তলস্তয়ের “রেসারেকসন” ও আমাদের পাপবোধ



সৈয়দ কামরুল হাসান
অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

সম্প্রতি আমার তীব্র সময়াভাবের মধ্যেও, মুষ্ঠিচালের মতো একটু একটু করে সময় বাঁচিয়ে অবশেষে তলস্তয়ের বিশাল ও মহাকাব্যিক উপন্যাস “রেসারেকসন”-এর পাঠ শেষ করেছি। “রেসারেকসন” প্রগতি প্রকাশনের বাংলা অনুবাদে “পুনরুজ্জীবন”। অনুবাদকের পটুত্বের কথা বলতেই হবে, এ-বিষয়ে তাঁদের কুশলতায় যে কোনো সংশয় নাই সে-কথা প্রগতির অনুবাদে যাঁরা রুশ সাহিত্য ছোটবেলা থেকে পড়ে আসছেন তাঁরা সকলে কবুল করবেন। কিন্তু তিনখণ্ডে সমাপ্ত সাতশো পৃষ্ঠার বইখানা কেবলমাত্র অনুবাদের গুণে নয়, স্বয়ং তলস্তয়ই আমার মতো ভক্তকে যে কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেছেন শেষ অবধি—সেই কথাটা আগেভাগে জানিয়ে রাখছি। সারা বিশ্বের মহাজনদের কাতারে অন্ততঃপক্ষে তাঁর ভক্তকূলের মধ্যে আমিও যে সামিল সে কথাটাও সবিনয়ে বলি; মহাত্মা গান্ধী যেমনটা জানিয়েছেন: “তলস্তয়ের প্রতি আমার সম্পর্ক—একনিষ্ঠ ভক্তের সম্পর্ক। জীবনের অনেক কিছুর জন্যে আমি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ।”

“রেসারেকসন” তলস্তয়ের শেষ বয়সে—একটানা দশ বছর ধরে লেখা পূর্ণাঙ্গ রচনা। ইতোমধ্যে ওয়ার এন্ড পিস ও আনা ক্যারেনিনা লিখে কাল জয় করে ফেলেছেন তিনি, তাঁর মাথায় শোভা পাচ্ছে বিশ্বসাহিত্যে সর্বকালের সেরা ঔপন্যাসিকের রাজমুকুট। কিন্তু শ্রেষ্ঠত্বের বুঝি আরো খানিকটা বাকি ছিল—রেসারেকসন লিখে তা পূর্ণ হলো। সকলেই, নিদেনপক্ষে কষ্ট করে (!) পড়েছেন যাঁরা, তাঁরা জানেন বইটিতে কী আছে পাতায় পাতায়, পরতে পরতে। ঊনবিংশ শতাব্দীর রুশীয় সমাজজীবনে এক জমিদার-তনয় প্রিন্স নেখলিউদভ ও “নিম্ন” শ্রেণীভুক্ত এক নারী মাসলোভার অসম প্রেম পরিণতি পায় না। প্রেমিকের প্রগলভতায় ভীরু ও নিরুপায় কিশোরী অন্তঃসত্ত্বা ও সামাজিকভাবে পরিত্যক্ত হয়ে দেহপসারিণীর জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়। অপরাধজগতের পাকচক্রে মিথ্যা মামলায় দণ্ডিত হয়ে সাইবেরিয়ায় নির্বাসন সাব্যস্ত হয় তার। মাসলোভার বিচারকার্জের অন্যতম জুরি প্রিন্স নেখলিউদভ কাঠগড়ায় মাসলোভাকে দেখে প্রথমে অপরাধবোধ ও পরে তীব্র পাপবোধে আক্রান্ত হয়। ধীরে ধীরে তার মধ্যে পরিবর্তনের সূচনা ঘটে। অনুশোচনায় তাড়িত প্রিন্স মাসলোভাকে বিবাহের প্রস্তাব দিয়েই ক্ষান্ত হয় না, নানান মিথ্যা অজুহাতে দণ্ডিত আরো অসংখ্য কয়েদির সঙ্গে পথের কষ্ট-ক্লেশ উপেক্ষা করে মাসলোভার সঙ্গে সুদূর সাইবেরিয়ায় পাড়ি জমায়। মাসলোভার মিথ্যা দণ্ড মওকুবের জন্য নিজের প্রভাব খাটিয়ে প্রিন্স নেখলিউদভ বিচার ও আইন কর্তৃপক্ষের সর্বোচ্চ পর্যায় এমনকি খোদ জার সম্রাটের কাছে আবেদনপত্র পেশ করে। নিজের জীবনকেও পাল্টে ফেলে প্রিন্স, নিজ জমিদারীর তাবৎ সম্পত্তি কৃষকদের (প্রজাদের) মধ্যে বিলি করে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়, ত্যাগ করে বিলাস-ব্যসন, চ্যালেঞ্জ করে সমাজের উঁচু তলায় এমনকি নিজের একান্ত ঘনিষ্ঠ পারিবারিক সম্পর্কও। ওদিকে মাসলোভারও ঘটে পরিবর্তন। “পুনরুজ্জীবন” এই আভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের বা বদলে-যাওয়ার গল্প। মোটা দাগে এটুকু ছাড়াও মূল কাহিনীর পাশাপাশি রয়েছে আরো আরো কাহিনী, আরো অনেক অনেক চরিত্র—তাদের জীবনের পতন কিংবা জাগরণ, সবটা মিলে বহুবর্ণিল এক মানবিক উপাখ্যান।

