কাদের স্বার্থে, মদতে শান্তি ও সম্প্রীতির পাহাড়ে চলছে সন্ত্রাসবাদ?



আবুল খায়ের মোহাম্মদ
কাদের স্বার্থে, মদতে শান্তি ও সম্প্রীতির পাহাড়ে চলছে সন্ত্রাসবাদ?

কাদের স্বার্থে, মদতে শান্তি ও সম্প্রীতির পাহাড়ে চলছে সন্ত্রাসবাদ?

  • Font increase
  • Font Decrease

দুই যুগ আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে হানাহানির অন্ধকার অধ্যায়ের অবসান হয়ে এসেছিল শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়নের নতুন ভোর। তারপর আলোকোজ্জ্বল হয়েছে পশ্চাৎপদ পার্বত্যাঞ্চল। নবজীবনের স্বাদ পেয়েছে পাহাড়ে বসবাসকারী উপজাতি ও বাঙালি জনগোষ্ঠী।

কিন্তু অকস্মাৎ বান্দরবানের গহীনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাদের স্বার্থে, কাদের মদদে শুরু হলো সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের নাশকতা? অভিজ্ঞরা বলেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম হলো লাভজনক সন্ত্রাসবাদের ‘দোকান’। সেখানে সন্ত্রাসের নতুন সংজ্ঞার নাম 'পাহাড় দখল'। তারপর আন্তর্জাতিক মাফিয়া গোষ্ঠীর মদতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে আফিম ও গাঁজার চাষ। দেশের হেরোইন রাজধানী হয়ে উঠেছে ভারত ও মায়ানমারের সীমান্তরেখা।

আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশিক তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশের অপর পার্শ্বের সীমান্তবর্তী গ্রামগুলো মাদক তৈরির কারখানা, মানুষ ফসলের চাষবাস বন্ধ করে আফিম চাষ করছেন। মায়ানমার-চট্টগ্রাম সীমান্ত জুড়ে মাদক তৈরি সংগঠিত ‘শিল্প’, যা কুকিদের ব্যবহার করে তা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। মায়ানমার ও মিজ়োরাম থেকে কুকিরা নাগাড়ে ঢুকছেন মাদক আর অস্ত্র নিয়ে। আফিম চাষের পাশাপাশি উন্নত আগ্নেয়াস্ত্র দিয়েও মদত দিচ্ছে,সীমান্তের ও-পারের এজেন্টরা। যার ফলে নিরাপত্তার ক্ষতি হচ্ছে শান্ত পাহাড়ের এবং বিশেষভাবে বান্দরবানের।

সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সঠিক চিত্র পেতে তাকানো দরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে। বাংলাদেশের আয়তনের প্রায় এক দশমাংশ এলাকা নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম। এই এলাকাটি বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে ভিন্ন প্রকৃতির। এখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপজাতি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতি, ভাষাগত বৈচিত্র, তাদের বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান, প্রথাগত রীতিনীতি এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি খ্যাত সাজেক পর্যটন এলাকা, আলুটিলা, রাঙামাটি ঝুলন্ত ব্রীজ, বান্দরবান এর নীলগিরি, বগালেক ও তাজিংডং পাহাড় এর মত উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান এই অঞ্চলেই অবস্থিত বিধায় এই এলাকাটি বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত।

আরও পড়ুন: বান্দরবানে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের উত্থান নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ

শান্তিচুক্তির পরবর্তী সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থিতিশীলতা রক্ষার পাশাপাশি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা এই অঞ্চলের আপামর জনসাধারণের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, খাদ্য সমস্যা, মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত স্থানীয় ব্যক্তিবর্গদের চিকিৎসা সেবা, দরিদ্র ব্যক্তিবর্গদের আর্থিক অনুদান প্রদান করে স্বাবলম্বী হতে সহযোগিতা করা, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করা, দুর্গম এলাকায় পানির সমস্যায় জর্জরিত স্থানীয়দের কষ্ট লাঘবে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা এবং বেকার ব্যক্তিবর্গের কর্মসংস্থানের জন্য ক্ষুদ্র কারখানা স্থাপন করে আসছে।

এছাড়া তিন পার্বত্য জেলার অরক্ষিত সীমান্ত এলাকাকে নজরদারির আওতায় আনতে বাংলাদেশ সরকারের আহবানে সাড়া দিয়ে দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল ও উপজাতি সন্ত্রাসীদের প্রতিকূল অবস্থান মোকাবেলা করে সীমান্ত সড়ক নির্মাণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিবেদিতপ্রাণ হয়ে দায়িত্বপালন করছে।

