নবগঙ্গার চিতল
“ঘর খুলিয়া বাহির হইয়া জোছনা ধরতে যাই
হাত ভরতি চান্দের আলো, ধরতে গেলে নাই”
- হুমায়ূন আহমেদ
১.
সন্ধ্যার শিয়ালদহ আজও তেমনই ব্যস্ত। লোকে লোকারণ্য। একটা করে ট্রেন আসছে, মাইকে ঘোষণা হচ্ছে আর মানুষ ছুটছে সেই প্লাটফরমের দিকে। অন্যদল ট্রেন থেকে নামছে; ছুটছে গন্তব্যে। প্রচণ্ড ভিড় ঠেলে ক্যানিং লোকালে উঠে পড়েন ধীরেণবাবু। কাজ করেন গড়িয়াহাটের একটা কাপড়ের দোকানে। সরকার বা অন্যকথায় ম্যানেজার। থাকেন ক্যানিংয়ে। রেলস্টেশন থেকে নেমে টাউনের দিকে যেতে বা হাতের প্রথম গলি। তারপর পূজামণ্ডপ বামে রেখে পুকুর পাড় দিয়ে হাতের ডানের গলি। আজও গন্তব্য সেই চরপাড়া। চরপাড়ায় তার নিজের বাড়ি। সম্পন্ন গৃহস্থ বলা যায়।
আটটার ট্রেন শেয়ালদা ছাড়ে সোয়া আটটার দিকে। ট্রেনে তখন ‘ঠাঁই নাই’ ‘ঠাঁই নাই’ অবস্থা। দাঁড়ানোর জায়গা পাওয়া কঠিন। এই ভিড়ের মধ্যেই নিজেকে সেঁধিয়ে দিয়েছেন ধীরেণবাবু। ক্যানিং লোকালের পঁচিশ বছরের ডেইলি প্যাসেঞ্জার। অভিজ্ঞতা থেকে জানেন, ছটফট করে কোনো লাভ নেই; চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকাই ভালো। চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ব্যাগটা দিয়েছেন সুরেণের কাছে। সুরেণ সিট পেয়েছে। সুরেণের সাথে ধীরেণ বাবুর কখনো সেরকম কথা হয় নি। দু-একদিন সিগারেট ধরাতে গিয়ে আগুন চেয়ে নিয়েছেন স্টেশনে—এটুকুই। সুরেণ নামবে সোনারপুর। প্রতিদিন দেখছেন; তাই জানেন। প্রায়-অপরিচিত মানুষের কাছে ব্যাগ দিতে পারাটা এখানে স্বাভাবিক ব্যাপার। দাঁড়িয়ে যাওয়া যাত্রীদের অধিকার বলেই ধরে নেওয়া হয়। সবাই ডেইলি প্যাসেঞ্জার। মুখচেনা। যেদিন যে বসতে পারে অনেকের ব্যাগ নিয়ে বসতে হয়।
যাদবপুরে এসে আরো যাত্রী উঠল। এটাই শেষ ট্রেন। যেতেই হবে। কারো কারো যেতে যেতে রাত দশটা সাড়ে দশটা বাজবে। তারপর রাতটা বাড়িতে কাটিয়ে সকাল সাড়ে ছটায় আবার ট্রেনে ওঠা। আবার যাত্রা মহানগর কলকাতার দিকে। নতুন আরেকটা দিন শুরু। একই রকম দিন। ব্যস্ততা, ভিড়, ভালো, মন্দ অভিজ্ঞতার দিন। যাদবপুর থেকে ট্রেন ছাড়ার পর সবাই যেন হাফ ছাড়ে। জানে আর ভিড় বাড়বে না। এর পরের স্টেশন থেকে লোক নামতে শুরু করবে। ট্রেন তখন ভিড়ে-ঠাসা কলকাতা ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে। চলছে মাঠের ভিতর দিয়ে—দুপাশে গ্রাম, গঞ্জ আর জনপদকে পেছনে ফেলে। সোনারপুর এসে যাত্রী নামা শুরু। এরপর যাত্রী শুধু কমতেই থাকবে। ভিড় একটু পাতলা হতেই চারজন যাত্রী পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তাস খেলতে শুরু করে। চারজনের প্যান্টের কোমরের কাছে গুঁজে নেয় বড় একটি রুমালের চারটি কোনা। তারপর ওই রুমালকে বোর্ড করে তার ওপর চলে তাস খেলা। সেই সকাল থেকে রাত—জীবিকার জন্য জীবনকে টেনে নিয়ে যাওয়া। সমস্ত দিনে হয়তো এটুকুই বিনোদন। এখন বস বা মালিকের কড়া চোখ নেই, ছেলের স্কুলের বেতন নেই, ঘরের চাল বা তরকারি নেই। শুধুই বিনোদন—সেই ছেলে বেলার মতো। মধ্যবয়সী মানুষগলো যেন হারিয়ে যায় অন্য জগতে।