কিন্তু কেবলমাত্র অসাধারণ কাহিনী-কাঠামোর জন্য নয়, “পুনরুজ্জীবন”-এর জোর বিপ্লব-পূর্ব রুশ সমাজব্যবস্থার যে মঞ্চে এই কাহিনী ও এর কুশীলবরা আবর্তিত হয়েছে সেই সমাজব্যবস্থার স্বরূপ উদঘাটনে। কারাগারের স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকারে মিথ্যা সাজায় দণ্ডিত দরিদ্র রুশীয় নারী, পুরুষ ও শিশুর যে অবর্ণনীয় দুর্দশা, তার পশ্চাতে নিয়োজিত খ্রিস্টধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক বাতাবরণে নিরাপদ এক নিষ্ঠুর, পরাক্রান্ত অভিজাত আমলাতন্ত্র—এর প্রায় পুরোটাই তুলে এনেছেন তলস্তয় তাঁর অসাধারণ বর্ণনায়। একই সমান্তরালভাবে বর্ণিত হয়েছে বিশাল রাশিয়ার শোষিত কৃষক সমাজের কায়ক্লেশে বেঁচে থাকার অনুপুঙ্খ আলেখ্য। দেশ-জুড়ে ছড়িয়ে-পড়া নানান ভিন্নমতাবলম্বী বিপ্লবী রাজবন্দীর কাহিনী বর্ণনার মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে বিপ্লব-পূর্ব প্রস্তুতির কথাও। কলমের নিপুণ আঁচড়ে মহান শিল্পী যে সম্জাব্যবস্থার বিবরণী তুলে এনেছেন তা যেন যথার্থই অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছে বলশেভিক বিপ্লব; বস্তুত এ ছিল এমনি এক সমাজব্যবস্থা যাতে আর সামান্য পরিমাণ ধাক্কা দেওয়া বাকি। প্রলেতারীয় লেখক ম্যাক্সিম গোর্কি নেখলিউদভের চরিত্রের সঙ্গে স্বয়ং তলস্তয়ের চরিত্রকে একাত্ম করে দেখেছেন। নিজ সমাজব্যবস্থার স্বরূপ উদঘাটনে তলস্তয়ের দেনা স্বীকার করতে গিয়ে বিপ্লবী প্রলেতারীয় লেখক ম্যাক্সিম গোর্কি লিখেছেন : “প্রিন্স নেখলিউদভ ৬০ বছর ধরে রাশিয়ার বুকে ঘুরে বেড়িয়েছে। ৬০ বছর ধরে ধ্বনিত হয়েছে সুকঠোর ন্যায়ের কণ্ঠস্বর, উদঘাটন করেছে সকলের এবং সবকিছুর স্বরূপ। আমাদের বাদবাকি সমস্ত সাহিত্যসৃষ্টি মিলে রুশ জীবনের যতটা বর্ণনা করেছে প্রায় ততটাই বর্ণিত হয়েছে এতে।”


বার্তা২৪.কম-এর শিল্প-সাহিত্য বিভাগে লেখা পাঠানোর ঠিকানা
[email protected]


