জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধু ও সোনার বাংলার স্বপ্নের বাস্তবায়ন (২)

  • মিনার মনসুর
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

গ্রাফিক: বার্তা২৪.কম

গ্রাফিক: বার্তা২৪.কম

জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধু ও সোনার বাংলার স্বপ্নের বাস্তবায়ন (১)


কিভাবে সম্ভব হলো এতসব অসাধ্য সাধন? যারা বাংলাদেশকে আঁতুড় ঘরেই হত্যা করতে চেয়েছিল, যারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত এ দেশটির ললাটে লেপে দিয়েছিল ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র অপবাদ, যারা মাঝপথে খাদ্যবোঝাই জাহাজ ফিরিয়ে নিয়ে লাখ লাখ মানুষকে ঠেলে দিয়েছিল নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে এবং যারা কথায় কথায় আরোপ করে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা—তারাই এখন এ প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে প্রবৃত্ত হয়েছেন। তারা খোলাখুলিই বলছেন যে বাংলাদেশের সামগ্রিক অগ্রগতি এককথায় ‘বিস্ময়কর’। শুধু তাই নয়, তারা এখন এ বিস্ময়ের কারণও খুঁজে দেখছেন। এ নিয়ে বিশদ গবেষণা করা প্রয়োজন বলেও মনে করছেন। বাংলাদেশের মতো নগণ্য একটি দেশকে নিয়ে তাদের এতো আগ্রহ কেন—সেই প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছেন তারা অকপটে। বলেছেন, বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কাজে লাগাতে চান তারা।

বিজ্ঞাপন

এই যে বিস্ময়কর সাফল্য তার উত্তরটি আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা জানেন না—এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। উত্তর তারা অবশ্যই জানেন। সরাসরি না বললেও আভাসে-ইঙ্গিতে তা বলছেনও। সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনার নেতিবাচক ভূমিকা ও অবস্থান কারো অজানা নয়। সেই ভদ্রলোকও রাখঢাক ছাড়াই বাংলাদেশের এ বিস্ময়কর অগ্রযাত্রার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে গেছেন বিদায়ের প্রাক্কালে। বলেছেন, বাংলাদেশ যে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, তা স্বীকার করতে তার কোনো দ্বিধা নেই। ভিন্ন নয় বর্তমান রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া স্টিফেন ব্লুম বার্নিক্যাটের অবস্থানও। একই কথা বলে আসছে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), আইএমএফসহ বিশ্বের নামিদামি সব মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠানও। তবে সবচেয়ে বড় প্রমাণটি হলো, যাদের অঙ্গুলিহেলনে মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায় পদ্মাসেতুর মতো বিশাল প্রকল্পের প্রতিশ্রুত অর্থ-সহায়তা, এত অসামান্য সাফল্যের জোরালো সমর্থন না থাকলে তারা এ সরকারকে এতদিনে বঙ্গোপসাগরে ছুড়ে ফেলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করত না। পাশাপাশি, সেইসব দেশীয় ‘সুশীল’-এর শক্তিকেও খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই, যারা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্যে সারা পৃথিবী চষে বেড়িয়েছেন এবং এখনো নানাভাবে জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা যে মুখে কুলুপ এঁটে সুবোধ বালকের মতো বসে আছেন সেটা অকারণে নয়।

