প্রত্যক্ষদর্শী শহীদজায়ার স্মৃতিতে ঢাবির জগন্নাথ হলে ২৫শে মার্চের গণহত্যা

  • কানজুল কারাম কৌষিক, ঢাবি করেসপন্ডেন্ট
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বকুল রাণী দাস ও তাঁর ছেলে শ্যামল চন্দ্র দাস

ছবি: বকুল রাণী দাস ও তাঁর ছেলে শ্যামল চন্দ্র দাস

বকুল রাণী দাস (৭৩), ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ এর কালরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে ঘটে যাওয়া নৃশংস গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী। 'অপারেশন সার্চলাইট' নামক সেই হত্যাযজ্ঞে জগন্নাথ হলে শহীদ হন তাঁর স্বামী  জগন্নাথ হলের তৎকালীন নৈশপ্রহরী শহীদ সুনীল চন্দ্র দাস। সেই রাতে নিজের চোখে দেখা ঘটনা ও দেড় বছর বয়সী ছেলে ও তিন বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে সেই হত্যাপুরী থেকে বেঁচে ফেরার গল্প শোনান বকুল রাণী দাস।

শহীদজায়ার এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বার্তা২৪.কম-এর ঢাবি করেসপন্ডেন্ট কানজুল কারাম কৌষিক।

বিজ্ঞাপন

প্রশ্ন: ১৯৭১ সালে আপনার বয়স কত ছিল?

বকুল রাণী দাস: আমার বয়স তখন বাইশ। ছোট ছিলাম। এত কিছু বুঝতাম না।

বিজ্ঞাপন

প্রশ্ন: ২৫ শে মার্চে রাতে কি অবস্থা ছিল জগন্নাথ হলের?

বকুল রাণী দাস: ২৫ মার্চের রাত্রে আমাকে স্বামী (শহীদ সুনীল চন্দ্র দাস) বলল বাচ্চাদেরকে নিয়ে তুমি ঘুমিয়ে যাও। তখন আমি খাওয়া দাওয়া করে বাচ্চাদেরকে নিয়ে শুয়ে পরছি। আমাকে বাইরে থেকে তালা মেরে দিয়ে সে গেলো ডিউটিতে। যখন রাত ১২ টা বাজল, তখন অনেক শব্দ শুনি। শব্দ আর শব্দ(গোলাগুলি)। নিজে কিছু বুঝি নাই তখন পাশের বাসার এক বৃদ্ধ মহিলা যাকে দিদিমা বলে ডাকতাম তিনি এসে ডেকে বললেন, এই বকুলি,এই বকুলি কি করস? আমি বললাম আমি আর কি করুম বাচ্চাদেরকে নিয়া বইসা আছি। জিগেস করল বাচ্চার বাবা কই। আমি বললাম ওর বাবা ডিওটিতে গেছে। তখন দিদিমা বলল দেখি কাওরে দিয়া ওর বাবারে আনানো যায় কি না। পরে পাশার বাসার এক ছেলেকে দিয়ে খবর পাঠালে ওর বাবা আসে। এসেই বলে চল আমরা বের হয়ে যাই।

প্রশ্ন: তখন কি আপনি নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে পেরেছিলেন?

