবস্থান করি। কাঠমুন্ডুর থমেলে এই হোটেলের আশপাশটাই রাজধানীর অভিজাত এলাকা। এখানেই সার্কের সদর দপ্তর। বাইরে থেকে প্রধান ফটকটির কারুকাজ ঐতিহ্যবাহী। এখান থেকে রিক্সায়, ঘোড়ার গাড়িতে কিংবা ট্যাক্সি-অটোরিক্সায় শহরের নানাস্থানে যাওয়া যায়। সিমসাম শহরটাতে বিশেষ ভিড়ভাট্টা নেই। নেপালি ঐতিহ্যের আরেকটা প্রধান সড়কে ঘোড়সওয়ারি ট্রাফিক পুলিশ। এটাও তাদের পুরনো এতিহ্য। স্থানে স্থানে ঝুরিতে করে ফলমূল ও শাকসব্জি নিয়ে বসে রয়েছে নেপালি মহিলা। খাবারের দোকানগুলো বেশ চড়া দামের। অনন্ত ২৫০ রুপি না হলে, একবেলার মোটামুটি ভালো খাবার বলতে, মুরগি সব্জিও মেলে না। সঙ্গে দুটো বা তিনটে চাপাতি (তন্দুরি)। চায়ের অর্ডার দিতে গিয়ে বিপত্তিতে পড়েছিলাম। ওরা চাপাতি নিয়ে হাজির। ভাগ্যিস তা বাংলাদেশি অস্ত্র নয়! অন্যদিকে গো-মাংস ভক্ষণ করতে হলে যেখানে আসতে হয় তার নাম মদিনা হোটেল। আমরা রাতের অন্ধকারে বুভুক্ষু মন নিয়ে সেখানে হাজির হলাম। রান্না এখানে বেশ ভালো। তৃপ্তির খাবার ঐ একবারই জুটেছিল নেপালে।

কাঠমুন্ডু সেই অর্থে পর্যটন শহর। কাজেই মার্কেটগুলোতে নানাদেশি পণ্যসামগ্রীর ভিড়। ট্রেডিশনাল নেপালি পোশাক কিংবা আসবাবপত্রের দোকানও লক্ষ করা গেল। সবজি ও ফলের দোকানগুলো চমৎকারভাবে সাজানো। এদিকে নেপালের রোদ গা ফুটানো অস্বস্তির। পাহাড়ি শহরটায় কিঞ্চিত ঠান্ডা আবহাওয়াতেও দুপুর বেলার রোদে যেন ত্বক পুড়ে যায়। রিক্সাগুলো একটু ভিন্ন গড়নের। স্প্রিং বসানো গদিঅলা রিক্সা, ক্রিংক্রিং বেলের বদলে ভুভুজেলা আওয়াজের ভেপু লাগানো। রিক্সাওয়ালার পোশাক হাফপ্যান্ট, মাথায় হ্যাট, তার মাথার ওপরে একটা সুবৃহৎ ছাতা। ছাতাটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে রিক্সায় আটকানো। সহ্যাতীত ভয়ঙ্কর রোদের আঁচ থেকে সুরক্ষার জন্য এই ছাতার বিকল্প নেই। বাতাসের আর্দ্রতা সেখানে খুবই কম, তাই ঘাম হয় না কিন্তু সূর্যটা গনগনে। রিক্সাওয়ালার সঙ্গে বাংলা মিশ্রিত ভাঙা-ভাঙা হিন্দি ভাষায় আমাদের ‘বাতচিত’ চলল শহরের কেন্দ্রীয় মার্কেটপ্লেস অবধি। মনে হলো তারা সবাই কিছু হিন্দি-বাংলা এমনকি দু চারটি ইংরেজি শব্দও বোঝে। বিদেশিদের আনাগোনা বেশি বলেই তাদের এই ধরনের সংযোগ ভাষা বা ‘লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা’ তৈরি হয়েছে। কিছু বুঝি বা বুঝি না, তবুও যোগাযোগের কমতি হলো না। কাঠমুন্ডু শহর রাতেও ঘুমায় না। তবে প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়ে রাতের বেলা। মধ্য মে-তেও রাতে দু ফর্দ মোটা কম্বল না হলে চলে না। দিন আর রাতের আবহাওয়া সেখানে সত্যিই আলাদা। কাঠমুন্ডুর দু দিনের সফরে দরবার স্কোয়ারসহ পুরো শহর-দর্শনের অনেকখানি সম্পন্ন হলো। দরবার স্কোয়ারের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা এবং খিলানগুলো চোখ জুড়ানো। অনেকগুলো ছোটবড় দ্বিতল-ত্রিতল ঘর, সিংহদ্বার প্রবেশগৃহ, স্তম্ভের মাথায় সর্প আসনকৃত দেবতা শিব স্থানটিকে অনন্য করে তুলেছে। বিগত ভূমিকম্পে এরই কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী ইট-কাঠ-টালির গৃহ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।

কাঠমুন্ডু থেকে ১৪-১৬ সিটের একটি বড় মাইক্রোবাস আমাদের সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয় কয়েকদিন। প্রথমে পোখারা ভ্রমণ। পোখারার ফেওয়া লেকের কথা মনে পড়ে। সেখানকার দৃশ্য চমৎকার। সারি সারি রঙিন নৌকা শোভা পাচ্ছে পোখারা লেকে, তার ধার ঘেঁষে পরিবেষ্টিত স্বল্প দূরত্বের পাহাড় মনোমুগ্ধকর। বিকেলের সূর্যালোক লেকের সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে শতগুণ। পোখারার হোটেল মনিলায় আমাদের রাত্রিযাপন। ভাটায় পোড়া ইটের বদলে রকমারি পাথরের প্রাচুর্যে গড়া পোখারা যেন স্বর্গীয় নগরী। পোখারার শহরতলীতে ‘রাধাকৃষ্ণ মন্দির’। এর চূড়ায় অবস্থান করে পোখারাকে মনে হচ্ছিল স্বপ্নের শহর। রোদের ঝলক বিচিত্র স্থাপত্যের প্রাসাদোপম বাড়িগুলোর পাথরের টাইল্স করা দেয়ালে পড়ে চকচক করে উঠছে। পাথরের প্রাচুর্যকে তারা উপযুক্তভাবেই কাজে লাগিয়েছে।

পোখারার পাহাড় বন ভ্রমণ করলাম। আবার কাঠমুন্ডুর দিকেই ফিরে আসা হলো। তবে কাঠমুন্ডুর পাশ ঘেঁষে নাগরকোটের দিকে আমাদের যাত্রা তখনও অব্যাহত। মাঝখানে ‘মনোকামনা’ একটি চমৎকার স্থান। তবে বাইরে থেকে যতটুকু প্রত্যক্ষ করা যায় ততটুকুই পর্যবেক্ষণ করতে হলো। ছুটির দিন বলে তার রাজকীয় প্রবেশদ্বারটি বন্ধ। এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে যাওয়ার কেবল কারের লাইন পরিদৃষ্ট হলো। তবে পোখারা-মনোকামনা-কাঠমুন্ডু ভ্রমণপথের কোনো দৃশ্যই ফ্যালনা নয়। এর মধ্যেই একটি মিউজিয়ামে প্রবেশ করলাম। একটি গুহা বা বড় সুরঙ্গ মাটির নিচ দিয়ে। ঐ-সুরঙ্গে যাদের শ্বাসকষ্ট আছে না প্রবেশ করাই শ্রেয়। এখানেই একটি পার্কের মধ্যে দেখলাম ‘ডেভিস ফল’। বছরের পর বছর অনবরত পানি ঝরছে পাথরের মাঝখান দিয়ে একটি বড় কুপের ভেতর। এখান থেকে আরেকটু দূরেই আশ্চর্য দুধের নদী ‘শ্বেতী গজ রিভার’। গভীর ও সরু সাংঘাতিক স্রোতস্বিনী। গজ খানেক প্রশস্ত নদীটি অসম্ভব সুন্দর কলকল শব্দে বয়ে চলছে। নেপালের পর্বত থেকে চুনাপাথর গলে প্রবাহিত বলেই শ্বেতী গজের পানির বর্ণ এমন দুধসাদা। শ্বেতী গজ রিভারের পাশেই ‘গুর্খা মেমোরিয়াল’ মিউজিয়াম।

কাঠমুন্ডু থেকে মধ্যরাতের পরেই পোখারা রওয়ানা হতে হয়েছিল। যদিও সময়ের শিডিউল মেলাতেই এই মধ্যরাতের অযাচিত ভ্রমণ। কিন্তু ভোর হতেই অন্নপূর্ণা আর মচ্ছপুচ্ছের শুভ্র পর্বত-চূড়া যেন রাস্তার অপর পাশেই বলে বিভ্রম হয়। রাস্তার মধ্যখানে নেমেই সেই অপূর্ব দৃশ্যের উপভোগ মনটাকে খানিক আলগা করে দিল। একি শুভ্রতা! একি সুন্দর সকাল! জীবনে এমন সকাল কমই আসে। হিমালয়ের এই পর্বত চূড়াগুলোর ভেতর দিয়ে প্রতিদিনকার সূর্যেই নতুন ভোরের অপেক্ষায় অপেক্ষমান আমাদের প্রত্যেকের দুচোখ।

পরদিন বিকেলেই নাগরকোট গিয়ে পৌঁছালাম। নাগরকোট বিস্মিত সৌন্দর্যের ভূমি। হোটেল ভিউ পয়েন্ট আমাদের বিশ্রামস্থল। সেই হোটেল নাগরকোটের পূর্বপ্রান্তে। পাশেই নিচের ফাঁকাস্থান তার বিশাল শূন্যতা নিয়ে হাজির। কারণ ওপারেই মাউন্ট এভারেস্ট চূড়া পরিদৃশ্যমান। কুয়াশা আর মেঘের ভিড় মাঝেমধ্যেই অস্পষ্ট করে তুলছে পর্বত চূড়া দর্শনকে। নাগরকোটের বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ের গায়ে গায়ে মেঘ। যেন মেঘের দেশে ডানা লাগানো অশরীরী হয়ে উড়ে যাচ্ছি স্বর্গীয় আমেজে। শুধুই নাগরকোটের বর্ণনা করব বলে অনেকখানি লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু যে-দৃশ্য হৃদয়ের গহন-গভীরে নাড়া দিয়ে যায় তার বর্ণনা বুঝি দুষ্কর। সন্ধ্যার দিকে ‘ফোর সিজন রিসোর্টে’র বিশাল লবিতে ঘুরে বেড়াচ্ছি এমন সময় অস্ট্রীয় তরুণের সঙ্গে আলাপ। সে কয়েকদিন থাকবে বলে এসেছিল কিন্তু যেতে তো মন সরছে না তার। নাগরকোটের প্রেমে না পড়ে কারো উপায় কী? অগত্যা কী করা ক্যামেরাটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম, “দুজনের ছবি তোলো।” মুখে হাসি ধরে রেখেই তুলল ছবি। আমাদের ব্যক্তিগত ছবি বলতে ঐ-কয়েকটিই সেরা। আরো কিছুক্ষণ তার সঙ্গে আলাপ করে, পাশের অপরূপ সৌন্দর্য গায়ে মেখে হোটেল রুমে ফিরলাম।

