আর্নেস্ট হেমিংওয়ের অগ্রন্থিত গল্প : অনুসৃতিই আনন্দ



অনুবাদ: রাজিয়া সুলতানা
অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

  • Font increase
  • Font Decrease

‘ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি’ দিয়ে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে যেভাবে সাহিত্যে চিরস্থায়ী আসন পেয়েছিলেন, সেই একই কিউবার উপকূল থেকে শুরু ‘অনুসৃতিই আনন্দ’, এটিতেও আছে মার্লিনমাছের ঘটনা। মিশেছে আরো অনেক ঘটনাবলি। হেমিংওয়ের গুটি কয়েক গল্পই শুধুমাত্র অপ্রকাশিত আছে, এটি তার মধ্যে একটি। এটি লেখা হয়েছিল ১৯৩৬ থেকে ১৯৫৬ সালের মধ্যে কোনো এক সময়ে। হেমিংওয়ের নাতির সূত্রে পাওয়া গেছে এই অমূল্য গল্পটি।

এই গল্পের মূল আকর্ষণ ‘ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি’ উপন্যাসিকার মার্লিনমাছ এবং হেমিংওয়ের আত্মজৈবনিক উপাদান। - বিভাগীয় সম্পাদক


সে বছর কিউবার উপকূলে আমরা মাসব্যাপী মার্লিনমাছ ধরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করি। সেই মাসটা শুরু হয়েছিল এপ্রিলের দশ তারিখ থেকে। মে মাসের দশ তারিখ পর্যন্ত আমরা পঁচিশটা মাছ ধরি এবং এই সময় আমাদের মাছধরার অনুমতিপত্রের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। আমাদের উচিত ছিল কী ওয়েস্ট(১)-এ ফিরে যাওয়ার জন্য কিছু উপহারসামগ্রী কেনা আর এদিকওদিক ঘোরার জন্য প্রয়োজনের তুলনায় আরেকটু দামি কিউবান জ্বালানি অনিটায় ভরিয়ে নিয়ে, হিসেবপত্র চুকিয়ে বাড়ি ফেরা। কিন্তু তখনও বড়মাছগুলো আসা শুরু করেনি।

মি. জোসি জিজ্ঞেস করল, “আর একটা মাস কি ওকে রেখে চেষ্টা করে দেখতে চাও, ক্যাপ?” ক্যাপ অনিটার মালিক আর দিনে দশ ডলার করে ভাড়ায় টিকেট দিচ্ছিল। সে সময়ে ভাড়ায় স্ট্যান্ডার্ড টিকেটের মূল্য ছিল দিনে পঁয়ত্রিশ ডলার।

“যদি থাকতে চাও তো কমিয়ে নয় ডলার করতে পারি।”
“নয় ডলার আমরা কোথায় পাব?”
“যখন টাকা হাতে আসে তখন দিয়ো। ব্যুলোতে উপসাগর জুড়ে স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানির সঙ্গে তোমাদের লেনদেন ভালো। বিল পাওয়ার পর গতমাসের টিকেট বিক্রির টাকা থেকে ওদের পরিশোধ করতে পারব। আর আমরা যদি বিরূপ আবহাওয়ার মধ্যে পড়ে যাই তাহলে তুমি কিছু একটা লিখে দিয়ো।”

আমি বললাম “বেশ।” এরপর আমরা আরো একমাস ধরে মাছ ধরলাম। এরমধ্যে আমরা বেয়াল্লিশটা মার্লিন ধরলেও তখনও বড় মাছগুলো আসছিল না। তখনও মরো(২)র কাছে বইছিল গভীর ভারী স্রোত। কোনো কোনো সময় একরের পর এক টোপ ফেলে রাখা হতো—উড়ন্ত মাছগুলো বোটের সামনের অংশের নিচ থেকে লাফ দিত আর সামুদ্রিক পাখিগুলো সেগুলোকে ধরতে চেষ্টা করত। প্রতিদিনই আমরা সাদা মার্লিনগুলো ধরছিলাম, কিছু কিছু আবার হাতছাড়াও হয়ে যাচ্ছিল, একদিন আমি পাঁচটা ধরেছিলাম কিন্তু একটা বিশাল মাছও আমরা ধরতে পারিনি।

তীরে পানির কিনারে আমরা খুব জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিলাম। কারণ, সবগুলো মাছ কেটে টুকরো করে ওখানে সবাইকে দিয়ে দিতাম আর যখন মার্লিনমাছের পতাকা উড়িয়ে মরো কেল্লা পার হয়ে খালের ওপর দিয়ে সানফ্রান্সিসকোর জেটির দিকে যেতাম তখন লোকজন পারঘাটার দিকে দৌড়ে আসত। সে বছর পাউন্ড প্রতি আট থেকে বারো সেন্ট করে কিনে দ্বিগুণ দামে বাজারে বিক্রি করতে পারত বলে জেলেদের জন্য তা ছিল লাভজনক। যেদিন আমরা পাঁচটা পতাকা উড়িয়ে তীরে এলাম, পুলিশ লোকজনদের লাঠিপেটা করেছিল। তীরে অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। সে বছরটাও ছিল মন্দ।

জোসি বলল, “শালার পুলিশ আমাদের নিয়মিত সব খদ্দেরকে তাড়িয়ে দিয়ে সব মাছ নিয়ে নিচ্ছে।” একজন পুলিশ ঝুঁকে পড়ে মার্লিনের দশপাউন্ড ওজনের একটা টুকরা তুলে নেওয়ার সময় জোসি বলল—“আচ্ছা মানুষ তো আপনি, দূর হোন।” পুলিশ বলেছিল—“এইরকম কুৎসিত চেহারা তো আমি এর আগে কখনো দেখি নাই। তোমার নাম কী হে?”

বলাবাহুল্য, পুলিশ ওর একটা নাম দিয়ে দিল।

“কমপ্রমিজো-বইয়ে ওনার নাম আছে নাকি, ক্যাপ?”

আমরা যাদের মাছ দেব বলে কথা দিতাম, তাদের নাম এই বইয়ে লিখে রাখতাম যার অর্থ হচ্ছে প্রতিশ্রুতি-বই।

“আরে নাহ।”

মি. জোসি বলল, “পরের সপ্তাহের তালিকায় ছোট একটা টুকরার জন্য ওর নামটা লিখে রাখো তো, ক্যাপ।” “আর এই যে পুলিশ, আপনে এখন পাটাতন থেকে নেমে দূর হোন, জাহান্নাম বা অন্য কোথাও যান আর এমন কাউকে লাঠিপেটা করেন যে আমাদের বন্ধু নয়। জীবনে অনেক হারামী পুলিশ দেখেছি। যান, ঘাটের পুলিশ না হলে লাঠি পিস্তল দুটোই নিয়ে দূর হোন।”

শেষে সমস্ত মাছ কেটে টুকরো করে বই অনুযায়ী যার যার মাছ আলাদা করে রেখেছিলাম আর পরের সপ্তাহের জন্য প্রতিশ্রুতি-বই নাম দিয়ে ভর্তি হয়ে গিয়েছিল।

“আম্বুজ মুন্ডোজ-এ গিয়ে ধুয়ে টুয়ে পরিষ্কার হয়ে নাও, ক্যাপ। স্নান সেরে নাও। তারপর ওখানে তোমার সঙ্গে কথা হবে। আমরা ফ্লোরিদিতায় গিয়েও কথাবার্তা সেরে নিতে পারব। ওই পুলিশ কর্মকর্তা আমার মেজাজটা বিগড়ে দিয়েছে।”
“তুমিও ওখানে আসতে পারো তো, শাওয়ার নিতে পারো। আমি এখানেই পরিষ্কার হয়ে নেব’খন। আজ আমি তোমার মতো অতটা ঘামিনি।”

আমি আম্বুজ মুন্ডোজ হোটেলের দিকে খোয়া দিয়ে বাঁধানো এই সংক্ষিপ্ত রাস্তাটা দিয়ে হেঁটে গিয়ে কোনো চিঠি এসেছে কিনা ডেস্কে খোঁজ নিয়ে লিফটে উঠে উপরের তলায় গেলাম। আমার রুমটা ছিল উত্তর-পূর্ব কোণে আর জানালা দিয়ে আয়নবায়ু এসে শীতল করে দিচ্ছিল। আমি জানলা দিয়ে পোতাশ্রয়ের চারিদিকে পুরনো শহরের ছাদগুলোর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম। দেখলাম মেক্সিকোর অরিজবা শহর তার সমস্ত বাতি নিয়ে ধীরে ধীরে পোতাশ্রয়ের নিচে নিভে যাচ্ছে। অত অত মাছ ধরে আমি তখন ভীষণ ক্লান্ত, ঘুম পাচ্ছিল খুব। আমি জানতাম শুলেই ঘুম এসে যাবে চোখে, তাই বিছানায় বসে জানলা দিয়ে তাকিয়ে রইলাম। তখন দেখতে পেলাম বাঁদুড়েরা শিকারে নেমেছে, আমি কাপড় খুলে স্নান সেরে পরিষ্কার কাপড় পরে নিচের তলায় গেলাম। মি. জোসি তখন হোটেলের দরোজায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল।

সে বলল—“তুমি নিশ্চয়ই ক্লান্ত, আর্নেস্ট।”
”না”, আমি মিথ্যে বললাম।

সে বলল, “আমি ক্লান্ত। তোমার মাছ টেনে তোলা দেখতে দেখতেই আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমাদের সর্বসময়ের রেকর্ড অনুযায়ী মাত্র তো দুইটা। সাত আর আট নাম্বার চোখ।” মি. জোসি আর আমি কখনোই আটনম্বর মাছের চোখ এভাবে বলতে পছন্দ করতাম না, কিন্তু সবসময় এভাবেই লিখে রাখতাম।

আমরা অবিস্পো স্ট্রিটের পাশের ছোট রাস্তাটা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম আর মি. জোসি দোকানের সমস্ত আলোকিত জানলাগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখছিল। বাড়ি ফিরে যাবার আগ পর্যন্ত সে কখনো কিছু কিনত না। কিন্তু মূল্যহ্রাসের পণ্যগুলো দেখতে পছন্দ করত। আমরা দুটো দোকান পেছনে ফেলে লটারির টিকেট বিক্রির অফিসে এসে পৌঁছালে ঠেলা দিয়ে ফ্লোরিদিতার ঝুলন্ত দরজাটা খুললাম।

মি. জোসি বলল— “তুমি বরং বসো, ক্যাপ,”
“না, আমার কাছে পানশালায় দাঁড়িয়ে থাকতেই ভালো লাগছে।”

মি. জোসি বলল, “বিয়ার, কোনটা? জার্মান বিয়ার খাচ্ছো, ক্যাপ?”
“চিনিহীন হিমায়িত ড্যাকোরি খাচ্ছি।” কন্সতান্তে যথেষ্ট পরিমাণে মালমশলা রেখে গেছে। আরো দুটো বানানো যাবে। আমি অপেক্ষা করছিলাম যে মি. জোসি কথা তুলবে। বিয়ার আসার সঙ্গে সঙ্গে সে বলতে শুরু করল।

বলল, “কার্লোস বলেছে ওদের পরের মাসে আসতে হবে।” কার্লোস ছিল আমাদের কিউবান সঙ্গী আর মার্লিনমাছের মস্তবড় ব্যবসায়ী জেলে। “এইরকম স্রোত নাকি ওরা আর কখনো দেখেনি। এবার ওরা এমনভাবে আসবে সেও নাকি আমরা কখনো দেখিনি। বলেছে পরের মাসে নাকি ওদের আসতেই হবে।”
“আমাকেও বলেছে।”
“ক্যাপ, তুমি যদি আরেকটা মাস থাকতে চাও তবে দিনে আট ডলারে অনিটাকে ভাড়া দিতে পারি আর স্যান্ডউইচ কিনে টাকা অপচয় করার চেয়ে আমি নিজেই রান্না করতে পারব। দুপুরের খাবার রান্নার জন্য ওই খাড়িতে গিয়ে ঝটপট রান্না সেরে ফেলতে পারব। গায়ে ঢেউখেলানো স্ট্রাইপঅলা বনিটো মাছগুলো তো সবসময়ই ধরছি। ছোট্ট টুনামাছের মতো খেতে দারুণ স্বাদ ওগুলোর! কার্লোস বাজারে মাছের আধার আনতে গেলে প্রয়োজনীয় বাজার সদাই করে আনবে বলেছে। রাতের খাবারটা আমরা পার্লা অব সানফ্রান্সিসকো রেস্তোরাঁতে খেতে পারি। গতরাতে আমি ওখানে পঁয়ত্রিশ সেন্ট দিয়ে ভালো মতন খেয়েছি।”
“আমি পয়সা বাঁচানোর জন্য গতরাতে না খেয়ে ছিলাম।” “তোমাকে খেতে হবে, ক্যাপ। সে জন্যেই মনে হয় তোমাকে আজ একটু ক্লান্ত লাগছে।”
“আমি জানি, কিন্তু তুমি কি নিশ্চিত যে আরেকটা মাস চেষ্টা করে দেখতে চাও?”
“অনিটাকে তাহলে একমাসের জন্য আর এখান থেকে বের হতে হবে না। বড় মাছগুলো এলে এই স্থান ছেড়ে কেন আমরা চলে যাব?”
“তোমার অন্য কোনোকিছু কি করার আছে?“
“না, তুমি কী করবে?”
“তোমার কি মনে হয়, মাছ সত্যি সত্যি আসবে?”
“কার্লোস বলেছে আসতেই হবে।”
“তাহলে ধরো, আমরা একটা বড় মাছ ধরলাম আর আমাদের শক্তি দিয়ে ওকে ধরে রাখতে পারলাম না।”
“পারতে হবে। ভালো মতন খাওয়া দাওয়া করলে সারাজীবনই ধরে রাখা যাবে ওকে। আর আমরা তো ভালো খাবও। আমি অন্য কিছুও ভাবছি।”
“কী?”
“তুমি যদি তাড়াতাড়ি ঘুমোতে যাও, আর কোনো সামাজিক জীবন না থাকে যদি তোমার, দিনের আলো ফুটে উঠতেই ঘুম থেকে উঠে লিখতে আরম্ভ করে আটটা পর্যন্ত লিখে সারাদিনের লেখালেখি শেষ করতে পারো যদি, তো যাবার আগে কার্লোস আর আমি সবকিছু রেডি করে রাখব, তুমি শুধু আমাদের সঙ্গে বোটে উঠে যাবে।”