কিন্তু “পুনরুজ্জীবন”-এর অন্বিষ্ট শুধু সমাজব্যবস্থার উত্তরণ নয়; একই সাথে এ হলো ব্যক্তির নৈতিকতার উজ্জীবন, পাপবোধ থেকে এক শুভ্র সমুজ্জ্বল পবিত্র বোধে উত্থান। তলস্তয় উপন্যাসের পরতে পরতে দেখিয়েছেন কী করে তৃপ্ত, ভোগী, সম্রাটের চাটুকার আমলাশ্রেণী, সেনা, পুলিশ বাহিনী ও নতজানু পুরোহিত শ্রেণী নিজেদের কর্তৃত্ব ও ভোগের প্রয়োজনে এই সর্বত্র-জারি বিচার, দণ্ডনীতি ও জমিদারী ব্যবস্থা চালু রেখেছে। প্রাসাদোপম গির্জায় খ্রিস্টধর্মের জাঁকালো আনুষ্ঠানিকতার মোড়কে ও মহামান্য সম্রাটের পৃষ্ঠপোষকতায় এই অন্যায্যতা ও পাপ নিয়ত সংঘটিত হয়ে চলেছে; কিন্তু তার জন্য বিন্দুমাত্র অনুশোচনা ও পাপবোধ তো কোথাও নেই! উপন্যাসে নেখলিউদভ তথা তলস্তয়ের মূল জিজ্ঞাসা সেখানেই। তাঁর মতে মানুষ এই পাপাচারের উর্ধ্বে উঠতে না পারলে তার পুনরুত্থান সম্ভব নয়। ব্যাক্তির নৈতিক ও আত্মিক পরিশুদ্ধি না ঘটলে সামাজিক মুক্তির স্বপ্নও অলীক, অবান্তর। অবশেষে নিজেকে সব পাপাচার থেকে মুক্ত করে, খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাস স্থাপনের মধ্য দিয়ে নেখলিউদভ নিজেকে মুক্ত করার উপায় খুঁজে পায়।

“খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাস স্থাপনের মধ্য দিয়ে নেখলিউদভের নিজেকে মুক্ত করার উপায় খুঁজে পাওয়ার” জন্য তলস্তয় সুদীর্ঘ উপন্যাসে মাত্র একটি ক্ষুদ্র অধ্যায় ব্যয় করেছেন—বইটির শেষ অধ্যায়। আমার কাছে মনে হয়েছে বইটির শেষ অধ্যায় না থাকলেও বইটির যেন খুব ক্ষতি হতো না। লেখকও কি জানতেন সে-কথা? কেন না, মূল কাহিনী ও চরিত্রগুলির স্বাভাবিক পরিণতি লেখক আগের অধ্যায়েই যেন শেষ করেছেন। বইটি পাঠের পর প্যারিস রিভিউ, দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট, তলস্তয় রিসার্চ সেন্টারসহ নামজাদা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা ঘেঁটে দেখেছি—আরো অনেকে বইটির শেষ অধ্যায়টি কবুল করেননি; এ-ব্যাপারে আমার অভিমতের সঙ্গে পুরোপুরি খাপ খেয়েছে দি ইন্ডিপেডেন্টের আলোচনা ।

২.
“পুনরুজ্জীবন” পড়তে পড়তে আমাকে বারবার খুঁচিয়ে মেরেছে যে-প্রশ্ন তা হলো, প্রায় একই বিষয় ও প্রেক্ষাপট নিয়ে আমাদের এখানে কেন এমন সাহিত্য রচিত হলো না! কেন আজও রচিত হলো না এই যে আমাদের বিশাল গ্রামীণ সমাজ, মুসলিম ধর্মীয় বিশ্বাসে ভীরু কৃষক শ্রেণী, [স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরও] তাদের ওপর চেপে-বসা শ্রেণীশোষণ, মোল্লাতন্ত্র আর তাদের দোসর উঁচুতলার সমাজ যারা কিনা একই ধর্মীয় বিশ্বাসে সামিল, কিন্তু নিজেদের কৃতকর্মের জন্য পাপবোধে এতটুকু কাহিল নয়—এইসব নিয়ে একটা পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস? এই রকম একটা প্রশ্ন আত্মজিজ্ঞাসার মতো আমাকে নিয়ত খুঁচিয়ে মারে! “পুনরুজ্জীবন”-এর মতো এরকম একটা সহজ ও সাবলীল আলেখ্য আমাদের ভাষায়ও রচিত ও বহুলপঠিত হলে আমরা আপন দর্পণে দেখতে পেতাম নিজেদের চেহারা অর্থাৎ কে আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি আর তাহলে নিজেদের সমাজ সংস্কারের কাজটাও ঠিক কিভাবে শুরু হতে পারে তার একটা দিকনির্দেশনা পাওয়া যেত।