নাগরকোট থেকে পরদিন আমাদের মাইক্রোবাসটি এগিয়ে চলল চীন-তিব্বত সীমান্তে। সেখানে যাওয়া-আসার পথের দৃশ্যই পরম উপভোগের। একটি এঁকেবেঁকে চলা স্রোতস্বিনী নদী যেন পুরো নেপাল-চিন-তিব্বতকে আলাদা করে রেখেছে। কিছু দূর পরপরই ছোট-বড় অসংখ্য ঝর্না। এত ঝর্নার সমাহার পৃথিবীর আর কোথাও আছে বলে জানি না। সেসব দৃশ্য নয়, যেন মনের পাতায় আঁকা বিপুল চিত্রশালা। মাইক্রোবাসটি আমাদেরকে নিয়ে চলছে একটি বিপদসঙ্কুল পথে। এতক্ষণ খেয়ালই করিনি। যেদিকে পাহাড় তার উল্টোদিকে বিশাল বিশাল খাদ। ওখান থেকে পড়ে যাওয়া মানে হাড়গোর দুমড়ে-মুচরে নির্ঘাৎ মৃত্যুদর্শন। কিন্তু দৃশ্য যে চোখ থেকে সরছে না। আর ওসব মৃত্যুও কেউ যেন পরোয়া করছে না। মাঝে মধ্যে খাড়া পাথরের পাহাড়। প্রাকৃতিক বিচিত্র ক্ষয়েও সেগুলো মাথা-ঘাড় কেশবাস নিয়ে দাম্ভিকতার সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। পাহাড়ি ঝর্নায় নেমে পা ভেজালাম। নুড়ি পাথরের বড় একটির ওপর এক পা রেখে আরেকটিতে অন্য পা রেখে দাঁড়িয়ে ক্যামেরায় দৃশ্য ধারণ সম্পন্ন হলো। পাহাড়ি নদীটি ঠিক কতটা এলাকা জুড়ে তা অনুমান-অসাধ্য। তবে ৫/৬ ঘণ্টার জার্নিতেও পুরোটা শেষ হয়নি।

নেপালের তাতোপানি নদী

আমরা তিব্বত-চিন সীমান্তে উপস্থিত। এই এলাকাটার নাম কোডারি। পাশ দিয়ে বয়ে চলা আমাদের দীর্ঘ পথসঙ্গী নদীটির নাম ‘তাতোপানি’—এর অর্থ উষ্ণ জল। এর পানি শীতল তবে উষ্ণতা কি তার চরম অভ্যর্থনার নাম? সীমান্তটি একটি ব্রিজ দিয়ে আলাদা করা। বিরাট দীর্ঘ লম্বা একটি উঁচু ঘর ব্রিজের ওপাশে। তার গায়ে বড় দাগ টানা টানা হরফে কিছু লেখা। ইংরেজিতে এই লেখার অর্থ ‘পিপলস রিপাবলিক অব চায়না’। কিন্তু আমাদের সেখানে প্রবেশাধিকার নেই। শুধু জানা গেল, ঐ ঘরটিরই বাঁ দিকটায় তাকালে তিব্বত। সেখানে জঙ্গল গাছপালা ঘন অরণ্য। শহরের কিঞ্চিতধিক খালি চোখে দেখা যায়, যায় না। ওদিককার পাহাড় থেকেই কোডারির ‘তাতোপানি’র উৎপত্তিস্থল। তবুও মনে বড় উথাল-পাথাল অবস্থা—তিব্বত-চিন তাহলে ছুঁয়ে এলাম! ব্রিজটির মাঝখান অবধি যাওয়া যায়। ওখানে গেলাম, হাতছানি দিয়ে ডাকছে ওপারের পাহাড়-ঝর্না। সীমান্ত থেকে বিশাল চীন দেশটির দিকে হাত নাড়লাম।

এদিকে পেটের অবস্থা তথৈবচ। কিন্তু এই মরার সীমান্তে ভালো খাবার হোটেলই বা কই? একটিতে কোনো রকমে প্রবেশ করলাম। বললাম, খাবার কিছু হবে কিনা? ভাষা তো বড়ই যোগাযোগহীন। তবুও ওয়েটার বলল ‘মাটন’। কিন্তু যা খেলাম তাতে মনে হলো অন্যকিছু। আমার সহধর্মিনী নোনতা স্বাদ চেখে কী ভেবেছিল জানি না, আমাকে তখনও বলেনি। সামান্য খেয়ে আমারই পাতে মাংসটা তুলে দেয়। পরে আশঙ্কার ভাষায় বলল, শুকর-টুকর না তো! আমি সে-কথায় গা করলাম না। প্রচণ্ড ক্ষুধায় বধির হয়ে আছি। ক্ষুধা মিটেছে এই বেশি। কিন্তু এখনো মনে পড়লে সন্দেহ জাগে—সত্যিই নিষিদ্ধ জিনিসটা গিলে এসেছি কিনা! তবুও মনকে বলি, ‘জেনে কি খেয়েছি?’ সে-ও অবশ্য তা-ই বলে। এখনো মাঝেমধ্যে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কি নোনতা স্বাদটা... মানে... সত্যি টের পাওনি! আমি তো ... পেয়েছিলাম। আর হ্যাঁ,ওগুলোর স্বাদ নাকি নোনতাই হয়।”—“আহা, তখন কেন বলোনি!”—“তোমার যা অবস্থা… বললেই আর কী।”

আমরা দুপুরের খাবার সেরেই খুব দ্রুত মাইক্রোবাসে উঠে পড়ি। কারণ সন্ধ্যের আগেই ‘ধূলিখেলে’র সূর্যাস্ত দেখতে হবে। সন্ধ্যের আগে সে-দৃশ্য নাকি অপূর্ব হয়ে ওঠে। যতটা মনে পড়ছে ভক্তপুরের মধ্য দিয়ে আমরা ধূলিখেল পৌঁছাই। ভক্তপুর পুরনো শহর। এর বাড়িঘরের জীর্ণতাও প্রাচীনত্বের ভাব স্মরণ করিয়ে দেয়। বিকেল নাগাদ মাইক্রোবাসটি এক স্থানে রেখে ড্রাইভারসহ আমরা পাশেই পাহাড়ের ওপরে নির্মানাধীন একটি বাড়ির ছাদে দাঁড়াই। ধূলিখেলের ‘ল্যাঙট্যাঙ হিলে’র অস্তগামী সূর্যাস্তটা পাহাড়ের কোল বেয়ে নেমে যাবে। আর আমরা এই স্থানটা থেকে সে-দৃশ্য দেখার অপেক্ষায়। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তটি আসতে বড্ড দেরি। আসলে ফেরার তাড়াও রয়েছে, রয়েছে দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি। ড্রাইভার একসময় রসিকতা করে বলে ওঠে, “ক্যায়া আপকো দেশমে সুরিয়া (সূর্য) নেহি ডুবতা?”

কথাটা বড়ই নির্মম। আসলে ড্রাইভার তো এ-পথে বারবার আসতে-যেতে ভাজাভাজা। ফলে আমাদের ঐ ভূ-দৃশ্য ধারণ আর পাগলামি দেখে একঘেয়ে ক্লান্তির ক্লেশ চেপেও তার রসিকতাটা উপচে ওঠে। আমাদের সঙ্গে ছিলেন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক আব্দুর রশীদ। তিনিও রসিকতা করতে কম যান না—“আপ তো জানতে নেহি মেরা ভাই, ও, সুরয বাংলাদেশকো নেহি হ্যায়, ও নেপালি হ্যায়।”

আসলে নেপালের সূর্যটাই আলাদা! যাই হোক আমাদের এই সূর্যাস্ত দেখার ফাঁকে পাহাড় ও বনের ভেতরের হালকা গাছপালাবেষ্টিত কিঞ্চিৎ আঁকাবাঁকা সুন্দর পথটি পরিভ্রমণ করা গেল। জীবনে যে-জায়গায় হয়তো আর একবারও যাওয়া হবে না তার সবটা দেখে নিতে মন্দ কী!

আমরা পুনরায় কাঠমুন্ডু ফিরে গেলাম। সেই হোটেল তিব্বতেই রাত্রিযাপন শেষে পরদিন বিদায়ের পালা। হোটেল ম্যানেজার পুরো নামটা মনে নেই। তবে উপাধিতে তিনি চোপড়া। তাঁর শেষ অভিবাদনের ভাষা এখনো পরিষ্কার মনে আছে। তিনি গভীর আন্তরিকতার সাথে বললেন, “আপনারা আমাদের আত্মীয়।” ভাবলাম বাণিজ্য বিশ্বের বাইরেও মানুষের অন্তর্গত মনের অস্তিত্ব এখনো মুছে যায়নি। একখানা করে ঘিয়ে-ধূসর রঙের উত্তরীয় তিনি নিজ হাতে পরিয়ে দিলেন একে একে সবার গলায়। তারপর ছবি তোলার হিড়িক পড়লো ক্যামেরাগুলোয়। অনাত্মীয় দেশে এমন উষ্ণতা অভাবনীয়। তিনি পুনরায় ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানিয়ে আমাদেরকে বিদায় সম্ভাষণ জানালেন। কাঠমুন্ডুর শেষ দৃশ্যগুলো মনের ভেতরে গেঁথে পথ চললাম। আবারও ক্লান্তিকর বাস জার্নির ১৪ ঘণ্টা অতিক্রম করে নেপাল সীমান্ত পার হলাম। সেখান থেকে শিলিগুড়িতে আমাদের বিশ্রাম। এরপর পুনরায় ভারত-বুড়িমারি সীমান্ত পেরিয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। এদিকে বাংলাদেশের মোবাইল নেটওয়ার্কটা পেতেই মনে হলো—স্বদেশের ফুরফুরে বাতাস মনটাকে ঘরে ফেরার তাগাদা দিচ্ছে। তবুও রবীন্দ্রনাথের ভাষায় পুনশ্চ ‘যা দেখেছি, যা পেয়েছি, তুলনা তার নাই।’ সে দেখা হয়তো মুসাফের/অতিথির মতো। কিন্তু এরচেয়ে বেশি কিছু এই দীনহীনের পোষায় কি? শেষ-পর্যন্ত পোষায় কারণ সাদা মেঘে সবুজ পাহাড় ছেয়ে গেলে জীবনটাও হয়ে ওঠে শুভ্র-সবুজ।

অসুস্থ ‘তিলোত্তমা’র কাছে কী সেবা চান আপনি!