দেশমাতৃকার সেবায় নিয়োজিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড এবং শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় তাদের আত্মত্যাগের বিষয়টি আজ দেশে-বিদেশে প্রশংসিত। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের আত্মত্যাগ ও কল্যাণকর কাজে ফলে পাহাড়ে বৃদ্ধি পেয়েছে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য। এজন্য সেনাবাহিনী কঠোর ত্যাগ স্বীকার করে চলছে। উদাহরণ স্বরূপ দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল খাগড়াছড়ি জেলার আলুটিলা পুনর্বাসন এলাকায় ১৬০টি পরিবারের ৪০০ জন ব্যক্তিবর্গ দীর্ঘদিন যাবৎ পানির সমস্যায় ভূগছিল। সেখানে ছিলনা কোন সুপেয় পানির উৎস। এই খবর জানার পরপরই ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে খাগড়াছড়ি রিজিয়নের উদ্যোগে সেনাবাহিনী কর্তৃক ১০ হাজার লিটার ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন একটি পানির ট্যাংক স্থাপন করা হয়। যা ৫০০ মিটার গভীর হতে মোটর এর মাধ্যমে পানি সংগ্রহ করতঃ উক্ত পানির ট্যাংকে সংরক্ষিত হয় এবং সেখান থেকে স্থানীয়রা সুপেয় পানি সংগ্রহ করে। সেখানে এই প্রকল্প চালুর পর স্থানীয় জনগোষ্ঠীর পানির সমস্যা সমাধান হওয়ায় সেনাবাহিনীর অনন্য ভূমিকায় আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন।

অতি সম্প্রতি খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার গোলাবাড়ী ইউনিয়নের জংলীটিলা এলাকায় স্থানীয় পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের পানির সমস্যা সমাধানে মহালছড়ি সেনা জোনের মাধ্যমে একটি সুপেয় পানির হাউজ নির্মাণ করা হয়। এতে ঐ এলাকার স্থানীয় জনগণ সেনাবাহিনীর মানবিক দায়িত্ব পালনে অত্যন্ত আনন্দিত ও গর্ববোধ করছে।

পাহাড়ের অসুস্থ মানুষকে হাসপাতালে দ্রুত পৌঁছে দেন তারা। যে কোনো দুর্যোগে পাহাড়ি মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায় তাদের। না এখানেই শেষ নয়, বেকার যুবকদের জন্য ব্যবস্থা করছেন কর্মসংস্থানের। রাত হলে উপজাতি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর কারণে ঘুমাতে পারেন না পাহাড়ি-বাঙালিরা। তাদের শান্তিতে ঘুমোনোর ব্যবস্থাও করছেন এই বাহিনীর প্রতিটি সদস্য।

পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন পাহাড়ি অঞ্চল- খাগড়াছড়ি, বান্দরবন এবং রাঙামাটিতে সেনাবাহিনীর মানুষের পাশে থাকার কথা সর্বজনবিদিত। সামাজিক উন্নয়নে এই বাহিনীর ভূমিকা যেমন এখন দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশংসিত, তেমনি আস্থা অর্জন এবং সম্প্রীতি বজায়ে তিন পাহাড়ের সব ধর্মের মানুষের কাছে সেনাবাহিনী একটি নির্ভরতার প্রতীক। পার্বত্য চট্টগ্রামে সাধারণ মানুষের প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর পাশে দাঁড়ানোর বিষয়টি এখন একটি নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা।

খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার হাজাপাড়া নামক দূর্গম পাহাড়ী এলাকায় মহামারি আকারে ডায়রিয়া আর অন্যান্য পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিলো কিছু দিন আগে। ঐ সময়ে বেশ কিছু পাহাড়ী যুবক, বৃদ্ধা ও শিশু গুরুত্বর অসুস্থ হয়ে পড়ার খবর পাওয়ার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অতি দ্রুত সেখানে ছুটে গিয়ে দূর্গম পাহাড়ী পথে কয়েক ঘন্টা হেটে হাতিরমাথা অতিক্রম করে হাজাপাড়া এলাকায় পৌছায়, সেখানে অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প নির্মাণ করে ১৫০-১৬০ জন মহামারী আক্রান্ত রোগীদের পরম যত্নের সাথে চিকিৎসা সেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলে। প্রখর রৌদ্র উপেক্ষা করে দূর্গম ঐ এলাকায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা দেশমাতৃকার সেবায় নিজেদের কষ্ট বিসর্জন দিয়ে বিভিন্ন প্রকার চিকিৎসা সেবা এবং জনস্বার্থমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল।

