আর্নেস্ট হেমিংওয়ের অগ্রন্থিত গল্প : অনুসৃতিই আনন্দ



অনুবাদ: রাজিয়া সুলতানা
অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

  • Font increase
  • Font Decrease

‘ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি’ দিয়ে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে যেভাবে সাহিত্যে চিরস্থায়ী আসন পেয়েছিলেন, সেই একই কিউবার উপকূল থেকে শুরু ‘অনুসৃতিই আনন্দ’, এটিতেও আছে মার্লিনমাছের ঘটনা। মিশেছে আরো অনেক ঘটনাবলি। হেমিংওয়ের গুটি কয়েক গল্পই শুধুমাত্র অপ্রকাশিত আছে, এটি তার মধ্যে একটি। এটি লেখা হয়েছিল ১৯৩৬ থেকে ১৯৫৬ সালের মধ্যে কোনো এক সময়ে। হেমিংওয়ের নাতির সূত্রে পাওয়া গেছে এই অমূল্য গল্পটি।

এই গল্পের মূল আকর্ষণ ‘ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি’ উপন্যাসিকার মার্লিনমাছ এবং হেমিংওয়ের আত্মজৈবনিক উপাদান। - বিভাগীয় সম্পাদক


সে বছর কিউবার উপকূলে আমরা মাসব্যাপী মার্লিনমাছ ধরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করি। সেই মাসটা শুরু হয়েছিল এপ্রিলের দশ তারিখ থেকে। মে মাসের দশ তারিখ পর্যন্ত আমরা পঁচিশটা মাছ ধরি এবং এই সময় আমাদের মাছধরার অনুমতিপত্রের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। আমাদের উচিত ছিল কী ওয়েস্ট(১)-এ ফিরে যাওয়ার জন্য কিছু উপহারসামগ্রী কেনা আর এদিকওদিক ঘোরার জন্য প্রয়োজনের তুলনায় আরেকটু দামি কিউবান জ্বালানি অনিটায় ভরিয়ে নিয়ে, হিসেবপত্র চুকিয়ে বাড়ি ফেরা। কিন্তু তখনও বড়মাছগুলো আসা শুরু করেনি।

মি. জোসি জিজ্ঞেস করল, “আর একটা মাস কি ওকে রেখে চেষ্টা করে দেখতে চাও, ক্যাপ?” ক্যাপ অনিটার মালিক আর দিনে দশ ডলার করে ভাড়ায় টিকেট দিচ্ছিল। সে সময়ে ভাড়ায় স্ট্যান্ডার্ড টিকেটের মূল্য ছিল দিনে পঁয়ত্রিশ ডলার।

“যদি থাকতে চাও তো কমিয়ে নয় ডলার করতে পারি।”
“নয় ডলার আমরা কোথায় পাব?”
“যখন টাকা হাতে আসে তখন দিয়ো। ব্যুলোতে উপসাগর জুড়ে স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানির সঙ্গে তোমাদের লেনদেন ভালো। বিল পাওয়ার পর গতমাসের টিকেট বিক্রির টাকা থেকে ওদের পরিশোধ করতে পারব। আর আমরা যদি বিরূপ আবহাওয়ার মধ্যে পড়ে যাই তাহলে তুমি কিছু একটা লিখে দিয়ো।”

আমি বললাম “বেশ।” এরপর আমরা আরো একমাস ধরে মাছ ধরলাম। এরমধ্যে আমরা বেয়াল্লিশটা মার্লিন ধরলেও তখনও বড় মাছগুলো আসছিল না। তখনও মরো(২)র কাছে বইছিল গভীর ভারী স্রোত। কোনো কোনো সময় একরের পর এক টোপ ফেলে রাখা হতো—উড়ন্ত মাছগুলো বোটের সামনের অংশের নিচ থেকে লাফ দিত আর সামুদ্রিক পাখিগুলো সেগুলোকে ধরতে চেষ্টা করত। প্রতিদিনই আমরা সাদা মার্লিনগুলো ধরছিলাম, কিছু কিছু আবার হাতছাড়াও হয়ে যাচ্ছিল, একদিন আমি পাঁচটা ধরেছিলাম কিন্তু একটা বিশাল মাছও আমরা ধরতে পারিনি।

তীরে পানির কিনারে আমরা খুব জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিলাম। কারণ, সবগুলো মাছ কেটে টুকরো করে ওখানে সবাইকে দিয়ে দিতাম আর যখন মার্লিনমাছের পতাকা উড়িয়ে মরো কেল্লা পার হয়ে খালের ওপর দিয়ে সানফ্রান্সিসকোর জেটির দিকে যেতাম তখন লোকজন পারঘাটার দিকে দৌড়ে আসত। সে বছর পাউন্ড প্রতি আট থেকে বারো সেন্ট করে কিনে দ্বিগুণ দামে বাজারে বিক্রি করতে পারত বলে জেলেদের জন্য তা ছিল লাভজনক। যেদিন আমরা পাঁচটা পতাকা উড়িয়ে তীরে এলাম, পুলিশ লোকজনদের লাঠিপেটা করেছিল। তীরে অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। সে বছরটাও ছিল মন্দ।

জোসি বলল, “শালার পুলিশ আমাদের নিয়মিত সব খদ্দেরকে তাড়িয়ে দিয়ে সব মাছ নিয়ে নিচ্ছে।” একজন পুলিশ ঝুঁকে পড়ে মার্লিনের দশপাউন্ড ওজনের একটা টুকরা তুলে নেওয়ার সময় জোসি বলল—“আচ্ছা মানুষ তো আপনি, দূর হোন।” পুলিশ বলেছিল—“এইরকম কুৎসিত চেহারা তো আমি এর আগে কখনো দেখি নাই। তোমার নাম কী হে?”

বলাবাহুল্য, পুলিশ ওর একটা নাম দিয়ে দিল।

“কমপ্রমিজো-বইয়ে ওনার নাম আছে নাকি, ক্যাপ?”

আমরা যাদের মাছ দেব বলে কথা দিতাম, তাদের নাম এই বইয়ে লিখে রাখতাম যার অর্থ হচ্ছে প্রতিশ্রুতি-বই।

“আরে নাহ।”

মি. জোসি বলল, “পরের সপ্তাহের তালিকায় ছোট একটা টুকরার জন্য ওর নামটা লিখে রাখো তো, ক্যাপ।” “আর এই যে পুলিশ, আপনে এখন পাটাতন থেকে নেমে দূর হোন, জাহান্নাম বা অন্য কোথাও যান আর এমন কাউকে লাঠিপেটা করেন যে আমাদের বন্ধু নয়। জীবনে অনেক হারামী পুলিশ দেখেছি। যান, ঘাটের পুলিশ না হলে লাঠি পিস্তল দুটোই নিয়ে দূর হোন।”

শেষে সমস্ত মাছ কেটে টুকরো করে বই অনুযায়ী যার যার মাছ আলাদা করে রেখেছিলাম আর পরের সপ্তাহের জন্য প্রতিশ্রুতি-বই নাম দিয়ে ভর্তি হয়ে গিয়েছিল।

“আম্বুজ মুন্ডোজ-এ গিয়ে ধুয়ে টুয়ে পরিষ্কার হয়ে নাও, ক্যাপ। স্নান সেরে নাও। তারপর ওখানে তোমার সঙ্গে কথা হবে। আমরা ফ্লোরিদিতায় গিয়েও কথাবার্তা সেরে নিতে পারব। ওই পুলিশ কর্মকর্তা আমার মেজাজটা বিগড়ে দিয়েছে।”
“তুমিও ওখানে আসতে পারো তো, শাওয়ার নিতে পারো। আমি এখানেই পরিষ্কার হয়ে নেব’খন। আজ আমি তোমার মতো অতটা ঘামিনি।”

আমি আম্বুজ মুন্ডোজ হোটেলের দিকে খোয়া দিয়ে বাঁধানো এই সংক্ষিপ্ত রাস্তাটা দিয়ে হেঁটে গিয়ে কোনো চিঠি এসেছে কিনা ডেস্কে খোঁজ নিয়ে লিফটে উঠে উপরের তলায় গেলাম। আমার রুমটা ছিল উত্তর-পূর্ব কোণে আর জানালা দিয়ে আয়নবায়ু এসে শীতল করে দিচ্ছিল। আমি জানলা দিয়ে পোতাশ্রয়ের চারিদিকে পুরনো শহরের ছাদগুলোর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম। দেখলাম মেক্সিকোর অরিজবা শহর তার সমস্ত বাতি নিয়ে ধীরে ধীরে পোতাশ্রয়ের নিচে নিভে যাচ্ছে। অত অত মাছ ধরে আমি তখন ভীষণ ক্লান্ত, ঘুম পাচ্ছিল খুব। আমি জানতাম শুলেই ঘুম এসে যাবে চোখে, তাই বিছানায় বসে জানলা দিয়ে তাকিয়ে রইলাম। তখন দেখতে পেলাম বাঁদুড়েরা শিকারে নেমেছে, আমি কাপড় খুলে স্নান সেরে পরিষ্কার কাপড় পরে নিচের তলায় গেলাম। মি. জোসি তখন হোটেলের দরোজায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল।

সে বলল—“তুমি নিশ্চয়ই ক্লান্ত, আর্নেস্ট।”
”না”, আমি মিথ্যে বললাম।

সে বলল, “আমি ক্লান্ত। তোমার মাছ টেনে তোলা দেখতে দেখতেই আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমাদের সর্বসময়ের রেকর্ড অনুযায়ী মাত্র তো দুইটা। সাত আর আট নাম্বার চোখ।” মি. জোসি আর আমি কখনোই আটনম্বর মাছের চোখ এভাবে বলতে পছন্দ করতাম না, কিন্তু সবসময় এভাবেই লিখে রাখতাম।

আমরা অবিস্পো স্ট্রিটের পাশের ছোট রাস্তাটা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম আর মি. জোসি দোকানের সমস্ত আলোকিত জানলাগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখছিল। বাড়ি ফিরে যাবার আগ পর্যন্ত সে কখনো কিছু কিনত না। কিন্তু মূল্যহ্রাসের পণ্যগুলো দেখতে পছন্দ করত। আমরা দুটো দোকান পেছনে ফেলে লটারির টিকেট বিক্রির অফিসে এসে পৌঁছালে ঠেলা দিয়ে ফ্লোরিদিতার ঝুলন্ত দরজাটা খুললাম।

মি. জোসি বলল— “তুমি বরং বসো, ক্যাপ,”
“না, আমার কাছে পানশালায় দাঁড়িয়ে থাকতেই ভালো লাগছে।”

মি. জোসি বলল, “বিয়ার, কোনটা? জার্মান বিয়ার খাচ্ছো, ক্যাপ?”
“চিনিহীন হিমায়িত ড্যাকোরি খাচ্ছি।” কন্সতান্তে যথেষ্ট পরিমাণে মালমশলা রেখে গেছে। আরো দুটো বানানো যাবে। আমি অপেক্ষা করছিলাম যে মি. জোসি কথা তুলবে। বিয়ার আসার সঙ্গে সঙ্গে সে বলতে শুরু করল।

বলল, “কার্লোস বলেছে ওদের পরের মাসে আসতে হবে।” কার্লোস ছিল আমাদের কিউবান সঙ্গী আর মার্লিনমাছের মস্তবড় ব্যবসায়ী জেলে। “এইরকম স্রোত নাকি ওরা আর কখনো দেখেনি। এবার ওরা এমনভাবে আসবে সেও নাকি আমরা কখনো দেখিনি। বলেছে পরের মাসে নাকি ওদের আসতেই হবে।”
“আমাকেও বলেছে।”
“ক্যাপ, তুমি যদি আরেকটা মাস থাকতে চাও তবে দিনে আট ডলারে অনিটাকে ভাড়া দিতে পারি আর স্যান্ডউইচ কিনে টাকা অপচয় করার চেয়ে আমি নিজেই রান্না করতে পারব। দুপুরের খাবার রান্নার জন্য ওই খাড়িতে গিয়ে ঝটপট রান্না সেরে ফেলতে পারব। গায়ে ঢেউখেলানো স্ট্রাইপঅলা বনিটো মাছগুলো তো সবসময়ই ধরছি। ছোট্ট টুনামাছের মতো খেতে দারুণ স্বাদ ওগুলোর! কার্লোস বাজারে মাছের আধার আনতে গেলে প্রয়োজনীয় বাজার সদাই করে আনবে বলেছে। রাতের খাবারটা আমরা পার্লা অব সানফ্রান্সিসকো রেস্তোরাঁতে খেতে পারি। গতরাতে আমি ওখানে পঁয়ত্রিশ সেন্ট দিয়ে ভালো মতন খেয়েছি।”
“আমি পয়সা বাঁচানোর জন্য গতরাতে না খেয়ে ছিলাম।” “তোমাকে খেতে হবে, ক্যাপ। সে জন্যেই মনে হয় তোমাকে আজ একটু ক্লান্ত লাগছে।”
“আমি জানি, কিন্তু তুমি কি নিশ্চিত যে আরেকটা মাস চেষ্টা করে দেখতে চাও?”
“অনিটাকে তাহলে একমাসের জন্য আর এখান থেকে বের হতে হবে না। বড় মাছগুলো এলে এই স্থান ছেড়ে কেন আমরা চলে যাব?”
“তোমার অন্য কোনোকিছু কি করার আছে?“
“না, তুমি কী করবে?”
“তোমার কি মনে হয়, মাছ সত্যি সত্যি আসবে?”
“কার্লোস বলেছে আসতেই হবে।”
“তাহলে ধরো, আমরা একটা বড় মাছ ধরলাম আর আমাদের শক্তি দিয়ে ওকে ধরে রাখতে পারলাম না।”
“পারতে হবে। ভালো মতন খাওয়া দাওয়া করলে সারাজীবনই ধরে রাখা যাবে ওকে। আর আমরা তো ভালো খাবও। আমি অন্য কিছুও ভাবছি।”
“কী?”
“তুমি যদি তাড়াতাড়ি ঘুমোতে যাও, আর কোনো সামাজিক জীবন না থাকে যদি তোমার, দিনের আলো ফুটে উঠতেই ঘুম থেকে উঠে লিখতে আরম্ভ করে আটটা পর্যন্ত লিখে সারাদিনের লেখালেখি শেষ করতে পারো যদি, তো যাবার আগে কার্লোস আর আমি সবকিছু রেডি করে রাখব, তুমি শুধু আমাদের সঙ্গে বোটে উঠে যাবে।”

আমি বললাম, “ঠিক আছে। মেনে নিচ্ছি আমার কোনো সামাজিক জীবন থাকবে না।”
“ওই সামাজিক জীবনই তো তোমাকে শেষ করে দিচ্ছে, ক্যাপ। তাই বলে বলছি নে সামাজিক জীবন একেবারেই থাকবে না। শনিবার রাতগুলোতে থাকতে পারে।”
“ঠিক আছে।” আমি বললাম। “শুধু শনিবার রাতগুলোতে সামাজিক জীবন চলবে। কী নিয়ে লিখব এ ব্যাপারে তোমার কোনো পরামর্শ?”
“সে তোমার ব্যাপার, ক্যাপ। আমি এ নিয়ে কিছু বলব না। তুমি যখন কোনো কাজ করো, সবসময়ই ভালোভাবে করো।”
“তোমার কী পড়তে পছন্দ?”
“ইউরোপ বা পাশ্চাত্য নিয়ে ভালো ছোট গল্প লেখো না কেন অথবা যখন নিষ্কর্মা ছিলে বা যুদ্ধে ছিলে—এই জাতীয় বিষয় নিয়ে। শুধু তুমি আর আমি জানি এমন কোনো বিষয় নিয়ে লেখো না কেন? অনিটা যা যা দেখেছে তা নিয়ে লিখতে পারো। যথেষ্ট সামাজিক জীবন দিয়ে ভরিয়ে লিখবে যেন সবার কাছে তা আবেদন সৃষ্টি করে।”
“আমি সামাজিক জীবন একেবারে বাদ দিয়ে দিচ্ছি।”
“অবশ্যই বাদ দেবে, ক্যাপ। কিন্তু তোমার তো মনে রাখার অনেককিছু আছে। সামাজিক জীবন এখন না থাকলে কোনো ক্ষতি হবে না।”

