তলস্তয়ের “রেসারেকসন” ও আমাদের পাপবোধ
সম্প্রতি আমার তীব্র সময়াভাবের মধ্যেও, মুষ্ঠিচালের মতো একটু একটু করে সময় বাঁচিয়ে অবশেষে তলস্তয়ের বিশাল ও মহাকাব্যিক উপন্যাস “রেসারেকসন”-এর পাঠ শেষ করেছি। “রেসারেকসন” প্রগতি প্রকাশনের বাংলা অনুবাদে “পুনরুজ্জীবন”। অনুবাদকের পটুত্বের কথা বলতেই হবে, এ-বিষয়ে তাঁদের কুশলতায় যে কোনো সংশয় নাই সে-কথা প্রগতির অনুবাদে যাঁরা রুশ সাহিত্য ছোটবেলা থেকে পড়ে আসছেন তাঁরা সকলে কবুল করবেন। কিন্তু তিনখণ্ডে সমাপ্ত সাতশো পৃষ্ঠার বইখানা কেবলমাত্র অনুবাদের গুণে নয়, স্বয়ং তলস্তয়ই আমার মতো ভক্তকে যে কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেছেন শেষ অবধি—সেই কথাটা আগেভাগে জানিয়ে রাখছি। সারা বিশ্বের মহাজনদের কাতারে অন্ততঃপক্ষে তাঁর ভক্তকূলের মধ্যে আমিও যে সামিল সে কথাটাও সবিনয়ে বলি; মহাত্মা গান্ধী যেমনটা জানিয়েছেন: “তলস্তয়ের প্রতি আমার সম্পর্ক—একনিষ্ঠ ভক্তের সম্পর্ক। জীবনের অনেক কিছুর জন্যে আমি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ।”
“রেসারেকসন” তলস্তয়ের শেষ বয়সে—একটানা দশ বছর ধরে লেখা পূর্ণাঙ্গ রচনা। ইতোমধ্যে ওয়ার এন্ড পিস ও আনা ক্যারেনিনা লিখে কাল জয় করে ফেলেছেন তিনি, তাঁর মাথায় শোভা পাচ্ছে বিশ্বসাহিত্যে সর্বকালের সেরা ঔপন্যাসিকের রাজমুকুট। কিন্তু শ্রেষ্ঠত্বের বুঝি আরো খানিকটা বাকি ছিল—রেসারেকসন লিখে তা পূর্ণ হলো। সকলেই, নিদেনপক্ষে কষ্ট করে (!) পড়েছেন যাঁরা, তাঁরা জানেন বইটিতে কী আছে পাতায় পাতায়, পরতে পরতে। ঊনবিংশ শতাব্দীর রুশীয় সমাজজীবনে এক জমিদার-তনয় প্রিন্স নেখলিউদভ ও “নিম্ন” শ্রেণীভুক্ত এক নারী মাসলোভার অসম প্রেম পরিণতি পায় না। প্রেমিকের প্রগলভতায় ভীরু ও নিরুপায় কিশোরী অন্তঃসত্ত্বা ও সামাজিকভাবে পরিত্যক্ত হয়ে দেহপসারিণীর জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়। অপরাধজগতের পাকচক্রে মিথ্যা মামলায় দণ্ডিত হয়ে সাইবেরিয়ায় নির্বাসন সাব্যস্ত হয় তার। মাসলোভার বিচারকার্জের অন্যতম জুরি প্রিন্স নেখলিউদভ কাঠগড়ায় মাসলোভাকে দেখে প্রথমে অপরাধবোধ ও পরে তীব্র পাপবোধে আক্রান্ত হয়। ধীরে ধীরে তার মধ্যে পরিবর্তনের সূচনা ঘটে। অনুশোচনায় তাড়িত প্রিন্স মাসলোভাকে বিবাহের প্রস্তাব দিয়েই ক্ষান্ত হয় না, নানান মিথ্যা অজুহাতে দণ্ডিত আরো অসংখ্য কয়েদির সঙ্গে পথের কষ্ট-ক্লেশ উপেক্ষা করে মাসলোভার সঙ্গে