ওদিকে ধীরেণবাবু হারিয়ে গেছেন তার জগতে। সোনারপুরে এসে তিনি বসার জায়গা পেয়েছেন। সুরেণ নেমে যাওয়ার সময় তাকে ডেকে ওই সিটে বসিয়ে দিয়ে গেছে। ধীরেণবাবু তার সদ্য কেনা খেলনাটি নিয়ে বসেছেন—স্মার্ট ফোন।
মাসখানেক আগে মেয়ে-জামাই এসেছিল বেড়াতে। তার স্মার্টফোন নিয়ে নাতনি দেবলা এসে বলল, “দাদু আমার স্কুল দেখবে ইন্টারনেটে?” ধীরেণ বাবু প্রথমে বিশ্বাস করেননি; ভেবেছেন ছেলেমানুষি। কিন্তু দেবলা সত্যিই গুগল আর্থে গিয়ে তাকে দেখিয়ে দিল তার স্কুল। তারপর দেবলা দেখিয়ে দিল ক্যানিং স্টেশন থেকে ধীরেণবাবুর বাড়িতে আসার পথ, তার বাড়ি আর ক্যানিংয়ের পাশের মাতলা নদী। আঙুলের ছোঁয়ায় ছোট জায়গাকে বড় করে যেমন দেখা যায় আবার বড় জায়গাকে ছোট করে চারপাশটা দেখা যায়। ধীরেণবাবু চমৎকৃত হয়েছিলেন। মনে মনে ভেবেছিলেন, এই জিনিস তার একটা চাই। মাস শেষে কিনেও ফেলেন একটি সস্তা দামের স্মার্টফোন। খোকার মা অবশ্য বলেছিল, অযথা পয়সা খরচের দরকার কী, আগের ফোনে তো কথা শুনতে কোনো সমস্যা হয় না। কিন্ত দরকার যে কী তা জানেন একমাত্র ধীরেণবাবু—তিনি ইন্টারনেট ব্রাউজ করবেন, গুগল আর্থে যাবেন।
দোকানের কর্মচারী গোবিন্দ আবার ইন্টারনেট-ফেসবুকে ওস্তাদ। সারাক্ষণ ফোনেই লক্ষ; খদ্দেরকে কাপড় দেখাতে দেখাতেও পারলে একবার স্ক্রিনে চোখ রাখে। ধীরেণ বাবু অনেক বকাবকিও করেন তাকে এ নিয়ে। সেই ধীরেণ বাবু যখন গোবিন্দকে বললেন, একটু শিখিয়ে দে, গোবিন্দ তখন মহা উৎসাহে লেগে পড়ে তার ধীরেনদাকে শেখাতে। বসের চাইতে একটা বিষয়ে সে ভালো, বস সেটা স্বীকার করে তার কাছ থেকে শিখতে চাইছেন, এর চাইতে আনন্দের আর কী হতে পারে গোবিন্দের কাছে।
২.
গত কয়েকদিন ধরে তিনি ট্রেনে আসা যাওয়ার সময় ফাঁক পেলেই ইন্টারনেট ব্রাউজ করেন। খবর পড়েন, রাজধানী এক্সপ্রেসের সময়সূচি দেখেন, স্বামী বিবেকানন্দের বাণী পড়েন। একটা সার্চ তিনি দেবেন, যে জন্য এই ফোন তিনি বুড়ো বয়সে কিনেছেন। সেই সার্চটি দিতে গিয়েও কোথায় যেন বাঁধছে। দেওয়া হয়ে উঠছে না। আজ তিনি সেই সার্চ দিলেন। গুগলে গিয়ে লিখলেন, ‘নবগঙ্গা’; চাপ দিলেন সার্চ বাটনে। নেট বেশ স্লো। লোডিং ইন্ডিকেটর ঘুরছে তো ঘুরছেই। ধীরেণবাবুর মনে হচ্ছে অনন্তকাল তিনি সার্চ দিয়ে বসে আছেন, অনেক দূরে তিনি যাচ্ছেন।
তারপর অনেকগুলো ওয়েবপেজের নিশানা আসে; একটা মানচিত্র আসে; আসে কতকগুলো ছবিও। একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে একজন বয়স্কমানুষ, লুঙ্গি-গেঞ্জি পরা, মাথায় টুপি, বিশাল এক চিতল মাছ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। হাসি হাসি মুখ। পাশে সম্ভবত তার স্ত্রী দাঁড়ানো; তার মুখও হাসি হাসি। ধীরেণবাবু অন্য পেইজগুলো বাদ দিয়ে ওই ছবিটাতেই ক্লিক করেন। চিতল তার খুব প্রিয় মাছ। গড়াই নদীর চিতল মাছ বিখ্যাত।
