সবার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য ও সুস্থতার বিশ্বব্যাপী অগ্রাধিকার প্রদান

  • ড. মতিউর রহমান
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

বিশ্বজুড়ে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতি বছর ১০ অক্টোবর ‘বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস’ পালিত হয়। ভালোভাবে বাঁচতে হলে একজন মানুষকে শারীরিক স্বাস্থ্যের মতোই তার মানসিক স্বাস্থ্যের সুস্থতা বজায় রাখতে হয়।

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস বিশ্বের সকলের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে শিক্ষা এবং সচেতনতা বৃদ্ধির একটি দিন। এটি প্রথম ১৯৯২ সালে পালন করা হয়। কিছু দেশে এটি মানসিক অসুস্থতা সচেতনতা সপ্তাহের অংশ হিসাবে পালন করা হয়। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য “সবার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য ও সুস্থতার বিশ্বব্যাপী অগ্রাধিকার প্রদান” (Make mental health & well-being for all a global priority).

বিজ্ঞাপন

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে কোভিড-১৯ মহামারী মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য একটি বিশ্বব্যাপী সঙ্কট তৈরি করেছে, স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদী চাপ বাড়িয়েছে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যকে দুর্বল ও ভঙ্গুর করে তুলেছে। সংস্থাটির মতে, করোনা মহামারীর প্রথম বছরে বিশ্ব জুড়ে মানুষের মাঝে উদ্বেগ এবং হতাশাজনক ব্যাধি করোনা পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় ২৫ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সময়ে, মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবাগুলি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে।

করোনা মহামারীকালে মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসা ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলি উদ্ঘাটিত হয়েছে। মহামারীর আগে বিশ্বব্যাপী আনুমানিক আটজনের মধ্যে একজন মানসিক ব্যাধি নিয়ে বসবাস করছিলেন। একই সময়ে, মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপলব্ধ পরিষেবা, দক্ষতা এবং তহবিলের স্বল্পতা নিম্ন এবং মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে ব্যাপক সংকট তৈরি করেছে।

বিজ্ঞাপন

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বব্যাপী প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন ব্যক্তি আত্মহত্যা করে। ভঙ্গুর মানসিক স্বাস্থ্যই মূলত আত্মহত্যার জন্য দায়ী। যদি একজন ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে তবে সে কখনো আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হবে না। আত্মহত্যার অধিকাংশই প্রতিরোধযোগ্য।

আত্মহত্যার সময় একজন ব্যক্তি একধরনের মানসিক সমস্যায় ভোগেন। সাধারণত সেসব মানসিক সমস্যায় গুরুত্ব না দেওয়ায় বা যথাযথ চিকিৎসা প্রদান না করায় আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটে। মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির মাধ্যমে আত্মহত্যার হার কমানো যেতে পারে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এক জরিপ অনুযায়ী, দেশে দুই কোটিরও বেশি মানুষ বিভিন্ন মানসিক রোগে ভুগছেন। শতাংশ হিসাবে এটি ১৬.৮ । জরীপ মতে, বর্তমানে দেশে ১৬.৫ কোটির বেশি মানুষের জন্য ২৭০ জন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। আর কাউন্সেলিং এর জন্য আছে মাত্র ২৫০ জন সাইকোলজিস্ট।

মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসার জন্য সরকারিভাবে পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল নেই। রয়েছে অবকাঠামোগত সংকট। ঢাকা ও পাবনায় দুটি সরকারি বিশেষায়িত হাসপাতাল রয়েছে। এখানেও ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি রয়েছ। প্রয়োজনের তুলনায় সীমিত অবকাঠামো, কম চিকিৎসক ও প্রশিক্ষিত জনবল না থাকার সুযোগ নিচ্ছে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল।

এসব হাসপতালের ওপর প্রয়োজনীয় তদারকিও নেই। এমন অনেক প্রতিষ্ঠানও মানসিক রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছে যাদের এবিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। এসব প্রতিষ্ঠান কোনো শর্তই মেনে চলেনা। মারধোর তাদের অন্যতম চিকিৎসা পদ্ধতি। এবং অনেক ক্ষেত্রে তারা মনোরোগ চিকিৎসা এবং মাদকাসক্তির চিকিৎসাকে একত্রিত করেছে।