এ তো চর্মচক্ষে দেখা যায় যে বিশাল এক কর্মযজ্ঞ চলছে সারা দেশজুড়ে। শুধু দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোর দিকে তাকালেই তার তীব্র ঝাঁকুনি টের পাওয়া যায়। ভোর ৫টা থেকে গভীর রাত অবধি সর্বত্র লেগে আছে যানবাহনের রুদ্ধশ্বাস ভিড়। দিবারাত্রি ছুটছে গাড়ি, ছুটছে মানুষ। আমরা বিরক্ত হই বটে, কিন্তু এ যে টগবগে একটি অর্থনীতিরই প্রাণস্পন্দন—তা তো অস্বীকার করা যাবে না। সারা রাত ধরে কলকারখানাগুলো জেগে আছে বলেই রাস্তাগুলোর চোখেও ঘুম নেই। এ জাগরণ কোনো সামান্য ব্যাপার নয়; নয় বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনাও। যে যাত্রাবাড়ির যানজট বছরের পর বছর ধরে যাত্রীসাধারণের মনে আতঙ্ক ছড়াত—মাত্র কয়েক মিনিটে সেই যাত্রাবাড়ি ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে এখন দেশের নানা প্রান্তে ছুটে যাচ্ছে যানবাহন। শুধু যাত্রাবাড়িই নয়, ইতোমধ্যে অনেকটাই বদলে গেছে ঢাকার মানচিত্র। আমূল বদলে যাওয়াটাও এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। শান্তিনগর, মালিবাগ, মগবাজার হয়ে মহাখালী পর্যন্ত বিশাল এলাকাও ইতোমধ্যে চলে এসেছে ফ্লাইওভারের আওতায়। মেট্রো রেলের কাজ চলছে পুরোদমে। দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে বহু প্রত্যাশিত পদ্মা সেতুর অবয়বও। মহাশূন্যে স্বমহিমায় নিজের জায়গা করে নিয়েছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১। বিশ্ববাসীর নজর কাড়ছে রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। এ কি কম গর্বের বিষয় যে বাংলাদেশ এখন বিশ্ব স্যাটেলাইট ক্লাবের ৫৭তম সদস্য আর পরমাণু শক্তিধর দেশগুলোর সারিতে তার অবস্থান ৩৪তম। দুটি সাবমেরিন ক্রয়ের মাধ্যমে সমুদ্রের তলদেশেও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে বাংলাদেশ। বিপুল সমুদ্র সম্পদ আহরণের উদ্দেশ্যে স্থাপিত হয়েছে সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট। কখন শুরু হয়েছে এ কর্মযজ্ঞ? কার নেতৃত্বে? উত্তরটা সবাই জানি বললে ভুল হবে। কারণ এমনিতেই আমাদের স্মৃতিশক্তি দুর্বল। তদুপরি, এ দেশের অনেক জ্ঞানীগুণীজনও অপ্রিয় সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় পান।

বিজ্ঞাপন

শুধু এটুকু বলাই যথেষ্ট হবে না যে মহাজোট সরকারের আমলেই এ কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। সুনির্দিষ্টভাবে বলতে হবে যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। প্রসঙ্গত বলা দরকার, যে দীর্ঘ কালক্ষেপণের পর বিগত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার যাত্রাবাড়ি ফ্লাইওভার প্রকল্পটি বাতিল করে দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন যাত্রাবাড়ি সেতুর কাজ শুরুর নির্দেশ দিয়েছিলেন, তখনও ‘গেল গেল’ রব উঠেছিল। যারা সেদিন এ ধরনের রব তুলেছিলেন, তারাই এখন অকুণ্ঠচিত্তে তার সবটুকু সুফল ভোগ করছেন। ততোধিক রব উঠেছিল বিদ্যুৎ নিয়ে। মহাজোট সরকার যখন দায়িত্ব নেয়, তখন সারা দেশে বিদ্যুতের জন্যে হাহাকার চলছে। চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ বিদ্যুৎও উৎপাদিত হয় না দেশে। কারণ পূর্ববর্তী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার পাঁচ বৎসরে জাতীয় গ্রিডে এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎও যোগ করতে পারেনি। দফায় দফায় টেন্ডার দিয়েও শুরু করতে পারেনি বৃহৎ কোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজও। কেন পারেনি—তা দাতারা সাংবাদিক সম্মেলন করে দেশবাসীকে জানাতে বাধ্য হয়েছিলেন। একমাত্র টঙ্গীতে একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছিল ৮০ বা ৯০ মেগাওয়াটের। সেটিও বেশিরভাগ সময় বন্ধ থাকত যান্ত্রিক ত্রুটি কিংবা গ্যাসের অভাবে।

দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যখন বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হলেন, গ্রহণ করলেন জরুরি, মধ্যমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী নানা পদক্ষেপ—তখনও দেশজুড়ে সমালোচনার বন্যা বয়ে দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল যে বিদ্যুৎ খাত ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি বাংলা দৈনিকও একের পর এক নেতিবাচক প্রতিবেদন প্রকাশ করে তাতে সুর মিলিয়েছিল। সব নিন্দুকের মুখে ছাই দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ইতোমধ্যে ১১ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। আর মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২০ হাজার মেগাওয়াটের মাইলফলক ছুঁইছুঁই করছে। মাত্র এক দশক আগেও যেখানে খোদ রাজধানীতেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকত না—দিনরাত্রির বেশিরভাগ সময় দেশের বৃহদংশই তলিয়ে থাকত অন্ধকারে, সেখানে দেশে এখন লোডশেডিং নেই বললেই চলে। জানা যায়, খোদ পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিদ্যুৎ খাতে এ জাদুকরী সাফল্যের রহস্য জানতে চেয়েছিলেন।

প্রসঙ্গত এও লক্ষণীয় যে আমাদের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান খাত পোশাক শিল্পের অবস্থা ছিল আরো ভয়াবহ। আগে থেকেই অসন্তোষ ও অন্তর্ঘাত চলছিল এ খাতে। মহাজোট সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দৃশ্য-অদৃশ্য নানা কারণে তা আরো তীব্র আকার ধারণ করেছিল। তাজরীন ফ্যাশনের অগ্নিকাণ্ডে এবং সাভারে রানা প্লাজা ট্রাজিডি তাতে মারাত্মক ঘৃতাহুতির কাজ করে। আবারও ‘গেল গেল’ বলে রব ওঠে। সত্যি সত্যি আমাদের স্বর্ণডিম্বপ্রসূ এ শিল্প যাতে রসাতলে যায় সেজন্যে ব্যাপক প্রচারণাও চালানো হয় দেশে-বিদেশে। অন্যদিকে, এর সমুদয় দায় চাপানোর চেষ্টা হয় বর্তমান সরকারের ওপর। যারা এ অপচেষ্টায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মদদ দিয়েছিলেন তারাই এখন স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন যে বিশ্বে বাংলাদেশের রফতানিমুখী পোশাক শিল্পের অবস্থান ইতোমধ্যে দ্বিতীয় স্থানে উন্নীত হয়েছে। ক্রমেই অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে বাংলাদেশ।

‘গেল গেল’ রব তোলা হয়েছিল জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রেও। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সঙ্গে জুড়ে এক ঢিলে একাধিক পাখি শিকারের সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হয়েছিল। একদিকে মধ্যপ্রাচ্যের জনশক্তি আমদানিকারক দেশগুলোকে নানাভাবে প্ররোচিত করা হয়েছিল বাংলাদেশবিরোধী অবস্থান গ্রহণের জন্যে; অন্যদিকে, বিদেশ যেতে ইচ্ছুক এবং বিদেশি আয়ের ওপর নির্ভরশীল বিপুল জনগোষ্ঠীকে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা চালানো হয়েছিল সর্বাত্মকভাবে। তাদের বোঝানো হয়েছিল যে যুদ্ধাপরাধের বিচারের মাধ্যমে মূলত তাদের পেটে লাথি মারা হচ্ছে। কিন্তু সেই প্রচারণাও হালে পানি পায়নি। এখন গ্রামগঞ্জের অতি সাধারণ মানুষও জানেন বর্তমান সরকারের কার্যকর পদক্ষেপের কারণে বিদেশযাত্রা বরং অনেক সহজতর ও ব্যয়সাশ্রয়ী হয়েছে। প্রতারণা কমেছে। সর্বোপরি, বিদেশে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিভাবে এটা সম্ভব হলো? সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত উদ্যোগ, আন্তরিকতা ও নিরলস প্রচেষ্টার ফলে। প্রায় প্রতিটি দেশ তিনি সফর করেছেন। কথা বলেছেন সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে। লক্ষণীয় যে কখনোই খালি হাতে ফিরতে হয়নি তাঁকে। গভীর সদিচ্ছাপ্রসূত আত্মবিশ্বাস থাকলে সব বাধাই যে অতিক্রম করা যায়—তিনি তা বারবার প্রমাণ করে চলেছেন।

