মাক্সিম গোর্কির অকালবোধন



সাখাওয়াত টিপু
অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

  • Font increase
  • Font Decrease

কথাসাহিত্যিক, তাত্ত্বিক ও কবি মাক্সিম গোর্কি ১৫০ বছর বেঁচে আছেন, এটা একটা আজব ঘটনা। যদিও তিনি ইহকাল গত করেছেন ১৯৩৬ সালের ১৮ জুন। মৃত্যুর পর এই বেঁচে থাকাকে আমরা বললাম মাক্সিম গোর্কির অকালবোধন। তিনি কেন বেঁচে আছেন? কিভাবে আছেন? সেই চিন্তারাজ্যে প্রবেশের আগে আমরা দুটো কথা বলে নিতে চাই। তাতে হয়তো আলোচনার কিঞ্চিত সুবিধে হতে পারে। কড়ে কড়ে হিসেব করলে লিখিত রুশ ভাষার বয়স সহস্রাধিক বছর। প্রাচীন রুশ ইতিহাসের দিকে তাকালে সেই অর্থ অল্পস্বল্প বোঝা যাবে। রুশ লিখিত ভাষার বর্ণ আর ভাষার বিকাশ ঘটে গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের হাতেই। বিশেষত বাইবেলের অনুবাদ কর্মের ভেতরই রুশ ভাষার গঠন বা স্ট্রাকচার সৃষ্টি হয়। আমরা বলছি না, রোমান কিংবা গ্রিক ভাষার মতোই রুশ ভাষা এক পদার্থ। রুশ সম্পূর্ণ আলাদা ভাষা। আমরা দেখাচ্ছি ভাষার প্রভাবক কোথায়। দেখা যায়, রুশ ভাষার বর্ণমালা রোমান আর গ্রিক বর্ণমালারই মিশ্রিত ভাষা। তাই কোনো কোনো রুশ বর্ণ রোমান বর্ণ হতে খানিক তফাৎ। কোনো কোনো বর্ণ অবিকল গ্রিক বর্ণেরই মতো। ইয়ুরোপীয় ইতিহাসবেত্তাগণ এটাকে কনস্তান্তিনপোলীয় বা বাইজেন্টাইন বলেন। বাংলায় আমরা যাকে বলি ‘বিজাতীয়’! মানে অপর জাতির প্রভাব। এমন কথা বলার পেছনে ছোট্ট চিন্তা কাজ করেছে। তাত্ত্বিকভাবে দেখলে ভাষার বর্ণের সঙ্গে দুটো গুরুত্বপূর্ণ ভাব প্রভাবক হয়ে ওঠে। তার একটি অর্থ বা ভাবগত মানসকাঠামো, আর অন্যটি সাংস্কৃতিক উৎপাদন-কাঠামো। আর বাইবেলের প্রভাব কিভাবে রুশ সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছিল, সেটা পরখ করা। সেটা কেমন?

দশম শতাব্দীর বহুদেবত্ববাদী সামন্ত রাজা ভ্লাদিমিরের রাশিয়া খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ থেকে লিয়েভ তলস্তোয়ের সাহিত্যনাগাদ রুশসমাজের বাইবেলীয় সহজ ও নৈতিক মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যাবে অনায়সে। মনে রাখা দরকার—তলস্তোয় মিশনারি লেখক নন, আধুনিক এক কথাশিল্পী। লিয়েভ তলস্তোয়ের ‘হোয়াট ইজ আর্ট’ বা ‘শিল্পের আদল কী’ বইয়েও সেই চিন্তা দৃশ্যমান আছে। ধর্মশাসিত সাহিত্য আদতে ‘মঙ্গল’ আর ‘অমঙ্গল’ দিক-দর্শনে চিহ্নিত। সেই ক্ষেত্রে ইয়ুরোপের অপরাপর রোমান ক্যাথলিক চার্চ-প্রভাবিত দেশগুলোর সাহিত্য থেকে রুশ সাহিত্য একরাশ ভিন্ন প্রকৃতির। কেননা গ্রিক অর্থোডক্স চার্চ আর রুশ সমাজের লৌকিক সংস্কৃতি মিলে ইয়ুরোপখণ্ডে নতুন ভাষা আর সাহিত্য জন্ম নিয়েছিল রাশিয়ায়। রুশ প্রাচীন ভাষা-সাহিত্যের এটা একটা সরলরেখা। আমরা চিন্তার অন্য বিন্দুতে পৌঁছাতে চাই। সেই বিন্দু কোথায়?

রুশ সাহিত্য উদ্ভবের প্রধান শর্ত ছিল রাষ্ট্র গঠন আর লিপির প্রচলন দিয়েই। বিশেষত নদী-বাণিজ্যকে আমলে নিয়ে ৯১১ আর ৯৪৪ ইসায়ি সনে গ্রিসের সঙ্গে রুশীয়দের চুক্তিকে বলা হতো ‘লোতোপিস্’ বা ‘বর্ষপঞ্জি’। এসব চুক্তি গ্রিক আর রুশ ভাষায় লিখিত হতো। প্রাচীন এসব সাহিত্যের কথা সমসাময়িক আরবের সাহিত্যিক ইবনে খালদুন আর ইবনে আল নাদিমের লেখায়ও উল্লেখ আছে। মজার ব্যাপার হলো—১৯১৫ ইসায়ি সনে মাক্সিম গোর্কি দেশে ফেরার পর একই শিরোনামে ‘লোতোপিস্’ নামে নতুন পত্রিকা প্রকাশ করেন। পত্রিকাটি পরে দু-বছরের মাথায় বন্ধ হয়ে যায়। সেই তর্কে আমরা পরে আসছি। তবে রুশ ভাষার সাথে বাংলার অদ্ভুত মিল—ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামোর ভেতর দিয়ে দুটো ভাষার লিখিত রূপ প্রতিষ্ঠিত হয়। বেমিলটা এখানেই—খোদ রাষ্ট্র গঠনকে আমলে নিয়ে রুশ ভাষার জন্ম। আর বাংলা জনসংস্কৃতি থেকে উঠে আসা ভাষা। আমাদের ভাষা আন্দোলন ছিল—আত্মনিয়ন্ত্রণ আর প্রতিষ্ঠিত ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই। আমাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পায় মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়েই। ভাষা আন্দোলন সেখানে ছিল অনুপ্রেরণা আর দিকনির্দেশক মাত্র। ফলে আমরা যখন রুশ সাহিত্য নিয়ে আলোচনা পাড়ছি, তাতে ‘রাষ্ট্র’ নামক পদ আর পদার্থকে মাথায় রাখলে আলোচনার সুবিধে হয়। আলোচনা সুবিধার্থে কয় বাক্যে রুশ সাহিত্যের ইতিহাসে চোখ বোলাব আমরা।

রুশ সাহিত্যের রত্নভাণ্ডার বিশাল। খোদ মাক্সিম গোর্কির রচনাখণ্ড ৩০ খানার বেশি। আমাদের আলোচনা, পরিমাণের তুলনায় ধূলিকণা মাত্র! প্রাচীন যুগের রুশ সাহিত্য প্রায় ৩০০ বছরের। ১০০০ থেকে ১৩০০ সালনাগাদ বর্ষপঞ্জি, সন্তদের জীবনকাহিনী, উপদেশ বাণী, লৌকিক ধর্মোপদেশ, পাদ্রীদের জয়গান আর রূপকথার নৈতিক বিষয়াদিই প্রাচীন রুশ সাহিত্যে প্রধান প্রবণতা। কোনো কোনো রুশ তাত্ত্বিক এসময়ের সাহিত্যকে ‘মৌলিক সাহিত্য’ রূপে আখ্যা দিয়েছেন। রুশ সাহিত্যের মধ্যযুগ ৪০০ বছরের। চতুর্দশ শতাব্দীতে রুশ সামন্তপ্রথার ভাঙন ধরে। রাশিয়ানদের এটা মূলত মোগল আর তাতারবিরোধী সংগ্রামের যুগ। ফলে রুশের সাধারণ জনগণ ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। এটা রুশীয় বীরগাথা কাহিনীর কাল। বলা চলে ব্যক্তির জীবনকাহিনীর কাল। পঞ্চদশ শতাব্দীতে রুশ রাজ্যের পত্তন ঘটে। ফলে প্রাচীন লৌকিক আর বীরগাথা সাহিত্যের সাথে যুক্ত হয় ভ্রমণকাহিনীও। ষষ্ঠ আর সপ্তদশ শতকে রুশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সমাপ্তি ঘটে। সাহিত্যও যুগোপযোগী হতে থাকে আস্তে আস্তে। রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির বিকাশের ফলে যে অস্থিরতা দেখা দেয়—তাতে সাহিত্যে নতুন অর্গল খোলে। অন্তর্গতভাবে সাহিত্যে আত্মজীবনীর পালাবদল ঘটে। আত্মজীবনী থেকে সাহিত্যে রূপান্তর ঘটে ব্যক্তি মানুষের পার্থিব জীবন। ফলে রুশ সাহিত্যে নানা নন্দনতত্ত্বের সঙ্গে যুক্ত হয় নানান ছান্দসিকের কবিতা, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, নাটক আর প্রহসন।

অষ্টাদশ শতাব্দী রুশ ধ্রুপদী সাহিত্যের সংস্কার যুগ। রাজা পিয়োতরের সমাজ সংস্কারের ফলে রুশ সংবাদপত্র আর প্রবন্ধ সাহিত্য নতুন আকার পায়। এই সময় সাহিত্যে দুটো জিনিসের বিস্তার ঘটে। একটি রুশ সাহিত্য বাসনাবাদ [রোমান্টিসিজম] আরেকটি জ্ঞানবাদী বাস্তবতা [দ্য রিয়েলিটি অব নলেজ]। রোমান্টিকতা নিয়ে দুটো কথা বলা দরকার। রোমান্টিকতা দুটো ভাবের ভর মাত্র। ব্যক্তির আবেগ আর কল্পনার মিলন। বাংলায় আমরা ‘রোমান্টিসিজম’ কথাকে বললাম ‘বাসনাবাদ’। কেন? ভাষাশাস্ত্র বলছে, বাসনা মানে বাস না করা। মানে যেখানে সে বস্তুগতভাবে বাস করে না, বাস করে ভাবগতভাবে। মানে কল্পনার আশ্রয়ে। তাই বললাম বাসনাবাদ। কথামালা আলেকজান্দ্র রাদিশশোভ, ইভান ক্রিলোভসহ অপরাপর সাহিত্যিকদের দুয়েকছত্র পাঠ করলে তার হদিশ মিলবে। কোনো কোনো রুশ সাহিত্য তাত্ত্বিক এটাকে বলছেন ‘সেন্টিমেন্টালিজম’ বা ‘জাগরণবাদী’ যুগ। কারণ সংবাদপত্রের সাথে প্রকাশিত হতে থাকে নানা সাহিত্য সাময়িকী। নানা বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তারও বিকাশ ঘটতে থাকে এসময়। ফলে আমরা একটু অন্যভাবে দেখব। তো দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের ভাষায় বললে বলতে হয় ‘এনলাইটেনমেন্ট’। বাংলায় আমরা ‘এনলাইটেনমেন্ট’ শব্দটিকে বললাম ‘প্রভাতফেরি’। মানে প্রভাতের আলোর দিশারি। তাতে একটা সুবিধে হয়—ভাষা আন্দোলনের সঙ্গেও বাংলার নবজাগরণ মিলিয়ে দেখতে পারি আমরা। এক অর্থে ভাষার জাতীয় জাগরণ বটে। এটা নিছক তাত্ত্বিক প্রস্তাবনা মাত্র! ভবিষ্যত যেহেতু সামনেই। তাই টুকলাম হালকা ইশারায়।

২.
রুশ সাহিত্য আধুনিক যুগে প্রবেশ করে ঊনবিংশ শতকেই। আধুনিক সাহিত্যের এই ধারা প্রধান দুটো ভাগ হয়ে যায়। একদল প্রকৃতিবাদী ধারা, আরেকদল বাসনাবাদকে ভেঙে বাস্তববাদের দিকে ধাবিত হন। প্রকৃতিবাদীদের মধ্যে ভিসসারিন বেলিনস্কি, ইভান তুর্গোনেভ, আলেসাই কলোৎসভ উল্লেখযোগ্য। এরা পশ্চিমাধাঁচের কলাকৈবল্যবাদের দিকে ধাবিত হন। তারা খানিকটা পশ্চিমা উদারনৈতিক গণতন্ত্রী ভাবাপন্ন লেখক। উল্লেখ করার মতো বিষয়—তুর্গোনেভের দুঃসাহসী রচনা ‘শিকারীর রোচনামচা’র কথা। ভূমিদাস প্রথাবিরোধী এই রচনা তৎকালীন সরকার বাজেয়াপ্ত করতে বাধ্য হন। মূলত নিত্যঘটনার অন্তঃসার শূন্য স্বপ্নবিলাস আর জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষার অবাস্তব বাসনাকে বিদ্রুপ করা হয়েছে প্রকৃতিবাদী সাহিত্যধারায়। দ্বিতীয় ধারাটির প্রধান প্রবক্তা আলেক্সান্দর পুশকিন, লিয়েভ লেরমেন্তভ, নিকোলাই গোগল। পুশকিনকে তো রুশ জাতীয়তাবাদের নায়কই বলা হয়। রুশ দেশের জাতীয় কবি তিনিই। পুশকিন কবিতায় প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘আমার নাম জেনে তোমার কাম কী’। ‘আমি’ এবং ‘নাম জানা’র ভেতর দিয়ে জাতিত্বের প্রশ্নটি সামনে এনেছিলেন পুশকিন। আর মিখাইল লেরমেন্তভের ‘আমাদের কালের নায়ক’ উপন্যাসে দেখা যায়, নায়ক পিচুরিন খোড়া বদখৎ প্রকারের। রিষ্ট-পুষ্ট নায়কের বিপরীতে তিনি রুশীয় সমাজের ভেতরকার অন্য এক দুস্থ নায়ককে হাজির করেছেন। উপন্যাসে তিনি নাদুস-নুদুস নায়কের ধারাকে পাল্টে দেন।