প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত, প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম

ছবি: সংগৃহীত, প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

জুলাই ১৩, ২০২৪ সালের ভোর পাঁচটায় শুরু হয়েছিল এক তুমুল বৃষ্টি। রাজধানী ঢাকার বেশিরভাগ মানুষ তখনও গভীর ঘুমে।

এ সময়টা ঘোর বর্ষাকাল। সে কারণে ভারী বৃষ্টিপাত হতেই পারে। তাই, অ্যালার্ম শুনেও আরেকটু ঘুমিয়ে নিই বলে যারা কিছুটা দেরিতে উঠে অফিসে যাবেন বলে আটটার দিকে পথে নেমেছেন, তাদের চক্ষু সেদিন চড়কগাছ‍!

সকাল ৯টা পর্যন্ত বৃষ্টি থামেনি। একটানা চার ঘণ্টার মুষলধারার পতনে ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার ২৬ থেকে ৩০টি বড় রাস্তা একসঙ্গে ডুবে গেছে।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, এই ‘ডোবা’ সেই ডোবা নয়! রাস্তায় ১-২ ঘণ্টা জ্যামে দাঁড়িয়ে থাকার পর অনেক গাড়ির ইঞ্জিনে পানি ঢুকে পড়ায় অচল হয়ে যানজট অসহনীয় করে তুলেছিল সেদিন। সংবাদে টেলিভিশনের ভিডিওচিত্র দেখেও তাই-ই মনে হচ্ছিল।

সে এক অতি ভয়ঙ্কর অবস্থা সারাদিন জুড়ে। যেখানে চোখ যায়, সেখানেই মনে হয়, প্লাবন বয়ে যাচ্ছে। নটরডেম কলেজের পাশের রাস্তায় পার্কিং করা কারের শুধু ছাদটা দেখা যাচ্ছে। মালিক গাড়িতে উঠতে গিয়ে হতবাক হয়ে পড়েছেন।

নিউমার্কেটের প্রধান গলিতে বুকসমান পানি। দোকানকার মালিকেরা যারা বাসা থেকে ডুবন্ত নিউমার্কেটের ছবি দেখে দৌড়ে এস মাল সরানোর চেষ্টা করেছিলেন, তারা অনেকে এসে দেখেন দোকানের তালা ঘোলা-ময়লা পানিতে ডুবে অচেনা হয়ে গেছে। মালপত্র ভিজে গছে। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে পর্যন্ত সেই মালামাল সরাতে পারেননি।

কোথায় নেবেন! বেরুনোর সব রাস্তায় থৈ থৈ পানি! ভ্যান, যানবাহন কিছুই ঢোকানো যাবে না! এখানে জলের যানবাহন নেই। কলের গাড়ি জমানো বৃষ্টির বুকসমান জলে চলার পথ খুঁজে পায়নি কোথাও।

গ্রীন রোডে অনেকগুলো প্রাইভেট হাসপাতাল। সেখানে আগত রোগীদের অবস্থা খুবই করুণভাবে চিত্রিত হয়ে সংবাদে ঠাঁই নিয়েছে সেদিন। ডুবন্ত রিকশাভ্যানে নারী রোগীকে শুইয়ে নিয়ে ঠেলে চলছেন রোগীর আত্মীয়-স্বজনেরা। পাশের ভবনের কৌতূহলী মানুষ শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে ‘আহারে’ বলে অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। ভাগ্যিস! শুক্রবার হওয়ায় সেদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা ছিল না।

এদিন পথে যারই নেমেছেন, তারাই দুর্ভোগে পড়ে গিয়েছেন। বাইকারদের অনেকের ইঞ্জিনে পানি ঢুকে স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেছে। পেটের ধান্ধায় যারা ব্যাটারিরিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন, তাদের বাহন অচল হয়ে যাওয়ায় সেগুলো ঠেলে অন্যখানে সরিয়ে নেওয়ার কোনো উপায় ছিল না।

চিৎকার করে কেউ কেউ বলছিলেন- ‘আমাদের ট্যাক্স, ভ্যাট আদায়ের সময় যারা নিয়ম দেখায়, যারা জরিমানা আদায় করে তারা এখন ঘরে বসে টিভিতে আমাদের কষ্ট দেখে তামাশা করছে! এই তিলোত্তমা নগরে নাগরিক সুবিধা কি সামান্য বৃষ্টির পানিতে ডুবে থাকবে’!

কথা হলো- এই ‘তিলোত্তমা’ কী দেবে তোমায় আমায়! তার কি-বা দেবার আছে! রাজধানী ঢাকাকে বিশেষণ দিয়ে রূপসীর টোলপড়া গালের তিলের সঙ্গে তুলনা করা হয়। এর সৌন্দর্যের মোহে কবি-সাহিত্যকরা কত শত ছড়া-কবিতা লিখেন দিনরাত।

কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর কত মূল্যবান প্রসাধনী কিনে সাজানোর চেষ্টা করেন এর দেহকে। এর একই অঙ্গে উত্তর-দক্ষিণে কত বাহারি আলো শোভা পায়‍ কিন্তু দিনশেষে এত মেকাপ ‘রিমুভ’ করে ঘুমুতে যাওয়া উপায় নেই তার। এজন্য সে নিজেই নিজের সহ্যগুণ হারিয়ে ‘ভালনেরাবল’ বা ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। কিন্তু সেদিকে কারো কোনো নজর নেই।

তবুও প্রতিদিন নতুন নতুন ফেসপাউডার, কাজল, ভারী ভারী গহনা পরানো হচ্ছে। তিলোত্তমার বুক চিরে এত ভারী গহনা পরানোর ফলে এর বুক দুরু দুরু করছে। কানের গহনা কখন কান ছিঁড়ে পড়বে, তার নিরাপত্তা নেই। এর প্রাকৃতিক পঞ্চন্দ্রিয় এখন বন্ধ হয়ে গেছে! এসব কথা আক্ষেপ করে বলছিলন এক প্রবীণ ঢাকাবাসী। তাঁর কাছে ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার প্রাকৃতিক পঞ্চন্দ্রিয় বন্ধ হওয়ার কথা হঠাৎ আঁতকে উঠে জিজ্ঞাসা করলাম- সেটা কেমন!

মানুষের প্রাকৃতিক পঞ্চন্দ্রিয় বন্ধ হয়ে গেলে যদি দ্রুত চিকিৎসা করানো না যায়, তাহলে তার মৃত্যু অনিবার্য! তবে ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার পঞ্চন্দ্রিয় বন্ধ হলো কীভাবে! তিনি জানালেন, ধরুন, এর বাতাসের মান বছরের ১০ মাসই অস্বাস্থ্যকর থাকে। পথে হাঁটতে গেলে নাক, চোখ দিয়ে গরম পানি ঝরে। এখন বর্ষাকাল তাই বায়ুতে একটা স্বস্তি। এর মুখ খোলা। কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, যা দিয়ে প্রতিদিন নতুন নতুন মানুষ, ছাত্র, বেকার, ভাসমান মানুষ ঢুকছে। কেউ একবার ঢুকলে আর বের হতে চায় না।

তবে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো- এর নিচের ইন্দ্রিয় দুটো বর্ষাকালে হঠাৎ করে অকেজো হয়ে পড়ে। যেমন- ধরুন, ভূগর্ভস্থ সুয়্যারেজ লাইন ও নর্দমাগুলোর কথা। এই দুটি ‘তিলোত্তমা’র অতি গুরুত্বপূর্ণ ইন্দ্রিয়। জুলাই ১৩, ২০২৪ তারিখ চার ঘণ্টার বৃষ্টির পানি যদি বাধাহীনভাবে সব নর্দমা দিয়ে বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়তো, তাহলে কি এই ভয়ঙ্কর জলজট হতো!

কিন্তু ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার অতি গুরুত্বপূর্ণ ইন্দ্রিয় সদৃশ নর্দমাগুলোর মুখ বন্ধ হয়ে পড়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান এর নর্দমাগুলোর ভেতরে পাইপ বসিয়ে এর স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে। ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার উন্নয়ন কাজে এত বেশি প্রতিষ্ঠান জড়িত, তা গুনে শেষ করা যাবে না। তাদের মধ্যে কাজের সমন্বয় নেই। কে কখন কাটলো, কে ঢেকে রাখলো, আর কে নর্দমাগুলোর ভেতরে পাইপ বসিয়ে পানি প্রবাহ বন্ধ করে দিলো, তা ঠিকমতো হিসাব রাখার মতো সময় সুযোগ নেই কর্পোরেশনগুলোর।

সুতরাং একটু বৃষ্টি হলেই প্লাষ্টিক, মাটি, কাপড়ের টুকরো, কিচেন গার্বেজ ইত্যাদি দিয়ে এর নিচের ইন্দ্রিয় বা ময়লা নিষ্কাশনের নর্দমা বর্ষাকালে হঠাৎ করে অকেজো হয়ে পড়ে; যার নেতিবাচক প্রভাব এসে পড়ে রাজপথে, অলিতে-গলিতে, বাড়িতে, মার্কেটে। নগরের সব জায়গার সব কার্যক্রম হঠাৎ থৈ থৈ পানিতে সয়লাব হয়ে যায়।

এজন্য কর্পোরেশনগুলোর সার্বক্ষণিক ওয়াচটিম ও মটিভেশন কর্মসূচি থাকা দরকার। একেকটি সার্বক্ষণিক ওয়াচটিমের এক-দুইজন সদস্য একেকটি এলাকার ১০টি করে নর্দমার প্রবাহ পরিষ্কার আছে কিনা তা নজরদারিতে রাখলে এই জলাবদ্ধতা সহজেই নিরাময় করা যাবে!