বকুল রাণী দাস: তখন আমরা আর পাশের বাসার ৭/৮ জন মানুষজনসহ এস এম বিল্ডিং থেকে বের হতে যাই। এসএমবির ভিতরে গিয়ে বসছি। আর্মির বুটের টক টক শব্দ শুনতে পাই। তখন আমরা একটা কাঠামোর পেছনে গিয়ে লুকিয়ে পরি। কাঠামোটা ছিলো স্বরস্বতী পূজার কাঠামো। এমন সময় একটা বাচ্চা কান্না করে উঠল। ওরা শব্দ শুনলো, ব্যাটারি লাইট দিয়ে খুঁজে পেল ওর বাবারে (শহীদ সুনীল চন্দ্র দাস)। আর কোন পুরুষ মানুষ ছিলো না আমাদের সাথে। তখন ওর বাবা রে পাঞ্জাবিরা টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো। ওনার কোলে ৩ বছর বয়সী মেয়ে ছিল। মেয়েকে তার কোল থেকে ফেলে দিলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম আমার স্বামী কে কোথায় নেন? এ কথা বলার পর আমারে লাত্থি দিয়া ফেলে দিলো। তারপর আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম। আমার সাথে যারা ছিল তারা আমাকে জল ঢেলে জ্ঞান ফেরায়। কিছুক্ষণ পরে আমাকে গেটের সামনে একটা টুলে বসায় পাঞ্জাবিরাই টুল দেয়। তখন আমি আবার জিগেস করি আমার স্বামী কোথায়। তখন ওরা আমাকে শান্তনা দিয়ে বলল, তোমার স্বামীকে নিয়ে গেছে আবার দিয়ে যাবে। তখন আমি আবার অজ্ঞান হয়ে দেড় বছরের ছেলেকে কোলে নিয়েই পড়ে যাই। জ্ঞান ফিরলে আমি দেখি একটা লোক কে পাঞ্জাবিরা এসএমবির ভেতর থেকে ধরে নিয়ে আসছে। সেই লোকটা হলের হাউজ টিউটর। তার পরনের ধুতি দিয়েই তাকে বেঁধে নিয়ে আসছে। তারপর পাঞ্জাবীরা উর্দুতে কি যেন জিজ্ঞাস করল। হাউজ টিউটর এর উত্তর দেয়ায় তাকে থাপ্পড় মারল। তারপর তাকে আর আরেকজন সিকিউরিটি গার্ড প্রিয়নাথকে ধরে নিয়ে যায় জগন্নাথ হলের মাঠে। ওর বাবারেও ওইখানেই নিলো।

প্রশ্ন: উনাদেরকে ধরে কোথায় নিয়ে গেল?

বকুল রাণী দাস: জগন্নাথ হলের মাঠে। বড় একটা গাছের নিচে। কিছুক্ষণ পর ৩ জনকে ৩ টা গুলি করল। আমি বললাম গুলির শব্দ হয় কিসের? আমার সাথের সবাই বলল তোমার স্বামীকে কিছু করে নাই।

প্রশ্ন: আপনারা কি শহীদদের লাশ খুঁজে পেয়েছিলেন?

বকুল রাণী দাস: যখন রাত ৪ টা বাজে তখন সবাই বলল চল মাঠের দিকে যাই। গিয়ে দেখি ওরা ট্রাক দিয়ে গর্ত করে সব লাশ একসাথে গণকবর দিয়ে দিচ্ছে। বাথরুম,বারান্দা যেখানে যত লাশ ছিল কিছু যুবক ছেলেদেরকে দিয়ে লাশগুলো আনায়। এনেই ওই মাঠেই গণকবর দিয়ে দেয়।

প্রশ্ন: আপনারা সেখান থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে গেলেন কিভাবে?

বকুল রাণী দাস: আমরা ৭/৮ জন কিছুক্ষণ সেখানে থেকে মেডিকেলের দিকে রওনা হলাম যাওয়ার পথে মেইন গেইটেই ২ টা লাশ দেখলাম। মেডিকেলে যাওয়ার পর বাচ্চারা খেতে চাইলে খাবার দেয়ার মত টাকা ছিল না। ক্যান্টিনের একটা ছেলে এক গ্লাস দুধ আর একটা রুটি দিলে ছেলেকে দুধ খাওয়াই আর মেয়েটাকে রুটি খাওয়াই। এভাবেই বেচে ছিলাম।পরে সদরঘাটে গিয়ে নৌকায় উঠি। আমার মনে হচ্ছিল নদীর বুকে যেই ঢেউ আমার বুকেও সেই ঢেউ। এভাবেই ভাসতে ভাসতে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছাই।

প্রশ্ন: এখন আপনি কেমন আছেন? সরকার থেকে কোন সহযোগিতা পাচ্ছেন?

বকুল রাণী দাস: এইযে এত কষ্ট করে বেঁচে ফিরলাম। এখনো অব্দি কোন সরকার ই আমাদেরকে কোন সাহায্য করে নাই। শহীদ পরিবার হিসেবে আমার ইচ্ছা প্রধানমন্ত্রীর সাথে একটু দেখা করে আমি কিছু কথা বলতাম।