মাক্সিম গোর্কির অকালবোধন



সাখাওয়াত টিপু
অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

  • Font increase
  • Font Decrease

কথাসাহিত্যিক, তাত্ত্বিক ও কবি মাক্সিম গোর্কি ১৫০ বছর বেঁচে আছেন, এটা একটা আজব ঘটনা। যদিও তিনি ইহকাল গত করেছেন ১৯৩৬ সালের ১৮ জুন। মৃত্যুর পর এই বেঁচে থাকাকে আমরা বললাম মাক্সিম গোর্কির অকালবোধন। তিনি কেন বেঁচে আছেন? কিভাবে আছেন? সেই চিন্তারাজ্যে প্রবেশের আগে আমরা দুটো কথা বলে নিতে চাই। তাতে হয়তো আলোচনার কিঞ্চিত সুবিধে হতে পারে। কড়ে কড়ে হিসেব করলে লিখিত রুশ ভাষার বয়স সহস্রাধিক বছর। প্রাচীন রুশ ইতিহাসের দিকে তাকালে সেই অর্থ অল্পস্বল্প বোঝা যাবে। রুশ লিখিত ভাষার বর্ণ আর ভাষার বিকাশ ঘটে গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের হাতেই। বিশেষত বাইবেলের অনুবাদ কর্মের ভেতরই রুশ ভাষার গঠন বা স্ট্রাকচার সৃষ্টি হয়। আমরা বলছি না, রোমান কিংবা গ্রিক ভাষার মতোই রুশ ভাষা এক পদার্থ। রুশ সম্পূর্ণ আলাদা ভাষা। আমরা দেখাচ্ছি ভাষার প্রভাবক কোথায়। দেখা যায়, রুশ ভাষার বর্ণমালা রোমান আর গ্রিক বর্ণমালারই মিশ্রিত ভাষা। তাই কোনো কোনো রুশ বর্ণ রোমান বর্ণ হতে খানিক তফাৎ। কোনো কোনো বর্ণ অবিকল গ্রিক বর্ণেরই মতো। ইয়ুরোপীয় ইতিহাসবেত্তাগণ এটাকে কনস্তান্তিনপোলীয় বা বাইজেন্টাইন বলেন। বাংলায় আমরা যাকে বলি ‘বিজাতীয়’! মানে অপর জাতির প্রভাব। এমন কথা বলার পেছনে ছোট্ট চিন্তা কাজ করেছে। তাত্ত্বিকভাবে দেখলে ভাষার বর্ণের সঙ্গে দুটো গুরুত্বপূর্ণ ভাব প্রভাবক হয়ে ওঠে। তার একটি অর্থ বা ভাবগত মানসকাঠামো, আর অন্যটি সাংস্কৃতিক উৎপাদন-কাঠামো। আর বাইবেলের প্রভাব কিভাবে রুশ সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছিল, সেটা পরখ করা। সেটা কেমন?

দশম শতাব্দীর বহুদেবত্ববাদী সামন্ত রাজা ভ্লাদিমিরের রাশিয়া খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ থেকে লিয়েভ তলস্তোয়ের সাহিত্যনাগাদ রুশসমাজের বাইবেলীয় সহজ ও নৈতিক মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যাবে অনায়সে। মনে রাখা দরকার—তলস্তোয় মিশনারি লেখক নন, আধুনিক এক কথাশিল্পী। লিয়েভ তলস্তোয়ের ‘হোয়াট ইজ আর্ট’ বা ‘শিল্পের আদল কী’ বইয়েও সেই চিন্তা দৃশ্যমান আছে। ধর্মশাসিত সাহিত্য আদতে ‘মঙ্গল’ আর ‘অমঙ্গল’ দিক-দর্শনে চিহ্নিত। সেই ক্ষেত্রে ইয়ুরোপের অপরাপর রোমান ক্যাথলিক চার্চ-প্রভাবিত দেশগুলোর সাহিত্য থেকে রুশ সাহিত্য একরাশ ভিন্ন প্রকৃতির। কেননা গ্রিক অর্থোডক্স চার্চ আর রুশ সমাজের লৌকিক সংস্কৃতি মিলে ইয়ুরোপখণ্ডে নতুন ভাষা আর সাহিত্য জন্ম নিয়েছিল রাশিয়ায়। রুশ প্রাচীন ভাষা-সাহিত্যের এটা একটা সরলরেখা। আমরা চিন্তার অন্য বিন্দুতে পৌঁছাতে চাই। সেই বিন্দু কোথায়?

রুশ সাহিত্য উদ্ভবের প্রধান শর্ত ছিল রাষ্ট্র গঠন আর লিপির প্রচলন দিয়েই। বিশেষত নদী-বাণিজ্যকে আমলে নিয়ে ৯১১ আর ৯৪৪ ইসায়ি সনে গ্রিসের সঙ্গে রুশীয়দের চুক্তিকে বলা হতো ‘লোতোপিস্’ বা ‘বর্ষপঞ্জি’। এসব চুক্তি গ্রিক আর রুশ ভাষায় লিখিত হতো। প্রাচীন এসব সাহিত্যের কথা সমসাময়িক আরবের সাহিত্যিক ইবনে খালদুন আর ইবনে আল নাদিমের লেখায়ও উল্লেখ আছে। মজার ব্যাপার হলো—১৯১৫ ইসায়ি সনে মাক্সিম গোর্কি দেশে ফেরার পর একই শিরোনামে ‘লোতোপিস্’ নামে নতুন পত্রিকা প্রকাশ করেন। পত্রিকাটি পরে দু-বছরের মাথায় বন্ধ হয়ে যায়। সেই তর্কে আমরা পরে আসছি। তবে রুশ ভাষার সাথে বাংলার অদ্ভুত মিল—ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামোর ভেতর দিয়ে দুটো ভাষার লিখিত রূপ প্রতিষ্ঠিত হয়। বেমিলটা এখানেই—খোদ রাষ্ট্র গঠনকে আমলে নিয়ে রুশ ভাষার জন্ম। আর বাংলা জনসংস্কৃতি থেকে উঠে আসা ভাষা। আমাদের ভাষা আন্দোলন ছিল—আত্মনিয়ন্ত্রণ আর প্রতিষ্ঠিত ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই। আমাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পায় মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়েই। ভাষা আন্দোলন সেখানে ছিল অনুপ্রেরণা আর দিকনির্দেশক মাত্র। ফলে আমরা যখন রুশ সাহিত্য নিয়ে আলোচনা পাড়ছি, তাতে ‘রাষ্ট্র’ নামক পদ আর পদার্থকে মাথায় রাখলে আলোচনার সুবিধে হয়। আলোচনা সুবিধার্থে কয় বাক্যে রুশ সাহিত্যের ইতিহাসে চোখ বোলাব আমরা।

রুশ সাহিত্যের রত্নভাণ্ডার বিশাল। খোদ মাক্সিম গোর্কির রচনাখণ্ড ৩০ খানার বেশি। আমাদের আলোচনা, পরিমাণের তুলনায় ধূলিকণা মাত্র! প্রাচীন যুগের রুশ সাহিত্য প্রায় ৩০০ বছরের। ১০০০ থেকে ১৩০০ সালনাগাদ বর্ষপঞ্জি, সন্তদের জীবনকাহিনী, উপদেশ বাণী, লৌকিক ধর্মোপদেশ, পাদ্রীদের জয়গান আর রূপকথার নৈতিক বিষয়াদিই প্রাচীন রুশ সাহিত্যে প্রধান প্রবণতা। কোনো কোনো রুশ তাত্ত্বিক এসময়ের সাহিত্যকে ‘মৌলিক সাহিত্য’ রূপে আখ্যা দিয়েছেন। রুশ সাহিত্যের মধ্যযুগ ৪০০ বছরের। চতুর্দশ শতাব্দীতে রুশ সামন্তপ্রথার ভাঙন ধরে। রাশিয়ানদের এটা মূলত মোগল আর তাতারবিরোধী সংগ্রামের যুগ। ফলে রুশের সাধারণ জনগণ ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। এটা রুশীয় বীরগাথা কাহিনীর কাল। বলা চলে ব্যক্তির জীবনকাহিনীর কাল। পঞ্চদশ শতাব্দীতে রুশ রাজ্যের পত্তন ঘটে। ফলে প্রাচীন লৌকিক আর বীরগাথা সাহিত্যের সাথে যুক্ত হয় ভ্রমণকাহিনীও। ষষ্ঠ আর সপ্তদশ শতকে রুশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সমাপ্তি ঘটে। সাহিত্যও যুগোপযোগী হতে থাকে আস্তে আস্তে। রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির বিকাশের ফলে যে অস্থিরতা দেখা দেয়—তাতে সাহিত্যে নতুন অর্গল খোলে। অন্তর্গতভাবে সাহিত্যে আত্মজীবনীর পালাবদল ঘটে। আত্মজীবনী থেকে সাহিত্যে রূপান্তর ঘটে ব্যক্তি মানুষের পার্থিব জীবন। ফলে রুশ সাহিত্যে নানা নন্দনতত্ত্বের সঙ্গে যুক্ত হয় নানান ছান্দসিকের কবিতা, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, নাটক আর প্রহসন।

অষ্টাদশ শতাব্দী রুশ ধ্রুপদী সাহিত্যের সংস্কার যুগ। রাজা পিয়োতরের সমাজ সংস্কারের ফলে রুশ সংবাদপত্র আর প্রবন্ধ সাহিত্য নতুন আকার পায়। এই সময় সাহিত্যে দুটো জিনিসের বিস্তার ঘটে। একটি রুশ সাহিত্য বাসনাবাদ [রোমান্টিসিজম] আরেকটি জ্ঞানবাদী বাস্তবতা [দ্য রিয়েলিটি অব নলেজ]। রোমান্টিকতা নিয়ে দুটো কথা বলা দরকার। রোমান্টিকতা দুটো ভাবের ভর মাত্র। ব্যক্তির আবেগ আর কল্পনার মিলন। বাংলায় আমরা ‘রোমান্টিসিজম’ কথাকে বললাম ‘বাসনাবাদ’। কেন? ভাষাশাস্ত্র বলছে, বাসনা মানে বাস না করা। মানে যেখানে সে বস্তুগতভাবে বাস করে না, বাস করে ভাবগতভাবে। মানে কল্পনার আশ্রয়ে। তাই বললাম বাসনাবাদ। কথামালা আলেকজান্দ্র রাদিশশোভ, ইভান ক্রিলোভসহ অপরাপর সাহিত্যিকদের দুয়েকছত্র পাঠ করলে তার হদিশ মিলবে। কোনো কোনো রুশ সাহিত্য তাত্ত্বিক এটাকে বলছেন ‘সেন্টিমেন্টালিজম’ বা ‘জাগরণবাদী’ যুগ। কারণ সংবাদপত্রের সাথে প্রকাশিত হতে থাকে নানা সাহিত্য সাময়িকী। নানা বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তারও বিকাশ ঘটতে থাকে এসময়। ফলে আমরা একটু অন্যভাবে দেখব। তো দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের ভাষায় বললে বলতে হয় ‘এনলাইটেনমেন্ট’। বাংলায় আমরা ‘এনলাইটেনমেন্ট’ শব্দটিকে বললাম ‘প্রভাতফেরি’। মানে প্রভাতের আলোর দিশারি। তাতে একটা সুবিধে হয়—ভাষা আন্দোলনের সঙ্গেও বাংলার নবজাগরণ মিলিয়ে দেখতে পারি আমরা। এক অর্থে ভাষার জাতীয় জাগরণ বটে। এটা নিছক তাত্ত্বিক প্রস্তাবনা মাত্র! ভবিষ্যত যেহেতু সামনেই। তাই টুকলাম হালকা ইশারায়।