করোনায় যখন সারাদেশের মানুষ নিজের জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই খাগড়াছড়ি, বান্দরবন এবং রাঙামাটির দুর্গম অঞ্চলের মানুষকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে সেনাবাহিনী। কেবল তাই নয়, করোনা ছাড়াও রাত-বিরাতে অনেক মানুষ হাসপাতালে যেতে পারেন না। তাদেরকে উদ্ধার করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন এই বাহিনীর প্রতিটি চৌকষ সদস্য।

এই বাহিনীর আরও রয়েছে নানান ভূমিকা। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার পাশাপাশি তারা সেখানকার বসবাসরত লোকজনের জীবনমানোন্নয়নে ধারাবাহিকভাবে উন্নয়নমূলক প্রকল্প পরিচালনা করে আসছে।

পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত ৩ বছরে ২৪ পদাতিক ডিভিশনের আওতাধীন তিন পার্বত্য জেলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ৫০ হাজারের বেশি মানুষের ভেতর শীতবস্ত্র বিতরণ করেছে। এছাড়াও অন্তত এক লাখ মানুষের মাঝে বিভিন্ন প্রকার ত্রাণসামগ্রী বিতরণ ও ২০ হাজার জনকে বিভিন্ন আর্থিক অনুদান প্রদান করেছে। নিয়মিতভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে বিনামূল্যে চক্ষুশিবির।

এসব চক্ষুশিবিরে দুর্গম পার্বত্য এলাকার সুবিধাবঞ্চিত বয়োবৃদ্ধ পাহাড়ী ও বাঙালির চোখের ছানি অপারেশনসহ বিভিন্ন ধরনের চক্ষু সেবা প্রদান করা হয়।

ইতিপূর্বে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা, রাঙামাটির সাজেক ও বান্দরবানের বিভিন্ন এলাকায় হাম আক্রান্ত হয়ে বহু পাহাড়ী শিশু নিহত হবার ঘটেছে। এসব আক্রান্ত এলাকাগুলোতে নিজেদের জীবন বাজি রেখে সুপেয় পানি সরবরাহ, খাবার ব্যবস্থা, অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প করে অসুস্থদের চিকিৎসাসেবা পরিচালনা করে পাহাড়ে হাম আক্রান্ত পাহাড়ীদের জীবন বাঁচানোর মতো মানবিক কাজে সেনাবাহিনীর অবদানও কম নয়।

পাহাড়ে সশস্ত্র সন্ত্রাস দমন, শান্তি রক্ষায় সেনাবাহিনী রয়েছে বদ্ধপরিকর। বিভিন্ন সময়ে পাহাড়ের দূর্গম স্থানগুলোতে গর্ভবতী মুমূর্ষ নারীদের পাহাড়ী রাস্তায় কাঁঢ়ে করে এনে হেলিকপ্টার যোগে সিএমএইচ এ নিয়ে সন্তান প্রসবসহ সুস্থ করে তোলার নজিরও রয়েছে অহরহ।

দূর্গম পাহাড়ি এলাকায় ২০২০ সালে ভাল্লুকের আক্রমণে গুরুতর আহত মঙ্গলিয় মুরং (০৬) ও তার দাদা ইয়াংসাই (৪৮) কে আশংকাজনক অবস্থায় উদ্ধার করে চট্টগ্রাম সিএমএইচ এ নিয়ে চিকিৎসা সেবা ও এরপর ভাল্লুকের আক্রমনে আহত ত্রইল মুরং (৬৬) নামের আরো এক পাহাড়ীকে উদ্ধার করে হেলিকপ্টারে করে চট্টগ্রাম সিএমএইচ এ নিয়ে চিকিৎসা সেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলার একমাত্র প্রসংশার দাবীদার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীই।

শিক্ষাবিস্তারে সেনাবাহিনী এর তত্ত্বাবধানে সর্বশেষ গত ৩ বছরে ২৫০টির বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পাহাড়ে নির্মাণ করা হয়েছে। যেখান থেকে প্রচুর স্কুল শিক্ষার্থী পড়ালেখা করে একধাপ এগিয়ে যাচ্ছে। এখানেই শেষ নয়। ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষায়ও এগিয়ে আছে সেনাবাহিনী। গত ৩ বছরে ২২০টির বেশি ধর্মীয় উপসনালয় গড়ে দিয়েছে তিন পাহাড়ি জেলায়। অবেহেলিত শিশুদের মানসিক বিকাশে তাদের রয়েছে সময়োপযুগী পদক্ষেপ। অনেক স্কুলে পড়ালেখার বই নেই। নেই উপকরণ। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিভিন্ন প্রকার শিক্ষা উপকরণ, ছাত্রছাত্রীদের স্কুল ড্রেস ও খেলাধুলার সামগ্রী বিতরণ করে তারা মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