আমি বললাম, “ঠিক আছে। মেনে নিচ্ছি আমার কোনো সামাজিক জীবন থাকবে না।”
“ওই সামাজিক জীবনই তো তোমাকে শেষ করে দিচ্ছে, ক্যাপ। তাই বলে বলছি নে সামাজিক জীবন একেবারেই থাকবে না। শনিবার রাতগুলোতে থাকতে পারে।”
“ঠিক আছে।” আমি বললাম। “শুধু শনিবার রাতগুলোতে সামাজিক জীবন চলবে। কী নিয়ে লিখব এ ব্যাপারে তোমার কোনো পরামর্শ?”
“সে তোমার ব্যাপার, ক্যাপ। আমি এ নিয়ে কিছু বলব না। তুমি যখন কোনো কাজ করো, সবসময়ই ভালোভাবে করো।”
“তোমার কী পড়তে পছন্দ?”
“ইউরোপ বা পাশ্চাত্য নিয়ে ভালো ছোট গল্প লেখো না কেন অথবা যখন নিষ্কর্মা ছিলে বা যুদ্ধে ছিলে—এই জাতীয় বিষয় নিয়ে। শুধু তুমি আর আমি জানি এমন কোনো বিষয় নিয়ে লেখো না কেন? অনিটা যা যা দেখেছে তা নিয়ে লিখতে পারো। যথেষ্ট সামাজিক জীবন দিয়ে ভরিয়ে লিখবে যেন সবার কাছে তা আবেদন সৃষ্টি করে।”
“আমি সামাজিক জীবন একেবারে বাদ দিয়ে দিচ্ছি।”
“অবশ্যই বাদ দেবে, ক্যাপ। কিন্তু তোমার তো মনে রাখার অনেককিছু আছে। সামাজিক জীবন এখন না থাকলে কোনো ক্ষতি হবে না।”

আমি বললাম, “না। অনেক অনেক ধন্যবাদ তোমাকে মি. জোসি। আগামীকাল সকাল থেকে আমি লেখার কাজ শুরু করে দেব।”
“আমি ভাবছি নতুন এই নিয়ম শুরু করার আগে আমাদের যা করা উচিত তা হচ্ছে আজ রাতে তোমার বিরল কোনো মাছের বড় একটা টুকরা খাওয়া উচিত। তাহলে কাল সকালে উঠে শরীরে অনেক শক্তি পাবে আর মাছ ধরার জন্য এই শক্তি কাজ দেবে খুব। কার্লোস বলেছে বড় মাছগুলো যে কোনো সময়ে আসতে শুরু করে দেবে। ক্যাপ, তোমার সর্বশক্তি দিয়ে ওদের ধরে রাখতে হবে কিন্তু।”
“তোমার কি মনে হয় আর একটা ড্যাকোরি বেশি গিললে কোনো ক্ষতি হবে?”
“ধূর! কী যে বলো না, ক্যাপ। এর মধ্যে রাম দেয় একটু, একটু লেবুর রস আর মেরাশচিনো। কোনো ক্ষতি হবে না।”

ঠিক তখন আমাদের পরিচিত দুটো মেয়ে পানশালায় এলো। সেই সন্ধ্যেয় খুব ফ্রেশ লাগছিল ওদের আর দেখতে খুব সুন্দরী ছিল ওরা।

ওদের একজন স্প্যানিশ ভাষায় বলল, “এরা জেলে দেখছি।”

অন্য মেয়েটা বলল, “হু, সমুদ্র থেকে আসা বিশালদেহী দুজন স্বাস্থ্যবান জেলে।”

মি. জোসি আমাকে বলল, “এন.এস.এল”।

আমিও নিশ্চিত করতে বললাম , “নো সোশাল লাইফ (এন.এস.এল)। মেয়ে দুজনার একজন বলল—“তোমাদের গোপন কোনো ব্যাপার আছে নাকি?” এই মেয়েটা ছিল অসম্ভব রূপবতী, চেহারায় কোথাও এতটুকুন খুঁত ছিল না। ওর আগের কোনো বন্ধুর ডান হাত ওর অমন সুন্দর টানটান নাকের রেখাটা নষ্ট করে দিয়েছে।

মি. জোসি মেয়ে দুটোকে বলল, “ক্যাপ আর আমি কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলাপ করছি।” এরপর তারা পানশালার দূরবর্তী কোণের দিকে চলে গেল। মি. জোসি আমাকে বলল, “ব্যাপারটা কী সহজ হয়ে গেল, দেখেছো? আমি সামাজিক দিকটার পুরোটাই সামলাব, তোমাকে শুধু ভোরবেলা উঠে লেখালেখির কাজ সেরে ফেলে মাছ ধরতে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে হবে। শারীরিকভাবে সবসময় শক্তিসামর্থ্য রাখতে হবে। বিশাল মাছগুলো, যেগুলোর ওজন হাজার পাউন্ড অথবা তার চেয়েও বেশি, সেগুলোর সঙ্গে পেরে উঠতে হবে।”

আমি বললাম—“চলো, আমরা কাজ বদল করি। আমি সামাজিক দিকটা দেখব’খন। তুমি খুব সকালে উঠে লিখবে। হাজার পাউন্ড ওজন ছাড়িয়ে যাওয়া বড় মাছগুলোকে সামলানোর জন্য শরীরটাকে তৈরি রাখবে সবসময়।”

জোসি সিরিয়াস হয়ে বলল, “তাহলে আমি তো খুশিই হই, ক্যাপ। কিন্তু আমাদের দুজনের মধ্যে তুমিই তো শুধু লিখতে পা্রো। তুমি আমার চেয়ে বয়সেও ছোট। আর মাছ সামলানোর জন্য তুমিই বেশি উপযুক্ত। যেভাবে আমি বোট চালাই, তাতে আমি মনে করি ওই মাছ আমি বোটে তোলা মানে ইঞ্জিনের বারোটা বাজানো।”

“তা জানি, আমিও চেষ্টা করব লেখালেখির কাজটা ভালো করে করতে।” আমি বললাম। মি. জোসি বলল—“আমি তোমাকে নিয়ে গর্ব করতে চাই। আর চাই যে শালার, মহাসমুদ্রে আমরা পৃথিবীর সবচে বড় মার্লিনটা ধরি, ভালোভাবে ওটার ওজন করি আর কেটে টুকরা করে ওই শালার ব্যাটা ডাণ্ডাবাজ পুলিশকে নয়, বরং গ্রামে আমাদের পরিচিত দরিদ্র লোকদের মধ্যে বিলিয়ে দিই।”
“আমরা তাই করব।”

ঠিক তখন মেয়েদুটোর একজন পানশালার দূরের কোণ থেকে আমাদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ল। সেই রাতে ব্যবসা মন্দা ছিল। আমরা ছাড়া আর কেউ সেখানে ছিল না। মি. জোসি বললেন, “এন. এস.এল।” আমিও অভ্যেসমতন পুনরাবৃত্তি করলাম। বললাম—“এন.এস.এল (নো সোশাল লাইফ।)”

“কন্সতান্তে,” মি. জোসি বললেন, “আর্নেস্তো একজন ওয়েটার চাচ্ছে। আমরা বিরল মাছের দুটো বড় টুকরা অর্ডার দিতে যাচ্ছি।”

কন্সতান্তে মৃদু হেসে আঙুল দিয়ে ওয়েটারের জন্য ইশারা করল।

মেয়েদুজনার পাশ দিয়ে ডাইনিংরুমে যাবার সময় ওদের একজন হাত বাড়িয়ে দিলে আমি হ্যান্ডশেক করলাম আর গম্ভীরভাবে স্প্যানিশ ভাষায় বললাম—“এন. এস. এল।”

অন্য মেয়েটি বলল, “হায় ঈশ্বর, এরা তো রাজনীতি করে আর এরকম একটা বছরে।” ওদের মধ্যে কিছুটা মুগ্ধতা, কিছুটা আতঙ্ক কাজ করছিল।

উপসাগর জুড়ে সকালের প্রথম আলো যখন আমাকে জাগিয়ে দিল, আমি উঠে গিয়ে মি. জোসির যেন পছন্দ হয় এই আশায় একটা ছোটগল্প লিখতে শুরু করলাম। সেই গল্পে অনিটার কথা ছিল, সমুদ্রতীরের কথা ছিল, আর যা যা ঘটেছিল সেইসব কথা ছিল। প্রতিদিন আমি সমুদ্রের অনুভূতিটা, সেখানে যা যা দেখেছি, শুনেছি, যা কিছুর গন্ধ শুঁকেছি, অনুভব করেছি—তার সবই লেখায় তুলে আনার চেষ্টা করেছিলাম। প্রতিদিন সকালে উঠে আমি গল্পটা লিখতাম, মাছ ধরতে যেতাম আর ভালো ভালো মাছ ধরতাম। মাছ ধরার জন্য আমি কঠিন প্রশিক্ষণ দিতাম আর চেয়ারে বসে না থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাছ ধরতাম। এরপরও বড় মাছগুলো আসছিল না। একদিন আমরা এক লোককে ব্যবসায়ী জেলেদের একটা ডিঙি নৌকা দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যেতে দেখলাম।স্পিডবোট যেমন বোটের সামনে ঢেউ তুলে পানি ছড়িয়ে চলে যায়, তেমনি করে প্রত্যেকবার লাফানোর সময় মার্লিনমাছও সেভাবে পানি ছিটিয়ে যাচ্ছিল। ওই ডিঙি-নৌকাটা ভেঙে গিয়েছিল।

আরেকদিন, দমকা হাওয়া আর বৃষ্টির মধ্যে আমরা দেখলাম চারজন লোক গাঢ় বেগুনি রঙের গভীর প্রশস্ত একটা মাছ একটা ডোঙাতে তোলার চেষ্টা করছে। কেটে নাড়িভুড়ি ফেলে দেওয়ার পর সেই মার্লিনটার ওজন হয়েছিল পাঁচশ পাউন্ড আর পুরনো বাজারের মার্বেলপাথরের ফলকের ওপর কাটতে দেখেছিলাম সেই মাছের বিশাল বিশাল চাকা।

তারপর আরেক রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে খুব কাছ থেকে পোতাশ্রয়ের মুখে দেখেছিলাম গভীর কালো স্রোত। পরিষ্কার সেই পানির দুই বাঁও গভীরে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলাম ওরা ঝাঁকে ঝাঁকে আসছে। আমাদের প্রথম বড়মাছটা ধরা পড়ে মরোর পাশেই। সেইসব দিনগুলোতে পাল খাটাবার কোনো খুঁটি ছিল না, রড ধারণ করার কিছু ছিল না। খালে হালকা একটা খুঁটি দিয়ে বড় একটা মাছ ধরার আশায় ছিলাম। আর তখনই এই মাছটা ধরা পড়েছিল। বিরাট একটা ঢেউ তুলে এসেছিল সে, বিলিয়ার্ড কিউ-এর বন্ধ করাতের মতো দাঁত আর সেই দাঁতের পেছনে তার বিশাল মাথাটা ছিল ডিঙি নৌকার মতো প্রশস্ত। তারপর বোটের সমান্তরালে সুতো টানতে টানতে দ্রুত সে আমাদের থেকে দূরে চলে গেল । বড়শির রিল এত দ্রুত ফুরিয়ে গেল যে ছুঁতে গেলে হাতে গরম লাগছিল। পনেরটা সুতোর প্যাঁচ দিয়ে একেকটা থ্রেড তৈরি আর রিলে ভরা হয়েছিল এই থ্রেডের চারশ গজ—আমি অনিটার সামনের দিকটায় ভেতরে আসতে আসতে যার অর্ধেকটাই ফুরিয়ে গিয়েছিল।

বোটের ছাদের দিকে ধরার জন্য যে হ্যান্ডলক আমরা আগেই বানিয়ে রেখেছিলাম সেগুলো ধরে ধরে আমি সেইদিকে এগুলাম। এইটা আমরা আগেই অনুশীলন করেছিলাম। বোটের কানসেতে পা রেখে দ্রুত ঠেলা দিয়ে পাটাতনে উঠে যাওয়া যায়। কিন্তু লোকাল স্টেশনের সাবওয়ে এক্সপ্রেসের মতো যে মাছ দ্রুত পার হয়ে চলে যায় সেই মাছের সঙ্গে তো আর প্র্যাকটিসটা করা হয়নি। একহাত দিয়ে রডটা ধরে ছিলাম কিন্তু রডের প্রান্তটা নিচে ওটা রাখার জায়গাটিতে ঘষা খাচ্ছিল, খুঁড়ছিল। আর রডের সুতোর টানে আমার অন্যহাতটি, খালি দুইপা বোটের মেঝেতে এসে ধাক্কা খেয়ে থেমে গিয়েছিল।

আমি চিৎকার করে বললাম, “হুক দিয়ে ওকে গেঁথে ফেলো, জোসি। রিলের সবটুকু সুতোই টেনে নিচ্ছে দেখছি।”
“গাঁথা হয়েছে তো, ক্যাপ, দেখো না কী অবস্থা।”

তখন অনিটার কানসের ওপর এক পা, বোটের ডানদিকে নোঙ্গরের ওপর আরেক পা দিয়ে আমি প্রতিরোধ করতে ব্যস্ত। কার্লোস আমার কোমর পেঁচিয়ে ধরেছে আর আমাদের সামনে মাছটা লাফাচ্ছে। এই অবস্থায় মাছটাকে দেখতে লাগছে মদের ব্যারেলের মতো। সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় ওকে রূপোলি দেখাচ্ছিল আর আমি ওর গায়ের পাথালে ওপর থেকে নিচে নেমে যাওয়া বড় বড় বেগুনি রঙের স্ট্রাইপগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম। প্রত্যেকবার লাফানোর সময় মনে হচ্ছিল পাহাড়ের চূড়া থেকে যেন কোনো ঘোড়া নিচে লাফিয়ে পড়ছে। মাছটা লাফাতেই থাকল, লাফাতেই থাকল, লাফাতেই থাকল। অনিটা পূর্ণ গতিতে মাছের পিছনে পিছনে ছুটলেও রিল এতটাই গরম হয়ে যাচ্ছিল যে হাত দিয়ে ধরে রাখা যাচ্ছিল না আর সুতোর মাঝখানটা টানের প্রবল বেগে ক্রমশই পাতলা হয়ে আসছিল।

আমি চিৎকার করে মি. জোসিকে বললাম, “অনিটার গতি কি আরো একটু বাড়ানো যায়?”
“এই পৃথিবীতে তা সম্ভব নয়। আর সুতো নেই?”
“খুবই সামান্য আছে।”

কার্লোস বলল, “মাছটা অনেক বড়। এত বড় মার্লিন আমি জীবনে দেখি নি। শুধু যদি থামত একবার আর নিচের দিকে যেত, তাহলে ওর কাছে যেতে পারতাম আমরা, যথেষ্ট সুতোও পেয়ে যেতাম।”

মরো ক্যাসেল থেকে ন্যাশনাল হোটেলের বিপরীত দিকে মাছটা তখন এক পাক দেওয়া শেষ করেছে। আমরাও ওর পিছে পিছে একইভাবে গিয়েছি। রিলে তখন বিশ গজের মতো সুতো আছে। এমন সময় মাছটা থামল। আমরা সুতো উদ্ধার করতে করতে দ্রুত ওর কাছে গেলাম। আমার মনে আছে, আমাদের সামনে ছিল সুতো সরবরাহকারী একটা গ্রেস লাইন জাহাজ। কালো রঙের একটা পাইলট বোট সেদিকে যাচ্ছিল। এদিকেই যেহেতু আসছিল, আমার ভয় হচ্ছিল আমরা না আবার ওটার গতিপথের মধ্যে পড়ে যাই। রিলে সুতো পেঁচাতে পেঁচাতে আমি তাই চেয়ে চেয়ে দেখছিলাম এবং আমাদের বোটের সামনে ফিরে এসেছিলাম। দেখেছিলাম বোটটা গতি বাড়িয়ে দিয়েছিল তখন, বেশ দূর থেকে আমাদের এদিকেই আসছিল তবে আমাদের সঙ্গে পাইলট বোটের ফাজলামো করার প্রশ্নই আসে না।

তখন আমি চেয়ারে বসে আর মাছটা সোজা উপর নিচ হয়ে আর রিলে চড়ছিল তৃতীয় সুতোটা। রিলের তাপ কমানোর জন্য ওতে সমুদ্রের পানি ঢালছিল কার্লোস; বালতিতে করে আমার মাথা আর ঘাড়েও ঢালছিল।

মি. জোসি জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছো তুমি, ক্যাপ?”
“ঠিকঠাক মতন আছি।”
“বোটের সামনে লেগে কোথাও আঘাত পাওনি তো?”
“না।”
“তুমি কি ভেবেছিলে কখনো ওখানে ওইরকম একটা মাছ থাকতে পারে?”
“না।”

কার্লোস চিৎকার করে বলতে লাগল, “গ্রান্ডে গ্রান্ডে,” বিরাট শিকারী কুকুরের মতো কাঁপছিল সে আর বলছিল, “জীবনে এইরকম মাছ দেখিনি আর। কখনোই দেখিনি। কক্ষনো না, না দেখিনি।”

পরে একঘণ্টা কুড়ি মিনিট মাছটার কোনো খবর ছিল না। প্রথম যেখানে ও শব্দ করেছিল, প্রবল স্রোত সেখান থেকে আমাদেরকে ছয়মাইল দূরে কোজিমারের উল্টোদিকে টেনে নিয়ে গেল। আমি ক্লান্ত হয়ে পড়লেও আমার হাত আর পায়ের অবস্থা ভালো ছিল। রিল থেকে ওকে সুতো ছাড়ছিলাম একই গতিতে, সাবধানে ছিলাম যেন জোরে টান না খায় অথবা ঝাঁকুনি না লাগে। আমি কিন্তু সরাতেও পারতাম ওকে ওখান থেকে। কিন্তু কাজটা সহজ হতো না মোটেও। তবে ব্রেকিং পয়েন্টের এইপাশে সুতো ধরে রাখতে পারলে তা সম্ভব হতো।

“ও আসবে। বড় মাছগুলো কখনো এমন করে,” কার্লোস বলল, “তবে যুদ্ধংদেহী হয়ে ওঠার আগেই হুকঅলা ডান্ডা দিয়ে ওকে কাবু করে ফেলতে পারো।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ও আসবে কেন এখন?”

কার্লোস বলল, “ওর মাথা আউলায় গেছে আর তুমি তো ওর গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করছো। কী হচ্ছে তার কিছুই কিন্তু বুঝতে পাচ্ছে না ও।”

আমি বললাম, “ওকে একটুও বুঝতে দিয়ো না কিন্তু।”

কার্লোস বলল, “নাড়িভুড়ি কেটে ফেলে দেওয়ার পর ওর ওজন নয়শ পাউন্ডেরও বেশি হবে।”

মি. জোসি বলল, “এ নিয়ে আর কোনো কথা বলবে না।”
“অন্য কোনোভাবে চেষ্টা করতে চাও, ক্যাপ?”
“না।”

আমরা যখন কাছে গেলাম মাছটার, দেখলাম বিশাল দেহ ওর। ভয়ংকর রকমের নয় তবে অসম্ভব বড় ছিল মাছটা। দেখলাম সে ধীর আর শান্ত হয়ে আছে। বলতে গেলে কাস্তে ব্লেডের মতো দেখতে বেগুনি রঙের দারুণ দুটো পাখনা নিয়ে সে পানিতে চুপ করে আছে। এরপর আমাদের বোটটা ও যেই না দেখে ফেলল, অমনি সুতো রিল থেকে প্রচণ্ড বেগে ছুটল যেন কোনো মটরগাড়ির সঙ্গে হুক দিয়ে আমাদের লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। লাফাতে লাফাতে ও উত্তরপশ্চিম দিকে যাচ্ছিল আর প্রত্যেক লাফের সঙ্গে গা থেকে পানি বেয়ে বেয়ে পড়ছিল।

আবার আমাকে বোটের ভেতরে সামনের দিকে যেতে হয়েছিল। মাছটা যতক্ষণ না শব্দ করা বন্ধ করল ততক্ষণ আমরা ওকে ধাওয়া করে গেলাম। এইবার সে মরোর উল্টোদিকের ভাটিতে চলে গেল। আবার আমাকে বোট চালিয়ে সামনে আসতে হলো।

“কোনো ড্রিংকস লাগবে তোমার, ক্যাপ?” মি. জোসি জিজ্ঞেস করল।

আমি বললাম, “না, কার্লোসকে বলো রিলে তেল মাখতে, তেল যেন বাইরে না পড়ে আর আমার ওপর কিছু লবণাক্ত পানি ঢালো।”
“কিছুই কি দিতে পারব না তোমাকে, ক্যাপ?”
“পারো, দুটো হাত আর একটা নতুন পিঠ দিতে পারো।” আমি বললাম।
“কুকুরীর বাচ্চাটার তেজ এখনো কমে নাই। শুরুতে যেমন সতেজ ছিল এখনো তাই রয়ে গেছে।”

এরপর দেড়ঘণ্টা পর ওকে দেখা গেল কজিমা পার হয়ে বেশ খানিকটা দূরে। সে লাফিয়ে লাফিয়ে দৌড়াতে শুরু করেছে। ওকে ধাওয়া করতে করতে আমাকে বোটের ভেতরে সামনের অংশে যেতে হয়েছিল।

ফিরে এসে যখন সামনে বসছিলাম তখন মি. জোসি বলল, “মাছটা কেমন, ক্যাপ?”
“সবসময় যেমন, তেমন। তবে রডের অবস্থা বেশি ভালো না।”

রডটা প্রথমে সুন্দর পূর্ণ একটা ধনুকের মতো বেঁকে গেল, কিন্তু যখন তুললাম যেরকম সোজা হবার কথা ছিল, সেরকম আর হলো না।

মি. জোসি বলল, “ওর আরো কিছু শক্তি বাকি আছে। মনে হচ্ছে ওর পেছনে তোমাকে লেগে থাকতে হবে অনন্তকাল, ক্যাপ। তোমার মাথায় আরো পানি ঢালতে বলছ?”

আমি বললাম, “এখুনিই না। রডটা নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে। ওর ওজন এত বেশি যে এইমাত্র রডের শক্তি নিঃশেষ করে দিয়েছে।”

একঘণ্টা পর মাছটা আবার এগিয়ে আসছিল, ধীর বৃত্তাকার একটা স্থির গতিতে ভালোই এগুচ্ছিল সে। বড় একটা বৃত্ত তৈরি করে শ্লথ গতিতে আসছিল।

কার্লোস বলল, “ও ক্লান্ত হয়ে গেছে। এখন গা ছেড়ে দেবে। লাফালাফি করে ওর বাতাসের থলেগুলো পূর্ণ হয়ে গেছে। গভীরে যাবার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। আর পারবে না।”

আমি বললাম, “রডের অবস্থাও শেষ। বেঁকেছে তো বেঁকেছে। আর সোজা হতে পারছে না মোটেও।”

সত্যিই তাই। রডের মাথাটা পানির উপরিভাগ ছুঁয়েছে, মাছটা ওপরে তোলার জন্য রড ওঠালে, রিলে সুতো ওঠানো রড আর নিতে পারছে না। রড আর রড নেই। যেন সুতোর অভিক্ষেপ শুধু। যদিও প্রত্যেকবার উঁচুতে তোলার সময় তখনও কয়েক ইঞ্চি সুতো ফিরে পাওয়া সম্ভব ছিল। তবে ওইটুকুই, এর বেশি নয়।


বার্তা২৪.কম-এর শিল্প-সাহিত্য বিভাগে লেখা পাঠানোর ঠিকানা
[email protected]


মাছটা বৃত্তাকারে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছিল। অর্ধেক বৃত্ত পূর্ণ করে যখন বাইরের দিকে যাচ্ছিল তখন রিল থেকে সুতোর প্যাঁচ খুলে আসছিল। যখন ভেতরের দিকে আবার বৃত্তে ফিরে আসছিল তখন সুতো আবার উদ্ধার হচ্ছিল। কিন্তু রডের অবস্থা খারাপ হওয়ার জন্য ওকে তো আর শাস্তি দিতে পারো না। আর ওর ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণই বা করবে কিভাবে।

আমরা একে অন্যকে ক্যাপ বলে সম্বোধন করতাম। আমি মি. জোসিকে বললাম, “খুব খারাপ। ও যদি ডুব দিয়ে মরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে তবে ওকে আর কখনোই ওপরে তুলতে পারব না আমরা।”

“কার্লোস বলেছে ও উপরে আসছে। বলেছে ও লাফাতে লাফাতে শরীরে এত বেশি বাতাস নিয়ে ফেলেছে যে চাইলেও অত গভীরে যেয়ে মরতে পারবে না। বড় মাছগুলো অতিরিক্ত লাফালাফি করে শেষে এসে এরকমই করে। আমি গুনে দেখেছি ছত্রিশবার লাফ দিয়েছে মাছটা, মনে হয় একবার গুনতে ভুলেও গেছি।”

আমার জীবনে শোনা সবচে লম্বা বক্তৃতাগুলোর মধ্যে এটি একটি। মি. জোসি যেভাবে বলল তাতে আমি একেবারে মুগ্ধ। ঠিক তখনই মাছটা ধীরে ধীরে সাঁতার কেটে নিচের দিকে যেতে শুরু করল। আমি দুহাত দিয়ে রিলের সুতো ছাড়ছিলাম আর ব্রেকিং পয়েন্ট থেকে সুতোকে রক্ষা করায় ব্যস্ত ছিলাম। রিলে ড্রামের ধাতুটা আমার আঙুলের নিচে ছোট ছোট ঝাঁকুনি খেয়ে ঘুরছিল।

আমি মি. জোসিকে জিজ্ঞেস করলাম, “সময় কেমন কাটছে? তিনঘণ্টা পঞ্চাশ মিনিট ধরে তো ওর সঙ্গে আছ।”

কার্লোসকে বললাম, “আমি তো ভাবলাম তুমি বলেছো ও নিচে গিয়ে মরতে পারবে না।”

“হেমিংওয়ে, ওকে যে উপরে আসতেই হবে। আমি জানি, ওকে আসতেই হবে।”

আমি বললাম, “ওকে বলো না কেন আসতে।”

মি. জোসি বলল, “ওকে পানি দাও তো কার্লোস।” “আর তুমি কথা বোলো না তো, ক্যাপ।”

বরফপানি খুব ভালো লাগছিল। কিছু পানি মুখ থেকে বের করে কব্জির ওপর ছেড়ে দিলাম আর কার্লোসকে বললাম গ্লাসের বাকি পানিটা আমার ঘাড়ের পেছনে ঢেলে দিতে। ঘাড়ে খালি চামড়ায় যেখানে হার্নেসের ঘষা লেগেছিল সেখানে ঘামের লবণ মেখে ছিল কিন্তু সূর্যের তাপ এতটাই প্রখর ছিল যে রক্তের কোনো তাপ অনুভব করিনি। জুলাই মাসের এক দুপুর ছিল সেটা।

“ওর মাথায় স্পঞ্জ দিয়ে আরো কিছু লবণাক্ত পানি ঢালো।” মি.জোসি বলল।

ঠিক তখন মাছটা সুতো টানা ছেড়ে দিল। কতক্ষণ স্থির হয়ে রইল, মনে হলো শানের কোনো জেটির সঙ্গে আমাকে বেঁধে ফেলা হয়েছে। তারপর ধীরে ধীরে সে আবার নড়তে শুরু করল। আমি শুধু হাতের কব্জি দিয়ে এমনভাবে সুতো উদ্ধার করতে লেগে গেলাম যেন রডে কোনো স্প্রিং ছিল না আর এতটাই নেতিয়ে পড়েছিল সেটা, মনে হচ্ছিল যেন ক্রন্দনরত কোনো উইলো গাছ।

পানির ওপর থেকে প্রায় একবাঁও নিচে আমরা ওর অভিক্ষিপ্ত লম্বা বেগুনি রঙের চমৎকার দাগযুক্ত পাখনা দুটো দেখতে পেলাম। মনে হলো যেন একটা ডোঙা। তখন সে ধীরে ধীরে বৃত্তাকারে ঘুরতে শুরু করে দিল। ঘুরতে খুব যেন সুবিধা করতে না পারে সেজন্য আমি ওকে সাধ্যমতন চাপে রাখলাম। এতটাই চাপ প্রয়োগ করলাম যে সুতো ছিঁড়ে যাবার যোগাড় হলো আর এই অবস্থায় পড়লে রড ছেড়ে না দিয়ে আর কোনো উপায় থাকে না। সঙ্গে সঙ্গে রড ভাঙল না বটে কিন্তু শক্তি হারিয়ে নষ্ট হয়ে গেল।

কার্লোসকে বললাম, “বড় খুঁটি থেকে ত্রিশ বাঁও সুতো কেটে নাও। বৃত্তে ঘুরে আসার সময় আমি ওকে ধরব, আর যখন এদিকে আসতে শুরু করবে তখন যথেষ্ট পরিমাণে সুতো হাতে আসবে। সুতো যেহেতু কম পড়বে না, তখন আমি রডটা বদলে ফেলব।”

রড যখন ভেঙে গেছে এখন তো আর মাছ ধরায় বিশ্ব রেকর্ড বা অন্য কোনো রেকর্ড সৃষ্টির প্রশ্নই আসে না। কিন্তু মাছটা তো কাবু হয়ে গেছে, তাই এখন ওর পেছনে উঠে পড়ে লেগে ওকে ধরা উচিত। কিন্তু সমস্যা একটাই—বড় রডটা পনের প্যাঁচের সুতোর জন্য বেশিরকম শক্ত। এখন আমাকে এই সমস্যার সমাধান বের করতে হবে।

নামকরা হার্ডি কোম্পানির রিল থেকে কার্লোস রডে সুতো তোলার গাইড ব্যবহার করে ছত্রিশটা সাদা থ্রেড-লাইন খুলছিল আর হাত দিয়ে মাপছিল। ওর হাত থেকে রিলটা বোটের মেঝেতে পড়ে গেল। নষ্ট হয়ে যাওয়া রডটা দিয়ে যথাসাধ্য মাছটাকে ধরে রাখার চেষ্টা করলাম। দেখলাম কার্লোস সাদা সুতো কেটে রডের গাইডের সাহায্যে অনেকখানি সুতো তুলল।

আমি মি. জোসিকে বললাম, “ক্যাপ, বেশ তাহলে এই সুতো নাও। মাছটা বৃত্তাবর্তে ফিরে আসবে যখন তখন সুতো যথেষ্ট টেনে নিলেও কার্লোস দ্রুত সুতোর দুটো থ্রেড বানিয়ে ফেলতে পারবে। আর কিছু ভাববার প্রয়োজন নেই। শুধু নরম আর সহজভাবে সুতো টানবে।”

ঘুরে ঘুরে মাছটা আসতেই থাকল আর মি. জোসি একফুট একফুট করে সুতো উদ্ধার করে কার্লোসকে দিচ্ছিল, কার্লোস সাদা সুতোর সঙ্গে সেই সুতোর গিঁট দিচ্ছিল। মি. জোসি বলল, “ও তো ওগুলো বেঁধেই ফেলেছে।” তখনও প্রায় গজ খানেক সবুজ রঙের পনের প্যাঁচের সুতোটা ব্যবহার করা বাকি, মাছটা ওর বৃত্ত সীমার মধ্যে এলে সে আঙুল দিয়ে সুতোটাকে ধরে রাখল। আমি ছোট রডটা থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে ওটা নিচে রাখলে কার্লোস বড় রডটা আমার হাতে দিল।

আমি কার্লোসকে বললাম—“তুমি যখন প্রস্তুত হও, ওটা কেটে ফেলো।” মি. জোসিকে বললাম, “ক্যাপ, তুমি আস্তে আস্তে নরম করে ঢিলা দিতে থাকো। যখন সময় হবে, বুঝতে পারব, তখন আমি আস্তে আস্তে টানতে শুরু করব।”

কার্লোস যখন সুতো কাটছিল আমি তখন সবুজ রঙের সুতোর লাইন আর বিশাল মাছটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম। তখন এমন জোরে এক চিৎকার শুনলাম এর আগে কখনো কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষকে এভাবে চিৎকার করতে শুনিনি। যেন সমস্ত হতাশাকে জড়ো করে এমন শব্দে রূপ দেওয়া। তারপর প্রত্যক্ষ করলাম সবুজ সুতোর লাইনটা ধীরে ধীরে মি. জোসির আঙুলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। এরপর দেখলাম মাছটা যাচ্ছে তো যাচ্ছেই এবং একসময় সে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল। কার্লোস গিঁট দেয়া সুতোয় ভুল লুপ কেটেছিল।

মি. জোসি বলল, “ক্যাপ।” তাকে ঠিক ভালো দেখাচ্ছিল না। এরপর হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে জোসি বলল, “চারঘণ্টা বাইশ মিনিট হয়ে গেছে।”

আমি নিচে কার্লোসকে দেখতে গেলাম সেখানে সে বমি করে ভাসিয়ে দিচ্ছিল। আমি চিন্তা করতে নিষেধ করে বললাম, যে কারো এরকম হতে পারে। তাঁর বাদামি রঙের মুখটা তখন স্নায়ুচাপে পীড়িত। অদ্ভুত নিচু গলায় কথা বলছিল সে, আমি ঠিকমতন শুনতেও পাচ্ছিলাম না।

“আমি সারাজীবন মাছ ধরে আসছি কখনো এইরকম মাছ দেখিনি। এইবারই প্রথম। আমি আমার, তোমার দুজনার জীবনই নষ্ট করে দিয়েছি।”

আমি বললাম, “কী যে বলো! বাজে বোকো না তো। আমরা আরো বড় বড় মাছ ধরব।” কিন্তু কখনোই বড় মাছ ধরতে পারিনি আমরা।

মি. জোসি আর আমি বোটের পেছনের দিকে গিয়ে বসে অনিটাকে বাতাসের টানে এগুতে দিলাম। উপসাগরে সেটি ছিল চমৎকার একটা দিন। মৃদুমন্দ বাতাস বইছিল। আমরা তীর আবার তারও পেছনে ছোট ছোট পাহাড়গুলো দেখছিলাম। মি. জোসি আমার ঘাড়ে, হাতে যে জায়গাগুলোতে রড আটকে গিয়েছিল, সেই জায়গাগুলোতে মারকিউরোক্রোম মালিশ করে দিচ্ছিল। আবার পায়ের পাতাও ঘষা লেগে ছিলে গিয়েছিল বলে সেখানেও মলমটা লাগিয়ে দিচ্ছিল। এরপর সে দুটো হুইস্কি গাঁজাতে নিল।

“কার্লোস কেমন আছে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“ওর অবস্থা বেশি ভালো না। গুড়ি মেরে বসে আছে।”
“আমি বলেছিলাম নিজের ওপর দোষ না নিতে।”
“নিশ্চয়। সে তো ওখানে বসে থেকে নিজেকেই দোষারোপ করছে।”
“বড় মাছগুলোকে কেমন লাগছে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

মি. জোসি বলল, “আমি সবসময় এই-ই করতে চেয়েছি আসলে।”
“আমি কি ওকে ঠিকমতন সামলাতে পেরেছি, ক্যাপ?”
“পেরেছো মানে! খুব ভালো পেরেছো।”
“না। আমাকে সত্যি করে বলো।”
“আজকে তো আমাদের টিকেটের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। তুমি চাইলে আমি পয়সা ছাড়াই মাছ ধরতে পারি।”
“না”
“আমি পয়সা ছাড়াই বরং মাছ ধরতে চাচ্ছি। কিভাবে যে মাছটা ন্যাশনাল হোটেলের দিকে গেল যেন কোনোদিকে হুঁশ ছিল না ওর, মনে আছে তোমার?”
“ওর সবকিছু আমার মনে আছে।”
“তোমার লেখালেখির কী খবর, ক্যাপ, ভালো চলছে? খুব ভোরে উঠে লেখা মনে হয় তেমন কঠিন কোনো ব্যাপার না, তাই কি?”
“সাধ্যমতো চেষ্টা করছি ভালো লিখতে।”
“তুমি চালিয়ে যাও। আর প্রতিদিন নিয়ম করে লিখলে কখনোই সমস্যা হবার কথা না।”
“আগামীকাল সকাল থেকে বাদ দিয়ে দিতে পারি।”
“কেন?”
“আমার পিঠে সমস্যা।”
“তোমার মাথা তো ঠিক আছে, নয় কি? পিঠ দিয়ে তো আর লেখো না।”
“হাত ব্যথা হয়ে থাকবে।”
“ধুত্তোরি! পেন্সিল তো ধরতে পারবে। সকালে উঠে দেখবে, ঠিক হয়ে গেছে। তখন পারবে।”

ভাবতে অবাক লাগলেও পরদিন সকালে আমি লিখতে পেরেছিলাম এবং বেশ ভালোই লিখেছি। সকাল আটটায় পোতাশ্রয়ের দিকে রওনা দিয়েছিলাম। আরেকটা চমৎকার দিন ছিল সেটি। মৃদুমন্দ বাতাস বইছিল। মরো ক্যাসেলের কাছে স্রোত ছিল আগের দিনের মতো। পরিষ্কার পানির কাছে গিয়ে পৌঁছালে কোনো খুঁটির বাতি নিভাইনি আমরা। একবারই তা করেছিলাম, আর নয়। চার পাউন্ড ওজনের বিরাট একটা সেরো ম্যাকরল ধরেছিলাম আমি, রডটা ছিল অনেক বড় আর ভারী, হার্ডি কোম্পানির রড ছিল সেটা; রিলে ছিল ছত্রিশটা সাদা সুতোর প্যাঁচের থ্রেড লাইন। কার্লোস আগের দিন ত্রিশ বাঁওয়ের যে সুতোটা খুলে নিয়েছিল, সেটা আবার যুক্ত করেছে আর পাঁচ ইঞ্চি রিল সম্পূর্ণ ভর্তি ছিল। তবে সমস্যা ছিল রড নিয়ে। রডটা খুবই শক্ত ছিল। বড় মাছ ধরার ক্ষেত্রে বেশি শক্ত রড জেলের বারোটা বাজিয়ে দেয় আর যে রড ঠিকমতন বাঁকা হয়, সেই রড মাছের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ে।

কার্লোসের সঙ্গে কথা বললে তবেই সে কথা বলে এবং সে তার কষ্ট নিয়েই ছিল। আমার শরীরে এত ব্যথা ছিল যে, কষ্টের কথা ভাবার সময় পাইনি আর মি. জোসি এমন শক্ত লোক যে, সে এসবকে পাত্তাই দেয়নি।

সে বলল, “শালার, সারাটা সকাল মাথা ঝোঁকাতেই গেছে ওর। এরকম করলে মাছ ধরতে পারবে না ও।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কেমন আছো, ক্যাপ?”

মি. জোসি বলল, “আমি তো মনে করি ভালোই আছি। গতরাতে শহরে গিয়েছিলাম। সেখানে স্কয়ারে মেয়েদের অর্কেস্ট্রা শুনেছি। কয়েক বোতল বিয়ার গলাধঃকরণ করে ডনোভ্যানের ওখানে গিয়েছিলাম। কী যে জঘন্য ব্যাপার ঘটেছে সেখানে।”
“কী জঘন্য ব্যাপার?”
“ভালো না। খুব খারাপ। আমি খুশি যে তুমি সেখানে ছিলে না, ক্যাপ।”

পাশে, দূরে উঁচুতে রডটা ধরে বড় ম্যাকরলটাকে পেছনে ঢেউয়ের তোড় থেকে সরে যেতে সাহায্য করতে করতে বললাম, “কী ঘটেছিল আমাকে বলো।” কাবানা দূর্গ বরাবর স্রোতের কিনার অনুসরণ করার জন্য কার্লোস অনিটাকে ঘোরাল। পেছনে উত্থিত স্রোতে মাছকে প্রলুব্ধ করার জন্য যে সাদা রঙের টিজার ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছিল, সেই সাদা সিলিন্ডার বোটের সঙ্গে সঙ্গে ছুটছিল, স্রোতের তোড়ে মাঝে মাঝে লাফাচ্ছিল, উড়ছিল। মি. জোসি এবার বোটের পেছনে একপাশে চেয়ারে বসে মাছ ধরছিল। তার বড়শিতে বড় একটা ম্যাকরল আধার খাচ্ছে।

“ডনোভ্যানে এক লোক নিজেকে সিক্রেট পুলিশের ক্যাপ্টেন বলে দাবি করছিল। সে বলল আমার মুখটা নাকি তার পছন্দ। সেজন্য সে আমাকে একটা উপহার দেবে, আর সেই উপহার হিসেবে সে যে কোনো এক লোককে খুন করবে। আমি তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু নাছোড়বান্দা সে, বলছিল আমাকে পছন্দ করেছে এবং এইটা প্রমাণ করার জন্য একজনকে সে হত্যা করবেই। সে ছিল মাচাদো বিশেষ নতুন মেরিন পুলিশ অফিসারদের একজন। ওই যে ডাণ্ডাবাজ পুলিশ।”
“আমি তো ওদের চিনি।”
“চিনতেও পারো, ক্যাপ। তবে আমি খুশি যে তুমি সেখানে ছিলে না।”
“কী করেছে সে?”
“আমাকে সে কতটা পছন্দ করে তা প্রমাণ করার জন্য সে কাউকে হত্যা করার কথা বলেই চলল। আমি বললাম তার কোনো প্রয়োজন নেই বরং একটু ড্রিংক করে সে কথা ভুলে যাওয়া যেতে পারে। একটু শান্ত হতে না হতেই সে আবার একই কথা বলতে শুরু করল।”
“লোকটা নিশ্চয়ই ভালো।”
“ক্যাপ, আরে নাহ। কোনো কাজের লোক না সে। আমি তাকে এসব ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য মাছের কথা বলতে চেষ্টা করলাম।”

সে বলল, “আপনার মাছের ওপর আমি পায়খানা করে দিই। তাহলে মাছ আর নাই। হলো তো?”

আমি বললাম, “ঠিক আছে। মাছের ওপর হাগু। আপনার কথাই রইল। চলেন এবার দুজনেই বাড়ি যাই।”
“বাড়ি যাব? কী যা তা বলছেন? আপনার জন্য আমি কাউকে হত্যা করবই। আর মাছের ওপর কিন্তু হাগবই। তাহলে মাছ বাদ হয়ে যাবে। বুঝতে পেরেছেন?” সে বলল।

তো ক্যাপ, আমি তাকে শুভরাত জানিয়ে ডনোভ্যানকে টাকা দিলাম কিন্তু এই পুলিশ সেই টাকা ফট করে মেঝেতে ফেলে দিয়ে তা পা দিয়ে চেপে ধরল আর বলল, “মাথা বিগড়ায় দিয়েন না, কইলাম। আপনি আমার বন্ধু, আপনি এখানে থাকবেন।” এরপরও আমি তাকে শুভরাত বললাম। ডনোভ্যানকে বললাম, “ডনোভ্যান, আমি দুঃখিত যে আপনার টাকাটা মেঝেতে।”

আমি বুঝতে পারছিলাম না এই পুলিশ কী করতে যাচ্ছে; অবশ্য সে ব্যাপারে মাথাব্যথাও ছিল না আমার। আমি বাড়ি যাবার জন্য মনস্থ করে যেই পা বাড়িয়েছি, অমনি পুলিশটা পিস্তল বের করে বেচারা গ্যালিগোর দিকে ধরে। গ্যালিগো চুপচাপ বিয়ার খাচ্ছিল। সারারাত একটিবারের জন্য একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি সে। কেউ পুলিশটাকে কিচ্ছু করেনি, বলেনি। আমিও কিছু করিনি। কী যে লজ্জা হচ্ছে বলতে আমার, ক্যাপ।”

আমি বললাম, “বেশিক্ষণ এই অবস্থা চলার কথা না।”
“আমি জানি। কারণ, তা চলতে পারে না। কিন্তু যে কথাটা আমি মোটেও পছন্দ করতে পারিনি তা হচ্ছে আমার মুখ তার পছন্দ। আমার মুখের কী শ্রী বলো তো, ক্যাপ যে একজন পুলিশ বলবে সে পছন্দ করেছে?”

মি. জোসির চেহারাটা আমিও খুব পছন্দ করতাম। আমার পরিচিত যে কোনো মুখের চেয়ে তার মুখটা আমার বেশি পছন্দ ছিল। কারণ, দ্রুত বা সহজ সাফল্য লাভের জন্য এই মুখ পাথরে খোদাই করা হয়নি। পানশালার লাভজনক দিকটায়, অন্যান্য জুয়াড়ির সঙ্গে কার্ড খেলতে খেলতে, বিরাট ঝুঁকির এন্টারপ্রাইজ বুঝতে পেরেও ঠান্ডা মস্তিষ্কের নির্ভুল বুদ্ধিমত্তায়, সমুদ্রে যার জন্ম—সেই মুখ তো পছন্দ করবই। চোখ ছাড়া মুখের আর কোনো অংশ দেখতে অমন সুশ্রী নয়; কোনো উজ্জ্বলতম ঝকঝকে পরিষ্কার দিনে ভূমধ্যসাগরের চেয়েও নীলাভ অদ্ভুত সেই চোখের রঙ। চেহারা সুন্দর নয় মোটেও শুধু আশ্চর্য দুটো চোখ—এখন ফোস্কা ওঠা চামড়ার মতো হয়ে গেছে।

আমি বললাম, “আপনার চেহারাও সুন্দর, ক্যাপ।”
“হ্যাঁ, মনে হয় ওই একটা ভালো জিনিসই ওই কুকুরীর বাচ্চাটা দেখতে পেয়েছিল।”

মি. জোসি বলল, “এখন আমাদের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সামাজিক জীবন নিয়ে মাথা ঘামাব না।”
“স্কয়ারে বসে মেয়েদের অর্কেস্ট্রা আর যে মেয়েটা গাইছিল, শুনতে ভালোই লাগছিল, চমৎকার লাগছিল। সত্যি করে বলো তো কেমন লাগছে তোমার ক্যাপ?”

“আমি তো বলেছি, ভালো না, খুব খারাপ।”
“ভেতরে অন্ত্রে কোথাও লাগেনি তো? বোটের সামনে যতক্ষণ ছিলে, তোমার জন্য দুশ্চিন্তা করেছি আমি।”

আমি বললাম, “না, পেছনে একদম পিঠের গোড়ায়।”
“হাত পা কোনো কাজে আসেনি, একেবারে হার্নেস পর্যন্ত পট্টি দিয়ে বেঁধে দিলাম,” জোসি বলল। “এখন আর অত ঘষা লাগবে না। তুমি কি আসলেই ঠিকঠাকমতন পেরেছিলে, ক্যাপ?”
“অবশ্যই, অভ্যেস করা যেমন কঠিন, অভ্যেসে পরিণত হলে এত্থেকে বের হয়ে আসাটাও তেমনটাই কঠিন।”

“আমি জানি, অভ্যেস খুব খারাপ একটা ব্যাপার।” মি. জোসি বলল, “আর অন্য কোনো অভ্যেস নয়, সম্ভবত কাজই বেশিরভাগ মানুষকে মেরে ফেলে। কিন্তু তোমার বেলায় সে কথা খাটে না। তুমি যখন কিছু করো তখন অন্যকিছুর তোয়াক্কা করো না।”

আমি তীরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম বিচের কাছাকাছি অতল গভীর পানির সন্নিকটে একটা চুনাপাথরের ভাঁটি যেখানে উপসাগরীয় প্রবাহ প্রায় তীরের কাছে এসে মিশেছে। ভাঁটি থেকে সামান্য ধোঁয়া উঠছিল। দেখতে পেলাম তীর বেয়ে ধুলো উড়িয়ে একটা ট্রাক পাথুরে রাস্তা দিয়ে সামনে অগ্রসর হচ্ছে। কিছু পাখি বড়শির আধারের একটা দলা খুবলে খাচ্ছিল। তখনই শুনলাম কার্লোস, “মার্লিন, মার্লিন!” বলে চিৎকার করছে।

সবাই একসঙ্গে ওকে দেখতে পেলাম। পানিতে কী গভীর সেই রঙ ওর। আমি দেখলাম ওর ঠোঁটটা বিরাট ম্যাকরলটার পেছন থেকে পানির ওপর ভেসে উঠল। বেঁটে, গোলাকার, পুরু, কুৎসিত একটা ঠোঁট। তারই পেছনে পানির নিচে স্তূপীকৃত ওর শরীর।

কার্লোস চিৎকার করে বলল, “ও খাক, ওকে ওটা খেতে দাও, মুখের ভেতরে নিয়েছে তো।”

মি. জোসি রিলে আধারের সুতোটা পেঁচিয়ে আনছিল। আমি সেই তীব্র টানটার জন্য অপেক্ষা করছিলাম যার অর্থ হচ্ছে মার্লিন ম্যাকরলটাকে গিলে ফেলেছে।


অনুবাদকের নোট

১.কী ওয়েস্ট—কিউবার প্রায় নব্বই মাইল উত্তরে আমেরিকার একটি দ্বীপ শহর
২. মরো—হাবানা উপসাগর প্রতিরক্ষাদূর্গ

   

গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ধ্রুব এষ



বার্তা২৪ ডেস্ক
শিল্পী ধ্রুব এষ

শিল্পী ধ্রুব এষ

  • Font increase
  • Font Decrease

নান্দনিক প্রচ্ছদ ও অলংকরণশিল্পী হিসেবে দেশে আলাদা অবস্থান তৈরি করেছেন ধ্রুব এষ। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ে ঢাকার পান্থপথের হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এই শিল্পী।

হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে বলেন, “তার অবস্থা বর্তমানে স্থিতিশীল।”

জ্বর সঙ্গে তীব্র কাশি নিয়ে বুধবার এ হাসপাতালে আসেন ধ্রুব এষ। পরিস্থিতি দেখে তাকে এইচডিইউতে ভর্তি করে নেওয়া হয়।

লেলিন চৌধুরী বলেন, "শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের কারণে উনার অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গিয়েছিল। সে কারণে অবস্থা কিছুটা অবনতির দিকে গিয়েছিল। পরে অক্সিজেন সরবারাহ করা হয়, এখন তিনি স্টেবল আছেন। আমরা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছি।"

সুনামগঞ্জের সন্তান ধ্রুব এষের বয়স ৫৭ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলার ছাত্র থাকার সময় বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা শুরু করেন। প্রয়াত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ বইয়ের প্রচ্ছদ ধ্রুব এষেরই আঁকা। তার আঁকা প্রচ্ছদে প্রকাশিত হয়েছে ২৫ হাজারের বেশি বই।

দেশে প্রচ্ছদশিল্পে আধুনিকতা আনার কৃতিত্ব কেউ কেউ ধ্রুব এষকে দেন। আঁকাআঁকির সঙ্গে তিনি লেখালেখিও করেন। শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য ২০২২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান ধ্রুব এষ।

;

তৃতীয় পক্ষ



ওমর শরিফ
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

 

এ শহরে বাড়ি আর বাড়ি। ছায়া, শান্তি দেবে এমন গাছ কোথায়? গত বারের তুলনায় এবার গরমটা একটু বেশী পড়েছে। দুপুরবেলা তাই খাঁ খাঁ করছে রাস্তাঘাট। প্রায় জনমানব শূন্য চারিদিক। মাঝে মাঝে কিছু রিক্সা, ট্যাক্সি চলছে এদিক সেদিক। ভাগ্যিস দুই রাস্তার মাঝের ডিভাইডারে সারি সারি গাছ আছে। তবু একটু সবুজ দেখা যায়, তা-না হলে কিযে হতো? কথাগুলো ভাবলো মিতু। কলেজ পড়ুয়া তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী মিতু। কলেজে কোন ভাবেই মন বসছিলোনা মিতুর। একটা ঘটনা অস্থির করে রেখেছে তাকে কাল থেকে। তাই মাত্র তিনটা ক্লাস করে বেরিয়েছে ধানমন্ডি লেক যাবে বলে। ধানমন্ডি লেকে অনেক গাছ, অনেক শান্তি। সায়েলা, রবি দু’একবার জিজ্ঞেস করেছে কোথায় যাচ্ছে জানার জন্য। সায়েলা, রবি মিতুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মিতু ওদের মিথ্যে বলেছে।

-বলেছে ‘বড় চাচার বাড়ি যাচ্ছি, চাচা একটু অসুস্থ তাই দেখা করে ওখান থেকেই বাসা চলে যাবো’।     

‘ক্লাস শেষে বন্ধুদের আড্ডা জমে উঠেছিলো খুব তবু ছাড়তে হয়েছে। এই খাঁ খাঁ রোদে কার দায় পড়েছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসার? কল দিলে কল ধরো না, কেটে দাও আবার ব্যাকও করনা! এটা কি ধরনের কথা’? রিক্সার ভাড়া দিতে দিতে বলল মিতু। মিতুর রাগ দেখে সামনে দাঁড়ানো স্বপন মিটমিট হাসছে। ছয় ফিটের মতো লম্বা, ট্রিম করা দাড়ি, মাথার চুল এলোমেলো, একটা হাওয়াই শার্ট সঙ্গে জিন্স পড়া। পায়ে স্যান্ডেলের বদলে স্নিকার পড়েছে আজ। একটু আগোছাল যাকে বলে ‘স্বযত্নে অবহেলা’। স্বপনের এই ব্যাপারটাই দারুণ টানে মিতুকে। ওর মধ্যে কোথায় একটা ব্যাপার আছে। কি নেই, আবার আছে। ঠিক পূর্ণ নয় আবার খালিও নয়। স্বপন মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। দেশের নামকরা একটা পত্রিকা অফিসে কাজ করে। কথা কম বলে। যা কথা বলে তা ওর গিটার বলে। খুব ভালো গিটার বাজায় স্বপন।      

রিক্সা থেকে নেমে তেড়ে এলো মিতু। ‘কি কানে শোন না। হাসছো আবার, লজ্জা নেই’? রাগে বলল মিতু।

‘আচ্ছা বাবা রাগ পরে হবে। আগে চলো লেকের ভেতরটায় যাই, এখানে অনেক রোদ’। বলল স্বপন। লেকের পার ধরে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে লেকের পাশে থাকা রেস্টুরেন্ট ‘জলসিরি’তে গিয়ে বসলো। রেস্টুরেন্টে লোকজন কম। দাঁড়িয়ে থাকা ওয়েটারকে এসিটা অন করে দিতে বলল স্বপন। মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বলো কি হয়েছে, এতো জরুরি তলব কেন?’

মিতু প্রতিত্তরে বলল, ‘আগে বলো এতক্ষণ ধরে তুমি আমার ফোন ধরছিলে না কেন’? কতোবার ট্রাই করার পর তোমাকে পেয়েছি, তোমার হিসাব আছে? এতো কথার পরও স্বপনকে শান্ত দেখে মিতু আরও খানিকটা রেগে গেলো। বলল, ‘তুমি কি অনুভূতিহীন, তোমার কি জানতে ইচ্ছে করেনা, আমি কেন এতবার ফোন দিয়েছি’?

স্বপন একটু সিরিয়াস হয়ে গলা খাকিয়ে বলল, ‘আসার পর থেকে আমাকে বলার সুযোগ দিয়েছ তুমি? শুধু নিজেই বলে যাচ্ছ’।

এতক্ষণে নিজেকে যেন খুঁজে পেলো মিতু, একটু লজ্জাও পেলো। কিছুটা নমনীয় হয়ে বলল, ‘আচ্ছা বলো কেন ফোন ধরতে এত সময় নিলে’?

স্বপনের সরল উত্তর, ‘খুব জরুরি মিটিং এ ছিলাম তাই তোমার ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরতে পারেনি। মিটিং শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছি। তারপর সব কাজ ফেলে এইতো তোমার সামনে আমি’।

মুখের এক্সপ্রেশন দেখে বোঝা গেলো উত্তরে মিতু সন্তুষ্ট হয়েছে। কিন্তু কিসের যেন উদ্বেগ স্পষ্ট। ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ায়নি স্বপনের।  সে বলল, ‘কি হয়েছে? কোন সমস্যা? আমাকে খুলে বলো’।

মিতু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘স্বপন আমার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে বাসা থেকে। পাত্র পক্ষ জানিয়েছে আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে তাদের। আগামীকাল আসবে ডেট ফাইনাল করতে। আমি এখন কি করবো স্বপন? আমাকে বলে দাও’।

স্বপন বলল, ‘বিয়ে করে ফেল। বাবা মা যা চাই তাই করো এতে সবার মঙ্গল’।

মিতু অবাক হয়ে স্বপনের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। বলল, ‘মানে কি? তাহলে এতদিন আমারা কি করলাম। তুমি একটা প্রতারক। তুমি একটা হিপোক্রেট। এখন দায়িত্ব নেয়ার সময় পালাচ্ছো। কাপুরুষ কোথাকার’। তখনও স্বপনের ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখে অবাক হয়ে গেলো মিতু।

স্বপন মিতুর দুহাত টেনে কাছে নিয়ে বলল, ‘এতো দিনেও চিনতে পারলেনা আমাকে। তুমি যা ভাবো আমি তার থেকে অনেক অনেক বেশী ভালোবাসি তোমাকে’। বলে উঠে দাঁড়িয়ে স্বপন বলল,‘চলো’। মিতু বললো,

- ‘চলো’। মিতু বললো,
- ‘কোথায়’?
- চলোই না।
- আগে বলো কোথায়?
- কাজী অফিসে।
- মানে?!
- আমরা আজই এক্ষুনি বিয়ে করছি।
- কি বলো এসব?
- যা বলছি ঠিক বলছি। এছাড়া আমাদের হাতে আর কোন পথ নেই।
- তোমার বাসা?
- আমি ম্যানেজ করবো।
- আমার বাসা?
- ওটা পরে ম্যানেজ হয়ে যাবে।

 

দরজা খুলতেই নাসরিন স্বপনের সঙ্গে একটি মেয়েকে দেখতে পেলো। দুজনেই পা ছুঁয়ে সালাম করতেই নাসরিন অবাক হয়ে পা সরিয়ে নিলো। কিছুটা সংকোচেও। নাসরিন স্বপনের মা। নাসরিন কিছুটা হতভম্ব হয়ে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন। সোফায় বসতে দিলেন। সোফাতে বসে মাকে উদ্দেশ্য করে স্বপন বলল, ‘মা আমরা বিয়ে করে ফেলেছি। তোমাকে  পরিচয় করিয়ে দিই। এ হচ্ছে মিতু। মিতু, ‘ইনি তোমার শাশুড়ি’।

নাসরিন ছেলের দিকে হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, ‘এসব কি বলছিস স্বপন, কাউকে না জানিয়ে এতবড় কাজ তুই কিভাবে করলি? তোর বাবাকে আমি কি উত্তর দিবো। আর চিনি না জানি না একটা মেয়েকে এনে ঘরে তুললি?

স্বপন পাত্তা না দিয়ে উত্তর দিলো, ‘মিতু ভালো ঘরের মেয়ে। বাবা মা শিক্ষিত। সে নিজেও শিক্ষিত অনার্স করছে। দেখতে ভালো, স্বভাব চরিত্রেও ভালো। তোমার সামনেই আছে দেখে নাও’। বলে হাসতে লাগলো।

নাসরিন আর বেশী কথা না বাড়িয়ে মিতুর দিকে তাকালেন। প্রথমিক কিছু কথা বার্তা জিজ্ঞেস করলেন।

বললেন, ‘বিয়েটা কি কোন ভাবে থামানো যাচ্ছিল না বা বাবা মা কে বুঝিয়ে শুনিয়ে অনার্স শেষ করে তারপর বিয়েটা হলে বোধহয় ভালো ছিল’। মিতু মাথা নিচু করে শুধু শুনে যাচ্ছে।

শুধু বলল, ‘আন্টি আমি বাবাকে খুব ভয় পাই আর বাবা সরকারি চাকরি ছাড়া বিয়ে দিবেন না। বললে আরও ঝামেলা বাড়বে’। 

নাসরিন মিতুকে থামিয়ে দিয়ে ঘরে নিয়ে যেতে বললো।

স্বপন দু’জনের উদ্দেশ্যে বললো, ‘অফিসে বিশেষ কাজ আছে, আমাকে একবার এক্ষুনি অফিস যেতে হবে। এর মধ্যে আশা করি তোমাদের চেনা জানা হয়ে যাবে’।

স্বপনের কথা শুনে মা ও মিতু দুজনেই বেশ অবাক হয়ে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।

নিজের রুমে বসে বসে মিতু ল্যাপটপে হানিমুনের ছবি দেখছিল। কাশ্মীর যে কি সুন্দর ভাবাই যায় না। পাহেলগাম, সোনমার্গ, গুলমার্গ জায়গাগুলো ভোলার মতো না। সেবারই জীবনের প্রথম বরফ পড়া দেখেছিলো মিতু। কিছু ছবি দেখেতো মিতু রীতিমত না হেসে পারল না। সে সময় ওরা দুজনেই কেমন বাচ্চা বাচ্চা ছিল। ‘দেখতে দেখতে বিয়ের প্রায় চার বছর হতে চললো’ ভাবল মিতু। একটু কি দীর্ঘশ্বাসের মতো বয়ে গেলো বুকের ভিতরটায়? হানিমুনের ছবি দেখা শেষে পুরনো কিছু ছবিতে চোখ গেলো মিতুর। বাবা মা’র ছবি। বাবা মা পাশাপাশি বসা। বাবার কোলে মিতু। মিতুর বয়স তখন ছয় কি সাত হবে। কি দারুন একটা ছবি। মনের অগোচরেই চোখটা ভিজে এলো মিতুর। এখনও বাবার বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক হয়নি।

মিতুর বাবা মিতুর বিয়ের কথা শুনে বলেছিলেন, ‘মিতু নামে আমার মেয়ে ছিল আমি ভুলে গেছি। বাবার অপমান করতে যে মেয়ের বিন্দুমাত্র বাঁধে না; সে আমার মেয়ে হতে পারে না। মিতুর মুখ আমি দেখতে চায়না’।

মাস্টার্স পাস করে মিতু চাকরির কথা ভাবেনি, যদিও স্বপন ওকে বার বার বলেছে বাসায় একা একা বোর লাগবে, তবুও। মিতুর শাশুড়িও একই কথা বলেছে, কিন্তু মন থেকে সায় দেয়নি মিতু। বাচ্চা পালন করবে আর সংসার সামলাবে এটিই ছিল তার চিন্তা।

মিতুর বাচ্চার খুব শখ কিন্তু স্বপন এখন বাচ্চা নিতে নারাজ। বললেই বলে, ‘আরে বাচ্চার জন্য এতো তাড়া কিসের, অঢেল সময় পড়ে আছে, আগে নিজেদের মতো করে সময় পার করি’।

স্বপন সকাল সকাল বেরিয়ে যায় ফেরার কোন সময় নির্দিষ্ট নেই। কখনও আটটা কখনও দশটা পেরিয়ে যায়। আবার কখনও কাজের এতো চাপ থাকে যে কোন কোন রাতে বাসা ফেরা হয়না। কাজ নিয়ে খুব সিরিয়াস স্বপন। খুব তাড়াতাড়ি কয়েকটা প্রমশনও পেয়েছে সে। এই বছর প্রমোশন নিয়ে গাড়ি কিনেছে ওরা। মিতুর পছন্দতেই কেনা। লাল রঙের গাড়ি। লাল রঙের গাড়ি মিতুর খুব পছন্দ। স্বপনের উন্নতিতে মিতুর গর্বের শেষ ছিলনা। মিতুর কেবলই মনে হতো স্বপনের যত সাফল্য সবই তার নিজের। সে নিজে অনুভব করতো আর আনন্দ নিয়ে সেলেব্রেট করতো। মিতুর বন্ধু বান্ধবী পাড়া পরশি যার সঙ্গেই কথা হোক না কেন, ইনিয়ে বিনিয়ে স্বপনের সাফল্যের কথা বলবেই। সে কথায় কথায় স্বপন যে তার ক্যারিয়ারে খুব ভালো করছে, সে হাসবান্ড হিসেবে খুব কেয়ারিং, পরিবারের ব্যাপারে যত্নবান সেগুলো অন্যকে বলে আত্মতৃপ্তি পায়। সেদিন পাশের বাসার ভাবি বললেন, ‘মিতু ভাবি কি যে করি বলেন তো? আমার হাসবান্ড তো আমার হাতের রান্না একেবারেই খেতে পারেনা। আপনি কিভাবে যে ম্যানেজ করেন’?

মিতু হাসতে হাসতে বলন, ‘আপনার ভাইতো আমার হাতের রান্না ছাড়া খেতেই পারেনা। আসলে এ হচ্ছে ভালোবাসা, বুঝেছেন ভাবি ভালবাসা থাকলে বিষও মধু মনে হয়’।

মিতুর সেদিনের সেই আত্মতৃপ্তি ভোলার মতো না। কথা যখন বলছিলো তখন দু চোখ চকচক করে উঠছিল যেন। 

কিছুক্ষণ ধরে মোবাইলটা বেজে চলেছে। মিতু রান্না করছিলো তাই ধরতে দেরি হলো।

হাত মুছে ফোনটা ধরে বলল, ‘হ্যালো স্লামালেকুন। কে বলছেন’?  

মোবাইল ওপাশ থেকে ভেসে এলো, ‘ভাবি আমাকে চিনতে পারছেন আমি ফারুক বলছি। ঐযে নিউ মার্কেটে দেখা। আপানারা প্লাস্টিকের কিছু জিনিস কিনছিলেন। মনে আছে’?  

মনে পড়ে গেলো মিতুর। সে বলল, ‘ও হ্যাঁ ফারুক ভাই! কেমন আছেন? বাসায় সবায় কেমন আছে? বাচ্চারা কেমন আছে’? সরি ফারুক ভাই আপনার নম্বারটা আমার মোবাইল সেভ ছিল না’।  

ফারুক উত্তরে বলল, ব্যাপার না ভাবি, হতেই পারে। আপনাদের দোয়ায় সবাই ভালো আছে। আলহামদুলিল্লাহ। ভাবি একটা কাজে একটু ফোন করেছিলাম’।

মিতু বলল, কি ব্যাপার বলুন তো?

স্বপন ভাইকে একটু দরকার ছিল। উনি কি বাসায় আছে না কোন কাজে বাইরে গেছেন?

কেন আপনি জানেন না? আপনার স্বপন ভাইতো আপনাদেরই অফিসের ট্যুরে চট্টগ্রাম গেছে।

ফারুক একটু অবাক হয়ে বলল, ‘কি বলেন ভাবি? আমার জানা মতে স্বপন ভাইতো অফিসের ট্যুরে কোথাও যাননি। বরং উনি তো বাসার কাজের কথা বলে দু’দিন ছুটি নিয়েছেন।!

মিতু আর কথা বাড়ায় না। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে, অনুমানে সে তা বুঝেছে। সে কথাটা ঘুরিয়ে ফারুককে বলল, ‘হ্যাঁ স্বপন বলছিলো বাসার কাজের সঙ্গে অফিসের কাজও সেরে আসবে। তাইতো সেদিন আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলো। আমি হয়তো বুঝতে ভুল করেছি’।

ফারুক ওপাশ থেকে বলল, ‘ও আচ্ছা ঠিক আছে ভাবি, স্বপন ভাইয়ের অন্য কোন নম্বার থাকলে দিলে ভালো হয়। জরুরি আলাপ আছে’।

ফারুক ভাই স্বপনের তো একটাই নম্বার। ও তো আর অন্য কোন নম্বার ব্যবহার করেনা। ও কল দিলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবো’।

কথা বলার সময় যতদূর সম্ভব মাথাটাকে ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করলো মিতু। কথা শেষ করে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লো সে। সে কিছু একটা গড়বড় আছে অনুমান করছে। কিন্তু আবার এও চিন্তা করছে অনুমান নির্ভর কিছু ভেবে বসা ঠিক না। সে মনে মনে চিন্তা করলো, ‘স্বপন এলে কথা বলবে’।

স্বপন দুই দিন পর অফিসের কাজ করে বাসায় ফিরে এলো। এসেই মিতুকে জরিয়ে ধরে চুমু খেল। গভীর আদরে বুকের মধ্যে নিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘আহা কি শান্তি। তোমাকে বুকে নিলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। এই কি আছে তোমার মধ্যে? তোমাকে বুকে নিলেই আমার কেন এতো শান্তি শান্তি লাগে?

মিতু শুধু হুম হলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। বেশী কথা বাড়ালো না। স্বপন মিতুর এই ব্যবহারে কিছুটা অবাক হল। বলল, কি ব্যাপার শরীর খারাপ নাকি? কিছু হয়েছে? মন খারাপ?

মিতু উত্তরে বলল, ‘রান্না করতে করতে একটু টায়ার্ড হয়ে গেছি মনে হয়। ঠিক হয়ে যাবে। তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি’। বলে মিতু রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। স্বপনও ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকে পড়লো।

মিতুর স্বপনের এরকম ব্যবহার দেখে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলো। মন থেকে কালো মেঘ যা এতক্ষণ খেলা করছিলো তা কেটে গেলো। নিজেকে খুব হাল্কা হাল্কা বোধ করছে এখন। দুজনে একসঙ্গে বসে খেল। ডাইনিং টেবিলে স্বপন অনেক গল্প করলো মিতুর সঙ্গে। মনে হল এই দুইদিনে অনেক গল্প জমা ছিল। মিতুকে পেয়ে সব বাধা সরে গিয়ে একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে লাগলো সব।

এতো কিছুর পরও মিতু লক্ষ্য করলো, ‘আগে কথায় কথায় স্বপন মিতুর গায়ে হাত দিত। ট্যুর থেকে এলে বেডে অনেক আদর করতো। কিন্তু এবার টায়ার্ড বলে পাশ ফিরে শুয়ে গেলো। মিতুর শরীরটাকে কাছে টেনে পর্যন্ত নিলো না। স্বপনের ব্যবহার মিতুর কাছে কিছুটা আলাদা মনে হল। শুয়ে শুয়ে মিতুর কেবলই মনে হতে লাগলো অফিস থেকে দেরিতে ফেরা, হুটহাট ট্যুরের নামে বাইরে যাওয়া। মোবাইল চ্যাট করা আর মোবাইল বেজে উঠলে খুব সন্তর্পণে অন্য রুমে গিয়ে কথা বলা, কেমন যেন আলগা একটা অনুভূতির সৃষ্টি করলো মিতুর কাছে। মিতু ঠিক বুঝতে পারছে কিছু তো একটা আছে যা মোটেও স্বাভাবিক নয়। কোথায় যেন কি নেই। মিতু মনে মনে ছটপট করে উঠলো। এতদিন তাহলে কেন বুঝতে পারেনি সে? নাকি এ সবই তার ভুল, দুর্বল মনের বিকার মাত্র।

শুক্রবার ছুটির দিন। এই দিনটিতে স্বপন কিছুটা বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। মিতু সকালের রান্না করতে ব্যাস্ত সময় পার করছে। আজ পরোটা, ডিমভাজা আর আলুর দম রান্না হচ্ছে। স্বপনের ফেভারিট। নাস্তা প্রায় রেডি। স্বপনকে উঠাতে ঘরে ঢোকা মাত্র স্বপনের মোবাইল মেসাজের শব্দ কানে ভেসে এলো মিতুর। স্বপন তখনও ঘুমে অচেতন। ‘কোন জরুরি মেসেজ নাকি’? ভাবলো মিতু। মিতু কাছে গিয়ে মোবাইল তুলতেই আরেকটি মেসেজ ভেসে উঠলো। রিয়া নামে কেউ লিখেছে, ‘তোমাকে খুব মিস করছি’। মেসেজ দেখে মিতুর কেমন যেন বাজে অনুভূতি হল। সে সম্পূর্ণ মেসেজ পড়ার জন্য মোবাইল আনলক করতেই একগাদা হার্ট ইমজি ভেসে উঠলো। মিতুর চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠলো। সে ধীরে ধীরে স্ক্রল করতে শুরু করলো। সে যতই পড়ছে ততই অবাক হচ্ছে। স্বপন লিখেছে চট্টগ্রামের ট্যুরটা অতুলনীয় ছিল। রিয়ার উত্তর, ‘না মোটেও না। আমার মতে গুলশান হোটেলে আমাদের সময়টা ছিল বেস্ট। তবে কক্সবাজার ট্যুরটাও বেশ উপভোগ্য ছিল। বেডে যে তুমি কি পাগলের মতো করো না। তোমাকে সামলানোই যায় না। ইউ আর আ রিয়েল ওয়াইল্ড টাইগার। আই লাভ ইউ’।

উত্তরে স্বপন লিখেছে, ‘তোমার কোন তুলনা হয় না। তুমি বেস্ট। আই লাভ ইউ ঠু’।

সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছে যেন। নিজেকে দিশেহারা মনে হচ্ছে। পাগল পাগল লাগছে সব। পড়ছে আর মিতুর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ওদের দুজনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি দেখা যাচ্ছে। এসব দেখে মিতুর কেবলই মনে হচ্ছে কেউ যেন ওর হৃৎপিণ্ডটাকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে দিচ্ছে। বুকের ভেতর প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছে সে। কষ্টে কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না যেন। 

হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে মিতুকে তার মোবাইল হাতে কি যেন করছে দেখতে পেলো স্বপন। এমন সময় উঠে এসে পেছন থেকে মিতুর কাছ থকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বললো, ‘হাউ ডেয়াড় ইউ। তুমি আমার মোবাইলে হাত দিয়েছো কেন? মেসাজ কেন পড়ছো? মানুষের প্রাইভেসি বলে একটা কথা আছে। আনশিভিলাইসড কোথাকার’।

মিতু কিছুই বললোনা শুধু ফ্যালফ্যাল করে স্বপনের দিকে চেয়ে থাকলো। স্বপনের উদ্ধতপূর্ণ কথাবার্তা  নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে। এ ধরনের অন্যায় করার পর কোন মানুষ যে এতো নির্বিকার হতে পারে মিতুর চিন্তার বাইরে ছিল। শান্ত থাকতে থাকতে হঠাৎ মিতু চিৎকার করে উঠলো। বলল, চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার? অফিসের ট্যুরের নাম করে বান্ধবী কে নিয়ে ঘুরে বেড়াও। ছি ছি তোমার লজ্জা করেনা?

স্বপন মিতুকে থামাতে এগিয়ে আসতেই মিতু একরকম পাগলের মতো চড়, থাপ্পড় দিতে শুরু করে দিলো। আক্রোশে স্বপনের রাতে পড়া জামাটা একটানে ছিঁড়ে ফেললো মিতু। মুখে বলল কুত্তার বাচ্চা তুই আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আমার জীবন নিয়ে খেলেছিস। বাস্টার্ড।

স্বপন মিতুকে থামাতে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। মুখে বলল, ‘আর একটা কথা বললে তোকে এখানেই মেরে ফেলবো। কি প্রমাণ আছে তোর কাছে যে আমি লম্পট। ... উল্টাপাল্টা কথা বললে তোকে আমি খুন করে ফেলবো’।

মিতু তখনও স্বপনের জামার কলার ধরে আছে। বলল, ‘ফারুক ভাই কল করেছিলো উনি বলেছেন তুমি অফিসের ট্যুরে যাওনি। তুমি তোমার লাভারের সঙ্গে হানিমুনে গিয়েছ চট্টগ্রামে। তারও আগে কক্সবাজারে আর গুলশানে একসঙ্গে রাত কাটিয়েছ। সবই পড়েছই আমি। তোমাদের একসঙ্গে ইন্টিমেট সব ছবিও দেখেছি। ছি তোমার ঘেন্না করেনা। চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার?

সব শুনে স্বপন একটা ধাক্কা খেল যেন। একটু বোকা বোকা লাগছে নিজেকে। সে আস্তে আস্তে বিছানায় গিয়ে বসলো। কোন উপায় না পেয়ে মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার ভুল হয়েছে মিতু, আমাকে তুমি ক্ষমা করো। এবারের মতো মাফ করে দাও, প্লিজ’।

অপরাধবোধ আর অনুশোচনায় নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিলো স্বপনের। ক্ষণিকের আনন্দের জন্য এ কোন ভুল করে বসলো স্বপন। সে চাইলেও নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারবেনা।  

এতক্ষণে মিতুও কিছুটা ধাতস্ত হয়ে এসেছে। স্বপনের দিকে তাকিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করলো, ‘স্বপন আমার কি দোষ ছিল? আমিতো তোমাকে নিজেকে উজাড় করে চেয়েছি। এতো বড় কষ্ট তুমি আমাকে দিতে পারলে? তুমি আমার পৃথিবী ধ্বংস করে দিয়েছ। আমাকে শেষ করে দিয়েছ। কিভাবে পারলে? এসব জানার আগে আমার মৃত্যু হলনা কেন? স্বপন আমি যে তোমাকে খুব খুব ভালোবেসে ছিলাম। এত বড় প্রতারণা তুমি কেন করলে? আমাকে বললে আমিই তোমার জীবন থেকে চলে যেতাম। তাই বলে এতবড় আঘাত তুমি আমাকে দিতে পারলে’?

 

সময় যেন থেমে গেলো। মিতু আর আগের মতো উচ্ছ্বসিত হয়না। স্বপন বিরাট ভুল করেছে এবং তা সে বারবার স্বীকার করেছে। মিতু স্বপনকে মন থেকে ক্ষমাও করেছে। কিন্তু দিন শেষে যখন মুখোমুখি হয় তখন নিজের মূল্য নিয়ে সংশয় দেখা দেয় মিতুর। বড্ড সস্তা লাগে নিজেকে। পরিপূর্ণভাবে কিছু দিতে না পারার বেদনা নিজেকে কুড়ে কুড়ে খায়। মিতু বুঝতে চেষ্টা করে তাদের মাঝে কি ছিলনা যে স্বপনকে অন্য মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। সম্মানবোধ? মিতুর মতে, ‘স্বপন মিতুকে ভালোবাসতো ঠিক কিন্তু তার মধ্যে গভীরতা ছিলনা, সম্মান ছিলনা। যা ছিল তা প্রাত্যহিক জীবনের অভ্যেস। মাপ করে চুমু দেয়া, বাহির থেকে এসে জড়িয়ে ধরা, সাংসারিক কথা বলা, রুটিন করে মিলিত হওয়া। এর মধ্যে নতুনত্ব কি আছে? যা আছে তা সবই অভ্যেস। মিতু স্বপনকে রিয়ার কাছে কেন যাচ্ছে না জানতে চাইলে বলে, ‘রিয়াকে আমি সেভাবে কখনই দেখিনি। এটা একটা মোহ’।

মিতু বুঝতে পারে রিয়া স্বপনের পাঞ্চ লাইন। অনেকটা সারাদিনের ক্লান্তির পর এক পেগ মদ যেমন তেমন। স্বপনের কাছে ঘরটা থাকলো ঠিকই, মাঝে মাঝে একটু বাম্পার রাইডিং ও থাকলো, যা জীবনে স্পাইস যুক্ত করবে। এই সমীকরণ যা বোঝায় তা হচ্ছে। স্বপনের লয়াল থাকা প্রায় অসম্ভব, মিতুও সেটি বোঝে।

আগে দুজনার অনেক কথা হতো এখন সত্তুর শতাংশ কথা কমে গেছে দুজনার মধ্যে। প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় না। একে ওপরের দিকে ঠিক ভাবে তাকাতে পর্যন্ত পারে না। অনুশোচনায় আর অপমানে দুজনেই শুধু হারিয়ে থাকে। দুজনেই অনুভব করে, কোন কিছুই আর আগের মতো নেই। ঘটনা প্রবাহে সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। স্বপন মিতুকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য যথেষ্ট সাহায্য চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মিতু নিজের সামনে নিজেই দাঁড়াতে পারছেনা। দুপুরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মিতু ভাবছে সে আর কি করলে এমন ঘটনা ঘটতো না? কি করলে স্বপনকে আগলে রাখতে পারতো? বার বার একই উত্তর পেলো। অভ্যেস! টানটা আর আগের মতো নেই।

পরের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে মিতু বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালের আকাশ দেখছে। আনমনে কি যেন ভাবছে। স্বপন মিতুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, ‘অফিসে যাচ্ছি’ বলে বের হয়ে গেলো। মিতু একবার সকালের নাস্তার কথা জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না। বারান্দায় বসে দুই হাতের তালুতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে  কাঁদতে শুরু করলো।

রাতে স্বপন অফিস থেকে ফিরে এসে কলিং বেল দিলো। কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না দেখে একটু ভয় পেয়ে গেলো সে। ব্যাগে রাখা এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল স্বপন। রাতে লাইট জ্বালায়নি মিতু। পুরো বাসা চুপচাপ। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো স্বপনের। হঠাৎ ভয় পেয়ে মিতু মিতু বলে ডাকতে শুরু করে দিলো স্বপন। বেডরুমে ঢুকে দেখল মিতু সেখানে নেই। লাইটের সুইচ অন করলো স্বপন। বাথরুম, পাশের রুম, বেলকণি ঘুরে ঘুরে দেখল, কয়েকবার ডাকলো মিতু নাম ধরে কিন্তু কোন সাড়া নেই। বেড রুমে ফিরে এসে বিছানায় বসে পড়লো স্বপন। দুই হাতের তালুতে মুখ লুকাল সে। ভয়ে টেনশনে ঘেমে নেয়ে গেছে একেবারে। হাত থেকে মুখ তুলতেই লক্ষ্য করলো এস্ট্রের নিচে চিঠির মতো কি যেন চাপা দেয়া আছে টেবিলের উপর। স্বপন উঠে এসে দেখল হ্যাঁ মিতুর লেখা চিঠি একটা।

চিঠিতে লেখা,

স্বপন, আমরা পছন্দ করে পরিবারের মতের বাইরে গিয়ে সংসার পেতে ছিলাম। সুখে দুখে আমরা সব সময় এক ছিলাম। পাশাপাশি ছিলাম। ভেবেছিলাম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমার সঙ্গে পাড়ি দিবো। তা আর হলনা। এই ৮ বছরের সম্পর্কে কোনদিন বুঝিনি তুমি আমার কেউ নও। আজকের পর থেকে শুধুই মনে হচ্ছে তুমি আমার কেউ নও, তুমি আর পাঁচটা মানুষের মতো। তুমি নিশ্চয় জানো একটা সম্পর্ক টিকে থাকে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর সম্মান বোধ থেকে। একটা সম্পর্কের আয়ু বেড়ে যায় একে অপরকে বোঝা পড়ার মাধ্যমে। জানিনা কি পাপ করেছিলাম যে আল্লাহ আমাকে এতো বড় শাস্তি দিলেন। হ্যাঁ, শাস্তিই বটে। সম্পর্কে প্রতারণার কোন জায়গা থাকতে পারে না। আমি জানি আমাকে তুমি ঠিক ভালোবাসতে পারোনি। যা তুমি ভালবাসা বলছো তা আমার প্রতি নিছক ইনফাচুয়েসন। পুরনো অভ্যেস। কেন? সেটির উত্তর তুমিই ভালো দিতে পারবে। তুমি আজ আমাকে যে অসম্মান করেছ তার কোন তুলনা হয় না। আয়নার সামনে কোনদিন দাঁড়াতে পারবো এ বিশ্বাস আমার মরে গেছে। তোমার প্রতি রাগ বা ঘৃণা কোনটিই নেই আমার। তুমি আমার কাছে এখন যে কোন পুরুষ। তবু আমি তোমার ভালো চাইবো। তুমি ভালো থেকো। অনেক ভালো থেকো। নিজের যত্ন নিয়ো। শুধু জেন মিতু নামের একটি মেয়ে তোমাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিল। তোমাকে খুব খুব চেয়েছিলো। তার দাম সে পায়নি বলে চলে যাচ্ছে। আমাকে খুঁজনা।-মিতু

চিঠিটা পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বুকের মাঝে ধরে, ‘মিতু আমাকে মাফ করে দাও, আমাকে ক্ষমা করে দাও’ বলে বিলাপ করতে লাগলো স্বপন। কেমন পাগলের মতো মিতু মিতু বলে ডাকতে লাগলো সে। কিছুক্ষণ পর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনটাকে অসম্ভব ভারি বলে মনে হতে লাগলো স্বপনের। বিস্তীর্ণ আকাশে জীবনের অসীম অনিশ্চয়তার দিকে তাকিয়ে থাকলো শুধু।      

;

নৃত্য-গীতে জীবন্ত হল রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কালজয়ী আখ্যান



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্ব পরিভ্রমণের সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আর্জেন্টিনায় ল্যাটিন আমেরিকার কালজয়ী সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক ও নারীবাদী লেখক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ঐতিহাসিক সাক্ষাতের শতবর্ষ এ বছর।

১৯২৪ সালে এই দুই কালজয়ী লেখকের সাক্ষাত অক্ষয় হয়ে আছে দু’জনের জীবনস্মৃতিতে, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আদান-প্রদানে আর ভিক্টোরিয়াকে রবীন্দ্রনাথের ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করার মতো বহু ঘটনাবহুল আখ্যানকে ঘিরে। দু’জনের এই মধুর এ আখ্যানকে ঢাকার সাহিত্য ও সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে তুলে ধরলো ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি)।

সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ছায়ানট মিলনায়তনে ‘TAGORE AND VICTORIA OCAMPO-VIJAYA the victorious: 100 years on’ শীর্ষক নৃত্য-গীতে সেই অবিস্মরণীয় আখ্যানকেই ফুটিয়ে তুললেন যুক্তরাজ্য থেকে আগত বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও শিল্পী ডা. অনন্ত গুপ্ত এবং তাঁর সহশিল্পীরা।

বক্তব্য রাখছেন ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসা

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি) এর পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী আয়োজনের পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে অতিথি ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসার লাতিন আমেরিকার জনগণের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির কথা তুলে ধরে তাকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধন রচনকারী মহান লেখক হিসেবে বর্ণনা করেন। অনুষ্ঠানে আর্জেন্টিনায় অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ রচিত বিভিন্ন কালজয়ী গান নৃত্যসহযোগে পরিবেশন করেন শিল্পীরা। একইসঙ্গে সেইসব গানের প্রেক্ষিত তুলে ধরা হয়।

উল্লেখ্য, ১৯২৪ সালে পেরু সরকারের আমন্ত্রণে দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষ উদযাপনে যোগ দিতে গিয়ে তেষট্টি বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ সমুদ্রপথে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় তিনি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেসে থামেন এবং ওঠেন সান ইসিদ্রো শহরের এক হোটেলে। সেখানে কবির ভীষণ অনুরাগী আর্জেন্টিনার বিখ্যাত সাহিত্যিক ও নারীবাদী লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো (যিনি কবির গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ পড়ে তাঁর কবিতার সঙ্গে কবিরও অনুরাগী হয়ে উঠেন)। রবীন্দ্রনাথের আগমনের খবরে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ছুটে যান কবির কাছে। তিনি কবিকে সুস্থ করার জন্য হোটেল থেকে নদী তীরে বাগানবাড়িতে নিয়ে আসেন।

অনুষ্ঠান মঞ্চে অতিথিদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন আইজিসিসি পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী

এরপর এই দুই লেখকের সম্পর্ক গভীর আত্মিক সম্পর্কে পর্যবসিত হয়। কবি তাঁকে বিজয়া বলে সম্বোধন করতেন। কবির বিভিন্ন গানেও ভিক্টোরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। তাকে উৎসর্গ করেন কাব্যগ্রন্থ ‘পূরবী’। রবীন্দ্রনাথকে চিত্রকর্মে প্রাণিত করেন ওকাম্পো। ব্যবস্থা করেন প্রদর্শনীরও। দুই কালজয়ী সাহিত্যিকের মাঝে যেসব পত্র বিনিময় হয় তা সাহিত্যের চিরকালীন সম্পদে পরিণত হয়েছে।

;

বর্ষবিদায় - বর্ষবরণ

  ‘এসো হে বৈশাখ’



প্রদীপ কুমার দত্ত
মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

আবারও বছর ঘুরে এসেছে বৈশাখের পয়লা দিন। আমাদের জাতীয় উৎসব নববর্ষ। গত বেশ কয়েক বছর ধরে দেখতে পাই এই উৎসব নিকটবর্তী হলেই মঙ্গল,আনন্দ,আশার প্রতীক দিনটিকে বিতর্কিত করে একে বানচাল করার এক অশুভ প্রচেষ্টা দানা বাঁধানোর উদ্দেশ্যে একশ্রেণির লোক মাঠে নামে। পহেলা বৈশাখ উৎযাপন উপলক্ষে যে উৎসবমুখরতা, তা আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়,আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এই জাতীয় নানা বিষয়ের অবতারণা করে দিনটিকে বিতর্কিত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।

বিতার্কিকদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এর মধ্যে ধর্মাচরণকেও টেনে আনেন। গত বছর তো আইনগত ব্যবস্থা নেয়াও শুরু হয়েছিল। সেই প্রচেষ্টা অবশ্য হালে পানি পায় নি। এবারেও দন্ত-নখর বের করা শুরু করেছিল আমাদের বাংলার আদি সংস্কৃতির বিরোধীরা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় সরকার ক্ষমতায় থাকায় অংকুরেই সেই চেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়ে থেমে গেছে। অবশ্য সরকার উভয়পক্ষকে খুশি রাখার চেষ্টা করে উৎসব পালনের সময়সীমা সংক্ষিপ্ত করে নির্দেশনা জারি করেছেন। এই রকম আপোষ করে সেই কুৎসিত শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তোলা হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা সরকারের উপযুক্ত মহলের উচিৎ।

উৎসব পালনের কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। সময়ের সাথে সাথে এবং অঞ্চলভেদে বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও ধরন পাল্টায়। সংস্কৃতি ও কৃষ্টি গতিশীল। সমাজে গ্রহণযোগ্য এবং শালীনতার মাত্রা অতিক্রম না করা আনন্দে মেতে ওঠার বিভিন্ন কার্যক্রমের সমষ্টিই উৎসব। আদিকাল থেকেই বৈশাখী মেলা, হালখাতা, চৈত্র সংক্রান্তি, গাজন, নীলপূজা, চড়ক, বিভিন্ন প্রকৃতির লোকজ সংস্কৃতির ও খেলাধুলার আয়োজন,সাধ্যমত নতুন পোষাক ও ভালো খাবারের আয়োজন,অতিথি আপ্যায়ন, ইত্যাদি নিয়ে বাঙ্গালীরা পুরাতন বর্ষ বিদায় ও নববর্ষের আগমনকে একটি উৎসবের রূপ দিয়ে আসছে।

কালক্রমে বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে বাংলা সংস্কৃতির উপর পাক সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন কতৃপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার অংশ হিসাবে ছায়ানট রমনা বটমূলের বর্ষবরণ উৎসব আয়োজন শুরু করে। সেই আয়োজন আজ ডালপালা বিস্তার করে সারা দেশে এমনকি দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিহাস স্বাক্ষী, মৌলবাদের কালো থাবা সেই আয়োজন থামিয়ে দিতে রমনা বটমূলের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে নিরীহ সংস্কৃতি প্রেমীদের হত্যা করেও সফল হয়নি।২০০১ সালের সেই হামলার পর নিরীহ বাঙ্গালী গর্জে উঠে ২০০২ সালে আরও অধিক সংখ্যায় রমনায় হাজির হয়েছে। দেশের শহর ও গ্রামের দিকে দিকে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আরও ব্যপ্তি লাভ করেছে।

ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট বিগত শতাব্দীর আশির দশকে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু করে। এই আনন্দ উৎসব পরবর্তীতে মঙ্গল শোভাযাত্রার রূপ ধারণ করে। এই সফল আয়োজন ইতোমধ্যে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করেছে। আনন্দ প্রকাশের এই বহিঃপ্রকাশ নিয়ে এক শ্রেণির লোকের প্রচন্ড গাত্রদাহ রয়েছে।ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে তারা এই শোভাযাত্রা বন্ধ করতে চায়।দেশের প্রাগ্রসর প্রগতিশীল নাগরিকরা এই জাতীয় অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চায় না। মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান সহ বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের সকল আয়োজন দিন দিন আরও সবল,সতেজ ও পরিশীলিতভাবে অগ্রসর হবেই।

বৈশাখী উৎসবের বিরোধিতাকারী কূপমণ্ডূকদের অনেকের জানাই নেই যে এই উৎসব একই সময়ে দুই একদিন আগে বা পরে বহু জায়গায় বিভিন্ন নামে পালিত হয়। আমাদের নববর্ষ, আসামে বিহু,পাণ্জাবে বৈসাখ,থাইল্যান্ডে সাংক্রান,বার্মায় থিংইয়ান,নেপাল ও সংলগ্ন উত্তর ভারতে বিক্রম সম্ভত,কম্বোডিয়ায় চউল চ্নাম থিমে, সিংহলে আলুথ অনুরুদ্ধা, লাওসে বা পি মেই, কেরালায় ভিষু, তামিলনাড়ুতে পুথান্ডু, এই সব উৎসবই দক্ষিণ /দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রাচীণ কাল থেকে চলে আসা বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ। অনেক এলাকায়,এমনকি আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামেও ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল বা একে অপরের শরীরে পানি ছিটানো এই উৎসবের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। জল শুচি,পবিত্রতা ও শুভ্রতার প্রতীক। পুরনো বছরের ভুল, অসাফল্য, গ্লাণি সব ধুয়ে নতুন বছর আরও উন্নততর জীবনযাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক এই জল ক্রীড়া।

যে সকল অন্ধকারের শক্তি এই বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ উৎসবকে হিন্দুয়ানীর সাথে সম্পর্কিত অনুষ্ঠান বলে প্রচার করেন তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে সনাতনী ধর্মাচার ও সামাজিক আচার কিছু এই সময়ে অবশ্যই থাকে। সেগুলো সবই তাঁরা পালন করেন পণ্জিকা অনুযায়ী। সেই পঞ্জিকার সনাতনী ধর্মের পূজা বা উৎসব সমূহ নির্ধারিত হয় বিক্রম সম্ভত বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চন্দ্র/সূর্য/নক্ষত্র এর অবস্থান সমন্বয় করে বিভিন্ন মাস ২৯,৩০,৩১ এমনকি ৩২ দিনেও হয়।

সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী পহেলা বৈশাখ বেশির ভাগ বছর ১৫ এপ্রিল তারিখে হয়ে থাকে।লিপ ইয়ার সেই বর্ষপণ্জিতে না থাকার কারনে মোটামুটি চার বছরে একবার এটি ১৪ এপ্রিলে হয়। বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের জন্য বহু বছর গবেষণার পর বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে নিজস্ব বর্ষপঞ্জি চালু করেছে। সেই বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে প্রায় বছরই বাংলাদেশের সনাতনী সম্প্রদায় নববর্ষের দিন (১৪ এপ্রিল) তাঁদের সামাজিক/ধর্মীয় চৈত্র সংক্রান্তির পালনীয় ক্রিয়াকর্ম নিজেদের ঘরে পালন করেন।কিন্তু পহেলা বৈশাখের নববর্ষের সকল উৎসব ও কর্মকাণ্ডে আপামর দেশবাসীর সাথে সানন্দে অংশগ্রহণ করে থাকেন। একই কথা তাঁদের অন্য সকল পূজা পার্বণের বেলায়ও খাটে।


আমাদের পার্বত্য এলাকায় এই নববর্ষ পালন হয় জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে। এই অঞ্চলে বহু বাঙ্গালী তো আছেনই। কিন্তু বৃহৎ সংখ্যায় থাকেন ১৪টি বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মানুষ। নৃতাত্ত্বিক,সাংস্কৃতিক,ভাষাগত এবং বিভিন্ন ভাবে তাঁরা সমতলের বাঙ্গালীদের চাইতে তো বটেই, এমনকি একে অপরের চাইতেও আলাদা। এই বিভিন্নতা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এই সৌন্দর্যের নামই বহুল প্রচলিত শব্দবন্ধ ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি বা বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্য।

এখানকার বম,খিয়াং,লুসাই,পাঙ্খোয়া ও খুমিরা বৃহত্তর সংখ্যায় খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী। তাঁদের বড় উৎসব বড়দিন(ক্রিসমাস)।বকি সকলের জন্য তিন দিন ব্যাপী বর্ষবিদায় /বর্ষবরণ উৎসবই বছরের সেরা পার্বণ। এই সময় সব পাহাড় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে উৎযাপনে।যোগ দেন তাঁদের খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী অন্যান্য জাতিসত্ত্বার প্রতিবেশীরা এবং পাহাড়ে থাকা বাঙ্গালীরা। আমোদে অংশ নিতে দেখা যায় সমতল থেকে এই উপলক্ষে ছুটে আসা পর্যটকদেরও।

তাঁদের উৎসব আনন্দ উৎযাপনের মধ্যে অনেক উপাদান। মঙ্গল শোভাযাত্রার আলোকে র‍্যালী হয় সবাইকে নিয়ে।আয়োজনে থাকে প্রশাসন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। হয় বিচিত্রানুষ্ঠান। খাওয়া দাওয়ার আয়োজন সকলে করেন সাধ্যানুযায়ী উঁচুমানের। তার মধ্যে বিশেষ একটি আয়োজন হল বিভিন্ন তরিতরকারির মিশ্রণে পাঁজন বা লাবড়া। কে কত পদের তরকারি/শাক/ওষধি দিয়ে পাঁজন রেঁধেছেন তার চলে অঘোষিত প্রতিযোগিতা। ক্ষেত্র বিশেষে এই সংখ্যা পণ্চাশ ছাড়িয়ে যায় বলে শুনেছি।


উৎসবমালা শুরু হয় দেবতা ও প্রয়াতঃ পূর্বপুরুষদের স্মৃতিতে পাহাড়ি ঝরণা বা নদীতে ফুল ও প্রদীপ ভাসিয়ে। নতুন কাপড় পরিধান নতুন বছরের আগমনকে স্বাগত জানানোর প্রতীক।মন্দিরে চলে মহামতি বুদ্ধদেবের আরাধনা আগত বছরে সকলের মঙ্গল কামনায়। অনেক বড় মন্দিরে বহু লোক সমাগম হয় প্রথম দিন রাতে।সারা রাত উৎসবমুখর পরিবেশে পিঠা তৈরিতে সবাই হাত লাগায়। প্রত্যুষে সেই পিঠা দেবতাকে নিবেদন করা হয়। প্রথম দিন বহু মন্দিরের বুদ্ধ মূর্তি বাদ্য সহযোগে আনন্দ মিছিল করে নিয়ে যাওয়া হয় নিকটবর্তী নদীর পানিতে স্নান করানোর জন্য।

পাহাড়ে নববর্ষের সবচাইতে বড় আকর্ষণ সাংগ্রাইং জলক্রীড়ার কথা আগে উল্লিখিত হয়েছে। এছাড়াও থাকে পিঠা তৈরির প্রতিযোগিতা, কুস্তি,তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা, ইত্যাদি। সৌহার্দ্য বাড়াতে একে অপরের বাড়িতে যাওয়া,দলবদ্ধ ভাবে পান ভোজনের ব্যবস্থা করাও এই তিন দিনের কার্যক্রমের বিশেষ একটি দিক। চাকমারা বিজু, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বৈসুক,মারমারা সাংগ্রাইং, ম্রো জনগণ চাক্রান নামে এই উৎসবকে অভিহিত করেন। তণ্চঙ্গাদের কাছে বিষু,অসমীয়া সম্প্রদায়ের কাছে বিহু নামে পরিচিতি এই উৎসবের।

নামে কি বা আসে যায়। যে যেই নামেই জানুক এই উৎসব আমাদের লোকজ সংস্কৃতির একটি প্রাণের উৎসব। বাঙ্গালী ক্ষুদ্রতর নৃগোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই যার যার পছন্দ ও সাধ্য অনুযায়ী উৎসব পালন করবেন এটাই স্বাভাবিক। কারো যদি পছন্দ না হয় তিনি উৎসব পালনে বিরত থাকতেই পারেন। সেটা তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা। কিন্তু অন্যের উৎযাপনে বাধা সৃষ্টি করার অধিকার কারও নেই।

প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এই নববর্ষের সাথে সাথে হিজরি সাল;চন্দ্র,সূর্য, নক্ষত্র মন্ডলীর অবস্থান;ফসল তোলা;খাজনা পরিশোধ; ইত্যাদি বিষয়ের সমণ্বয় করে জ্যোতির্বিদ ফতেহউল্লাহ্ সিরাজী ও রাজা টোডরমলের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বাদশাহ আকবর চালু করেন আমাদের বর্তমানে চলিত বাংলা বর্ষপঞ্জি। সেই বর্ষপঞ্জির ১৪৩১ সাল সমাগত।

আসুন আমরা ১৪৩০ কে বিদায় জানিয়ে আবাহন করে নেই ১৪৩১কে। দেশবাসী ও বিশ্ববাসী সকলকে জানাই নববর্ষের শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি সকলের। কামনা করি ক্ষুধা মুক্ত,বণ্চনা মুক্ত, প্রতারণা মুক্ত, ব্যথা মুক্ত ও যুদ্ধ মুক্ত পৃথিবী। কল্যাণ হোক সকলের।সুখী ও সমৃদ্ধ হোন সবাই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;