ফ্রাঞ্জ কাফকার পুনরুদ্ধারকৃত গল্পগুচ্ছ : স্বীয় সময়ে শুরু হবে পরিত্রাণের পালা

  • অনুবাদ: মামুনুর রশিদ তানিম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

ধারণা করা হয়, ফ্রাঞ্জ কাফকার জীবনের শেষ সময়ে লেখা হয়েছে এই ছোটগল্পগুলো। এই চারটি ছোটগল্পকে প্রশংসা স্বরূপ “ক্লস্ট্রোফোবিক জেম” হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। জার্মান ভাষা হতে ইংরেজি ভাষায় গল্পগুলো অনুবাদ করেছেন মাইকেল হফম্যান। কাফকার হারিয়ে যাওয়া লেখা হিসেবেই একরকম উদ্ধার হয় গল্পগুলো। পরবর্তীতে জানা যায়, এই চারটি গল্পের প্রথম গল্পটি “দ্য কমপ্লিট স্টোরিজ” সংকলনগ্রন্থেও আছে। এবং এই চারটি গল্পের ইংরেজি অনুবাদই ১৯৫৪ সালে “ডিয়ারেস্ট ফাদার: এন্ড আদার রাইটিংস”-এ প্রকাশিত হয়েছিল বর্তমানে যার কোনো প্রিন্ট অবশিষ্ট নেই। তাই বলা যায়, নতুন করেই ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে গল্প চারটি। চারটি গল্পের মাঝে শেষের গল্পটিকে কেন্দ্র করেই, “দ্য রেস্কিউ উইল বিগিন ইন ইটস ওউন টাইম”—এই নাম দ্বারা গল্পগুলোকে সংঘবদ্ধ করেছে দ্য নিউ ইয়র্কার। - অনুবাদক

আজ ফ্রাঞ্জ কাফকার জন্মদিনে তাঁর পুনরুদ্ধারকৃত চারটি গল্পের বাংলা অনুবাদ বার্তা২৪.কম-এ প্রকাশ করা হলো। - বিভাগীয় সম্পাদক

বিজ্ঞাপন


★★★

পৌরাণিক কাহিনী ব্যাখ্যাতীতকে, ব্যাখ্যায় ধরার একটি প্রচেষ্টামাত্র। সত্যের ভিত্তিপ্রস্তর হতে উদিত হবার মতো করেই উদীয়মান হয় এটি, ব্যাখ্যাতীতে পরিসমাপ্তি ঘটাই যার নিয়তি।

বিজ্ঞাপন

প্রমিথিউস সম্বন্ধে চারটি পুরাকথা আমাদের মাঝে প্রচলিত আছে। সেগুলোর প্রথমটি অনুযায়ী, মানুষের তরে দেবতাদের ধোঁকা দেওয়ার শাস্তিস্বরূপ তাকে ককেশাস পর্বতচূড়ায় শৃঙ্খলিত করে রাখা হয়, এবং দেবতা জিউস বাজপাখি পাঠাতেন, যেটি প্রমিথিউসের কলিজা খুবলে খুবলে খেত এবং পুনরায় সে-স্থানে নতুন কলিজা জন্মাত।

দ্বিতীয় পুরাকথা অনুযায়ী, ধারালো ঠোঁটের সেই ব্যথা প্রমিথিউসকে পাথরগাত্রের আরো গভীরে নিপতিত করতে থাকে রোজ, যতদিন না তিনিও পাথর হয়ে যাচ্ছিলেন।

তৃতীয় পুরাকথা অনুযায়ী, তার ধোঁকার বিষয়টি সহস্র বছরের সময়ের চক্রে ভুলে যাওয়া হয়: দেবতারা ভুলে গিয়েছিলেন, ঈগলও ভুলে গিয়েছিল, এমনকি তিনি নিজেও ভুলে গিয়েছিলেন।

