মৃতের সাথে প্রেমের এক অমর কাহিনী
১৯৫২ সালে কার্ল ট্যাঞ্জলার যখন মৃত্যুবরণ করেন, তিনি ততদিনে অন্য ধরনের এক ভালোবাসার জীবন্ত কিংবদন্তি। তাকে নিয়ে তখন গান বাঁধা শুরু হয়ে গেছে। তাকে নিয়ে বের হয়েছে গানের অ্যালবাম—‘দ্য ব্ল্যাক ডালিয়া মার্ডার’, ‘অ্যান্ড ইউ উইল নো আস বাই দ্য ট্রেইল অব ডেড’, ‘স্লিপ স্টেশন’, ‘কাউন্ট কাসেল’স অবসেশন’।
কার্ল ট্যাঞ্জলারের জন্ম ১৮৭৭ সালে জার্মানির ড্রেসডেনে। নিজ নামের বাইরেও তিনি কাউন্ট কার্ল ফন কসেল নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। অভিবাসী হয়ে ১৯২৭ সালে ফ্লোরিডায় চলে আসেন। কিছুদিন পর তার সঙ্গে এসে যোগ দেন স্ত্রী ও দুই কন্যা। সেখানে ইউনাইটেড স্টেট মেরিন হাসপাতালে রেডিওলজিস্ট হিসাবে কাজ শুরু করেন।
তার দায়িত্ব হাসপাতালের যক্ষ্মা ওয়ার্ডে। যক্ষ্মা তখন ভয়াবহ রোগ। ডাক্তারের আপ্রাণ চেষ্টার পরও রোগী বাঁচিয়ে রাখা যাচ্ছে না। তখনও ভালো কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি।
কার্লের পরিচিতজন বলতে রোগীরাই। একজনের পর একজন অসহায় অবস্থায় মৃত্যুবরণ করছে। এই অবস্থায় একজন ডাক্তারের পক্ষেও মাথা ঠান্ডা রাখা সম্ভব নয়। কিন্তু কার্ল ঠান্ডা মাথায় রোগী দেখে যাচ্ছেন, চিকিৎসাবিজ্ঞানে তার দখল ও অভিজ্ঞতার কথা বলে যাচ্ছেন। নিজেই রোগীদের ওপর নতুন নতুন পরীক্ষা চালাচ্ছেন। শৈশবে তিনি বিশ্বাস করতেন বহু আগে মৃত তার এক আত্মীয় কাউন্টেস আনা কন্সট্যান্টিনা ফন কসেল (নিজের কাউন্ট পদবি আর ফন কসেল নাম তার কাছ থেকেই নিয়েছেন) তাকে দেখতে আসেন। তার সঙ্গে কথা বলেন এবং তাকে জানিয়ে যান কালো চুলের একটি মেয়ের সঙ্গেই হবে তার সত্যিকারের প্রেম। ফ্লোরিডায় আসার পরও কার্ল বলতেন যে, কাউন্টেস আনা তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ অব্যাহত রেখেছেন।
কাউন্টেস আনা কোনো কল্পিত চরিত্র নন, তিনি পোল্যান্ডের রাজা অষ্টম অগাস্টাসের রক্ষিতা ছিলেন, কিন্তু তার একগুঁয়েমি থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য রাজা তাকে খোরাকিসহ নির্বাসনে পাঠিয়ে দেন। ৪৯ বছর নির্বাসিত জীবনযাপনের পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। দুর্ভাগ্য এই কসেল পরিবারকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে।
কার্ল অভিজ্ঞ মানুষ, ভারত, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া, কিউবা এবং নেদারল্যান্ডস সফর করেছেন, তিনি প্রথম মহাযুদ্ধেও সময় অস্ট্রেলিয়ান ইনটার্ন ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসেন। তিনি নিজের নামের সাথে কাউন্ট ব্যাবহার করতে পছন্দ করতেন, বহু সংখ্যক ডিগ্রিধারী বলে গর্বও করতেন।
এমন সময়ই তার জীবনে মারিয়ার আবির্ভাব ঘটে।