বলা হয়ে থাকে, নিকোলাই গোগলের ‘ওভারকোট’ গল্পের পকেট থেকেই আধুনিক কথাসাহিত্যের জন্ম। কথাটা কোথাও ইভান তুর্গেনেভ কিংবা কোথাও ফিয়োদর দস্তোয়ভস্কির নামে চালু। ‘ওভারকোট’ গল্পে দেখা যায়, নায়ক আকাকি আকাকিয়োভিচ একজন নিম্নপদস্থ সরকারি কেরানি। আকাকি নিঃসঙ্গ মানুষ। তদুপরি একজন দৈন্য, বিরস, হতাশ আর অভাবী মানুষ। একই সঙ্গে তিনি প্রতিবাদহীন ও ভঙ্গুর প্রকৃতির মানুষ। অভাবী আকাকির ওভারকোট কেনাটাই জীবনের একটা বড় ঘটনা। আর ওভারকোট হারানোর ভেতর দিয়েই সে মরে ভূত হয়ে যায়। ক্লিষ্ট এক মানুষের স্বপ্ন দিয়ে শুরু, আর শেষ হয় অস্তিত্ব বিলীনের ভেতর দিয়েই। আসলে আকাকি আধুনিক সমাজের এক রহস্য! এমন কোনো চরিত্র ছিল কি ছিল না সে নিয়েই বিস্তর তর্ক আছে। আকাকির ওভারকোট বস্তুত তৎকালীন অন্তঃসারশূন্য রুশ সমাজ ব্যবস্থার প্রতীক! গোগল সম্পর্কে বন্ধু-পুশকিন বলেছিলেন, ‘হাসাতে হাসাতে তিনি চোখে অশ্রু নিয়ে আসতেন।’

ঊনবিংশ শতাব্দীর দুজন রুশ কিংবদন্তী লেখক ও তাত্ত্বিক ফিয়োদর দস্তয়োভস্কি আর লিয়েভ তলস্তোয়। দুটো কথা বলা দরকার। গোর্কি সাহিত্যের ওপর আন্তন শেকভের যে প্রভাব, দস্তয়োভস্কি আর তলস্তয়ের প্রভাব অনেক কম। তিনজনেরই সাহিত্যের প্রধান উপজীব্য ভাগ্যাহত মানুষ। তবে তফাৎ ছিল কিছুটা। কারণ বাইবেলীয় নৈতিকতা থেকে গোর্কি খানিকটা সাহিত্যকে দূরে রেখেছেন। শেষ জীবনেও তলস্তোয় আর গোর্কির সম্পর্ক শিথিল ছিল। গোর্কি মিলিয়েছেন রূপকথা, লৌকিক সাহিত্যের সঙ্গে আধুনিক দুনিয়ার ভুখানাঙ্গা মানুষের জীবন। তবে সত্য এই—হাল-নাগাদ বাংলাভাষায় সবচে বহুল পঠিত আর আলোচিত রুশ লেখক দুজন। ফিয়োদর দস্তয়োভস্কি আর লিয়েভ তলস্তোয়। ফলে আমরা আলোচনায় ওদিকে গেলাম না। সাহিত্যমহলে দুজনের চেয়ে খানিক কম আলোচিত লেখক মাক্সিম গোর্কি। কেন? মিখাইল গর্ভাচেভের অর্থহীন অর্থনৈতিক সংস্কার গ্লাসনাস্তো আর পেরোস্ত্রোইকার ফল? নাকি গোলকায়নের যুগে বিশ্বপুঁজিবাদের উদারনৈতিক সংস্কৃতির যুগে গোর্কির সাহিত্য খাপ খাচ্ছে না আর? প্রশ্নগুলোর উত্তর জটিল নয়। ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছে। কার্ল মার্কসের তত্ত্ব বিচারে দেখা যাবে—এহেন অর্থনৈতিক সংস্কারকে বলা চলে ‘বুর্জোয়া সমাজের দ্বন্দ্বমূলক উন্নয়ন।’ দ্বন্দ্ব কোথায়? আরেকটু এগিয়ে বলি—উদারনৈতিকতার ভেতর দিয়ে পুঁজিবাদ পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়া ছাড়া অন্য উপায় আছে, বৈকি! একদম নাই। বস্তুত বৈষম্যমূলক ভোগের স্বাধীনতা মানুষের মুক্তি দিতে পারে না। উন্নয়ন আছে তো, মানবতা নাই। শাসক আছে তো গণতন্ত্র নাই। বণ্টন আছে তো সাম্য নাই। খোদ মিখাইল গর্বাচেভই দু দশকের মাথায় ভুলের জন্য নিজের চুল ছিঁড়ছেন! তিনি বলেছেন, ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন সবচে বড় ভুল।’ তাহলে আমরা কোথায় যাব?

৩.
বিংশ শতাব্দীর সাহিত্যের নায়ক মাক্সিম গোর্কি। জুলিয়ান পঞ্জিকা মতে ম্যাক্সিম গোর্কির জন্ম ১৮৬৮ সালের ১৬ মার্চ। অবশ্য গেগরিয়ান মতে সেটা ১২ দিন পর ২৮ মার্চ। ভলগার তীরবর্তী নিজনি নোভগরদ্ শহরের পিতার আদিবাসেই তার জন্মস্থান। আদি নাম তার আলেক্সেই মাক্সিমভিচ পেশকভ। বাংলায় যার অর্থ পেশকভ বংশের মাক্সিমের ছেলে আলেক্সেই। প্রশ্ন হলো—‘আলেক্সেই মাক্সিমভিচ পেশকভ’ কিভাবে ‘মাক্সিম গোর্কি’ হয়ে উঠলেন? ছদ্মনামের পেছনে এক টুকরো ইতিহাস আছে। সেটা কী? জর্জিয়ায় ১৮৮৯ সালে পুলিশি নজনদারিতে পড়েন মাক্সিম। তখন ‘আত্মবিকাশ’ নামে বামপন্থী গোপন দলে নাম লেখান তিনি। কাজ দুটোই—জ্ঞানদান আর দলীয় প্রচারকার্য সাধন। জর্জিয়ার রাজধানী তিতলিসে বামপন্থী শ্রমিকদের সঙ্গেও আত্মীয়তা হয় সে সময়। রাস্তায় কাজ করার সময় জেলখাটা কয়েদি আলেক্সান্দর কালিজনির সঙ্গে পরিচয় তার। সেই কয়েদি গোর্কির মানবেতর জীবন, দুঃখ-দুদর্শার কথা শুনে বললেন, কাহিনীগুলো লিখতে। শ্রমিক সমর্থিত ‘ককেশাস্’ পত্রিকায় তার প্রথম গল্প ছাপা হয় ‘মাকার চুদ্রা’। তাতেই নিজের আদিনাম নাম পাল্টিয়ে রাখলেন মাক্সিম গোর্কি। বাংলা ‘গোর্কি’ শব্দের অর্থ ‘তেতো’ বা ‘তিক্ত’। মানে তিক্ততায় ভরা জীবন। তবে পরিণত ‘মাক্সিম গোর্কি’ আর ছন্নছাড়া ‘আলেক্সেই মাক্সিমভিচ পেশকভ’ এক জিনিস নয়। অভাব, অন্নহীন, বখে যাওয়া কিশোর আর উচ্ছন্ন পরিবারিক জীবনের কষ্টিপাথর ঘষে নাম নিয়েছিলেন মাক্সিম গোর্কি। সেটা কিভাবে?

গোর্কির দরিদ্র পিতা মাক্সিম সাভভাতেভিচ্ পেশকভই ছিলেন ভোলগা স্টিমশিপ কোম্পানির ছুতোরমিস্ত্রি। মা ভার্ভারা ভাসিলিয়েভ্না পেশকভা মালিক ভাসিলি কাশিরিনের কন্যা। বিয়ের পর গোর্কির পিতার পেশাগত পদোন্নতি হয়। কিন্তু ১৮৭১ সালে জুলাই মাসে পুত্র জন্মের তিন কি চার বছরের মাথায় ওলাওঠা রোগে পিতা পেশকভ গত হন। গোর্কির দুরাবস্থার শুরু সেখান থেকেই। মা সন্তানকে নিয়ে ওঠেন বাপের বাড়িতে। অবক্ষয়ী রাশিয়ায় তখন যৌথ পারিবারিক প্রথা ভেঙে পড়েছে। ফলে পারিবারিক সম্পত্তি নিয়েও তিক্ত হয়ে ওঠে সবার জীবন। নানার বিত্তবান পরিবারটিও অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়ে। নানা ভাসিলি কাশিরিন গোর্কিকে একদম দেখতে পারতেন না। শুধু শুধু পেটাতেন! কিন্তু তার নানী আকুলিনা কাশিরিনা ছিলেন খুব দরদী। হস্তশিল্পের কারিগর হিসেবে খুব নামডাক তার। নাতিকে ছড়া, লোক কাহিনী আর রূপকথার গল্প শোনাতেন। মূলত গোর্কির সাহিত্যের ভ্রুণ জন্মায় নানীর হাতেই। মায়ের নৈতরঙ্গ জীবন আর সন্তানের প্রতি উদাসীনতা গোর্কির ছেলেবেলা তিক্ততায় পর্যবসিত হয়। মা চলে যান নিজের চেয়ে ১০ বছরের ছোট এক পরপুরুষের কাছে। সেটাও সুখ আনেনি তার। তিনি মারা যান ১৮৭৯ সালে।

গোর্কি প্রাথমিক বিদ্যাপীঠে কদিন গিয়েছিলেন, সেটা না যাওয়ার মতোই। বাড়িতে পড়াশোনার পরিবেশ না থাকায় তিনি হয়ে ওঠেন ডানপিটে ভবঘুরে এক কিশোর। খেতে দিত না নানামশাই। ফলে বোহেমিয়ান জীবন ছাড়া তার অন্য উপায় ছিল না। গোর্কি নানার বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়েছিলেন নানীর হার-মাদুলি চুরির দায়েই। নানার সাফ সাফ কথা—‘তুই আমার বাড়ি থেকে হার-মাদুলি চুরি করিস, তোর পথ তুই দেখ।’ অন্নাভাব তাকে পথে নামিয়েছিল। প্রথমদিকে নানালোকের ফায়-ফরমাস খেটে পেট চালাতেন। পরে কাজ নেন খাবার হোটেলে। কত বিচিত্র পেশা তার—মুচির দোকান, রেলস্টেশনের দাড়োয়ান, শিক্ষানবিশি ড্রাফটম্যান, রাস্তার দিনমজুরি, মাছের আড়ত থেকে বাগানের মালির কাজ পর্যন্ত করতে হয়েছে তাকে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনের কোনো কোনো ঘটনা একই রকমের। তৎকালীন এক রাজনীতিকের বাসার পিস্তল চুরির দায়ে পুলিশি তদন্তের শিকার হয়েছিলেন নজরুল। সঙ্গে কমরেড মুজফ্ফর আহমদ থাকায় সে কিস্তিতে রেহায় পান তিনি। যদিও চুরির ব্যাপার ছিল একদম ভুয়া! গোর্কির বেলায় সেটা উল্টো! চুরির দায়ে বঞ্চনা আর সাজা ভোগ করেছেন। গোর্কির জীবনী পড়লে মনে হতে পারে—বোহেমিয়ান চালচুলোহীন এক মহানায়ক কিভাবে বিক্ষুব্ধ সময় পার করছেন। যিনি জীবনপাথরে বীজ ফেলে অমূল্য শস্য ফলিয়েছেন। বীজ রোপণ করেছেন ভবিষ্যতের।

মাক্সিম গোর্কি নব্বইয়ে দশকে চষে বেড়ান পুরো রাশিয়া। ১৮৮৪ সালে কাজান শহরে যান ১৬ বছর বয়সে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে গিয়ে ব্যর্থ হন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাবে। স্বপ্ন চুরমার হওয়া তরুণ দুঃখ-কষ্ট, গ্লানি-হতাশা আর মর্মযাতনায় দুবার আত্মহত্যা করতে গিয়েও ব্যর্থ হন। আরো নিষ্ঠুর ব্যাপার—‘আত্মহত্যা পাপ’ এমন দায়ে তাকে একবার শাস্তিস্বরূপ পাঠানো হয়েছিল গির্জার ফাদারের কাছে। পাপ মোচনের ভেতর দিয়ে যদি তার কিছু ইহলৌকিক নৈতিক শিক্ষা হয়। সেখানে এক কাণ্ড করে বসলেন তিনি। গির্জার ফাদারকে প্রশ্ন করে বসলেন—‘তোমরা বলছো এখানে ঈশ্বর আছে, কই তাকে তো দেখলাম না এখানে।’ অদ্ভুত আচরণের জন্য তাকে সেখান থেকেও বহিষ্কার করা হয়। এটা তার ঊনিশ বছর বয়সের ঘটনা।

গোর্কির জীবন নজরুলের জীবন নয়, দুজনের অন্তর্সলিলা রূপ একই নদীর মতো বয়ে গেছে। দুজনই জানতেন সাহিত্য আর লড়াইয়ের জন্য বেপোরোয়া জীবনে কোথায় ছুটতে হয়, কোথায় থামতে হয় আর কোথায় দাঁড়াতে হয়। বিক্ষুব্ধ জীবন আর হাড়-খাটুনির কৈশোরে দুজনেই কাজের ফাঁকে ফাঁকে মজে ছিলেন বইয়ে বইয়ে। কপালে স্কুল না জুটলেও বই হয় চিরসঙ্গী। নজরুলের মতো প্রথম জীবনে তার ব্যর্থতার শেষ নাই। তবে চরিত্রগত দুজনেরই অদ্ভুত অনেক মিল—পেশাগত জীবন, অপ্রাতিষ্ঠানিক স্বশিক্ষিত, জেলখাটা, শাসকের কোপানলে পরা, বই নিষিদ্ধ হওয়া, সম্পাদিত পত্রিকা নিষিদ্ধ হওয়া, বৈবাহিক জীবন থেকে রাজনৈতিক মতাদর্শগতভাবে প্রায় একই অর্গলের ভিন্ন ভিন্ন রূপ! ফলে আমরা বলতে পারি—গোর্কিও নজরুলের মতো আমাদের পরম বন্ধু। আমাদের সাহিত্যেরও অংশ। কেননা রুশ ভাষা ভেদ করে গোর্কির সাহিত্য আর চিন্তার বাংলা তর্জমা আমাদের সাহিত্যে নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে।