২.
রুশ সাহিত্য আধুনিক যুগে প্রবেশ করে ঊনবিংশ শতকেই। আধুনিক সাহিত্যের এই ধারা প্রধান দুটো ভাগ হয়ে যায়। একদল প্রকৃতিবাদী ধারা, আরেকদল বাসনাবাদকে ভেঙে বাস্তববাদের দিকে ধাবিত হন। প্রকৃতিবাদীদের মধ্যে ভিসসারিন বেলিনস্কি, ইভান তুর্গোনেভ, আলেসাই কলোৎসভ উল্লেখযোগ্য। এরা পশ্চিমাধাঁচের কলাকৈবল্যবাদের দিকে ধাবিত হন। তারা খানিকটা পশ্চিমা উদারনৈতিক গণতন্ত্রী ভাবাপন্ন লেখক। উল্লেখ করার মতো বিষয়—তুর্গোনেভের দুঃসাহসী রচনা ‘শিকারীর রোচনামচা’র কথা। ভূমিদাস প্রথাবিরোধী এই রচনা তৎকালীন সরকার বাজেয়াপ্ত করতে বাধ্য হন। মূলত নিত্যঘটনার অন্তঃসার শূন্য স্বপ্নবিলাস আর জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষার অবাস্তব বাসনাকে বিদ্রুপ করা হয়েছে প্রকৃতিবাদী সাহিত্যধারায়। দ্বিতীয় ধারাটির প্রধান প্রবক্তা আলেক্সান্দর পুশকিন, লিয়েভ লেরমেন্তভ, নিকোলাই গোগল। পুশকিনকে তো রুশ জাতীয়তাবাদের নায়কই বলা হয়। রুশ দেশের জাতীয় কবি তিনিই। পুশকিন কবিতায় প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘আমার নাম জেনে তোমার কাম কী’। ‘আমি’ এবং ‘নাম জানা’র ভেতর দিয়ে জাতিত্বের প্রশ্নটি সামনে এনেছিলেন পুশকিন। আর মিখাইল লেরমেন্তভের ‘আমাদের কালের নায়ক’ উপন্যাসে দেখা যায়, নায়ক পিচুরিন খোড়া বদখৎ প্রকারের। রিষ্ট-পুষ্ট নায়কের বিপরীতে তিনি রুশীয় সমাজের ভেতরকার অন্য এক দুস্থ নায়ককে হাজির করেছেন। উপন্যাসে তিনি নাদুস-নুদুস নায়কের ধারাকে পাল্টে দেন।

বলা হয়ে থাকে, নিকোলাই গোগলের ‘ওভারকোট’ গল্পের পকেট থেকেই আধুনিক কথাসাহিত্যের জন্ম। কথাটা কোথাও ইভান তুর্গেনেভ কিংবা কোথাও ফিয়োদর দস্তোয়ভস্কির নামে চালু। ‘ওভারকোট’ গল্পে দেখা যায়, নায়ক আকাকি আকাকিয়োভিচ একজন নিম্নপদস্থ সরকারি কেরানি। আকাকি নিঃসঙ্গ মানুষ। তদুপরি একজন দৈন্য, বিরস, হতাশ আর অভাবী মানুষ। একই সঙ্গে তিনি প্রতিবাদহীন ও ভঙ্গুর প্রকৃতির মানুষ। অভাবী আকাকির ওভারকোট কেনাটাই জীবনের একটা বড় ঘটনা। আর ওভারকোট হারানোর ভেতর দিয়েই সে মরে ভূত হয়ে যায়। ক্লিষ্ট এক মানুষের স্বপ্ন দিয়ে শুরু, আর শেষ হয় অস্তিত্ব বিলীনের ভেতর দিয়েই। আসলে আকাকি আধুনিক সমাজের এক রহস্য! এমন কোনো চরিত্র ছিল কি ছিল না সে নিয়েই বিস্তর তর্ক আছে। আকাকির ওভারকোট বস্তুত তৎকালীন অন্তঃসারশূন্য রুশ সমাজ ব্যবস্থার প্রতীক! গোগল সম্পর্কে বন্ধু-পুশকিন বলেছিলেন, ‘হাসাতে হাসাতে তিনি চোখে অশ্রু নিয়ে আসতেন।’

ঊনবিংশ শতাব্দীর দুজন রুশ কিংবদন্তী লেখক ও তাত্ত্বিক ফিয়োদর দস্তয়োভস্কি আর লিয়েভ তলস্তোয়। দুটো কথা বলা দরকার। গোর্কি সাহিত্যের ওপর আন্তন শেকভের যে প্রভাব, দস্তয়োভস্কি আর তলস্তয়ের প্রভাব অনেক কম। তিনজনেরই সাহিত্যের প্রধান উপজীব্য ভাগ্যাহত মানুষ। তবে তফাৎ ছিল কিছুটা। কারণ বাইবেলীয় নৈতিকতা থেকে গোর্কি খানিকটা সাহিত্যকে দূরে রেখেছেন। শেষ জীবনেও তলস্তোয় আর গোর্কির সম্পর্ক শিথিল ছিল। গোর্কি মিলিয়েছেন রূপকথা, লৌকিক সাহিত্যের সঙ্গে আধুনিক দুনিয়ার ভুখানাঙ্গা মানুষের জীবন। তবে সত্য এই—হাল-নাগাদ বাংলাভাষায় সবচে বহুল পঠিত আর আলোচিত রুশ লেখক দুজন। ফিয়োদর দস্তয়োভস্কি আর লিয়েভ তলস্তোয়। ফলে আমরা আলোচনায় ওদিকে গেলাম না। সাহিত্যমহলে দুজনের চেয়ে খানিক কম আলোচিত লেখক মাক্সিম গোর্কি। কেন? মিখাইল গর্ভাচেভের অর্থহীন অর্থনৈতিক সংস্কার গ্লাসনাস্তো আর পেরোস্ত্রোইকার ফল? নাকি গোলকায়নের যুগে বিশ্বপুঁজিবাদের উদারনৈতিক সংস্কৃতির যুগে গোর্কির সাহিত্য খাপ খাচ্ছে না আর? প্রশ্নগুলোর উত্তর জটিল নয়। ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছে। কার্ল মার্কসের তত্ত্ব বিচারে দেখা যাবে—এহেন অর্থনৈতিক সংস্কারকে বলা চলে ‘বুর্জোয়া সমাজের দ্বন্দ্বমূলক উন্নয়ন।’ দ্বন্দ্ব কোথায়? আরেকটু এগিয়ে বলি—উদারনৈতিকতার ভেতর দিয়ে পুঁজিবাদ পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়া ছাড়া অন্য উপায় আছে, বৈকি! একদম নাই। বস্তুত বৈষম্যমূলক ভোগের স্বাধীনতা মানুষের মুক্তি দিতে পারে না। উন্নয়ন আছে তো, মানবতা নাই। শাসক আছে তো গণতন্ত্র নাই। বণ্টন আছে তো সাম্য নাই। খোদ মিখাইল গর্বাচেভই দু দশকের মাথায় ভুলের জন্য নিজের চুল ছিঁড়ছেন! তিনি বলেছেন, ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন সবচে বড় ভুল।’ তাহলে আমরা কোথায় যাব?

৩.
বিংশ শতাব্দীর সাহিত্যের নায়ক মাক্সিম গোর্কি। জুলিয়ান পঞ্জিকা মতে ম্যাক্সিম গোর্কির জন্ম ১৮৬৮ সালের ১৬ মার্চ। অবশ্য গেগরিয়ান মতে সেটা ১২ দিন পর ২৮ মার্চ। ভলগার তীরবর্তী নিজনি নোভগরদ্ শহরের পিতার আদিবাসেই তার জন্মস্থান। আদি নাম তার আলেক্সেই মাক্সিমভিচ পেশকভ। বাংলায় যার অর্থ পেশকভ বংশের মাক্সিমের ছেলে আলেক্সেই। প্রশ্ন হলো—‘আলেক্সেই মাক্সিমভিচ পেশকভ’ কিভাবে ‘মাক্সিম গোর্কি’ হয়ে উঠলেন? ছদ্মনামের পেছনে এক টুকরো ইতিহাস আছে। সেটা কী? জর্জিয়ায় ১৮৮৯ সালে পুলিশি নজনদারিতে পড়েন মাক্সিম। তখন ‘আত্মবিকাশ’ নামে বামপন্থী গোপন দলে নাম লেখান তিনি। কাজ দুটোই—জ্ঞানদান আর দলীয় প্রচারকার্য সাধন। জর্জিয়ার রাজধানী তিতলিসে বামপন্থী শ্রমিকদের সঙ্গেও আত্মীয়তা হয় সে সময়। রাস্তায় কাজ করার সময় জেলখাটা কয়েদি আলেক্সান্দর কালিজনির সঙ্গে পরিচয় তার। সেই কয়েদি গোর্কির মানবেতর জীবন, দুঃখ-দুদর্শার কথা শুনে বললেন, কাহিনীগুলো লিখতে। শ্রমিক সমর্থিত ‘ককেশাস্’ পত্রিকায় তার প্রথম গল্প ছাপা হয় ‘মাকার চুদ্রা’। তাতেই নিজের আদিনাম নাম পাল্টিয়ে রাখলেন মাক্সিম গোর্কি। বাংলা ‘গোর্কি’ শব্দের অর্থ ‘তেতো’ বা ‘তিক্ত’। মানে তিক্ততায় ভরা জীবন। তবে পরিণত ‘মাক্সিম গোর্কি’ আর ছন্নছাড়া ‘আলেক্সেই মাক্সিমভিচ পেশকভ’ এক জিনিস নয়। অভাব, অন্নহীন, বখে যাওয়া কিশোর আর উচ্ছন্ন পরিবারিক জীবনের কষ্টিপাথর ঘষে নাম নিয়েছিলেন মাক্সিম গোর্কি। সেটা কিভাবে?

গোর্কির দরিদ্র পিতা মাক্সিম সাভভাতেভিচ্ পেশকভই ছিলেন ভোলগা স্টিমশিপ কোম্পানির ছুতোরমিস্ত্রি। মা ভার্ভারা ভাসিলিয়েভ্না পেশকভা মালিক ভাসিলি কাশিরিনের কন্যা। বিয়ের পর গোর্কির পিতার পেশাগত পদোন্নতি হয়। কিন্তু ১৮৭১ সালে জুলাই মাসে পুত্র জন্মের তিন কি চার বছরের মাথায় ওলাওঠা রোগে পিতা পেশকভ গত হন। গোর্কির দুরাবস্থার শুরু সেখান থেকেই। মা সন্তানকে নিয়ে ওঠেন বাপের বাড়িতে। অবক্ষয়ী রাশিয়ায় তখন যৌথ পারিবারিক প্রথা ভেঙে পড়েছে। ফলে পারিবারিক সম্পত্তি নিয়েও তিক্ত হয়ে ওঠে সবার জীবন। নানার বিত্তবান পরিবারটিও অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়ে। নানা ভাসিলি কাশিরিন গোর্কিকে একদম দেখতে পারতেন না। শুধু শুধু পেটাতেন! কিন্তু তার নানী আকুলিনা কাশিরিনা ছিলেন খুব দরদী। হস্তশিল্পের কারিগর হিসেবে খুব নামডাক তার। নাতিকে ছড়া, লোক কাহিনী আর রূপকথার গল্প শোনাতেন। মূলত গোর্কির সাহিত্যের ভ্রুণ জন্মায় নানীর হাতেই। মায়ের নৈতরঙ্গ জীবন আর সন্তানের প্রতি উদাসীনতা গোর্কির ছেলেবেলা তিক্ততায় পর্যবসিত হয়। মা চলে যান নিজের চেয়ে ১০ বছরের ছোট এক পরপুরুষের কাছে। সেটাও সুখ আনেনি তার। তিনি মারা যান ১৮৭৯ সালে।

গোর্কি প্রাথমিক বিদ্যাপীঠে কদিন গিয়েছিলেন, সেটা না যাওয়ার মতোই। বাড়িতে পড়াশোনার পরিবেশ না থাকায় তিনি হয়ে ওঠেন ডানপিটে ভবঘুরে এক কিশোর। খেতে দিত না নানামশাই। ফলে বোহেমিয়ান জীবন ছাড়া তার অন্য উপায় ছিল না। গোর্কি নানার বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়েছিলেন নানীর হার-মাদুলি চুরির দায়েই। নানার সাফ সাফ কথা—‘তুই আমার বাড়ি থেকে হার-মাদুলি চুরি করিস, তোর পথ তুই দেখ।’ অন্নাভাব তাকে পথে নামিয়েছিল। প্রথমদিকে নানালোকের ফায়-ফরমাস খেটে পেট চালাতেন। পরে কাজ নেন খাবার হোটেলে। কত বিচিত্র পেশা তার—মুচির দোকান, রেলস্টেশনের দাড়োয়ান, শিক্ষানবিশি ড্রাফটম্যান, রাস্তার দিনমজুরি, মাছের আড়ত থেকে বাগানের মালির কাজ পর্যন্ত করতে হয়েছে তাকে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনের কোনো কোনো ঘটনা একই রকমের। তৎকালীন এক রাজনীতিকের বাসার পিস্তল চুরির দায়ে পুলিশি তদন্তের শিকার হয়েছিলেন নজরুল। সঙ্গে কমরেড মুজফ্ফর আহমদ থাকায় সে কিস্তিতে রেহায় পান তিনি। যদিও চুরির ব্যাপার ছিল একদম ভুয়া! গোর্কির বেলায় সেটা উল্টো! চুরির দায়ে বঞ্চনা আর সাজা ভোগ করেছেন। গোর্কির জীবনী পড়লে মনে হতে পারে—বোহেমিয়ান চালচুলোহীন এক মহানায়ক কিভাবে বিক্ষুব্ধ সময় পার করছেন। যিনি জীবনপাথরে বীজ ফেলে অমূল্য শস্য ফলিয়েছেন। বীজ রোপণ করেছেন ভবিষ্যতের।

মাক্সিম গোর্কি নব্বইয়ে দশকে চষে বেড়ান পুরো রাশিয়া। ১৮৮৪ সালে কাজান শহরে যান ১৬ বছর বয়সে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে গিয়ে ব্যর্থ হন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাবে। স্বপ্ন চুরমার হওয়া তরুণ দুঃখ-কষ্ট, গ্লানি-হতাশা আর মর্মযাতনায় দুবার আত্মহত্যা করতে গিয়েও ব্যর্থ হন। আরো নিষ্ঠুর ব্যাপার—‘আত্মহত্যা পাপ’ এমন দায়ে তাকে একবার শাস্তিস্বরূপ পাঠানো হয়েছিল গির্জার ফাদারের কাছে। পাপ মোচনের ভেতর দিয়ে যদি তার কিছু ইহলৌকিক নৈতিক শিক্ষা হয়। সেখানে এক কাণ্ড করে বসলেন তিনি। গির্জার ফাদারকে প্রশ্ন করে বসলেন—‘তোমরা বলছো এখানে ঈশ্বর আছে, কই তাকে তো দেখলাম না এখানে।’ অদ্ভুত আচরণের জন্য তাকে সেখান থেকেও বহিষ্কার করা হয়। এটা তার ঊনিশ বছর বয়সের ঘটনা।

গোর্কির জীবন নজরুলের জীবন নয়, দুজনের অন্তর্সলিলা রূপ একই নদীর মতো বয়ে গেছে। দুজনই জানতেন সাহিত্য আর লড়াইয়ের জন্য বেপোরোয়া জীবনে কোথায় ছুটতে হয়, কোথায় থামতে হয় আর কোথায় দাঁড়াতে হয়। বিক্ষুব্ধ জীবন আর হাড়-খাটুনির কৈশোরে দুজনেই কাজের ফাঁকে ফাঁকে মজে ছিলেন বইয়ে বইয়ে। কপালে স্কুল না জুটলেও বই হয় চিরসঙ্গী। নজরুলের মতো প্রথম জীবনে তার ব্যর্থতার শেষ নাই। তবে চরিত্রগত দুজনেরই অদ্ভুত অনেক মিল—পেশাগত জীবন, অপ্রাতিষ্ঠানিক স্বশিক্ষিত, জেলখাটা, শাসকের কোপানলে পরা, বই নিষিদ্ধ হওয়া, সম্পাদিত পত্রিকা নিষিদ্ধ হওয়া, বৈবাহিক জীবন থেকে রাজনৈতিক মতাদর্শগতভাবে প্রায় একই অর্গলের ভিন্ন ভিন্ন রূপ! ফলে আমরা বলতে পারি—গোর্কিও নজরুলের মতো আমাদের পরম বন্ধু। আমাদের সাহিত্যেরও অংশ। কেননা রুশ ভাষা ভেদ করে গোর্কির সাহিত্য আর চিন্তার বাংলা তর্জমা আমাদের সাহিত্যে নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে।

৪.
অভিজ্ঞতার পোড়খাওয়া অস্থির এক পান্থজনের আঁকাবাঁকা পদ দেখলাম এতক্ষণ। এই পদ ধূসর নয়, রক্তাক্ত টগবগে এক মানুষের। যিনি দেখিয়েছেন আস্তাকুঁড়ে থেকে বন্ধুর পথ মাড়িয়ে কিভাবে সৃষ্টিশীলতার অমোঘ সূর্যকে ছুঁতে হয়। আর শুধু নিজেকে জাগিয়ে নয়, অন্যের মানসালোক কিভাবে জাগাতে হয়—সেই কাণ্ডটিও। কল্পনা করুন—নবযুগের গোর্কির ‘বুড়ি ইজেরগিল’ রূপকথার কাহিনী। যেখানে দাংকো নিজের হৃদপিণ্ড তুলে আনছেন। আর তার স্ফটিকালোয় পথ দেখাচ্ছেন সর্বসাধারণকে। খুবই সুন্দর হৃৎপিণ্ডের আলো, খুবই প্রতীকী আলো। যেন বাতলে দিচ্ছেন অভীষ্ট ভবিষ্যতের পথ। তাহলে প্রশ্ন জাগে—মাক্সিম গোর্কির সাহিত্য কি পদার্থ? রুশতাত্ত্বিকদের মধ্যে দুধরনের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। একদল মনে করেন, সাহিত্যে রুশ বাস্তববাদের জনক মাক্সিম গোর্কি। আরেকদল মনে করেন তিনি ‘রিয়েলিটি অব সোশালিজম’ বা ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা’র লেখক তিনি। তর্কটা মূলত সাধারণ বুদ্ধিজীবী আর আমলাতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবীদের। এ কথা মানতেই হবে, কানা গলিতে না ঢুকেই তৎকালীন সমাজ-রাষ্ট্র ব্যবস্থার বাস্তবতারই কথাচিত্র এঁকেছেন তিনি। আর যুক্ত করেছিলেন মতাদর্শিক লড়াইয়ের তাত্ত্বিক ভিত। তবে কুটতর্কে জড়াব না আমরা। বলব—শ্রেণী সচেতন বাস্তববাদের ইহজাগতিক গুণবিচারী একজন সফল কথা সাহিত্যিক তিনি।


বার্তা২৪.কম-এর শিল্প-সাহিত্য বিভাগে লেখা পাঠানোর ঠিকানা
[email protected]