জাপানের ট্রাফিক যেমন অফিসে বসেই রাস্তার চলন্ত গাড়ি ওয়াচ করে মাসিক বেতন বিলের সঙ্গে জরিমানার বিল কেটে ধরিয়ে দেয় তদ্রুপ আমাদের সিটি কর্পোরেশনের নর্দমা ওয়াচ টিমের দৈনন্দিন কার্যকলাপ সিসি ক্যামেরা ও ড্রোন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ করে জরিমানার বিধান করা যেতে পারে।

‘তিলোত্তমা’ ঢাকার নির্মাণ কাজ সারাবছর জুড়ে চলে। কখনো শেষ হয় না। নির্মাতারা রাস্তার পার্শ্বে বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রী, নুড়িপাথর বর্জ্য ফেলে স্তূপ করে রাখে। একটু বৃষ্টি হলে সেগুলো গড়িয়ে কাছাকাছির ড্রেন বন্ধ করে দেয়। বিভিন্ন পার্ক, পথঘাটের খোলা রেস্টুরেন্টে হরদম পলিথিন প্যাকেটে খাদ্যসামগ্রী বিক্রি হয়। ফুটপাতের দোকান, দর্জিপাড়া ইত্যাদি থেকে প্লাষ্টিক ব্যাগ ও বেশি শক্ত বর্জ্য নর্দমার মধ্যে ফেলা হয়ে থাকে। ওয়াচটিমের মাধ্যমে সেগুলো নিয়মিত সরিয়ে ড্রেনের ময়লা পানির গতিপ্রবাহ দেখে প্রতিদিন রিপোর্ট নেওয়ার নিয়ম থাকা উচিত।
হয়ত অনেক নিয়ম-কানুন হাতে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ‘তিলোত্তমা’র রাস্তায় যেখানে-সেখানে কাগজ, পলিথিন, ইটের টুকরা, আবর্জনার ছড়াছড়ি দেখে এসব কাজের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তাইতো মনে হয়, মাত্র একবেলা বৃষ্টির পানিতে কেন এই বন্যা! গেল অর্থবছরে ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে সাতশ পঞ্চাশ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে বলে একটি জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম হয়েছে। তবু কেন নগর জুড়ে ভয়াবহ জলাব্ধতার দুর্ভোগ কিছুদিন পর পর ঘাড়ে চাপে! এর দায়ভার কার!

‘তিলোত্তমা’ ঢাকা যানজট, জলজট ইত্যাদিতে নিজেই পঙ্গু হয়ে অসাড় হয়ে পড়েছে। বুয়েটের আবাসিকের মতো জায়গায় নগর পরিকল্পনাবিদদের কোয়ার্টারের নিচতলাবাসী এবার জলজটকে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। তারা কেউ কেউ পাম্প দিয়ে ঘরের পানি সেচে বাইরে ফেলার চেষ্টা করেছেন। কেউ সারারাত ঘুমাতে পারেননি। তাদের জন্যও উন্নত নাগরিক সেবা সে রাতে শূন্যের কোটায় নেমে গিয়েছিল।

‘তিলোত্তমা’ ঢাকায় প্রায় প্রতিবছর এই জায়গায় বার বার কাটাছেঁড়া করায় অতি উন্নয়নের ভারে সে ন্যুজ্ব হয়ে পড়েছে। যেমনটি ঘটেছিল পপ তারকা মাইকেল জ্যাকসনের বেলায়। তাঁর দেহের বিভিন্ন অঙ্গে এত বেশি প্লাস্টিক সার্জারি করা হয়েছিল যে, তিনি একসময় চরম হতাশ হয়ে ওষুধ গ্রহণ ছেড়ে দিয়ে একা একা বাঁচার জন্য নিঃসঙ্গ থাকতে চেয়েছেন। তবুও শেষ রক্ষা হয়নি তার। এখন থেকে আমাদের ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার অঙ্গে আর কাটাছেঁড়া না করাটাই উত্তম।

অসুস্থ ‘তিলোত্তমা’র ওপর একসঙ্গে অনেক ব্যাধি ভর করেছে। এ অবস্থায় তার কাছে আর কী নতুন সেবা চাওয়ার আছে আমাদের! তাই, ‘তিলোত্তমা’র ওপর আর শল্য চিকিৎসা না চাপিয়ে উল্লিখিত টোটকা দাওয়াই দিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর আছে বলে মনে হয় না!

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। E-mail: [email protected]

;

সাহিত্য পত্রিকা 'কথার কাগজ'র আত্মপ্রকাশ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সাহিত্য পত্রিকা 'কথার কাগজ'র আত্মপ্রকাশ

ছবি: সাহিত্য পত্রিকা 'কথার কাগজ'র আত্মপ্রকাশ

  • Font increase
  • Font Decrease

শ্রাবণ সংখ্যা আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে শিল্প ও সাহিত্যের ছোট পত্রিকা 'কথার কাগজ'-এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলো।

শুক্রবার (১২ জুলাই) বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মিলনায়তনে 'কথার কাগজ' শ্রাবণ সংখ্যার মোড়ক উন্মোচন করা হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক শাহানারা স্বপ্না, কথাসাহিত্যিক ফরিদুল ইসলাম নির্ঝর, স্টুডেন্ট ওয়েজ প্রকাশনীর প্রকাশক মাশফিক তন্ময়, কথার কাগজের প্রধান সম্পাদক কেতন শেখ, নির্বাহী সম্পাদক অয়ন আব্দুল্লাহ প্রমুখ। পত্রিকাটির বার্ষিক শ্রাবণ, কার্তিক ও ফাল্গুন তিনটি সংখ্যায় প্রকাশ হবে।

মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে কথার কাগজের প্রধান সম্পাদক কেতন শেখ বলেন, 'করোনাকালীন ২০২০ সালে কথার কাগজের জন্ম। সে সময় কয়েকজন প্রবাসী আর দেশি লেখক অনলাইনে ব্লগের মাধ্যমে কথার কাগজের লেখালেখি শুরু করি। তরুণ সাহি- ত্যিকদের সঙ্গে প্রবীণ সাহিত্যিকদের লেখালেখির একটি প্ল্যাটফর্ম হয়ে দাঁড়ায় কথার কাগজ।

প্রকাশক মাশফিক তন্ময় বলেন, 'এক সময় সাহিত্য আন্দোলনের প্রধান বাহন ছিল ছোট পত্রিকা বা লিটলম্যাগ। কিন্তু নানা সংকটে লিটলম্যাগের কলেবর ছোট হয়ে গেছে। প্রকাশকরা অনেকেই অর্থসংকটে তাদের প্রকাশনা বন্ধ করে দিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে অনলাইনের এই যুগে ছাপা কাগজে কথার কাগজের যাত্রা তরুণ লেখকদের অনুপ্রেরণা জোগাবে।'

শাহানারা স্বপ্না বলেন, 'আশা করি, পত্রিকাটি অনেক দূর এগিয়ে যাবে। শ্রাবণ সংখ্যার প্রথম দর্শনে মনে হচ্ছে এটি পাঠকদের সাহিত্যের খোরাক জোগাবে।'

ফরিদুল ইসলাম নির্ঝর বলেন, 'মানুষের ভাষার প্রতি টান থাকলে দেশ ও দেশের বাইরে থেকে কাজ করা যায়, এর উদাহরণ কথার কাগজ। সম্পাদকম- গুলীর তিনজনই দেশের বাইরে থেকে এর যাত্রা শুরু করেন। আজকে দেশে এসেই তারা পত্রিকাটির ছাপা সংস্করণের মোড়ক উন্মোচন করলেন।'

সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান বলেন, 'আমাদের তরুণরা বিদেশ চলে যাচ্ছে, আর ফিরছে না। তবে কথার কাগজের সঙ্গে জড়িতরা বিদেশ থেকে সাহিত্য আর দেশের টানে ফিরে এসেছেন। অনলাইনের যুগে যখন অনেক পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, এ অবস্থায় তারা কথার কাগজের প্রিন্ট ভার্সন নিয়ে এসেছেন। এটি অনেক ভালো লাগার।' নতুন পত্রিকাটি টিকিয়ে রাখতে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

;

লেখক শেখ হাসিনা কোটিপতি হওয়ার পথে!



আবদুল হামিদ মাহবুব
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখালেখির হাত খুব ভালো। তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী হননি তখনই তার একাধিক বই প্রকাশ হয়েছে। সম্ভবত তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই ‘ওরা টোকাই কেন’। ঢাকার আগামী প্রকাশনী থেকে বইখানা বের হয়েছিল। ওই প্রকাশনী থেকে আমারও দু’খানা ছড়ার বই প্রকাশ হয়। ১৯৯১ সালে আমার ‘ডিমের ভিতর হাতি’ যখন প্রকাশ হচ্ছিলো তখন আগামী প্রকাশনীর কর্ণধার ওসমান গনি ভাই শেখ হাসিনার ‘ওরা টোকাই কেন’ এককপি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন।

বইখানা প্রথম না দ্বিতীয় সংস্করণের ছিলো সেটা মনে নেই। ওই বই কয়েকটি নিবন্ধের সংকলন। অধিকাংশ নিবন্ধেই শেখ হাসিনা তাঁর ভিতরের যন্ত্রণার কথা লিখেছিলেন। লিখেছিলেন দেশ ও রাজনীতি নিয়ে তাঁর পরিকল্পনার কিছু কিছু ইঙ্গিত। পড়েছিলাম তো অনেক আগে। তারপরও লেখাগুলোর অনেক বিষয় মনে রয়ে গেছে। প্রতিটি নিবন্ধ পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমার পারিবারিক ছোট লাইব্রেরিতে বইখানা গোছিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু আজ যখন ওই বই খোঁজতে লাগলাম, পেলাম না। অনুমান হচ্ছে আমার বইচোর কোন বন্ধু হয়তো এই বইখানা মেরে দিয়েছেন। অথবা বন্যা অতঙ্কে কয়েকেবার বাসার বইগুলো টানাটানি করার কারণে কোথাও হয়ত খুইয়ে ফেলেছি। তবে আমার ধারণা এই বইয়ের ক্ষেত্রে প্রথমটি ঘটেছে।