৪.
অভিজ্ঞতার পোড়খাওয়া অস্থির এক পান্থজনের আঁকাবাঁকা পদ দেখলাম এতক্ষণ। এই পদ ধূসর নয়, রক্তাক্ত টগবগে এক মানুষের। যিনি দেখিয়েছেন আস্তাকুঁড়ে থেকে বন্ধুর পথ মাড়িয়ে কিভাবে সৃষ্টিশীলতার অমোঘ সূর্যকে ছুঁতে হয়। আর শুধু নিজেকে জাগিয়ে নয়, অন্যের মানসালোক কিভাবে জাগাতে হয়—সেই কাণ্ডটিও। কল্পনা করুন—নবযুগের গোর্কির ‘বুড়ি ইজেরগিল’ রূপকথার কাহিনী। যেখানে দাংকো নিজের হৃদপিণ্ড তুলে আনছেন। আর তার স্ফটিকালোয় পথ দেখাচ্ছেন সর্বসাধারণকে। খুবই সুন্দর হৃৎপিণ্ডের আলো, খুবই প্রতীকী আলো। যেন বাতলে দিচ্ছেন অভীষ্ট ভবিষ্যতের পথ। তাহলে প্রশ্ন জাগে—মাক্সিম গোর্কির সাহিত্য কি পদার্থ? রুশতাত্ত্বিকদের মধ্যে দুধরনের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। একদল মনে করেন, সাহিত্যে রুশ বাস্তববাদের জনক মাক্সিম গোর্কি। আরেকদল মনে করেন তিনি ‘রিয়েলিটি অব সোশালিজম’ বা ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা’র লেখক তিনি। তর্কটা মূলত সাধারণ বুদ্ধিজীবী আর আমলাতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবীদের। এ কথা মানতেই হবে, কানা গলিতে না ঢুকেই তৎকালীন সমাজ-রাষ্ট্র ব্যবস্থার বাস্তবতারই কথাচিত্র এঁকেছেন তিনি। আর যুক্ত করেছিলেন মতাদর্শিক লড়াইয়ের তাত্ত্বিক ভিত। তবে কুটতর্কে জড়াব না আমরা। বলব—শ্রেণী সচেতন বাস্তববাদের ইহজাগতিক গুণবিচারী একজন সফল কথা সাহিত্যিক তিনি।


বার্তা২৪.কম-এর শিল্প-সাহিত্য বিভাগে লেখা পাঠানোর ঠিকানা
[email protected]


বালকবেলায় গোর্কিকে কবি বলে জানতাম। কোথাও জানি পড়েছিলাম ১৮৯৫ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম কবিতার বই ‘পেস্নিয়া অ সোকলে’ বা ‘বাজপাখির গান’। আর প্রথম জীবনে আমি পড়ি ‘পেসনিয়া অ বুলেভিয়েস্তানিকে’ বা ‘ঝ’ড়ো পাখির গান’। যা মনে এখনো গেঁথে আছে। সুভাষ মুখোপাধ্যায় অনুবাদ করেছিলেন সেই বিখ্যাত কবিতা। পরে জেনেছি—১৯০১ সালে রচিত এই কবিতা তাকে অন্য উপাধি দিয়েছিল। কবিতাটি প্রকাশের পর সেন্সর বিভাগের মুখোমুখি হন তিনি। সেন্সর বিভাগের কর্মচারিরা তার নাম দেন ‘ঝ’ড়ো পাখি’। সেই বছরই জারবিরোধী বিপ্লবী কর্মকাণ্ড আর শ্রমিক সংশ্রবের জন্য গ্রেফতার হন তিনি। এমনকি জেলখানার কয়েদি হিসেবেও তাকে ডাকা হতো ‘ঝ’ড়ো পাখি’ নামে। আলেক্সান্দর পুশকিনের কবিতা যেমন গীতিময় আর ছন্দোবদ্ধ, গোর্কির কবিতা সেরকম নয়। তার গদ্যাবদ্ধ কবিতাকে কেউ কেউ গল্প বলে ঠাউরিয়েছেন! শেষ বয়সে আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও মুক্তছন্দে এমন গদ্য কবিতা লিখেছেন। গোর্কির কবিতাটি কেন এত জনপ্রিয় হয়েছিল? উত্তর একটাই—দুষ্টশাসক জারতন্ত্র যে ক্রমে ক্রমে তলিয়ে যাচ্ছিল তার আলোকচ্ছটা কবিতার ভাবে স্পষ্ট করে তুলেছিল। কবিতায় প্রতীক ‘পাখি’ রুশদেশের ভবিষ্যত বিপ্লবেরই ইঙ্গিত বহন করছিল। ঝড়-ঝঞ্ঝা, বজ্র-বিদ্যুৎ মাড়িয়েই ভয়শূন্য পাখিটি বয়ে আনছে আনন্দের বার্তা। সেই অর্থে তিনি একজন ভবিষ্যতদ্রষ্টাও বটেন। সেটা কেমন—

এখুনি ঝড় উঠবে। ঝড় উঠতে দেরি নেই।
তবু সেই দুঃসাহসী ঝ’ড়ো পাখি বিদ্যুতের ভিড়ে,
গর্জমান উত্তাল
সমুদ্রের ওপর দিয়ে দীপ্ত পাখসাটে উড়ে চলে।
তার চিৎকারে
পুলকিত প্রতিধ্বনি ওঠে,
চূড়ান্ত জয়ের ভবিষ্যবাণীর মতো
সমস্ত ভীষণতা নিয়ে ভেঙে পড়ুক,
ঝড় ভেঙে পড়ুক।

[ঝ’ড়ো পাখির গান/ ১৯০১]

৫.
মাক্সিম গোর্কিকে ‘চেল্কাশ্’ গল্পটি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। গল্পের নায়ক ‘চেল্কাশ্’ একজন চোরা কারবারি। সে অর্থের দাস নয়, মুক্ত মনের মানুষ। বস্তুত পুঁজিবাদী এই উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও এমন সূত্রের ওপর টিকে আছে। কেন? গোর্কি দেখিয়েছেন, চেল্কাশ্ সমাজ ব্যবস্থার শিকার। চোরাকারবারি করা ছাড়া তার অন্যকিছু করে টিকে থাকার মওকা ছিল না। সমাজ তাকে অন্ধকার পথে যেতে বাধ্য করেছে। মানে তার ইচ্ছার স্বাধীনতা হরণ করেছে। কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দোপাধ্যয়ের অনুরূপ বিখ্যাত গল্প আছে, নাম ‘কালোবাজারে প্রেমের দর’। অর্থাভাব নিয়ে নায়কের সঙ্গে নায়িকার সংসার কলহ লেগে থাকত প্রতিনিয়ত। বান্ধবীর সংসারের চাকচিক্যের জীবন দেখিয়ে নায়কের জীবন অতীষ্ট করত নায়িকা-স্ত্রী। নায়ক একদিন আবিষ্কার করেন তার বৌয়ের বান্ধবী-স্বামীর চাকচিক্য। সে পাতি-বুর্জোয়া বান্ধবী স্বামীর অর্থবিত্ত আর বৈভব জীবনের প্রধান কারণ চোরাকারবারি। এক সময় সে বুর্জোয়া শ্রেণিতে উন্নীতও হয়।

‘অন্ধকার মানুষ’কে নিয়ে ১৮৯৫ সালে ‘চেল্কাশ্’ গল্প প্রকাশিত হলে সংবাদপত্রে কাজের প্রস্তাব পান গোর্কি। এখানেই নতুন জীবনের শুরু তার। সে সময় ‘সামারাস্কায়া গাজিয়েতা’ পত্রিকায় তার সহকর্মী ছিলেন একাতেরিনা ভোজলিনা। মেধাবী আর ধনীর মেয়ে একাতারিনা। বছর পেরুনো প্রেমের পর ১৮৯৬ সালে পরিণয়ে আবদ্ধ হন। তাদের সংসার টিকে ছিল মাত্র ৮ বছর। যদিও তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়নি কখনো। বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই গোর্কি প্রেমে পড়েন বিদুষী ভাষাতাত্ত্বিক ও অভিনেত্রী মারিয়া আন্দ্রেইয়েভার। ‘না দইনয়ে’ বা ‘নিচের মহল’ নাটকের রিহের্সাল থেকে। মারিয়া মস্কো আর্ট থিয়েটারের কর্মকর্তা ছিলেন। এই সম্পর্ক টিকে ছিল ১৭ বছর। ১৯২০ সালে তাদের বিচ্ছেদ হয়। গোর্কির নাটুকে জীবন এসময়ে দুটো ঘটনা ঘটে। একটি—বলশেভিক পার্টিতে যোগ দান। অবশ্য গোর্কি পার্টিতে যোগ দেন ১৯০৫ সালে। আর অন্যটি—নাটক মঞ্চস্থ করতে শিকার হন পুলিশি হয়রানির। বলশেভিক পার্টির সভ্য মারিয়া সেসময় অনেক সহযোগিতা করেন তাকে।

আন্তন চেখভের শিষ্য গোর্কির তিনটি নাটক খুবই বিখ্যাত। পাতি-বুর্জোয়া, নিচের মহল আর ফোমা গার্দায়েভ। প্রথম নাটক ‘পাতি-বুর্জোয়া’য় দেখা যায়—পাতি বুর্জোয়া সমাজের সাথে নিচুতলার মানুষের দ্বন্দ্ব। দেখা মেলে কিভাবে একটি সমাজে নিচুতলার মানুষ আরো কত নিচে নামে। আর সুবিধাবাদকে কাজে লাগিয়ে পাতি-বুর্জোয়া সমাজ কতটা উচ্চে উঠতে চায়। সমাজে ভেদাভেদের সংস্কৃতি কিভাবে রূপান্তর ঘটে তার নৈবেদ্য রূপও আছে এতে। নাটকে বিধবা ইলিয়েনার উক্তিটি স্বর্তব্য—‘থিয়েটারে গুরুগম্ভীর দৃশ্যের পরে সব সময়েই হালকা কিছু দেখায়... আসল জীবনে সেটা আরো বেশি দরকার...’। জীবন নিয়ে কেমন বিদ্রুপে ঠাসা এক উক্তি! এটি প্রথম যখন মঞ্চস্থ হয় সমাজের উপরতলার মানুষ দর্শকের সারিতে ভিড় করে। স্তানিস্লাভস্কি ও দেনচাংকোর মতো তাত্ত্বিকেরা এতে অভিনয় করেন। ‘নিচের মহল’ নাটকের কাহিনী ছিল ভাড়াটে বস্তিবাড়ির মানুষের সমাবেশ। বস্তির মানুষের দারিদ্র্যের কষাঘাত, মৃত্যু, গালিগালাজ, মাতলামি, বিশ্বাসঘাতকতা আর কলহভরা জীবনই যেন বেঁচে থাকার সারকথা! জীবন এখানে তুচ্ছ, মূল্যহীন! নাটকে নিষ্পেষিত আর আশাভঙ্গের নিরাভরণ মানুষকে সচেতন করাই ছিল গোর্কিও উদ্দেশ্য। গোর্কি নাটক দিয়ে শুধু সমাজের বাস্তব দশাকে দেখাতে চাননি, চেয়েছেন সমাজ অধ্যুষিত নিরন্ন-হাভাতে, বঞ্চিত-লাঞ্ছিত মানুষের অধিকার বোধ জাগিয়ে তুলতে। বিপ্লবপূর্ব রাশিয়ায় গোর্কিরা নিরঙ্কুশভাবে সফল হয়েছিলেন।

‘সংস্কৃতি ও স্বাধীনতা’ প্রবন্ধে মাক্সিম গোর্কি বলেছেন, ‘সর্বহারা সংঘবদ্ধভাবে কেবল একটা প্রত্যক্ষ কায়িক শক্তি, তার চেয়ে বেশি কিছু নয়, চাষীদের ক্ষেত্রে সেই একই ব্যাপার।’ মজার ব্যাপার হলো—গোর্কির ‘সর্বহারা’ হচ্ছেন অধিকার বঞ্চিত ‘সাধারণ জনগণ’। তিনি মানস শক্তিকেও এড়িয়ে যাননি। তিনি শ্রমশিবির বিচ্যুত বুদ্ধিজীবীদের কথাও বলেছেন। বস্তুত সাধারণ্যের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন এই বুদ্ধিজীবী সমাজ। ফলে সমাজের অধঃপতন টের পেতেন তিনি। তিনি বলছেন, ‘সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের গুরুতর সমস্যা হলো বুদ্ধিজীবীদের প্রাণ প্রাচুর্যের ক্ষয়। সেই ক্ষয়ের কারণ ক্ষুধা ও মোহভঙ্গ, এক ধরনের ঔদাসীন্য যা বুদ্ধিজীবীদের দমিয়ে দিতে থাকে।’ এই ক্ষয় বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায়ও ছিল। ফলে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের সাথে তার সম্পর্কের ওঠানামা ছিল। সে সময় অনেকে গোর্কির এই বক্তব্যকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। বলশেভিক গোর্কিকে বানানো হয়েছিল মেনশেভিক পার্টির চিন্তক। চিন্তার মৃদু পার্থক্যের কারণে লেনিন তাকে দূরে ঠেলে দেননি। এমনকি—বক্তব্যটি দিয়েছিলেন লেনিন শাসিত শিক্ষা অধিদপ্তরের অনুষ্ঠানে।

বুদ্ধিজীবীদের প্রশ্নে আমাদেরও নতুন করে ভাববার সময় এসেছে। আমরা অতীত থেকে শিখব। গোর্কি অধিক রাজনৈতিক সংগ্রামকে টিকিয়ে রাখবার প্রশ্নে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’কে। প্রশ্ন হচ্ছে—সাংস্কৃতিক বিপ্লব কী? গোর্কি বলছেন, ‘সব রকম শক্তিকে সুসংহত করে, তাদের সঙ্গে শ্রমিক ও কৃষক বুদ্ধিজীবীদের নবীন শক্তির সংযোগ সাধন করে সংস্কৃতি-কর্মীদের মন দিতে হবে নিজেদের কাজ গোছানোর দিকে।’ একবিংশ শতাব্দীর নব্বই দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙনের পর সবচে আলোচিত বই বামপন্থী বুদ্ধিজীবী ও দার্শনিক আলাঁ বাদিয়ুর ‘দি কমিউনিস্ট হাইপেথিসিস’ বা ‘কমিউনিস্ট রূপকল্প’। ফরাসি দার্শনিক বাদিয়ু দেখিয়েছেন, ‘কেন সাংস্কৃতিক বিপ্লব, বিপ্লবের আদি-অন্ত উৎস’। বাদিয়ু বলছেন, সংস্কৃতির রূপান্তর মানুষকে বদলে দেয়। সবচে বড় বদল ঘটায় মানুষের অভিজ্ঞতাকে। আর সাংস্কৃতিক রূপান্তর একই সঙ্গে মানুষের পূর্বতন অবস্থার ঐতিহাসিক বদল ঘটায়। ফলে অতীত ইতিহাস থেকে বাস্তব রাজনৈতিক প্রশ্নের উত্থান ঘটাতে পারে। সেই প্রশ্নের সুরাহা হয় রূপান্তরের ভেতর দিয়েই। বাদিয়ু আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন—‘ক্ষমতার জন্য লড়াই’ আর ‘ক্ষমতাসীনদের লড়াই’ এক জিনিস নয়। সাংস্কৃতিক মুক্তির প্রশ্নে অবশ্যই ‘ক্ষমতাসীনদের লড়াই’কে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে নাকচ করতে হবে। বুর্জোয়া সমাজ কাঠামোর প্রশ্নে—এটাই আমাদের সাংস্কৃতিক লড়াই।