গড়াইয়ের শাখানদী নবগঙ্গার মাছের স্বাদও অনন্য। নবগঙ্গার চিতল জিরা, গরম মশলা আর চুই দিয়ে মা রান্না করতেন। সেদিন একটা উৎসব-মুখর দিন থাকত। তাদের বাড়িতে মাংসের চল ছিল না। বড় আকারের চিতল ছিল একটা বিশাল ব্যাপার। ধীরেণবাবু চিতলের পেটির মাছ ভালোবাসতেন। গাদার অর্থাৎ পিঠের দিকের মাছ তিনি খেতে পারতেন না; বড্ড কাঁটা। ভাবতে ভাবতে চোখে জল চলে আসে। তিনি ছবির ওয়েবসাইটটিতে ক্লিক করেন। বিষয়টা হচ্ছে, ছবির এই বয়স্ক মানুষটি বিশাল আকারের এই মাছটি ধরেছেন। খালি হাতে। তিনি স্নান করতে নেমেছিলেন নবগঙ্গায়। ১৪ কেজি ওজনের মাছটি তিনি তখন ধরে ফেলেন লুঙ্গিতে পেঁচিয়ে।
গামছা পরে স্নান করতে নেমে গামছার একমাথা পরে থেকে অন্য মাথা দিয়ে কলমি ঝোপের নিচে ছেঁকে তুলে চুনোপুটি তিনিও ধরেছেন ছোটবেলায়। সমস্যা হচ্ছে গামছার অন্যমাথা কলমির নিচে দিয়ে ছেকে তুলতে তুলতে এমাথা কোমর থেকে খুলে পড়ার রিস্ক খুব বেশি। চুনোপুটি ধরতেই ওই অবস্থা; আর ১৪ কেজি ওজনের চিতল! হেসে ফেলেন ধীরেণবাবু। পাশের যাত্রী ঘাড় ঘুরিয়ে তাকান, “দাদা খুব মজার কিছু পেলেন নাকি; হাসছেন যে বড়।” ধীরেণবাবু নিজেকে সামলে নেন, “না, ওই আর কি।”
ব্যাক করে তিনি সার্চ দেন, ‘পলিতা বাজার’। একটা মানচিত্র আসে গুগলের। সাথে কতকগুলো ওয়েবসাইট। তিনি মানচিত্রে ক্লিক করেন। দেখতে চান পলিতা বাজার, তার শৈশব কৈশোরের সেই পলিতা বাজার, যেখান থেকে নবগঙ্গার খেয়া পার হয়ে মামাবাড়ি যেতেন, এখন কেমন আছে সেসব জায়গা। ওখানকার কেউ কি আর চিনবে তাকে!
৩.
ধীরেণবাবুর শৈশব-কৈশোর কেটেছে নবগঙ্গার তীরে। যশোর জেলার মাগুরা মহাকুমার পরমেশ্বরপুর গ্রামে। নদীর তীরে দৌড়াদৌড়ি করে, নদীতে লাফালাফি ঝাপাঝাপি করে বড় হয়েছেন তিনি। তারপর একদিন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি, ভরা বর্ষায় দু কূল ছাপানো নবগঙ্গা বেয়ে পরমেশ্বরপুর ছেড়ে নৌকায় করে নড়াইল। সাথে বাবা-মা, একটিন চিড়ামুড়ি, একটা বোচকার মধ্যে কতকগুলো কাপড়চোপড় আর সামান্য সোনাদানা। নৌকা ভর্তি মানুষ। সবার একই অবস্থা। কেউ জানে না কোথায় গিয়ে থামবে তারা।
ঠাকুরমার অস্থি ছিল বাড়ির উঠোনের তুলসীতলায় পোঁতা। গত তিন বছরে বাবার সময় হয় নি ভারতে গিয়ে গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়ার। কেউ খেয়াল করেনি, বাবা আসার সময় সেই অস্থি নিয়ে এসেছেন সাথে করে। নড়াইলের ঘাটে সুর্যোদয়ের মুহূর্তে বাবা ডাকেন—“ধীরেণ, ওঠ, আয় গাঙে ছ্যান করি।” মা বলেছিল, “এত ভোরে ছ্যান কিসির? ক’নে যাচ্ছি তার ঠিক নেই। তুমি যাচ্চো ছ্যান করতি।” বাবা কোনো কথা শোনেননি। এক প্রকার হাত ধরে টেনে তিনি ধীরেণকে নামান নৌকা থেকে। স্নান সেরে নদীতে দাঁড়িয়ে সূর্য প্রণাম করে তিনি বললেন, “ধীরেণ, তোর ঠাম্মার অস্থি গঙ্গায় বিসর্জন দিতি পারলাম না। এও তো সেই একই জলের ধারা। এহেনিই বিসর্জন দিই সেই অস্থি।” বাবা তার গায়ে জড়ানো গামছার নিচ থেকে বের করেছিলেন ঠাকুর ঘরের সিঁদুরের-ফোঁটা-দেওয়া কাঁসার ঘট। এর মধ্যে করে তিনি মায়ের অস্থি নিয়ে এসেছিলেন। তারপর বাবা-ছেলে মিলে অস্থি বিসর্জন দেন নড়াইলের ঘাটে। বারানসীর দশাশ্বমেধ ঘাটে তিনি জাগযজ্ঞের মাধ্যমে যা তিনি করতে চেয়েছিলেন, তাই তিনি করলেন চলতি পথে নড়াইলের খেয়াঘাটে। অথচ তখন তিনি ভারতের উদ্দেশ্যেই যাচ্ছেন। বাবা কি জানতেন, ভারতে আসা হলেও গঙ্গা পর্যন্ত যাওয়া তার হবে না?