আর চতুর্থ পুরাকথা অনুযায়ী, শাস্তির এই একই রকম প্রক্রিয়ায় সবাই ক্লান্ত হয়ে উঠেছিল এবং কারণটাও একসময় ফিকে হয়ে গিয়েছিল। দেবতারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন, ঈগলও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, এমনকি ক্ষতও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল এবং বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
ওই পর্বতগুলোই আসল রহস্যধারী।


★★★

পাউরুটির একটি বড় ঢেলা টেবিলে পড়ে ছিল। এটিকে দুভাগ করবে বলে বাবা একটি ছুরি নিয়ে আসলো। ছুরিটি ছিল বড় এবং তীক্ষ্ণ, ওদিকে পাউরুটি খুব বেশি নরম বা শক্ত কোনোটিই ছিল না, কিন্তু তারপরেও ছুরি দিয়ে এটিকে খণ্ডায়িত করা গেল না। আমরা সন্তানেরা, বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে বাবার দিকে চাইলাম। তিনি বললেন, “তোমরা অবাক কেন হচ্ছো? কোনোকিছু ব্যর্থ না হয়ে যদি সফল হতো সেটি কি আরো অবাক করার মতো নয়? শুতে যাও; হতে পারে, পরে আমি কিছু একটা ব্যবস্থা করে ফেলব।” আমরা শুতে চলে গেলাম, কিন্তু রাতের গোটা সময়টায় কিছুক্ষণ পরপর, আমাদের মাঝ থেকে একজন বা অন্যজন উঠত আর বকের মতো গলা বাড়িয়ে বাবাকে দেখত। ডান পা পেছনে নিয়ে বাম পায়ের সাথে ঠেকানো, লম্বা কোট গায়ে চড়ানো বড় মানুষটি, যিনি সেখানে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছেন আর পাউরুটির মাঝে ছুরি চালানোর উপায় খুঁজছেন। আমরা সকালে যখন ঘুম থেকে উঠলাম, বাবা তখন ছুরিটাকে পাশেই রাখছিলেন এবং বললেন, “এতই দুঃসাধ্য কাজ এটি, যে দেখো এখনো কিছুই ব্যবস্থা করতে পারলাম না।” আমরা নিজেরা একবার চেষ্টা করে কিছুটা পার্থক্য গড়তে চাইলাম এবং তিনি আমাদের সে অনুমতি দিলেন। কিন্তু আমরা ছুরিটাই ওঠাতে পারলাম না; রীতিমতো কুস্তি লড়তে হচ্ছিল হাতলটি ওঠাতে, যেটি তখনও জ্বলজ্বল করছিল বাবার অবিরত প্রয়াসের নিদর্শনস্বরূপ। বাবা হেসে উঠলেন এবং বললেন, “বাদ দাও। আমি বেরুচ্ছি এখন। রাতে ফের চেষ্টা করব। পাউরুটির একটা ঢেলা আমাকে নাস্তানাবুদ করবে, এ আমি হতে দেব না। এত স্বচ্ছন্দে নিজেকে কাটতে দেওয়ার মতো বাধ্যগত এটি নয়। এটিরও অধিকার আছে বিরোধ করার, তাই সে করছে।” বিস্ময়জনকভাবে এর পরপরই দেখা গেল, তিনি যেমন করে বললেন ঠিক তেমন করেই, একজন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মানুষের মুখের আকৃতির মতো পাউরুটিটি কুঁচকে যাচ্ছে এবং তারপর এটি আসলেই ছোট্ট একখণ্ড ঢেলা হয়ে পড়ে ছিল।