আমি বললাম, “না। অনেক অনেক ধন্যবাদ তোমাকে মি. জোসি। আগামীকাল সকাল থেকে আমি লেখার কাজ শুরু করে দেব।”
“আমি ভাবছি নতুন এই নিয়ম শুরু করার আগে আমাদের যা করা উচিত তা হচ্ছে আজ রাতে তোমার বিরল কোনো মাছের বড় একটা টুকরা খাওয়া উচিত। তাহলে কাল সকালে উঠে শরীরে অনেক শক্তি পাবে আর মাছ ধরার জন্য এই শক্তি কাজ দেবে খুব। কার্লোস বলেছে বড় মাছগুলো যে কোনো সময়ে আসতে শুরু করে দেবে। ক্যাপ, তোমার সর্বশক্তি দিয়ে ওদের ধরে রাখতে হবে কিন্তু।”
“তোমার কি মনে হয় আর একটা ড্যাকোরি বেশি গিললে কোনো ক্ষতি হবে?”
“ধূর! কী যে বলো না, ক্যাপ। এর মধ্যে রাম দেয় একটু, একটু লেবুর রস আর মেরাশচিনো। কোনো ক্ষতি হবে না।”

ঠিক তখন আমাদের পরিচিত দুটো মেয়ে পানশালায় এলো। সেই সন্ধ্যেয় খুব ফ্রেশ লাগছিল ওদের আর দেখতে খুব সুন্দরী ছিল ওরা।

ওদের একজন স্প্যানিশ ভাষায় বলল, “এরা জেলে দেখছি।”

অন্য মেয়েটা বলল, “হু, সমুদ্র থেকে আসা বিশালদেহী দুজন স্বাস্থ্যবান জেলে।”

মি. জোসি আমাকে বলল, “এন.এস.এল”।

আমিও নিশ্চিত করতে বললাম , “নো সোশাল লাইফ (এন.এস.এল)। মেয়ে দুজনার একজন বলল—“তোমাদের গোপন কোনো ব্যাপার আছে নাকি?” এই মেয়েটা ছিল অসম্ভব রূপবতী, চেহারায় কোথাও এতটুকুন খুঁত ছিল না। ওর আগের কোনো বন্ধুর ডান হাত ওর অমন সুন্দর টানটান নাকের রেখাটা নষ্ট করে দিয়েছে।

মি. জোসি মেয়ে দুটোকে বলল, “ক্যাপ আর আমি কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলাপ করছি।” এরপর তারা পানশালার দূরবর্তী কোণের দিকে চলে গেল। মি. জোসি আমাকে বলল, “ব্যাপারটা কী সহজ হয়ে গেল, দেখেছো? আমি সামাজিক দিকটার পুরোটাই সামলাব, তোমাকে শুধু ভোরবেলা উঠে লেখালেখির কাজ সেরে ফেলে মাছ ধরতে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে হবে। শারীরিকভাবে সবসময় শক্তিসামর্থ্য রাখতে হবে। বিশাল মাছগুলো, যেগুলোর ওজন হাজার পাউন্ড অথবা তার চেয়েও বেশি, সেগুলোর সঙ্গে পেরে উঠতে হবে।”

আমি বললাম—“চলো, আমরা কাজ বদল করি। আমি সামাজিক দিকটা দেখব’খন। তুমি খুব সকালে উঠে লিখবে। হাজার পাউন্ড ওজন ছাড়িয়ে যাওয়া বড় মাছগুলোকে সামলানোর জন্য শরীরটাকে তৈরি রাখবে সবসময়।”

জোসি সিরিয়াস হয়ে বলল, “তাহলে আমি তো খুশিই হই, ক্যাপ। কিন্তু আমাদের দুজনের মধ্যে তুমিই তো শুধু লিখতে পা্রো। তুমি আমার চেয়ে বয়সেও ছোট। আর মাছ সামলানোর জন্য তুমিই বেশি উপযুক্ত। যেভাবে আমি বোট চালাই, তাতে আমি মনে করি ওই মাছ আমি বোটে তোলা মানে ইঞ্জিনের বারোটা বাজানো।”

“তা জানি, আমিও চেষ্টা করব লেখালেখির কাজটা ভালো করে করতে।” আমি বললাম। মি. জোসি বলল—“আমি তোমাকে নিয়ে গর্ব করতে চাই। আর চাই যে শালার, মহাসমুদ্রে আমরা পৃথিবীর সবচে বড় মার্লিনটা ধরি, ভালোভাবে ওটার ওজন করি আর কেটে টুকরা করে ওই শালার ব্যাটা ডাণ্ডাবাজ পুলিশকে নয়, বরং গ্রামে আমাদের পরিচিত দরিদ্র লোকদের মধ্যে বিলিয়ে দিই।”
“আমরা তাই করব।”

ঠিক তখন মেয়েদুটোর একজন পানশালার দূরের কোণ থেকে আমাদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ল। সেই রাতে ব্যবসা মন্দা ছিল। আমরা ছাড়া আর কেউ সেখানে ছিল না। মি. জোসি বললেন, “এন. এস.এল।” আমিও অভ্যেসমতন পুনরাবৃত্তি করলাম। বললাম—“এন.এস.এল (নো সোশাল লাইফ।)”

“কন্সতান্তে,” মি. জোসি বললেন, “আর্নেস্তো একজন ওয়েটার চাচ্ছে। আমরা বিরল মাছের দুটো বড় টুকরা অর্ডার দিতে যাচ্ছি।”

কন্সতান্তে মৃদু হেসে আঙুল দিয়ে ওয়েটারের জন্য ইশারা করল।

মেয়েদুজনার পাশ দিয়ে ডাইনিংরুমে যাবার সময় ওদের একজন হাত বাড়িয়ে দিলে আমি হ্যান্ডশেক করলাম আর গম্ভীরভাবে স্প্যানিশ ভাষায় বললাম—“এন. এস. এল।”

অন্য মেয়েটি বলল, “হায় ঈশ্বর, এরা তো রাজনীতি করে আর এরকম একটা বছরে।” ওদের মধ্যে কিছুটা মুগ্ধতা, কিছুটা আতঙ্ক কাজ করছিল।

উপসাগর জুড়ে সকালের প্রথম আলো যখন আমাকে জাগিয়ে দিল, আমি উঠে গিয়ে মি. জোসির যেন পছন্দ হয় এই আশায় একটা ছোটগল্প লিখতে শুরু করলাম। সেই গল্পে অনিটার কথা ছিল, সমুদ্রতীরের কথা ছিল, আর যা যা ঘটেছিল সেইসব কথা ছিল। প্রতিদিন আমি সমুদ্রের অনুভূতিটা, সেখানে যা যা দেখেছি, শুনেছি, যা কিছুর গন্ধ শুঁকেছি, অনুভব করেছি—তার সবই লেখায় তুলে আনার চেষ্টা করেছিলাম। প্রতিদিন সকালে উঠে আমি গল্পটা লিখতাম, মাছ ধরতে যেতাম আর ভালো ভালো মাছ ধরতাম। মাছ ধরার জন্য আমি কঠিন প্রশিক্ষণ দিতাম আর চেয়ারে বসে না থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাছ ধরতাম। এরপরও বড় মাছগুলো আসছিল না। একদিন আমরা এক লোককে ব্যবসায়ী জেলেদের একটা ডিঙি নৌকা দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যেতে দেখলাম।স্পিডবোট যেমন বোটের সামনে ঢেউ তুলে পানি ছড়িয়ে চলে যায়, তেমনি করে প্রত্যেকবার লাফানোর সময় মার্লিনমাছও সেভাবে পানি ছিটিয়ে যাচ্ছিল। ওই ডিঙি-নৌকাটা ভেঙে গিয়েছিল।

আরেকদিন, দমকা হাওয়া আর বৃষ্টির মধ্যে আমরা দেখলাম চারজন লোক গাঢ় বেগুনি রঙের গভীর প্রশস্ত একটা মাছ একটা ডোঙাতে তোলার চেষ্টা করছে। কেটে নাড়িভুড়ি ফেলে দেওয়ার পর সেই মার্লিনটার ওজন হয়েছিল পাঁচশ পাউন্ড আর পুরনো বাজারের মার্বেলপাথরের ফলকের ওপর কাটতে দেখেছিলাম সেই মাছের বিশাল বিশাল চাকা।

তারপর আরেক রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে খুব কাছ থেকে পোতাশ্রয়ের মুখে দেখেছিলাম গভীর কালো স্রোত। পরিষ্কার সেই পানির দুই বাঁও গভীরে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলাম ওরা ঝাঁকে ঝাঁকে আসছে। আমাদের প্রথম বড়মাছটা ধরা পড়ে মরোর পাশেই। সেইসব দিনগুলোতে পাল খাটাবার কোনো খুঁটি ছিল না, রড ধারণ করার কিছু ছিল না। খালে হালকা একটা খুঁটি দিয়ে বড় একটা মাছ ধরার আশায় ছিলাম। আর তখনই এই মাছটা ধরা পড়েছিল। বিরাট একটা ঢেউ তুলে এসেছিল সে, বিলিয়ার্ড কিউ-এর বন্ধ করাতের মতো দাঁত আর সেই দাঁতের পেছনে তার বিশাল মাথাটা ছিল ডিঙি নৌকার মতো প্রশস্ত। তারপর বোটের সমান্তরালে সুতো টানতে টানতে দ্রুত সে আমাদের থেকে দূরে চলে গেল । বড়শির রিল এত দ্রুত ফুরিয়ে গেল যে ছুঁতে গেলে হাতে গরম লাগছিল। পনেরটা সুতোর প্যাঁচ দিয়ে একেকটা থ্রেড তৈরি আর রিলে ভরা হয়েছিল এই থ্রেডের চারশ গজ—আমি অনিটার সামনের দিকটায় ভেতরে আসতে আসতে যার অর্ধেকটাই ফুরিয়ে গিয়েছিল।

বোটের ছাদের দিকে ধরার জন্য যে হ্যান্ডলক আমরা আগেই বানিয়ে রেখেছিলাম সেগুলো ধরে ধরে আমি সেইদিকে এগুলাম। এইটা আমরা আগেই অনুশীলন করেছিলাম। বোটের কানসেতে পা রেখে দ্রুত ঠেলা দিয়ে পাটাতনে উঠে যাওয়া যায়। কিন্তু লোকাল স্টেশনের সাবওয়ে এক্সপ্রেসের মতো যে মাছ দ্রুত পার হয়ে চলে যায় সেই মাছের সঙ্গে তো আর প্র্যাকটিসটা করা হয়নি। একহাত দিয়ে রডটা ধরে ছিলাম কিন্তু রডের প্রান্তটা নিচে ওটা রাখার জায়গাটিতে ঘষা খাচ্ছিল, খুঁড়ছিল। আর রডের সুতোর টানে আমার অন্যহাতটি, খালি দুইপা বোটের মেঝেতে এসে ধাক্কা খেয়ে থেমে গিয়েছিল।

আমি চিৎকার করে বললাম, “হুক দিয়ে ওকে গেঁথে ফেলো, জোসি। রিলের সবটুকু সুতোই টেনে নিচ্ছে দেখছি।”
“গাঁথা হয়েছে তো, ক্যাপ, দেখো না কী অবস্থা।”

তখন অনিটার কানসের ওপর এক পা, বোটের ডানদিকে নোঙ্গরের ওপর আরেক পা দিয়ে আমি প্রতিরোধ করতে ব্যস্ত। কার্লোস আমার কোমর পেঁচিয়ে ধরেছে আর আমাদের সামনে মাছটা লাফাচ্ছে। এই অবস্থায় মাছটাকে দেখতে লাগছে মদের ব্যারেলের মতো। সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় ওকে রূপোলি দেখাচ্ছিল আর আমি ওর গায়ের পাথালে ওপর থেকে নিচে নেমে যাওয়া বড় বড় বেগুনি রঙের স্ট্রাইপগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম। প্রত্যেকবার লাফানোর সময় মনে হচ্ছিল পাহাড়ের চূড়া থেকে যেন কোনো ঘোড়া নিচে লাফিয়ে পড়ছে। মাছটা লাফাতেই থাকল, লাফাতেই থাকল, লাফাতেই থাকল। অনিটা পূর্ণ গতিতে মাছের পিছনে পিছনে ছুটলেও রিল এতটাই গরম হয়ে যাচ্ছিল যে হাত দিয়ে ধরে রাখা যাচ্ছিল না আর সুতোর মাঝখানটা টানের প্রবল বেগে ক্রমশই পাতলা হয়ে আসছিল।

আমি চিৎকার করে মি. জোসিকে বললাম, “অনিটার গতি কি আরো একটু বাড়ানো যায়?”
“এই পৃথিবীতে তা সম্ভব নয়। আর সুতো নেই?”
“খুবই সামান্য আছে।”

কার্লোস বলল, “মাছটা অনেক বড়। এত বড় মার্লিন আমি জীবনে দেখি নি। শুধু যদি থামত একবার আর নিচের দিকে যেত, তাহলে ওর কাছে যেতে পারতাম আমরা, যথেষ্ট সুতোও পেয়ে যেতাম।”

মরো ক্যাসেল থেকে ন্যাশনাল হোটেলের বিপরীত দিকে মাছটা তখন এক পাক দেওয়া শেষ করেছে। আমরাও ওর পিছে পিছে একইভাবে গিয়েছি। রিলে তখন বিশ গজের মতো সুতো আছে। এমন সময় মাছটা থামল। আমরা সুতো উদ্ধার করতে করতে দ্রুত ওর কাছে গেলাম। আমার মনে আছে, আমাদের সামনে ছিল সুতো সরবরাহকারী একটা গ্রেস লাইন জাহাজ। কালো রঙের একটা পাইলট বোট সেদিকে যাচ্ছিল। এদিকেই যেহেতু আসছিল, আমার ভয় হচ্ছিল আমরা না আবার ওটার গতিপথের মধ্যে পড়ে যাই। রিলে সুতো পেঁচাতে পেঁচাতে আমি তাই চেয়ে চেয়ে দেখছিলাম এবং আমাদের বোটের সামনে ফিরে এসেছিলাম। দেখেছিলাম বোটটা গতি বাড়িয়ে দিয়েছিল তখন, বেশ দূর থেকে আমাদের এদিকেই আসছিল তবে আমাদের সঙ্গে পাইলট বোটের ফাজলামো করার প্রশ্নই আসে না।

তখন আমি চেয়ারে বসে আর মাছটা সোজা উপর নিচ হয়ে আর রিলে চড়ছিল তৃতীয় সুতোটা। রিলের তাপ কমানোর জন্য ওতে সমুদ্রের পানি ঢালছিল কার্লোস; বালতিতে করে আমার মাথা আর ঘাড়েও ঢালছিল।

মি. জোসি জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছো তুমি, ক্যাপ?”
“ঠিকঠাক মতন আছি।”
“বোটের সামনে লেগে কোথাও আঘাত পাওনি তো?”
“না।”
“তুমি কি ভেবেছিলে কখনো ওখানে ওইরকম একটা মাছ থাকতে পারে?”
“না।”

কার্লোস চিৎকার করে বলতে লাগল, “গ্রান্ডে গ্রান্ডে,” বিরাট শিকারী কুকুরের মতো কাঁপছিল সে আর বলছিল, “জীবনে এইরকম মাছ দেখিনি আর। কখনোই দেখিনি। কক্ষনো না, না দেখিনি।”

পরে একঘণ্টা কুড়ি মিনিট মাছটার কোনো খবর ছিল না। প্রথম যেখানে ও শব্দ করেছিল, প্রবল স্রোত সেখান থেকে আমাদেরকে ছয়মাইল দূরে কোজিমারের উল্টোদিকে টেনে নিয়ে গেল। আমি ক্লান্ত হয়ে পড়লেও আমার হাত আর পায়ের অবস্থা ভালো ছিল। রিল থেকে ওকে সুতো ছাড়ছিলাম একই গতিতে, সাবধানে ছিলাম যেন জোরে টান না খায় অথবা ঝাঁকুনি না লাগে। আমি কিন্তু সরাতেও পারতাম ওকে ওখান থেকে। কিন্তু কাজটা সহজ হতো না মোটেও। তবে ব্রেকিং পয়েন্টের এইপাশে সুতো ধরে রাখতে পারলে তা সম্ভব হতো।

“ও আসবে। বড় মাছগুলো কখনো এমন করে,” কার্লোস বলল, “তবে যুদ্ধংদেহী হয়ে ওঠার আগেই হুকঅলা ডান্ডা দিয়ে ওকে কাবু করে ফেলতে পারো।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ও আসবে কেন এখন?”

