নিরাপত্তাশঙ্কায় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা বুয়েট শিক্ষার্থীদের একাংশের

  • ঢাবি করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) চলমান ইস্যুতে একদল শিক্ষার্থী উগ্রবাদী ও নিষিদ্ধ সংঠনের বিরুদ্ধে কথা বলায় নিরাপত্তা শঙ্কায় রয়েছেন বলে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন শঙ্কিত ওই শিক্ষার্থীরা।

বৃহস্পতিবার (৪ এপ্রিল) বিকেলে বুয়েট শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে এক সংবাদ সম্মেলনে তারা এ শঙ্কার কথা জানান।

বিজ্ঞাপন

প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে এক খোলা চিঠিতে তারা দাবি করেন, বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতিকে এক ধরনের নিষিদ্ধ কাজ হিসেবে দেখা হচ্ছে। প্রগতিশীল রাজনৈতিক চিন্তাধারণায় বিশ্বাসী এবং স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় আমরা অংশ নিতে চাই দেখে আমাদের ক্যাম্পাসে দীর্ঘ একটি সময় ধরে মানসিক নিপীড়ন চলে আসছে, যা বর্তমানে আমাদের জীবনের হুমকিস্বরূপ।

আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাসী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকে আমরা বলতে চাই, শুধুমাত্র স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য যে পরিমাণ বুলিং করা হয়েছে, আমাদের ওপর তা অকথ্য। এই নিপীড়নের কারণ শুনতে হলে আমাদের ২০১৯ পরবর্তী বেশ কিছু ঘটনা জানতে হবে। বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ (ইইই ১৭) ভাইয়ের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়। কিন্তু এরপরে র‍্যাগিং বা এর সঙ্গে জড়িত কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আইন ভঙ্গের অভিযোগ না থাকলেও সংখ্যালঘু ছাত্রদের ওপর শুরু হয় 'পাবলিক হিউমিলিয়েশন' এবং 'ডিফেমেশন', যা হয় শুধুমাত্র স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী হওয়ার কারণে।

পরবর্তীতে আমরা বুয়েটে ভর্তি হলে আমরাও আমাদের জাতির জনকের আদর্শকে পালন করতে চাইলেই আমাদের সঙ্গে বুলিং ও নানাভাবে আমাদের হ্যারাস (হয়রানি) করা হয়।

ঘটনা প্রসঙ্গে তারা উল্লেখ করেন, ২০২৩ সালের ৩১ জুলাই সুনামগঞ্জের তাহেরপুর টাঙ্গুয়ার হাওর সংলগ্ন এলাকায় বুয়েটের ২৪ শিক্ষার্থীসহ মোট ৩৪ জনকে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিকল্পনার অভিযোগে শিবির সন্দেহে আটক করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এই ধরনের ভয়ঙ্কর ঘটনায় আমরা মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে মানববন্ধনে দাঁড়াই এই শিরোনামে- 'Rise Above Extremists, Protest Fundamentalism'। এই মানববন্ধনে আমাদের দাবি ছিল দোষীদের শাস্তি প্রদান এবং নির্দোষদের নিঃশর্ত মুক্তি। কিন্তু এমন একটা সচেতনতামূলক কাজ করার পরেও আমাদের মানববন্ধনে দাঁড়ানো সব সাধারণ শিক্ষার্থী বন্ধু ও সহপাঠীদের সঙ্গে শুরু হয় জবাবদিহিতার পর্ব। সেখানে মানববন্ধনে দাঁড়ানো সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও সামাজিকভাবে বয়কটের ভয় দেখিয়ে মানববন্ধনের প্রথম ছাত্র হওয়ার কারণে আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হিসেবে রাখা হয়।

তারা উল্লেখ করেন, বিশ্ববিদ্যালয় মনন চর্চার মুক্তমঞ্চ। বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌলবাদবিরোধী অবস্থান রাখাকে কীভাবে অভিযোগ হিসেবে তুলে ধরা হয়, তা আজও জবাবদিহিতা চাওয়া প্রত্যেক ছাত্রের প্রশ্ন। মানববন্ধনের প্রথম ব্যক্তিবর্গ হিসেবে আমাদের নিয়ে শুরু হয়, সোশ্যাল মিডিয়ায় বুলিং এবং জবাবদিহিতার ঘটনা। সে ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমাদের দুইজন সহপাঠীকে আহসান উল্লাহ হলে রাত ১১টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত জবাবদিহিতার নামে যে প্রহসনমূলক র‍্যাগিং বা বুলিং এবং কমনরুম ও মাঠে একটানা অপমান করা হয়। এই ঘটনা আমাদের মানসিক স্থিতির ওপর বিরাট প্রভাব ফেলে। আমাদের নিচু দেখিয়ে কথা বলাও শুরু হয় এবং হল থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। এরপর থেকেই আমাদের চিহ্নিত করে বারবার বুলিং এবং আমাদের ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণ করা হয়। আমরা কখন কোথায় যাচ্ছি তাও সরাসরি অনুসরণ করে চিহ্নিত করা হয়।