সন্ধ্যারাতে রওনা হয়ে ভোর নাগাদ নড়াইল। তারপর সারাদিন পায়ে হেঁটে যশোর। পেছনে নবগঙ্গা, পেছনে পরমেশ্বরপুর, পেছনে শৈশব-কৈশোর। সামনে উদ্বাস্তু মানুষের স্রোত। যাচ্ছে বেনাপোলের দিকে। প্রায় তিন দিনের এই পথচলার শেষে যখন বনগাঁর একটা ক্যাম্পে জায়গা হলো, ততক্ষণে বাবা হারিয়ে ফেলেছেন তার সমস্ত জীবনী শক্তি। রিফিউজি ক্যাম্পে বাবা চার দিন বেঁচে ছিলেন। পঞ্চম দিন ভোরে, শীর্ণ-ক্লান্ত রিফিউজিরা সারারাত জেগে থেকে যখন কেউ ঘুমাচ্ছে, কেউ ঝিমাচ্ছে তারই কোনো এক ফাঁকে তিনি চলে যান। স্ট্রোক করেছিল হয়তো।
কয়েক মাস পরে যুদ্ধ থামে; দেশ স্বাধীন হয়। অধিকাংশ মানুষ ফিরে যায় স্বাধীন বাংলাদেশে নিজের শিকড়ের কাছে। তাদের চোখেমুখে স্বপ্ন। কিশোর ধীরেণ যায় না; মাকে নিয়ে সে থেকে যায় বনগাঁয়। তারপর বহু পথ ঘুরে, বহু ঘাটে ধাক্কা খেয়ে একেবারে দক্ষিণে সুন্দরবন সংলগ্ন মহাকুমা শহর ক্যানিংয়ে এসে বসতি গড়েন। কয়লা ফেরি করতেন শুরুতে। তারপর অনেক রকম কাজ করেছেন। শেষটা থিতু হয়েছেন গড়িয়াহাটের এই কাপড়ের দোকানে। ফুট ফরমাস খাটা ছেলে থেকে আজ সরকার বা ম্যানেজার। মাঝে পঁয়ত্রিশটা বছর। মাঝে বনগাঁর ক্যাম্প ছেড়ে যাদবপুরের বস্তি। মাঝে বিয়ে সংসার। মাঝে মাকে হারানো। মাঝে দুই ছেলে মেয়েকে পাওয়া। এরই মাঝে দূর থেকে দূরে চলে গেছে নবগঙ্গা; দূরে চলে গেছে পরমেশ্বরপুর, পলিতা বাজার; দূরে চলে গেছে জিরা-গরম মশলা-চুই দিয়ে রাঁধা চিতল। দূরে চলে গেছে তার শৈশব-কৈশোর। কখনো যাওয়া হয়নি আর। স্ত্রী যাদবপুরের মেয়ে। শেকড় ছেঁড়ার কষ্ট সে বুঝবে না; ধীরেণবাবু বোঝাতে যাননি কখনো। হঠাৎ কখনো বৃষ্টির দুপুরে জানালার কাছে বসে মনে পড়েছে বৃষ্টির দুপুরে নবগঙ্গায় লুটোপুটি ঝাপাঝাপি। চোখের কোনে অশ্রু জমেছে। মুছে ফেলেছেন। এটুকুই।
৪.
শুধু সেবার। অম্বরিশ মাগুরা থেকে ফেরার পর তিনি অম্বরিশের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। অম্বরিশ থাকতেন ডানলপের দিকে। অম্বরিশ লক্ষীদিয়ার মানুষ। পরমেশ্বরপুরের পাশের গ্রাম। মাগুরার লক্ষীদিয়া থেকে এসে কলকাতার উপকণ্ঠে থিতু হওয়া অম্বরিশের গল্পটাও প্রায় একই রকম। অনেক বছর বাদে অম্বরিশ যখন মাগুরা যান, তখন তিনি ক্যান্সারে ভুগছেন। হয়তো শেষ দেখা দেখতে চেয়েছিলেন নিজের জন্মভিটাকে। হয়তো খুঁজে ফিরতে চেয়েছিলেন হারানো সেইসব দিনকে যেখানে ক্যান্সারের যন্ত্রণা নেই; অভাব-অনটনের জীবন যাপনের গ্লানি নেই।
মাগুরা এখন জেলা, পরমেশ্বরপুর পড়েছে মোহাম্মদপুর থানায়। মাগুরা শহর থেকে নবগঙ্গার তীর ধরে পাকা রাস্তা। বাস চলে। পলিতা বাজারের ঘাট আর নেই। সেখানে ব্রিজ। নদীটা আর সেই নবগঙ্গা নেই; প্রায় মরে গেছে। এসব কথার মধ্যে ধীরেণবাবু প্রশ্ন করে বসেন, “তা আমাগে কথা কেউ বাত্তা ন’লো না?” এত বছর পর সেই ভাষা! কোথায় ছিল এত দিন! পশ্চিমবঙ্গের কথার সাথে এর কোনো মিল নেই। প্রতিদিন এখানকার ভঙ্গিতে কথা বলছেন। মনের মধ্যে কোথায় লুকানো ছিল সেই নবগঙ্গাপাড়ের ভাষা! নিজেই চমকে যান। অম্বরিশও চমকে তাকান ধীরেণের দিকে।