বালকবেলায় গোর্কিকে কবি বলে জানতাম। কোথাও জানি পড়েছিলাম ১৮৯৫ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম কবিতার বই ‘পেস্নিয়া অ সোকলে’ বা ‘বাজপাখির গান’। আর প্রথম জীবনে আমি পড়ি ‘পেসনিয়া অ বুলেভিয়েস্তানিকে’ বা ‘ঝ’ড়ো পাখির গান’। যা মনে এখনো গেঁথে আছে। সুভাষ মুখোপাধ্যায় অনুবাদ করেছিলেন সেই বিখ্যাত কবিতা। পরে জেনেছি—১৯০১ সালে রচিত এই কবিতা তাকে অন্য উপাধি দিয়েছিল। কবিতাটি প্রকাশের পর সেন্সর বিভাগের মুখোমুখি হন তিনি। সেন্সর বিভাগের কর্মচারিরা তার নাম দেন ‘ঝ’ড়ো পাখি’। সেই বছরই জারবিরোধী বিপ্লবী কর্মকাণ্ড আর শ্রমিক সংশ্রবের জন্য গ্রেফতার হন তিনি। এমনকি জেলখানার কয়েদি হিসেবেও তাকে ডাকা হতো ‘ঝ’ড়ো পাখি’ নামে। আলেক্সান্দর পুশকিনের কবিতা যেমন গীতিময় আর ছন্দোবদ্ধ, গোর্কির কবিতা সেরকম নয়। তার গদ্যাবদ্ধ কবিতাকে কেউ কেউ গল্প বলে ঠাউরিয়েছেন! শেষ বয়সে আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও মুক্তছন্দে এমন গদ্য কবিতা লিখেছেন। গোর্কির কবিতাটি কেন এত জনপ্রিয় হয়েছিল? উত্তর একটাই—দুষ্টশাসক জারতন্ত্র যে ক্রমে ক্রমে তলিয়ে যাচ্ছিল তার আলোকচ্ছটা কবিতার ভাবে স্পষ্ট করে তুলেছিল। কবিতায় প্রতীক ‘পাখি’ রুশদেশের ভবিষ্যত বিপ্লবেরই ইঙ্গিত বহন করছিল। ঝড়-ঝঞ্ঝা, বজ্র-বিদ্যুৎ মাড়িয়েই ভয়শূন্য পাখিটি বয়ে আনছে আনন্দের বার্তা। সেই অর্থে তিনি একজন ভবিষ্যতদ্রষ্টাও বটেন। সেটা কেমন—

এখুনি ঝড় উঠবে। ঝড় উঠতে দেরি নেই।
তবু সেই দুঃসাহসী ঝ’ড়ো পাখি বিদ্যুতের ভিড়ে,
গর্জমান উত্তাল
সমুদ্রের ওপর দিয়ে দীপ্ত পাখসাটে উড়ে চলে।
তার চিৎকারে
পুলকিত প্রতিধ্বনি ওঠে,
চূড়ান্ত জয়ের ভবিষ্যবাণীর মতো
সমস্ত ভীষণতা নিয়ে ভেঙে পড়ুক,
ঝড় ভেঙে পড়ুক।

[ঝ’ড়ো পাখির গান/ ১৯০১]

৫.
মাক্সিম গোর্কিকে ‘চেল্কাশ্’ গল্পটি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। গল্পের নায়ক ‘চেল্কাশ্’ একজন চোরা কারবারি। সে অর্থের দাস নয়, মুক্ত মনের মানুষ। বস্তুত পুঁজিবাদী এই উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও এমন সূত্রের ওপর টিকে আছে। কেন? গোর্কি দেখিয়েছেন, চেল্কাশ্ সমাজ ব্যবস্থার শিকার। চোরাকারবারি করা ছাড়া তার অন্যকিছু করে টিকে থাকার মওকা ছিল না। সমাজ তাকে অন্ধকার পথে যেতে বাধ্য করেছে। মানে তার ইচ্ছার স্বাধীনতা হরণ করেছে। কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দোপাধ্যয়ের অনুরূপ বিখ্যাত গল্প আছে, নাম ‘কালোবাজারে প্রেমের দর’। অর্থাভাব নিয়ে নায়কের সঙ্গে নায়িকার সংসার কলহ লেগে থাকত প্রতিনিয়ত। বান্ধবীর সংসারের চাকচিক্যের জীবন দেখিয়ে নায়কের জীবন অতীষ্ট করত নায়িকা-স্ত্রী। নায়ক একদিন আবিষ্কার করেন তার বৌয়ের বান্ধবী-স্বামীর চাকচিক্য। সে পাতি-বুর্জোয়া বান্ধবী স্বামীর অর্থবিত্ত আর বৈভব জীবনের প্রধান কারণ চোরাকারবারি। এক সময় সে বুর্জোয়া শ্রেণিতে উন্নীতও হয়।

‘অন্ধকার মানুষ’কে নিয়ে ১৮৯৫ সালে ‘চেল্কাশ্’ গল্প প্রকাশিত হলে সংবাদপত্রে কাজের প্রস্তাব পান গোর্কি। এখানেই নতুন জীবনের শুরু তার। সে সময় ‘সামারাস্কায়া গাজিয়েতা’ পত্রিকায় তার সহকর্মী ছিলেন একাতেরিনা ভোজলিনা। মেধাবী আর ধনীর মেয়ে একাতারিনা। বছর পেরুনো প্রেমের পর ১৮৯৬ সালে পরিণয়ে আবদ্ধ হন। তাদের সংসার টিকে ছিল মাত্র ৮ বছর। যদিও তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়নি কখনো। বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই গোর্কি প্রেমে পড়েন বিদুষী ভাষাতাত্ত্বিক ও অভিনেত্রী মারিয়া আন্দ্রেইয়েভার। ‘না দইনয়ে’ বা ‘নিচের মহল’ নাটকের রিহের্সাল থেকে। মারিয়া মস্কো আর্ট থিয়েটারের কর্মকর্তা ছিলেন। এই সম্পর্ক টিকে ছিল ১৭ বছর। ১৯২০ সালে তাদের বিচ্ছেদ হয়। গোর্কির নাটুকে জীবন এসময়ে দুটো ঘটনা ঘটে। একটি—বলশেভিক পার্টিতে যোগ দান। অবশ্য গোর্কি পার্টিতে যোগ দেন ১৯০৫ সালে। আর অন্যটি—নাটক মঞ্চস্থ করতে শিকার হন পুলিশি হয়রানির। বলশেভিক পার্টির সভ্য মারিয়া সেসময় অনেক সহযোগিতা করেন তাকে।

আন্তন চেখভের শিষ্য গোর্কির তিনটি নাটক খুবই বিখ্যাত। পাতি-বুর্জোয়া, নিচের মহল আর ফোমা গার্দায়েভ। প্রথম নাটক ‘পাতি-বুর্জোয়া’য় দেখা যায়—পাতি বুর্জোয়া সমাজের সাথে নিচুতলার মানুষের দ্বন্দ্ব। দেখা মেলে কিভাবে একটি সমাজে নিচুতলার মানুষ আরো কত নিচে নামে। আর সুবিধাবাদকে কাজে লাগিয়ে পাতি-বুর্জোয়া সমাজ কতটা উচ্চে উঠতে চায়। সমাজে ভেদাভেদের সংস্কৃতি কিভাবে রূপান্তর ঘটে তার নৈবেদ্য রূপও আছে এতে। নাটকে বিধবা ইলিয়েনার উক্তিটি স্বর্তব্য—‘থিয়েটারে গুরুগম্ভীর দৃশ্যের পরে সব সময়েই হালকা কিছু দেখায়... আসল জীবনে সেটা আরো বেশি দরকার...’। জীবন নিয়ে কেমন বিদ্রুপে ঠাসা এক উক্তি! এটি প্রথম যখন মঞ্চস্থ হয় সমাজের উপরতলার মানুষ দর্শকের সারিতে ভিড় করে। স্তানিস্লাভস্কি ও দেনচাংকোর মতো তাত্ত্বিকেরা এতে অভিনয় করেন। ‘নিচের মহল’ নাটকের কাহিনী ছিল ভাড়াটে বস্তিবাড়ির মানুষের সমাবেশ। বস্তির মানুষের দারিদ্র্যের কষাঘাত, মৃত্যু, গালিগালাজ, মাতলামি, বিশ্বাসঘাতকতা আর কলহভরা জীবনই যেন বেঁচে থাকার সারকথা! জীবন এখানে তুচ্ছ, মূল্যহীন! নাটকে নিষ্পেষিত আর আশাভঙ্গের নিরাভরণ মানুষকে সচেতন করাই ছিল গোর্কিও উদ্দেশ্য। গোর্কি নাটক দিয়ে শুধু সমাজের বাস্তব দশাকে দেখাতে চাননি, চেয়েছেন সমাজ অধ্যুষিত নিরন্ন-হাভাতে, বঞ্চিত-লাঞ্ছিত মানুষের অধিকার বোধ জাগিয়ে তুলতে। বিপ্লবপূর্ব রাশিয়ায় গোর্কিরা নিরঙ্কুশভাবে সফল হয়েছিলেন।

‘সংস্কৃতি ও স্বাধীনতা’ প্রবন্ধে মাক্সিম গোর্কি বলেছেন, ‘সর্বহারা সংঘবদ্ধভাবে কেবল একটা প্রত্যক্ষ কায়িক শক্তি, তার চেয়ে বেশি কিছু নয়, চাষীদের ক্ষেত্রে সেই একই ব্যাপার।’ মজার ব্যাপার হলো—গোর্কির ‘সর্বহারা’ হচ্ছেন অধিকার বঞ্চিত ‘সাধারণ জনগণ’। তিনি মানস শক্তিকেও এড়িয়ে যাননি। তিনি শ্রমশিবির বিচ্যুত বুদ্ধিজীবীদের কথাও বলেছেন। বস্তুত সাধারণ্যের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন এই বুদ্ধিজীবী সমাজ। ফলে সমাজের অধঃপতন টের পেতেন তিনি। তিনি বলছেন, ‘সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের গুরুতর সমস্যা হলো বুদ্ধিজীবীদের প্রাণ প্রাচুর্যের ক্ষয়। সেই ক্ষয়ের কারণ ক্ষুধা ও মোহভঙ্গ, এক ধরনের ঔদাসীন্য যা বুদ্ধিজীবীদের দমিয়ে দিতে থাকে।’ এই ক্ষয় বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায়ও ছিল। ফলে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের সাথে তার সম্পর্কের ওঠানামা ছিল। সে সময় অনেকে গোর্কির এই বক্তব্যকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। বলশেভিক গোর্কিকে বানানো হয়েছিল মেনশেভিক পার্টির চিন্তক। চিন্তার মৃদু পার্থক্যের কারণে লেনিন তাকে দূরে ঠেলে দেননি। এমনকি—বক্তব্যটি দিয়েছিলেন লেনিন শাসিত শিক্ষা অধিদপ্তরের অনুষ্ঠানে।

বুদ্ধিজীবীদের প্রশ্নে আমাদেরও নতুন করে ভাববার সময় এসেছে। আমরা অতীত থেকে শিখব। গোর্কি অধিক রাজনৈতিক সংগ্রামকে টিকিয়ে রাখবার প্রশ্নে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’কে। প্রশ্ন হচ্ছে—সাংস্কৃতিক বিপ্লব কী? গোর্কি বলছেন, ‘সব রকম শক্তিকে সুসংহত করে, তাদের সঙ্গে শ্রমিক ও কৃষক বুদ্ধিজীবীদের নবীন শক্তির সংযোগ সাধন করে সংস্কৃতি-কর্মীদের মন দিতে হবে নিজেদের কাজ গোছানোর দিকে।’ একবিংশ শতাব্দীর নব্বই দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙনের পর সবচে আলোচিত বই বামপন্থী বুদ্ধিজীবী ও দার্শনিক আলাঁ বাদিয়ুর ‘দি কমিউনিস্ট হাইপেথিসিস’ বা ‘কমিউনিস্ট রূপকল্প’। ফরাসি দার্শনিক বাদিয়ু দেখিয়েছেন, ‘কেন সাংস্কৃতিক বিপ্লব, বিপ্লবের আদি-অন্ত উৎস’। বাদিয়ু বলছেন, সংস্কৃতির রূপান্তর মানুষকে বদলে দেয়। সবচে বড় বদল ঘটায় মানুষের অভিজ্ঞতাকে। আর সাংস্কৃতিক রূপান্তর একই সঙ্গে মানুষের পূর্বতন অবস্থার ঐতিহাসিক বদল ঘটায়। ফলে অতীত ইতিহাস থেকে বাস্তব রাজনৈতিক প্রশ্নের উত্থান ঘটাতে পারে। সেই প্রশ্নের সুরাহা হয় রূপান্তরের ভেতর দিয়েই। বাদিয়ু আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন—‘ক্ষমতার জন্য লড়াই’ আর ‘ক্ষমতাসীনদের লড়াই’ এক জিনিস নয়। সাংস্কৃতিক মুক্তির প্রশ্নে অবশ্যই ‘ক্ষমতাসীনদের লড়াই’কে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে নাকচ করতে হবে। বুর্জোয়া সমাজ কাঠামোর প্রশ্নে—এটাই আমাদের সাংস্কৃতিক লড়াই।

৬.
বাংলাভাষায় অনূদিত গোর্কির সবচে আলোচিত ও পঠিত বই ‘মা’। বইটি তিনি রাশিয়ায় বসে লিখেননি। লিখেছেন মার্কিন প্রদেশে। প্রথম ছাপা হয়েছিল ইংরেজি অনুবাদে। প্রকাশিত হয় ১৯০৬ সালে। তারপর জার্মান ও রুশ ভাষায়। বলে রাখা ভালো, জার্মান ভাষায় প্রকাশের আগে লেনিন মা পাণ্ডুলিপি পড়েছিলেন। মা সম্পর্কে রুশ বিপ্লবের নায়ক ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের মত—‘বহু মজলুম বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন অচেতন-স্বতঃস্ফূর্তভাবে, এবার মা পড়ে তাদের মহা-উপকার হবে। এটি কালোপযোগী বই।’ বেশিরভাগ পশ্চিমা তাত্ত্বিক মার্কসবাদী ভাবাদর্শে লেখা মা উপন্যাসকে ‘মেকানিক্যালটাইপ’ বা ‘যান্ত্রিককলা’ বলে তুচ্ছজ্ঞান করেন! কিন্তু বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে সেটি ঘটেনি। পশ্চিমা বামপন্থী তাত্ত্বিক গেওর্গে লুকাচও বলেছেন, ‘প্রথম বিপ্লবের সমকালে সাংবাদিকের কার্যাবলী থেকে উঠে আসে মা।’ দেখা যাচ্ছে—উপন্যাসের ভাষার প্রতিবেদনধর্মীতা নিয়ে লুকাচের অভিযোগ। অভিযোগ কিঞ্চিত বেঠিক মনে হয়। কারণ গোর্কি তার সমকালীন ঘটনার প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে চেয়েছেন। এমনকি—সমকালীন ঘটনা থেকে বিচ্যুত হতে চাননি। কারণ তিনি মুক্তি রূপক আকারে দেখেননি। দেখেছেন বাস্তবতার অলিখিত দলিলরূপে। শ্রেণী এখানে মুখ্য হলেও মায়ের সঙ্গে পাভেল করচাগিনের যে সম্পর্ক সেটা শুধু রক্তের নয়, সাংস্কৃতিক লড়াইয়েরও গতিমুখ বৈকি। কেন?

১৯০৫ সালের ঘটনা। জাপানিদের কাছে পরাজয়ের পর রাশিয়ায় ঘটে এক রক্তাক্ত ঐতিহাসিক ঘটনা। যাকে রুশের ‘প্রথম বিপ্লব’ বলা হয়। ঘটনার শুরু ‘রক্তাক্ত রোববার’ দিয়েই। ভোটাধিকারের দাবিতে লাখ লাখ শ্রমিক-কৃষক-জনগণ যাচ্ছিল নিকোলাই জারের সাম্রাজ্যের কেন্দ্র পিতেসবার্গের দিকে। কোনো কারণ ছাড়াই গুলি করে শত শত শ্রমিককে হত্যা করেছিল জারবাহিনী। ঐতিহাসিক আরেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এই—বলশেভিক পার্টির উন্মেষও রক্তাক্ত রোববারের মধ্যদিয়ে। রক্তাক্ত সেই ঘটনায় নানা বিবৃতি আর লেখা প্রচার করলেন গোর্কি। গরাদে ঢোকানো হলো তাকে। পরে মুক্তি পেয়ে দেশ ছাড়তে হলো তাকে। ১৯০৬ সালে তিনি মার্কিন দেশে পালিয়ে যান। দীর্ঘ শ্রমিক জীবনের অভিজ্ঞতা আর বাস্তবের রক্তাক্ত লড়াইকে ‘মা’ উপন্যাসে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছিলেন গোর্কি। নন্দনতাত্ত্বিক শিল্পগুণ নিয়ে তর্ক হতে পারে। পৃথিবীর ইতিহাসে অসংখ্য উপন্যাস লেখা হয়েছে মা নিয়ে। কিন্তু অনেক মায়ের মধ্যে সার্বজনীন সর্বহারার মা হচ্ছেন মাক্সিম গোর্কির ‘মা’। শুধু তাই নয়—এপিক থিয়েটার তত্ত্বের কিংবদন্তী নাট্যকার বার্টল্ড ব্রেখট মা উপন্যাসের নাট্যরূপ মঞ্চস্থ করেছিলেন ১৯৩২ সালে। কোনো কোনো তাত্ত্বিক বলেছেন, অ্যাবসার্ট থিয়েটার তত্ত্বের ভ্রুণও ওতে আছে। ফারাক শুধু জার্মান আর ফ্রান্স! একটা কথা টুকে রাখি—মা উপন্যাসের পর গোর্কি ‘সন্তান’ নামে আরেকটি উপন্যাস লেখার কথা ছিল, সেটা পেরে ওঠেননি আর।

সাহিত্যিক হিসেবে গোর্কি ছিলেন সমন্বয়বাদী ধারার। সমন্বয় শব্দটি আমরা শাব্দিক অর্থে ব্যবহার করিনি। তাত্ত্বিকভাবে বললাম, অব্যয়ের অধিক অন্বয়। মানে চিন্তার সমবায়ী সাংস্কৃতিক রূপান্তর। বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কৃতিকে মুক্ত পাটাতনে নিয়ে আসা। তাই বন্ধু লেনিনের সহায়তায় প্রকাশ করেন পত্রিকা ‘লোপোতিস’ বা ‘বর্ষপঞ্জি’। ১৯১৫ সালে প্রকাশিত পত্রিকা টিকেছিল দুবছর। বলে নেওয়া ভালো—বলশেভিক আর মেনশেভিক ভাবাপন্ন মতাদর্শের লেখা ছাপা হতো পত্রিকায়। তাতে মনোদ্বৈরথও সৃষ্টি হয় হালকা। শেষ নাগাদ শারীরিক অসুস্থার কারণে লেনিন তাকে চিকিৎসার জন্য জার্মানিও পাঠিয়েছিলেন। বলে নেওয়া ভালো—অনেক সাহিত্যিক, কবি আর বুদ্ধিজীবী ছিলেন হয়তো, কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে গোর্কির মতো প্রভাবশালী লেখক রুশ দেশে জন্মায়নি আর! সাহিত্যিক প্রভাব এতটাই যে—পরলোক গোর্কির মরদেহ কাঁধে বহন করেছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রনায়ক জোসেফ স্তালিন। হালনাগাদ ইতিহাসে আমাদের এখনো জানা নাই, কোনো দেশের রাষ্ট্রপ্রধান তার দেশের একজন শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকের কফিন বহন করেছেন এভাবে। শেষ প্রণতির সময় সেই শ্রেষ্ঠ সম্মানটুকুও অর্জন করেছিলেন মাক্সিম গোর্কি।

মানতেই হবে—মাক্সিম গোর্কি আধুনিক একজন কথাশিল্পী। খেটে-খাওয়া মানুষের চিন্তার রূপকার। কিন্তু প্রশ্ন জাগে—আধুনিক সাহিত্য কী পদার্থ? আধুনিকতার মৌলিক কোনো সংজ্ঞা নেই। কিছু সাহিত্যিক প্রবণতা দিয়েই সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়। রাষ্ট্রের দিক থেকে—রাষ্ট্রীয় পুঁজির উলম্ব বিকাশ, আইন কাঠামোর বিকাশ, কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে যন্ত্রশিল্পের বিপ্লব, অর্থনৈতিক অবকাঠামোগত উন্নয়নের সঙ্গে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের উন্মেষ, গির্জা থেকে জ্ঞানকাণ্ডকে মানবিক বাস্তবকাণ্ডে নিয়ে আসা, লৌকিক বস্তুগত জীবন, বিজ্ঞান আর তথ্য প্রযুক্তির নতুন তরঙ্গ সৃষ্টি, ব্যক্তি-মানসের ইন্দ্রিয়ানুভূতিকেই জাগানো বা প্রতীকী করাসহ ইতিআদি। কিন্তু সংকট কিংবা প্রশ্ন অন্যখানে। আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় ব্যক্তির চরম বিকাশ ব্যক্তিকে কোথায় নিয়ে যায়? দর্শন বলছে, একচেটিয়া পুঁজি আধুনিক সমাজ ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক। একক ব্যক্তির বিকাশ থেকেই ভোগবাদের শুরু। ভোগ নিছক বস্তু হজম নয়, আরামদায়কও বটে! কিন্তু একক ভোগ ব্যক্তিকে সমাজের অপরাপর সামষ্টিক চেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। আর ব্যক্তি উৎপাদনের ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। একক ব্যক্তি আর্দশের মৃত্যু হতে পারে। কিন্তু সামষ্টিক আদর্শের কখনো মৃত্যু হয় না। যেমন আমরা মাক্সিম গোর্কির অকালবোধন করলাম। ঘুমন্ত গোর্কিকে মৃদু স্বরে জাগিয়ে তুললাম। আমরা গোর্কির স্বপ্নাদর্শের সঙ্গে অনুশীলন যোগ করলাম। সেই স্বর বাংলায় একদিন তরঙ্গ পাবে। সেটা নিশ্চিত।


তত্ত্ব ও তথ্য তালাশ
১. রুশ সাহিত্যের ইতিহাস: অরুণ সোম, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, ভারত
২. শ্রেষ্ঠ মাক্সিম গোর্কি: সংকলন ও সম্পাদনা—হায়াৎ মামুদ, অবসর প্রকাশনী, ঢাকা
৩. রচনাসপ্তক: নিকোলাই গোগল, সম্পাদনা অরুণ সোম, রাদুগা প্রকাশন, মস্কো
৪. মা: মাক্সিম গোর্কি, ভাষান্তর : পুষ্পময়ী বসু, সম্পাদনা হায়াৎ মামুদ, অবসর প্রকাশনী, ঢাকা
৫. কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা: মুজফফর আহমদ, মুক্তধারা সংস্করণ [পুর্নমুদ্রণ], ঢাকা
৬. On literature: Maxim Gorky, Foreign Languages publishing house, Moscow
৭. A history of Russian literature [ From beginning to 1900] : D. S. Mirsky, edited by Fransic J. Whitfield, Northwestern university press, USA
৮. Romantic Literature [From 1790 to 1830]: edited by Geoff Word, Bloomsbury, London
৯. Philosophy of Dictionary: Voltaire, edited & translated by Theodore Besterman, Penguin classics, England.
১০. A contribution to the critique of Political economy: Karl Marx, edited by Maurice Dobb, Progress Publisher, Moscow
১১. The Communist Hypothesis: Alain Badiou, translated by David Macey and Steve Corcoran, Verso, London

ইতিহাসবেত্তা রূপ কুমার বর্মনের বীক্ষণে দলিত, তপশিলি, নিম্নশ্রেণির ইতিহাস



সাৰ্থক লাহা
ইতিহাসবেত্তা রূপ কুমার বর্মন

ইতিহাসবেত্তা রূপ কুমার বর্মন

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাস চর্চা দীর্ঘকাল ধরে মূলত রাজনীতি, রাজনৈতিক চিন্তা, রাজবংশ, রাজা-রাজত্বের মধ্যে সীমায়িত ছিল। আবার একইসাথে ইতিহাসের সংজ্ঞায়নে কেউ কেউ বলেছেন মহান মহান মানুষের জীবন অবতারনা বা আলোচনার নামই হল ইতিহাস। থমাস কার্লাইলের ভাষায়, 'ইতিহাস হল অসংখ্য মহান মানুষের আত্মজীবনির সারবস্তু’।

মূলত একটা সময় ইতিহাস মানে নেপোলিয়ান, আলেকজান্ডার, অশোক, সমুদ্রগুপ্ত, আকবর প্রমুখ মানুষদের জীবনীগাঁথা ও তাঁদের সময়কালকেই বোঝা হতো। কিন্তু ইতিহাসের যে অন্য অনুষঙ্গ আছে বা ইতিহাস যে সমস্ত শ্রেণির মানুষের ইতিবৃত্ত সেটা বুঝতে বেশ কয়েক শতাব্দী অপেক্ষা করতে হয়।

মূলত গত শতাব্দীর ৮০’র দশক থেকে নিম্নবর্গের কথা ঐতিহাসিক কলমে উন্মোচিত হয়। তা সত্ত্বেও প্রশ্ন উঠেছে ‘নিম্নবর্গের মানুষ কি সত্যিই কথা বলতে পারে?’- এই প্রশ্নের উত্তরে সজ্জিত উপাত্ত নিয়ে ইতিহাসে যে দলিত শ্রেনি, তপশিলি জাতির উচ্চারনও সমানভাবে প্রতীয়মান, সেই জায়গাটি বাংলা ভাষায় ইতিহাসচর্চার আলোকে যিনি সম্মুখে আনেন তিনি হলেন অন্যতম ইতিহাসবেত্তা রূপ কুমার বর্মন। যার কলমে বিভিন্ন গ্রন্থে দলিত শ্রেনি, তপশিলি শ্রেণির তথা নিম্নশ্রেনির ইতিহাস, আত্মকথন, স্বকীয় রচনাগুলি পরিস্ফুটিত হয়েছে। লেখকের ‘সমকালীন পশ্চিমবঙ্গ জাতপাত জাতি-রাজনীতি ও তপশিলি সমাজ’ গ্রন্থটিও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়।

ইতিহাসচর্চা বস্তুনিষ্ঠতা, বিজ্ঞানবাদিতা, নিরপেক্ষতা সহ নানা নতুন অনুষঙ্গ নিয়ে ক্রমশই অগ্রবর্তী হচ্ছে। ইতিহাসবেত্তাদের কলমে ক্রমশই পরিবেশ, খাদ্যাভ্যাস, মহামারি, বিজ্ঞান, ক্রীড়াসহ নানাবিধ চর্চা বিশ শতকে নানা আবর্ত আলোচিত হতে দেখা যায়।

মুখ্যত বাংলা ভাষায় জাতপাত, জাতি-রাজনীতি ও তপশিলি সমাজ বিষয়ক আলোচনার আবর্ত দীর্ঘকাল যাবৎ ইতিহাসচর্চাকারীদের কলমে অপাংক্তেয় অবস্থাতেই থেকে গিয়েছিল। ঔপনিবেশিক কালপর্বে এবং সাম্প্রতিকে কিছুক্ষেত্রে জাতিচেতনা, দলিত আন্দোলন নিয়ে লেখালেখি হলেও মূলত তা ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যেই সীমায়িত। কাজেই কলকাতার গাঙচিল প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত রূপ কুমার বর্মনের ‘সমকালীন পশ্চিমবঙ্গ জাতপাত জাতি-রাজনীতি ও তপশিলি সমাজ’ এই গ্রন্থটি জাতপাতের ও আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে একটি নতুন দিকনির্দেশক গ্রন্থ তা বলাই যায়।

লেখক মূলত সমকালীন পশ্চিমবঙ্গকে এক্ষেত্রে অনুধাবন করেছেন। অসংখ্য সাক্ষাৎকার ও ক্ষেত্রসমীক্ষা সহ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংযোজন এবং অসংখ্য প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্তিকরনের প্রয়াসের ফসল এই গবেষণা গ্রন্থটি। শিরোনামেই ধরা পড়েছে গ্রন্থের মূল নির্যাস। যার মধ্যে সমকালীন পশ্চিমবঙ্গের জাতপাত, জাতি-হিংসা, তপশিলিদের সামাজিক স্তরীকরণে কী অবস্থা, অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা, নারীদের বৈষম্যকরনের পাশাপাশি ডান-বাম রাজনীতির আবহে এই তপশিলি জাতির চিত্রপটের স্বরূপ অনুধাবন, জাতিকেন্দ্রিক রচনা, কিছু ব্যক্তিত্বের বর্ননের সাথেও সরকারী নীতি, বিভাগ স্থাপন, প্রতিস্থান নির্মান ও নামকরন প্রভৃতি নানাবিধ বিষয়ের সংযুক্তকরুন বইটিকে এক অনন্য মাত্রা দান করেছে।

রুপ কুমার বর্মনের গ্রন্থটিতে ভূমিকা, অধ্যায়ীকরন, উপসংহার, সুদীর্ঘ গ্রন্থ তালিকা সহ বিভিন্ন সাক্ষাৎকারের সন্নিবিষ্টকরন পরিলক্ষিত করতে পারি। গ্রন্থ তালিকায় প্রাথমিক তথ্যাদি সহ বিভিন্ন আঞ্চলিক রচনা, অফিসিয়াল ও লেখ্যাগারের তথ্যাদি ও বৈদেশিক গ্রন্থের প্রয়োগ গ্রন্থটির প্রামাণ্যতাকে নির্দেশ করে। অতিরিক্ত তথ্যাদির এই ব্যবহার গ্রন্থটিকে আরো প্রাঞ্জল করেছে।

গ্রন্থটির ভূমিকাংশে জাতপাত এবং জাতি, বর্ণবাদের উৎপত্তির ব্যাখ্যা থেকে শুরু করে প্রাচীন ও আদি মধ্যযুগের বর্ণবাদের বিকাশ এবং ক্রমশই যে জাতপাতের ভারতীয় সমাজে নিম্নবর্ণীয়দের প্রান্তিকায়িত করার আভাস তার ব্যাখ্যা দেখতে পায়। লেখক ইসলামিক এবং ঔপনিবেশিক সময়কালেও গ্রন্থগুলি অবলোকন করে ভারতীয় সমাজের নিম্নবর্ণীয়দের কি অবস্থান, তারা কিভাবে জাতি বৈষম্যের শিকার সেই ব্যাখ্যা করেছেন এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন আইন এবং প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা মধ্য দিয়ে নিম্নবর্ণীয়দের অবস্থা যে ক্রমিক প্রভু-দাস সম্পর্কের (patron-client Relationship) বন্ধনে নিমজ্জিত হয়েছে। এবং প্রান্তিকিকরন হয়ে যাওয়ার যে ব্যাখ্যা সেটা আমরা দেখতে পাই এবং স্বাধীনতার সময়কালে ভারতের নিম্ন বর্ণের জাতি জাতি হিংসা অবসানের যে প্রচেষ্টা এবং সেই প্রচেষ্টায় তপশিলি জাতি এবং জনজাতীয় অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জাতির স্বরূপ কতটা বিকাশমূলক হয়েছে তার ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এবং খুব সুস্পষ্টভাবে ভারতীয় প্রেক্ষিতে পরিবর্তনের অনুধাবন করার চেষ্টা করেছেন এবং সমকালীন পশ্চিমবঙ্গেও জাতপাতের যে ধারাবাহিকতা সেটির আলোচনা করেছেন।

বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে তপশিলি জাতি ক্রমিক কিভাবে মৌখিক তথা বাহ্যিক এবং মানসিক জাতপাতের শিকার হচ্ছে সেই নব ব্যাখ্যাও এক্ষেত্রে সুস্পষ্ট।

গ্রন্থটির বিভিন্ন অধ্যায়ে বিভিন্ন আঙ্গিকে এই জাতপাত, জাতি-রাজনীতি, জাতি-হিংসা, জাতি-বৈষম্য এই বিষয়গুলি পরিস্ফুটিত হয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে পশ্চিমবঙ্গে জাতপাত, জাতি হিংসা এবং সামাজিক সংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক স্তরীকরণের ক্ষেত্রে জাতপাতের যে গুরুত্বপূর্ণ সেই ব্যাখ্যা যেমন আলোচিত হয়েছে তেমনি অন্য মেরুতে পশ্চিমবঙ্গের শহরাঞ্চলে চলতে থাকা বাচিক, মানসিক, ব্যবহারগত জাতপাতের যে অন্ধকার দিক সেটি লেখক তুলে ধরেছেন।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে স্বাধীনতার পর্বে পশ্চিমবঙ্গের পরিবর্তনকালীন রাজনীতি জাতপাত বা জাতি রাজনীতি কে কতটা ত্বরান্বিত করেছে এবং তপশিলি জাতির বিকাশ তথা উন্নয়ন নাকি তপশিলিরা রাজনীতির শিকার হয়েছে সেই ব্যাখ্যায় আমরা মূলত সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত পর্যবেক্ষিত হতে দেখি।

গ্রন্থটির তৃতীয় অধ্যায় মূলত বাংলার নিম্নবর্ণীয়দের নিজস্ব স্বকীয় লেখনীর মাধ্যমে তাদের অবস্থা নির্ণয়ের বা নির্মাণের আলোকে উঠে এসেছে। খুব সুন্দর ভাবেই লেখক বিভিন্ন জীবনী সাহিত্য, সৃজনধর্মী সাহিত্য অবলোকন এবং ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গে নিম্নবর্ণের উত্থানের প্রশ্নটিই উত্থাপন করেছেন। গ্রন্থটির চতুর্থ অধ্যায়ে বাংলার তপশিলি সমাজের থেকে রাজনীতিতে প্রতিনিধিত্বকরণ এবং বেশ কিছু নিম্নবর্ণীয় মানুষের বিস্মৃত স্মৃতির নতুন করে চর্চা এবং চর্যার জগতে আনার আলোকে রচিত হয়েছে।

জাতপাত, জাতি-বৈষম্য, জাতি রাজনীতি এই শব্দবন্ধগুলি ভারতীয় সমাজের আদি থেকে বর্তমান পর্যন্ত সমানভাবেই বহমান হয়ে রয়েছে। সমাজে অন্যকে দেখার মানসিকতা, প্রভু-দাসত্বের সম্পর্ক উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণের রূপক বর্তমান বিশ্বায়ন এবং প্রযুক্তির যুগেও সমভাবেই জাজ্বল্যমান সেটি পরিস্ফুটিত হয়েছে। গ্রন্থটি অনুধাবন করলে আমরা এই বিষয়টির সুস্পষ্ট বর্ণনা ফুটে উঠতে দেখতে পারি। কাজেই শুধুমাত্র ইতিহাস চর্চার আলোকে বা ইতিহাস পাঠকদের কাছেই নয়, সমাজের প্রতিটি মানুষের কাছে এই বইটির এক অন্যকথনের গল্প বলে যে গল্প জাতপাত, জাতি হিংসা, বৈষম্য প্রভৃতি বিষয়ের সংযোজনে জাতপাতের ইতিহাসে এই গ্রন্থটির গুরুত্বকে বর্নিত করে।

অনেক প্রশ্নের জবাব রূপ কুমার বর্মনের সমকালীন পশ্চিমবঙ্গ জাতপাত জাতি-রাজনীতি ও তপশিলি সমাজ’ গ্রন্থটি সজ্জা, জাতি ইতিহাসের নানা আঙ্গিকে বর্ননা, নির্ভরযোগ্য গ্রন্থতালিকা এবং সার্বিক-সুস্পষ্ট বর্ননা গ্রন্থটিকে অনন্য মাত্রা দান করে। হাল আমলে দাঁড়িয়ে জাতপাতের বর্ননা, আঞ্চলিক প্রেক্ষিত, জাতি-হিংসার নানা দিকের উন্মোচন এবং বিভিন্ন তথ্যাদির প্রয়োগে সার্বিকভাবে সমকালীন বাংলার জাতপাতের ইতিহাস নির্মানের ক্ষেত্রে এক দিকনির্দেশক পাঠ হয়ে উঠেছে রূপ কুমার বর্মনের ‘সমকালীন পশ্চিমবঙ্গ জাতপাত জাতি-রাজনীতি ও তপশিলি সমাজ’ গ্রন্থটি।

গ্ৰন্থ আলোচনা
সমকালীন পশ্চিমবঙ্গ: জাতপাত, জাতি-রাজনীতি ও তপশিলি সমাজ
রূপ কুমার বর্মণ
গাঙচিল প্রকাশনী, কলকাতা, ২০২২, দাম- ৪০০ টাকা
.....

সাৰ্থক লাহা, গবেষক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।

;

নজরুল পুত্রবধূ কল্যাণী কাজীর শেষ ইচ্ছা



সোমঋতা মল্লিক
নজরুল পুত্রবধূ কল্যাণী কাজীর শেষ ইচ্ছা

নজরুল পুত্রবধূ কল্যাণী কাজীর শেষ ইচ্ছা

  • Font increase
  • Font Decrease

“তোমার মহাবিশ্বে কিছু হারায় না তো কভু।

আমরা অবোধ, অন্ধ মায়ায় তাই তো কাঁদি প্রভু।।"

১৪ মে, সকাল। কলকাতার রবীন্দ্র সদনে সমবেত কণ্ঠে ধ্বনিত হল এই নজরুল সঙ্গীত। বহুল প্রচলিত গানটি এই বিশেষ দিনে আমার কাছে ধরা দেয় অন্যরূপে। সমুখে শায়িত রয়েছেন সদ্য প্রয়াত কাজী নজরুল ইসলামের কনিষ্ঠ পুত্রবধূ শ্রীমতী কল্যাণী কাজী। নিথর দেহে পুষ্পের অঞ্জলি। তাঁকে ঘিরে তাঁর আপনজনদের এই মর্মস্পর্শী উচ্চারণ মনকে ব্যাকুল করে।

তাঁর সঙ্গে আমার দীর্ঘ ১২-১৩ বছরের আত্মিক সম্পর্ক। ছায়ানট (কলকাতা)-এর হাত ধরেই যদিও এই সম্পর্ক শুরু হয়, কিন্তু পরবর্তীতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমাদের পরিবারের একজন। তাঁর কাছ থেকে যে ভালোবাসা পেয়েছি তা অবর্ণনীয়। আমার জীবনে এই প্রথম নজরুল জন্মজয়ন্তী যেদিন কল্যাণী কাজী আর সশরীরে আমাদের মধ্যে নেই। একথা ভাবলেই চোখ ভরে ওঠে জলে। বছরের এই বিশেষ দিনগুলিতে তাঁর সাথে দেখা হলে মনে হত, কি অসীম ভালোবাসায় তিনি আমাদের প্রাণের কবিকে অন্তরে ধারণ করেন। আর পাঁচজন শিশুর মতো তিনিও নজরুলকে ভালোবেসেছেন শৈশবেই।


'অন্তরঙ্গ অনিরুদ্ধ' বইয়ের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, "ছেলেবেলা থেকেই আমার প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। 'প্রভাতী', ‘লিচুচোর’ থেকে শুরু করে ‘বিদ্রোহী', 'আমার কৈফিয়ৎ’ ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’, ‘ইন্দ্রপতন’ প্রভৃতি কবিতা বিভিন্ন বয়সে মনে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। ছবিতে তাঁর ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল আর বড় বড় ভাবালু চোখ দুটোর দিকে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতাম। খুব কাছ থেকে তাঁকে দেখার ইচ্ছা হত। মনে পড়ছে, একবার গৃহশিক্ষককে অনুরোধ করেছিলাম তাঁকে দেখতে নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু কেন জানি না শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয়ে ওঠেনি। নিয়তি সেদিন অলক্ষ্যে নিশ্চয় হেসেছিলেন। নয়ত যে মানুষটাকে শুধু মাত্র চোখের দেখা দেখবার জন্য সেদিন ব্যাকুল হয়েছিলাম - পরবর্তী জীবনে তাঁরই পরিবারের একজন হয়ে তাঁর কাছে থেকে তাঁকে সেবা করার সুযোগ পেলাম কি করে? একেই বোধহয় বলে ‘বিধিলিপি’!

এই বিরল ব্যক্তিত্বের খুব কাছের মানুষ হয়েও, দুর্ভাগ্যবশত আমি সুস্থ অবস্থায় তাঁকে পাইনি। আমি এ বাড়ীর ছোট বউ হয়ে আসার বেশ কয়েক বছর আগেই বিস্মৃতি তাঁর চেতনার ওপর কালো পর্দা টেনে দিয়েছিল। তবুও আমাদের সবার প্রিয় ‘মামনি’ প্রমীলার স্নেহচ্ছায়ায় থেকে, তাঁর যতটুকু সেবা করার সুযোগ পেয়েছি তাতেই আমি ধন্য।"


এভাবেই কাজী অনিরুদ্ধর সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হওয়ার সুবাদে নজরুল পরিবারের একজন হয়ে উঠেছিলেন তিনি। বহু অন্তরঙ্গ আড্ডায় তিনি পরিবারিক স্মৃতিচারণা করতেন।

প্রথমবার তাঁর শ্বশুরবাবা কে সামনে থেকে দেখার অনুভূতির বর্ণনা যখনই দিতেন, মনে হত আমরাও সেই সময়ে উপস্থিত হয়েছি। তাঁর কথা বলার ভঙ্গি ছিল অসাধারণ। অতি সামান্য ঘটনাও তাঁর বাচনভঙ্গিতে হয়ে উঠত অসাধারণ।

তাঁকে ঘিরেই জমে উঠত আড্ডা। কখনও কথা, আবার কখনও গেয়ে উঠতেন একের পর এক নজরুল সঙ্গীত। নিয়মিত দূরদর্শনে নজর রাখতেন কোন্ শিল্পী কিভাবে নজরুলের গান গাইছেন। বিভিন্ন চ্যানেলের প্রভাতী অনুষ্ঠান দেখতে খুবই ভালোবাসতেন। পরিচিত শিল্পী হলে অনুষ্ঠানের পরেই চলভাষের মাধ্যমে অভিনন্দন জানাতেন। এভাবেই তিনি ভালোবাসায় আবদ্ধ করে রাখতেন সকলকে।

নজরুল চর্চার সঙ্গে যুক্ত যে কোন ব্যক্তি/সংগঠনকে তিনি আপন করে নিতেন। তাঁর পূর্ণদাস রোডের বাড়িতে ছিল নজরুল প্রেমীদের নিত্য যাতায়াত। নজরুল বিষয়ক আলোচনায় তাঁর ক্লান্তি ছিলনা। যে কোন সময়, যে কোন পরিস্থিতে তিনি পাশে থেকেছেন। ২০১৭ সালে কলকাতার বুকে প্রথম নজরুল মেলার আয়োজন করে ছায়ানট (কলকাতা), উদ্বোধক কল্যাণী কাজী। শিশুদের জন্য নজরুলের লেখা ২৫টি ছড়া ও কবিতা নিয়ে ২০২১ সালে ছায়ানটের উদ্যোগে কল্যাণী কাজীর কণ্ঠে ‘শিশু কিশোরদের নজরুল’ শিরোনামে একটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। পরম যত্নে তাঁর হাতে গড়া দল 'বিষের বাঁশী' ছায়ানট (কলকাতা) - এর বহু অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছে।