কার্লোস বলল, “ওর মাথা আউলায় গেছে আর তুমি তো ওর গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করছো। কী হচ্ছে তার কিছুই কিন্তু বুঝতে পাচ্ছে না ও।”

আমি বললাম, “ওকে একটুও বুঝতে দিয়ো না কিন্তু।”

কার্লোস বলল, “নাড়িভুড়ি কেটে ফেলে দেওয়ার পর ওর ওজন নয়শ পাউন্ডেরও বেশি হবে।”

মি. জোসি বলল, “এ নিয়ে আর কোনো কথা বলবে না।”
“অন্য কোনোভাবে চেষ্টা করতে চাও, ক্যাপ?”
“না।”

আমরা যখন কাছে গেলাম মাছটার, দেখলাম বিশাল দেহ ওর। ভয়ংকর রকমের নয় তবে অসম্ভব বড় ছিল মাছটা। দেখলাম সে ধীর আর শান্ত হয়ে আছে। বলতে গেলে কাস্তে ব্লেডের মতো দেখতে বেগুনি রঙের দারুণ দুটো পাখনা নিয়ে সে পানিতে চুপ করে আছে। এরপর আমাদের বোটটা ও যেই না দেখে ফেলল, অমনি সুতো রিল থেকে প্রচণ্ড বেগে ছুটল যেন কোনো মটরগাড়ির সঙ্গে হুক দিয়ে আমাদের লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। লাফাতে লাফাতে ও উত্তরপশ্চিম দিকে যাচ্ছিল আর প্রত্যেক লাফের সঙ্গে গা থেকে পানি বেয়ে বেয়ে পড়ছিল।

আবার আমাকে বোটের ভেতরে সামনের দিকে যেতে হয়েছিল। মাছটা যতক্ষণ না শব্দ করা বন্ধ করল ততক্ষণ আমরা ওকে ধাওয়া করে গেলাম। এইবার সে মরোর উল্টোদিকের ভাটিতে চলে গেল। আবার আমাকে বোট চালিয়ে সামনে আসতে হলো।

“কোনো ড্রিংকস লাগবে তোমার, ক্যাপ?” মি. জোসি জিজ্ঞেস করল।

আমি বললাম, “না, কার্লোসকে বলো রিলে তেল মাখতে, তেল যেন বাইরে না পড়ে আর আমার ওপর কিছু লবণাক্ত পানি ঢালো।”
“কিছুই কি দিতে পারব না তোমাকে, ক্যাপ?”
“পারো, দুটো হাত আর একটা নতুন পিঠ দিতে পারো।” আমি বললাম।
“কুকুরীর বাচ্চাটার তেজ এখনো কমে নাই। শুরুতে যেমন সতেজ ছিল এখনো তাই রয়ে গেছে।”

এরপর দেড়ঘণ্টা পর ওকে দেখা গেল কজিমা পার হয়ে বেশ খানিকটা দূরে। সে লাফিয়ে লাফিয়ে দৌড়াতে শুরু করেছে। ওকে ধাওয়া করতে করতে আমাকে বোটের ভেতরে সামনের অংশে যেতে হয়েছিল।

ফিরে এসে যখন সামনে বসছিলাম তখন মি. জোসি বলল, “মাছটা কেমন, ক্যাপ?”
“সবসময় যেমন, তেমন। তবে রডের অবস্থা বেশি ভালো না।”

রডটা প্রথমে সুন্দর পূর্ণ একটা ধনুকের মতো বেঁকে গেল, কিন্তু যখন তুললাম যেরকম সোজা হবার কথা ছিল, সেরকম আর হলো না।

মি. জোসি বলল, “ওর আরো কিছু শক্তি বাকি আছে। মনে হচ্ছে ওর পেছনে তোমাকে লেগে থাকতে হবে অনন্তকাল, ক্যাপ। তোমার মাথায় আরো পানি ঢালতে বলছ?”

আমি বললাম, “এখুনিই না। রডটা নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে। ওর ওজন এত বেশি যে এইমাত্র রডের শক্তি নিঃশেষ করে দিয়েছে।”

একঘণ্টা পর মাছটা আবার এগিয়ে আসছিল, ধীর বৃত্তাকার একটা স্থির গতিতে ভালোই এগুচ্ছিল সে। বড় একটা বৃত্ত তৈরি করে শ্লথ গতিতে আসছিল।

কার্লোস বলল, “ও ক্লান্ত হয়ে গেছে। এখন গা ছেড়ে দেবে। লাফালাফি করে ওর বাতাসের থলেগুলো পূর্ণ হয়ে গেছে। গভীরে যাবার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। আর পারবে না।”

আমি বললাম, “রডের অবস্থাও শেষ। বেঁকেছে তো বেঁকেছে। আর সোজা হতে পারছে না মোটেও।”

সত্যিই তাই। রডের মাথাটা পানির উপরিভাগ ছুঁয়েছে, মাছটা ওপরে তোলার জন্য রড ওঠালে, রিলে সুতো ওঠানো রড আর নিতে পারছে না। রড আর রড নেই। যেন সুতোর অভিক্ষেপ শুধু। যদিও প্রত্যেকবার উঁচুতে তোলার সময় তখনও কয়েক ইঞ্চি সুতো ফিরে পাওয়া সম্ভব ছিল। তবে ওইটুকুই, এর বেশি নয়।


বার্তা২৪.কম-এর শিল্প-সাহিত্য বিভাগে লেখা পাঠানোর ঠিকানা
[email protected]


মাছটা বৃত্তাকারে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছিল। অর্ধেক বৃত্ত পূর্ণ করে যখন বাইরের দিকে যাচ্ছিল তখন রিল থেকে সুতোর প্যাঁচ খুলে আসছিল। যখন ভেতরের দিকে আবার বৃত্তে ফিরে আসছিল তখন সুতো আবার উদ্ধার হচ্ছিল। কিন্তু রডের অবস্থা খারাপ হওয়ার জন্য ওকে তো আর শাস্তি দিতে পারো না। আর ওর ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণই বা করবে কিভাবে।

আমরা একে অন্যকে ক্যাপ বলে সম্বোধন করতাম। আমি মি. জোসিকে বললাম, “খুব খারাপ। ও যদি ডুব দিয়ে মরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে তবে ওকে আর কখনোই ওপরে তুলতে পারব না আমরা।”

“কার্লোস বলেছে ও উপরে আসছে। বলেছে ও লাফাতে লাফাতে শরীরে এত বেশি বাতাস নিয়ে ফেলেছে যে চাইলেও অত গভীরে যেয়ে মরতে পারবে না। বড় মাছগুলো অতিরিক্ত লাফালাফি করে শেষে এসে এরকমই করে। আমি গুনে দেখেছি ছত্রিশবার লাফ দিয়েছে মাছটা, মনে হয় একবার গুনতে ভুলেও গেছি।”

আমার জীবনে শোনা সবচে লম্বা বক্তৃতাগুলোর মধ্যে এটি একটি। মি. জোসি যেভাবে বলল তাতে আমি একেবারে মুগ্ধ। ঠিক তখনই মাছটা ধীরে ধীরে সাঁতার কেটে নিচের দিকে যেতে শুরু করল। আমি দুহাত দিয়ে রিলের সুতো ছাড়ছিলাম আর ব্রেকিং পয়েন্ট থেকে সুতোকে রক্ষা করায় ব্যস্ত ছিলাম। রিলে ড্রামের ধাতুটা আমার আঙুলের নিচে ছোট ছোট ঝাঁকুনি খেয়ে ঘুরছিল।

আমি মি. জোসিকে জিজ্ঞেস করলাম, “সময় কেমন কাটছে? তিনঘণ্টা পঞ্চাশ মিনিট ধরে তো ওর সঙ্গে আছ।”

কার্লোসকে বললাম, “আমি তো ভাবলাম তুমি বলেছো ও নিচে গিয়ে মরতে পারবে না।”

“হেমিংওয়ে, ওকে যে উপরে আসতেই হবে। আমি জানি, ওকে আসতেই হবে।”

আমি বললাম, “ওকে বলো না কেন আসতে।”

মি. জোসি বলল, “ওকে পানি দাও তো কার্লোস।” “আর তুমি কথা বোলো না তো, ক্যাপ।”

বরফপানি খুব ভালো লাগছিল। কিছু পানি মুখ থেকে বের করে কব্জির ওপর ছেড়ে দিলাম আর কার্লোসকে বললাম গ্লাসের বাকি পানিটা আমার ঘাড়ের পেছনে ঢেলে দিতে। ঘাড়ে খালি চামড়ায় যেখানে হার্নেসের ঘষা লেগেছিল সেখানে ঘামের লবণ মেখে ছিল কিন্তু সূর্যের তাপ এতটাই প্রখর ছিল যে রক্তের কোনো তাপ অনুভব করিনি। জুলাই মাসের এক দুপুর ছিল সেটা।

“ওর মাথায় স্পঞ্জ দিয়ে আরো কিছু লবণাক্ত পানি ঢালো।” মি.জোসি বলল।

ঠিক তখন মাছটা সুতো টানা ছেড়ে দিল। কতক্ষণ স্থির হয়ে রইল, মনে হলো শানের কোনো জেটির সঙ্গে আমাকে বেঁধে ফেলা হয়েছে। তারপর ধীরে ধীরে সে আবার নড়তে শুরু করল। আমি শুধু হাতের কব্জি দিয়ে এমনভাবে সুতো উদ্ধার করতে লেগে গেলাম যেন রডে কোনো স্প্রিং ছিল না আর এতটাই নেতিয়ে পড়েছিল সেটা, মনে হচ্ছিল যেন ক্রন্দনরত কোনো উইলো গাছ।

পানির ওপর থেকে প্রায় একবাঁও নিচে আমরা ওর অভিক্ষিপ্ত লম্বা বেগুনি রঙের চমৎকার দাগযুক্ত পাখনা দুটো দেখতে পেলাম। মনে হলো যেন একটা ডোঙা। তখন সে ধীরে ধীরে বৃত্তাকারে ঘুরতে শুরু করে দিল। ঘুরতে খুব যেন সুবিধা করতে না পারে সেজন্য আমি ওকে সাধ্যমতন চাপে রাখলাম। এতটাই চাপ প্রয়োগ করলাম যে সুতো ছিঁড়ে যাবার যোগাড় হলো আর এই অবস্থায় পড়লে রড ছেড়ে না দিয়ে আর কোনো উপায় থাকে না। সঙ্গে সঙ্গে রড ভাঙল না বটে কিন্তু শক্তি হারিয়ে নষ্ট হয়ে গেল।

কার্লোসকে বললাম, “বড় খুঁটি থেকে ত্রিশ বাঁও সুতো কেটে নাও। বৃত্তে ঘুরে আসার সময় আমি ওকে ধরব, আর যখন এদিকে আসতে শুরু করবে তখন যথেষ্ট পরিমাণে সুতো হাতে আসবে। সুতো যেহেতু কম পড়বে না, তখন আমি রডটা বদলে ফেলব।”

রড যখন ভেঙে গেছে এখন তো আর মাছ ধরায় বিশ্ব রেকর্ড বা অন্য কোনো রেকর্ড সৃষ্টির প্রশ্নই আসে না। কিন্তু মাছটা তো কাবু হয়ে গেছে, তাই এখন ওর পেছনে উঠে পড়ে লেগে ওকে ধরা উচিত। কিন্তু সমস্যা একটাই—বড় রডটা পনের প্যাঁচের সুতোর জন্য বেশিরকম শক্ত। এখন আমাকে এই সমস্যার সমাধান বের করতে হবে।

নামকরা হার্ডি কোম্পানির রিল থেকে কার্লোস রডে সুতো তোলার গাইড ব্যবহার করে ছত্রিশটা সাদা থ্রেড-লাইন খুলছিল আর হাত দিয়ে মাপছিল। ওর হাত থেকে রিলটা বোটের মেঝেতে পড়ে গেল। নষ্ট হয়ে যাওয়া রডটা দিয়ে যথাসাধ্য মাছটাকে ধরে রাখার চেষ্টা করলাম। দেখলাম কার্লোস সাদা সুতো কেটে রডের গাইডের সাহায্যে অনেকখানি সুতো তুলল।

আমি মি. জোসিকে বললাম, “ক্যাপ, বেশ তাহলে এই সুতো নাও। মাছটা বৃত্তাবর্তে ফিরে আসবে যখন তখন সুতো যথেষ্ট টেনে নিলেও কার্লোস দ্রুত সুতোর দুটো থ্রেড বানিয়ে ফেলতে পারবে। আর কিছু ভাববার প্রয়োজন নেই। শুধু নরম আর সহজভাবে সুতো টানবে।”

ঘুরে ঘুরে মাছটা আসতেই থাকল আর মি. জোসি একফুট একফুট করে সুতো উদ্ধার করে কার্লোসকে দিচ্ছিল, কার্লোস সাদা সুতোর সঙ্গে সেই সুতোর গিঁট দিচ্ছিল। মি. জোসি বলল, “ও তো ওগুলো বেঁধেই ফেলেছে।” তখনও প্রায় গজ খানেক সবুজ রঙের পনের প্যাঁচের সুতোটা ব্যবহার করা বাকি, মাছটা ওর বৃত্ত সীমার মধ্যে এলে সে আঙুল দিয়ে সুতোটাকে ধরে রাখল। আমি ছোট রডটা থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে ওটা নিচে রাখলে কার্লোস বড় রডটা আমার হাতে দিল।

আমি কার্লোসকে বললাম—“তুমি যখন প্রস্তুত হও, ওটা কেটে ফেলো।” মি. জোসিকে বললাম, “ক্যাপ, তুমি আস্তে আস্তে নরম করে ঢিলা দিতে থাকো। যখন সময় হবে, বুঝতে পারব, তখন আমি আস্তে আস্তে টানতে শুরু করব।”

কার্লোস যখন সুতো কাটছিল আমি তখন সবুজ রঙের সুতোর লাইন আর বিশাল মাছটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম। তখন এমন জোরে এক চিৎকার শুনলাম এর আগে কখনো কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষকে এভাবে চিৎকার করতে শুনিনি। যেন সমস্ত হতাশাকে জড়ো করে এমন শব্দে রূপ দেওয়া। তারপর প্রত্যক্ষ করলাম সবুজ সুতোর লাইনটা ধীরে ধীরে মি. জোসির আঙুলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। এরপর দেখলাম মাছটা যাচ্ছে তো যাচ্ছেই এবং একসময় সে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল। কার্লোস গিঁট দেয়া সুতোয় ভুল লুপ কেটেছিল।