সুদূর সাইবেরিয়ায় পাড়ি জমায়। মাসলোভার মিথ্যা দণ্ড মওকুবের জন্য নিজের প্রভাব খাটিয়ে প্রিন্স নেখলিউদভ বিচার ও আইন কর্তৃপক্ষের সর্বোচ্চ পর্যায় এমনকি খোদ জার সম্রাটের কাছে আবেদনপত্র পেশ করে। নিজের জীবনকেও পাল্টে ফেলে প্রিন্স, নিজ জমিদারীর তাবৎ সম্পত্তি কৃষকদের (প্রজাদের) মধ্যে বিলি করে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়, ত্যাগ করে বিলাস-ব্যসন, চ্যালেঞ্জ করে সমাজের উঁচু তলায় এমনকি নিজের একান্ত ঘনিষ্ঠ পারিবারিক সম্পর্কও। ওদিকে মাসলোভারও ঘটে পরিবর্তন। “পুনরুজ্জীবন” এই আভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের বা বদলে-যাওয়ার গল্প। মোটা দাগে এটুকু ছাড়াও মূল কাহিনীর পাশাপাশি রয়েছে আরো আরো কাহিনী, আরো অনেক অনেক চরিত্র—তাদের জীবনের পতন কিংবা জাগরণ, সবটা মিলে বহুবর্ণিল এক মানবিক উপাখ্যান।
কিন্তু কেবলমাত্র অসাধারণ কাহিনী-কাঠামোর জন্য নয়, “পুনরুজ্জীবন”-এর জোর বিপ্লব-পূর্ব রুশ সমাজব্যবস্থার যে মঞ্চে এই কাহিনী ও এর কুশীলবরা আবর্তিত হয়েছে সেই সমাজব্যবস্থার স্বরূপ উদঘাটনে। কারাগারের স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকারে মিথ্যা সাজায় দণ্ডিত দরিদ্র রুশীয় নারী, পুরুষ ও শিশুর যে অবর্ণনীয় দুর্দশা, তার পশ্চাতে নিয়োজিত খ্রিস্টধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক বাতাবরণে নিরাপদ এক নিষ্ঠুর, পরাক্রান্ত অভিজাত আমলাতন্ত্র—এর প্রায় পুরোটাই তুলে এনেছেন তলস্তয় তাঁর অসাধারণ বর্ণনায়। একই সমান্তরালভাবে বর্ণিত হয়েছে বিশাল রাশিয়ার শোষিত কৃষক সমাজের কায়ক্লেশে বেঁচে থাকার অনুপুঙ্খ আলেখ্য। দেশ-জুড়ে ছড়িয়ে-পড়া নানান ভিন্নমতাবলম্বী বিপ্লবী রাজবন্দীর কাহিনী বর্ণনার মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে বিপ্লব-পূর্ব প্রস্তুতির কথাও। কলমের নিপুণ আঁচড়ে মহান শিল্পী যে সম্জাব্যবস্থার বিবরণী তুলে এনেছেন তা যেন যথার্থই অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছে বলশেভিক বিপ্লব; বস্তুত এ ছিল এমনি এক সমাজব্যবস্থা যাতে আর সামান্য পরিমাণ ধাক্কা দেওয়া বাকি। প্রলেতারীয় লেখক ম্যাক্সিম গোর্কি নেখলিউদভের চরিত্রের সঙ্গে স্বয়ং তলস্তয়ের চরিত্রকে একাত্ম করে দেখেছেন। নিজ সমাজব্যবস্থার স্বরূপ উদঘাটনে তলস্তয়ের দেনা স্বীকার করতে গিয়ে বিপ্লবী প্রলেতারীয় লেখক ম্যাক্সিম গোর্কি লিখেছেন : “প্রিন্স নেখলিউদভ ৬০ বছর ধরে রাশিয়ার বুকে ঘুরে বেড়িয়েছে। ৬০ বছর ধরে ধ্বনিত হয়েছে সুকঠোর ন্যায়ের কণ্ঠস্বর, উদঘাটন করেছে সকলের এবং সবকিছুর স্বরূপ। আমাদের বাদবাকি সমস্ত সাহিত্যসৃষ্টি মিলে রুশ জীবনের যতটা বর্ণনা করেছে প্রায় ততটাই বর্ণিত হয়েছে এতে।”