পরমেশ্বরপুরের বসুরা ছিল সম্ভ্রান্ত পরিবার। তাদের কথা অনেকে জিজ্ঞাসা করেছে। জিজ্ঞাসা করেছে আরো অনেকের কথা। এদের সাথে অম্বরিশের যোগাযোগ নেই; যোগাযোগ থাকার কথাও নয়। একই এলাকা থেকে এলেও সমাজের বিভিন্ন ভাগে তাদের অবস্থান। জীবন যুদ্ধে ছিটকে পড়েছে বিভিন্ন জায়গায়। যে যার মতো ব্যস্ত। কোনো খবরও দিতে পারেনি সে। কিন্তু বিশেষত্বহীন কিশোর ধীরেণের কথা কেউ তেমন জিজ্ঞেস করেনি। শুধু একজন এসেছিল শুধুমাত্র ধীরেণের খবর জানতে—আলেক। আলেকের বাড়ি পানিঘাটায়। ঈশ্বরপুরের পাশের গ্রাম। ধীরেণের ছোটবেলার বন্ধু। একসাথে খেলার বন্ধু, একসাথে মাছ ধরার বন্ধু, ভরদুপুরে আম পাড়ার বন্ধু। আলেকদের বাড়িতে খেজুরের রস দিয়ে গুড় বানানো হতো। বড় বড় তাফালে রস জাল দেওয়া হতো সকাল থেকে। পাশে বসে দেখেছে কত কত দিন! আবার গুড় ঠান্ডা হওয়ার পর আঙুল দিয়ে খুঁচে তুলে খেয়েছেও দুজনে। অসম্ভব রঙিন অসংখ্য দিন মনে পড়ে যায়। প্রশ্ন করেন, “আলেক আছে কী র’ম?” সেই ভাষায় তিনি খুঁজছেন ছেলেবেলাকে। অম্বরিশ জানান, আলেকের শরীরও খুব ভালো নয়; বয়স তো সবার হচ্ছে। তার ছেলেপেলেরা বড় হয়েছে। পলিতাবাজার আর আশপাশের গ্রামে এখন মূল আলোচ্য বিষয় হচ্ছে, আলেকের এক ছেলে ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছে। এখন ট্রেনিং চলছে; কদিন বাদেই পোস্টিং হবে। “মেজিচটেট!” উচ্ছ্বসিত ধীরেণবাবু চিৎকার করে ওঠেন। এ যেন তার নিজের ছেলের বিশ্বজয়। একটা আন্তর্জাতিক সীমানার ওধারের একজন মানুষ, যাকে কোনো দিন দেখেননি; হয়তো কখনো দেখবেনও না; তার সাফল্যে তিনি গর্বিত বোধ করেন।
৫.
একটু ঝিমুনি মতো এসেছিল কি? ঠক করে ফোনটা পড়ে যায় হাত থেকে। ধীরেণবাবুর ঘুম এমনিতেও পাতলা। তার ওপরে এমন সাধনার ধন হাতে, অবচেতন মনও বুঝি সচেতন ছিল। তিনি চোখ মেলে ফোনটি কুড়িয়ে নিলেন। প্যান্টের পকেটে রাখলেন।
সোয়া দশটার দিকে ট্রেন যখন ক্যানিং স্টেশনে থামল তখন আর খুব বেশি যাত্রী নেই সেখানে। লাস্ট স্টেশন বলেই হয়তো কারো মধ্যে তাড়াহুড়ো নেই; ধীরে সুস্থে নামছে সবাই। স্টেশনের দু-একটা দোকান তখনও খোলা। অপেক্ষায় ছিল শেষ ট্রেনের যাত্রীদের। এত রাতেও কেউ কেউ বাড়ির দিকে পা বাড়ানোর আগে স্টেশনে বসে এক ভাড় চা খাবেন; দোকানদারের সাথে গল্পগাছা করবেন। খোঁজ নেবেন সারাদিন কী কী উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটল ক্যানিংয়ে। এখানে তারা বাস করেন সত্যি। কিন্তু রবিবার ছাড়া দিনের বেলার ক্যানিং তো তারা দেখেন না। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে বেরিয়ে যান কলকাতার উদ্দেশ্যে আর ফেরেন এই প্রায়-মধ্যরাতে; ক্যানিং তখন প্রায় ঘুমানো। তাই ঘরে ফেরার আগে চায়ের দোকানে বসে একটু চা সিগারেট খাওয়া। ক্যানিংয়ের গল্প শোনা আর কলকাতার গল্প দেওয়া।
ধীরেণবাবু সাধারণত কারো পাল্লায় না পড়লে ট্রেন থেকে নেমে আর কোথাও দাঁড়ান না। হাঁটতে থাকেন বাড়ির দিকে। এ পথটুকু তিনি হেঁটেই যান প্রতিদিন। তাতে একটু হাঁটাচলাও হয়; পয়সাও বাঁচে। প্রতিদিনের তার এই নিয়ম সহযাত্রীরা জানেন বলেই কেউ আর তাকে রিকশায় ওঠার সময় ডাকেন না।
ধীরেণবাবু ট্রেন থেকে নামলেন একটু দেরি করে। ততক্ষণে ঝাড়ুদার ট্রেনে উঠে গেছে। শরীরটা যেন একটু ভারী ভারী লাগছে তার। ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে দু হাতে দুপাশের হাতল ধরে সাবধানে নামবার চেষ্টা করলেন। বাঁ পাটা প্রথম সিঁড়িতে দিয়েছেন আর অমনি হঠাৎ আকাশের দিকে চোখ চলে গেল। তারাভরা আকাশ। মেঘ ভেসে যাচ্ছে। সেই মুহূর্তে একখণ্ড মেঘ চাঁদকে আড়াল করে আবার ছেড়ে দিল। ধীরেণবাবু হঠাৎ অভিভূত হলেন, যেটা তিনি সাধারণত হন না। সাবধানে নামলেন। হাঁটতে শুরু করলেন বাড়ির দিকে।
৬.