মি. জোসি বলল, “ক্যাপ।” তাকে ঠিক ভালো দেখাচ্ছিল না। এরপর হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে জোসি বলল, “চারঘণ্টা বাইশ মিনিট হয়ে গেছে।”

আমি নিচে কার্লোসকে দেখতে গেলাম সেখানে সে বমি করে ভাসিয়ে দিচ্ছিল। আমি চিন্তা করতে নিষেধ করে বললাম, যে কারো এরকম হতে পারে। তাঁর বাদামি রঙের মুখটা তখন স্নায়ুচাপে পীড়িত। অদ্ভুত নিচু গলায় কথা বলছিল সে, আমি ঠিকমতন শুনতেও পাচ্ছিলাম না।

“আমি সারাজীবন মাছ ধরে আসছি কখনো এইরকম মাছ দেখিনি। এইবারই প্রথম। আমি আমার, তোমার দুজনার জীবনই নষ্ট করে দিয়েছি।”

আমি বললাম, “কী যে বলো! বাজে বোকো না তো। আমরা আরো বড় বড় মাছ ধরব।” কিন্তু কখনোই বড় মাছ ধরতে পারিনি আমরা।

মি. জোসি আর আমি বোটের পেছনের দিকে গিয়ে বসে অনিটাকে বাতাসের টানে এগুতে দিলাম। উপসাগরে সেটি ছিল চমৎকার একটা দিন। মৃদুমন্দ বাতাস বইছিল। আমরা তীর আবার তারও পেছনে ছোট ছোট পাহাড়গুলো দেখছিলাম। মি. জোসি আমার ঘাড়ে, হাতে যে জায়গাগুলোতে রড আটকে গিয়েছিল, সেই জায়গাগুলোতে মারকিউরোক্রোম মালিশ করে দিচ্ছিল। আবার পায়ের পাতাও ঘষা লেগে ছিলে গিয়েছিল বলে সেখানেও মলমটা লাগিয়ে দিচ্ছিল। এরপর সে দুটো হুইস্কি গাঁজাতে নিল।

“কার্লোস কেমন আছে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“ওর অবস্থা বেশি ভালো না। গুড়ি মেরে বসে আছে।”
“আমি বলেছিলাম নিজের ওপর দোষ না নিতে।”
“নিশ্চয়। সে তো ওখানে বসে থেকে নিজেকেই দোষারোপ করছে।”
“বড় মাছগুলোকে কেমন লাগছে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

মি. জোসি বলল, “আমি সবসময় এই-ই করতে চেয়েছি আসলে।”
“আমি কি ওকে ঠিকমতন সামলাতে পেরেছি, ক্যাপ?”
“পেরেছো মানে! খুব ভালো পেরেছো।”
“না। আমাকে সত্যি করে বলো।”
“আজকে তো আমাদের টিকেটের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। তুমি চাইলে আমি পয়সা ছাড়াই মাছ ধরতে পারি।”
“না”
“আমি পয়সা ছাড়াই বরং মাছ ধরতে চাচ্ছি। কিভাবে যে মাছটা ন্যাশনাল হোটেলের দিকে গেল যেন কোনোদিকে হুঁশ ছিল না ওর, মনে আছে তোমার?”
“ওর সবকিছু আমার মনে আছে।”
“তোমার লেখালেখির কী খবর, ক্যাপ, ভালো চলছে? খুব ভোরে উঠে লেখা মনে হয় তেমন কঠিন কোনো ব্যাপার না, তাই কি?”
“সাধ্যমতো চেষ্টা করছি ভালো লিখতে।”
“তুমি চালিয়ে যাও। আর প্রতিদিন নিয়ম করে লিখলে কখনোই সমস্যা হবার কথা না।”
“আগামীকাল সকাল থেকে বাদ দিয়ে দিতে পারি।”
“কেন?”
“আমার পিঠে সমস্যা।”
“তোমার মাথা তো ঠিক আছে, নয় কি? পিঠ দিয়ে তো আর লেখো না।”
“হাত ব্যথা হয়ে থাকবে।”
“ধুত্তোরি! পেন্সিল তো ধরতে পারবে। সকালে উঠে দেখবে, ঠিক হয়ে গেছে। তখন পারবে।”

ভাবতে অবাক লাগলেও পরদিন সকালে আমি লিখতে পেরেছিলাম এবং বেশ ভালোই লিখেছি। সকাল আটটায় পোতাশ্রয়ের দিকে রওনা দিয়েছিলাম। আরেকটা চমৎকার দিন ছিল সেটি। মৃদুমন্দ বাতাস বইছিল। মরো ক্যাসেলের কাছে স্রোত ছিল আগের দিনের মতো। পরিষ্কার পানির কাছে গিয়ে পৌঁছালে কোনো খুঁটির বাতি নিভাইনি আমরা। একবারই তা করেছিলাম, আর নয়। চার পাউন্ড ওজনের বিরাট একটা সেরো ম্যাকরল ধরেছিলাম আমি, রডটা ছিল অনেক বড় আর ভারী, হার্ডি কোম্পানির রড ছিল সেটা; রিলে ছিল ছত্রিশটা সাদা সুতোর প্যাঁচের থ্রেড লাইন। কার্লোস আগের দিন ত্রিশ বাঁওয়ের যে সুতোটা খুলে নিয়েছিল, সেটা আবার যুক্ত করেছে আর পাঁচ ইঞ্চি রিল সম্পূর্ণ ভর্তি ছিল। তবে সমস্যা ছিল রড নিয়ে। রডটা খুবই শক্ত ছিল। বড় মাছ ধরার ক্ষেত্রে বেশি শক্ত রড জেলের বারোটা বাজিয়ে দেয় আর যে রড ঠিকমতন বাঁকা হয়, সেই রড মাছের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ে।

কার্লোসের সঙ্গে কথা বললে তবেই সে কথা বলে এবং সে তার কষ্ট নিয়েই ছিল। আমার শরীরে এত ব্যথা ছিল যে, কষ্টের কথা ভাবার সময় পাইনি আর মি. জোসি এমন শক্ত লোক যে, সে এসবকে পাত্তাই দেয়নি।

সে বলল, “শালার, সারাটা সকাল মাথা ঝোঁকাতেই গেছে ওর। এরকম করলে মাছ ধরতে পারবে না ও।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কেমন আছো, ক্যাপ?”

মি. জোসি বলল, “আমি তো মনে করি ভালোই আছি। গতরাতে শহরে গিয়েছিলাম। সেখানে স্কয়ারে মেয়েদের অর্কেস্ট্রা শুনেছি। কয়েক বোতল বিয়ার গলাধঃকরণ করে ডনোভ্যানের ওখানে গিয়েছিলাম। কী যে জঘন্য ব্যাপার ঘটেছে সেখানে।”
“কী জঘন্য ব্যাপার?”
“ভালো না। খুব খারাপ। আমি খুশি যে তুমি সেখানে ছিলে না, ক্যাপ।”

পাশে, দূরে উঁচুতে রডটা ধরে বড় ম্যাকরলটাকে পেছনে ঢেউয়ের তোড় থেকে সরে যেতে সাহায্য করতে করতে বললাম, “কী ঘটেছিল আমাকে বলো।” কাবানা দূর্গ বরাবর স্রোতের কিনার অনুসরণ করার জন্য কার্লোস অনিটাকে ঘোরাল। পেছনে উত্থিত স্রোতে মাছকে প্রলুব্ধ করার জন্য যে সাদা রঙের টিজার ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছিল, সেই সাদা সিলিন্ডার বোটের সঙ্গে সঙ্গে ছুটছিল, স্রোতের তোড়ে মাঝে মাঝে লাফাচ্ছিল, উড়ছিল। মি. জোসি এবার বোটের পেছনে একপাশে চেয়ারে বসে মাছ ধরছিল। তার বড়শিতে বড় একটা ম্যাকরল আধার খাচ্ছে।

“ডনোভ্যানে এক লোক নিজেকে সিক্রেট পুলিশের ক্যাপ্টেন বলে দাবি করছিল। সে বলল আমার মুখটা নাকি তার পছন্দ। সেজন্য সে আমাকে একটা উপহার দেবে, আর সেই উপহার হিসেবে সে যে কোনো এক লোককে খুন করবে। আমি তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু নাছোড়বান্দা সে, বলছিল আমাকে পছন্দ করেছে এবং এইটা প্রমাণ করার জন্য একজনকে সে হত্যা করবেই। সে ছিল মাচাদো বিশেষ নতুন মেরিন পুলিশ অফিসারদের একজন। ওই যে ডাণ্ডাবাজ পুলিশ।”
“আমি তো ওদের চিনি।”
“চিনতেও পারো, ক্যাপ। তবে আমি খুশি যে তুমি সেখানে ছিলে না।”
“কী করেছে সে?”
“আমাকে সে কতটা পছন্দ করে তা প্রমাণ করার জন্য সে কাউকে হত্যা করার কথা বলেই চলল। আমি বললাম তার কোনো প্রয়োজন নেই বরং একটু ড্রিংক করে সে কথা ভুলে যাওয়া যেতে পারে। একটু শান্ত হতে না হতেই সে আবার একই কথা বলতে শুরু করল।”
“লোকটা নিশ্চয়ই ভালো।”
“ক্যাপ, আরে নাহ। কোনো কাজের লোক না সে। আমি তাকে এসব ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য মাছের কথা বলতে চেষ্টা করলাম।”

সে বলল, “আপনার মাছের ওপর আমি পায়খানা করে দিই। তাহলে মাছ আর নাই। হলো তো?”

আমি বললাম, “ঠিক আছে। মাছের ওপর হাগু। আপনার কথাই রইল। চলেন এবার দুজনেই বাড়ি যাই।”
“বাড়ি যাব? কী যা তা বলছেন? আপনার জন্য আমি কাউকে হত্যা করবই। আর মাছের ওপর কিন্তু হাগবই। তাহলে মাছ বাদ হয়ে যাবে। বুঝতে পেরেছেন?” সে বলল।

তো ক্যাপ, আমি তাকে শুভরাত জানিয়ে ডনোভ্যানকে টাকা দিলাম কিন্তু এই পুলিশ সেই টাকা ফট করে মেঝেতে ফেলে দিয়ে তা পা দিয়ে চেপে ধরল আর বলল, “মাথা বিগড়ায় দিয়েন না, কইলাম। আপনি আমার বন্ধু, আপনি এখানে থাকবেন।” এরপরও আমি তাকে শুভরাত বললাম। ডনোভ্যানকে বললাম, “ডনোভ্যান, আমি দুঃখিত যে আপনার টাকাটা মেঝেতে।”

আমি বুঝতে পারছিলাম না এই পুলিশ কী করতে যাচ্ছে; অবশ্য সে ব্যাপারে মাথাব্যথাও ছিল না আমার। আমি বাড়ি যাবার জন্য মনস্থ করে যেই পা বাড়িয়েছি, অমনি পুলিশটা পিস্তল বের করে বেচারা গ্যালিগোর দিকে ধরে। গ্যালিগো চুপচাপ বিয়ার খাচ্ছিল। সারারাত একটিবারের জন্য একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি সে। কেউ পুলিশটাকে কিচ্ছু করেনি, বলেনি। আমিও কিছু করিনি। কী যে লজ্জা হচ্ছে বলতে আমার, ক্যাপ।”

আমি বললাম, “বেশিক্ষণ এই অবস্থা চলার কথা না।”
“আমি জানি। কারণ, তা চলতে পারে না। কিন্তু যে কথাটা আমি মোটেও পছন্দ করতে পারিনি তা হচ্ছে আমার মুখ তার পছন্দ। আমার মুখের কী শ্রী বলো তো, ক্যাপ যে একজন পুলিশ বলবে সে পছন্দ করেছে?”

মি. জোসির চেহারাটা আমিও খুব পছন্দ করতাম। আমার পরিচিত যে কোনো মুখের চেয়ে তার মুখটা আমার বেশি পছন্দ ছিল। কারণ, দ্রুত বা সহজ সাফল্য লাভের জন্য এই মুখ পাথরে খোদাই করা হয়নি। পানশালার লাভজনক দিকটায়, অন্যান্য জুয়াড়ির সঙ্গে কার্ড খেলতে খেলতে, বিরাট ঝুঁকির এন্টারপ্রাইজ বুঝতে পেরেও ঠান্ডা মস্তিষ্কের নির্ভুল বুদ্ধিমত্তায়, সমুদ্রে যার জন্ম—সেই মুখ তো পছন্দ করবই। চোখ ছাড়া মুখের আর কোনো অংশ দেখতে অমন সুশ্রী নয়; কোনো উজ্জ্বলতম ঝকঝকে পরিষ্কার দিনে ভূমধ্যসাগরের চেয়েও নীলাভ অদ্ভুত সেই চোখের রঙ। চেহারা সুন্দর নয় মোটেও শুধু আশ্চর্য দুটো চোখ—এখন ফোস্কা ওঠা চামড়ার মতো হয়ে গেছে।

আমি বললাম, “আপনার চেহারাও সুন্দর, ক্যাপ।”
“হ্যাঁ, মনে হয় ওই একটা ভালো জিনিসই ওই কুকুরীর বাচ্চাটা দেখতে পেয়েছিল।”

মি. জোসি বলল, “এখন আমাদের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সামাজিক জীবন নিয়ে মাথা ঘামাব না।”
“স্কয়ারে বসে মেয়েদের অর্কেস্ট্রা আর যে মেয়েটা গাইছিল, শুনতে ভালোই লাগছিল, চমৎকার লাগছিল। সত্যি করে বলো তো কেমন লাগছে তোমার ক্যাপ?”

“আমি তো বলেছি, ভালো না, খুব খারাপ।”
“ভেতরে অন্ত্রে কোথাও লাগেনি তো? বোটের সামনে যতক্ষণ ছিলে, তোমার জন্য দুশ্চিন্তা করেছি আমি।”

আমি বললাম, “না, পেছনে একদম পিঠের গোড়ায়।”
“হাত পা কোনো কাজে আসেনি, একেবারে হার্নেস পর্যন্ত পট্টি দিয়ে বেঁধে দিলাম,” জোসি বলল। “এখন আর অত ঘষা লাগবে না। তুমি কি আসলেই ঠিকঠাকমতন পেরেছিলে, ক্যাপ?”
“অবশ্যই, অভ্যেস করা যেমন কঠিন, অভ্যেসে পরিণত হলে এত্থেকে বের হয়ে আসাটাও তেমনটাই কঠিন।”

“আমি জানি, অভ্যেস খুব খারাপ একটা ব্যাপার।” মি. জোসি বলল, “আর অন্য কোনো অভ্যেস নয়, সম্ভবত কাজই বেশিরভাগ মানুষকে মেরে ফেলে। কিন্তু তোমার বেলায় সে কথা খাটে না। তুমি যখন কিছু করো তখন অন্যকিছুর তোয়াক্কা করো না।”

আমি তীরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম বিচের কাছাকাছি অতল গভীর পানির সন্নিকটে একটা চুনাপাথরের ভাঁটি যেখানে উপসাগরীয় প্রবাহ প্রায় তীরের কাছে এসে মিশেছে। ভাঁটি থেকে সামান্য ধোঁয়া উঠছিল। দেখতে পেলাম তীর বেয়ে ধুলো উড়িয়ে একটা ট্রাক পাথুরে রাস্তা দিয়ে সামনে অগ্রসর হচ্ছে। কিছু পাখি বড়শির আধারের একটা দলা খুবলে খাচ্ছিল। তখনই শুনলাম কার্লোস, “মার্লিন, মার্লিন!” বলে চিৎকার করছে।

সবাই একসঙ্গে ওকে দেখতে পেলাম। পানিতে কী গভীর সেই রঙ ওর। আমি দেখলাম ওর ঠোঁটটা বিরাট ম্যাকরলটার পেছন থেকে পানির ওপর ভেসে উঠল। বেঁটে, গোলাকার, পুরু, কুৎসিত একটা ঠোঁট। তারই পেছনে পানির নিচে স্তূপীকৃত ওর শরীর।

কার্লোস চিৎকার করে বলল, “ও খাক, ওকে ওটা খেতে দাও, মুখের ভেতরে নিয়েছে তো।”

মি. জোসি রিলে আধারের সুতোটা পেঁচিয়ে আনছিল। আমি সেই তীব্র টানটার জন্য অপেক্ষা করছিলাম যার অর্থ হচ্ছে মার্লিন ম্যাকরলটাকে গিলে ফেলেছে।


অনুবাদকের নোট

১.কী ওয়েস্ট—কিউবার প্রায় নব্বই মাইল উত্তরে আমেরিকার একটি দ্বীপ শহর
২. মরো—হাবানা উপসাগর প্রতিরক্ষাদূর্গ

অসুস্থ ‘তিলোত্তমা’র কাছে কী সেবা চান আপনি!