প্রধানমন্ত্রীর অনেক বইয়ের মতো ‘ওরা টোকাই কেন’ নিশ্চয়ই বহুল প্রচারিত হয়েছিল, বেরিয়েছিল অনেক অনেক সংস্করণ। আর বই সমূহের রয়্যারিটিও তিনি হাজার হাজার টাকা পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এমন প্রাপ্তি ঘটে থাকলে, আমি একজন লেখক হিসাবে অবশ্যই পুলকিত হই। আমি দেখেছি সেই ১৯৯১ সালের পর থেকে আগামী প্রকাশনীর প্রকাশনা ব্যবসারও অনেক উন্নতি হয়েছে। ব্যবসার উন্নতি ঘটার অর্থ প্রকাশকের উন্নতি ঘটা। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি আগামী প্রকাশনীর কর্ণধার ওসমান গনি ভাইয়ের আর্থিক অবস্থা অনেক অনেক ভালো হয়েছে।

পূর্বে দেখতাম একুশের বইমেলায় আগামী প্রকাশনী ছোট্ট স্টল নিত। এখন প্যাভিলিয়ন নেয়। লাখ লাখ টাকা খরচ করে প্যাভিলিয়নের অঙ্গসজ্জা করা হয়। নিশ্চয় বইয়ের ব্যবসা ভালো হয়। সেকারণেই বইমেলার প্যাভিলিয়ন তৈরিতে বিনিয়োগও বেশি করেন। প্রতিবছরই আগামী প্রকাশনীর কোন না কোন বই কেনার জন্য পাঠকের লাইন পড়ে। পাঠক যখন যে কোন লেখকের বই কেনে, সেটা দেখে আমি একজন লেখক হিসাবে আনন্দিত হই। বইয়ের ব্যবসার উন্নতি হোক। প্রকাশকরা ভালো লাভ করুন, আমি মনে প্রাণে সেটা চাই।

অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, প্রকাশকের লাভ হলে আমার মতো মফস্বলের লেখকরা কি লাভমান হই? অবশ্যই যৌক্তিক প্রশ্ন। এর জবাব খুব সংক্ষিপ্ত। প্রকাশকরা যখন বই প্রকাশ করে লাভের মুখ দেখবেন, তখন তারা নতুন নতুন বই প্রকাশে আগ্রহী হবেন। নতুবা আমাদের মতো লেখকদের প্রকাশককে উল্টো টাকা দিয়ে বই প্রকাশ করিয়ে নিতে হবে। এবং আমরা অনেকেই সেটা করছিও।

অনেকে আবার এও বলেন ডিজিটালের এই যুগে এখন আর কেউ বই কিনে পড়ে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে টুকটাক পড়েই তাদের পড়া শেষ করেন। সেই কারণে লেখকরা গাঁটের টাকা খরচ করে বই প্রকাশ করলেও সেগুলো বিক্রি হয় না। আমি এই অপবাদটা মানতে নারাজ। কারণ আমি দেখেছি কেবল ফেব্রুয়ারি মাসেই বইমেলা চলাকালে শত শত কোটি টাকার বই বিক্রি হয়। আর যারা পড়ুয়া, তারা সারা বছরই খোঁজে খোঁজে রকমারি, প্রথমা, আগামী, শ্রাবণ, ইউপিএলসহ বিভিন্ন আনলাইন বই বিক্রয় প্রতিষ্ঠান থেকে বই আনান।

আমি মফস্বলের একটি শহরে থাকি। আমাদেরে শহরে বইয়ের দোকান আছে অনেক। সেগুলোতে স্কুল কলেজের পাঠ্য ও গাইড বই ছাড়া অন্য বই খুব কমই দেখা যায়। সৃজনশীল বলুন আর মননশীল বলুন, সেইরকম বইয়ের দোকান খুব একটা নাই। আমাদের শহরে প্রকাশনা ব্যবসার সাথে ‘কোরাস’ নামে একটি দোকান চালান বই পাগল এক যুবক মুজাহিদ আহমদ। তাঁর কোরাসেই আমাদের মত পাঠকের উপযোগী কিছু কিছু বই আসে। কিন্তু সবসময় কোরাসও আমাদের মতো পাঠকদের চাহিদার যোগান দিতে পারে না। তারপরও মন্দের ভালো হিসাবে দোকানটি টিকে আছে, টিকে থাক্।

আমাকে প্রায়ই অর্ডার করে ‘রকমারি’ থেকে বই আনাতে হয়। আমার আনানো বই ছাড়িয়ে আনার জন্য আমি নিজে প্রায়ই কুরিয়ার অফিসে যাই। আমি যেদিনই কুরিয়ার অফিসে গিয়েছি, দেখেছি কেবল আমার বই নয়, আমার মতো আরও অন্তত বিশ থেকে পঁচিশ জনের বইয়ের প্যাকেট এসেছে। কুরিয়ার অফিসের লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জেনেছি, প্রতিদিনই এভাবে কিছু না কিছু বই নানাজনের নামে আসে। আর আমার নিজের চোখে দেখাটাকেওতো বিশ্বাস করতে হবে। মানুষ যদি বই নাই পড়বে তবে কেনো রকমারি কিংবা অনলাইনের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে এতো এতো বইয়ের প্যাকেট আসবে? আমি বলবো বইয়ের পাঠক মোটেই কমেনি বরংচ বেড়েছে।

শুরু করেছিলাম আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বইয়ের প্রসঙ্গ দিয়ে। বই প্রসঙ্গেই বলতে গিয়ে অন্য প্রসঙ্গও এসে গেল। আমাদের শহরের সেই যে ‘কোরাসে’র কথা বলেছি; ক’দিন আগে এক দুপুরবেলা কোরাসে গিয়ে বই দেখছি। এসময় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুইজন প্রধান শিক্ষক কোরাসে এসে ঢুকলেন। তাদের দু’জনের হাতেই বেশ বড় সাইজের চারখানা করে বই। ওই দুই প্রধান শিক্ষক আমার পূর্ব পরিচিত। তাদের হাতে বই দেখে আমি উৎফুল্ল হলাম। কি বই? কোথা থেকে আনলেন? এমন প্রশ্ন করে বইগুলো দেখতে চাইলাম। দু’জনই ক্ষোভ প্রকাশ করে আমার সামনে টেবিলের উপর ধাম্ ধাম্ করে বইগুলো রাখলেন। একজন বললেন, ‘‘আমাদের বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের পড়ার জন্য এই বইগুলো নগদ চব্বিশ’ টাকা দিয়ে কিনে এনেছি। বলুন ছাত্ররা এই বই পড়তে পারবে? তারা কি কিছু বুঝবে?’’ অন্য প্রধান শিক্ষকের চেহারায় তখনও বিরক্তি রয়ে গেছে। তিনি বললেন, ‘বইগুলো দেখুন, আপনি লেখক মানুষ, আপনিও কিছু বলুন।’

আমি তাদের আনা বইয়ের দিকে মনোযোগ দিলাম। দেখি চার চার আটখানা বই, দুটি বিষয় নিয়ে করা হয়েছে। প্রচ্ছদে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ছবি। বইগুলোর লেখক আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একটি বইয়ের নাম ‘সকলের তরে সকলে আমরা’। এই বইয়ে প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ ও ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত যে ভাষণগুলো দিয়েছেন সেগুলোর বাংলা ও ইংরেজি সংকলন। অপর বইয়ের নাম ‘আহ্বান’। এই বই করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত জাতির উদ্দেশে যেসব ভাষণ দিয়েছেন সেগুলো সংকলিত করে।

দু’খানা বইয়ের-ই কাগজ, ছাপা, বাঁধাই খুবই উন্নত মানের। প্রতি কপি বইয়ের মূল্য ছয়শত টাকা। প্রত্যেকটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লাইব্রেরির জন্য প্রতিটি বইয়ের দুই কপি করে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস বিক্রি করেছে। প্রধান শিক্ষকরা এই বইগুলো কিনে নিতে বাধ্য। চারখানা বইয়ের জন্য প্রধান শিক্ষকদের দুই হাজার চারশত টাকা করে অফিসের সংশ্লিষ্ট ক্লার্কের কাছে পরিশোধ করতে হয়েছে। বুঝতে পারি টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে বলেই এই দুই প্রধান শিক্ষক ক্ষুব্ধ। আমি শিক্ষকদের অনুমতি নিয়েই একটি বিদ্যালয়ের জন্য আনা চারখানা বইয়ের ছবি উঠিয়ে নিলাম। এই সময় কোরাসের কর্ণধার মুজাহিদ আহমদ বললো, ‘ভাই, আমি এমন একখান বই প্রকাশের অনুমতি পেলে কোটিপতি হয়ে যেতাম।’

আমি ওই দুই প্রধান শিক্ষককে উদ্দেশ্য করে বললাম; ‘প্রধানমন্ত্রীর বই প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাচ্ছে, এটাতো আনন্দের বিষয়। কিন্তু আমারও প্রশ্ন হচ্ছে বইগুলো কি প্রাথমিকের ছাত্রছাত্রীদের জন্য উপযোগি? আর প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রিয় এইসব ভাষণ বই আকারে করাটা তো সরকারি খরচেই হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, উচ্চ বিদ্যালয় ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লাইব্রেরিগুলোতে দিতে হলে বিনামূল্যে দেওয়ার কথা। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ সংকলন টাকার বিনিময়ে কিনতে হবে কেনো?’