পার্বত্য অঞ্চলের অবহেলিত মানুষদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে সেনাবাহিনী নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিনামূল্যে কম্পিউটার ও সেলাই মেশিন বিতরণসহ ঐ বিষয়ে প্রশিক্ষণও প্রদান করছে তারা। এতে পিছিয়ে পড়া পাহাড়ী-বাঙালি নারীরা স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছে।

দুর্গম পার্বত্য এলাকার জনগণের সুষ্ঠু বিনোদনের জন্য সেনাবাহিনী প্রতিবছর নানা দিবসে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। তাদের এসব কার্যক্রম মুক্তবুদ্ধি ও সাংস্কৃতিক চর্চাকে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পথে পরিচালিত করছে। যা ইতিবাচক বলে মত দিয়েছেন দেশের আপামর জনগণ।

একসময় ভীষণ অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম। ছিলনা শিক্ষার আলো। রোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের বা গুরুত্বর অসুস্থ ও আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ছিলনা। এছাড়া তিন পার্বত্য জেলার পাহাড়ী সন্ত্রাসী দলগুলোর পাল্টা-পাল্টি হামলা ও খুনোখুনির কারণে ভয় নেমে আসতো সেখানকার বসবাসরত সাধারণ মানুয়ের ভেতর। সময় গড়িয়ে এখন বদলে গেছে এই পাহাড়ী জনপদ। বঙ্গবন্ধু কন্যা ও বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার পাহাড়ের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে হাতে নিয়েছেন নানান পরিকল্পনা।

আর সেই পরিকল্পনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হাত ধরেই এগিয়ে যাচ্ছে খাগড়াছড়ি, বান্দরবন ও রাঙামাটি জেলায়। যার ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে গুইমারা সেনা রিজিয়নের উদ্যোগে গুইমারা রিজিয়নের পুরাতন কমান্ডার বাংলোতে একটি কম্বল ও ব্যাগ ফ্যাক্টরি উদ্বোধন করা হয়। এতে ঐ এলাকার স্থানীয় জনগণের ক্ষুদ্র কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়ায় বেশ কিছু বাঙালি ও পাহাড়ী ব্যক্তিবর্গ শ্রমিক হিসাবে নিয়োগ লাভ করায় তাদের পারিবারিক ভরণপোষণ ক্ষমতা ও স্বচ্ছলতা বৃদ্দি পেয়েছে। অনেকেই ভাবেননি এসব অঞ্চলে পানি আসবে, থাকবেনা বিদ্যুৎ সমস্যা। দুর্গম পাহাড়ী পথে ঘটবে উন্নয়ন, প্রান্তিক চাষিগণ প্রত্যন্ত এলাকা হতে বিভিন্ন উৎপাদিত কৃষিপণ্য ও ফলফলাদি পরিবহণে সুবিধা প্রাপ্তি হয়ে নিজেদের অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়নে অবদান রাখবে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, দুর্গম পাহাড়ে এখন জ্বলছে বিদ্যুতের আলো। রাস্তা করা হয়েছে প্রশস্ত। কোথাও পাকা সড়ক। বেড়েছে কৃষিকাজ। বেড়েছে চাষাবাদ। পর্যটন খাতেও উন্নতির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সেখানে বাড়ছে বিনিয়োগ। তিন পার্বত্য জেলা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এখন চলছে উন্নয়নযজ্ঞ।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য তিন জেলাতে যোগাযোগের উপযোগী রাস্তা ছিল ২ হাজার ৮০৩ কিলোমিটার, বর্তমানে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের তত্ত্বাবধানে নির্মিত সড়ক যোগাযোগের পরিধি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৯৪৯ কিলোমিটার।

শান্তিচুক্তির পূর্বে তিন জেলায় হাসপাতাল-ক্লিনিক ছিল মাত্র ২৪টি, এখন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও কমিউনিটি পর্যায়ে ক্লিনিক স্থাপিত হয়েছে ২৭০টির বেশি। যাত্রী ছাউনি ও ব্রীজ নির্মাণ করা হয়েছে ২০টি। সীমান্তসড়ক নির্মাণেও ভূমিকা রয়েছে তাদের। এর সবই সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধায়নে।

পাহাড়ি জনগোষ্ঠী এবং বাঙালিদের মাঝে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে সেনাবাহিনী নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকাগুলো ছিলো একসময় অরক্ষিত। বলা যায়, সন্ত্রাসী আর উগ্রবাদীদের অভয়ারণ্য। গোষ্ঠীগুলোর পরস্পরবিরোধী কার্যকলাপে প্রায়ই ঘটতো মৃত্যুর ঘটনা। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার প্রথমবার ক্ষমতায় আসে।