প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত, প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম

ছবি: সংগৃহীত, প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

জুলাই ১৩, ২০২৪ সালের ভোর পাঁচটায় শুরু হয়েছিল এক তুমুল বৃষ্টি। রাজধানী ঢাকার বেশিরভাগ মানুষ তখনও গভীর ঘুমে।

এ সময়টা ঘোর বর্ষাকাল। সে কারণে ভারী বৃষ্টিপাত হতেই পারে। তাই, অ্যালার্ম শুনেও আরেকটু ঘুমিয়ে নিই বলে যারা কিছুটা দেরিতে উঠে অফিসে যাবেন বলে আটটার দিকে পথে নেমেছেন, তাদের চক্ষু সেদিন চড়কগাছ‍!

সকাল ৯টা পর্যন্ত বৃষ্টি থামেনি। একটানা চার ঘণ্টার মুষলধারার পতনে ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার ২৬ থেকে ৩০টি বড় রাস্তা একসঙ্গে ডুবে গেছে।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, এই ‘ডোবা’ সেই ডোবা নয়! রাস্তায় ১-২ ঘণ্টা জ্যামে দাঁড়িয়ে থাকার পর অনেক গাড়ির ইঞ্জিনে পানি ঢুকে পড়ায় অচল হয়ে যানজট অসহনীয় করে তুলেছিল সেদিন। সংবাদে টেলিভিশনের ভিডিওচিত্র দেখেও তাই-ই মনে হচ্ছিল।

সে এক অতি ভয়ঙ্কর অবস্থা সারাদিন জুড়ে। যেখানে চোখ যায়, সেখানেই মনে হয়, প্লাবন বয়ে যাচ্ছে। নটরডেম কলেজের পাশের রাস্তায় পার্কিং করা কারের শুধু ছাদটা দেখা যাচ্ছে। মালিক গাড়িতে উঠতে গিয়ে হতবাক হয়ে পড়েছেন।

নিউমার্কেটের প্রধান গলিতে বুকসমান পানি। দোকানকার মালিকেরা যারা বাসা থেকে ডুবন্ত নিউমার্কেটের ছবি দেখে দৌড়ে এস মাল সরানোর চেষ্টা করেছিলেন, তারা অনেকে এসে দেখেন দোকানের তালা ঘোলা-ময়লা পানিতে ডুবে অচেনা হয়ে গেছে। মালপত্র ভিজে গছে। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে পর্যন্ত সেই মালামাল সরাতে পারেননি।

কোথায় নেবেন! বেরুনোর সব রাস্তায় থৈ থৈ পানি! ভ্যান, যানবাহন কিছুই ঢোকানো যাবে না! এখানে জলের যানবাহন নেই। কলের গাড়ি জমানো বৃষ্টির বুকসমান জলে চলার পথ খুঁজে পায়নি কোথাও।

গ্রীন রোডে অনেকগুলো প্রাইভেট হাসপাতাল। সেখানে আগত রোগীদের অবস্থা খুবই করুণভাবে চিত্রিত হয়ে সংবাদে ঠাঁই নিয়েছে সেদিন। ডুবন্ত রিকশাভ্যানে নারী রোগীকে শুইয়ে নিয়ে ঠেলে চলছেন রোগীর আত্মীয়-স্বজনেরা। পাশের ভবনের কৌতূহলী মানুষ শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে ‘আহারে’ বলে অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। ভাগ্যিস! শুক্রবার হওয়ায় সেদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা ছিল না।

এদিন পথে যারই নেমেছেন, তারাই দুর্ভোগে পড়ে গিয়েছেন। বাইকারদের অনেকের ইঞ্জিনে পানি ঢুকে স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেছে। পেটের ধান্ধায় যারা ব্যাটারিরিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন, তাদের বাহন অচল হয়ে যাওয়ায় সেগুলো ঠেলে অন্যখানে সরিয়ে নেওয়ার কোনো উপায় ছিল না।

চিৎকার করে কেউ কেউ বলছিলেন- ‘আমাদের ট্যাক্স, ভ্যাট আদায়ের সময় যারা নিয়ম দেখায়, যারা জরিমানা আদায় করে তারা এখন ঘরে বসে টিভিতে আমাদের কষ্ট দেখে তামাশা করছে! এই তিলোত্তমা নগরে নাগরিক সুবিধা কি সামান্য বৃষ্টির পানিতে ডুবে থাকবে’!

কথা হলো- এই ‘তিলোত্তমা’ কী দেবে তোমায় আমায়! তার কি-বা দেবার আছে! রাজধানী ঢাকাকে বিশেষণ দিয়ে রূপসীর টোলপড়া গালের তিলের সঙ্গে তুলনা করা হয়। এর সৌন্দর্যের মোহে কবি-সাহিত্যকরা কত শত ছড়া-কবিতা লিখেন দিনরাত।

কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর কত মূল্যবান প্রসাধনী কিনে সাজানোর চেষ্টা করেন এর দেহকে। এর একই অঙ্গে উত্তর-দক্ষিণে কত বাহারি আলো শোভা পায়‍ কিন্তু দিনশেষে এত মেকাপ ‘রিমুভ’ করে ঘুমুতে যাওয়া উপায় নেই তার। এজন্য সে নিজেই নিজের সহ্যগুণ হারিয়ে ‘ভালনেরাবল’ বা ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। কিন্তু সেদিকে কারো কোনো নজর নেই।

তবুও প্রতিদিন নতুন নতুন ফেসপাউডার, কাজল, ভারী ভারী গহনা পরানো হচ্ছে। তিলোত্তমার বুক চিরে এত ভারী গহনা পরানোর ফলে এর বুক দুরু দুরু করছে। কানের গহনা কখন কান ছিঁড়ে পড়বে, তার নিরাপত্তা নেই। এর প্রাকৃতিক পঞ্চন্দ্রিয় এখন বন্ধ হয়ে গেছে! এসব কথা আক্ষেপ করে বলছিলন এক প্রবীণ ঢাকাবাসী। তাঁর কাছে ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার প্রাকৃতিক পঞ্চন্দ্রিয় বন্ধ হওয়ার কথা হঠাৎ আঁতকে উঠে জিজ্ঞাসা করলাম- সেটা কেমন!

মানুষের প্রাকৃতিক পঞ্চন্দ্রিয় বন্ধ হয়ে গেলে যদি দ্রুত চিকিৎসা করানো না যায়, তাহলে তার মৃত্যু অনিবার্য! তবে ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার পঞ্চন্দ্রিয় বন্ধ হলো কীভাবে! তিনি জানালেন, ধরুন, এর বাতাসের মান বছরের ১০ মাসই অস্বাস্থ্যকর থাকে। পথে হাঁটতে গেলে নাক, চোখ দিয়ে গরম পানি ঝরে। এখন বর্ষাকাল তাই বায়ুতে একটা স্বস্তি। এর মুখ খোলা। কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, যা দিয়ে প্রতিদিন নতুন নতুন মানুষ, ছাত্র, বেকার, ভাসমান মানুষ ঢুকছে। কেউ একবার ঢুকলে আর বের হতে চায় না।

তবে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো- এর নিচের ইন্দ্রিয় দুটো বর্ষাকালে হঠাৎ করে অকেজো হয়ে পড়ে। যেমন- ধরুন, ভূগর্ভস্থ সুয়্যারেজ লাইন ও নর্দমাগুলোর কথা। এই দুটি ‘তিলোত্তমা’র অতি গুরুত্বপূর্ণ ইন্দ্রিয়। জুলাই ১৩, ২০২৪ তারিখ চার ঘণ্টার বৃষ্টির পানি যদি বাধাহীনভাবে সব নর্দমা দিয়ে বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়তো, তাহলে কি এই ভয়ঙ্কর জলজট হতো!

কিন্তু ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার অতি গুরুত্বপূর্ণ ইন্দ্রিয় সদৃশ নর্দমাগুলোর মুখ বন্ধ হয়ে পড়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান এর নর্দমাগুলোর ভেতরে পাইপ বসিয়ে এর স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে। ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার উন্নয়ন কাজে এত বেশি প্রতিষ্ঠান জড়িত, তা গুনে শেষ করা যাবে না। তাদের মধ্যে কাজের সমন্বয় নেই। কে কখন কাটলো, কে ঢেকে রাখলো, আর কে নর্দমাগুলোর ভেতরে পাইপ বসিয়ে পানি প্রবাহ বন্ধ করে দিলো, তা ঠিকমতো হিসাব রাখার মতো সময় সুযোগ নেই কর্পোরেশনগুলোর।

সুতরাং একটু বৃষ্টি হলেই প্লাষ্টিক, মাটি, কাপড়ের টুকরো, কিচেন গার্বেজ ইত্যাদি দিয়ে এর নিচের ইন্দ্রিয় বা ময়লা নিষ্কাশনের নর্দমা বর্ষাকালে হঠাৎ করে অকেজো হয়ে পড়ে; যার নেতিবাচক প্রভাব এসে পড়ে রাজপথে, অলিতে-গলিতে, বাড়িতে, মার্কেটে। নগরের সব জায়গার সব কার্যক্রম হঠাৎ থৈ থৈ পানিতে সয়লাব হয়ে যায়।

এজন্য কর্পোরেশনগুলোর সার্বক্ষণিক ওয়াচটিম ও মটিভেশন কর্মসূচি থাকা দরকার। একেকটি সার্বক্ষণিক ওয়াচটিমের এক-দুইজন সদস্য একেকটি এলাকার ১০টি করে নর্দমার প্রবাহ পরিষ্কার আছে কিনা তা নজরদারিতে রাখলে এই জলাবদ্ধতা সহজেই নিরাময় করা যাবে!

জাপানের ট্রাফিক যেমন অফিসে বসেই রাস্তার চলন্ত গাড়ি ওয়াচ করে মাসিক বেতন বিলের সঙ্গে জরিমানার বিল কেটে ধরিয়ে দেয় তদ্রুপ আমাদের সিটি কর্পোরেশনের নর্দমা ওয়াচ টিমের দৈনন্দিন কার্যকলাপ সিসি ক্যামেরা ও ড্রোন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ করে জরিমানার বিধান করা যেতে পারে।

‘তিলোত্তমা’ ঢাকার নির্মাণ কাজ সারাবছর জুড়ে চলে। কখনো শেষ হয় না। নির্মাতারা রাস্তার পার্শ্বে বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রী, নুড়িপাথর বর্জ্য ফেলে স্তূপ করে রাখে। একটু বৃষ্টি হলে সেগুলো গড়িয়ে কাছাকাছির ড্রেন বন্ধ করে দেয়। বিভিন্ন পার্ক, পথঘাটের খোলা রেস্টুরেন্টে হরদম পলিথিন প্যাকেটে খাদ্যসামগ্রী বিক্রি হয়। ফুটপাতের দোকান, দর্জিপাড়া ইত্যাদি থেকে প্লাষ্টিক ব্যাগ ও বেশি শক্ত বর্জ্য নর্দমার মধ্যে ফেলা হয়ে থাকে। ওয়াচটিমের মাধ্যমে সেগুলো নিয়মিত সরিয়ে ড্রেনের ময়লা পানির গতিপ্রবাহ দেখে প্রতিদিন রিপোর্ট নেওয়ার নিয়ম থাকা উচিত।
হয়ত অনেক নিয়ম-কানুন হাতে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ‘তিলোত্তমা’র রাস্তায় যেখানে-সেখানে কাগজ, পলিথিন, ইটের টুকরা, আবর্জনার ছড়াছড়ি দেখে এসব কাজের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তাইতো মনে হয়, মাত্র একবেলা বৃষ্টির পানিতে কেন এই বন্যা! গেল অর্থবছরে ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে সাতশ পঞ্চাশ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে বলে একটি জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম হয়েছে। তবু কেন নগর জুড়ে ভয়াবহ জলাব্ধতার দুর্ভোগ কিছুদিন পর পর ঘাড়ে চাপে! এর দায়ভার কার!

‘তিলোত্তমা’ ঢাকা যানজট, জলজট ইত্যাদিতে নিজেই পঙ্গু হয়ে অসাড় হয়ে পড়েছে। বুয়েটের আবাসিকের মতো জায়গায় নগর পরিকল্পনাবিদদের কোয়ার্টারের নিচতলাবাসী এবার জলজটকে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। তারা কেউ কেউ পাম্প দিয়ে ঘরের পানি সেচে বাইরে ফেলার চেষ্টা করেছেন। কেউ সারারাত ঘুমাতে পারেননি। তাদের জন্যও উন্নত নাগরিক সেবা সে রাতে শূন্যের কোটায় নেমে গিয়েছিল।

‘তিলোত্তমা’ ঢাকায় প্রায় প্রতিবছর এই জায়গায় বার বার কাটাছেঁড়া করায় অতি উন্নয়নের ভারে সে ন্যুজ্ব হয়ে পড়েছে। যেমনটি ঘটেছিল পপ তারকা মাইকেল জ্যাকসনের বেলায়। তাঁর দেহের বিভিন্ন অঙ্গে এত বেশি প্লাস্টিক সার্জারি করা হয়েছিল যে, তিনি একসময় চরম হতাশ হয়ে ওষুধ গ্রহণ ছেড়ে দিয়ে একা একা বাঁচার জন্য নিঃসঙ্গ থাকতে চেয়েছেন। তবুও শেষ রক্ষা হয়নি তার। এখন থেকে আমাদের ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার অঙ্গে আর কাটাছেঁড়া না করাটাই উত্তম।

অসুস্থ ‘তিলোত্তমা’র ওপর একসঙ্গে অনেক ব্যাধি ভর করেছে। এ অবস্থায় তার কাছে আর কী নতুন সেবা চাওয়ার আছে আমাদের! তাই, ‘তিলোত্তমা’র ওপর আর শল্য চিকিৎসা না চাপিয়ে উল্লিখিত টোটকা দাওয়াই দিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর আছে বলে মনে হয় না!