তখন একজন বললেন; ‘ভাই, এই বই রাষ্ট্রিয় ভাবে হয়নি। ব্যবসার জন্য প্রধানমন্ত্রীর আশপাশের এক দু’জন প্রকাশনীর মাধ্যমে প্রকাশ করে আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তারা কোটি কোটি টাকা কামাই করে নিচ্ছেন।’ উনার কথায় আমি বইয়ের প্রথম দিকের পাতা উল্টালাম। ঠিকইতো প্রকাশক ‘জিনিয়াস পাবলিকেশন্স’-এর মো. হাবিবুর রহমান। দু’খানা বইয়েরই গ্রন্থনা ও সম্পাদনা মো. নজরুল ইসলাম, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার (সচিব)। খেয়াল করে দেখলাম বই দু’খানার কপিরাইট শেখ হাসিনা। বুঝতে পারি যে এই বইগুলোর যে রয়্যালিটি আসবে সেটা আমাদের প্রধানমন্ত্রীই পাবেন।

এখন একটা হিসাব করে দেখি। বাংলাদেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৬শ ২০টি। এই বই যখন প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে বাধ্যতামূলক কিনতেই হবে, তা হলে ৪ কপি করে বই বিক্রি হবে উল্লেখিত বিদ্যালয়গুলোতে ২ লাখ ৬২ হাজার ৪শ ৮০ কপি। এই বইয়ের মূল্য থেকে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের হাতে টাকা আসবে ১৫ কোটি ৭৪ লাখ ৮৮হাজার। বইয়ের কপিরাইট অনুযায়ী শতকরা ১৫ ভাগ রয়্যালিটি নিলেও আমাদের প্রধানমন্ত্রী পাবেন ২ কোটি ৩৬ লাখ ২৩ হাজার ২শ টাকা। হিসাবে কিন্তু আমার মাথা ঘুরে গেছে। বই থেকে এমন অঙ্কের রয়্যারিটি এদেশে আগে কেউ পেয়েছেন কি না আমি জানি না।

আর এটাতো আমি কেবল প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বিক্রির হিসাব দিলাম। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লাইব্রেরির জন্য যখন বাধ্যতামুলক করা হয়েছে, তবে তো উচ্চ বিদ্যালয়, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়েও এই বইগুলো এভাবেই বিক্রি হবে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যুক্ত করলে আরো কতো কতো হাজার বেড়ে যাবে। আমি হিসাব বাড়ালে অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারি।

আমার ঘরেও একজন প্রধান শিক্ষক আছেন। লেখাটার পূর্ণতার জন্য তার কাছে কিছু তথ্য জানতে চেয়েছিলাম। তিনি খ্যাক্ করে উঠে বললেন, ‘স্কুল আমি চালাই। আমার স্কুলের জন্য কখন কি ভাবে কি কিনবো না কিনবো সেটা তোমাকে বলবো কেনো?’ দেখলাম ঘাটাতে গেলে আবার কি থেকে কি হয়ে যায়। তাই কথা না বাড়িয়ে লেখা শেষ করার দিকেই মনোযোগ রাখলাম।

আমরা যারা লেখক আমাদের মধ্যে একটা কথা প্রচলিত আছে যে, প্রকাশকরা লেখকদের ঠকান। তারা ঠিক মতো লেখকের পাওনা রয়্যালিটি পরিশোধ করেন না। তাই বলে কি প্রধানমন্ত্রীকে ‘জিনিয়াস পাবলিকেশন্স’-এর মো. হাবিবুর রহমান ঠকানোর সাহস করবেন? নিশ্চয় না। এই ভরসাতেই বলতেই পারি বই বিক্রির অর্থে আমাদের লেখক শেখ হাসিনা কোটিপতি হবার পথে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, ছড়াকার

ইমেইল: [email protected]

;

দশ টাকার শোক



মনি হায়দার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

প্রায় পনেরো মিনিট ধরে মানিব্যাগটা উল্টেপাল্টে দ্যাখে রজব আলী।

মানিব্যাগটা খুব পছন্দ হয়েছে তার। বিশেষ করে মানিব্যাগটার বাদামি রংটা। ব্যাগটা চামড়ার তৈরি। রজব আলী নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শোকে। বোঝা যায় না কোন্ পশুর চামড়ায় মানিব্যাগটা তৈরি হয়েছে। মানিব্যাগটার ভেতরে অনেকগুলো ছোট ছোট কুঠরি। রজব আলী কল্পনায় দেখতে পায়- মানিব্যাগটার ভিতরে রাখা টাকায় ভেতরের কুঠুরিগুলো ভরে উঠেছে।

ব্যাগটা প্যান্টের পকেটে নিয়ে যখন হাঁটবে পিছটা ফুলে যাবে, মুহূর্তেই শরীরের কোষে কোষে একটা অন্যরকম অহমিকা অনুভব করে সে।

ভাই, মানিব্যাগটার দাম কতো ? রজব আলী মানিব্যাগঅলাকে জিজ্ঞেস করে।

ব্যাগঅলা রজব আলীর উপর মনে মনে চটে উঠেছে। সেই কতোক্ষণ থেকে ব্যাগটা উল্পেপাল্টে দেখছে। কেনার কথা বলছে না। অথচ রজব আলীর দেখার মধ্যে দুটো ব্যাগ সে বিক্রি করেছে। ফুটপাতের জিনিস এতক্ষণ নাড়াচাড়া কেউ করে না। ব্যাগঅলা রাগ করে কিছু বলতেও পারে না। যদি কেনে ?

আপনি নেবেন ? রজব আলীর দাম জিজ্ঞাসায় ব্যাগঅলা পাল্ট প্রশ্ন ছোড়ে। কারণ রজব আলীকে দেখে তার মনে হয় না এই লোক মানিব্যাগ কিনবে।

রজব আলী একটি বহুজাতিক কোম্পানির অফিসের পিওন। পরনের পোশাকে ঐ বহুজাতিক কোম্পানির পরিচয় আছে। ব্যাগঅলার ধারণা এইসব লোকজন সাধারণত মানিব্যাগ-ট্যাগ কেনে না। তাদের সামান্য টাকা আয়, কোনোভাবে সেই পয়সায় মানিব্যাগ কেনার মানসিকতা বা প্রয়োজনীয়তাও থাকে না।
নেবো।

ইতোমধ্যে ব্যাগঅলার সামনে দামি প্যান্টশার্ট পরা একজন ভদ্রলোক এসেছে। সঙ্গে তন্বী তরুণী। তাদের আসায় চারপাশের আবহাওয়ায় বিদেশী সেন্টের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। ভদ্রলোকের কাছে রজব আলী অযাচিতভাবে হেরে যায়। বাস্তবতার কারণে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়াতে হয় তাকে।

তন্বী তরুণী ও ভদ্রলোক মিলে কয়েকটা মানিব্যাগ দেখে। বাছাই করে। অবশেষে তন্বীয় কথানুযায়ী ভদ্রলোক তিনশো পঁচিশ টাকায় একটা মানিব্যাগ নিয়ে চলে গেলো। মাত্র তিন-চার মিনিটের মধ্যে তারা মানিব্যাগ দেখলো, দাম করলো, কিনলো এবং চলেও গেলো। অথচ রজব আলী বিশ-পঁচিশ মিনিচের মধ্যে মধ্যে দামটাও জানতে পারলো না ! তারা চলে যাওয়ার পর রজব আলী ব্যাগঅলার কাছে যায়।

বললেন না কতো দাম ?

রজব আলীর দিকে আড়চোখে তাকায়, মানিব্যাগ আপনার পছন্দ হয়েছে?

পছন্দ না হলে দাম জিজ্ঞেস করবো কেনো ?

একশো আশি টাকা।

একশো আশি টাকা। রজব আলী মুখ থেকে বিপন্ন শব্দগুলো বের হয়।

বিরক্তি প্রকাশ করে ব্যাগঅলা, অবাক হওয়ার কি আছে? আপনার সামনেই তো দেখলেন তিনশো পঁচিশ টাকায় একটা মানিব্যাগ বিক্রি করেছি। ঠিক আছে আপনি ঐ সোয়াশ টাকাই দেন।
সোয়াশ টাকা একটা মানিব্যাগের দাম ! রজব আলীর বিস্ময় কোনো বাঁধা মানে না।

ব্যাগঅলা বুঝতে পারে রজব আলী এতো টাকায় ব্যাগ কিনবে না। সবাইতো ঐ টাকাঅলা ভদ্রলোক নয়, বেশি দাম-দর না করেই তাদের হাকানো দামেই কিনবে। রজব আলীরা তো মানিব্যাগই কেনে না। সেখানে রজব আলী যে কিনতে এসেছে সেটাই অনেক। ব্যাগঅলা মানিব্যাগ বিক্রি করলেও তার পকেটে মানিব্যাগ থাকে না। নিজের সঙ্গে রজব আলীর সাদৃশ্য দেখতে পায় ব্যাগঅলা। একই কাতারের ঠেলা-গুতা খাওয়া মানুষ তারা। লোকটাকে ঠকিয়ে লাভ নেই। হয়তো অনেক আশা করে সারা জীবনে একবার একটা মানিব্যাগ কিনতে এসেছে।

আপনি সত্যিই কি মানিব্যাগটা কিনবেন ? নরম কণ্ঠে ব্যাগঅলা জানতে চায়।

কিনবো বলেই তো পছন্দ করেছি। দাম জানতে চাইছি।

তাহলে শোনেন ভাই, অনেক্ষণ ধরে আপনি মানিব্যাগটা দেখছেন, ফাইনাল কথা বলে দিচ্ছি, মানিব্যাগটা আপনি আশি টাকায় নিতে পারবেন। আশি টাকার এক টাকা কমেও বিক্রি করবো না।
রজব আলীর এই মুহূর্তে ব্যাগঅলাকে খুব কাছের মানুষ মনে হয়। কোথায় একশো আশি টাকা, সেখান থেকে একশত পঁচিশ এবং সবশেষে পুরো শতকই নেই; কেবল আশি টাকা। সে পকেট থেকে টাকা বের করে দিয়ে মানিব্যাগটা পকেটে রাখে। মানিব্যাগটা পকেটে রাখার সঙ্গে সঙ্গে রজব আলী নিজেকে একজন দামি মানুষ ভাবে। তার পকেটেও অনেকের মতো মানিব্যাগ আছে।

দীর্ঘদিনের একটা আকাক্ষা, একটা স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলো রজব আলীর। মানিব্যাগ কেনার একটা সিগারেট কেনে। সাধারণত সে সিগারেট টানে না। কিন্তু এই মুহূর্তে একটা সিগারেট টানার ইচ্ছে হলো তার। না, কেবল সিগারেটই নয়, একটা ঝাল দেওয়া পানও কিনলো এবং মুখে দিয়ে পরম আয়াসে চিবুতে লাগলো। সিগারেটটা ধরিয়ে পান চিবুতে চিবুতে রজব আলী একটা রিকশায় উঠলো। পর পর তিনটি কাজ সে করলো-যা সে খুবই কম করে। সিগারেট টানা, পান খাওয়া এবং রিকশায় করে বাসায় ফেরা। তার জীবনেএকটুকুই শ্রেষ্ঠ বিলাসিতা। রিকশা ছুটে চলেছে।

রজব আলীর মাথার কোষে, যেখানে স্বপ্ন বিলাসী বা ইচ্ছের রক্তকণিকা থাকে- সেখানে মানিব্যাগ কেনার শখ জাগলো প্রায় মাস তিনেক আগে। সে, অফিসের বড় সাহেবের ব্যক্তিগত পিওন। চা, চিনি, সিগারেট থেকে শুরু করে যা কিছু দরকার সবই আনে রজব আলী। দীর্ঘদিনের চাকরির কারণে সে বড় সাহেবের খুব বিশ্বস্ত ও অনুরাগী। অফিসে প্রতিদিন অনেক মেহমান আসে।