এরপরই সেখানে শান্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর। সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে কয়েক দফা সংলাপের পর অনুষ্ঠিত হয় পার্বত্য শান্তিচুক্তি। যা ইতিহাসে ঠাঁই করে নেয় সফলতার সঙ্গে।

এই চুক্তির পরপরই কমে আসে পাহাড়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। স্থানীয় সূত্র মতে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র এক শতাংশের বসবাস তিন পার্বত্য জেলায়। সেনাবাহিনী দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই যেন এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটেছে। তবে শান্তিচুক্তির পরও এখনও পাহাড়ে উগ্র উপজাতি গোষ্ঠী বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে তৎপর রয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি চার ভাগ হয়ে এখন প্রতিদিনই ঘটাচ্ছে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। তবে সেনাবাহিনীর কারণে সেখানে অনেক কমে আসছে এই ধরণের ঘটনা।

পাহাড়ে অনেক স্থান ছিলো অনুন্নত। পায়ে হেঁটে যাওয়ার কথা তো ভাবাই যায় না। অথচ সেনাবাহিনীর সদস্যরা পার্বত্যাঞ্চলে দিনরাত পরিশ্রম করে রাতারাতি সেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটিয়েছেন।

পাহাড়ে শান্তিকামী মানুষকে প্রায়শই বিচলিত দেখা যায়। উপজাতি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। লুটপাট করে। পর্যটক অপহরণ করে নিয়ে যায়। চাঁদাবাজি তো আছেই। এসব অপকর্ম থেকে পাহাড়ের মানুষকে শান্তিতে রাখতে দিনরাত অতন্দ্র প্রহরী হয়ে কাজ করছে সেনাবাহিনীর সদস্যরা।

স্থানীয় সূত্রমতে, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি এবং বান্দরবানে একাধিক উপজাতি সন্ত্রাসী সংগঠন রয়েছে। যাদের হাতে জিম্মি রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েক লাখ মানুষ।

শান্তিচুক্তির পরবর্তী সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) এবং ইউনাইটেড পিপল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এবং ওয়ান এলিভেন সরকারের পর এ দুইটি সংগঠন থেকে আরও দুইটি উপজাতি সশস্ত্র সংগঠন সৃষ্টি হয়ে তারা বিভিন্ন নাশকতা ও সন্ত্রাসীমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার মাধ্যমে চাঁদাবাজি, অপহরণের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায়, হামলা ও পাল্টা হামলার মাধ্যমে নিজেদের এলাকার নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব বিস্তারে সক্রিয় রয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য সরকার কয়েক হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। অথচ এসব উপজাতিগোষ্ঠী সেখানে উন্নয়ন কাজে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও ইউনাইটেড পিপল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট নামক উপজাতি সংগঠন মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হচ্ছে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা যখনই কোন ঘটনা ঘটার খবর পাচ্ছেন, সঙ্গে সঙ্গে সেখানে ছুটে যাচ্ছেন। তাদের কাছ থেকে নানা অভিযানে উদ্ধার করা হয়েছে রকেট লঞ্চার, ১৪-এমএম, এম-১৬, এসকে-৩২, সেনেভা-৮১, এম-৪ এবং এম-১ এর মতো ভয়াবহ অস্ত্র।

পার্বত্য এলাকা থেকে সেনাক্যাম্প অপসারণ না করার দাবি সেখানকার লাখো বাঙালির। এই দাবিতে একমত স্বয়ং পাহাড়িরাও। তারা বলেছেন, সেনাবাহিনীর তৎপরতার কারণে পাহাড়ের মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সুখী। কেননা পাহাড়ী-বাঙালি সবার জন্যই এই বাহিনীর সদস্যরা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে।

একটি সূত্র জানায়, বিভিন্ন খাত থেকে বছরে এসব সন্ত্রাসী গ্রুপের আয় ৫০০ কোটি টাকার বেশি। খাগড়াছড়িতে গত ২০ বছরে এমন সংঘাতে ৭শ’র বেশি খুন হয়েছে। এছাড়া রাঙামাটিতে গত ৫ বছরে মারা গেছে অন্তত ৪৫ জন।

২০১৭ সালের জুন মাসের ১২ তারিখ সোমবার রাত ১৩ তারিখ মঙ্গলবার ভোরে অতিবৃষ্টির ফলে রাঙামাটির বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে, সেখানে ব্যাপক প্রানহানি ও ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এদিন জেলার মানিকছড়িতে পাহাড় ধসে মাটি ও গাছ পড়ে চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি মহাসড়ক বন্ধ হয়ে যায়। তাৎক্ষণিকভাবে রাঙ্গামাটি জোন সদরের নির্দেশে মানিকছড়ি আর্মি ক্যাম্প থেকে সেনাবাহিনীর ১৬ জনের একটি দল ওই সড়কে চলাচল স্বাভাবিক করতে উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করে।