নজরুল সঙ্গীতের শিক্ষা তিনি কিভাবে পেয়েছিলেন সেই বিষয়ে কল্যাণী কাজী স্মৃতিচারণা করেছেন, "সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিল্পী শ্রী ধীরেন্দ্র চন্দ্র মিত্রের কাছে গান শেখার সুযোগ পাই। কিন্তু আজ আমার মনে হচ্ছে আমি সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারিনি। বাংলা গানের সাথে সাথে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতেও যাতে ব্যুৎপত্তি লাভ করতে পারি,  তিনি তার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। কিন্তু আমার তখন চটুল গানের দিকেই ঝোঁক বেশি, তাই রাগ সঙ্গীতের জটিল পথে চলতে মন চাইত না। যতদিন যাচ্ছে ততই বুঝতে পারছি গলাকে স্ববশে রেখে গান গাইতে হলে, বিশেষ করে নজরুল গীতিকে প্রাণবন্ত করতে রাগ সঙ্গীত চর্চা খুবই দরকার।

আজ সঙ্গীতের শিক্ষকতা করতে গিয়ে নজরুল গীতির সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রীদের সব রকমের বাংলা গানের চাহিদা যে মেটাতে পারি, তারজন্য আমি আমার গুরু শ্রদ্ধেয় শ্রী ধীরেন্দ্র চন্দ্র মিত্রের কাছে বিশেষ ভাবে কৃতজ্ঞ। সেদিন যদি তিনি জোর করে খেয়াল, ঠুংরী, দাদরা, গীত, গজল এর সাথে সাথে কীর্তন, পুরাতনী, রাগপ্রধান প্রভৃতি গান না শেখাতেন, তবে গানের অনেক ধারাই আমার অজানা থেকে যেত। কাজী নজরুলের গানের সঙ্গে প্রকৃত পক্ষে তিনিই আমায় প্রথম পরিচয় করান। প্রথম যে নজরুল গীতিটা শিখিয়েছিলেন সেটা হল হাম্বির রাগে নিবদ্ধ 'আজো কাঁদে কাননে কোয়েলিয়া'। এরপর তিনি শেখালেন 'ভোরের ঝিলের জলে', 'প্রথম প্রদীপ জ্বালো', 'শাওন আসিল ফিরে', 'ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি' প্রভৃতি নজরুলের রাগভিত্তিক গানগুলো।


আমার স্বামী অনিরুদ্ধ যখন নজরুল গীতির স্বরলিপির বই 'রাগবিচিত্রা'-র প্রস্তুতি নেন, তখন আমিই হাম্বির রাগের গানটির স্বরলিপির কাজে সাহায্য করেছিলাম। তিনি গানটা জানতেন না। অপ্রচলিত গানটা পরে খুবই জনপ্রিয় হয়েছে।" 

তিনি অসুস্থ ছিলেন বেশ কয়েকমাস, কিন্তু তাঁর জীবনীশক্তি ছিল প্রবল। জীবনের বহু দুঃসময়কে তিনি জয় করেছিলেন অবলীলায়। ১২ মে ভোরে নজরুল অনুরাগীদের চোখের জলে ভাসিয়ে অনন্তলোকে পাড়ি দিলেন তিনি।

তাঁর কন্যা অনিন্দিতা কাজী বলেছেন মায়ের শেষ ইচ্ছের কথা। শোকবার্তায় অনিন্দিতা লিখেছেন - "মায়ের শেষ ইচ্ছা ছিল তাঁর নিজের বাড়িতে (৭৪ এইচ, পূর্ণদাস রোড, ট্রায়াঙ্গুলার পার্ক) দাদু ও ঠাকুমার স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটা আর্কাইভ হবে।"

আমরা সকলেই চাই তাঁর শেষ ইচ্ছে পূরণ হোক।

সোমঋতা মল্লিক, নজরুল সঙ্গীতশিল্পী ও গবেষক। সভাপতি, ছায়ানট (কলকাতা)।

;

বাজারে এলো আতিফ ওয়াফিকের বই ‘এটিকেট এনসাইক্লোপিডিয়া’ 



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

এইচ এম আতিফ ওয়াফিক, যোগাযোগের ক্ষেত্রে একজন বিশেষজ্ঞ, তার সর্বশেষ বই "এটিকেট এনসাইক্লোপিডিয়া" বাজারে এসেছে। এই বইটি আজকের পাঠকদের দ্রুত-গতির বিশ্বে সঠিক আচরণের শিল্প সম্পর্কে একটি সমসাময়িক দৃষ্টিভঙ্গি সরবরাহ করবে বলে লেখক মনে করেন।

একটি সমাজে যেখানে আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, "এটিকেট এনসাইক্লোপিডিয়া" সেই ব্যক্তিদের জন্য একটি অমূল্য সম্পদ হিসাবে কাজ করবে বলে লেখক মনে করেন। বিশেষ করে আজকের স্কুল এবং কলেজ পড়ুয়া ছাত্র ছাত্রী দের এই বই টি অনেক কাজে আসবে। এই বইটি পাঠকদের আধুনিক আচরণের সূক্ষ্মতা আয়ত্ত করতে সাহায্য করার জন্য ব্যবহারিক পরামর্শ এবং কার্যকরী টিপস প্রদান করে৷

"এটিকেট এনসাইক্লোপিডিয়া" যত্ন সহকারে গবেষণা করা হয়েছে, পাঠকদের সমসাময়িক শিষ্টাচারের নিয়ম সম্পর্কে সর্বশেষ অন্তর্দৃষ্টি এবং নির্দেশিকা প্রদান করে। এর সহজ ভাষা এবং উপস্থাপন উদাহরণ সহ, সমস্ত পটভূমির পাঠকদের জন্য উপযুক্ত, তারা তাদের সামাজিক দক্ষতা পোলিশ করতে চাইছে বা তাদের পেশাদার চিত্র উন্নত করতে চাইছে।

এইচ এম আতিফ ওয়াফিক একজন অন্বেষিত যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ, তার আকর্ষক কথা বলার ব্যস্ততা এবং অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ পরামর্শের জন্য পরিচিত। বর্তমানে তিনি সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন ইউনিভার্সিটি অব স্কলার্স এ ।

রিডিং ক্যাফে, বনানীতে বইটি উন্মোচনের সময়, জনাব ববি হাজ্জাজ (একজন অক্সফোর্ড স্কলার), জনাব সোলায়মান শুকন (একজন বাংলাদেশী যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ), জনাব শাহরিয়ার নাফীস (সাবেক জাতীয় ক্রিকেটার), জনাব হাসান মাহমুদ (প্রতিষ্ঠাতা, স্কুল অফ ইঞ্জিনিয়ার্স), জনাব বেনজির আবরার (প্রতিষ্ঠাতা, এক্সিলেন্স বাংলাদেশ), মিসেস আফরুজা তানজি (রাষ্ট্রদূত, ওয়ান ইয়াং ওয়ার্ল্ড), মিসেস শারমিন কবির (প্রতিষ্ঠাতা, রিতু), মিসেস ইশরাত নাহের ইরিনা (প্রতিষ্ঠাতা, প্রেসক্রিপশন বাংলাদেশ), জনাব ফাহিন আরাফিন (ক্রিয়েটিভ হেড, স্বপ্ন), জনাব সালেহীন মাহবুব (বিশ্ববিদ্যালয় অনুষদ), মিসেস ফারহানা শারমিন (ডিজিটাল স্ট্র্যাটেজিস্ট, রিমার্ক এইচবি), এবং আরও অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী প্রিয় শিক্ষার্থীউপস্থিত ছিলেন।

;

কলকাতা আলীপুর জেল মিউজিয়ামে 'নজরুল কক্ষ'



কনক জ্যোতি, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
কলকাতা আলীপুর জেল মিউজিয়ামে 'নজরুল কক্ষ'

কলকাতা আলীপুর জেল মিউজিয়ামে 'নজরুল কক্ষ'

  • Font increase
  • Font Decrease

আধুনিক বাংলা সাহিত্যে তিনি একক ও অনন্য। তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। যার অগ্নিঝরা লেখনি ত্রস্ত করেছে ঔপনিবেশিক শাসকদের। যার বই বার বার বাজেয়াপ্ত হয়েছে। যাকে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে কাটাতে হয়েছে দিনের পর দিন।

নজরুল শতবর্ষ আগে বন্দি ছিলেন কলকাতার আলীপুর সেন্ট্রাল জেলখানায়। নজরুল বিষয়ক সংগঠন ছায়ানট কলকাতা শিল্প, সঙ্গীত, সাহিত্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা-গবেষণার পাশাপাশি নজরুল স্মৃতিধন্য হেরিটেজ স্থান ও স্থাপনাসমূহ রক্ষায় জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সক্রিয় রয়েছে। ছায়ানট কলকাতার সভাপতি, বিশিষ্ট শিল্পী, সোমঋতা মল্লিক কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের নজরুলতীর্থগুলো নিজে গিয়ে সেগুলো রক্ষার প্রশাসনিক ও নাগরিক তৎপরতা চালিয়ে ছিলেন। যার ফলে এবছর নজরুল জয়ন্তীতে কলকাতা আলীপুর জেল মিউজিয়ামে স্থাপিত হয়েছে 'নজরুল কক্ষ'।


ছায়ানট কলকাতা সভাপতি সোমঋতা মল্লিক বার্তা২৪.কম'কে জানান, গত ১৪ ডিসেম্বর,২০২২ তারিখে ছায়ানট (কলকাতা) তথ্য সহ WBHIDCO - এর কাছে এই মর্মে আবেদন করে যে, নজরুল স্মৃতি বিজড়িত আলিপুর জেল মিউজিয়ামে কাজী নজরুল ইসলাম যে জায়গায় বন্দি হিসেবে ছিলেন, সেই জায়গাটি চিহ্নিত করা এবং নজরুল মূর্তি স্থাপন করার জন্য।

তিনি বলেন, গত ১৭ জানুয়ারি,২০২৩ তারিখে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে নজরুলের আগমনের শতবর্ষকে স্মরণ করে ছায়ানট (কলকাতা) এবং আলিপুর মিউজিয়াম যৌথভাবে একটি অনুষ্ঠানও পালন করে।

শনিবার (২৬ মে) আমরা সত্যিই আনন্দিত, আমাদের এই প্রস্তাব তাঁরা বিবেচনা করেছেন এবং আলিপুর মিউজিয়ামে 'নজরুল কক্ষ' তৈরি হয়েছে, জানান সোমঋতা মল্লিক।

;