যুগান্তকারী পরিবর্তন সূচিত হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে। ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন আর দূরের কোনো অধরা স্বপ্ন নয়। স্মর্তব্য যে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে নিজ দলীয় একটি মাত্র অপারেটরকে মোবাইল সেবার লাইসেন্স দিয়ে একচেটিয়া বাণিজ্যের সুযোগ করে দেওয়ার পাশাপাশি সম্ভাবনাময় এই খাতটিকে শেকলবন্দি করে রাখা হয়েছিল। বর্তমান সরকারের জনবান্ধব নীতির কারণে এখন ভিক্ষুকের হাতেও পৌঁছে গেছে এই সেবা। বর্তমানে মোবাইল ফোন গ্রাহকের সংখ্যা ১৩.৯৩ কোটি এবং ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা ৭.৭১ কোটি। বর্তমানে দেশে টেলিডেনসিটি ৮৯.৭১ শতাংশ এবং ইন্টারনেট ডেনসিটি ৪৭.৬৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। মহাকাশে ডানা মেলেছে বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট। বর্তমানে দেশে ২৮টি হাই-টেক/আইটি পার্ক নির্মাণের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে সর্বস্তরের জনগণের জন্য মোবাইল ফোনভিত্তিক হেল্পডেস্ক বাস্তবায়ন কর্মসূচির আওতায় পরিচালিত ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি সার্ভিস ’৯৯৯’ কল সেন্টারটি সফলভাবে দেশব্যাপী জরুরি পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুলেন্স সেবা প্রদান করছে। রীতিমতো বিপ্লব ঘটে গেছে ব্যাংকিং সেবার ক্ষেত্রে। মোবাইল ব্যাংকিংএর মাধ্যমে দ্রুত অর্থ লেনদেনের পাশাপাশি ঘরে বসে সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা ও কৃষিভর্তুকি পাচ্ছে তৃণমূল পর্যায়ের লাখ লাখ মানুষ। সরকারি বহু দপ্তরও ইতোমধ্যে ডিজিটাল সেবার আওতায় চলে এসেছে।

প্রায় প্রতিটি সূচকই বলছে যে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। মাথাপ্রতি আয় বেড়েছে। বেড়েছে মানুষের গড় আয়ু। সেই সঙ্গে তাৎপর্যপূর্ণভাবে উন্নতি হয়েছে সামগ্রিক জীবনমানের। ‘মঙ্গা’ নামক শব্দটি স্থায়ীভাবে অভিধানের অন্তর্গত হতে চলেছে। গ্রামে-গঞ্জে কর্মহীন মানুষের সাক্ষাত পাওয়াটা কঠিন হয়ে পড়েছে। দারিদ্র্যের হার ইতোমধ্যে ১২ শতাংশে নেমে এসেছে। সবচেয়ে আশাপ্রদ তথ্যটি হলো, ধারাবাহিকভাবে কমছে দারিদ্র্য। এ ধারা অব্যাহত থাকলে অচিরেই দারিদ্র্যের বংশানুক্রমিক জোয়ালটি যে খসে যাবে আমাদের দগদগে ঘাড় থেকে—তা এখন নিন্দুকেরাও স্বীকার করছেন অকপটে। সর্বোপরি, বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশ শুধু নয়, উন্নত দেশগুলোর সারিতে স্থান করে নেওয়ার স্বপ্ন দেখছে। এটা এখন আর দিবাস্বপ্ন নয়। খাদ্য ঘাটতির দেশ থেকে বাংলাদেশ খাদ্য রফতানিকারক দেশে পরিণত হতে চলেছে। মাছ ও সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান এখন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর সারিতে। অথচ আমাদের জমি কমছে। কমছে পুকুর-জলাশয়, নদ-নদীর সংখ্যা। অন্যদিকে, বাড়ছে মানুষ। একাত্তরে আমাদের যে জনসংখ্যা ছিল তা ইতোমধ্যে দ্বিগুণ হয়েছে। তার পরও এ অসাধ্য কিভাবে সাধিত হলো? উত্তর অভিন্ন। প্রথমত, গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা; এবং দ্বিতীয়ত, বলিষ্ঠ ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ নেতৃত্ব।