উদ্ধার কার্যক্রম চলাকালীন আনুমানিক বেলা ১১টায় পাশেই পাহাড়ের একটি বড় অংশ উদ্ধারকারীদলের সদস্যদের ওপর ধসে পড়ে। পাহাড় ধসের ফলে সেনবাহিনী সদস্যরা প্রায় ৩০ ফুট নিচে পড়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই মেজর মোহাম্মদ মাহফুজুল হক ও ক্যাপ্টেন মো. তানভীর সালাম শান্ত নিহত হয়েছেন। পরে এ ঘটনায় আরো ৩ সেনা সদস্যের লাশ উদ্ধার করা হয় এবং ১০ সেনা সদস্য গুরুতর আহত হন।

বাকি নিহতরা হলেন কর্পোরাল মোহাম্মদ আজিজুল হক ও সৈনিক মো. শাহিন আলম ও সৈনিক মোঃ আজিজুর রহমান। পাহাড় ধসে উদ্ধারের বিষয়ে হয়তো তাদের কোন প্রশিক্ষণ ছিল না, কিন্তু দেশের মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ানোকে নিজেদের কর্তব্য মনে করেই ওরা সেদিন এগিয়ে গিয়েছিল।

এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফেরাতে এসে আজ অবধি বহু সেনা সদস্য মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া হয়ে, সাপের কামড়ে কিংবা বন্য জন্তুর আক্রমনে নিহত হয়েছেন। কেউ কেউ আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন।

দেশমাতৃকার সেবায় নিয়োজিত সেনাবাহিনীর বেশকিছু সদস্য পাহাড়ের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে সশস্ত্র আঞ্চলিক সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন। বহু সেনা সদস্য আহত হয়েছেন।

সর্বোপরি, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় থেকে এ পর্যন্ত প্রতিনিয়ত সবসময়ে বাংলাদেশের মানুষ তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের আপদে/বিপদে সেনাবাহিনীর সদস্যদেরকে কোন না কোনভাবে নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে যেতে দেখা গেছে, এমন ঘটনা অসংখ্যবার ঘটেছে।

তারপরেও কাদের স্বার্থে, কাদের মদতে পাহাড়ে সন্ত্রাসবাদ চলছে? এই প্রশ্নে সঠিক উত্তর পাহাড়ে বসবাসকারী প্রতিটি মানুষকে জানতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে পাহাড়ে সন্ত্রাসবাদের নেপথ্য কারণ। এবং সম্মিলিতভাবে সন্ত্রাসের মূলোৎপাটন করে শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়নের পথে পার্বত্য চট্টগ্রামের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হবে আর সুদৃঢ় করতে হবে জাতীয় নিরাপত্তা।

আবুল খায়ের মোহাম্মদ, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম

মংডুতে মডেল ভিলেজ: গরু মেরে জুতা দান



প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশ ও মিয়ানমার রেহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের চূড়ান্ত তারিখ নির্ধারণ করেছিল ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর। সেটা কার্যকরী হয়নি। এরপর চীনের মধ্যস্থতায় ২০১৯ সালে ২২ আগস্ট প্রত্যাবাসনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করা হয়েছিল। কিন্তু মিয়ানমারের আন্তরিকতায় ঘাটতি অবলোকন ও রাখাইন রাজ্যের সামগ্রিক পরিবেশ নিয়ে রোহিঙ্গাদের আপত্তির কারণে প্রত্যাবাসন শুরু করা হয়ে উঠেনি। একটি সুষ্ঠু পরিবেশ ও আস্থার অভাব ফিরিয়ে আনতে দীর্ঘদিন অপেক্ষার পর বিষয়টি এক সময় আন্তর্জাতিক আদালতের ফাইলের প্রক্রিয়ায় গতি আনতে তাড়া দেয়। এত নড়েচড়ে উঠে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সব উইং। শুরু হয়ে যায় রাখাইনে উভয় দেশের প্রতিনিধি পাঠানোর মাধ্যমে মডেল ভিলেজের সার্বিক অবস্থা পরিদর্শনের কাজ।