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। E-mail: [email protected]

;

সাহিত্য পত্রিকা 'কথার কাগজ'র আত্মপ্রকাশ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সাহিত্য পত্রিকা 'কথার কাগজ'র আত্মপ্রকাশ

ছবি: সাহিত্য পত্রিকা 'কথার কাগজ'র আত্মপ্রকাশ

  • Font increase
  • Font Decrease

শ্রাবণ সংখ্যা আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে শিল্প ও সাহিত্যের ছোট পত্রিকা 'কথার কাগজ'-এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলো।

শুক্রবার (১২ জুলাই) বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মিলনায়তনে 'কথার কাগজ' শ্রাবণ সংখ্যার মোড়ক উন্মোচন করা হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক শাহানারা স্বপ্না, কথাসাহিত্যিক ফরিদুল ইসলাম নির্ঝর, স্টুডেন্ট ওয়েজ প্রকাশনীর প্রকাশক মাশফিক তন্ময়, কথার কাগজের প্রধান সম্পাদক কেতন শেখ, নির্বাহী সম্পাদক অয়ন আব্দুল্লাহ প্রমুখ। পত্রিকাটির বার্ষিক শ্রাবণ, কার্তিক ও ফাল্গুন তিনটি সংখ্যায় প্রকাশ হবে।

মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে কথার কাগজের প্রধান সম্পাদক কেতন শেখ বলেন, 'করোনাকালীন ২০২০ সালে কথার কাগজের জন্ম। সে সময় কয়েকজন প্রবাসী আর দেশি লেখক অনলাইনে ব্লগের মাধ্যমে কথার কাগজের লেখালেখি শুরু করি। তরুণ সাহি- ত্যিকদের সঙ্গে প্রবীণ সাহিত্যিকদের লেখালেখির একটি প্ল্যাটফর্ম হয়ে দাঁড়ায় কথার কাগজ।

প্রকাশক মাশফিক তন্ময় বলেন, 'এক সময় সাহিত্য আন্দোলনের প্রধান বাহন ছিল ছোট পত্রিকা বা লিটলম্যাগ। কিন্তু নানা সংকটে লিটলম্যাগের কলেবর ছোট হয়ে গেছে। প্রকাশকরা অনেকেই অর্থসংকটে তাদের প্রকাশনা বন্ধ করে দিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে অনলাইনের এই যুগে ছাপা কাগজে কথার কাগজের যাত্রা তরুণ লেখকদের অনুপ্রেরণা জোগাবে।'

শাহানারা স্বপ্না বলেন, 'আশা করি, পত্রিকাটি অনেক দূর এগিয়ে যাবে। শ্রাবণ সংখ্যার প্রথম দর্শনে মনে হচ্ছে এটি পাঠকদের সাহিত্যের খোরাক জোগাবে।'

ফরিদুল ইসলাম নির্ঝর বলেন, 'মানুষের ভাষার প্রতি টান থাকলে দেশ ও দেশের বাইরে থেকে কাজ করা যায়, এর উদাহরণ কথার কাগজ। সম্পাদকম- গুলীর তিনজনই দেশের বাইরে থেকে এর যাত্রা শুরু করেন। আজকে দেশে এসেই তারা পত্রিকাটির ছাপা সংস্করণের মোড়ক উন্মোচন করলেন।'

সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান বলেন, 'আমাদের তরুণরা বিদেশ চলে যাচ্ছে, আর ফিরছে না। তবে কথার কাগজের সঙ্গে জড়িতরা বিদেশ থেকে সাহিত্য আর দেশের টানে ফিরে এসেছেন। অনলাইনের যুগে যখন অনেক পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, এ অবস্থায় তারা কথার কাগজের প্রিন্ট ভার্সন নিয়ে এসেছেন। এটি অনেক ভালো লাগার।' নতুন পত্রিকাটি টিকিয়ে রাখতে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

;

লেখক শেখ হাসিনা কোটিপতি হওয়ার পথে!



আবদুল হামিদ মাহবুব
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখালেখির হাত খুব ভালো। তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী হননি তখনই তার একাধিক বই প্রকাশ হয়েছে। সম্ভবত তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই ‘ওরা টোকাই কেন’। ঢাকার আগামী প্রকাশনী থেকে বইখানা বের হয়েছিল। ওই প্রকাশনী থেকে আমারও দু’খানা ছড়ার বই প্রকাশ হয়। ১৯৯১ সালে আমার ‘ডিমের ভিতর হাতি’ যখন প্রকাশ হচ্ছিলো তখন আগামী প্রকাশনীর কর্ণধার ওসমান গনি ভাই শেখ হাসিনার ‘ওরা টোকাই কেন’ এককপি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন।

বইখানা প্রথম না দ্বিতীয় সংস্করণের ছিলো সেটা মনে নেই। ওই বই কয়েকটি নিবন্ধের সংকলন। অধিকাংশ নিবন্ধেই শেখ হাসিনা তাঁর ভিতরের যন্ত্রণার কথা লিখেছিলেন। লিখেছিলেন দেশ ও রাজনীতি নিয়ে তাঁর পরিকল্পনার কিছু কিছু ইঙ্গিত। পড়েছিলাম তো অনেক আগে। তারপরও লেখাগুলোর অনেক বিষয় মনে রয়ে গেছে। প্রতিটি নিবন্ধ পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমার পারিবারিক ছোট লাইব্রেরিতে বইখানা গোছিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু আজ যখন ওই বই খোঁজতে লাগলাম, পেলাম না। অনুমান হচ্ছে আমার বইচোর কোন বন্ধু হয়তো এই বইখানা মেরে দিয়েছেন। অথবা বন্যা অতঙ্কে কয়েকেবার বাসার বইগুলো টানাটানি করার কারণে কোথাও হয়ত খুইয়ে ফেলেছি। তবে আমার ধারণা এই বইয়ের ক্ষেত্রে প্রথমটি ঘটেছে।

প্রধানমন্ত্রীর অনেক বইয়ের মতো ‘ওরা টোকাই কেন’ নিশ্চয়ই বহুল প্রচারিত হয়েছিল, বেরিয়েছিল অনেক অনেক সংস্করণ। আর বই সমূহের রয়্যারিটিও তিনি হাজার হাজার টাকা পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এমন প্রাপ্তি ঘটে থাকলে, আমি একজন লেখক হিসাবে অবশ্যই পুলকিত হই। আমি দেখেছি সেই ১৯৯১ সালের পর থেকে আগামী প্রকাশনীর প্রকাশনা ব্যবসারও অনেক উন্নতি হয়েছে। ব্যবসার উন্নতি ঘটার অর্থ প্রকাশকের উন্নতি ঘটা। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি আগামী প্রকাশনীর কর্ণধার ওসমান গনি ভাইয়ের আর্থিক অবস্থা অনেক অনেক ভালো হয়েছে।

পূর্বে দেখতাম একুশের বইমেলায় আগামী প্রকাশনী ছোট্ট স্টল নিত। এখন প্যাভিলিয়ন নেয়। লাখ লাখ টাকা খরচ করে প্যাভিলিয়নের অঙ্গসজ্জা করা হয়। নিশ্চয় বইয়ের ব্যবসা ভালো হয়। সেকারণেই বইমেলার প্যাভিলিয়ন তৈরিতে বিনিয়োগও বেশি করেন। প্রতিবছরই আগামী প্রকাশনীর কোন না কোন বই কেনার জন্য পাঠকের লাইন পড়ে। পাঠক যখন যে কোন লেখকের বই কেনে, সেটা দেখে আমি একজন লেখক হিসাবে আনন্দিত হই। বইয়ের ব্যবসার উন্নতি হোক। প্রকাশকরা ভালো লাভ করুন, আমি মনে প্রাণে সেটা চাই।

অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, প্রকাশকের লাভ হলে আমার মতো মফস্বলের লেখকরা কি লাভমান হই? অবশ্যই যৌক্তিক প্রশ্ন। এর জবাব খুব সংক্ষিপ্ত। প্রকাশকরা যখন বই প্রকাশ করে লাভের মুখ দেখবেন, তখন তারা নতুন নতুন বই প্রকাশে আগ্রহী হবেন। নতুবা আমাদের মতো লেখকদের প্রকাশককে উল্টো টাকা দিয়ে বই প্রকাশ করিয়ে নিতে হবে। এবং আমরা অনেকেই সেটা করছিও।

অনেকে আবার এও বলেন ডিজিটালের এই যুগে এখন আর কেউ বই কিনে পড়ে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে টুকটাক পড়েই তাদের পড়া শেষ করেন। সেই কারণে লেখকরা গাঁটের টাকা খরচ করে বই প্রকাশ করলেও সেগুলো বিক্রি হয় না। আমি এই অপবাদটা মানতে নারাজ। কারণ আমি দেখেছি কেবল ফেব্রুয়ারি মাসেই বইমেলা চলাকালে শত শত কোটি টাকার বই বিক্রি হয়। আর যারা পড়ুয়া, তারা সারা বছরই খোঁজে খোঁজে রকমারি, প্রথমা, আগামী, শ্রাবণ, ইউপিএলসহ বিভিন্ন আনলাইন বই বিক্রয় প্রতিষ্ঠান থেকে বই আনান।

আমি মফস্বলের একটি শহরে থাকি। আমাদেরে শহরে বইয়ের দোকান আছে অনেক। সেগুলোতে স্কুল কলেজের পাঠ্য ও গাইড বই ছাড়া অন্য বই খুব কমই দেখা যায়। সৃজনশীল বলুন আর মননশীল বলুন, সেইরকম বইয়ের দোকান খুব একটা নাই। আমাদের শহরে প্রকাশনা ব্যবসার সাথে ‘কোরাস’ নামে একটি দোকান চালান বই পাগল এক যুবক মুজাহিদ আহমদ। তাঁর কোরাসেই আমাদের মত পাঠকের উপযোগী কিছু কিছু বই আসে। কিন্তু সবসময় কোরাসও আমাদের মতো পাঠকদের চাহিদার যোগান দিতে পারে না। তারপরও মন্দের ভালো হিসাবে দোকানটি টিকে আছে, টিকে থাক্।

আমাকে প্রায়ই অর্ডার করে ‘রকমারি’ থেকে বই আনাতে হয়। আমার আনানো বই ছাড়িয়ে আনার জন্য আমি নিজে প্রায়ই কুরিয়ার অফিসে যাই। আমি যেদিনই কুরিয়ার অফিসে গিয়েছি, দেখেছি কেবল আমার বই নয়, আমার মতো আরও অন্তত বিশ থেকে পঁচিশ জনের বইয়ের প্যাকেট এসেছে। কুরিয়ার অফিসের লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জেনেছি, প্রতিদিনই এভাবে কিছু না কিছু বই নানাজনের নামে আসে। আর আমার নিজের চোখে দেখাটাকেওতো বিশ্বাস করতে হবে। মানুষ যদি বই নাই পড়বে তবে কেনো রকমারি কিংবা অনলাইনের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে এতো এতো বইয়ের প্যাকেট আসবে? আমি বলবো বইয়ের পাঠক মোটেই কমেনি বরংচ বেড়েছে।

শুরু করেছিলাম আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বইয়ের প্রসঙ্গ দিয়ে। বই প্রসঙ্গেই বলতে গিয়ে অন্য প্রসঙ্গও এসে গেল। আমাদের শহরের সেই যে ‘কোরাসে’র কথা বলেছি; ক’দিন আগে এক দুপুরবেলা কোরাসে গিয়ে বই দেখছি। এসময় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুইজন প্রধান শিক্ষক কোরাসে এসে ঢুকলেন। তাদের দু’জনের হাতেই বেশ বড় সাইজের চারখানা করে বই। ওই দুই প্রধান শিক্ষক আমার পূর্ব পরিচিত। তাদের হাতে বই দেখে আমি উৎফুল্ল হলাম। কি বই? কোথা থেকে আনলেন? এমন প্রশ্ন করে বইগুলো দেখতে চাইলাম। দু’জনই ক্ষোভ প্রকাশ করে আমার সামনে টেবিলের উপর ধাম্ ধাম্ করে বইগুলো রাখলেন। একজন বললেন, ‘‘আমাদের বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের পড়ার জন্য এই বইগুলো নগদ চব্বিশ’ টাকা দিয়ে কিনে এনেছি। বলুন ছাত্ররা এই বই পড়তে পারবে? তারা কি কিছু বুঝবে?’’ অন্য প্রধান শিক্ষকের চেহারায় তখনও বিরক্তি রয়ে গেছে। তিনি বললেন, ‘বইগুলো দেখুন, আপনি লেখক মানুষ, আপনিও কিছু বলুন।’

আমি তাদের আনা বইয়ের দিকে মনোযোগ দিলাম। দেখি চার চার আটখানা বই, দুটি বিষয় নিয়ে করা হয়েছে। প্রচ্ছদে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ছবি। বইগুলোর লেখক আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একটি বইয়ের নাম ‘সকলের তরে সকলে আমরা’। এই বইয়ে প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ ও ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত যে ভাষণগুলো দিয়েছেন সেগুলোর বাংলা ও ইংরেজি সংকলন। অপর বইয়ের নাম ‘আহ্বান’। এই বই করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত জাতির উদ্দেশে যেসব ভাষণ দিয়েছেন সেগুলো সংকলিত করে।

দু’খানা বইয়ের-ই কাগজ, ছাপা, বাঁধাই খুবই উন্নত মানের। প্রতি কপি বইয়ের মূল্য ছয়শত টাকা। প্রত্যেকটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লাইব্রেরির জন্য প্রতিটি বইয়ের দুই কপি করে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস বিক্রি করেছে। প্রধান শিক্ষকরা এই বইগুলো কিনে নিতে বাধ্য। চারখানা বইয়ের জন্য প্রধান শিক্ষকদের দুই হাজার চারশত টাকা করে অফিসের সংশ্লিষ্ট ক্লার্কের কাছে পরিশোধ করতে হয়েছে। বুঝতে পারি টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে বলেই এই দুই প্রধান শিক্ষক ক্ষুব্ধ। আমি শিক্ষকদের অনুমতি নিয়েই একটি বিদ্যালয়ের জন্য আনা চারখানা বইয়ের ছবি উঠিয়ে নিলাম। এই সময় কোরাসের কর্ণধার মুজাহিদ আহমদ বললো, ‘ভাই, আমি এমন একখান বই প্রকাশের অনুমতি পেলে কোটিপতি হয়ে যেতাম।’

আমি ওই দুই প্রধান শিক্ষককে উদ্দেশ্য করে বললাম; ‘প্রধানমন্ত্রীর বই প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাচ্ছে, এটাতো আনন্দের বিষয়। কিন্তু আমারও প্রশ্ন হচ্ছে বইগুলো কি প্রাথমিকের ছাত্রছাত্রীদের জন্য উপযোগি? আর প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রিয় এইসব ভাষণ বই আকারে করাটা তো সরকারি খরচেই হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, উচ্চ বিদ্যালয় ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লাইব্রেরিগুলোতে দিতে হলে বিনামূল্যে দেওয়ার কথা। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ সংকলন টাকার বিনিময়ে কিনতে হবে কেনো?’