★★★

সড়কের ওপর একজন কৃষক আমার পথরোধ করে অনুনয় করেছিল, আমি যাতে তার সাথে তার বাড়িতে যাই। স্ত্রীর সাথে তার কলহবিবাদ হয়েছিল এবং তাদের এই ঝগড়া তার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলছিল, সম্ভবত আমি সাহায্য করতে পারতাম। তার কিছু সরলমনা ছেলেপুলেও ছিল, যারা জীবনে ভালো কেউ হয়ে উঠতে পারেনি। তারা হয় নির্বোধের মতো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকত, নাহয় কোনো আপদ ঘাড়ে আনত। আমি বললাম, আমি সানন্দেই তার সাথে যাব। কিন্তু আমি যে একজন আগন্তুক মাত্র, তাকে কোনো উপায়ে সহায়তা করতে পারব কিনা সেটি নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ ছিল। ছেলেগুলোকে হয়তো কোনো দরকারি কাজ জুটিয়ে দিতে পারব, কিন্তু তার স্ত্রীর ব্যাপারে কোনো সহায়তার ক্ষেত্রে আমি সম্ভবত অপারগই হব। কারণ একজন স্ত্রীর কুঁজড়ামির কারণটা তার স্বামীরই কোনো দোষ বা গুণের মূলে থাকে এবং যেহেতু সে গোটা পরিস্থিতি নিয়ে অসুখী ছিল, তারমানে ইতোমধ্যেই সে নিজেকে পরিবর্তনের পীড়াদায়ক কাজটুকু হাতে নিয়েছে কিন্তু সফলতা পায়নি, তবে আমিই বা আর কিভাবে এরচেয়ে বেশি সফলতা এনে দিতে পারি? সর্বসাকুল্যে আমি যা করতে পারি তা হলো, তার স্ত্রীর ক্রোধটুকু নিজের ওপর টেনে আনতে। শুরুতে অবশ্য আমি তার সাথে কথা বলার চাইতে নিজের সাথেই বিড়বিড় করছিলাম বেশি। কিন্তু তারপর তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এই ঝঁঝাট বহনের জন্য তিনি আমায় কী দেবেন। তিনি উত্তরে বললেন, যদি আমি কোনো কাজের প্রমাণিত হই তবে আমরা চটজলদিই কিছু একটাতে চুক্তিবদ্ধ হব, আর আমি যা খুশি তখন চাইতে পারি। এ পর্যায়ে এসে আমি থামলাম এবং বললাম, এই ধরনের অস্পষ্ট কোনো প্রতিশ্রুতি আমায় সন্তুষ্ট করতে পারবে না। প্রতি মাসে তিনি আমাকে কী দেবেন তার একটা যথাযথ চুক্তি আমি চাইলাম। আমি তার কাছ থেকে মাসোয়ারার মতো কিছু দাবি করছিলাম দেখে সে ভারি অবাক হয়েছিল। তাকে বিস্মিত হতে দেখে, আমি নিজেই বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলাম। তবে কি সে ভেবেছিল, দুজন মানুষ সারা জীবন ধরে যে ভুল করে আসছিল তার নিষ্পত্তি আমি মাত্র কয়েক ঘণ্টায় করে ফেলব? তবে কি সে প্রত্যাশা করেছিল ওই ঘণ্টা দুই শেষ হবার পর, এক বস্তা শুকনো মটরদানা আর কৃতজ্ঞতায় নত হয়ে হাতে চুম্বনের লোভ আমাকে জোড়াতালি দেওয়া কাপড়ে নিজেকে আবদ্ধ করে তুষারে ছেয়ে থাকা রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাবে? কক্ষনোই না। কৃষকটি মাথা নিচু করে নীরব থেকে, কিন্তু উদ্বিগ্নচিত্তে সবটা শুনল। আমি তাকে বললাম; গোটা ব্যাপারটি আমি যেভাবে দেখছি, সে-অনুযায়ী পরিস্থিতির সাথে পরিচিত হতে এবং সম্ভাব্য উন্নতি নিয়ে ভাবতে একটা দীর্ঘ সময় আমার তার সাথে থাকতে হতে পারে। তারপর আরো দীর্ঘ সময় থাকতে হতে পারে যথাযথ নির্দেশনা সৃষ্টিতে, যদি অমন কিছু আদৌ সম্ভবপর হতো আরকি। তারপর দেখা যেতে পারে আমি বৃদ্ধ এবং অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়লাম, কোথাও আর তাই গেলাম না বরং তাদের সাথে থেকে গেলাম, বিশ্রাম নিলাম আর পরিবারের সকলের কৃতজ্ঞতা উপভোগ করলাম।

