স্বর্ণপদকজয়ী বেরোবি শিক্ষার্থী হাবিবার গল্প
একজন মানুষের সফল বা ব্যর্থ হওয়া তার ক্ষমতার ওপর যতটা না নির্ভর করে, তার চেয়ে বেশি তার দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (২০১২-১৩) সেশনের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী হাবিবা আক্তার। তিনি বিজ্ঞান অনুষদ থেকে সবচেয়ে ভালো ফলের (সিজিপিএ ৩.৮৮) স্বীকৃতিস্বরূপ ‘প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক-২০১৮’ এর জন্য মনোনীত হয়েছেন।
এতো ভালো ফলের পেছনে সার্বক্ষণিক একাডেমিক পড়াশুনা নিয়েই যে তিনি ব্যস্ত সময় পার করতেন তেমনটা না। এর পাশাপাশি যুক্ত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সামাজিক ও বিতর্ক সংগঠনের সঙ্গে। সময়-সুযোগ পেলেই ছুটে যেতেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত বিভিন্ন সেমিনারে। এছাড়া গবেষণাকার্যে অংশ নিতে ঢাবি, জাবি, রাবি, মাভাবিপ্রবিতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করেন। এর জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় কর্তৃক ‘এনএসটি’ ফেলোশিপ এবং শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল থেকে প্রভোস্ট’স অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছেন।
ভালো ফল এবং সফলতার জন্য কেমন পরিশ্রম করেছেন, কারা বেশি অনুপ্রেরণা দিয়েছে, ভালো ফল অর্জনে জুনিয়রদের করণীয় কী, স্বর্ণপদকের জন্য মনোনীত হওয়ায় অনুভূতির কথা বার্তা২৪.কম-কে জানাচ্ছেন হাবিবা আক্তার-
শুরুতেই আল্লাহ তাআলার কাছে শুকরিয়া! আমাদের দেশের একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবনের সর্বোচ্চ প্রাপ্তির অংশীদার হতে পেরে আমি আনন্দিত। শুরুতেই কৃতজ্ঞতা মা-বাবার প্রতি,পরিসংখ্যান বিভাগের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকবৃন্দের প্রতি, সহপাঠী, অগ্রজ-অনুজ, শুভাকাঙ্ক্ষী সকলের প্রতি। বিশেষ কৃতজ্ঞতা, চন্দ্র নাথ দাদা (চেয়ারম্যান, মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, আমেরিকা), যিনি থমকে যাওয়া সময়ে আশার সলতে জাগিয়ে দিয়েছিলেন। আমার এই ক্ষুদ্র অর্জন আমার মা-বাবাকে উৎসর্গ করছি।
একজন মেয়ে হিসেবে নয় বরং একজন ভালো মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে, আমার মা-বাবার এই উপদেশই আমাকে স্বপ্ন দেখতে সাহায্য করে। কিন্তু আমার চলার পথ কখনও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। একজন মেয়ে হয়েও সময়ের সাথে চ্যালেঞ্জ করে সামনে এগিয়ে গিয়েছি কিছু মানুষকে আদর্শ জেনে, কিছু মানুষের লাগামহীন অনুপ্রেরণায়। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে গ্রাম থেকে উঠে এসে, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আমরা তিন বোনই মা-বাবার একমাত্র অবলম্বন।
কুড়িগ্রামের রাজারহাট পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে রংপুর পুলিশ লাইনস স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করি। স্বপ্নের পরিধি ছিল অনেক বড়, কঠিন কিছু বাস্তবতায় তা অন্য পথে বাঁক নেয়। তবে একাগ্র ছিলাম, যে কাজটাই করি- সৎ চিন্তা, সৎ সাহস নিয়েই করি। তাই বোধ হয় অনেক অন্ধকার কেটে গেছে।
উপমহাদেশের নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার নামে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে আমি গর্বিত, যার প্রাণপণ চেষ্টায় আজ নারীদের বন্দীদশা হতে মুক্তি। আমি গর্বিত যে, আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে পদক পেতে যাচ্ছি।
আমি একাডেমিক পড়াশুনার জন্য শিক্ষকদের রেফারেন্স বই পড়তাম। যখন পড়তে ভাল লাগতো না, বাংলা উপন্যাস পড়া, কবিতা লেখা আর গাছ লাগানোই ছিল আমার পছন্দের কাজ। ১ম থেকে ৩য় বর্ষ সামাজিক ও বিতর্ক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। সেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সেমিনারগুলোতে অংশগ্রহণ ছিল নেশার মত। আমি মনে করি একজন শিক্ষার্থীকে সবসময় উজ্জীবিত রাখতে এসবের ভূমিকা অপরিসীম।
জুনিয়রদের প্রতি আমার পরামর্শ থাকবে, নিয়মমাফিক পড়াশোনা করা। কোনো কাজ আগামী দিনের জন্য ফেলে রাখা যাবে না। পড়াশোনাটা ধরে রাখতে হবে। একবার পড়লাম আর একবার পড়লাম না-এমনটা না। আর শুধুমাত্র শিট কিংবা নোটের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে ক্লাসে স্যার বা ম্যামরা যা পড়ান তা মনোযোগ দিয়ে নোট করা ও যেসব রেফারেন্স বইয়ের নাম বলবেন, তা থেকে টপিকসগুলো ভালোভাবে আয়ত্ত করা। সর্বশেষ জুনিয়রদের প্রতি পরামর্শ থাকবে, পরীক্ষার আগের রাত বা দুই-একদিন আগে তাড়াহুড়ো করে না পড়ে পড়াশোনাগুলো গুছিয়ে রাখা।
আমি ইতোমধ্যে গবেষণা কাজের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় হতে (এনএসটি) ফেলোশিপ এবং শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল থেকে প্রভোস্ট’স অ্যাওয়ার্ড ২০১৯ প্রাপ্ত। আমার একটি গবেষণা আন্তর্জাতিক জার্নালে এবং অন্যটি দেশীয় জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া আরও একটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আমার প্রিয় পরিসংখ্যান বিভাগ, আমাকে নতুন পথ দেখিয়েছে, আজকের আমাকে তৈরি করেছে। আমি দেশের জন্য, আমাদের অত্র অঞ্চলের মানুষের সেবার জন্য নিজেকে নিয়োজিত রাখতে চাই। আমার চূড়ান্ত স্বপ্ন, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করা।