আবার পাশাপাশি এটুকু ভেবেও হতাশা বোধ করি—তাৎক্ষণিকতার এই যুগে এত বড় উপন্যাস লেখার দরকারই বা কী আর তার পাঠকই বা কোথায়—সমাজ সংস্কারের এজেন্ডা নিয়ে মিডিয়া তো আসর সরগরম রাখছেই। সত্যি বলতে কী, আমরা তো আর তলস্তয়ের যুগে পড়ে নেই! আমি না হয় প্রথম যৌবনের খোঁয়াড়িতে আটকে আছি বলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা গলাধকরণ করছি: রেসারেকশনে তলস্তয় পাতার পর পাতা ব্যয় করেছেন শুধু নেখলিউদভের মনোবিশ্লেষণে, প্রচলিত নীতি-নৈতিকতার সঙ্গে তার সংঘাত ও সংশ্লেষের বর্ণনায়। প্রতিটি ঘটনা, দৃশ্য ও চরিত্রের জন্য লেখক ব্যয় করেছেন গভীর অভিনিবেশ, শ্রম ও নিষ্ঠা দিয়েছেন, প্রতিটি চরিত্রকে দিয়েছেন স্বতন্ত্র মর্যাদা। খুঁটিনাটি বর্ননায় তা এমনই জীবন্ত ও বাস্তবানুগ যে একলহমায় তারা এক শতাব্দী পাড়ি দিয়ে, তাদের খিটিমিটি নামের বানান উপেক্ষা করেও কী দিব্যি আমার পড়ার টেবিলের চারিধারে সমবেত হয়েছে আর ঝুঁকে পড়েছে আমার দিকে : “আজি হতে শতবর্ষ পরে, কে তুমি...!”

কিন্তু কারই বা এমন দায় পড়েছে আজকাল অমন ভক্তির—সে-কথার অকাট্য প্রমাণও যে আছে একটা! কিছুকাল আগে এক পাঠিকা বান্ধবীকে পড়ার জন্য ধার দিয়েছিলাম বইটি (অখণ্ড সংস্করণ)। তিনি ক’দিন নেড়েচেড়ে ফেরত দিতে গিয়ে লঘুস্বরে বলছিলেন : আচ্ছা, বইটির একটি সংক্ষিপ্ত রূপও তো লেখক লিখে যেতে পারতেন। এতে সময় যেমন বাঁচত, আমরাও মহান লেখকের সান্নিধ্য সুখ পেতাম!

এই রকম অকাট্য প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও আমার আক্ষেপ থেকেই যায় : আমাদের সাহিত্যে “রেসারেকসন” বা “পুনরুজ্জীবন”-এর মতো একটি মহাগ্রন্থের অভাবে নিজেদের পাপবোধ থেকে আমরা কত দূরেই না আছি!

   

দুই দেশের রং মিলেছে এক দেয়ালে



মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, ব্যাংকক, থাইল্যান্ড
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

রঙের শহর, হাসির শহর ব্যাংকক। দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ করা শহর ব্যাংকক। ব্যাংককের প্রাণকেন্দ্র সিয়ামেই রয়েছে ব্যাংকক র্আট এন্ড কালচারাল সেন্টার (বিএসিসি)। বাংলাদেশ থেকে যারা ব্যাংককে বেড়াতে যান, তারা যদি এমবিকে মলের পাশ দিয়ে স্কাই ওয়াক হয়ে তৃতীয় তলায় প্রবেশ করেন তাহলে হাতের ডানে চোখ ফেললেই দেখতে পাবেন বাংলাদেশের রংয়ের খেলা আর জীবনযাত্রার চিত্র।

স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে গত ২৬ র্মাচ থেকে ব্যাংককের র্আট এন্ড কালচারাল সেন্টারে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ ও থাই চিত্রশিল্পীদের অংশগ্রহণে ‘ড্রীম অব কালারস’ বা ‘রংয়ের স্বপ্ন’ র্শীষক চিত্র প্রর্দশনী। ‘কানেক্টিং টু ল্যান্ডস এন্ড টুপিপলস’স্লোগানকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের নিমিত্তেই এই আয়োজন।