মামাবাড়ি শত্রুজিৎপুর থেকে বাড়ি ফিরছে ধীরেণ। হাঁটা রাস্তা। হাতের বামে নবগঙ্গা। তার তীর ধরে রাস্তা। রাস্তা মানে ওয়াপদা বাঁধ। ষাটের দশকের শেষ দিকে মূলত বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য পুরো দক্ষিণ বঙ্গে নদীর তীর ঘেঁষে এই বাঁধগুলি দেয় পাকিস্থান সরকার। বন্যার ভয় কমলো; সাথে কমলো মাছ। ছোট গাঙগুলোর মুখ বন্ধ করে দেওয়া হলো। তার কিছুদূর গিয়ে কৃত্রিম খালের মাধ্যমে নবগঙ্গার সাথে ছোট গাঙের যোগাযোগ। মাঝখানে স্লুইজ গেইট। গাঙগুলো হয়ে পড়ল খাল। প্রকৃতির জোয়ার-ভাটা নেই সেখানে। মানুষ যদি গেইট খোলে তবেই জল ঢুকতে পারে; বেরোতে গেলেও একই নিয়ম। ফলে মরে গেল ছোট ছোট খাল বা শিশে। মাছ কমলেও কিছু কিছু মাছ, বিশেষত চিতল, তখনও নবগঙ্গায় পাওয়া যেত প্রচুর। আজ সকালে ধরা পড়েছে দুটি দশাসই চিতল—এক একটা সাড়ে তিন চার কেজির কম হবে না। বাবা বললেন, “ধীরেণ, এট্টা মাছ দিয়ে আয় তোর মামাগে।” ধীরেণও খুশি। সেই পুজোর পরে আর মামাবাড়ি যাওয়া হয়নি। একটা চটের থলেয় চিতল মাছ নিয়ে ধীরেণ রওনা হয় শত্রুজিৎপুর। সেখানে দুপুরের খাবার খেয়ে রওনা হতে হতে বিকেল। কী ক্ষতি হতো একটা দিন থেকে আসলে? না, বাবার কড়া হুকুম আজই ফিরতে হবে। কাল সকালে জমিতে মই দিতে হবে।
শত্রুজিৎপুর থেকে পলিতা বাজার অন্তত মাইল চারেক। সেখানে খেয়াঘাট। ঘাট পেরিয়ে নবগঙ্গার অন্য পার ধরে আরো প্রায় এক মাইল দূরে পরমেশ্বরপুরে তার বাড়ি। সন্ধ্যার আগে পৌঁছাতে পারবে তো পলিতা বাজার? শেষ খেয়া ছেড়ে যাবে না তো। ধীরেণ যেভাবে চলতে থাকে তাকে ঠিক হাঁটা বলা যাবে না, আবার দৌঁড়ানোও বলা যাবে না—মাঝামাঝি কিছু একটা।
হিমালয় থেকে নেমে আসা গঙ্গা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে যখন বাংলাদেশে ঢোকে তখন তার নাম হয় পদ্মা; চলতে থাকে দক্ষিণ-পশ্চিমে। পদ্মা যখন কুষ্টিয়ার কাছ দিয়ে গোয়ালন্দের দিকে যাচ্ছিল তখন তার থেকে বেরিয়ে পড়ে এক শাখা। কুষ্টিয়া থেকে মাগুরা হয়ে চলে গেছে ফরিদপুরের দিকে। কখনো তার নাম গড়াই; কখনো মধুমতি। কুমারখালীর কাছে এই গড়াইয়ের একটি ছোট্ট শাখা উঠে এসেছে। চলে গেছে নড়াইলের দিকে। ছোট্ট শাখাটি ফিরে পেয়েছে সেই আদি ধারার নাম—গঙ্গা। এ নদীর নাম নবগঙ্গা। গঙ্গার ধারা হিসেবে অথবা নামের কারণে এ নদীর ধারাকে শ্রদ্ধা করে দুই পারের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। অনেকে স্নানের সময় নাভি-সমান জলে দাঁড়িয়ে নদীকে প্রণাম করেন।
নবগঙ্গার পলিতা ঘাটের পাটনী অর্থাৎ খেয়ার মাঝি বিষ্ণুদা। লোক ভালো। কিন্তু সন্ধ্যায় একবার বৈঠা রেখে পা ধুয়ে ঘরে উঠতে পারলে আর নামতে চায় না। বাড়িতে ডাকতে গেলে আসে, কিন্তু বিরক্তি প্রকাশ করতে ছাড়ে না। আর কোথাও গিয়ে তাসের আড্ডায় বসলে তো কথাই নেই। যতই যাত্রী দাঁড়িয়ে থাকুক দু দান না খেলে উঠবে না। বয়স্ক কোনো যাত্রী হলে তবু কতকটা; কিন্তু ধীরেণকে সে পাত্তা দেবে না। যাত্রী পার করা নিয়ে তার কোনো বাড়তি গরজ নেই। এ ঘাটে খেয়া পার হয়ে কাউকে টাকা পয়সা দিতে হয় না। বছরে একবার, ধানের সিজনে, বিষ্ণুদা আর তার বাবা পাশের সবগুলো গ্রামের সব বাড়িতে যাবেন। সারা বছরের পারানি বাবদ ধান আনবেন। সাধারণত প্রতি পরিবারের জন্য দুই পা’লে। পা’লে হচ্ছে বেতের ধামা, পাঁচ সের ওজনের ধান ধরে এমন সাইজের। তবে ধরাবাঁধা নয়; কেউ কম দিলে কমই সই। সারা বছরের পারানি সবার দেওয়া থাকে; কে কতবার পার হলো কেউ হিসাব করে না।
৭.