কৃষকটি বলে উঠল, “সে তো সম্ভব হবে না। আপনি তো উল্টো আমার ঘরেই থিতু হতে চাইছেন। হয়তোবা শেষে গিয়ে দেখা যাবে, আমাকেই ঘরছাড়া করছেন। তখন তো এখনকার চেয়ে আরো বড় বিপদে পড়ে যাব আমি।”

আমি বললাম, “দেখো, একে অপরের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা ছাড়া আমরা কোনো চুক্তিতেই পৌঁছুতে পারব না। তোমার ওপর যে আমার বিশ্বাস আছে, তা কি আমি দেখাইনি? আমার কাছে শুধুমাত্র তোমার প্রতিশ্রুতিই আছে, তা কি তুমি ভাঙতে পারো না? তোমার ইচ্ছা মোতাবেক আমি যদি সবকিছুর ব্যবস্থা করি, তারপর তুমি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে বাক্সপ্যাটরা গুছিয়ে আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারো না?”

কৃষকটি আমার দিকে চেয়ে বলল, “আপনি তা কখনোই হতে দেবেন না।”

আমি বললাম, “করো তোমার যা মর্জি এবং ভাবো আমাকে নিয়ে যেমন খুশি। কিন্তু আমি এই কথাটা তোমাকে বন্ধুত্বের খাতিরে নয়, বরং এক পুরুষ হয়ে আরেক পুরুষকে বলছি, যে আমাকে তোমার সাথে করে যদি না নিয়ে যাও তবে ওঘরে তুমি খুব বেশি সময় টিকতে পারবে না। ভুলে যেও না আমার এই কথাখানি। অমন স্ত্রী আর ছেলেপুলেদের নিয়ে কী করে সংসার করবে তুমি? আমাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার সুযোগটা যদি তুমি হাতে না নাও, তবে বাড়ির এত ঝঞ্ঝাট ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে আমার সাথে আসছো না কেন? একই পথ ধরে হাঁটব আমরা দুজনে এবং তোমার সন্দেহগুলোকে তোমার বিরুদ্ধে ব্যবহার করব না আর।”

“তা আমি করতে পারি না”, কৃষকটি বলে উঠল। “১৫ বছর ধরে আমি, আমার স্ত্রীর সাথে ঘর করছি। যথেষ্ট কঠিন কাজ ছিল এটা। এমনকি আমি নিজেও বুঝতে পারছি না, আমি কিভাবে হাল ধরে ছিলাম। কিন্তু সেটা সত্ত্বেও, তাকে সহ্য করা যায় এমন সকল কিছুর চেষ্টা করা ছাড়াই আমি তো তুড়িতেই আর তাকে পরিত্যাগ করতে পারি না। তারপর আপনাকে রাস্তা দিয়ে আসতে দেখে ভাবলাম, আপনাকে সাথে নিয়ে একটা শেষ চেষ্টা করে দেখা যাক। আপনি আসুন আমার সাথে, যা চান তাই-ই দেব আপনাকে। বলুন কী চান?”