অভিযোগ করে তারা জানান, আমরা শুধুমাত্র মত প্রকাশ করেছিলাম। স্বাধীন এই বাংলায় এই অধিকার কি আমাদের নেই? পরবর্তীকালে আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী ছাত্ররা একরাতে একসঙ্গে বসে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা ও খাওয়া-দাওয়া করলে আবারও ছুটে আসে সোশ্যাল ডিফেমেশনের  কালোছায়া। এতে প্রমাণবিহীনভাবে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উপস্থিত থাকার বানোয়াট ও মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে আমাদের সবাইকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সোশ্যাল গ্রুপ থেকে বের করে দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ সদস্যদের ক্লাব থেকে বের করে দেওয়া হয়। এমনকী ক্লাস শিডিউল ও পরীক্ষার রুটিন সঠিক সময়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছাত্রদের না জানানোর আদেশ দেওয়া হয়। পরিষ্কারভাবে আমাদের লালিত বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী অন্য শিক্ষার্থীদের সামাজিক বয়কটের পক্ষে ঘটা করে জানান দেওয়া হয়। দেশমাতার বুকে মাকে ভালোবাসার জন্য এ যেন এক ঘটা করে ডেকে অপমান করা। আমরা এই মর্মে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আবেদন করলেও কোনো মীমাংসা আজও পাইনি।

সমসময়িক ইস্যুতে তারা জানান, চলতি বছরের ২৭ মার্চ দিনগত রাতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি হুসাইন সাদ্দাম বুয়েট প্রাঙ্গণে রাতে উপস্থিত হলে তার সঙ্গে বুয়েটে অধ্যয়নরত বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য ইমতিয়াজ রাহিম রাব্বি সৌজন্য বিনিময়ের কারণকে অভিযোগ হিসেবে তুলে ধরে একটি প্রদর্শনীর ছাত্র আন্দোলন সৃষ্টি হয়। পরে তারা ইমতিয়াজ রাহিম রাব্বির হল বহিষ্কার দাবি করে এবং উপাচার্য মহোদয় কর্তৃক কোনোরকম তদন্ত ছাড়া তাই গৃহীত হয়। পরবর্তীতে তাকে স্থায়ীভাবে বুয়েট থেকে বহিষ্কারের দাবিও জানানো হয়, যা আসলে একজন শিক্ষার্থীর জন্য তার একাডেমিক ক্যারিয়ার ধ্বংসের শামিল। এই আন্দোলন ক্যাম্পাসে শান্তির পরিবেশ নষ্ট করে যা পরীক্ষা বয়কটের মতো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। এরই সঙ্গে অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সোশ্যাল হ্যারাসমেন্ট এবং ব্যক্তিগত তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে আমাদের জীবন হুমকির মুখে ফেলে দেওয়া হচ্ছে।

তারা আরো জানান, আমাদের উক্তিতে উঠে আসা ঘটনাগুলোতে সবসময়ই হোতা কিছু নির্দিষ্ট মানুষ যাদের সঙ্গে শিবির সন্দেহে আটককৃতদের সম্পৃক্ততা এবং মৌলবাদী চিন্তা পালনের দৃষ্টান্ত মেলে। অনেক ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক মতামত প্রতিষ্ঠার জোরও চালানো হয় তাদের দ্বারা। কিন্তু এই অন্ধকার রাজনীতি আড়ালে নেয় আবরার ফাহাদ ভাইকে হারানোর বেদনায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের আবেগকে ব্যবহার করে। সম্প্রতি, ক্যাম্পাসে ইসিই ভবনের লিস্টেও হিজবুত তাহরীর পোস্টারে কিউআর কোডের মাধ্যমে "পাশ্চাত্য সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে এসে খিলাফত প্রতিষ্ঠা" করার আহ্বান করা হয়, যা শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত এডুকেশনাল মেইলেও পাঠানো হয়। হে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি আমাদের রক্ষক, আপনি সহযোগিতা করুন, আমাদের আবেদন শুনুন।