গণতন্ত্র না থাকলে কী হয়—সেটা আমরা সর্বশেষ বিগত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও দেখেছি। শুধু দেখেছি বললে ভুল হবে, হাড়ে হাড়ে তা উপলব্ধিও করেছি। মাত্র দু বছর স্থায়ী সেই সরকারের শাসনকাল কী ভয়াবহ বিভীষিকা বয়ে নিয়ে এসেছিল জাতির জীবনে তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। মুখ থুবড়ে পড়েছিল অর্থনীতি। শুধু যে ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নেমেছিল তা-ই নয়, হাহাকার পড়ে গিয়েছিল সারা দেশে। চাল-ডাল-আটার জন্যে হাহাকার, তেলের জন্যে হাহাকার, লবণ-মরিচ-পেঁয়াজের জন্যে হাহাকার। বাঙালিজীবনে এমন হাহাকার নজিরবিহীনই বলা যায়। সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিডিআরকেও (বর্তমান বিজিবি) ন্যায্যমূল্যের দোকান খুলে বসতে হয়েছিল রাস্তার মোড়ে মোড়ে। আর সেসব দোকানকে ঘিরে ঢল নেমেছিল মানুষের। রাজধানী জুড়ে শুধু লাইন আর লাইন। এমনকি লাজলজ্জা বিসর্জন দিয়ে মধ্যবিত্তকেও শরিক হতে হয়েছিল চাল-ডাল সংগ্রহের সেই প্রতিযোগিতায়। জাতিকে ‘সুশাসন’ ও ‘প্রকৃত গণতন্ত্র’ উপহার দেওয়ার বিশাল প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারা ক্ষমতায় এলেও অচিরেই আইনের শাসন ও মানবাধিকার সোনার হরিণে পরিণত হয়েছিল। তুচ্ছ কারণে তাণ্ডব বয়ে গিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর দিয়ে। আইনবহির্ভূত পন্থায় কত মানুষকে যে গ্রেফতার ও নির্যাতন করা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। আর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণের চাপে পিষ্ট হয়ে সংবাদমাধ্যমগুলো প্রায় শুকিয়ে মরতে বসেছিল। অথচ দেশের সবচেয়ে বড় ‘সুশীল’-পণ্ডিতদের বিশাল সমাবেশ ঘটেছিল এ সরকারকে কেন্দ্র করে। এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছিল যে রাজনীতিকদের গালমন্দ করে টকশোতে চটকদার বক্তব্য দেওয়া যত সহজ, বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ এবং অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখা মোটেও তত সহজ নয়। সুশাসন, গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন—সে তো হনুজ দূর আস্ত্।