তখন একজন বললেন; ‘ভাই, এই বই রাষ্ট্রিয় ভাবে হয়নি। ব্যবসার জন্য প্রধানমন্ত্রীর আশপাশের এক দু’জন প্রকাশনীর মাধ্যমে প্রকাশ করে আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তারা কোটি কোটি টাকা কামাই করে নিচ্ছেন।’ উনার কথায় আমি বইয়ের প্রথম দিকের পাতা উল্টালাম। ঠিকইতো প্রকাশক ‘জিনিয়াস পাবলিকেশন্স’-এর মো. হাবিবুর রহমান। দু’খানা বইয়েরই গ্রন্থনা ও সম্পাদনা মো. নজরুল ইসলাম, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার (সচিব)। খেয়াল করে দেখলাম বই দু’খানার কপিরাইট শেখ হাসিনা। বুঝতে পারি যে এই বইগুলোর যে রয়্যালিটি আসবে সেটা আমাদের প্রধানমন্ত্রীই পাবেন।

এখন একটা হিসাব করে দেখি। বাংলাদেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৬শ ২০টি। এই বই যখন প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে বাধ্যতামূলক কিনতেই হবে, তা হলে ৪ কপি করে বই বিক্রি হবে উল্লেখিত বিদ্যালয়গুলোতে ২ লাখ ৬২ হাজার ৪শ ৮০ কপি। এই বইয়ের মূল্য থেকে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের হাতে টাকা আসবে ১৫ কোটি ৭৪ লাখ ৮৮হাজার। বইয়ের কপিরাইট অনুযায়ী শতকরা ১৫ ভাগ রয়্যালিটি নিলেও আমাদের প্রধানমন্ত্রী পাবেন ২ কোটি ৩৬ লাখ ২৩ হাজার ২শ টাকা। হিসাবে কিন্তু আমার মাথা ঘুরে গেছে। বই থেকে এমন অঙ্কের রয়্যারিটি এদেশে আগে কেউ পেয়েছেন কি না আমি জানি না।

আর এটাতো আমি কেবল প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বিক্রির হিসাব দিলাম। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লাইব্রেরির জন্য যখন বাধ্যতামুলক করা হয়েছে, তবে তো উচ্চ বিদ্যালয়, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়েও এই বইগুলো এভাবেই বিক্রি হবে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যুক্ত করলে আরো কতো কতো হাজার বেড়ে যাবে। আমি হিসাব বাড়ালে অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারি।

আমার ঘরেও একজন প্রধান শিক্ষক আছেন। লেখাটার পূর্ণতার জন্য তার কাছে কিছু তথ্য জানতে চেয়েছিলাম। তিনি খ্যাক্ করে উঠে বললেন, ‘স্কুল আমি চালাই। আমার স্কুলের জন্য কখন কি ভাবে কি কিনবো না কিনবো সেটা তোমাকে বলবো কেনো?’ দেখলাম ঘাটাতে গেলে আবার কি থেকে কি হয়ে যায়। তাই কথা না বাড়িয়ে লেখা শেষ করার দিকেই মনোযোগ রাখলাম।

আমরা যারা লেখক আমাদের মধ্যে একটা কথা প্রচলিত আছে যে, প্রকাশকরা লেখকদের ঠকান। তারা ঠিক মতো লেখকের পাওনা রয়্যালিটি পরিশোধ করেন না। তাই বলে কি প্রধানমন্ত্রীকে ‘জিনিয়াস পাবলিকেশন্স’-এর মো. হাবিবুর রহমান ঠকানোর সাহস করবেন? নিশ্চয় না। এই ভরসাতেই বলতেই পারি বই বিক্রির অর্থে আমাদের লেখক শেখ হাসিনা কোটিপতি হবার পথে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, ছড়াকার

ইমেইল: [email protected]

;

দশ টাকার শোক



মনি হায়দার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

প্রায় পনেরো মিনিট ধরে মানিব্যাগটা উল্টেপাল্টে দ্যাখে রজব আলী।

মানিব্যাগটা খুব পছন্দ হয়েছে তার। বিশেষ করে মানিব্যাগটার বাদামি রংটা। ব্যাগটা চামড়ার তৈরি। রজব আলী নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শোকে। বোঝা যায় না কোন্ পশুর চামড়ায় মানিব্যাগটা তৈরি হয়েছে। মানিব্যাগটার ভেতরে অনেকগুলো ছোট ছোট কুঠরি। রজব আলী কল্পনায় দেখতে পায়- মানিব্যাগটার ভিতরে রাখা টাকায় ভেতরের কুঠুরিগুলো ভরে উঠেছে।

ব্যাগটা প্যান্টের পকেটে নিয়ে যখন হাঁটবে পিছটা ফুলে যাবে, মুহূর্তেই শরীরের কোষে কোষে একটা অন্যরকম অহমিকা অনুভব করে সে।

ভাই, মানিব্যাগটার দাম কতো ? রজব আলী মানিব্যাগঅলাকে জিজ্ঞেস করে।

ব্যাগঅলা রজব আলীর উপর মনে মনে চটে উঠেছে। সেই কতোক্ষণ থেকে ব্যাগটা উল্পেপাল্টে দেখছে। কেনার কথা বলছে না। অথচ রজব আলীর দেখার মধ্যে দুটো ব্যাগ সে বিক্রি করেছে। ফুটপাতের জিনিস এতক্ষণ নাড়াচাড়া কেউ করে না। ব্যাগঅলা রাগ করে কিছু বলতেও পারে না। যদি কেনে ?

আপনি নেবেন ? রজব আলীর দাম জিজ্ঞাসায় ব্যাগঅলা পাল্ট প্রশ্ন ছোড়ে। কারণ রজব আলীকে দেখে তার মনে হয় না এই লোক মানিব্যাগ কিনবে।

রজব আলী একটি বহুজাতিক কোম্পানির অফিসের পিওন। পরনের পোশাকে ঐ বহুজাতিক কোম্পানির পরিচয় আছে। ব্যাগঅলার ধারণা এইসব লোকজন সাধারণত মানিব্যাগ-ট্যাগ কেনে না। তাদের সামান্য টাকা আয়, কোনোভাবে সেই পয়সায় মানিব্যাগ কেনার মানসিকতা বা প্রয়োজনীয়তাও থাকে না।
নেবো।

ইতোমধ্যে ব্যাগঅলার সামনে দামি প্যান্টশার্ট পরা একজন ভদ্রলোক এসেছে। সঙ্গে তন্বী তরুণী। তাদের আসায় চারপাশের আবহাওয়ায় বিদেশী সেন্টের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। ভদ্রলোকের কাছে রজব আলী অযাচিতভাবে হেরে যায়। বাস্তবতার কারণে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়াতে হয় তাকে।

তন্বী তরুণী ও ভদ্রলোক মিলে কয়েকটা মানিব্যাগ দেখে। বাছাই করে। অবশেষে তন্বীয় কথানুযায়ী ভদ্রলোক তিনশো পঁচিশ টাকায় একটা মানিব্যাগ নিয়ে চলে গেলো। মাত্র তিন-চার মিনিটের মধ্যে তারা মানিব্যাগ দেখলো, দাম করলো, কিনলো এবং চলেও গেলো। অথচ রজব আলী বিশ-পঁচিশ মিনিচের মধ্যে মধ্যে দামটাও জানতে পারলো না ! তারা চলে যাওয়ার পর রজব আলী ব্যাগঅলার কাছে যায়।

বললেন না কতো দাম ?

রজব আলীর দিকে আড়চোখে তাকায়, মানিব্যাগ আপনার পছন্দ হয়েছে?

পছন্দ না হলে দাম জিজ্ঞেস করবো কেনো ?

একশো আশি টাকা।

একশো আশি টাকা। রজব আলী মুখ থেকে বিপন্ন শব্দগুলো বের হয়।

বিরক্তি প্রকাশ করে ব্যাগঅলা, অবাক হওয়ার কি আছে? আপনার সামনেই তো দেখলেন তিনশো পঁচিশ টাকায় একটা মানিব্যাগ বিক্রি করেছি। ঠিক আছে আপনি ঐ সোয়াশ টাকাই দেন।
সোয়াশ টাকা একটা মানিব্যাগের দাম ! রজব আলীর বিস্ময় কোনো বাঁধা মানে না।

ব্যাগঅলা বুঝতে পারে রজব আলী এতো টাকায় ব্যাগ কিনবে না। সবাইতো ঐ টাকাঅলা ভদ্রলোক নয়, বেশি দাম-দর না করেই তাদের হাকানো দামেই কিনবে। রজব আলীরা তো মানিব্যাগই কেনে না। সেখানে রজব আলী যে কিনতে এসেছে সেটাই অনেক। ব্যাগঅলা মানিব্যাগ বিক্রি করলেও তার পকেটে মানিব্যাগ থাকে না। নিজের সঙ্গে রজব আলীর সাদৃশ্য দেখতে পায় ব্যাগঅলা। একই কাতারের ঠেলা-গুতা খাওয়া মানুষ তারা। লোকটাকে ঠকিয়ে লাভ নেই। হয়তো অনেক আশা করে সারা জীবনে একবার একটা মানিব্যাগ কিনতে এসেছে।

আপনি সত্যিই কি মানিব্যাগটা কিনবেন ? নরম কণ্ঠে ব্যাগঅলা জানতে চায়।

কিনবো বলেই তো পছন্দ করেছি। দাম জানতে চাইছি।

তাহলে শোনেন ভাই, অনেক্ষণ ধরে আপনি মানিব্যাগটা দেখছেন, ফাইনাল কথা বলে দিচ্ছি, মানিব্যাগটা আপনি আশি টাকায় নিতে পারবেন। আশি টাকার এক টাকা কমেও বিক্রি করবো না।
রজব আলীর এই মুহূর্তে ব্যাগঅলাকে খুব কাছের মানুষ মনে হয়। কোথায় একশো আশি টাকা, সেখান থেকে একশত পঁচিশ এবং সবশেষে পুরো শতকই নেই; কেবল আশি টাকা। সে পকেট থেকে টাকা বের করে দিয়ে মানিব্যাগটা পকেটে রাখে। মানিব্যাগটা পকেটে রাখার সঙ্গে সঙ্গে রজব আলী নিজেকে একজন দামি মানুষ ভাবে। তার পকেটেও অনেকের মতো মানিব্যাগ আছে।

দীর্ঘদিনের একটা আকাক্ষা, একটা স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলো রজব আলীর। মানিব্যাগ কেনার একটা সিগারেট কেনে। সাধারণত সে সিগারেট টানে না। কিন্তু এই মুহূর্তে একটা সিগারেট টানার ইচ্ছে হলো তার। না, কেবল সিগারেটই নয়, একটা ঝাল দেওয়া পানও কিনলো এবং মুখে দিয়ে পরম আয়াসে চিবুতে লাগলো। সিগারেটটা ধরিয়ে পান চিবুতে চিবুতে রজব আলী একটা রিকশায় উঠলো। পর পর তিনটি কাজ সে করলো-যা সে খুবই কম করে। সিগারেট টানা, পান খাওয়া এবং রিকশায় করে বাসায় ফেরা। তার জীবনেএকটুকুই শ্রেষ্ঠ বিলাসিতা। রিকশা ছুটে চলেছে।

রজব আলীর মাথার কোষে, যেখানে স্বপ্ন বিলাসী বা ইচ্ছের রক্তকণিকা থাকে- সেখানে মানিব্যাগ কেনার শখ জাগলো প্রায় মাস তিনেক আগে। সে, অফিসের বড় সাহেবের ব্যক্তিগত পিওন। চা, চিনি, সিগারেট থেকে শুরু করে যা কিছু দরকার সবই আনে রজব আলী। দীর্ঘদিনের চাকরির কারণে সে বড় সাহেবের খুব বিশ্বস্ত ও অনুরাগী। অফিসে প্রতিদিন অনেক মেহমান আসে।

নানান কিসিমের মানুষের আনাগোনা বড় সাহেবের কাছে। এইসব মেহমান আসলেই বড় সাহেব বেল টিপে রুমের বাইরে হাতলবিহীন চেয়ারে অপেক্ষায় থাকা রজব আলীকে ডাকেন। রজব আলী ত্রস্ত খরগোশের মতো ভেতরে ঢোকে। কিন্তু ঢুকেই খরগোশের মতো মাথা উঁচু রাখতে পারে না। কোথাকার কোন এক অদৃশ্য অপরিমেয় শক্তি এসে তার মাথাটাকে নিচু করে দেয়।

তার দাঁড়ানো পর বড় সাহেব বড় অবহেলায়, নিপুণ নৈপুণ্যে, গাম্ভীর্যের কৌশলী পারম্পর্যে অবলীলায় প্যান্টের ডান দিক থেকে মোগল সম্রাটদের ক্ষমতায় মানিব্যাগটা বের করে টেবিলে রাখেন। মেহমানবৃন্দ গভীর অভিনিবেশে বড় সাহেবের কর্মকান্ড দেখতে থাকেন। মানিব্যাগটা টেবিলে রেখেই বড় সাহেব টেবিলের অন্যপ্রান্তে রাখা দামি সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে পরম আদরে রাখেন এবং তৎক্ষণাৎ লাইটার জ্বালিয়ে সিগারেট টানেন আয়েসের সঙ্গে।

সিগারেটে দু’-দিনটি টান দিয়ে দুই ঠোঁটের মাঝখানে আটকে রেখে মানিব্যাগটা তোলেন ডান হাতে। মানিব্যাগটা টাকার কারণে সবসময় পোয়াতি নারীর মতো ফুলে থাকে। বড় সাহেবের মানিব্যাগে টাকাগুলো অধস্তন, পরাধীনভাবে নিবিড় শুয়ে থাকতে পছন্দ করে। একহাজার, পাঁচশ, একশ, পঞ্চাশ টাকার অসংখ্য নোট সাজানো পাশাপাশি। দেখতে কতো ভালো লাগে ! রজব আলী দেখে। দেখেই তার আনন্দ।

বাম হাতে মানিব্যাগটা ধরে ডান হাতের দুই আঙ্গুলে বড় সাহেব বেশ কয়েকটা নোট বের করেন। একটা নোট রজব আলীর দিকে বাড়িয়ে দেন, শীগগির নাস্তা নিয়ে আয়।

রজব আলী বিনয়ের সঙ্গে টাকাটা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। এবং নাস্তার আয়োজনে নিদারুণভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এইভাবেই রুটিন চলছিলো। হঠাৎ মাস তিনেক আগে রজব আলীর মাথায় এই প্রশ্নটা উঁকি দেয়- বড় সাহেবের গাড়ি বাড়ি টাকা মান-সম্মান ক্ষমতা আছে। রজব আলীর কিছুই নেই। কিন্তু একটা মানিব্যাগতো থাকতে পারে। আর যাই হোক বড় সাহেবের মতো মানিব্যাগ থেকে সেও টাকা বের করে বাস কন্ডাকটর, চালের দোকানদার, মাছঅলা, ডালঅলাদের দিতে পারবে।

এই ভাবনা, স্বপ্ন এবং কল্পনার পথ ধরে কয়েকমাস যাবৎ রজব আলী চেষ্টা করে আসছে একটা মানিব্যাগ কেনার। নানা কারণে হয়ে ওঠেনি। বৌয়ের শরীর খারাপ- ডাক্তারের টাকা দেওয়া, ছেলেমেয়েদের স্কুলের বেতন, বই খাতা কেনা- যাবতীয় সাংসারিক কাজের চাপে মানিব্যাগ কেনা সম্ভব হয়নি। আজকে সে বেতন পেয়েছে। এবং সমস্ত চাপ উপেক্ষা করে রজব আলী মানিব্যাগটা কিনেই ফেললো। আসলে কখনো কখনো একটু-আধটু রিস্ক নিতেই হয়। নইলে ছোটখাট স্বাদ-আহ্লাদ পূরণ হবার নয়।

রিকশায় বসেই সে জামার বুক পকেট থেকে বেতনের বাকি টাকাগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে মানিব্যাগে। মানিব্যাগটার পেট ফুলে যায়। হাতে নিয়ে তার দারুণ ভালো লাগে। কিছুক্ষণ হাতে রাখার পর রজব আলী মানিব্যাগটাকে পিছনে প্যান্টের পকেটে রাখে। ঘাড় ঘুরিয়ে সে প্যান্টের পিছন দিকটা ফিরে ফিরে দ্যাখে- কতোটা ফুলে উঠলো ? তেমন না। যেভাবে বড় সাহেবের পিছন দিকটা ফুলে থাকে, সে রকম নয়। রজব আলীর মনটা খারাপ হয়ে গেলো।

রিকশা বাসার কাছে আসলে সে ভাড়া মিটিয়ে নেমে যায়। তার মনের মধ্যে ছোট সুখের একটা ছোট পাখি ডানা মেলেছে। গানের সুর ভাজতে ভাজতে রজব আলী দেড় কামরার স্যাঁতস্যাঁতে বাসায় ঢোকে। সে ঢুকলো সংসারে, তাতে সংসারের কিছু যায় আসে না। সংসারটা তার কাছে সীমাহীন অন্ধগলির মোড়। যেখানে অভাব দারিদ্র ক্ষুধার চাহিদা কুমিরের হা মেলে থাকে, সেখানে তার মতো একজন রজব আলীর আসা না আসায় কিছুই যায় আসে না। রজব আলী স্ত্রী মকবুলা বেগম চতুর্থ সন্তান, যার বয়স মাত্র তিনমাস তাকে মাই খাওয়াচ্ছে।

অন্যান্যরা মেঝেতে জটলা পাকাচ্ছে একটা পুরোনো ক্যারামের গুটি নিয়ে। মকুবলা বেগম ঘাড় ফিরিয়ে রজব আলীকে একবার দেখে আবার মাই দিতে থাকে। রজব আলী কি করবে ভেবে পায় না। সাধারণত বেতন নিয়ে বাসায় ফিরলে তরিতরকারি, চাল, ডাল, লবণ, তেল, সাবান, দুই এক প্যাকেট সস্তা বিস্কুট সঙ্গে নিয়ে আসে রজব আলী। আজকে একবারে অন্যরকম একটা জিনিস এসেছে- যার প্রতি তার নিজের মমতা অনেক। সংসারে অন্যদের প্রতিক্রিয়া কি হবে বুঝতে পারছে না।

শুনছো ? রজব আলী স্ত্রীকে ডাকছে।

কনিষ্ঠতম সন্তানের মুখ থেকে মাই সরাতে সরাতে সাড়া দেয় মকবুলা বেগম, কি ?