তৃতীয় তলার করিডোর ধরে হাঁটতেই চোখে পড়বে শিল্পী মুস্তাফিজুল হকের নিহঙ্গ। ওয়াসি পেপারের ওপর জাপানি ধরনের চিত্রকর্মের জন্য প্রসিদ্ধ তিনি। ক্যানভাসের ওপর আর্কিলিকের চিত্রকর্ম ‘হর্স’ মনযোগ আকর্ষন করছিল দর্শনার্থীদের। তার চিত্রকর্মের বড় বৈশিষ্ঠ নাটকীয়তা এবং বিষয়ের গভীর উপস্থিতি।

নগরের জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলতে শিল্পী কামাল উদ্দিনের জুড়ি নেই। তবে এখানে ব্যক্তির প্রোট্রেট নয় বরং পেস্টেলে তবলার রং ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী।

আবার থামাসাত বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রকলার শিক্ষক খাজোনসাক মাহাকুন্নাওয়ানের তুলিতে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নগরের জীবন। রিকশার সঙ্গে যাত্রীদের ছুটে চলা। সময়কে যেন পাশ কাটিয়ে ছুটে চলছে তার চিত্রকর্ম।


ঢাকার গ্যালারি চিত্রকের ১৮ জন শিল্পী এবং থামাসাত ইউনিভার্সিটির ফাইন এন্ড এপ্লাইড আর্টস বিভাগের ৪ জন শিল্পীর যৌথ অংশগ্রহণে চলছে এই আয়োজন। চলবে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত। গত ২৬ মার্চ চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন থাইল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহা. আব্দুল হাই।

চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন নিয়ে তিনি বলেন, দুটি দেশের ভূমি আর মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে এনেছে এই আয়োজন। চিত্রকর্মের মাধ্যমে যে যোগাযোগ সেটা শুধু বাহ্যিক নয়, বরং আত্মার যোগাযোগ। শুধু দেশকে চেনায় না, বরং সেখানকার জীবনযাত্রার ধারণা দেয়, মানুষকে কাছে নিয়ে আসে।


ব্যাংককের বাংলাদেশ দূতাবাসের এই চিত্রপ্রদর্শনীতে রফিকুন্নবী, আব্দুস সাকুর শাহ, সৈয়দ আবুল বার্ক আলভি, শেখ আফজাল, মাহফুজুর রহমান, সুমনা হক, মুনিরুজ্জামান, জহির উদ্দিন, কনক চাপা চাকমা, বিপাশা হায়াত, মোহাম্মদ ইউনুস, সুলেখা চৌধুরী, রেজাউন নবী, কামাল উদ্দিন, পারভীন জামান, সুমন ওয়াহিদ, মোস্তাফিজুল হক, আহমেদ সামসুদ্দোহার চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে।

এছাড়াও থাইল্যান্ডের চিত্রশিল্পী খাওজনসাক মাহাকুন্নাওয়ান, ওয়ারাপান সামপাও, জিরাতচায়া ওয়ানচান, প্রারুনরপ প্রিউসোপির চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে।

ব্যাংকক আর্ট এন্ড কালচারাল সেন্টারে সকাল থেকেই বিভিন্ন বয়সী শিল্প প্রিয় মানুষের আনাগোনা থাকে। সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই প্রদর্শনী উপভোগ করতে পারছেন দর্শনার্থীরা।

;

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসবিদ-দার্শনিক মুঈন উদ-দীন আহমদ খান জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন এক মনীষীর নাম। বাংলাদেশের বিদ্যাবৃত্তে ক্লাসিক্যাল চরিত্রের শেষ দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। ২৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার) ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। 

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান (১৮ এপ্রিল, ১৯২৫-২৮ মার্চ, ২০২১) নির্জলা তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের খোঁজে সুদীর্ঘ জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চার কষ্টসাধ্য দিনগুলো অতিবাহিত করেন নি। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের সত্য সন্ধান শুধু তথ্য আর যুক্তি ভিত্তিক নয়। প্রকৃত ইতিহাস মূলত ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাসের পুনর্গঠন, কল্পনা, সমকালীন পর্যালোচনা ও ইনটুইশনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সান্নিধ্যে এলে সবাই এই সত্য টের পেতেন যে, ইতিহাস প্রধানত দর্শন ও সাহিত্যের সমধর্মীতায় বর্তমানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণের এবং দিকনির্দেশনা দেওয়ার অপরিহার্য মাধ্যম। তাঁর স্বকীয় চিন্তার দ্যুতিতে তিনি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা চর্চা ও গবেষণায় একটি বিশিষ্ট ধারার প্রতিভূ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং একটি পুরো জীবন সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাচর্চার ধ্যানজ্ঞানে যাপন করেছেন। আর চট্টগ্রামের নিরিখে তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা কাঠামোর আদি নির্মাতাদের অন্যতম। যেমনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র ড. আবদুল করিম ছিলেন ইতিহাসচর্চার প্রতিষ্ঠাতা, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইংরেজির, ড. আর. আই চৌধুরী রাজনীতি বিজ্ঞানের, তেমনিভাবে তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবদ্ধ বিদ্যাচর্চা ধারার সূচনাকারী। চট্টগ্রামের আধুনিক উচ্চশিক্ষা বিস্তারের আদি মুঘলদের একজন ছিলেন তিনি।  