মানসিক অসুস্থতার সাথে যুক্ত সামাজিক কলঙ্কের বিষয়টিও সাহায্য প্রত্যাশী ব্যক্তির আচরণকেও প্রভাবিত করে। ফলস্বরূপ, মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিরা সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং বৈষম্যসহ নিরবে তাদের ব্যাধি বয়ে চলেন। অথচ খুব কম মানুষই মানসিক রোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার গলদই মানসিক রোগের উৎপত্তিস্থল বলে সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন।

মানসিক অসুস্থতাকে খুব কমই জনস্বাস্থ্যের একটি বিষয় হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশে মানসিকভাবে অসুস্থদের প্রতি সামাজিক কলঙ্ক আরোপ করা হয়। মানসিক অসুস্থতাকে কুসংস্কারজনিত করণে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। মানসিক ব্যাধিকে জৈবিক বা মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার বিপরীতে পাপের পরিণতি বলে মনে করা হয়, যা মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রতি অবহেলা এবং তাদের প্রতি নৃশংসতা ও দুর্ব্যবহারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।

বাংলাদেশে মানসিক রোগের প্রকোপ অনেক বেশি এবং চিকিৎসা অপর্যাপ্ত। বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে। জনসাধারণের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির অভাব, দক্ষ মানসিক স্বাস্থ্য পেশাদারদের অভাব, অপর্যাপ্ত আর্থিক সম্পদ বণ্টন এবং সামাজিক কলঙ্ক আরোপ বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে। সামষ্টিক পর্যায়ে, বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্যসেবা ব্যয়ের অভাব, দুর্বল অ্যাডভোকেসি এবং সীমিত গবেষণা সমস্যাটিকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

বাংলাদেশে মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা যে বাড়ছে বিভিন্ন সময়ে গবেষণার মাধ্যমে তা তুলে ধরা হয়েছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনুভূত ক্রমবর্ধমান বিষন্নতা ও উদ্বেগের কথা বলা হয়েছে যা শিক্ষার্থীদের অবসাদের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে আত্মহত্যার দিকে চালিত করছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে ক্রমবর্ধমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য, দীর্ঘস্থায়ী দ্বন্দ্ব, সহিংসতা বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যার মানসিক স্বাস্থ্যকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করেছে। উন্নত ও কল্যাণের দিকে অগ্রগতিকে হুমকির মুখে ফেলেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে ব্যক্তি, সম্প্রদায় এবং সরকার হিসাবে আমরা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য যে অর্থ এবং প্রতিশ্রুতি দিই আমাদেরকে তা আরও বাড়াতে হবে। সকল স্টেকহোল্ডারদের সাথে মিলিতভাবে সাশ্রয়ী মূল্যে, মানসম্পন্ন পরিষেবা এবং সহায়তা দিয়ে মানসিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা ব্যবস্থাকে অবশ্যই শক্তিশালী করতে হবে।

মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে আমরা সকলেই যার যার অবস্থান থেকে ভূমিকা পালন করতে পারি যা মানসিক স্বাস্থ্যের অবক্ষয়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসাবে কাজ করে। বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস সম্মিলিতভাবে এটি করার সুযোগ প্রদান করে। আমাদেরকে এমন একটি বিশ্বের কথা চিন্তা করতে হবে যেখানে সবার মানসিক স্বাস্থ্যের সুস্থতাকে অগ্রাধিকার প্রদান করে। যেখানে মানসিক স্বাস্থ্যকে মূল্যবান মনে করা হয় এবং এর সুরক্ষায় যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যেখানে প্রত্যেকেরই মানসিক স্বাস্থ্য উপভোগ করার এবং তাদের মানবাধিকার প্রয়োগ করার সমান সুযোগ রয়েছে; এবং যেখানে প্রত্যেকেই তাদের প্রয়োজনীয় মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশিাধিকার পায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে যদিও করোনা মহামারী আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে এবং এখনও তা অব্যাহত আছে, বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস ২০২২ উদযাপন করার মাধ্যমে এটি আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং উন্নত করার জন্য আমাদের প্রচেষ্টাকে পুনরায় উজ্জীবিত করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

ড. মতিউর রহমান: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী