অবন্তিকার মৃত্যু: যা বললেন শিক্ষক দ্বীন ইসলাম
আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনায় নিজের কোনো দায় নেই বলে দাবি করেছেন অভিযুক্ত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাবেক সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম।
শনিবার (১৬ মার্চ) বেসরকারি একটি টিভি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এমন দাবি করেন ওই শিক্ষক।
এদিকে, অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনায় ফুঁসে উঠেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থীরা। মৃত্যুর জন্য দায়ীদের অবিলম্বে বিচারসহ ছয় দফা দাবি বাস্তবায়নে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছেন তারা।
ওই সাক্ষাৎকারে সাংবাকিদের এক প্রশ্নে দ্বীন ইসলাম বলেন, তিনি অফিশিয়ালি যে দায়িত্ব পেয়েছিলেন সে অনুযায়ী তা পালন করেছেন। উল্টো নিজ এলাকার মানুষ হওয়ায় অবন্তিকা ও তার পরিবারকে যথেষ্ট সহায়তা করেছেন।
তিনি বলেন, ঘটনা প্রায় দেড় বছর আগের। অবন্তিকার ব্যাচমেটরা কোতোয়ালি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন। ফেসবুকের কয়েকটি অ্যাকাউন্ট থেকে তাদের নিয়ে গুজব ছড়ানো হচ্ছিল। জিডি করার সময় অবন্তিকাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। পুলিশ তখন উচ্চতর তদন্তের আশ্বাস দিয়ে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে গুজব ছড়ানো আইডির পরিচালককে ধরার আশ্বাস দেয়। পরে থানা থেকে বেরিয়ে অবন্তিকা তার বন্ধুদের ফেসবুকের ফেক অ্যাকাউন্ট থেকে সে গুজব ছড়ায় বলে জানায়। এর জন্য সে দুঃখ প্রকাশ করে। পরে এ ঘটনায় ভুক্তভোগীরা প্রক্টর অফিসে এসে অবন্তিকার বিরুদ্ধে ২০২২ সালের ৮ আগস্ট একটা লিখিত অভিযোগ দেয়।
তিনি আরও বলেন, অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রক্টর মোস্তফা কামাল আমাকে এবং সহকারী প্রক্টর গৌতম কুমার সাহাকে (গণিত বিভাগ) ২০২২ সালের ১১ আগস্ট তদন্তের দায়িত্ব দেন। পরবর্তী সময়ে ২০২২ সালের ১৬ আগস্ট প্রক্টর স্যারের উপস্থিতিতে আমি এবং সহকারী প্রক্টর গৌতম কুমার সাহা অবন্তিকা এবং তার অভিভাবকদের প্রক্টর অফিসে আসার জন্য আহ্বান করি। পরে অবন্তিকার মা মিটিংয়ে আসেন এবং অবন্তিকার ক্লাসমেটসহ (অভিযোগকারীরা) সবাই উপস্থিত ছিল।
সে সময় অবন্তিকার মা তার ব্যাচমেট (যারা এ অভিযোগ করেছে) তাদের কাছে ঘটনার সত্যতা শুনে বলেন, আমার মেয়ে যা করেছে ভুল করেছে, ঘটনার জন্য অভিযোগকারী সবার কাছে আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করে এবং ভবিষ্যতে আমার মেয়ে আর এই ধরনের কাজ করবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। যদি সে এমন কিছু করে তার দায় আমরা নিবো।
বিষয়টি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য অবন্তিকার মা অনুরোধ জানান এবং বলেন, আমার মেয়ে ভালো শিক্ষার্থী কিন্তু সে কয়েকদিন ধরে মানসিকভাবে অসুস্থ এবং ওষুধ খাচ্ছে। তখন তার ব্যাচমেটরা বিষয়টা মানবিক এবং ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখেন। এভাবে বিষয়টা প্রাথমিকভাবে মীমাংসা করা হয়। মীমাংসার পর অবন্তিকার মা জিডি তুলে নেওয়ার জন্য অভিযোগকারীদের অনুরোধ করেন। কিন্তু অভিযোগকারীরা জিডি তুলে নিতে অসম্মতি জানায়, কারণ তাদের ধারণা অবন্তিকা ভবিষ্যতে এ ধরনের আচরণ আবারও করতে পারে।
সহকারী প্রক্টর হিসেবে জিডি তোলার বিষয়ে কিছু করার ছিল না জানিয়ে দ্বীন ইসলাম বলেন, আমরা শুধু প্রতিবেদন দেওয়ার অধিকার রাখি। অবন্তিকা ও তার পরিবারের সদস্যদের আমি এ বিষয়ে জানিয়ে প্রক্টর স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ করারও পরামর্শ দেই। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদেরও অনুরোধ জানাই বিষয়টি মীমাংসা করতে।