তিনি ছিলেন আড়ম্বরহীন জ্ঞানসাধক। নিজস্ব বিদ্যাবলয়ের বাইরে তাঁর কোনও আত্মপ্রচার বা আত্মগরিমা ছিল না। যদিও তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা তাঁর আশেপাশে খুব বেশি ছিল না, তথাটি যারা তাঁর রচনা খেয়াল করে পড়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে কিংবা অনানুষ্ঠানিক পরিসরে আলাপ, আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্কের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন, কত ভাষা, কত বিষয়, কত তত্ত্ব ও তথ্যাদি সম্পর্কে অনায়াস দক্ষতা ও পা-িত্য ছিল প্রাচ্যদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের এই জ্ঞানতাপসের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের আদিবাস আর পুরনো চট্টগ্রাম শহরের রুমঘাটা থেকে এই মান্যবর জ্ঞানবৃদ্ধের কাছ থেকে বিচ্যুরিত দীপ্তি কিছু কিছু অনুভব স্পর্শ করেছে দেশে-বিদেশে তাঁর কর্ম ও গবেষণা ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

তাঁর জ্ঞান, গবেষণা, মনীষা, বুদ্ধির দীপ্তি, বহু ভাষায় পারঙ্গমতা তাঁর সমকালে অন্য কারও মধ্যে বিশেষ পরিলক্ষিত হয় নি। বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চায় প্রবাদপ্রতীম ড. আহমদ হাসান দানি যে তিনজন ছাত্রকে গবেষণায় প্রণোদিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান তাঁদের একজন। অন্য দুইজন হলেন আবদুল করিম ও মোহর আলী। এই তিনজনই বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় সত্যিকারের মৌলিক অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে প্রথম বিভাগ, স্বর্ণপদক, ফেলোশিপ ও বৃত্তি লাভ করেন একজন মেধাবী ছাত্র রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর তিনি মোটেই থেমে থাকেন নি। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ফিরে এসে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানির তত্ত্বাবধানে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ বিষয়ে পথপ্রদর্শনকারী পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ফেলোশিপ লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলের ‘ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ রাজনীতি বিজ্ঞানের ‘সেমিনার ইন ফিল্ড ওয়ার্ক কোর্স’ অধ্যয়ন করেন। তিনি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রখ্যাত প-িত, ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের সান্নিধ্যে এসে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হন। যে কারণে, পরবর্তী জীবনে তিনি ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, বিশেষত এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের ক্ষেত্রেও নিজের অবদান রাখেন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থীদের ছাড়াও তাঁর মূল-বিষয়ের বাইরের লোকজনকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন নেতৃস্থানীয় শিক্ষক যথাক্রমে মর্শন বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান বদিউর রহমান এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন শব্বির আহমদ তাঁর অধীনে পিএউচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

গবেষণা তত্ত্বাবধানে তিনি ছিলেন প্রচ- রকমের শুদ্ধতাবাদী। একটি প্রকৃষ্ট গবেষণার জন্য ¯œাতকোত্তর ও এমফিল পর্যায়ের গবেষকদেরও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত করতেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে গবেষক হিসাবে স্বাধীনভাবে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তাঁর সাথে গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড. আফম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, “তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর অনুমোদন নিয়ে কলকাতা, লক্ষেœৗ, দিল্লি, তুঘলকাবাদ, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, মক্কা ও মদিনা সফর করি।” কোনও মতে একটি ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার অসৎ পন্থার বিপরীতে গবেষণাকে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর করতে তিনি ছিলেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শুদ্ধতম তত্ত্বাবধায়ক। শেষজীবনে তাঁর সঙ্গে বা পরামর্শে যারা গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মানস গঠনে ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নির্মাণে তিনি শ্রমবিমুখ ছিলেন না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা বই-পুস্তক পর্যালোচনায় লিপ্ত হতেন। এমন চিত্র আমি নিজে তাঁর বাসভবনে উপস্থিত কালে লক্ষ্য করেছি। কখনও নবাগত গবেষকদের তিনি অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে পাঠাতেন। তাঁর রেফারেন্সে একাধিক তরুণ গবেষক আমার কাছে এসে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাঁর রেফারেন্সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা সম্পন্ন করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ত ও প্রণোদনাদাতা রূপে ছিলেন নিরলস।   