“খুব বেশিকিছু আমি চাই না”, আমি বললাম। “তোমার অবস্থা আরো দুর্দশাপন্ন করার মতলব আমার নেই। আমি চাই, তোমার আজীবনের মজুর হিসেবে আমাকে তুমি নিয়ে যাবে। আমি সব ধরনের কাজেই সিদ্ধহস্ত। তাই তোমার বেশ কাজে লাগব বলেই আমার বিশ্বাস। কিন্তু আমি অন্যান্য শ্রমিকদের মতো পরিগণিত হতে চাই না। তুমি আমাকে দিয়ে ফরমায়েশ খাটাতে পারবে না। আমার যে কাজ মনে লয়, সেটাই করার স্বাধীনতা আমি রাখব। হয়তো এটা হয়তো সেটা, নয়তো কিছুই না; যেমনটা আমার মনে লয়। তুমি আমাকে কিছু একটা করতে ততক্ষণই বলতে পারবে, যতক্ষণ তুমি ভদ্রোচিত ভাবে সেটা বলছো। এবং তারপর যদি দেখো, আমি সেটা করতে চাইছি না তবে তোমাকে তা মেনে নিতে হবে। আমার পয়সাকড়ি চাই না। কিন্তু চলতি মানের সাথে মিল রেখে কাপড়, অন্তর্বাস, বুট জুতা আমার চাই। এবং যখনই দরকার পড়বে, ওগুলো তখনই বদলে দিতে হবে। তোমার গ্রামে যদি এই জিনিসগুলো অলভ্য হয়, প্রয়োজনে তুমি শহরে যাবে ওগুলো ক্রয় করতে। তবে অত ভেবো না। আমার বর্তমান কাপড়গুলোতেই আরো বছরখানেক চলে যাবে। মজুরের যথাযথ মজুরি নিয়েই আমি খুশি থাকব। তবে আমি জেদ ধরব শুধু, রোজ মাংস খাওয়ার ব্যাপারে।”

কথার মাঝখানে বাগড়া দিয়ে সে বলল, “রোজ?” বাকি শর্তগুলো মেনে নিল যদিও।

“হ্যাঁ রোজ”, আমি বললাম।

আমার অদ্ভুত শর্তকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় সে বলে উঠল, “আমি খেয়াল করেছি আপনার দাঁতগুলো বড়ই অস্বাভাবিক।” এমনকি সে আমার মুখ অব্দি পৌঁছে গেল ওগুলো ছুঁয়ে দেখতে। “খুব ধারালো। একেবারে কুকুরের দাঁতের মতো,” সে বলল।

“সে যাকগে। প্রতিদিন মাংস চাই,” আমি বললাম। “এবং বিয়ার এবং মদও ততখানি চাই, যতখানি তুমি পান করো।”

সে বলল, “এ তো অনেক বেশি। আমি প্রচুর পান করি।” আমি বললাম, “যত বেশি তত ভালো। তারপর তুমি যদি বেল্ট আঁটসাঁট করো, আমিও করব আমারটা। তোমার অসুখী সংসারজীবনের জন্যই হয়তো তুমি এত বেশি মদ খাও।”

“না,” সে বলল, “ওটা কেন এটার সাথে সম্পর্কিত হতে যাবে? তবে আমরা দুজনে একসাথেই পান করব। আমি যতখানি পান করব, আপনিও ততখানি।”

“না,” আমি বললাম, “সঙ্গ নয়। বরং একা একা খেতে এবং পান করতেই আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।”

কৃষক বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, “একা? আপনার এতসব শর্ত আমার মাথা ঘুরিয়ে দিচ্ছে।”

আমি বললাম, “এত বেশিও নয় এবং প্রায় শেষদিকেই চলে এসেছি। আমি প্রদীপের জন্য তেল চাই, যেটি রাতভর আমার পাশে জ্বলতে থাকবে। প্রদীপটি আমার সাথেই আছে। আকারে খুবই ছোট। ওই প্রদীপগুলোর মতো, যেগুলো চালিয়ে নেবার জন্য তেমন কিছুই লাগে না। উল্লেখযোগ্য কিছু যদিও এটি নয়। কিন্তু একটা সম্পূর্ণতার জন্যই আমি উল্লেখ করলাম, পাছে এটা নিয়ে পরবর্তীতে আমাদের মাঝে বিতর্ক না হয়। অর্থকড়ি আদানপ্রদানের কথা আসলে এই ব্যাপারগুলো আমার একেবারেই অপছন্দ। বাকি সবকিছুতে আমি নরম স্বভাবের মানুষ, কিন্তু একবার হয়ে যাওয়া চুক্তি ভঙ্গ হলেই, আমি ভারি উগ্র হতে পারি, স্মরণে রেখো। যা কিছু আমি অর্জন করেছি, তার পইপই হিসাব যদি আমাকে বুঝিয়ে না দেওয়া হয় তবে আমি তোমার ঘরও জ্বালিয়ে দিতে পারি যখন তুমি বেঘোরে ঘুমাবে। তাই যে ব্যাপারে আমরা একমত হয়েছিলাম, সেটা অস্বীকার করার কোনো প্রয়োজন নেই। আর তারপর, বিশেষ করে আবেগের বহিঃপ্রকাশ থেকে ক্কচিত্ কোনো উপহার যদি তুমি আমাকে দাও, খুব দামি কিছু হতে হবে না একদম তুচ্ছ কিছুও যদি হয়, তাও আমি সকল পন্থাতেই তোমার প্রতি বিশ্বস্ত থাকব, দুঃসাহসী থাকব। এইমাত্র যা বললাম, এর বাইরে আগস্টের ২৪ তারিখ, আমার নামকরণের দিনে ২ গ্যালন রামের একটা ছোট্ট পিপা ছাড়া আমার আর কিছু চাওয়ার থাকবে না।”

