রাবিতে ভাষায় স্নাতক করে নানা কারণে হতাশ শিক্ষার্থীরা

  • রাবি করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের সংস্কৃত বিভাগের শিক্ষার্থী ইসতিয়াক (ছদ্মনাম)। তিনি ২০১৯ সালে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। এরপর ৩ বছর ধরে চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু স্নাতক শেষ করার পরও ভাল চাকরি পেতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে।

বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় পাশের পরও বার বার ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। কারণ সংস্কৃত বিভাগ দেখলেই চাকরির ভাইবাতে তাকে বাদ দেয়া হয়। আবার এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে যেখানে ভাইবা বোর্ডের সদস্যরাই জানেন না সংস্কৃত ভাষার উপর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিভাগ আছে। ফলে ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশায় ভুগতে হচ্ছে তাকে।

বিজ্ঞাপন

শুধু ইসতিয়াক নন, বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন অনেক শিক্ষার্থী আছেন যারা ভাষা সংশ্লিষ্ট সংস্কৃত, আরবি, ফারসি ও উর্দু বিভাগ থেকে স্নাতক শেষে চাকরি পেতে হিমশিম খাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা ও ভাষা-সংশ্লিষ্ট শিক্ষা কার্যক্রমের বিস্তৃতি ঘটলেও জ্ঞানচর্চার অবকাঠামো ও প্রায়োগিক ক্ষেত্রের উন্নয়ন হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা সংশ্লিষ্ট সংস্কৃত, আরবি, ফারসি ও উর্দু বিভাগ থেকে প্রতিবছর অসংখ্য শিক্ষার্থী পাশ করে বের হন। ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের আরবী বিভাগে ১০০ জন, উর্দু বিভাগে ৪০ জন, সংস্কৃত বিভাগে ৫৬ জন ও ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ৪০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

এসব বিভাগের শিক্ষার্থীরা বলছেন, কারিকুলাম যুগোপযোগী না হওয়া, বিভাগ সংশ্লিষ্ট যথেষ্ট চাকরি না থাকা এবং অবমূল্যায়নের প্রবণতার ফলে তারা ব্যর্থ হচ্ছেন। একদিকে একাডেমিক জ্ঞান প্রয়োগের জন্য ক্ষেত্র নেই, অন্যদিকে চাকরিতে বৈষম্য। অন্য তিনটি বিভাগের তুলনায় আরবী বিভাগের ক্ষেত্রে শিক্ষকতাসহ বিভাগ সংশ্লিষ্ট কিছু চাকরি রয়েছে। তবে দক্ষতার অভাবে এসব চাকরির ক্ষেত্রেও তারা সুযোগ হারাচ্ছেন। অন্য চাকরির ক্ষেত্রে ভাইবা বোর্ডের নির্বাচকদের নেতিবাচক ধারণার কারণেও শিক্ষার্থীরা ব্যর্থ হচ্ছেন। জ্ঞানচর্চার অবকাঠামোর উন্নয়ন না হওয়ায় স্নাতক পাশ শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই এসব ভাষা ঠিকমতো লিখতে-পড়তে পারেন না।

তবে বিভাগগুলোর শিক্ষকরা বলছেন, তারা বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলামের সাথে সমন্বয় করে নিয়মিত কারিকুলাম আপডেট করেন। যাতে শিক্ষার্থীরা যুগোপযোগী জ্ঞানার্জন করতে পারেন। এছাড়া শিক্ষার্থীরা নানা ক্ষেত্রে ভালো করছেন বলেও দাবি তাদের। তবে ভাইবা বোর্ডের নির্বাচকদের কিছু নেতিবাচক ধারণার কারণেও শিক্ষার্থীরা ব্যর্থ হচ্ছেন। তবে যাদের আগ্রহ আছে তাদেরই এসব বিভাগে ভর্তি করানো উচিত। এতে প্রয়োজনে সিট সংখ্যা কমানো যেতে পারে বলে মত তাদের।

সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতক শেষ করেছেন আব্দুল হক। তিনি বলেন, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা। কিন্তু আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সংস্কৃত, উর্দু, ফারসি ও আরবীর মতো বিভাগে পড়ে চাকরি পেতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে ভালো চাকরি করব এটা সবার পরিবার প্রত্যাশা করে। স্নাতক পাশ করার পর চাকরির জন্য দীর্ঘ সময় ঘুরে বেড়ানো নতুন কিছু নয়। কিন্তু চাকরি ক্ষেত্রে আমরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছি প্রতিনিয়ত। চাকরির জন্য যথাযথ প্রস্তুতি থাকা স্বত্বেও কেবল বিভাগের নাম বললেই বাদ পড়ে যাচ্ছি। যেসব বিভাগের প্রায়োগিক ক্ষেত্র নেই, ম্ল্যূায়ন নেই সেসব বিভাগে পড়া বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু নয়। এসব বিভাগ বাদ দিয়ে কর্মমুখী শিক্ষার প্রসার করা উচিত।’

জানতে চাইলে উর্দু বিভাগের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান মুন্না বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষার্থী অনেক স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হন। তবে দেশের প্রেক্ষাপটে উর্দু বিষয় নিয়ে লেখাপড়া অনেকটা চ্যালেঞ্জিং। আর পাঁচটা ভাষার মতো উর্দু ভাষা এখানে সমাদৃত নয়। যার ফলে শিক্ষার্থীরা ভাষা শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে এর সাহিত্য এবং দর্শনের অংশটিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। শিক্ষার্থীরা উর্দু ভাষায় কথা বলতে ও লিখতে না পারলে তো পড়ালেখার বিষয়বস্তু ভালোভাবে বুঝতে পারা সম্ভব নয়। তাই কম বেশি সবাই এই ব্যাপারে দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা করেন। তবে শতাংশের হিসাবে বলতে গেলে মাত্র ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী ভাষাতে যথাযথ দক্ষতা অর্জন করতে পারেন।’

আরবি বিভাগের ফেরদৌস রিফাত বলেন, ‘ছোট বেলায় আরবি ভাষার হাতেখড়ি হয়। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে দ্বিতীয়বার শিখে সাহিত্য পড়া শুরু করেছি। আরবি সাহিত্য পড়তে ভালোই লাগে। তবে আমাদের বিভাগে যারা কলেজ থেকে এসেছে তাদের জন্য পড়াশোনা কিছুটা কষ্টের। তবে বিভাগের আরবি ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব থাকায় অনেকে ভালোভাবে ভাষা শিখতে পারছে।’

সার্বিক বিষয়ে উর্দু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিউল ইসলাম বলেন, ‘আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতিতে সমস্যা আছে। কারণ এই পদ্ধতিতে খুব কম সংখ্যক শিক্ষার্থী পছন্দের বিষয় পান। পছন্দের বিষয় না পেয়ে অনেকে পড়াশোনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এছাড়া ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে যাদের সবচেয়ে কম স্কোর তাদের এসব ভাষা সংশ্লিষ্ট বিভাগে জোর করে পাঠানো হয়। ফলে তারা বিভাগে এসে পড়াশোনায় আগ্রহ পায় না। তবে ভাষায় যাদের আগ্রহ আছে তাদেরই এ বিভাগে ভর্তি করানো উচিত। এতে সিট সংখ্যা কমানোর প্রয়োজন হলে সেটি করাও জরুরী।’

ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক নুরুল হুদা বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখার মূল উদ্দেশ্য কিন্তু চাকরি নয়। ভালো ও আদর্শ নাগরিক হয়ে উঠা আসল বিষয়। এছাড়া একটি বিভাগ থেকে পাশের পর সবাই আসলে চাকরিও পায় না। তবে আমাদের বিভাগ থেকে পড়াশোনা করে অনেকে বেশ জায়গায় চাকরি করছে। অন্যদিকে সবাই একটি ভাষায় দক্ষ হবে তেমনও নয়।’

কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ফজলুল হক বলেন, ‘ভাষার বিভাগগুলোর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোনো ধরনের অভিযোগ পাওয়া যায় নি। লিখিত অভিযোগ পেলে সে অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আর সব বিভাগ তাদের নিজস্ব চাহিদা অনুসারে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করাতে পারে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ধরনের চাপ থাকে না।’