কঠোর তথ্যনিষ্ঠা ও শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের প্রতিটি রচনায়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলো যে কারণে একই সাথে পাঠকপ্রিয় এবং অ্যাকাডেমিক জ্ঞান ভা-ারে মণি-মুক্তা তুল্য। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব ফরায়েজি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’ একটি পথিকৃৎ গবেষণা, যা ‘বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে। যে ফরায়েজি আন্দোলনকে ওয়াহাবি আন্দোলন বা তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া নামেই সবাই জানতো, তিনি তাঁর বহুমাত্রিক চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত করেন।  ফারায়েজি আন্দোলন যে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম ও আদি প্রচেষ্টা, তিনিই সর্বপ্রথম তা প্রমাণ করেন। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উত্থিত এই আন্দোলনের গণমুখী চরিত্র, ঔপনিবেশিকবাদ বিরোধী বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু মানসিকতার বিষয়াবলী তিনি ঐতিহাসিক তথ্য ও ধর্মতাত্ত্বিক মাত্রায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে উপস্থাপন করেন। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও বৃহৎ ক্যানভাসে গবেষণার কৃতিত্বে তিনি এই বিষয়ে এবং ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বিনির্মাণের পথিকৃৎ প্রাণিত স্বরূপে সর্বমহলে সম্মানীত হয়েছেন। 

পরবর্তীতে প্রকাশিত মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের গ্রন্থ ও প্রবন্ধে তিনি তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ রেখেছেন। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর লেখায় দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি বহুবিদ্যার প্রকাশ ঘটেছে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও গবেষণার বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাধারাকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করার প্রয়াস। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী দার্শনিকদের মতো সংলাপ-প্রবণ ব্যক্তিত্ব। কেউ আগ্রহী হলে কিংবা কারো প্রতি তিনি আগ্রহী হলে তাঁকে বা তাঁদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতেন। তিনি তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো বইয়ের পাতার শুকনো অক্ষরে বন্দি ছিলেন না, জ্ঞানবৃত্তের মানুষের সঙ্গে প্রাণবন্ত সংলাপ ও সংশ্লেষের মাধ্যমে সদা জীবন্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে তো বটেই, বৃহৎ বঙ্গদেশে খুব কম সংখ্যক প-িতই এমন ছিলেন, যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অন্যকে প্রণোদিত করার ক্ষমতা ধারণ করতেন। ঢাকায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং চট্টগ্রামে ড. আবদুল করিম, ড. আর. আই. চৌধুরী ছাড়া কম প-িতই ছিলেন, যারা শিক্ষার্থীদের প্রাণিত করার ক্ষেত্রে মনীষী মুঈন উদ-দীন খানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য।