হাত দুটো একত্রে বাজিয়ে বিস্ময়ের স্বরে কৃষক বলে উঠলো, “দুই গ্যালন।”

“হ্যাঁ, দুই গ্যালন,” আমি বললাম। “অত বেশিও তো নয়। তুমি হয়তো কষাকষি করে কমিয়ে আনার কথা ভাবছো। কিন্তু জেনে রাখো, তোমার কথা বিবেচনা করে, আমি ইতোমধ্যেই দাবিদাওয়া কমিয়ে এনেছি। কোনো আগন্তুক যদি আমাদের কথা শুনে ফেলার জন্য থাকত, তবে আমি যথেষ্ট লজ্জা পেয়ে যেতাম অবশ্যই। এখন আমরা যেভাবে কথা বলছি, কোনো আগন্তুকের সামনে আমি কখনোই সেভাবে কথা বলতে পারতাম না। তাই কেউ আমাদের চুক্তি শুনতে পাবে না। অবশ্য কেইবা এসব কথা বিশ্বাস করবে?”

কিন্তু কৃষক বলল, “আপনি বরং নিজের রাস্তাই ধরুন এবার। আমি বাড়ি যাব এবং স্ত্রীর সাথে সবকিছু মিটমাট করে নেওয়ার চেষ্টা করব। হ্যাঁ, এটা সত্যি, বিগত কিছু সময় ধরে তাকে অনেক মারধর করেছি আমি। এবার কিছুটা ছাড় দেব বলে মনে করি। এতে হয়তো সে খুব কৃতজ্ঞ হয়ে পড়বে আমার প্রতি। ছেলেগুলোকেও প্রচুর মেরেছি। আস্তাবল হতে চাবুক বের করে মারতাম তাদের। ওটায়ও একটু বিরাম দেব এবার, হয়তো সবকিছু বদলাতেও পারে। স্বীকার করছি, আমি অতীতেও এই চেষ্টা করেছি, বিন্দুমাত্র উন্নতি হয়নি তাতে। কিন্তু আপনার চাহিদার ভার অনেক। এমনকি ওগুলো না থাকলেও, এটি ব্যবসায়ের চেয়ে বেশি ভারী। রোজ মাংস, দুই গ্যালন রাম সম্ভব না। যদি সম্ভব হতো, তাও আমার স্ত্রী কখনোই অনুমতি দিত না। আর সে যদি না দেয়, তবে আমিও কিছু করতে পারব না।”

আমি বললাম, “তবে কেন আপোসের এই দীর্ঘ চেষ্টা?”