প্রত্যাবাসনের সহায়ক পরিবেশ পরিস্থিতি আছে কি-না তা দেখার জন্য গত ৫ মে ২০২৩ নাফ নদীর ওপাড়ে বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য ঘুরে এসেছে বাংলাদেশের ২৭ সদস্যের প্রতিনিধি দল। রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলে ছিলেন ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) যিনি একজন যুগ্মসচিব, সঙ্গে ছিলেন টেকনাফের লেদা, শালবাগান ও জাদিমুরা আশ্রয়শিবিরের ২০ জন শরণার্থী। তাদের মধ্যে ৩ জন নারী সদস্যও ছিলেন। এই প্রতিনিধি দলকে সহায়তা করেছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিজিবি ও সরকারি বিভিন্ন সংস্থার আরো সাতজন।

প্রতিনিধি দলটি দিনভর মংডুতে ছিলেন। তাঁদেরকে রাখাইনের ট্রানজিট কেন্দ্র এবং মংডু শহরও ঘুরে দেখানো হয়েছে। মংডু শহরে ৮০ শতাংশ মুসলমান জনগোষ্ঠীর বসতি। শহর ছাড়াও তাঁরা কমপক্ষে ১৫টি গ্রাম ঘুরে দেখেছেন যেখানে মানুষ স্বাভাবিক অবস্থায় চলাফেরা করছে, রোহিঙ্গারা ব্যবসা বাণিজ্য করছে।

তবে প্রতিনিধিদলটির রেহিঙ্গা সদস্যরা টেকনাফে ফিরে অভিযোগ করেছেন, রাখাইনে প্রত্যাবাসন উপযোগী পরিবেশ ও পরিস্থিতি কোনটাই নেই। রোহিঙ্গারা তাদের যে পৈত্রিক ভিটা থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন সেটা একনজর দেখার জন্য তাদের মন-প্রাণ আকুল হয়েছিল। কিন্তু সেখানে গিয়ে তাঁরা তাদের নিজ জন্মভিটার কোন নিদর্শন খুঁজে পাননি। তাদের ভিটায় গড়ে তোলা হয়েছে নতুন সেনা ব্যারাক, পুলিশ ফাঁড়ি, সীমান্ত চৌকি ইত্যাদি। রাস্তার দুপাশে আগে যেসব সুন্দর গ্রাম ছিল এখন সেসবের কোন চিহ্ন নাই। প্রতিনিধিদলের সদস্য মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার মতো পরিবেশ ও পরিস্থিতি কোনটাই নেই। বাংলাদেশে থেকে ফিরে আবার আশ্রয় শিবিরে কেন রোহিঙ্গারা থাকবে?’

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য যেখানে ‘মডেল ভিলেজ’ নির্মাণ করা হয়েছে সেগুলো আরসিসি খুঁটির উপর। মংডু শহর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে সেসব ভিলেজ নির্মাণ করা হয়েছে। মংডুর জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন রাখাইনে ফেরার পর রোহিঙ্গাদেরকে প্রথমে ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন সার্টিফিকেট (এনভিসি) দেয়া হবে। এরপর যাচাই করে পর্যাক্রমে এনআইডি দেয়া হবে। তাদের প্রত্যেককে কৃষি আবাদ করার জন্য এক একর করে জমি প্রদান করা হবে।

কিন্তু রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের সদস্য আবু সুফিয়ান ও গোলবাহার বলেছেন, ‘রোহিঙ্গাদেরকে নাগরিকত্ব প্রদানের পাশাপাশি নিজ জন্মভিটায় পুনর্বাসন করতে হবে। মডেল ভিলেজের মতো আশ্রয়শিবিরে কোন রোহিঙ্গা থাকতে রাজি হবে না।’ পরিদর্শনে গিয়ে নিজের বাড়িঘর দেখতে না পেরে মোটেও শান্তি লাগেনি বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন তারা। টেকনাফে ফিরে এসে রোহিঙ্গারা সাংবাদিকের নিকট তাদের নিজের জন্মস্থানের চিহ্ন দেখতে না পওয়ায় চরম অসন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন।

মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে মাত্র এক হাজার ৮৭ জন রোহিঙ্গার জন্য মডেল ভিলেজ নির্মাণ করেছেন বলে জানা গেছে। এই নির্মাণে আর্থিক সহায়তা দান করেছে চীন, জাপান ও ভারত। পরে আরো কিছু দেশ এই প্রকল্পে সহায়তা করতে পারে।