সেনাসমর্থিত সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার আবারও প্রমাণ করেছিল যে উন্নয়নের জন্যে, সুশাসনের জন্যে এবং অবশ্যই মানবাধিকারের জন্যে গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের একটি অংশ নিকট অতীতের সেই অভিজ্ঞতা থেকে কোনো শিক্ষাই গ্রহণ করেননি। গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হলে নির্বাচনের যে কোনো বিকল্প নেই—এটা তাদের অজানা থাকার কথা নয়। কিন্তু তারা শুধু যে নির্বাচনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন তা-ই নয়, নির্বাচন প্রতিহত করার জন্যে এমন সব পন্থা অবলম্বন করেছিলেন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যা অচিন্তনীয়। নির্বাচনে অংশ নেওয়া বা না নেওয়ার অধিকার সকলেরই আছে; কিন্তু দিনের পর দিন হরতাল-অবরোধ ডেকে, রেললাইন উপড়ে ফেলে, চলন্ত ট্রেনে আগুন দিয়ে, যাত্রীবোঝাই বাসে পেট্রোল বোমা ছুড়ে যাত্রীসাধারণকে পুড়িয়ে মেরে, স্কুলে অগ্নিসংযোগ করে এবং নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ-আনসার ও শিক্ষককে হত্যা করে আর যাই হোক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না। এ রকম দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কোথাও আছে বলে আমাদের জানা নেই। শুধু নির্বাচনই নয়, এসবদৃষ্টে মনে হয়েছে যে তারা অর্থনীতির প্রাণস্পন্দনকেও থামিয়ে দিতে চেয়েছিল।

যে কথাটি না বললেই নয় তা হলো—গণতন্ত্র আমাদের দেশে আগেও ছিল। সর্বশেষ বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটও পাঁচ বছর ক্ষমতায় ছিল। অভিযোগ আছে যে জাতি হিসেবে আমাদের স্মৃতি দুর্বল। তবু ‘বাংলাভাই’, আট ট্রাক অস্ত্র, একযোগে ৫শ’ স্থানে বোমা হামলা, অফিস-আদালতে বোমা হামলা, প্রকাশ্যে অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা এবং বঙ্গবন্ধু অ্যাভেনিউর জনসমাবেশে কাপুরুষোচিত গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা-চেষ্টার সেই লোমহর্ষক দিনগুলো ভুলে যাওয়া সহজ নয়। সেই আমলের সঙ্গে এই আমলের তুলনা করলে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস। সেটি হলো, শুধু গণতন্ত্র থাকলেই হয় না, সে রকম নেতাও লাগে। বঙ্গবন্ধুর মতো নেতা ছিলেন বলেই যেমন সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, তেমনি তাঁর সুযোগ্যা কন্যা শেখ হাসিনার দরদী ও দায়বদ্ধ নেতৃত্বের কারণেই যে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বিস্ময় হয়ে দাঁড়িয়েছে—তা স্বীকার করতে কারো কুণ্ঠা থাকার কথা নয়। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে মুক্তিযুদ্ধের অজেয় চেতনায় বলীয়ান হয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। এ অগ্রযাত্রাকে রোখার সাধ্য কারো নেই।

পুনশ্চ: যে মহাকাশযান যত দূরে যাবে, তার জন্যে সেরকম মজবুত পাটাতনও অপরিহার্য। একইভাবে আমরা যে এখন সোনার বাংলার স্বপ্ন ছুঁতে চলেছি, সেটাও সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের শক্ত পাটাতনটি তৈরি করে দিয়ে গেছেন বলে। সেই ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণেই তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। স্বাধীনতার সংগ্রাম তিনি নিজেই সফল করে গেছেন। এখন তাঁর অকুতোভয় কন্যার সুযোগ্য নেতৃত্বে চলছে অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর সূচনালগ্নে দাঁড়িয়ে আমরা গভীর প্রত্যয়ের সঙ্গে বলতে পারি যে এ সংগ্রামেও দেশবাসীর বিজয় এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। [সমাপ্ত]


মিনার মনসুর
কবি ও পরিচালক, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র