তখন অভিযোগকারীরা জানায়, তারা অবন্তিকাকে আগামী ৩ মাস পর্যবেক্ষণ করবে এবং যদি সে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে, তাহলে জিডিটা তুলে নেওয়া হবে। এর কিছুদিন পর অবন্তিকা ও তার মা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন এবং আমাকে প্রক্টর অফিসে না পেয়ে আমার বিভাগে আসেন। ওইদিন অবন্তিকার মা আমাকে জানান অবন্তিকার হলের বন্ধুরা ওর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করছেন না, এতে সে মানসিকভাবে আরও ভেঙে পড়েছে। তখন আমি তাদেরকে প্রক্টর অফিসে লিখিতভাবে অভিযোগ করার পরামর্শ দেই। তখন অবন্তিকার মা বলে যা হওয়ার হয়ে গেছে এখন আর এ বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে চাইছি না।
তখন অবন্তিকার মা জানায়, তার মেয়েকে আর হলে রাখবেন না। কারণ তার মেয়ের পড়াশোনা খারাপ হয়ে যাবে এবং সে মানসিকভাবে আরও ভেঙে পড়বে। তখন আমি তাকে বলি আপনি অভিভাবক যা ভালো মনে করেন সেটাই করেন। যে কোনো প্রয়োজনে আমার সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। অভিযোগ নিষ্পত্তির ৩ মাসেরও কিছুদিন পর অবন্তিকা এবং তার বাবা-মা প্রক্টর অফিসে জিডি তোলার জন্য আসেন, কিন্তু তার ব্যাচমেটরা জিডি তুলতে অসম্মতি জানায়।
তখন অবন্তিকার মা-বাবা এবং অবন্তিকা আবার আমাকে ফোন করে আমার বিভাগে দেখা করতে আসেন।
তখন তারা জিডি তোলার বিষয়ে আমাকে অনুরোধ করেন। আমি তখন তাদের বিষয়টা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করি যে বিষয়টা আমার হাতে নেই। আমাদের কাজ তদন্ত করে রিপোর্ট প্রদান করা এবং আমরা তাই করি। জিডির বিষয়ে প্রক্টর স্যার এবং অভিযোগকারীদের সঙ্গে আলাপ করে নিষ্পত্তি করার পরামর্শ দেই।
মৃত্যুর পূর্বে ফেসবুকে দেওয়া অবন্তিকার স্ট্যাটাস নিয়ে দ্বীন ইসলামের দাবি, প্রথমত আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ, আম্মানকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা, যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কারণ ঘটনা নিষ্পত্তি হয় ১৬/০৮/২০২২ সালে। এরপর এই বিষয় নিয়ে আর কারো সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি কখনোই।
উল্লেখ্য, শুক্রবার (১৫ মার্চ) রাতে ফাইরুজ অবন্তিকা নামে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এক ছাত্রী কুমিল্লায় নিজ বাড়িতে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তিনি আইন বিভাগের ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থী। মৃত্যুর আগে এক ফেসবুক পোস্টে নিজের মৃত্যুর জন্য নিজের সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকে দায়ী করেন। এরপরই ঘটনার বিচার চেয়ে আন্দোলনে নামেন জবি শিক্ষার্থীরা।
তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে শুক্রবার রাত ২টার দিকে আম্মান সিদ্দিকী নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি থেকে দেওয়া পোস্টে লেখেন, দুই বছর আগে অবন্তিকা নিজেই ফেসবুকে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে সহপাঠীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদমূলক কথা লেখেন। পরে বিষয়টি সে নিজে স্বীকার করে নিলে প্রক্টর অফিস থেকে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশও দেওয়া হয়। এরপর অবন্তিকার পরিবারের পক্ষে তার বাবা এসে অঙ্গীকার নামা দেন যে, তার মেয়ে ভবিষ্যতে এমন কোনো কাজ করবে না।
এ সংক্রান্ত জিডির কপি, কারণ দর্শানোর নোটিশ, অঙ্গীকারনামা এবং কিছু মেসেঞ্জারে আসা মেসেজের স্ক্রিনশট লেখার সঙ্গে সংযুক্ত করে দেন আম্মান।