একটা জিনিস এনেছি।

মকবুলা বেগম সরাসরি তাকায় রজব আলীর দিকে, কি এনেছো ?

অদ্ভুত একটা হাসি রজব আলীল ঠোঁটে, একটা মানিব্যাগ।

দ্রুত ব্যাগটা বের করে মকবুলা বেগমের হাতে দেয় রজব আলী। ব্যাগটা হাতে নিয়ে কয়েক মুহূর্ত স্থানুর মতো বসে থাকে মকবুলা বেগম। একবার কোটরের চোখ দিয়ে তাকায় রজব আলীর দিকে। দৃষ্টি ফিরিয়েই ব্যাগটা অবহেলায় রেখে দেয় সে, মানিব্যাগ ফুটাতে কে বলেছে তোমাকে! বেতন পেয়েছো আজ না ?

বেতন পেলে আর মাথা ঠিক থাকে না। মকবুলা বেগমের লং প্লে রেকর্ড বাজা আরম্ভ হলো, বাসায় কিছু নাই। অফিসে যাবার সময় বললাম, ফিরে আসার সময় ছোট বাচ্চাটার জন্য এক কৌটা দুধ এনো। বড় ছেলেটার খাতা পেন্সিল নেই- নিয়ে এসো। তার কোনো খবর নেই। উনি নিয়ে এলেন মানিব্যাগ। ছেলেমেয়ে বৌয়ের মুখে তিন বেলা ভাত জোটাতে পারে না, উনি মানিব্যাগ কিনে ভদ্দরলোক হয়েছেন! কানার আবার স্বপ্ন দেখার শখ!

রজব আলীর মন শরীর স্বপ্ন আকাক্ষাগুলো শাঁখের করাতে কাটছে এখন। হায়, সংসারের জন্য ব্যক্তিগত দুই-একটা স্বপ্নও কি পূরণ করা যাবে না ! সকাল থেকে রাত পর্যন্ততো সংসারের সুখের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। সামান্য একটা মানিব্যাগের জন্য স্ত্রী এমনভাবে শ্লেষের কথা বলে-একেক সময় মনে হয় রজব আলী আত্মহত্যা করে। পারে না।

স্ত্রীর শান দেওয়া কথার বান থেকে আপাতত রক্ষা পাবার জন্য না খেয়ে বাইরে চলে আসে রজব আলী। এভাবেই সে অক্ষমতার জ্বালা, বেদনা ও ক্ষরণকে তাড়িয়ে থাকার চেষ্টা করে। রাস্তায় দোকানে এখানে সেখানে ঘন্টাখানেক ঘোরাঘুরি করে আবার মকবুলা বেগমের সংসারেই ফিরে আসে। পরের দিন রজব আলী যথারীতি অফিসে।

অফিসের লোকজনের কাছে মানিব্যাগটা দেখায়। কেউ দেখে, কেউ আগ্রহবোধ করে না।

বল তো বারেক, অফিসের আরেকজন পিওনকে ডেকে জিজ্ঞেস করে রজব আলী- মানিব্যাগটা কেমন হয়েছে ?

বারেক মানিব্যাগটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে- ভালো। খুব ভালো হয়েছে। কতো টাকায় কিনেছো ?
প্রচ্ছন্ন গর্ব রজব আলীর, তুই বল।

আমি কেমনে বলবো ?
অনুমানে।
বারেক কয়েক মুহূর্ত ভেবে বলে, ত্রিশ-চল্লিশ টাকা।

তোর বাপের মাথা! ধমকে ওঠে রজব আলী। এ রকম একটা মানিব্যাগ জীবনে চোখে দেখেছিস ? কেমন রং এটার ! ভেতরে কতোগুলো ঘর আছে জানিস ! একহাজার, পাঁচশ, একশো, পঞ্চাশ টাকার নোট রাখার আলাদা আলাদা জায়গা আছে। তাছাড়া এই ব্যাগটা বিদেশী। দেশী না।

তোমার মানিব্যাগের যতো দামই থাক, তুমি বাপ তুলে কথা বলবে ? বারেকের আত্মসম্মানে সামান্য ঘা লাগে।

বলবো না, হাজার বার বলবো। এতো শখ করে একশ টাকা দিয়ে একটা মানিব্যাগ কিনলাম। আর তুই কিনা বলিস মাত্র ত্রিশ-চল্লিশ টাকায় কিনেছি ! জানিস, এই রকম মানিব্যাগ আছে আমাদের বড় সাহেবের।

হতেই পারে। আমার তো মানিব্যাগ নেই। কখনো ছিলোও না। তাই দাম জানি না। কিন্ত তুমি একটা একশো টাকা মানিব্যাগে জন্য বাবা তুলে কথা বলতে পারো না-

বারেক যখন মানিব্যাগ সংক্রান্ত তর্কে হেরে যাচ্ছিলো, তখনই বড় সাহেব অফিসে ঢোকেন সঙ্গে কয়েকজন বন্ধু মেহমান নিয়ে। বারেক চট্ করে সরে যায়। রজব আলী দ্রুত দরজা খুলে দাঁড়ায়। বড় সাহেব সঙ্গীদের নিয়ে রুমে ঢোকেন। রজব আলীকে চা আনতে বলেন বড় সাহেব। শুরু হয় রজব আলীর দৌড়।

কয়েকদিন পর বড় সাহেব অফিসে কয়েকজন ক্লায়েন্টের সামনে বসে রজব আলীকে ডাকেন, রজব আলী?

জ্বী স্যার ?
তোমার হয়েছে কি ?

রজব আলী ভেবে পায় না তার কোথায় কখন কি হয়েছে ? ডানে বামে উপরে নিচে তাকায় সে, কই স্যার-কিছু হয় নাইতো।
তোমার হাতে মানিব্যাগ কেনো ?

এই কথার কি জবাব দেবে রজব আলী? হঠাৎ মগজের কোষ কোনো কাজ করে না। সে বুঝে উঠতে পারে না- তার হাতে মানিব্যাগ থাকলে বড় সাহেবের অসুবিধা কি ? কক্ষের সবাই রজব আলীর দিকে চেয়ে আছে। এক অনিশ্চয়তার মুখোমুখি। হঠাৎ রজব আলী উপলব্ধি করতে পারে- মানিব্যাগটা থাকার কথা প্যান্টের পকেটে। হাতে নয়। এবং তার আরো মনে পড়লো মানিব্যাগটা কেনার পর থেকে, বিশেষ করে অফিস করার সময় মানিব্যাগটা কারণে-অকারণে তার হাতেই থাকে। কেন থাকে ?

সে কি সবাইকে তার সদ্য কেনা মানিব্যাগটি দেখিয়ে তৃপ্তি পেতে চায় ? যা প্রকারান্তরে অক্ষম অথর্ব মানুষের করুণ মনোবিকৃতি ? নিশ্চয়ই তার অবস্থা দেখে বড় সাহেব, তার পরিষদবর্গ, অফিসের লোকজন হাসছে। রজব আলী নিমিষে নিজেকে বায়ুশূন্য ফাটা একটা পরিত্যাক্ত বেলুন হিসাবে নিজেকে আবিষ্কার করে। লজ্জায় বালুর সঙ্গে সে মিশে যেতে চাইছে। কিন্তু মানুষের পক্ষে মুশকিল হচ্ছে- সে ইচ্ছে করলেই বালু বা বায়ুর সঙ্গে মিশে যেতে পারে না। মানুষ হিসাবে তাকে অনড় ও অবিচল থাকতে হয়।

বড় সাহেবের মুখে অদ্ভুত হাসি- রজব ?

জ্বী স্যার ?
মানিব্যাগটা কবে কিনেছো ?

রজব আলী জবাব দেয় না। দিতে পারে না। ভেতরের কে একজন যেন রজব আলীকে থামিয়ে দিয়েছে। যে রজব আলীর ওষ্ঠ জিহ্বা কণ্ঠ ভেতরের ক্ষুধিত শক্তিকে পাথর বানিয়ে জমাট করে রেখেছে। প্রাণপণে চেষ্টা করছে কথা বলতে। পারছে না। সে মাথাটা নিচু করে দাঁড়িয়ে। কথা বলছো না কেন ? বড় সাহেবের কণ্ঠে এখন কর্তৃত্ব ও অপমানের সুর।

ঢোক গিলে জবাব দেয় রজব আলী- কয়েক দিন আগে।

কতো টাকায় ?

একশ টাকা।

তাই নাকি ! দেখি, বড় সাহেব হাত বাড়ান।

রজব আলী সারা জীবনের সমস্ত অভিশাপ নিজের মাথায় ঢালে-কেন সে মানিব্যাগ কিনতে গেলো ? কিনলোই যদি তাহলে পকেটে না রেখে হাতে রাখার প্রয়োজন হলো কেন ? দেখাতে চেয়েছিলো বড় সাহেবকে ? বড় সাহেবের মানিব্যাগ থাকলে পারলে তার থাকবে না কেন ? প্রতিযোগিতা ? কি অসম প্রতিযোগিতা ? কি ভয়ংকর গ্লানিকর পরাজয় !

কই দাও, বড় সাহেবের হাতটা তখনো বাড়ানো। নিন।

রজব আলী ব্যাগটা দিয়ে বেরিয়ে যেতে চায়।

কোথায় যাও? তোমার মানিব্যাগ নিয়ে যাও-

আর যেতে পারে না সে কক্ষের বাইরে। কক্ষের ভিতরে রজব আলীর শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। বড় সাহেব মানিব্যাগটাকে উল্টেপাল্টে দেখেন। কক্ষের অন্যান্য সবাই বড় সাহেবের হাতের ব্যাগটাকে তীর্যক চোখে দেখছে। কেউ কেউ হাসছে। সে হাসির ভেতরে লুকিয়ে আছে তীক্ষ্ন কাঁটা। কাঁটায় বিষ। যা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পান করছে রজব আলী। এছাড়া তার উপায়ও নেই।

রজব আলী !

বড় সাহেবের ডাকে চোখ তুলে তাকায় সে, স্যার!

নাও তোমার মানিব্যাগ। ব্যাগটা ভালোই কিনেছো।

হাত বাড়িয়ে ব্যাগটি নিয়ে রজব আলী দরজা খুলে নিমিষে বাইরে চলে আসে। দরজা দ্বিতীয়বার বন্ধ করতে পারে না, তার আগেই বড় সাহেব এবং অন্যান্যদের হাসির ছুরি তীব্র অপমানে রজব আলীর কান এবং মর্মের মূলে আঘাত হানে। মনে হচ্ছে তাদের হাসির হলকা তাকে শান দেয়া ছুরির মতো কাটছে। আর রজব আলী নিজের রক্তে ভেসে যাচ্ছে।

রজব আলী মানিব্যাগ আর হাতে রাখে না। প্যান্টের পকেটেই রাখে। মাস শেষে মানিব্যাগের ছোট্ট খোপে খুচরো কয়েকটা মাত্র টাকা দেখতে পায় রজব আলী। মানিব্যাগে টাকা নেই, একটা পরিত্যাক্ত রুমালের মতো মনে হয় মানিব্যাগটাকে। এবং রজব আলী বুঝতে পারে- বড় সাহেবের মতো মানুষদের সঙ্গে রজব আলীরা কোনদিন, কোনোকালে পাল্লা দিয়ে টিকতে পারবে না।

মাস শেষ, রজব আলীর মানিব্যাগের টাকাও শেষ। অথচ বড় সাহেবের মানিব্যাগে মাসের প্রথম দিকে যতো টাকা ছিলো বা থাকে, এখনো সে রকমই আছে। কমে না। বরং বাড়ে। তাহাদের টাকা বাড়তেই থাকে। বাড়বে আমৃতকাল।

দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে রজব আলী।

দীর্ঘনিঃশ্বাস এবং পুঞ্জিভূত ক্ষোভ নিয়ে নিত্যদিনের স্বাভাবিক জীবনযাপন চালিয়ে যাচ্ছে রজব আলী। প্রতিদিনের জীবনাচারের সঙ্গে রজব আলী বেশ মানিয়ে নিয়েছে। মানিব্যাগটা তার সঙ্গে থাকছে প্রতিদিনকার মতো- যেমন তার পকেটে থাকছে একটি রুমাল, একটি চিরুনি।

মাসের প্রথম দিকে মানিব্যাগটা ভরা থাকে, মাঝখানের দিকে কমতে কমতে টাকা অর্ধেকেরও কমে এসে পৌঁছে এবং এই কমার গতিটা বলবৎ থাকে গাণিতিক হারে।

মাসের শেষের দিকে রজব আলী মানিব্যাগ বহন করার আর কোন যুক্তি খুঁজে পায় না। কারণ ব্যাগের তলায় পাঁচ-দশটা টাকা পড়ে থাকে বড় অযত্নে, বড় অবহেলায়। কখনো কখনো রজব আলীর মনে হয়- মানিব্যাগটা বোধহয় তাকেই উপহাস করছে। মাস খানেক পরে একদিন।

রজব আলী অফিস থেকে ফিরছে। মাস শেষের দিকে। বাসে প্রচুর ভিড়। বাসে ওঠা মানে জন্তুর খাঁচায় ওঠা। জীবন যে কতো অবাঞ্ছিত, বাসে উঠেই সেটা বুঝতে পারে রজব আলী।

বাস থেকে নেমেই হাত দেয় প্যান্টের পকেটে। পকেটটা খালি, বুকটা ধড়াস ধড়াস করে, মানিব্যাগটা নেই ! এতো সাবধানে থাকার পরও মানিব্যাগটা নিয়ে গেলো?

রজব আলী কয়েক মুহূর্ত স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। মানিব্যাগটা পকেটমার নিয়ে গ্যাছে। রজব আলী মানিব্যাগটার জন্য ভাবছে না। ভাবছে মানিব্যাগের সর্বশেষ পুরোনো ময়লা দশটি টাকা...। ওই দশ টাকা থাকলে আরো দুই দিন বাস ভাড়া দিয়ে অফিসে আসা-যাওয়া করতে পারতাম।

;