কিউবান এক সিগার প্রস্তুতকারীর কন্যা মারিয়ার জীবনটা ভালো যাচ্ছিল না। কালো চুলের সুন্দরী এই তরুণীর বয়স যখন ১৬ বছর লুই মেসা নামের এক যুবকের সাথে বিয়ে হয়, একটি গর্ভপাতের পর মারিয়া অসুস্থ হয়ে পড়লে লুই তাকে পরিত্যাগ করে চলে যায়। তাদের মধ্যে আর যোগাযোগ না থাকলেও আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের সমাপ্তি ঘটেনি।
২১ বছরের মেয়ে মারিয়া এলেনা মিলাগ্রো (১৯৩০ সালে) ভয়াবহ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়। সে সময় আমেরিকাতে যক্ষ্মায় বছরে গড়ে ১ লক্ষ ১০ হাজার রোগীর মৃত্যু হতো, যক্ষা থেকে সেরে ওঠার ঘটনা বিরল। যক্ষ্মা আক্রান্ত রোগীকে পরিবারের সদস্যরা খরচের খাতায় তুলে রাখত, তারা জানত বড় জোর আর ক’দিন।
১৯৩০ সালের এপ্রিলে তাকে মেরিন হসপিটালে মরণাপন্ন অবস্থায় ভর্তি করা হলো। পরিবার তার আশা ছেড়ে দিয়েছে। আশা ছাড়েননি সে হাসপাতালের ডাক্তার কেবল কার্ল। তার দিন ও রাত্রি কেটে যায় এলেনাকে যন্ত্রণা থেকে একটুখানি উপশম দিতে, তাকে মৃত্যুর হাত থেকে ছিনিয়ে আনতে। কার্ল নিশ্চিত কাউন্টেস আনা তাকে যে মেয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছেন, এলেনাই সে মেয়ে।
পরিবার যেখানে তার নিশ্চিত মৃত্যু দেখতে পাচ্ছে, কার্ল জোর দিয়ে বললেন, তাকে বাঁচিয়ে তুলবেনই। বনজ চিকিৎসা থেকে শুরু করে এক্সরে—সব প্রয়োগ করলেন। তিনি বিশ্বাস করলেন, এলেনা সুস্থ হয়ে তার ভালোবাসার জবাব দেবে। তিনি তার ডায়েরিতে লিখলেন, আশা ছিল তার শরীরের এত ক্ষয়ক্ষতির পরও এলেনা বিপদ কাটিয়ে উঠবে এবং আমরা একদিন বিয়ে করব, যতদিন তার প্রাণ ছিল আমি এ আশা ত্যাগ করিনি।
তিনি মরণাপন্ন মারিয়া এলেনাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন কিন্তু কোনো সাড়া পাননি, তিনি ভালো সময়ের অপেক্ষায় ছিলেন।
দেড় বছর ভোগান্তির ২৫ অক্টোবর ১৯৩১ সালে এলেনা মৃত্যুবরণ করল। তার পরিবারের সম্মতি নিয়ে কার্ল নিজ খরচে এলেনার কবরে একটি সৌধ নির্মাণ করলেন; প্রতিদিনই কবরে আসতে থাকলেন, তার এই অদ্ভুত পাগলামি মেনে নিল এলেনার পরিবার। আসলে এই আসা-যাওয়ার মাঝে তিনি কবরের মাটি সরিয়ে কফিনের ডালা খুলে এলেনার মৃতদেহে ফরমালিন ঢেলে এটাকে সজীব রাখতেন।
প্রায় দু বছর তিনি সঙ্গোপনে এই কাজটি করে গেলেন। মৃতদেহ যখন আর অটুট রাখা যাচ্ছে না, তিনি চুরি করে দেহ উঠিয়ে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং ১৯৩৩ সালের এক শীতের রাতে টয় ওয়াগান নিয়ে কবরস্থানে ঢোকেন এবং সকলের অজান্তে সাফল্যের সঙ্গে মৃতদেহ উঠিয়ে নিলেন।
দেখতে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতো এবং বয়স তার ৫০ ছাড়িয়ে, মরদেহ নিয়ে আসার পর শুরু হলো কার্লের দিন-রাতের পরিশ্রম, পচন থেকে এটাকে রক্ষা করতেই হবে। কিন্তু পেরে উঠছিলেন না; পচে মাংস ও চামড়া বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, চুল পড়ে যাচ্ছে, অস্থি জোড়া থেকে খসে পড়ছে; তিনি বাদ্যযন্ত্রের তার দিয়ে হাড়গুলো একত্রে রাখার চেষ্টা করছেন। অবস্থার একটু উন্নতি হয়েছে মনে হলেই এলেনাকে তার পোশাকে সাজিয়ে শুইয়ে রাখছেন। এভাবে কেটে গেল আরো কয়েক বছর।