★★★

সত্যি কথা বলতে, এই গোটা বিষয়টায় আমি খুব একটা উৎসাহী নই। এক কোনায় শুয়ে আমি ততটাই দেখছিলাম, এমন হেলানো অবস্থান থেকে যতটা কেউ দেখতে পারে। ততটাই শুনছিলাম, যতটা বুঝতে পারি আমি। এ ছাড়া তো একরকম ঊষালগ্নেই বাস করছি আজ অনেকমাস যাবত। অপেক্ষা করছি নিঝুম রাত নামার। আমার কারাসঙ্গী অবশ্য ভিন্ন অবস্থায় আছে। অদম্য একটা চরিত্র তিনি, একজন দলপতি। তার অবস্থা আমি আন্দাজ করতে পারি। তিনি ওই দৃষ্টিভঙ্গির লোক, যার দুর্দশা বিপরীত মেরুর অনুসন্ধানকারীর মতো, যিনি বেহাল অবস্থার চাপে জমাটবদ্ধ হয়ে পড়েছেন কিন্তু শীঘ্রই যার পরিত্রাণের পালা আসবে অথবা ইতিমধ্যেই যাকে মুক্ত করা হয়েছে। তবে এতে অনৈক্যও আছে: কেবল তার বিজয়ী ব্যক্তিত্বের ওজন বিবেচনা করে, তাকে উদ্ধার করা হবে এটা তার কাছে কল্পনাতীত। তার কি এবার পরিত্রাণ কামনা করা উচিত? তার কামনা করা বা না করায় অবশ্য কিছু আসে যাবে না, উদ্ধার সে হবেই। তবে; তার কামনা করা উচিত কিনা, সে প্রশ্ন কিন্তু রয়েই যাবে। আপাতদৃষ্টিতে তার সাথে সংযুক্ত এই নিগূঢ় প্রশ্নটি নিয়ে তিনি আগাগোড়া ভাবেন, আমার সামনেও উত্থাপন করেন। আমরা একসাথে বসে আলোচনা করি। তার উদ্ধারকর্ম নিয়ে আমরা বাতচিত করি না। উদ্ধারের জন্য সম্ভবত, কোনো উপায়ে লব্ধ ছোট্ট ওই হাতুড়িতেই তিনি তার সকল আশা আটকে রেখেছেন, যেই হাতুড়ি ড্রয়িংবোর্ডে পিন আটকাতেই মানুষ ব্যবহার করে বড়জোর। এর বেশিকিছু পাওয়ার সামর্থ্য তার নেই, কিন্তু এটিও তিনি ব্যবহার করেন না। এটির ওপর তার অধিকারের বিষয়টি শুধুমাত্র আনন্দিতই করে তাকে। কখনো কখনো তিনি আমার পাশে নতজানু হয়ে বসেন এবং হাতুড়িটি ধরে থাকেন যেটি হাজারবার আমি আমার মুখের সামনে দেখেছি, নয়তো আমার হাতটি টেনে নিয়ে মেঝেতে বিছিয়ে হাতুড়ি দিয়ে আমার আঙুলগুলো ঠুকতে থাকেন। তিনি ভালো করেই জানেন দেয়াল হতে চটও খসানোর ক্ষমতা নেই হাতুড়িটির এবং তিনি ওকাজ করতেও আগ্রহী নন। কখনো কখনো হাতুড়িটি সারা দেয়ালে চড়িয়ে বেড়াতে থাকেন তিনি, যেন উদ্ধারকর্মের জন্য অপেক্ষারত যন্ত্রপাতিকে তাদের এই অপারেশনে একটু দোলা দেওয়ার সংকেত দিচ্ছেন। ঠিক এই তরিকায় তো নয় কিন্তু যথাসময়ে পরিত্রাণকর্ম ঠিকই আরম্ভ হবে। হাতুড়ি নির্বিশেষে কোনো কাজে তো আসবে না, কিন্তু কিছু একটা হয়ে রয়েই যাবে ঠিক। স্পর্শনীয়, উপলব্ধনীয় কিছু একটা। একটা নিদর্শন, যেটিকে চুম্বন করা যায়, পরিত্রাণকে চুম্বন করা না গেলেও।

অবশ্যই, যে কেউ বলতে পারে বন্দীদশা নেতাকে উন্মাদ করে তুলেছে। তার চিন্তাভাবনার বৃত্তটি এতই খর্বাকৃত হয়েছে যে নূন্যতম কিছু ভাববার জায়গা থোড়াই আছে আর।