বার্তা২৪.কম-এর শিল্প-সাহিত্য বিভাগে লেখা পাঠানোর ঠিকানা
[email protected]
কিন্তু “পুনরুজ্জীবন”-এর অন্বিষ্ট শুধু সমাজব্যবস্থার উত্তরণ নয়; একই সাথে এ হলো ব্যক্তির নৈতিকতার উজ্জীবন, পাপবোধ থেকে এক শুভ্র সমুজ্জ্বল পবিত্র বোধে উত্থান। তলস্তয় উপন্যাসের পরতে পরতে দেখিয়েছেন কী করে তৃপ্ত, ভোগী, সম্রাটের চাটুকার আমলাশ্রেণী, সেনা, পুলিশ বাহিনী ও নতজানু পুরোহিত শ্রেণী নিজেদের কর্তৃত্ব ও ভোগের প্রয়োজনে এই সর্বত্র-জারি বিচার, দণ্ডনীতি ও জমিদারী ব্যবস্থা চালু রেখেছে। প্রাসাদোপম গির্জায় খ্রিস্টধর্মের জাঁকালো আনুষ্ঠানিকতার মোড়কে ও মহামান্য সম্রাটের পৃষ্ঠপোষকতায় এই অন্যায্যতা ও পাপ নিয়ত সংঘটিত হয়ে চলেছে; কিন্তু তার জন্য বিন্দুমাত্র অনুশোচনা ও পাপবোধ তো কোথাও নেই! উপন্যাসে নেখলিউদভ তথা তলস্তয়ের মূল জিজ্ঞাসা সেখানেই। তাঁর মতে মানুষ এই পাপাচারের উর্ধ্বে উঠতে না পারলে তার পুনরুত্থান সম্ভব নয়। ব্যাক্তির নৈতিক ও আত্মিক পরিশুদ্ধি না ঘটলে সামাজিক মুক্তির স্বপ্নও অলীক, অবান্তর। অবশেষে নিজেকে সব পাপাচার থেকে মুক্ত করে, খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাস স্থাপনের মধ্য দিয়ে নেখলিউদভ নিজেকে মুক্ত করার উপায় খুঁজে পায়।
“খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাস স্থাপনের মধ্য দিয়ে নেখলিউদভের নিজেকে মুক্ত করার উপায় খুঁজে পাওয়ার” জন্য তলস্তয় সুদীর্ঘ উপন্যাসে মাত্র একটি ক্ষুদ্র অধ্যায় ব্যয় করেছেন—বইটির শেষ অধ্যায়। আমার কাছে মনে হয়েছে বইটির শেষ অধ্যায় না থাকলেও বইটির যেন খুব ক্ষতি হতো না। লেখকও কি জানতেন সে-কথা? কেন না, মূল কাহিনী ও চরিত্রগুলির স্বাভাবিক পরিণতি লেখক আগের অধ্যায়েই যেন শেষ করেছেন। বইটি পাঠের পর প্যারিস রিভিউ, দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট, তলস্তয় রিসার্চ সেন্টারসহ নামজাদা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা ঘেঁটে দেখেছি—আরো অনেকে বইটির শেষ অধ্যায়টি কবুল করেননি; এ-ব্যাপারে আমার অভিমতের সঙ্গে পুরোপুরি খাপ খেয়েছে দি ইন্ডিপেডেন্টের আলোচনা ।
২.