তারা আরো অভিযোগ করেন, ক্যাম্পাসে ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে স্টাফদের মধ্যে ইফতার বিতরণের জন্য তাদের সহযোগী জুনিয়র ও ব্যাচমেটদের প্রশ্নবিদ্ধ করা হয় এবং জবাবদিহিতা চাওয়া হয়। এমনকী সবাইকে সামাজিক বয়কটের হুমকি দেওয়া হয়।

প্রধানমন্ত্রীকে তারা জানান, হলের রুমে বঙ্গবন্ধু ও আপনার ছবি রাখতে চাইলেও আমাদের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে "বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ চেতনা" বিষয়ক ক্লাব প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেও তার বিরোধিতা করে সমালোচনা করা হয়, যার কারণে এই ক্লাব প্রতিষ্ঠায় আমাদের পিছপা হতে হয়।

প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য চেয়ে তারা জানান, বর্তমানে এই সবধরনের নিপীড়নের বিরুদ্ধে অভিযোগ করায় আমাদের জীবন হুমকিসহ নানা জটিলতার মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হচ্ছে। শিবির দ্বারা পরিচালিত বাঁশেরকেল্লার পক্ষ থেকে আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য চাওয়া হচ্ছে। আমাদের শিক্ষার্থীদের নাম, মোবাইল ফোন নম্বর, শিক্ষার্থী নম্বর থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ম্যাসেজিং অ্যাপসগুলো ব্যবহার করে। এর প্রমাণ, এরই মধ্যে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে জমা দিয়েছি। আমরা ২১ জন এই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি।

হে দেশরত্ন, বঙ্গবন্ধু তনয়া, আমাদের সাহায্য করুন। আমরা বিশ্বাস করি, ভিন্ন-অভিন্ন সব মতের সাধারণ বুয়েট শিক্ষার্থীরা সবাই মিলে স্বাভাবিক ও নিরাপদ ক্যাম্পাস চাই। আমরা মত প্রকাশের স্বাধীনতা চাই। আমরা চাই না, আমাদের ক্যাম্পাস জঙ্গি তৈরির কারখানা হোক। আমরা চাই না, দেশে দ্বীপভাই, সনিআপু ও আবরার ফাহাদ ভাইয়ের মতো নির্মম ঘটনা ঘটুক। আমরা দ্বিতীয় কোনো হলি আর্টিজান ঘটনাও চাই না। আমরা চাই না তন্ময়ভাইয়ের মতো কেউ শিবিরের নৃশংস হামলার ক্ষতচিহ্ন নিয়ে জীবনযাপন করুক। আমরা সবাই-ই জানি, বিশ্ববিদ্যালয় উন্নত মুক্তবুদ্ধি চর্চার মুক্ত মাঠের মতো। আমাদেরও সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে আপনার কাছে এই আকুল আবেদন।

তারা জানান, হিজবুত তাহারীর বা শিবিরের সন্ত্রাসী আক্রমণ থেকে কতটা নিরাপদ বুয়েটের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি! রাষ্ট্রযন্ত্র মেধাবীদের এই ক্যাম্পাসকে কতটা নজরদারিতে রেখেছে বা এর প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করছে, আমরা জানি না। যেকোনো বড় ধরনের নাশকতার ঘটনার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিলে হলি আর্টিজানের মতো কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছি, আমরা ক্যাম্পাসের প্রগতিশীল ছাত্র সমাজ। এ বিষয়ে বুয়েট ক্যাম্পাসে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর তৎপরতা কতটুকু, তাও আমরা জানি না। অতিসত্বর বুয়েট নিয়ে তাদের কার্যক্রম জোরদার করার দাবি জানাচ্ছি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে তারা বলেন, আপনার সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে আমরা আমাদের আকুল আর্জি রাখলাম যে, নিরাপদ ও স্বাধীন মতামত প্রকাশের ক্যাম্পাস উপহার দিন। দেশ ও দশের প্রতি ভালোবাসা রেখে সবার কল্যাণকে মাথায় রেখে আমরা ক্যাম্পাসে স্বাভাবিক পরিস্থিতি চাই এবং জীবনের নিরাপত্তা চাই। আমরা বুয়েট ক্যাম্পাসে নিরাপদে এবং সৎ সাহসের সঙ্গে প্রগতিশীল রাজনীতির চর্চা করতে চাই।