নানান কিসিমের মানুষের আনাগোনা বড় সাহেবের কাছে। এইসব মেহমান আসলেই বড় সাহেব বেল টিপে রুমের বাইরে হাতলবিহীন চেয়ারে অপেক্ষায় থাকা রজব আলীকে ডাকেন। রজব আলী ত্রস্ত খরগোশের মতো ভেতরে ঢোকে। কিন্তু ঢুকেই খরগোশের মতো মাথা উঁচু রাখতে পারে না। কোথাকার কোন এক অদৃশ্য অপরিমেয় শক্তি এসে তার মাথাটাকে নিচু করে দেয়।

তার দাঁড়ানো পর বড় সাহেব বড় অবহেলায়, নিপুণ নৈপুণ্যে, গাম্ভীর্যের কৌশলী পারম্পর্যে অবলীলায় প্যান্টের ডান দিক থেকে মোগল সম্রাটদের ক্ষমতায় মানিব্যাগটা বের করে টেবিলে রাখেন। মেহমানবৃন্দ গভীর অভিনিবেশে বড় সাহেবের কর্মকান্ড দেখতে থাকেন। মানিব্যাগটা টেবিলে রেখেই বড় সাহেব টেবিলের অন্যপ্রান্তে রাখা দামি সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে পরম আদরে রাখেন এবং তৎক্ষণাৎ লাইটার জ্বালিয়ে সিগারেট টানেন আয়েসের সঙ্গে।

সিগারেটে দু’-দিনটি টান দিয়ে দুই ঠোঁটের মাঝখানে আটকে রেখে মানিব্যাগটা তোলেন ডান হাতে। মানিব্যাগটা টাকার কারণে সবসময় পোয়াতি নারীর মতো ফুলে থাকে। বড় সাহেবের মানিব্যাগে টাকাগুলো অধস্তন, পরাধীনভাবে নিবিড় শুয়ে থাকতে পছন্দ করে। একহাজার, পাঁচশ, একশ, পঞ্চাশ টাকার অসংখ্য নোট সাজানো পাশাপাশি। দেখতে কতো ভালো লাগে ! রজব আলী দেখে। দেখেই তার আনন্দ।

বাম হাতে মানিব্যাগটা ধরে ডান হাতের দুই আঙ্গুলে বড় সাহেব বেশ কয়েকটা নোট বের করেন। একটা নোট রজব আলীর দিকে বাড়িয়ে দেন, শীগগির নাস্তা নিয়ে আয়।

রজব আলী বিনয়ের সঙ্গে টাকাটা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। এবং নাস্তার আয়োজনে নিদারুণভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এইভাবেই রুটিন চলছিলো। হঠাৎ মাস তিনেক আগে রজব আলীর মাথায় এই প্রশ্নটা উঁকি দেয়- বড় সাহেবের গাড়ি বাড়ি টাকা মান-সম্মান ক্ষমতা আছে। রজব আলীর কিছুই নেই। কিন্তু একটা মানিব্যাগতো থাকতে পারে। আর যাই হোক বড় সাহেবের মতো মানিব্যাগ থেকে সেও টাকা বের করে বাস কন্ডাকটর, চালের দোকানদার, মাছঅলা, ডালঅলাদের দিতে পারবে।

এই ভাবনা, স্বপ্ন এবং কল্পনার পথ ধরে কয়েকমাস যাবৎ রজব আলী চেষ্টা করে আসছে একটা মানিব্যাগ কেনার। নানা কারণে হয়ে ওঠেনি। বৌয়ের শরীর খারাপ- ডাক্তারের টাকা দেওয়া, ছেলেমেয়েদের স্কুলের বেতন, বই খাতা কেনা- যাবতীয় সাংসারিক কাজের চাপে মানিব্যাগ কেনা সম্ভব হয়নি। আজকে সে বেতন পেয়েছে। এবং সমস্ত চাপ উপেক্ষা করে রজব আলী মানিব্যাগটা কিনেই ফেললো। আসলে কখনো কখনো একটু-আধটু রিস্ক নিতেই হয়। নইলে ছোটখাট স্বাদ-আহ্লাদ পূরণ হবার নয়।

রিকশায় বসেই সে জামার বুক পকেট থেকে বেতনের বাকি টাকাগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে মানিব্যাগে। মানিব্যাগটার পেট ফুলে যায়। হাতে নিয়ে তার দারুণ ভালো লাগে। কিছুক্ষণ হাতে রাখার পর রজব আলী মানিব্যাগটাকে পিছনে প্যান্টের পকেটে রাখে। ঘাড় ঘুরিয়ে সে প্যান্টের পিছন দিকটা ফিরে ফিরে দ্যাখে- কতোটা ফুলে উঠলো ? তেমন না। যেভাবে বড় সাহেবের পিছন দিকটা ফুলে থাকে, সে রকম নয়। রজব আলীর মনটা খারাপ হয়ে গেলো।

রিকশা বাসার কাছে আসলে সে ভাড়া মিটিয়ে নেমে যায়। তার মনের মধ্যে ছোট সুখের একটা ছোট পাখি ডানা মেলেছে। গানের সুর ভাজতে ভাজতে রজব আলী দেড় কামরার স্যাঁতস্যাঁতে বাসায় ঢোকে। সে ঢুকলো সংসারে, তাতে সংসারের কিছু যায় আসে না। সংসারটা তার কাছে সীমাহীন অন্ধগলির মোড়। যেখানে অভাব দারিদ্র ক্ষুধার চাহিদা কুমিরের হা মেলে থাকে, সেখানে তার মতো একজন রজব আলীর আসা না আসায় কিছুই যায় আসে না। রজব আলী স্ত্রী মকবুলা বেগম চতুর্থ সন্তান, যার বয়স মাত্র তিনমাস তাকে মাই খাওয়াচ্ছে।

অন্যান্যরা মেঝেতে জটলা পাকাচ্ছে একটা পুরোনো ক্যারামের গুটি নিয়ে। মকুবলা বেগম ঘাড় ফিরিয়ে রজব আলীকে একবার দেখে আবার মাই দিতে থাকে। রজব আলী কি করবে ভেবে পায় না। সাধারণত বেতন নিয়ে বাসায় ফিরলে তরিতরকারি, চাল, ডাল, লবণ, তেল, সাবান, দুই এক প্যাকেট সস্তা বিস্কুট সঙ্গে নিয়ে আসে রজব আলী। আজকে একবারে অন্যরকম একটা জিনিস এসেছে- যার প্রতি তার নিজের মমতা অনেক। সংসারে অন্যদের প্রতিক্রিয়া কি হবে বুঝতে পারছে না।

শুনছো ? রজব আলী স্ত্রীকে ডাকছে।

কনিষ্ঠতম সন্তানের মুখ থেকে মাই সরাতে সরাতে সাড়া দেয় মকবুলা বেগম, কি ?

একটা জিনিস এনেছি।

মকবুলা বেগম সরাসরি তাকায় রজব আলীর দিকে, কি এনেছো ?

অদ্ভুত একটা হাসি রজব আলীল ঠোঁটে, একটা মানিব্যাগ।

দ্রুত ব্যাগটা বের করে মকবুলা বেগমের হাতে দেয় রজব আলী। ব্যাগটা হাতে নিয়ে কয়েক মুহূর্ত স্থানুর মতো বসে থাকে মকবুলা বেগম। একবার কোটরের চোখ দিয়ে তাকায় রজব আলীর দিকে। দৃষ্টি ফিরিয়েই ব্যাগটা অবহেলায় রেখে দেয় সে, মানিব্যাগ ফুটাতে কে বলেছে তোমাকে! বেতন পেয়েছো আজ না ?

বেতন পেলে আর মাথা ঠিক থাকে না। মকবুলা বেগমের লং প্লে রেকর্ড বাজা আরম্ভ হলো, বাসায় কিছু নাই। অফিসে যাবার সময় বললাম, ফিরে আসার সময় ছোট বাচ্চাটার জন্য এক কৌটা দুধ এনো। বড় ছেলেটার খাতা পেন্সিল নেই- নিয়ে এসো। তার কোনো খবর নেই। উনি নিয়ে এলেন মানিব্যাগ। ছেলেমেয়ে বৌয়ের মুখে তিন বেলা ভাত জোটাতে পারে না, উনি মানিব্যাগ কিনে ভদ্দরলোক হয়েছেন! কানার আবার স্বপ্ন দেখার শখ!

রজব আলীর মন শরীর স্বপ্ন আকাক্ষাগুলো শাঁখের করাতে কাটছে এখন। হায়, সংসারের জন্য ব্যক্তিগত দুই-একটা স্বপ্নও কি পূরণ করা যাবে না ! সকাল থেকে রাত পর্যন্ততো সংসারের সুখের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। সামান্য একটা মানিব্যাগের জন্য স্ত্রী এমনভাবে শ্লেষের কথা বলে-একেক সময় মনে হয় রজব আলী আত্মহত্যা করে। পারে না।

স্ত্রীর শান দেওয়া কথার বান থেকে আপাতত রক্ষা পাবার জন্য না খেয়ে বাইরে চলে আসে রজব আলী। এভাবেই সে অক্ষমতার জ্বালা, বেদনা ও ক্ষরণকে তাড়িয়ে থাকার চেষ্টা করে। রাস্তায় দোকানে এখানে সেখানে ঘন্টাখানেক ঘোরাঘুরি করে আবার মকবুলা বেগমের সংসারেই ফিরে আসে। পরের দিন রজব আলী যথারীতি অফিসে।

অফিসের লোকজনের কাছে মানিব্যাগটা দেখায়। কেউ দেখে, কেউ আগ্রহবোধ করে না।

বল তো বারেক, অফিসের আরেকজন পিওনকে ডেকে জিজ্ঞেস করে রজব আলী- মানিব্যাগটা কেমন হয়েছে ?