মৃতদেহ নিয়ে কার্লের এসব কারবার দীর্ঘদিন চেপে রাখা গেল না। এলেনার মৃত্যুর নয় বছর পর ১৯৪০ সালে মারিয়ার বোন কার্লের বাড়িতে হানা দিয়ে এলেনার পোশাকের আড়ালে এই মৃতদেহটি আবিষ্কার করে।
পরের অংশে কার্ল গ্রেফতার, জেলে। তার অজ্ঞাতে অজ্ঞাত কোনো স্থানে এলেনাকে আবার সমাহিত করা হলো। পরিবারের আশঙ্কা জেল থেকে ছাড়া পেয়ে কার্ল আবার হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াবে এলেনার লাশ। এবারও হয়তো চুরি করবে।
তার বিরুদ্ধে লাশ চুরির মামলা হলো। কিন্তু এ ধরনের অপরাধের সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা না থাকায় কার্লের কোনো সাজা হলো না। আদালতের অন্যতম বিবেচ্য ছিল এই অপরাধ সংগঠনের উদ্দেশ্য কী ছিল? জবাব একটিই, যেভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক একমাত্র উদ্দেশ্য ভালোবাসা।
ভালোবাসার জন্য তো দণ্ড হতে পারে না। কার্ল নিজেকে কখনো অসুস্থ মনে করেননি। সুন্দরী কালোকেশী এলেনার পচন ধরা দেহকেও তিনি একইভাবে ভালোবেসেছেন। জীবনের শেষ মুহূর্তেও এই ভালোবাসায় এতটুকু কমতি হয়নি।
ফ্লোরিডা হাসপাতাল তার মুখের কথায় বিশ্বাস করে চাকরি দিয়েছিল এবং তিনিও নিষ্ঠার সঙ্গে দক্ষ হাতে কাজ করে গেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বের হলো তিনি কখনো কোনো মেডিকেল স্কুলে পড়েননি। তিনি চাকুরিচ্যুত হলেন।
কার্ল ট্যাঞ্জলার একটি মর্মস্পর্শী আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথাও লিখেছেন, যার একটি উল্লেখ্যযোগ্য অংশজুড়ে আছে ২৩ বছর বয়সী সেই স্বপ্নকন্যা এলেনা।
তিনি লিখেছেন: এলেনা প্রিয়তমা আমার, সমুদ্রতীরে আমরা নিঃসঙ্গ দুজন। যিনি তোমাকে আমার হাতে তুলে দিয়েছেন, আমাদের আত্মাকে তিনি একত্রে গেঁথে রাখবেন।
ডায়েরিতে তিনি মারিয়াকে চুম্বন ও আলিঙ্গন করার কথা লিখেছেন। “মানুষের ঈর্ষপরায়ণতা আমার এলেনার দেহ আমার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়েছে, তবুও স্বর্গীয় প্রশান্তি আমার মধ্যে প্রবাহিত হয়, সে মৃত্যুকে অতিক্রম করেছে, চিরদিন সে আমার সাথেই আছে।”
ডাক্তার কার্ল নিজেকে যথেষ্ট সুস্থ মনে করেছেন, স্ত্রী ও দুই সন্তানকে পরিত্যাগ করে তিনি চলে গেলেও তার স্ত্রী ডোরিস নিয়মিত তাকে মাসোহারা পাঠাতেন। যে ডাক্তার একটি ভালোবাসার মৃতদেহ নয় বছর লালন করেছেন, সজীব রেখেছেন।
১৯৫২ সালে মৃত্যুর প্রায় তিন সপ্তাহ পরে ৭৫ বছর বয়স্ক কার্লকে গলিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। মারিয়ার দুই বোন অরোরা ও ফ্লোরিন্দাও যক্ষ্মায় মারা যায়।