৬.
বাংলাভাষায় অনূদিত গোর্কির সবচে আলোচিত ও পঠিত বই ‘মা’। বইটি তিনি রাশিয়ায় বসে লিখেননি। লিখেছেন মার্কিন প্রদেশে। প্রথম ছাপা হয়েছিল ইংরেজি অনুবাদে। প্রকাশিত হয় ১৯০৬ সালে। তারপর জার্মান ও রুশ ভাষায়। বলে রাখা ভালো, জার্মান ভাষায় প্রকাশের আগে লেনিন মা পাণ্ডুলিপি পড়েছিলেন। মা সম্পর্কে রুশ বিপ্লবের নায়ক ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের মত—‘বহু মজলুম বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন অচেতন-স্বতঃস্ফূর্তভাবে, এবার মা পড়ে তাদের মহা-উপকার হবে। এটি কালোপযোগী বই।’ বেশিরভাগ পশ্চিমা তাত্ত্বিক মার্কসবাদী ভাবাদর্শে লেখা মা উপন্যাসকে ‘মেকানিক্যালটাইপ’ বা ‘যান্ত্রিককলা’ বলে তুচ্ছজ্ঞান করেন! কিন্তু বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে সেটি ঘটেনি। পশ্চিমা বামপন্থী তাত্ত্বিক গেওর্গে লুকাচও বলেছেন, ‘প্রথম বিপ্লবের সমকালে সাংবাদিকের কার্যাবলী থেকে উঠে আসে মা।’ দেখা যাচ্ছে—উপন্যাসের ভাষার প্রতিবেদনধর্মীতা নিয়ে লুকাচের অভিযোগ। অভিযোগ কিঞ্চিত বেঠিক মনে হয়। কারণ গোর্কি তার সমকালীন ঘটনার প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে চেয়েছেন। এমনকি—সমকালীন ঘটনা থেকে বিচ্যুত হতে চাননি। কারণ তিনি মুক্তি রূপক আকারে দেখেননি। দেখেছেন বাস্তবতার অলিখিত দলিলরূপে। শ্রেণী এখানে মুখ্য হলেও মায়ের সঙ্গে পাভেল করচাগিনের যে সম্পর্ক সেটা শুধু রক্তের নয়, সাংস্কৃতিক লড়াইয়েরও গতিমুখ বৈকি। কেন?

১৯০৫ সালের ঘটনা। জাপানিদের কাছে পরাজয়ের পর রাশিয়ায় ঘটে এক রক্তাক্ত ঐতিহাসিক ঘটনা। যাকে রুশের ‘প্রথম বিপ্লব’ বলা হয়। ঘটনার শুরু ‘রক্তাক্ত রোববার’ দিয়েই। ভোটাধিকারের দাবিতে লাখ লাখ শ্রমিক-কৃষক-জনগণ যাচ্ছিল নিকোলাই জারের সাম্রাজ্যের কেন্দ্র পিতেসবার্গের দিকে। কোনো কারণ ছাড়াই গুলি করে শত শত শ্রমিককে হত্যা করেছিল জারবাহিনী। ঐতিহাসিক আরেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এই—বলশেভিক পার্টির উন্মেষও রক্তাক্ত রোববারের মধ্যদিয়ে। রক্তাক্ত সেই ঘটনায় নানা বিবৃতি আর লেখা প্রচার করলেন গোর্কি। গরাদে ঢোকানো হলো তাকে। পরে মুক্তি পেয়ে দেশ ছাড়তে হলো তাকে। ১৯০৬ সালে তিনি মার্কিন দেশে পালিয়ে যান। দীর্ঘ শ্রমিক জীবনের অভিজ্ঞতা আর বাস্তবের রক্তাক্ত লড়াইকে ‘মা’ উপন্যাসে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছিলেন গোর্কি। নন্দনতাত্ত্বিক শিল্পগুণ নিয়ে তর্ক হতে পারে। পৃথিবীর ইতিহাসে অসংখ্য উপন্যাস লেখা হয়েছে মা নিয়ে। কিন্তু অনেক মায়ের মধ্যে সার্বজনীন সর্বহারার মা হচ্ছেন মাক্সিম গোর্কির ‘মা’। শুধু তাই নয়—এপিক থিয়েটার তত্ত্বের কিংবদন্তী নাট্যকার বার্টল্ড ব্রেখট মা উপন্যাসের নাট্যরূপ মঞ্চস্থ করেছিলেন ১৯৩২ সালে। কোনো কোনো তাত্ত্বিক বলেছেন, অ্যাবসার্ট থিয়েটার তত্ত্বের ভ্রুণও ওতে আছে। ফারাক শুধু জার্মান আর ফ্রান্স! একটা কথা টুকে রাখি—মা উপন্যাসের পর গোর্কি ‘সন্তান’ নামে আরেকটি উপন্যাস লেখার কথা ছিল, সেটা পেরে ওঠেননি আর।

সাহিত্যিক হিসেবে গোর্কি ছিলেন সমন্বয়বাদী ধারার। সমন্বয় শব্দটি আমরা শাব্দিক অর্থে ব্যবহার করিনি। তাত্ত্বিকভাবে বললাম, অব্যয়ের অধিক অন্বয়। মানে চিন্তার সমবায়ী সাংস্কৃতিক রূপান্তর। বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কৃতিকে মুক্ত পাটাতনে নিয়ে আসা। তাই বন্ধু লেনিনের সহায়তায় প্রকাশ করেন পত্রিকা ‘লোপোতিস’ বা ‘বর্ষপঞ্জি’। ১৯১৫ সালে প্রকাশিত পত্রিকা টিকেছিল দুবছর। বলে নেওয়া ভালো—বলশেভিক আর মেনশেভিক ভাবাপন্ন মতাদর্শের লেখা ছাপা হতো পত্রিকায়। তাতে মনোদ্বৈরথও সৃষ্টি হয় হালকা। শেষ নাগাদ শারীরিক অসুস্থার কারণে লেনিন তাকে চিকিৎসার জন্য জার্মানিও পাঠিয়েছিলেন। বলে নেওয়া ভালো—অনেক সাহিত্যিক, কবি আর বুদ্ধিজীবী ছিলেন হয়তো, কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে গোর্কির মতো প্রভাবশালী লেখক রুশ দেশে জন্মায়নি আর! সাহিত্যিক প্রভাব এতটাই যে—পরলোক গোর্কির মরদেহ কাঁধে বহন করেছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রনায়ক জোসেফ স্তালিন। হালনাগাদ ইতিহাসে আমাদের এখনো জানা নাই, কোনো দেশের রাষ্ট্রপ্রধান তার দেশের একজন শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকের কফিন বহন করেছেন এভাবে। শেষ প্রণতির সময় সেই শ্রেষ্ঠ সম্মানটুকুও অর্জন করেছিলেন মাক্সিম গোর্কি।

মানতেই হবে—মাক্সিম গোর্কি আধুনিক একজন কথাশিল্পী। খেটে-খাওয়া মানুষের চিন্তার রূপকার। কিন্তু প্রশ্ন জাগে—আধুনিক সাহিত্য কী পদার্থ? আধুনিকতার মৌলিক কোনো সংজ্ঞা নেই। কিছু সাহিত্যিক প্রবণতা দিয়েই সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়। রাষ্ট্রের দিক থেকে—রাষ্ট্রীয় পুঁজির উলম্ব বিকাশ, আইন কাঠামোর বিকাশ, কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে যন্ত্রশিল্পের বিপ্লব, অর্থনৈতিক অবকাঠামোগত উন্নয়নের সঙ্গে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের উন্মেষ, গির্জা থেকে জ্ঞানকাণ্ডকে মানবিক বাস্তবকাণ্ডে নিয়ে আসা, লৌকিক বস্তুগত জীবন, বিজ্ঞান আর তথ্য প্রযুক্তির নতুন তরঙ্গ সৃষ্টি, ব্যক্তি-মানসের ইন্দ্রিয়ানুভূতিকেই জাগানো বা প্রতীকী করাসহ ইতিআদি। কিন্তু সংকট কিংবা প্রশ্ন অন্যখানে। আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় ব্যক্তির চরম বিকাশ ব্যক্তিকে কোথায় নিয়ে যায়? দর্শন বলছে, একচেটিয়া পুঁজি আধুনিক সমাজ ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক। একক ব্যক্তির বিকাশ থেকেই ভোগবাদের শুরু। ভোগ নিছক বস্তু হজম নয়, আরামদায়কও বটে! কিন্তু একক ভোগ ব্যক্তিকে সমাজের অপরাপর সামষ্টিক চেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। আর ব্যক্তি উৎপাদনের ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। একক ব্যক্তি আর্দশের মৃত্যু হতে পারে। কিন্তু সামষ্টিক আদর্শের কখনো মৃত্যু হয় না। যেমন আমরা মাক্সিম গোর্কির অকালবোধন করলাম। ঘুমন্ত গোর্কিকে মৃদু স্বরে জাগিয়ে তুললাম। আমরা গোর্কির স্বপ্নাদর্শের সঙ্গে অনুশীলন যোগ করলাম। সেই স্বর বাংলায় একদিন তরঙ্গ পাবে। সেটা নিশ্চিত।


তত্ত্ব ও তথ্য তালাশ
১. রুশ সাহিত্যের ইতিহাস: অরুণ সোম, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, ভারত
২. শ্রেষ্ঠ মাক্সিম গোর্কি: সংকলন ও সম্পাদনা—হায়াৎ মামুদ, অবসর প্রকাশনী, ঢাকা
৩. রচনাসপ্তক: নিকোলাই গোগল, সম্পাদনা অরুণ সোম, রাদুগা প্রকাশন, মস্কো
৪. মা: মাক্সিম গোর্কি, ভাষান্তর : পুষ্পময়ী বসু, সম্পাদনা হায়াৎ মামুদ, অবসর প্রকাশনী, ঢাকা
৫. কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা: মুজফফর আহমদ, মুক্তধারা সংস্করণ [পুর্নমুদ্রণ], ঢাকা
৬. On literature: Maxim Gorky, Foreign Languages publishing house, Moscow
৭. A history of Russian literature [ From beginning to 1900] : D. S. Mirsky, edited by Fransic J. Whitfield, Northwestern university press, USA
৮. Romantic Literature [From 1790 to 1830]: edited by Geoff Word, Bloomsbury, London
৯. Philosophy of Dictionary: Voltaire, edited & translated by Theodore Besterman, Penguin classics, England.
১০. A contribution to the critique of Political economy: Karl Marx, edited by Maurice Dobb, Progress Publisher, Moscow
১১. The Communist Hypothesis: Alain Badiou, translated by David Macey and Steve Corcoran, Verso, London

অসুস্থ ‘তিলোত্তমা’র কাছে কী সেবা চান আপনি!



প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত, প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম

ছবি: সংগৃহীত, প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

জুলাই ১৩, ২০২৪ সালের ভোর পাঁচটায় শুরু হয়েছিল এক তুমুল বৃষ্টি। রাজধানী ঢাকার বেশিরভাগ মানুষ তখনও গভীর ঘুমে।

এ সময়টা ঘোর বর্ষাকাল। সে কারণে ভারী বৃষ্টিপাত হতেই পারে। তাই, অ্যালার্ম শুনেও আরেকটু ঘুমিয়ে নিই বলে যারা কিছুটা দেরিতে উঠে অফিসে যাবেন বলে আটটার দিকে পথে নেমেছেন, তাদের চক্ষু সেদিন চড়কগাছ‍!

সকাল ৯টা পর্যন্ত বৃষ্টি থামেনি। একটানা চার ঘণ্টার মুষলধারার পতনে ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার ২৬ থেকে ৩০টি বড় রাস্তা একসঙ্গে ডুবে গেছে।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, এই ‘ডোবা’ সেই ডোবা নয়! রাস্তায় ১-২ ঘণ্টা জ্যামে দাঁড়িয়ে থাকার পর অনেক গাড়ির ইঞ্জিনে পানি ঢুকে পড়ায় অচল হয়ে যানজট অসহনীয় করে তুলেছিল সেদিন। সংবাদে টেলিভিশনের ভিডিওচিত্র দেখেও তাই-ই মনে হচ্ছিল।

সে এক অতি ভয়ঙ্কর অবস্থা সারাদিন জুড়ে। যেখানে চোখ যায়, সেখানেই মনে হয়, প্লাবন বয়ে যাচ্ছে। নটরডেম কলেজের পাশের রাস্তায় পার্কিং করা কারের শুধু ছাদটা দেখা যাচ্ছে। মালিক গাড়িতে উঠতে গিয়ে হতবাক হয়ে পড়েছেন।

নিউমার্কেটের প্রধান গলিতে বুকসমান পানি। দোকানকার মালিকেরা যারা বাসা থেকে ডুবন্ত নিউমার্কেটের ছবি দেখে দৌড়ে এস মাল সরানোর চেষ্টা করেছিলেন, তারা অনেকে এসে দেখেন দোকানের তালা ঘোলা-ময়লা পানিতে ডুবে অচেনা হয়ে গেছে। মালপত্র ভিজে গছে। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে পর্যন্ত সেই মালামাল সরাতে পারেননি।

কোথায় নেবেন! বেরুনোর সব রাস্তায় থৈ থৈ পানি! ভ্যান, যানবাহন কিছুই ঢোকানো যাবে না! এখানে জলের যানবাহন নেই। কলের গাড়ি জমানো বৃষ্টির বুকসমান জলে চলার পথ খুঁজে পায়নি কোথাও।

গ্রীন রোডে অনেকগুলো প্রাইভেট হাসপাতাল। সেখানে আগত রোগীদের অবস্থা খুবই করুণভাবে চিত্রিত হয়ে সংবাদে ঠাঁই নিয়েছে সেদিন। ডুবন্ত রিকশাভ্যানে নারী রোগীকে শুইয়ে নিয়ে ঠেলে চলছেন রোগীর আত্মীয়-স্বজনেরা। পাশের ভবনের কৌতূহলী মানুষ শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে ‘আহারে’ বলে অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। ভাগ্যিস! শুক্রবার হওয়ায় সেদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা ছিল না।

এদিন পথে যারই নেমেছেন, তারাই দুর্ভোগে পড়ে গিয়েছেন। বাইকারদের অনেকের ইঞ্জিনে পানি ঢুকে স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেছে। পেটের ধান্ধায় যারা ব্যাটারিরিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন, তাদের বাহন অচল হয়ে যাওয়ায় সেগুলো ঠেলে অন্যখানে সরিয়ে নেওয়ার কোনো উপায় ছিল না।

চিৎকার করে কেউ কেউ বলছিলেন- ‘আমাদের ট্যাক্স, ভ্যাট আদায়ের সময় যারা নিয়ম দেখায়, যারা জরিমানা আদায় করে তারা এখন ঘরে বসে টিভিতে আমাদের কষ্ট দেখে তামাশা করছে! এই তিলোত্তমা নগরে নাগরিক সুবিধা কি সামান্য বৃষ্টির পানিতে ডুবে থাকবে’!