“পুনরুজ্জীবন” পড়তে পড়তে আমাকে বারবার খুঁচিয়ে মেরেছে যে-প্রশ্ন তা হলো, প্রায় একই বিষয় ও প্রেক্ষাপট নিয়ে আমাদের এখানে কেন এমন সাহিত্য রচিত হলো না! কেন আজও রচিত হলো না এই যে আমাদের বিশাল গ্রামীণ সমাজ, মুসলিম ধর্মীয় বিশ্বাসে ভীরু কৃষক শ্রেণী, [স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরও] তাদের ওপর চেপে-বসা শ্রেণীশোষণ, মোল্লাতন্ত্র আর তাদের দোসর উঁচুতলার সমাজ যারা কিনা একই ধর্মীয় বিশ্বাসে সামিল, কিন্তু নিজেদের কৃতকর্মের জন্য পাপবোধে এতটুকু কাহিল নয়—এইসব নিয়ে একটা পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস? এই রকম একটা প্রশ্ন আত্মজিজ্ঞাসার মতো আমাকে নিয়ত খুঁচিয়ে মারে! “পুনরুজ্জীবন”-এর মতো এরকম একটা সহজ ও সাবলীল আলেখ্য আমাদের ভাষায়ও রচিত ও বহুলপঠিত হলে আমরা আপন দর্পণে দেখতে পেতাম নিজেদের চেহারা অর্থাৎ কে আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি আর তাহলে নিজেদের সমাজ সংস্কারের কাজটাও ঠিক কিভাবে শুরু হতে পারে তার একটা দিকনির্দেশনা পাওয়া যেত।
আবার পাশাপাশি এটুকু ভেবেও হতাশা বোধ করি—তাৎক্ষণিকতার এই যুগে এত বড় উপন্যাস লেখার দরকারই বা কী আর তার পাঠকই বা কোথায়—সমাজ সংস্কারের এজেন্ডা নিয়ে মিডিয়া তো আসর সরগরম রাখছেই। সত্যি বলতে কী, আমরা তো আর তলস্তয়ের যুগে পড়ে নেই! আমি না হয় প্রথম যৌবনের খোঁয়াড়িতে আটকে আছি বলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা গলাধকরণ করছি: রেসারেকশনে তলস্তয় পাতার পর পাতা ব্যয় করেছেন শুধু নেখলিউদভের মনোবিশ্লেষণে, প্রচলিত নীতি-নৈতিকতার সঙ্গে তার সংঘাত ও সংশ্লেষের বর্ণনায়। প্রতিটি ঘটনা, দৃশ্য ও চরিত্রের জন্য লেখক ব্যয় করেছেন গভীর অভিনিবেশ, শ্রম ও নিষ্ঠা দিয়েছেন, প্রতিটি চরিত্রকে দিয়েছেন স্বতন্ত্র মর্যাদা। খুঁটিনাটি বর্ননায় তা এমনই জীবন্ত ও বাস্তবানুগ যে একলহমায় তারা এক শতাব্দী পাড়ি দিয়ে, তাদের খিটিমিটি নামের বানান উপেক্ষা করেও কী দিব্যি আমার পড়ার টেবিলের চারিধারে সমবেত হয়েছে আর ঝুঁকে পড়েছে আমার দিকে : “আজি হতে শতবর্ষ পরে, কে তুমি...!”
কিন্তু কারই বা এমন দায় পড়েছে আজকাল অমন ভক্তির—সে-কথার অকাট্য প্রমাণও যে আছে একটা! কিছুকাল আগে এক পাঠিকা বান্ধবীকে পড়ার জন্য ধার দিয়েছিলাম বইটি (অখণ্ড সংস্করণ)। তিনি ক’দিন নেড়েচেড়ে ফেরত দিতে গিয়ে লঘুস্বরে বলছিলেন : আচ্ছা, বইটির একটি সংক্ষিপ্ত রূপও তো লেখক লিখে যেতে পারতেন। এতে সময় যেমন বাঁচত, আমরাও মহান লেখকের সান্নিধ্য সুখ পেতাম!
এই রকম অকাট্য প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও আমার আক্ষেপ থেকেই যায় : আমাদের সাহিত্যে “রেসারেকসন” বা “পুনরুজ্জীবন”-এর মতো একটি মহাগ্রন্থের অভাবে নিজেদের পাপবোধ থেকে আমরা কত দূরেই না আছি!