সন্ধের মধ্যে ঘাটে যেতেই হবে। ধীরেণবাবু জোরে জোরে পা চালাতে চাইলেন। যত জোরেই তিনি চলতে যান গতি যেন বাড়ছে না। দু-একবার হোঁচটও খেলেন। হুমড়ি খেয়ে পড়লেনও একবার। আবার উঠে চললেন। ওয়াপদা রাস্তা থেকে নদীর ঘাট পর্যন্ত সরু ভেড়ি—জমির আলের ওপর দিয়ে হাঁটার রাস্তা। ধীরেনবাবু পড়িমরি করে ছুটছেন। ওই যে বটগাছ দেখা যাচ্ছে। দূর আর বেশি নেই। ওয়াপদা রাস্তার বাম দিকে সোজা চলে গেছে ভেড়ি আর ডান দিকে একটা বটগাছ; বিষ্ণুদাই লাগিয়েছে। বলেছে এটা তার ঘাটের নিশানা।
বটগাছ দেখে নিজের গতি আরো বাড়ালেন ধীরেণবাবু। ততক্ষণে চাঁদ উঠেছে। মাথার উপরে ‘অনন্ত নক্ষত্রবীথি’। ঝলমলে, ভীষণ উজ্জ্বল আকাশ; চারদিক আলোময়। সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে মনেই হয় না। ধীরেণবাবু পড়িমরি করে ছুটছেন। শেষ খেয়া ধরতেই হবে। মূল রাস্তা থেকে ভেড়িতে উঠে আবার হোঁচট খেলেন। হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। এবার বোধহয় বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলের নখটা গেল। কিছুটা যন্ত্রণা বোধ হলো বটে। হাত দিয়ে চেপে ধরলেন আঙুলটি। হাতে রক্তের উষ্ণতা টের পেলেন তিনি। তবু উঠে ছুটতে শুরু করলেন।
বিষ্ণুদার গলা শোনা যাচ্ছে—“কেডা রে? যাবা নাহি?” ধীরেণবাবু শরীরের সব শক্তি সঞ্চয় করে বলতে চাইলেন, “যাব… আমার যাতিই হবে …আমারে নিয়ে যাও।”
নদীতে এখন ভাটা। জল অনেক নিচে। কাদার মধ্য দিয়ে গিয়ে নৌকায় উঠতে হবে। বিষ্ণুদা তাড়া দিচ্ছে, “তোমার জন্যি এতগুনো মানুষ দাঁড়া নে…জোয়ান ছাওয়াল… এট্টু তাড়াতাড়ি আসতি পারো না?” ধীরেণবাবু স্যান্ডেল খুলে হাতে নিলেন। প্যান্ট গোটানোর সময় পেলেন না—কাদার মধ্যে হাঁটতে থাকলেন। তিনি যত এগোচ্ছেন নৌকার দিকে, নৌকা যেন তত দূরে সরে যাচ্ছে; কিছুতেই তিনি নৌকার কাছে ভিড়তে পারছেন না। “বিষ্ণুদা, এর’ম করতেছো কেন?”
৮.
সারারাত বাড়ি ফেরেননি ধীরেণবাবু। স্টেশনের নাইট গার্ড বলছে যে, সে দেখেছে ধীরেণবাবুকে ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের বাইরে যেতে। লোকটা যাবে কোথায়? পাড়ার লোকেরা রাতভর খুঁজে কোনো কিনারা না পেয়ে সাব্যস্ত করে কাল সকালে থানায় জানাতে হবে। কিছু একটা সমস্যা তো হয়েছে। তা না হলে জলজ্যান্ত মানুষ স্টেশন থেকে বাড়ি পর্যন্ত পাঁচ-সাত মিনিটের পথ যেতে গিয়ে কোথায় হারাবে? সমস্যা হচ্ছে, গলির মোড়ের মন্দিরের শিবু বলতে পারছে না ধীরেণবাবু রাতে মন্দিরের সামনে দিয়ে গেছেন কিনা। তার মানে বাজারের রাস্তা থেকে গলি পর্যন্ত তিনি এসেছেন কিনা বলা যাচ্ছে না। সাধারণত প্রতিরাতে ধীরেণবাবু এই জায়গা দিয়ে যাওয়ার সময় হাঁক দেন... “কী করিস শিবু? খেয়েছিস?” গতরাতে সেরকম কোনো হাঁক যে তিনি দেননি এটা নিশ্চিত। তা হলে শিবু ঘরের মধ্যে থাকলেও শুনত।
ধীরেণবাবুর বাড়িতে কান্নার রোল। এরই মধ্যে সাতটা নাগাদ খবর এলো মাতলার খেয়াঘাটে একটা লোক কাদার মধ্যে পড়ে আছে। জীবিত কি মৃত বোঝা যাচ্ছে না। কেউ গায়ে হাত দেয়নি। পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছে। সবাই পড়িমরি করে ছুটল সে দিকে।
ধীরেণবাবুর বাড়ি যাওয়ার জন্য স্টেশন থেকে যেতে হয় পুবদিকে। আর খেয়াঘাট উত্তরে। তাও মিনিট পনেরোর হাঁটা পথ। স্টেশন থেকে বেরিয়ে বাজার ছাড়িয়ে মাতলা নদীর পাড় ধরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। সেই বাঁধই এখানকার বড় রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে ওদিকে তিনি কেন যাবেন? মাতলা নদীর এপারে ক্যানিং আর ওপারে সুন্দরবন। সুন্দরবনের মধ্যে আছে ছোট ছোট লোকালয়, আছে ছোটখাটো পর্যটন কেন্দ্রও। লোকজন তাই এপথে যাতায়াত করে। কিন্তু দিনের বেলায়। সন্ধ্যার পর আর নয়। মাতলা বড় বিচিত্র নদী। ভাটার সময় একদম শুকিয়ে যায়। তখন লোকে হেঁটে পার হয়। আবার যখন জোয়ার আসে, মারাত্মকভাবে আসে। একেবারে ফুলে ফেঁপে ওঠে; সবকিছু ভাসিয়ে নেয়। মনে হচ্ছে এই লোকটিকেও ভাসিয়ে নিয়ে এসেছে মাতলার স্রোত। সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় নদীর স্রোতে কখনো কখনো মানুষের লাশও ভেসে আসে না তা নয়। কতরকম কাণ্ড চলে জঙ্গলে! তাই পুলিশ না আসা পর্যন্ত কেউ কাছে যাচ্ছে না; সবাই দাঁড়িয়ে আছে দূরে।
বড় রাস্তা থেকে সরু একটা ভেড়ি চলে গেছে খেয়া ঘাট পর্যন্ত। ভেড়ি যেখানে শুরু তার উল্টোদিকে একটা বটগাছ। তার নিচে একটা কাঠের বেঞ্চি। ঘাটের মাঝিই করেছে। বটগাছের গোড়ায় এসে রিকশা ভ্যান থেকে নামে ধীরেণবাবুকে খুঁজতে বেরোনো লোকজন। তারপর একপ্রকার দৌঁড়ে তারা চলে যায় নদীর ঘাটে। ঘাট থেকে বেশ একটু দক্ষিণে লোকজন ভিড় করে আছে। ভেড়ি থেকে নেমে সেখানে যায় সবাই।
ধীরেণবাবুর ছেলে অর্ধেন্দু দলটির মধ্যে সবার আগে পৌঁছে যায় ভিড়টার কাছে। চরের কাদার মধ্যে উপুড় হয়ে পড়ে আছে একটা মানুষের দেহ, মাথাটা একদিকে কাত হয়ে আছে। জামা-কাপড় দেখে কিছুটা দূর থেকেও চিনতে দেরি হয় না—এ তার বাবা। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে সে। কয়েকজন বলে উঠল, “করেন কি দাদা... শেষে পুলিশ কেসে পড়বেন যে... পুলিশ আসার আগে যাবেন না।”
কোনো দিকে কর্ণপাত না করে অর্ধেন্দু ছুটে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে কাদায়। বাবার শরীরটাকে ধরে চিৎ করে মাথাটা কোলের উপরে তোলে। শরীরটা ঠান্ডা নয়। বরং ভীষণ গরম। অর্ধেন্দু চিৎকার করে ওঠে, “বাবা! বাবা!” ইতোমধ্যে আরো লোক পৌঁছে গেছে। একজন দৌঁড়ে খেয়া নৌকা থেকে মাঝির জলের ঘটি নিয়ে এসে ধীরেণবাবুর চোখে মুখে জল ছিটিয়ে দিতে থাকে। ওদিকে অর্ধেন্দু বাবার কাঁধ ধরে হালকা ঝাঁকুনি দিচ্ছে আর ‘বাবা’ ‘বাবা’ বলে চিৎকার করে যাচ্ছে।
তাকে যুগপৎ আনন্দিত এবং বিস্মিত করে ধীরেণবাবু কাতর স্বরে টেনে টেনে বলে ওঠেন, “মা আমারে পেটির মাছ দেবা কিন্তু... গাদার মাছে বড্ড কাঁটা...”