কথা হলো- এই ‘তিলোত্তমা’ কী দেবে তোমায় আমায়! তার কি-বা দেবার আছে! রাজধানী ঢাকাকে বিশেষণ দিয়ে রূপসীর টোলপড়া গালের তিলের সঙ্গে তুলনা করা হয়। এর সৌন্দর্যের মোহে কবি-সাহিত্যকরা কত শত ছড়া-কবিতা লিখেন দিনরাত।

কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর কত মূল্যবান প্রসাধনী কিনে সাজানোর চেষ্টা করেন এর দেহকে। এর একই অঙ্গে উত্তর-দক্ষিণে কত বাহারি আলো শোভা পায়‍ কিন্তু দিনশেষে এত মেকাপ ‘রিমুভ’ করে ঘুমুতে যাওয়া উপায় নেই তার। এজন্য সে নিজেই নিজের সহ্যগুণ হারিয়ে ‘ভালনেরাবল’ বা ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। কিন্তু সেদিকে কারো কোনো নজর নেই।

তবুও প্রতিদিন নতুন নতুন ফেসপাউডার, কাজল, ভারী ভারী গহনা পরানো হচ্ছে। তিলোত্তমার বুক চিরে এত ভারী গহনা পরানোর ফলে এর বুক দুরু দুরু করছে। কানের গহনা কখন কান ছিঁড়ে পড়বে, তার নিরাপত্তা নেই। এর প্রাকৃতিক পঞ্চন্দ্রিয় এখন বন্ধ হয়ে গেছে! এসব কথা আক্ষেপ করে বলছিলন এক প্রবীণ ঢাকাবাসী। তাঁর কাছে ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার প্রাকৃতিক পঞ্চন্দ্রিয় বন্ধ হওয়ার কথা হঠাৎ আঁতকে উঠে জিজ্ঞাসা করলাম- সেটা কেমন!

মানুষের প্রাকৃতিক পঞ্চন্দ্রিয় বন্ধ হয়ে গেলে যদি দ্রুত চিকিৎসা করানো না যায়, তাহলে তার মৃত্যু অনিবার্য! তবে ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার পঞ্চন্দ্রিয় বন্ধ হলো কীভাবে! তিনি জানালেন, ধরুন, এর বাতাসের মান বছরের ১০ মাসই অস্বাস্থ্যকর থাকে। পথে হাঁটতে গেলে নাক, চোখ দিয়ে গরম পানি ঝরে। এখন বর্ষাকাল তাই বায়ুতে একটা স্বস্তি। এর মুখ খোলা। কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, যা দিয়ে প্রতিদিন নতুন নতুন মানুষ, ছাত্র, বেকার, ভাসমান মানুষ ঢুকছে। কেউ একবার ঢুকলে আর বের হতে চায় না।

তবে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো- এর নিচের ইন্দ্রিয় দুটো বর্ষাকালে হঠাৎ করে অকেজো হয়ে পড়ে। যেমন- ধরুন, ভূগর্ভস্থ সুয়্যারেজ লাইন ও নর্দমাগুলোর কথা। এই দুটি ‘তিলোত্তমা’র অতি গুরুত্বপূর্ণ ইন্দ্রিয়। জুলাই ১৩, ২০২৪ তারিখ চার ঘণ্টার বৃষ্টির পানি যদি বাধাহীনভাবে সব নর্দমা দিয়ে বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়তো, তাহলে কি এই ভয়ঙ্কর জলজট হতো!

কিন্তু ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার অতি গুরুত্বপূর্ণ ইন্দ্রিয় সদৃশ নর্দমাগুলোর মুখ বন্ধ হয়ে পড়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান এর নর্দমাগুলোর ভেতরে পাইপ বসিয়ে এর স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে। ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার উন্নয়ন কাজে এত বেশি প্রতিষ্ঠান জড়িত, তা গুনে শেষ করা যাবে না। তাদের মধ্যে কাজের সমন্বয় নেই। কে কখন কাটলো, কে ঢেকে রাখলো, আর কে নর্দমাগুলোর ভেতরে পাইপ বসিয়ে পানি প্রবাহ বন্ধ করে দিলো, তা ঠিকমতো হিসাব রাখার মতো সময় সুযোগ নেই কর্পোরেশনগুলোর।

সুতরাং একটু বৃষ্টি হলেই প্লাষ্টিক, মাটি, কাপড়ের টুকরো, কিচেন গার্বেজ ইত্যাদি দিয়ে এর নিচের ইন্দ্রিয় বা ময়লা নিষ্কাশনের নর্দমা বর্ষাকালে হঠাৎ করে অকেজো হয়ে পড়ে; যার নেতিবাচক প্রভাব এসে পড়ে রাজপথে, অলিতে-গলিতে, বাড়িতে, মার্কেটে। নগরের সব জায়গার সব কার্যক্রম হঠাৎ থৈ থৈ পানিতে সয়লাব হয়ে যায়।

এজন্য কর্পোরেশনগুলোর সার্বক্ষণিক ওয়াচটিম ও মটিভেশন কর্মসূচি থাকা দরকার। একেকটি সার্বক্ষণিক ওয়াচটিমের এক-দুইজন সদস্য একেকটি এলাকার ১০টি করে নর্দমার প্রবাহ পরিষ্কার আছে কিনা তা নজরদারিতে রাখলে এই জলাবদ্ধতা সহজেই নিরাময় করা যাবে!

জাপানের ট্রাফিক যেমন অফিসে বসেই রাস্তার চলন্ত গাড়ি ওয়াচ করে মাসিক বেতন বিলের সঙ্গে জরিমানার বিল কেটে ধরিয়ে দেয় তদ্রুপ আমাদের সিটি কর্পোরেশনের নর্দমা ওয়াচ টিমের দৈনন্দিন কার্যকলাপ সিসি ক্যামেরা ও ড্রোন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ করে জরিমানার বিধান করা যেতে পারে।

‘তিলোত্তমা’ ঢাকার নির্মাণ কাজ সারাবছর জুড়ে চলে। কখনো শেষ হয় না। নির্মাতারা রাস্তার পার্শ্বে বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রী, নুড়িপাথর বর্জ্য ফেলে স্তূপ করে রাখে। একটু বৃষ্টি হলে সেগুলো গড়িয়ে কাছাকাছির ড্রেন বন্ধ করে দেয়। বিভিন্ন পার্ক, পথঘাটের খোলা রেস্টুরেন্টে হরদম পলিথিন প্যাকেটে খাদ্যসামগ্রী বিক্রি হয়। ফুটপাতের দোকান, দর্জিপাড়া ইত্যাদি থেকে প্লাষ্টিক ব্যাগ ও বেশি শক্ত বর্জ্য নর্দমার মধ্যে ফেলা হয়ে থাকে। ওয়াচটিমের মাধ্যমে সেগুলো নিয়মিত সরিয়ে ড্রেনের ময়লা পানির গতিপ্রবাহ দেখে প্রতিদিন রিপোর্ট নেওয়ার নিয়ম থাকা উচিত।
হয়ত অনেক নিয়ম-কানুন হাতে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ‘তিলোত্তমা’র রাস্তায় যেখানে-সেখানে কাগজ, পলিথিন, ইটের টুকরা, আবর্জনার ছড়াছড়ি দেখে এসব কাজের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তাইতো মনে হয়, মাত্র একবেলা বৃষ্টির পানিতে কেন এই বন্যা! গেল অর্থবছরে ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে সাতশ পঞ্চাশ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে বলে একটি জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম হয়েছে। তবু কেন নগর জুড়ে ভয়াবহ জলাব্ধতার দুর্ভোগ কিছুদিন পর পর ঘাড়ে চাপে! এর দায়ভার কার!

‘তিলোত্তমা’ ঢাকা যানজট, জলজট ইত্যাদিতে নিজেই পঙ্গু হয়ে অসাড় হয়ে পড়েছে। বুয়েটের আবাসিকের মতো জায়গায় নগর পরিকল্পনাবিদদের কোয়ার্টারের নিচতলাবাসী এবার জলজটকে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। তারা কেউ কেউ পাম্প দিয়ে ঘরের পানি সেচে বাইরে ফেলার চেষ্টা করেছেন। কেউ সারারাত ঘুমাতে পারেননি। তাদের জন্যও উন্নত নাগরিক সেবা সে রাতে শূন্যের কোটায় নেমে গিয়েছিল।

‘তিলোত্তমা’ ঢাকায় প্রায় প্রতিবছর এই জায়গায় বার বার কাটাছেঁড়া করায় অতি উন্নয়নের ভারে সে ন্যুজ্ব হয়ে পড়েছে। যেমনটি ঘটেছিল পপ তারকা মাইকেল জ্যাকসনের বেলায়। তাঁর দেহের বিভিন্ন অঙ্গে এত বেশি প্লাস্টিক সার্জারি করা হয়েছিল যে, তিনি একসময় চরম হতাশ হয়ে ওষুধ গ্রহণ ছেড়ে দিয়ে একা একা বাঁচার জন্য নিঃসঙ্গ থাকতে চেয়েছেন। তবুও শেষ রক্ষা হয়নি তার। এখন থেকে আমাদের ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার অঙ্গে আর কাটাছেঁড়া না করাটাই উত্তম।

অসুস্থ ‘তিলোত্তমা’র ওপর একসঙ্গে অনেক ব্যাধি ভর করেছে। এ অবস্থায় তার কাছে আর কী নতুন সেবা চাওয়ার আছে আমাদের! তাই, ‘তিলোত্তমা’র ওপর আর শল্য চিকিৎসা না চাপিয়ে উল্লিখিত টোটকা দাওয়াই দিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর আছে বলে মনে হয় না!

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। E-mail: [email protected]

;

সাহিত্য পত্রিকা 'কথার কাগজ'র আত্মপ্রকাশ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সাহিত্য পত্রিকা 'কথার কাগজ'র আত্মপ্রকাশ

ছবি: সাহিত্য পত্রিকা 'কথার কাগজ'র আত্মপ্রকাশ

  • Font increase
  • Font Decrease

শ্রাবণ সংখ্যা আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে শিল্প ও সাহিত্যের ছোট পত্রিকা 'কথার কাগজ'-এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলো।

শুক্রবার (১২ জুলাই) বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মিলনায়তনে 'কথার কাগজ' শ্রাবণ সংখ্যার মোড়ক উন্মোচন করা হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক শাহানারা স্বপ্না, কথাসাহিত্যিক ফরিদুল ইসলাম নির্ঝর, স্টুডেন্ট ওয়েজ প্রকাশনীর প্রকাশক মাশফিক তন্ময়, কথার কাগজের প্রধান সম্পাদক কেতন শেখ, নির্বাহী সম্পাদক অয়ন আব্দুল্লাহ প্রমুখ। পত্রিকাটির বার্ষিক শ্রাবণ, কার্তিক ও ফাল্গুন তিনটি সংখ্যায় প্রকাশ হবে।

মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে কথার কাগজের প্রধান সম্পাদক কেতন শেখ বলেন, 'করোনাকালীন ২০২০ সালে কথার কাগজের জন্ম। সে সময় কয়েকজন প্রবাসী আর দেশি লেখক অনলাইনে ব্লগের মাধ্যমে কথার কাগজের লেখালেখি শুরু করি। তরুণ সাহি- ত্যিকদের সঙ্গে প্রবীণ সাহিত্যিকদের লেখালেখির একটি প্ল্যাটফর্ম হয়ে দাঁড়ায় কথার কাগজ।

প্রকাশক মাশফিক তন্ময় বলেন, 'এক সময় সাহিত্য আন্দোলনের প্রধান বাহন ছিল ছোট পত্রিকা বা লিটলম্যাগ। কিন্তু নানা সংকটে লিটলম্যাগের কলেবর ছোট হয়ে গেছে। প্রকাশকরা অনেকেই অর্থসংকটে তাদের প্রকাশনা বন্ধ করে দিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে অনলাইনের এই যুগে ছাপা কাগজে কথার কাগজের যাত্রা তরুণ লেখকদের অনুপ্রেরণা জোগাবে।'

শাহানারা স্বপ্না বলেন, 'আশা করি, পত্রিকাটি অনেক দূর এগিয়ে যাবে। শ্রাবণ সংখ্যার প্রথম দর্শনে মনে হচ্ছে এটি পাঠকদের সাহিত্যের খোরাক জোগাবে।'

ফরিদুল ইসলাম নির্ঝর বলেন, 'মানুষের ভাষার প্রতি টান থাকলে দেশ ও দেশের বাইরে থেকে কাজ করা যায়, এর উদাহরণ কথার কাগজ। সম্পাদকম- গুলীর তিনজনই দেশের বাইরে থেকে এর যাত্রা শুরু করেন। আজকে দেশে এসেই তারা পত্রিকাটির ছাপা সংস্করণের মোড়ক উন্মোচন করলেন।'

সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান বলেন, 'আমাদের তরুণরা বিদেশ চলে যাচ্ছে, আর ফিরছে না। তবে কথার কাগজের সঙ্গে জড়িতরা বিদেশ থেকে সাহিত্য আর দেশের টানে ফিরে এসেছেন। অনলাইনের যুগে যখন অনেক পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, এ অবস্থায় তারা কথার কাগজের প্রিন্ট ভার্সন নিয়ে এসেছেন। এটি অনেক ভালো লাগার।' নতুন পত্রিকাটি টিকিয়ে রাখতে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

;

লেখক শেখ হাসিনা কোটিপতি হওয়ার পথে!



আবদুল হামিদ মাহবুব
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখালেখির হাত খুব ভালো। তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী হননি তখনই তার একাধিক বই প্রকাশ হয়েছে। সম্ভবত তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই ‘ওরা টোকাই কেন’। ঢাকার আগামী প্রকাশনী থেকে বইখানা বের হয়েছিল। ওই প্রকাশনী থেকে আমারও দু’খানা ছড়ার বই প্রকাশ হয়। ১৯৯১ সালে আমার ‘ডিমের ভিতর হাতি’ যখন প্রকাশ হচ্ছিলো তখন আগামী প্রকাশনীর কর্ণধার ওসমান গনি ভাই শেখ হাসিনার ‘ওরা টোকাই কেন’ এককপি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন।

বইখানা প্রথম না দ্বিতীয় সংস্করণের ছিলো সেটা মনে নেই। ওই বই কয়েকটি নিবন্ধের সংকলন। অধিকাংশ নিবন্ধেই শেখ হাসিনা তাঁর ভিতরের যন্ত্রণার কথা লিখেছিলেন। লিখেছিলেন দেশ ও রাজনীতি নিয়ে তাঁর পরিকল্পনার কিছু কিছু ইঙ্গিত। পড়েছিলাম তো অনেক আগে। তারপরও লেখাগুলোর অনেক বিষয় মনে রয়ে গেছে। প্রতিটি নিবন্ধ পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমার পারিবারিক ছোট লাইব্রেরিতে বইখানা গোছিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু আজ যখন ওই বই খোঁজতে লাগলাম, পেলাম না। অনুমান হচ্ছে আমার বইচোর কোন বন্ধু হয়তো এই বইখানা মেরে দিয়েছেন। অথবা বন্যা অতঙ্কে কয়েকেবার বাসার বইগুলো টানাটানি করার কারণে কোথাও হয়ত খুইয়ে ফেলেছি। তবে আমার ধারণা এই বইয়ের ক্ষেত্রে প্রথমটি ঘটেছে।

প্রধানমন্ত্রীর অনেক বইয়ের মতো ‘ওরা টোকাই কেন’ নিশ্চয়ই বহুল প্রচারিত হয়েছিল, বেরিয়েছিল অনেক অনেক সংস্করণ। আর বই সমূহের রয়্যারিটিও তিনি হাজার হাজার টাকা পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এমন প্রাপ্তি ঘটে থাকলে, আমি একজন লেখক হিসাবে অবশ্যই পুলকিত হই। আমি দেখেছি সেই ১৯৯১ সালের পর থেকে আগামী প্রকাশনীর প্রকাশনা ব্যবসারও অনেক উন্নতি হয়েছে। ব্যবসার উন্নতি ঘটার অর্থ প্রকাশকের উন্নতি ঘটা। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি আগামী প্রকাশনীর কর্ণধার ওসমান গনি ভাইয়ের আর্থিক অবস্থা অনেক অনেক ভালো হয়েছে।

পূর্বে দেখতাম একুশের বইমেলায় আগামী প্রকাশনী ছোট্ট স্টল নিত। এখন প্যাভিলিয়ন নেয়। লাখ লাখ টাকা খরচ করে প্যাভিলিয়নের অঙ্গসজ্জা করা হয়। নিশ্চয় বইয়ের ব্যবসা ভালো হয়। সেকারণেই বইমেলার প্যাভিলিয়ন তৈরিতে বিনিয়োগও বেশি করেন। প্রতিবছরই আগামী প্রকাশনীর কোন না কোন বই কেনার জন্য পাঠকের লাইন পড়ে। পাঠক যখন যে কোন লেখকের বই কেনে, সেটা দেখে আমি একজন লেখক হিসাবে আনন্দিত হই। বইয়ের ব্যবসার উন্নতি হোক। প্রকাশকরা ভালো লাভ করুন, আমি মনে প্রাণে সেটা চাই।

অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, প্রকাশকের লাভ হলে আমার মতো মফস্বলের লেখকরা কি লাভমান হই? অবশ্যই যৌক্তিক প্রশ্ন। এর জবাব খুব সংক্ষিপ্ত। প্রকাশকরা যখন বই প্রকাশ করে লাভের মুখ দেখবেন, তখন তারা নতুন নতুন বই প্রকাশে আগ্রহী হবেন। নতুবা আমাদের মতো লেখকদের প্রকাশককে উল্টো টাকা দিয়ে বই প্রকাশ করিয়ে নিতে হবে। এবং আমরা অনেকেই সেটা করছিও।

অনেকে আবার এও বলেন ডিজিটালের এই যুগে এখন আর কেউ বই কিনে পড়ে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে টুকটাক পড়েই তাদের পড়া শেষ করেন। সেই কারণে লেখকরা গাঁটের টাকা খরচ করে বই প্রকাশ করলেও সেগুলো বিক্রি হয় না। আমি এই অপবাদটা মানতে নারাজ। কারণ আমি দেখেছি কেবল ফেব্রুয়ারি মাসেই বইমেলা চলাকালে শত শত কোটি টাকার বই বিক্রি হয়। আর যারা পড়ুয়া, তারা সারা বছরই খোঁজে খোঁজে রকমারি, প্রথমা, আগামী, শ্রাবণ, ইউপিএলসহ বিভিন্ন আনলাইন বই বিক্রয় প্রতিষ্ঠান থেকে বই আনান।

আমি মফস্বলের একটি শহরে থাকি। আমাদেরে শহরে বইয়ের দোকান আছে অনেক। সেগুলোতে স্কুল কলেজের পাঠ্য ও গাইড বই ছাড়া অন্য বই খুব কমই দেখা যায়। সৃজনশীল বলুন আর মননশীল বলুন, সেইরকম বইয়ের দোকান খুব একটা নাই। আমাদের শহরে প্রকাশনা ব্যবসার সাথে ‘কোরাস’ নামে একটি দোকান চালান বই পাগল এক যুবক মুজাহিদ আহমদ। তাঁর কোরাসেই আমাদের মত পাঠকের উপযোগী কিছু কিছু বই আসে। কিন্তু সবসময় কোরাসও আমাদের মতো পাঠকদের চাহিদার যোগান দিতে পারে না। তারপরও মন্দের ভালো হিসাবে দোকানটি টিকে আছে, টিকে থাক্।

আমাকে প্রায়ই অর্ডার করে ‘রকমারি’ থেকে বই আনাতে হয়। আমার আনানো বই ছাড়িয়ে আনার জন্য আমি নিজে প্রায়ই কুরিয়ার অফিসে যাই। আমি যেদিনই কুরিয়ার অফিসে গিয়েছি, দেখেছি কেবল আমার বই নয়, আমার মতো আরও অন্তত বিশ থেকে পঁচিশ জনের বইয়ের প্যাকেট এসেছে। কুরিয়ার অফিসের লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জেনেছি, প্রতিদিনই এভাবে কিছু না কিছু বই নানাজনের নামে আসে। আর আমার নিজের চোখে দেখাটাকেওতো বিশ্বাস করতে হবে। মানুষ যদি বই নাই পড়বে তবে কেনো রকমারি কিংবা অনলাইনের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে এতো এতো বইয়ের প্যাকেট আসবে? আমি বলবো বইয়ের পাঠক মোটেই কমেনি বরংচ বেড়েছে।

শুরু করেছিলাম আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বইয়ের প্রসঙ্গ দিয়ে। বই প্রসঙ্গেই বলতে গিয়ে অন্য প্রসঙ্গও এসে গেল। আমাদের শহরের সেই যে ‘কোরাসে’র কথা বলেছি; ক’দিন আগে এক দুপুরবেলা কোরাসে গিয়ে বই দেখছি। এসময় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুইজন প্রধান শিক্ষক কোরাসে এসে ঢুকলেন। তাদের দু’জনের হাতেই বেশ বড় সাইজের চারখানা করে বই। ওই দুই প্রধান শিক্ষক আমার পূর্ব পরিচিত। তাদের হাতে বই দেখে আমি উৎফুল্ল হলাম। কি বই? কোথা থেকে আনলেন? এমন প্রশ্ন করে বইগুলো দেখতে চাইলাম। দু’জনই ক্ষোভ প্রকাশ করে আমার সামনে টেবিলের উপর ধাম্ ধাম্ করে বইগুলো রাখলেন। একজন বললেন, ‘‘আমাদের বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের পড়ার জন্য এই বইগুলো নগদ চব্বিশ’ টাকা দিয়ে কিনে এনেছি। বলুন ছাত্ররা এই বই পড়তে পারবে? তারা কি কিছু বুঝবে?’’ অন্য প্রধান শিক্ষকের চেহারায় তখনও বিরক্তি রয়ে গেছে। তিনি বললেন, ‘বইগুলো দেখুন, আপনি লেখক মানুষ, আপনিও কিছু বলুন।’

আমি তাদের আনা বইয়ের দিকে মনোযোগ দিলাম। দেখি চার চার আটখানা বই, দুটি বিষয় নিয়ে করা হয়েছে। প্রচ্ছদে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ছবি। বইগুলোর লেখক আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একটি বইয়ের নাম ‘সকলের তরে সকলে আমরা’। এই বইয়ে প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ ও ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত যে ভাষণগুলো দিয়েছেন সেগুলোর বাংলা ও ইংরেজি সংকলন। অপর বইয়ের নাম ‘আহ্বান’। এই বই করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত জাতির উদ্দেশে যেসব ভাষণ দিয়েছেন সেগুলো সংকলিত করে।

দু’খানা বইয়ের-ই কাগজ, ছাপা, বাঁধাই খুবই উন্নত মানের। প্রতি কপি বইয়ের মূল্য ছয়শত টাকা। প্রত্যেকটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লাইব্রেরির জন্য প্রতিটি বইয়ের দুই কপি করে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস বিক্রি করেছে। প্রধান শিক্ষকরা এই বইগুলো কিনে নিতে বাধ্য। চারখানা বইয়ের জন্য প্রধান শিক্ষকদের দুই হাজার চারশত টাকা করে অফিসের সংশ্লিষ্ট ক্লার্কের কাছে পরিশোধ করতে হয়েছে। বুঝতে পারি টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে বলেই এই দুই প্রধান শিক্ষক ক্ষুব্ধ। আমি শিক্ষকদের অনুমতি নিয়েই একটি বিদ্যালয়ের জন্য আনা চারখানা বইয়ের ছবি উঠিয়ে নিলাম। এই সময় কোরাসের কর্ণধার মুজাহিদ আহমদ বললো, ‘ভাই, আমি এমন একখান বই প্রকাশের অনুমতি পেলে কোটিপতি হয়ে যেতাম।’

আমি ওই দুই প্রধান শিক্ষককে উদ্দেশ্য করে বললাম; ‘প্রধানমন্ত্রীর বই প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাচ্ছে, এটাতো আনন্দের বিষয়। কিন্তু আমারও প্রশ্ন হচ্ছে বইগুলো কি প্রাথমিকের ছাত্রছাত্রীদের জন্য উপযোগি? আর প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রিয় এইসব ভাষণ বই আকারে করাটা তো সরকারি খরচেই হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, উচ্চ বিদ্যালয় ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লাইব্রেরিগুলোতে দিতে হলে বিনামূল্যে দেওয়ার কথা। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ সংকলন টাকার বিনিময়ে কিনতে হবে কেনো?’

তখন একজন বললেন; ‘ভাই, এই বই রাষ্ট্রিয় ভাবে হয়নি। ব্যবসার জন্য প্রধানমন্ত্রীর আশপাশের এক দু’জন প্রকাশনীর মাধ্যমে প্রকাশ করে আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তারা কোটি কোটি টাকা কামাই করে নিচ্ছেন।’ উনার কথায় আমি বইয়ের প্রথম দিকের পাতা উল্টালাম। ঠিকইতো প্রকাশক ‘জিনিয়াস পাবলিকেশন্স’-এর মো. হাবিবুর রহমান। দু’খানা বইয়েরই গ্রন্থনা ও সম্পাদনা মো. নজরুল ইসলাম, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার (সচিব)। খেয়াল করে দেখলাম বই দু’খানার কপিরাইট শেখ হাসিনা। বুঝতে পারি যে এই বইগুলোর যে রয়্যালিটি আসবে সেটা আমাদের প্রধানমন্ত্রীই পাবেন।

এখন একটা হিসাব করে দেখি। বাংলাদেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৬শ ২০টি। এই বই যখন প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে বাধ্যতামূলক কিনতেই হবে, তা হলে ৪ কপি করে বই বিক্রি হবে উল্লেখিত বিদ্যালয়গুলোতে ২ লাখ ৬২ হাজার ৪শ ৮০ কপি। এই বইয়ের মূল্য থেকে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের হাতে টাকা আসবে ১৫ কোটি ৭৪ লাখ ৮৮হাজার। বইয়ের কপিরাইট অনুযায়ী শতকরা ১৫ ভাগ রয়্যালিটি নিলেও আমাদের প্রধানমন্ত্রী পাবেন ২ কোটি ৩৬ লাখ ২৩ হাজার ২শ টাকা। হিসাবে কিন্তু আমার মাথা ঘুরে গেছে। বই থেকে এমন অঙ্কের রয়্যারিটি এদেশে আগে কেউ পেয়েছেন কি না আমি জানি না।

আর এটাতো আমি কেবল প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বিক্রির হিসাব দিলাম। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লাইব্রেরির জন্য যখন বাধ্যতামুলক করা হয়েছে, তবে তো উচ্চ বিদ্যালয়, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়েও এই বইগুলো এভাবেই বিক্রি হবে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যুক্ত করলে আরো কতো কতো হাজার বেড়ে যাবে। আমি হিসাব বাড়ালে অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারি।

আমার ঘরেও একজন প্রধান শিক্ষক আছেন। লেখাটার পূর্ণতার জন্য তার কাছে কিছু তথ্য জানতে চেয়েছিলাম। তিনি খ্যাক্ করে উঠে বললেন, ‘স্কুল আমি চালাই। আমার স্কুলের জন্য কখন কি ভাবে কি কিনবো না কিনবো সেটা তোমাকে বলবো কেনো?’ দেখলাম ঘাটাতে গেলে আবার কি থেকে কি হয়ে যায়। তাই কথা না বাড়িয়ে লেখা শেষ করার দিকেই মনোযোগ রাখলাম।

আমরা যারা লেখক আমাদের মধ্যে একটা কথা প্রচলিত আছে যে, প্রকাশকরা লেখকদের ঠকান। তারা ঠিক মতো লেখকের পাওনা রয়্যালিটি পরিশোধ করেন না। তাই বলে কি প্রধানমন্ত্রীকে ‘জিনিয়াস পাবলিকেশন্স’-এর মো. হাবিবুর রহমান ঠকানোর সাহস করবেন? নিশ্চয় না। এই ভরসাতেই বলতেই পারি বই বিক্রির অর্থে আমাদের লেখক শেখ হাসিনা কোটিপতি হবার পথে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, ছড়াকার

ইমেইল: [email protected]

;

দশ টাকার শোক



মনি হায়দার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

প্রায় পনেরো মিনিট ধরে মানিব্যাগটা উল্টেপাল্টে দ্যাখে রজব আলী।

মানিব্যাগটা খুব পছন্দ হয়েছে তার। বিশেষ করে মানিব্যাগটার বাদামি রংটা। ব্যাগটা চামড়ার তৈরি। রজব আলী নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শোকে। বোঝা যায় না কোন্ পশুর চামড়ায় মানিব্যাগটা তৈরি হয়েছে। মানিব্যাগটার ভেতরে অনেকগুলো ছোট ছোট কুঠরি। রজব আলী কল্পনায় দেখতে পায়- মানিব্যাগটার ভিতরে রাখা টাকায় ভেতরের কুঠুরিগুলো ভরে উঠেছে।

ব্যাগটা প্যান্টের পকেটে নিয়ে যখন হাঁটবে পিছটা ফুলে যাবে, মুহূর্তেই শরীরের কোষে কোষে একটা অন্যরকম অহমিকা অনুভব করে সে।

ভাই, মানিব্যাগটার দাম কতো ? রজব আলী মানিব্যাগঅলাকে জিজ্ঞেস করে।

ব্যাগঅলা রজব আলীর উপর মনে মনে চটে উঠেছে। সেই কতোক্ষণ থেকে ব্যাগটা উল্পেপাল্টে দেখছে। কেনার কথা বলছে না। অথচ রজব আলীর দেখার মধ্যে দুটো ব্যাগ সে বিক্রি করেছে। ফুটপাতের জিনিস এতক্ষণ নাড়াচাড়া কেউ করে না। ব্যাগঅলা রাগ করে কিছু বলতেও পারে না। যদি কেনে ?

আপনি নেবেন ? রজব আলীর দাম জিজ্ঞাসায় ব্যাগঅলা পাল্ট প্রশ্ন ছোড়ে। কারণ রজব আলীকে দেখে তার মনে হয় না এই লোক মানিব্যাগ কিনবে।

রজব আলী একটি বহুজাতিক কোম্পানির অফিসের পিওন। পরনের পোশাকে ঐ বহুজাতিক কোম্পানির পরিচয় আছে। ব্যাগঅলার ধারণা এইসব লোকজন সাধারণত মানিব্যাগ-ট্যাগ কেনে না। তাদের সামান্য টাকা আয়, কোনোভাবে সেই পয়সায় মানিব্যাগ কেনার মানসিকতা বা প্রয়োজনীয়তাও থাকে না।
নেবো।

ইতোমধ্যে ব্যাগঅলার সামনে দামি প্যান্টশার্ট পরা একজন ভদ্রলোক এসেছে। সঙ্গে তন্বী তরুণী। তাদের আসায় চারপাশের আবহাওয়ায় বিদেশী সেন্টের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। ভদ্রলোকের কাছে রজব আলী অযাচিতভাবে হেরে যায়। বাস্তবতার কারণে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়াতে হয় তাকে।

তন্বী তরুণী ও ভদ্রলোক মিলে কয়েকটা মানিব্যাগ দেখে। বাছাই করে। অবশেষে তন্বীয় কথানুযায়ী ভদ্রলোক তিনশো পঁচিশ টাকায় একটা মানিব্যাগ নিয়ে চলে গেলো। মাত্র তিন-চার মিনিটের মধ্যে তারা মানিব্যাগ দেখলো, দাম করলো, কিনলো এবং চলেও গেলো। অথচ রজব আলী বিশ-পঁচিশ মিনিচের মধ্যে মধ্যে দামটাও জানতে পারলো না ! তারা চলে যাওয়ার পর রজব আলী ব্যাগঅলার কাছে যায়।

বললেন না কতো দাম ?

রজব আলীর দিকে আড়চোখে তাকায়, মানিব্যাগ আপনার পছন্দ হয়েছে?

পছন্দ না হলে দাম জিজ্ঞেস করবো কেনো ?

একশো আশি টাকা।

একশো আশি টাকা। রজব আলী মুখ থেকে বিপন্ন শব্দগুলো বের হয়।

বিরক্তি প্রকাশ করে ব্যাগঅলা, অবাক হওয়ার কি আছে? আপনার সামনেই তো দেখলেন তিনশো পঁচিশ টাকায় একটা মানিব্যাগ বিক্রি করেছি। ঠিক আছে আপনি ঐ সোয়াশ টাকাই দেন।
সোয়াশ টাকা একটা মানিব্যাগের দাম ! রজব আলীর বিস্ময় কোনো বাঁধা মানে না।

ব্যাগঅলা বুঝতে পারে রজব আলী এতো টাকায় ব্যাগ কিনবে না। সবাইতো ঐ টাকাঅলা ভদ্রলোক নয়, বেশি দাম-দর না করেই তাদের হাকানো দামেই কিনবে। রজব আলীরা তো মানিব্যাগই কেনে না। সেখানে রজব আলী যে কিনতে এসেছে সেটাই অনেক। ব্যাগঅলা মানিব্যাগ বিক্রি করলেও তার পকেটে মানিব্যাগ থাকে না। নিজের সঙ্গে রজব আলীর সাদৃশ্য দেখতে পায় ব্যাগঅলা। একই কাতারের ঠেলা-গুতা খাওয়া মানুষ তারা। লোকটাকে ঠকিয়ে লাভ নেই। হয়তো অনেক আশা করে সারা জীবনে একবার একটা মানিব্যাগ কিনতে এসেছে।

আপনি সত্যিই কি মানিব্যাগটা কিনবেন ? নরম কণ্ঠে ব্যাগঅলা জানতে চায়।

কিনবো বলেই তো পছন্দ করেছি। দাম জানতে চাইছি।

তাহলে শোনেন ভাই, অনেক্ষণ ধরে আপনি মানিব্যাগটা দেখছেন, ফাইনাল কথা বলে দিচ্ছি, মানিব্যাগটা আপনি আশি টাকায় নিতে পারবেন। আশি টাকার এক টাকা কমেও বিক্রি করবো না।
রজব আলীর এই মুহূর্তে ব্যাগঅলাকে খুব কাছের মানুষ মনে হয়। কোথায় একশো আশি টাকা, সেখান থেকে একশত পঁচিশ এবং সবশেষে পুরো শতকই নেই; কেবল আশি টাকা। সে পকেট থেকে টাকা বের করে দিয়ে মানিব্যাগটা পকেটে রাখে। মানিব্যাগটা পকেটে রাখার সঙ্গে সঙ্গে রজব আলী নিজেকে একজন দামি মানুষ ভাবে। তার পকেটেও অনেকের মতো মানিব্যাগ আছে।

দীর্ঘদিনের একটা আকাক্ষা, একটা স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলো রজব আলীর। মানিব্যাগ কেনার একটা সিগারেট কেনে। সাধারণত সে সিগারেট টানে না। কিন্তু এই মুহূর্তে একটা সিগারেট টানার ইচ্ছে হলো তার। না, কেবল সিগারেটই নয়, একটা ঝাল দেওয়া পানও কিনলো এবং মুখে দিয়ে পরম আয়াসে চিবুতে লাগলো। সিগারেটটা ধরিয়ে পান চিবুতে চিবুতে রজব আলী একটা রিকশায় উঠলো। পর পর তিনটি কাজ সে করলো-যা সে খুবই কম করে। সিগারেট টানা, পান খাওয়া এবং রিকশায় করে বাসায় ফেরা। তার জীবনেএকটুকুই শ্রেষ্ঠ বিলাসিতা। রিকশা ছুটে চলেছে।

রজব আলীর মাথার কোষে, যেখানে স্বপ্ন বিলাসী বা ইচ্ছের রক্তকণিকা থাকে- সেখানে মানিব্যাগ কেনার শখ জাগলো প্রায় মাস তিনেক আগে। সে, অফিসের বড় সাহেবের ব্যক্তিগত পিওন। চা, চিনি, সিগারেট থেকে শুরু করে যা কিছু দরকার সবই আনে রজব আলী। দীর্ঘদিনের চাকরির কারণে সে বড় সাহেবের খুব বিশ্বস্ত ও অনুরাগী। অফিসে প্রতিদিন অনেক মেহমান আসে।

নানান কিসিমের মানুষের আনাগোনা বড় সাহেবের কাছে। এইসব মেহমান আসলেই বড় সাহেব বেল টিপে রুমের বাইরে হাতলবিহীন চেয়ারে অপেক্ষায় থাকা রজব আলীকে ডাকেন। রজব আলী ত্রস্ত খরগোশের মতো ভেতরে ঢোকে। কিন্তু ঢুকেই খরগোশের মতো মাথা উঁচু রাখতে পারে না। কোথাকার কোন এক অদৃশ্য অপরিমেয় শক্তি এসে তার মাথাটাকে নিচু করে দেয়।

তার দাঁড়ানো পর বড় সাহেব বড় অবহেলায়, নিপুণ নৈপুণ্যে, গাম্ভীর্যের কৌশলী পারম্পর্যে অবলীলায় প্যান্টের ডান দিক থেকে মোগল সম্রাটদের ক্ষমতায় মানিব্যাগটা বের করে টেবিলে রাখেন। মেহমানবৃন্দ গভীর অভিনিবেশে বড় সাহেবের কর্মকান্ড দেখতে থাকেন। মানিব্যাগটা টেবিলে রেখেই বড় সাহেব টেবিলের অন্যপ্রান্তে রাখা দামি সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে পরম আদরে রাখেন এবং তৎক্ষণাৎ লাইটার জ্বালিয়ে সিগারেট টানেন আয়েসের সঙ্গে।

সিগারেটে দু’-দিনটি টান দিয়ে দুই ঠোঁটের মাঝখানে আটকে রেখে মানিব্যাগটা তোলেন ডান হাতে। মানিব্যাগটা টাকার কারণে সবসময় পোয়াতি নারীর মতো ফুলে থাকে। বড় সাহেবের মানিব্যাগে টাকাগুলো অধস্তন, পরাধীনভাবে নিবিড় শুয়ে থাকতে পছন্দ করে। একহাজার, পাঁচশ, একশ, পঞ্চাশ টাকার অসংখ্য নোট সাজানো পাশাপাশি। দেখতে কতো ভালো লাগে ! রজব আলী দেখে। দেখেই তার আনন্দ।

বাম হাতে মানিব্যাগটা ধরে ডান হাতের দুই আঙ্গুলে বড় সাহেব বেশ কয়েকটা নোট বের করেন। একটা নোট রজব আলীর দিকে বাড়িয়ে দেন, শীগগির নাস্তা নিয়ে আয়।

রজব আলী বিনয়ের সঙ্গে টাকাটা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। এবং নাস্তার আয়োজনে নিদারুণভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এইভাবেই রুটিন চলছিলো। হঠাৎ মাস তিনেক আগে রজব আলীর মাথায় এই প্রশ্নটা উঁকি দেয়- বড় সাহেবের গাড়ি বাড়ি টাকা মান-সম্মান ক্ষমতা আছে। রজব আলীর কিছুই নেই। কিন্তু একটা মানিব্যাগতো থাকতে পারে। আর যাই হোক বড় সাহেবের মতো মানিব্যাগ থেকে সেও টাকা বের করে বাস কন্ডাকটর, চালের দোকানদার, মাছঅলা, ডালঅলাদের দিতে পারবে।

এই ভাবনা, স্বপ্ন এবং কল্পনার পথ ধরে কয়েকমাস যাবৎ রজব আলী চেষ্টা করে আসছে একটা মানিব্যাগ কেনার। নানা কারণে হয়ে ওঠেনি। বৌয়ের শরীর খারাপ- ডাক্তারের টাকা দেওয়া, ছেলেমেয়েদের স্কুলের বেতন, বই খাতা কেনা- যাবতীয় সাংসারিক কাজের চাপে মানিব্যাগ কেনা সম্ভব হয়নি। আজকে সে বেতন পেয়েছে। এবং সমস্ত চাপ উপেক্ষা করে রজব আলী মানিব্যাগটা কিনেই ফেললো। আসলে কখনো কখনো একটু-আধটু রিস্ক নিতেই হয়। নইলে ছোটখাট স্বাদ-আহ্লাদ পূরণ হবার নয়।

রিকশায় বসেই সে জামার বুক পকেট থেকে বেতনের বাকি টাকাগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে মানিব্যাগে। মানিব্যাগটার পেট ফুলে যায়। হাতে নিয়ে তার দারুণ ভালো লাগে। কিছুক্ষণ হাতে রাখার পর রজব আলী মানিব্যাগটাকে পিছনে প্যান্টের পকেটে রাখে। ঘাড় ঘুরিয়ে সে প্যান্টের পিছন দিকটা ফিরে ফিরে দ্যাখে- কতোটা ফুলে উঠলো ? তেমন না। যেভাবে বড় সাহেবের পিছন দিকটা ফুলে থাকে, সে রকম নয়। রজব আলীর মনটা খারাপ হয়ে গেলো।

রিকশা বাসার কাছে আসলে সে ভাড়া মিটিয়ে নেমে যায়। তার মনের মধ্যে ছোট সুখের একটা ছোট পাখি ডানা মেলেছে। গানের সুর ভাজতে ভাজতে রজব আলী দেড় কামরার স্যাঁতস্যাঁতে বাসায় ঢোকে। সে ঢুকলো সংসারে, তাতে সংসারের কিছু যায় আসে না। সংসারটা তার কাছে সীমাহীন অন্ধগলির মোড়। যেখানে অভাব দারিদ্র ক্ষুধার চাহিদা কুমিরের হা মেলে থাকে, সেখানে তার মতো একজন রজব আলীর আসা না আসায় কিছুই যায় আসে না। রজব আলী স্ত্রী মকবুলা বেগম চতুর্থ সন্তান, যার বয়স মাত্র তিনমাস তাকে মাই খাওয়াচ্ছে।

অন্যান্যরা মেঝেতে জটলা পাকাচ্ছে একটা পুরোনো ক্যারামের গুটি নিয়ে। মকুবলা বেগম ঘাড় ফিরিয়ে রজব আলীকে একবার দেখে আবার মাই দিতে থাকে। রজব আলী কি করবে ভেবে পায় না। সাধারণত বেতন নিয়ে বাসায় ফিরলে তরিতরকারি, চাল, ডাল, লবণ, তেল, সাবান, দুই এক প্যাকেট সস্তা বিস্কুট সঙ্গে নিয়ে আসে রজব আলী। আজকে একবারে অন্যরকম একটা জিনিস এসেছে- যার প্রতি তার নিজের মমতা অনেক। সংসারে অন্যদের প্রতিক্রিয়া কি হবে বুঝতে পারছে না।

শুনছো ? রজব আলী স্ত্রীকে ডাকছে।

কনিষ্ঠতম সন্তানের মুখ থেকে মাই সরাতে সরাতে সাড়া দেয় মকবুলা বেগম, কি ?