জ্ঞানের সঞ্চার ও বিস্তারে তাঁর অসীম কষ্ট সহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও বিনয় তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের প্রাচীন জ্ঞানতাপসের আধুনিক প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমি তা স্পষ্টভাবে অনুভব করি। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। এবং বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন আমার চেয়ে কয়েক প্রজন্ম অগ্রগামী। তথাপি অশীতিপর বয়সে এসেও তিনি আমার কোনও লেখার প্রতি আগ্রহী হলে নিজে ফোন করে জানিয়েছেন। ডেকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং বিষয়টিকে তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে আরও সমৃদ্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেসব আলোচনায় জ্ঞানতত্ত্ব ও তুলনামূলক দর্শন সম্পর্কে তাঁর অতলস্পর্শী পা-িতের দীপ্তিমান প্রভার আঁচ পাওয়ার বিরল সুযোগ আমার হয়েছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছিল, বহু তরুণকে তিনি গবেষণার দিক-নির্দেশনা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দিতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মধ্যে পথ প্রদর্শনের একটি বিরল গুণ ছিল। আর ছিল জ্ঞানকে অকাতরে ছড়িয়ে দেওয়ার উদার মানসিকতা, যা আজকের অ্যাকাডেমিক প্রতিযোগিতার পঙ্কিল ও সঙ্কীর্ণমনা ধারার প্রেক্ষিতে অকল্পনীয় বিষয়। বড় মন ও মুক্ত মানসিকতার কারণে তিনি ‘বাংলাদেশের লিলিপুট প-িতদের সমাবেশে’ মহীরূহ-সম ব্যক্তিত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের মতো বিটপী ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যপটে রেখে আজকের ক্ষুদ্রতর পরিসরে আলোচনা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানের ঊন-মানুষ ও ঊন-মানসিকতার পরিম-লে তাঁর মতো বড় মানুষের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। তিনি এবং তাঁর সমগোত্রীয়রা শেষ মুঘলের মতো দৃশ্যপট থেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু রেখে গিয়েছেন ধ্রুপদী ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্বের দীপ্তি ও বিভা। তিনি ছিলেন প্রথম প্রজন্মের আধুনিক বাঙালির হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সকল অগ্রণী প-িত, গবেষক ও শিক্ষাব্রতীগণের শ্রেষ্ঠতম ও উজ্জ্বল প্রতিনিধি, যারা  জাগতিক প্রাপ্তির আশায় জ্ঞানের সাধনা করেন নি। জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার নিতান্ত আবশ্যক পরিসীমার বাইরেও তাঁরা সচরাচর যান নি। তাঁদের নিতান্ত আবশ্যক বস্তুর তালিকায় সর্বাগ্রে ছিল জ্ঞানচর্চা, বিদ্যার্জন ও গ্রন্থপাঠ। বিষয় ভিত্তিক প্রয়োজনীয় বইয়ের বাইরেও অন্য বিষয় সংক্রান্ত রচনা তাঁরা পড়তেন আনন্দ ও কৌতূহল নিবৃত্তির সুতীব্র আকর্ষণে। কারও কারও পুস্তক সংগ্রহ আর রোজগারের মধ্যে কোনও ভারসাম্য থাকতো না। জাগতিক উন্নতির বিষয়গুলোকে তাঁরা তুচ্ছ বিবেচনা করে অবজ্ঞা করেছেন। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর মতে, “যে জীবনে বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা বিরল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ সত্যিই সারস্বত-কর্মে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বর্তমানের বিশ্লেষণপ্রবণ গবেষণার ধারা তখনও প্রবল হয় নি। কিন্তু অনেক গবেষণাই গভীর পা-িত্যের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতো।” মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান সম্পর্কে এই বক্তব্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আত্মমগ্ন ধ্যানীর মতো সারা জীবন তিনি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থেকে গভীর পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু নিজেই নন, প্রণোদিত করেছেন পরবর্তী বেশ কিছু প্রজন্মের উৎসাহী তরুণদের, যাদের অনেকেই বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত রয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে ইতিহাসের আরেক মহান সাধক যদুনাথ সরকারের কিছু কিছু বিষয় তুলনীয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রবল পরিশ্রম, জ্ঞান তৃষ্ণা এবং অনুসন্ধান। যদুনাথের বিশ্লেষণের নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বিতর্ক থাকার পরেও ইতিহাসচর্চায় তিনি সর্বজনমান্য আচার্য। তিনি নিজের কর্ম ও জীবন আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতেন: “পথের প্রান্তরে করি নাই খেলা/শুধু বাজায়েছি বসি সারাবেলা/ছিন্নতন্ত্রী বীণা।” মনীষী প্রফেসর ড. মুইন উদ-দীন আহমদ খানও সারাজীবন জ্ঞানচর্চার বাঁশরী বাজিয়েছেন। একটি আস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের মাধ্যমে। বিদ্যার্চচাকে পেশাগত পরিম-লে জিম্মি না করে জীবন ও যাপনের মূলমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সব কিছুই তিনি করেছেন নিজের সুমৃত্তিকা ও মানুষকে কেন্দ্র করেই। জীবনের পর্বে পর্বে নানা দেশে, নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তিনি অবশেষে ফিরে এসে আলোকিত করেছেন প্রিয় মাটির প্রিয় মানুষদের, প্রিয় জনপদকে। জীবনের দিনগুলোর মতোই মৃত্যুর পরেও তিনি আলোর দিশারী হয়ে দেদীপ্যমান রয়েছেন জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যামুখী অভিযাত্রীদের চৈতন্যের মর্মমূলে।  

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম  সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;