বারেক মানিব্যাগটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে- ভালো। খুব ভালো হয়েছে। কতো টাকায় কিনেছো ?
প্রচ্ছন্ন গর্ব রজব আলীর, তুই বল।

আমি কেমনে বলবো ?
অনুমানে।
বারেক কয়েক মুহূর্ত ভেবে বলে, ত্রিশ-চল্লিশ টাকা।

তোর বাপের মাথা! ধমকে ওঠে রজব আলী। এ রকম একটা মানিব্যাগ জীবনে চোখে দেখেছিস ? কেমন রং এটার ! ভেতরে কতোগুলো ঘর আছে জানিস ! একহাজার, পাঁচশ, একশো, পঞ্চাশ টাকার নোট রাখার আলাদা আলাদা জায়গা আছে। তাছাড়া এই ব্যাগটা বিদেশী। দেশী না।

তোমার মানিব্যাগের যতো দামই থাক, তুমি বাপ তুলে কথা বলবে ? বারেকের আত্মসম্মানে সামান্য ঘা লাগে।

বলবো না, হাজার বার বলবো। এতো শখ করে একশ টাকা দিয়ে একটা মানিব্যাগ কিনলাম। আর তুই কিনা বলিস মাত্র ত্রিশ-চল্লিশ টাকায় কিনেছি ! জানিস, এই রকম মানিব্যাগ আছে আমাদের বড় সাহেবের।

হতেই পারে। আমার তো মানিব্যাগ নেই। কখনো ছিলোও না। তাই দাম জানি না। কিন্ত তুমি একটা একশো টাকা মানিব্যাগে জন্য বাবা তুলে কথা বলতে পারো না-

বারেক যখন মানিব্যাগ সংক্রান্ত তর্কে হেরে যাচ্ছিলো, তখনই বড় সাহেব অফিসে ঢোকেন সঙ্গে কয়েকজন বন্ধু মেহমান নিয়ে। বারেক চট্ করে সরে যায়। রজব আলী দ্রুত দরজা খুলে দাঁড়ায়। বড় সাহেব সঙ্গীদের নিয়ে রুমে ঢোকেন। রজব আলীকে চা আনতে বলেন বড় সাহেব। শুরু হয় রজব আলীর দৌড়।

কয়েকদিন পর বড় সাহেব অফিসে কয়েকজন ক্লায়েন্টের সামনে বসে রজব আলীকে ডাকেন, রজব আলী?

জ্বী স্যার ?
তোমার হয়েছে কি ?

রজব আলী ভেবে পায় না তার কোথায় কখন কি হয়েছে ? ডানে বামে উপরে নিচে তাকায় সে, কই স্যার-কিছু হয় নাইতো।
তোমার হাতে মানিব্যাগ কেনো ?

এই কথার কি জবাব দেবে রজব আলী? হঠাৎ মগজের কোষ কোনো কাজ করে না। সে বুঝে উঠতে পারে না- তার হাতে মানিব্যাগ থাকলে বড় সাহেবের অসুবিধা কি ? কক্ষের সবাই রজব আলীর দিকে চেয়ে আছে। এক অনিশ্চয়তার মুখোমুখি। হঠাৎ রজব আলী উপলব্ধি করতে পারে- মানিব্যাগটা থাকার কথা প্যান্টের পকেটে। হাতে নয়। এবং তার আরো মনে পড়লো মানিব্যাগটা কেনার পর থেকে, বিশেষ করে অফিস করার সময় মানিব্যাগটা কারণে-অকারণে তার হাতেই থাকে। কেন থাকে ?

সে কি সবাইকে তার সদ্য কেনা মানিব্যাগটি দেখিয়ে তৃপ্তি পেতে চায় ? যা প্রকারান্তরে অক্ষম অথর্ব মানুষের করুণ মনোবিকৃতি ? নিশ্চয়ই তার অবস্থা দেখে বড় সাহেব, তার পরিষদবর্গ, অফিসের লোকজন হাসছে। রজব আলী নিমিষে নিজেকে বায়ুশূন্য ফাটা একটা পরিত্যাক্ত বেলুন হিসাবে নিজেকে আবিষ্কার করে। লজ্জায় বালুর সঙ্গে সে মিশে যেতে চাইছে। কিন্তু মানুষের পক্ষে মুশকিল হচ্ছে- সে ইচ্ছে করলেই বালু বা বায়ুর সঙ্গে মিশে যেতে পারে না। মানুষ হিসাবে তাকে অনড় ও অবিচল থাকতে হয়।

বড় সাহেবের মুখে অদ্ভুত হাসি- রজব ?

জ্বী স্যার ?
মানিব্যাগটা কবে কিনেছো ?

রজব আলী জবাব দেয় না। দিতে পারে না। ভেতরের কে একজন যেন রজব আলীকে থামিয়ে দিয়েছে। যে রজব আলীর ওষ্ঠ জিহ্বা কণ্ঠ ভেতরের ক্ষুধিত শক্তিকে পাথর বানিয়ে জমাট করে রেখেছে। প্রাণপণে চেষ্টা করছে কথা বলতে। পারছে না। সে মাথাটা নিচু করে দাঁড়িয়ে। কথা বলছো না কেন ? বড় সাহেবের কণ্ঠে এখন কর্তৃত্ব ও অপমানের সুর।

ঢোক গিলে জবাব দেয় রজব আলী- কয়েক দিন আগে।

কতো টাকায় ?

একশ টাকা।

তাই নাকি ! দেখি, বড় সাহেব হাত বাড়ান।

রজব আলী সারা জীবনের সমস্ত অভিশাপ নিজের মাথায় ঢালে-কেন সে মানিব্যাগ কিনতে গেলো ? কিনলোই যদি তাহলে পকেটে না রেখে হাতে রাখার প্রয়োজন হলো কেন ? দেখাতে চেয়েছিলো বড় সাহেবকে ? বড় সাহেবের মানিব্যাগ থাকলে পারলে তার থাকবে না কেন ? প্রতিযোগিতা ? কি অসম প্রতিযোগিতা ? কি ভয়ংকর গ্লানিকর পরাজয় !

কই দাও, বড় সাহেবের হাতটা তখনো বাড়ানো। নিন।

রজব আলী ব্যাগটা দিয়ে বেরিয়ে যেতে চায়।

কোথায় যাও? তোমার মানিব্যাগ নিয়ে যাও-

আর যেতে পারে না সে কক্ষের বাইরে। কক্ষের ভিতরে রজব আলীর শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। বড় সাহেব মানিব্যাগটাকে উল্টেপাল্টে দেখেন। কক্ষের অন্যান্য সবাই বড় সাহেবের হাতের ব্যাগটাকে তীর্যক চোখে দেখছে। কেউ কেউ হাসছে। সে হাসির ভেতরে লুকিয়ে আছে তীক্ষ্ন কাঁটা। কাঁটায় বিষ। যা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পান করছে রজব আলী। এছাড়া তার উপায়ও নেই।

রজব আলী !

বড় সাহেবের ডাকে চোখ তুলে তাকায় সে, স্যার!

নাও তোমার মানিব্যাগ। ব্যাগটা ভালোই কিনেছো।

হাত বাড়িয়ে ব্যাগটি নিয়ে রজব আলী দরজা খুলে নিমিষে বাইরে চলে আসে। দরজা দ্বিতীয়বার বন্ধ করতে পারে না, তার আগেই বড় সাহেব এবং অন্যান্যদের হাসির ছুরি তীব্র অপমানে রজব আলীর কান এবং মর্মের মূলে আঘাত হানে। মনে হচ্ছে তাদের হাসির হলকা তাকে শান দেয়া ছুরির মতো কাটছে। আর রজব আলী নিজের রক্তে ভেসে যাচ্ছে।

রজব আলী মানিব্যাগ আর হাতে রাখে না। প্যান্টের পকেটেই রাখে। মাস শেষে মানিব্যাগের ছোট্ট খোপে খুচরো কয়েকটা মাত্র টাকা দেখতে পায় রজব আলী। মানিব্যাগে টাকা নেই, একটা পরিত্যাক্ত রুমালের মতো মনে হয় মানিব্যাগটাকে। এবং রজব আলী বুঝতে পারে- বড় সাহেবের মতো মানুষদের সঙ্গে রজব আলীরা কোনদিন, কোনোকালে পাল্লা দিয়ে টিকতে পারবে না।

মাস শেষ, রজব আলীর মানিব্যাগের টাকাও শেষ। অথচ বড় সাহেবের মানিব্যাগে মাসের প্রথম দিকে যতো টাকা ছিলো বা থাকে, এখনো সে রকমই আছে। কমে না। বরং বাড়ে। তাহাদের টাকা বাড়তেই থাকে। বাড়বে আমৃতকাল।

দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে রজব আলী।

দীর্ঘনিঃশ্বাস এবং পুঞ্জিভূত ক্ষোভ নিয়ে নিত্যদিনের স্বাভাবিক জীবনযাপন চালিয়ে যাচ্ছে রজব আলী। প্রতিদিনের জীবনাচারের সঙ্গে রজব আলী বেশ মানিয়ে নিয়েছে। মানিব্যাগটা তার সঙ্গে থাকছে প্রতিদিনকার মতো- যেমন তার পকেটে থাকছে একটি রুমাল, একটি চিরুনি।

মাসের প্রথম দিকে মানিব্যাগটা ভরা থাকে, মাঝখানের দিকে কমতে কমতে টাকা অর্ধেকেরও কমে এসে পৌঁছে এবং এই কমার গতিটা বলবৎ থাকে গাণিতিক হারে।

মাসের শেষের দিকে রজব আলী মানিব্যাগ বহন করার আর কোন যুক্তি খুঁজে পায় না। কারণ ব্যাগের তলায় পাঁচ-দশটা টাকা পড়ে থাকে বড় অযত্নে, বড় অবহেলায়। কখনো কখনো রজব আলীর মনে হয়- মানিব্যাগটা বোধহয় তাকেই উপহাস করছে। মাস খানেক পরে একদিন।

রজব আলী অফিস থেকে ফিরছে। মাস শেষের দিকে। বাসে প্রচুর ভিড়। বাসে ওঠা মানে জন্তুর খাঁচায় ওঠা। জীবন যে কতো অবাঞ্ছিত, বাসে উঠেই সেটা বুঝতে পারে রজব আলী।

বাস থেকে নেমেই হাত দেয় প্যান্টের পকেটে। পকেটটা খালি, বুকটা ধড়াস ধড়াস করে, মানিব্যাগটা নেই ! এতো সাবধানে থাকার পরও মানিব্যাগটা নিয়ে গেলো?

রজব আলী কয়েক মুহূর্ত স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। মানিব্যাগটা পকেটমার নিয়ে গ্যাছে। রজব আলী মানিব্যাগটার জন্য ভাবছে না। ভাবছে মানিব্যাগের সর্বশেষ পুরোনো ময়লা দশটি টাকা...। ওই দশ টাকা থাকলে আরো দুই দিন বাস ভাড়া দিয়ে অফিসে আসা-যাওয়া করতে পারতাম।

;