একটা জিনিস এনেছি।

মকবুলা বেগম সরাসরি তাকায় রজব আলীর দিকে, কি এনেছো ?

অদ্ভুত একটা হাসি রজব আলীল ঠোঁটে, একটা মানিব্যাগ।

দ্রুত ব্যাগটা বের করে মকবুলা বেগমের হাতে দেয় রজব আলী। ব্যাগটা হাতে নিয়ে কয়েক মুহূর্ত স্থানুর মতো বসে থাকে মকবুলা বেগম। একবার কোটরের চোখ দিয়ে তাকায় রজব আলীর দিকে। দৃষ্টি ফিরিয়েই ব্যাগটা অবহেলায় রেখে দেয় সে, মানিব্যাগ ফুটাতে কে বলেছে তোমাকে! বেতন পেয়েছো আজ না ?

বেতন পেলে আর মাথা ঠিক থাকে না। মকবুলা বেগমের লং প্লে রেকর্ড বাজা আরম্ভ হলো, বাসায় কিছু নাই। অফিসে যাবার সময় বললাম, ফিরে আসার সময় ছোট বাচ্চাটার জন্য এক কৌটা দুধ এনো। বড় ছেলেটার খাতা পেন্সিল নেই- নিয়ে এসো। তার কোনো খবর নেই। উনি নিয়ে এলেন মানিব্যাগ। ছেলেমেয়ে বৌয়ের মুখে তিন বেলা ভাত জোটাতে পারে না, উনি মানিব্যাগ কিনে ভদ্দরলোক হয়েছেন! কানার আবার স্বপ্ন দেখার শখ!

রজব আলীর মন শরীর স্বপ্ন আকাক্ষাগুলো শাঁখের করাতে কাটছে এখন। হায়, সংসারের জন্য ব্যক্তিগত দুই-একটা স্বপ্নও কি পূরণ করা যাবে না ! সকাল থেকে রাত পর্যন্ততো সংসারের সুখের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। সামান্য একটা মানিব্যাগের জন্য স্ত্রী এমনভাবে শ্লেষের কথা বলে-একেক সময় মনে হয় রজব আলী আত্মহত্যা করে। পারে না।

স্ত্রীর শান দেওয়া কথার বান থেকে আপাতত রক্ষা পাবার জন্য না খেয়ে বাইরে চলে আসে রজব আলী। এভাবেই সে অক্ষমতার জ্বালা, বেদনা ও ক্ষরণকে তাড়িয়ে থাকার চেষ্টা করে। রাস্তায় দোকানে এখানে সেখানে ঘন্টাখানেক ঘোরাঘুরি করে আবার মকবুলা বেগমের সংসারেই ফিরে আসে। পরের দিন রজব আলী যথারীতি অফিসে।

অফিসের লোকজনের কাছে মানিব্যাগটা দেখায়। কেউ দেখে, কেউ আগ্রহবোধ করে না।

বল তো বারেক, অফিসের আরেকজন পিওনকে ডেকে জিজ্ঞেস করে রজব আলী- মানিব্যাগটা কেমন হয়েছে ?

বারেক মানিব্যাগটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে- ভালো। খুব ভালো হয়েছে। কতো টাকায় কিনেছো ?
প্রচ্ছন্ন গর্ব রজব আলীর, তুই বল।

আমি কেমনে বলবো ?
অনুমানে।
বারেক কয়েক মুহূর্ত ভেবে বলে, ত্রিশ-চল্লিশ টাকা।

তোর বাপের মাথা! ধমকে ওঠে রজব আলী। এ রকম একটা মানিব্যাগ জীবনে চোখে দেখেছিস ? কেমন রং এটার ! ভেতরে কতোগুলো ঘর আছে জানিস ! একহাজার, পাঁচশ, একশো, পঞ্চাশ টাকার নোট রাখার আলাদা আলাদা জায়গা আছে। তাছাড়া এই ব্যাগটা বিদেশী। দেশী না।

তোমার মানিব্যাগের যতো দামই থাক, তুমি বাপ তুলে কথা বলবে ? বারেকের আত্মসম্মানে সামান্য ঘা লাগে।

বলবো না, হাজার বার বলবো। এতো শখ করে একশ টাকা দিয়ে একটা মানিব্যাগ কিনলাম। আর তুই কিনা বলিস মাত্র ত্রিশ-চল্লিশ টাকায় কিনেছি ! জানিস, এই রকম মানিব্যাগ আছে আমাদের বড় সাহেবের।

হতেই পারে। আমার তো মানিব্যাগ নেই। কখনো ছিলোও না। তাই দাম জানি না। কিন্ত তুমি একটা একশো টাকা মানিব্যাগে জন্য বাবা তুলে কথা বলতে পারো না-

বারেক যখন মানিব্যাগ সংক্রান্ত তর্কে হেরে যাচ্ছিলো, তখনই বড় সাহেব অফিসে ঢোকেন সঙ্গে কয়েকজন বন্ধু মেহমান নিয়ে। বারেক চট্ করে সরে যায়। রজব আলী দ্রুত দরজা খুলে দাঁড়ায়। বড় সাহেব সঙ্গীদের নিয়ে রুমে ঢোকেন। রজব আলীকে চা আনতে বলেন বড় সাহেব। শুরু হয় রজব আলীর দৌড়।

কয়েকদিন পর বড় সাহেব অফিসে কয়েকজন ক্লায়েন্টের সামনে বসে রজব আলীকে ডাকেন, রজব আলী?

জ্বী স্যার ?
তোমার হয়েছে কি ?

রজব আলী ভেবে পায় না তার কোথায় কখন কি হয়েছে ? ডানে বামে উপরে নিচে তাকায় সে, কই স্যার-কিছু হয় নাইতো।
তোমার হাতে মানিব্যাগ কেনো ?

এই কথার কি জবাব দেবে রজব আলী? হঠাৎ মগজের কোষ কোনো কাজ করে না। সে বুঝে উঠতে পারে না- তার হাতে মানিব্যাগ থাকলে বড় সাহেবের অসুবিধা কি ? কক্ষের সবাই রজব আলীর দিকে চেয়ে আছে। এক অনিশ্চয়তার মুখোমুখি। হঠাৎ রজব আলী উপলব্ধি করতে পারে- মানিব্যাগটা থাকার কথা প্যান্টের পকেটে। হাতে নয়। এবং তার আরো মনে পড়লো মানিব্যাগটা কেনার পর থেকে, বিশেষ করে অফিস করার সময় মানিব্যাগটা কারণে-অকারণে তার হাতেই থাকে। কেন থাকে ?

সে কি সবাইকে তার সদ্য কেনা মানিব্যাগটি দেখিয়ে তৃপ্তি পেতে চায় ? যা প্রকারান্তরে অক্ষম অথর্ব মানুষের করুণ মনোবিকৃতি ? নিশ্চয়ই তার অবস্থা দেখে বড় সাহেব, তার পরিষদবর্গ, অফিসের লোকজন হাসছে। রজব আলী নিমিষে নিজেকে বায়ুশূন্য ফাটা একটা পরিত্যাক্ত বেলুন হিসাবে নিজেকে আবিষ্কার করে। লজ্জায় বালুর সঙ্গে সে মিশে যেতে চাইছে। কিন্তু মানুষের পক্ষে মুশকিল হচ্ছে- সে ইচ্ছে করলেই বালু বা বায়ুর সঙ্গে মিশে যেতে পারে না। মানুষ হিসাবে তাকে অনড় ও অবিচল থাকতে হয়।

বড় সাহেবের মুখে অদ্ভুত হাসি- রজব ?

জ্বী স্যার ?
মানিব্যাগটা কবে কিনেছো ?

রজব আলী জবাব দেয় না। দিতে পারে না। ভেতরের কে একজন যেন রজব আলীকে থামিয়ে দিয়েছে। যে রজব আলীর ওষ্ঠ জিহ্বা কণ্ঠ ভেতরের ক্ষুধিত শক্তিকে পাথর বানিয়ে জমাট করে রেখেছে। প্রাণপণে চেষ্টা করছে কথা বলতে। পারছে না। সে মাথাটা নিচু করে দাঁড়িয়ে। কথা বলছো না কেন ? বড় সাহেবের কণ্ঠে এখন কর্তৃত্ব ও অপমানের সুর।

ঢোক গিলে জবাব দেয় রজব আলী- কয়েক দিন আগে।

কতো টাকায় ?

একশ টাকা।

তাই নাকি ! দেখি, বড় সাহেব হাত বাড়ান।

রজব আলী সারা জীবনের সমস্ত অভিশাপ নিজের মাথায় ঢালে-কেন সে মানিব্যাগ কিনতে গেলো ? কিনলোই যদি তাহলে পকেটে না রেখে হাতে রাখার প্রয়োজন হলো কেন ? দেখাতে চেয়েছিলো বড় সাহেবকে ? বড় সাহেবের মানিব্যাগ থাকলে পারলে তার থাকবে না কেন ? প্রতিযোগিতা ? কি অসম প্রতিযোগিতা ? কি ভয়ংকর গ্লানিকর পরাজয় !

কই দাও, বড় সাহেবের হাতটা তখনো বাড়ানো। নিন।

রজব আলী ব্যাগটা দিয়ে বেরিয়ে যেতে চায়।

কোথায় যাও? তোমার মানিব্যাগ নিয়ে যাও-

আর যেতে পারে না সে কক্ষের বাইরে। কক্ষের ভিতরে রজব আলীর শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। বড় সাহেব মানিব্যাগটাকে উল্টেপাল্টে দেখেন। কক্ষের অন্যান্য সবাই বড় সাহেবের হাতের ব্যাগটাকে তীর্যক চোখে দেখছে। কেউ কেউ হাসছে। সে হাসির ভেতরে লুকিয়ে আছে তীক্ষ্ন কাঁটা। কাঁটায় বিষ। যা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পান করছে রজব আলী। এছাড়া তার উপায়ও নেই।

রজব আলী !

বড় সাহেবের ডাকে চোখ তুলে তাকায় সে, স্যার!

নাও তোমার মানিব্যাগ। ব্যাগটা ভালোই কিনেছো।

হাত বাড়িয়ে ব্যাগটি নিয়ে রজব আলী দরজা খুলে নিমিষে বাইরে চলে আসে। দরজা দ্বিতীয়বার বন্ধ করতে পারে না, তার আগেই বড় সাহেব এবং অন্যান্যদের হাসির ছুরি তীব্র অপমানে রজব আলীর কান এবং মর্মের মূলে আঘাত হানে। মনে হচ্ছে তাদের হাসির হলকা তাকে শান দেয়া ছুরির মতো কাটছে। আর রজব আলী নিজের রক্তে ভেসে যাচ্ছে।

রজব আলী মানিব্যাগ আর হাতে রাখে না। প্যান্টের পকেটেই রাখে। মাস শেষে মানিব্যাগের ছোট্ট খোপে খুচরো কয়েকটা মাত্র টাকা দেখতে পায় রজব আলী। মানিব্যাগে টাকা নেই, একটা পরিত্যাক্ত রুমালের মতো মনে হয় মানিব্যাগটাকে। এবং রজব আলী বুঝতে পারে- বড় সাহেবের মতো মানুষদের সঙ্গে রজব আলীরা কোনদিন, কোনোকালে পাল্লা দিয়ে টিকতে পারবে না।

মাস শেষ, রজব আলীর মানিব্যাগের টাকাও শেষ। অথচ বড় সাহেবের মানিব্যাগে মাসের প্রথম দিকে যতো টাকা ছিলো বা থাকে, এখনো সে রকমই আছে। কমে না। বরং বাড়ে। তাহাদের টাকা বাড়তেই থাকে। বাড়বে আমৃতকাল।

দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে রজব আলী।

দীর্ঘনিঃশ্বাস এবং পুঞ্জিভূত ক্ষোভ নিয়ে নিত্যদিনের স্বাভাবিক জীবনযাপন চালিয়ে যাচ্ছে রজব আলী। প্রতিদিনের জীবনাচারের সঙ্গে রজব আলী বেশ মানিয়ে নিয়েছে। মানিব্যাগটা তার সঙ্গে থাকছে প্রতিদিনকার মতো- যেমন তার পকেটে থাকছে একটি রুমাল, একটি চিরুনি।

মাসের প্রথম দিকে মানিব্যাগটা ভরা থাকে, মাঝখানের দিকে কমতে কমতে টাকা অর্ধেকেরও কমে এসে পৌঁছে এবং এই কমার গতিটা বলবৎ থাকে গাণিতিক হারে।

মাসের শেষের দিকে রজব আলী মানিব্যাগ বহন করার আর কোন যুক্তি খুঁজে পায় না। কারণ ব্যাগের তলায় পাঁচ-দশটা টাকা পড়ে থাকে বড় অযত্নে, বড় অবহেলায়। কখনো কখনো রজব আলীর মনে হয়- মানিব্যাগটা বোধহয় তাকেই উপহাস করছে। মাস খানেক পরে একদিন।

রজব আলী অফিস থেকে ফিরছে। মাস শেষের দিকে। বাসে প্রচুর ভিড়। বাসে ওঠা মানে জন্তুর খাঁচায় ওঠা। জীবন যে কতো অবাঞ্ছিত, বাসে উঠেই সেটা বুঝতে পারে রজব আলী।

বাস থেকে নেমেই হাত দেয় প্যান্টের পকেটে। পকেটটা খালি, বুকটা ধড়াস ধড়াস করে, মানিব্যাগটা নেই ! এতো সাবধানে থাকার পরও মানিব্যাগটা নিয়ে গেলো?

রজব আলী কয়েক মুহূর্ত স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। মানিব্যাগটা পকেটমার নিয়ে গ্যাছে। রজব আলী মানিব্যাগটার জন্য ভাবছে না। ভাবছে মানিব্যাগের সর্বশেষ পুরোনো ময়লা দশটি টাকা...। ওই দশ টাকা থাকলে আরো দুই দিন বাস ভাড়া দিয়ে অফিসে আসা-যাওয়া করতে পারতাম।

;