তবে প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া শুরু হবার পর এই ‘মডেল ভিলেজ’ প্রকল্প কেন মাথায় আনা হয়েছে তা অনেকের কাছে বিস্ময়ের ব্যাপার। কারণ, ২০১৭ সাল থেকে দশ লক্ষের অধিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া হয়েছে। গত প্রায় সাড়ে পাঁচ বছরে বাংলাদেশের বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে তাদের সংখ্যা বেড়ে সাড়ে বার লক্ষ পেরিয়ে গেছে। এতদিন পর এতগুলো উদ্বাস্তু মানুষকে ফিরিয়ে নেবার যে আগ্রহ মিয়ানমার দেখাচ্ছে সেটা এই ধীরগতিতে মডেল ভিলেজ বানিয়ে বাস্তবায়ন করতে হলে আগামী কয়েক যুগ লাগতে পারে। সেটা নির্ভর করবে দাতা দেশগুলোর বদান্যতার অগ্রগতির উপর। কারণ, মিয়ানমার নিজ ইচ্ছায় ও অর্থায়নে মডেল ভিলেজ তৈরি করে প্রত্যাবাসন করাতে ততটা আগ্রহী নয় বলে মনে করা হচ্ছে।

রাখাইন রাজ্যের মংডু এলাকায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট জনগণের বসতি। রোহিঙ্গারা সেখানে বসবাস করতে বেশি ভালবাসেন। কিন্তু মংডুতে বড় বড় সরকারি স্থাপনা তৈরি করে রোহিঙ্গা বসতি এলাকা সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে। বার লক্ষ শরণার্থীকে ফেরত নিয়ে মডেল ভিলেজ তৈরি করে জায়গা দিতে হলে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও সমতল জমি প্রয়োজন। প্রতিটি পরিবারকে এক একর আবাদী জমি বন্টন করে দিতে হলে বার লক্ষ একর আবাদী জমির প্রয়োজন। সেগুলো তাদের পরিকল্পনায় অর্ন্তভুক্ত করে মডেল ভিলেজ তৈরি করা হচ্ছে কি-না তা স্পষ্ট নয়। কতটি বসতি কোন ডোনার সংস্থা বা দেশের অর্থায়নে কতদিনে মডেল গ্রামে রুপান্তরিত হবে তা নিয়ে অনেকে হিসেব মেলাতে দুশ্চিন্তা করছেন।

অনেকে ভাবছেন মিয়নমারের বৈদেশিক সাহায্য নির্ভর এত বিশাল প্রকল্পের বস্তবায়নে ধীরগতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে প্রক্রিয়াকে যে কোন সময় থমকে দিতে পারে। মিয়ানমার হঠাৎ আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে এবং আন্তর্জাতিক আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে যে নমনীয়তা প্রদর্শন শুরু করেছে সেটার স্থায়ীত্ব কতটুকু হবে তা এখনই বোঝা মুস্কিল।

যেমন, আমাদের দেশে ভূমিহীনদের জন্য নির্মিত আবাসন প্রকল্পে শুধু ঘর দেয়া হচ্ছে। তারা ঘর পেয়ে আপাতত: খুশি। কিন্তু গ্রামীণ জীবনে হাঁস, মুর্গী, গাভী, ছাগল-ভেড়া ইত্যাদি পালন করে বহু ভূমিহীন মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। তাই আবাসনের ঘর পেয়ে সেখানে ঘুমানোর পর তাদেরকে গবাদি পশু পালনের জন্য দূর-দূরান্তে খোলা খাস জায়গা, নদী তীর, চর ইতাদিতে যেতে হয়। যারা ক্ষুদ্র আবাসনের মধ্যে বদ্ধ জায়গায় হাঁস, মুর্গী, গাভী, ছাগল পালন করতে শুরু করেছেন তাদের প্রতিবিশীদের মধ্যে এসব নিয়ে ঝগড়াঝাটি করে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কারণ, মানুষ বসতে দিলে শুতে চায়। খেতে দিলে জীবনের প্রয়োজনে একটু আরাম করে শুয়ে ঘুমাতে চায়। এটাই সব মানুষের চাওয়া-পাওয়ার স্বাভাবিক স্বভাব। মংডুর মডেল ভিলেজ নিয়ে একই ধরণের সমস্যার উদ্রেক হবার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এ ছাড়া যেসব রোহিঙ্গার পৈত্রিক ভিটায় বাড়ি, জমি, পুকুর, বাগান-বিলাস ইত্যাদি ছিল তারা কখনই মডেল ভিলেজের খুপরি ঘরে বসতি গড়তে আগ্রহী হতে চাইবে না। তাদের জীবনের স্বাধীনতা নিজস্ব অতীত ঐতিহ্য ও বড় ভাবনার নিপতিত হয়ে আছে। সেটাকে মডেল ভিলেজের বদ্ধ পরিবেশে বন্দী করে ফেলা খুব সহজ কাজ নয়।

রোহিঙ্গাদের আদি নিবাস গুঁড়িয়ে দেবার ফলে মনের মধ্যে যে ক্ষোভ সঞ্চিত হচ্ছে তা যে কোন সময় ফুঁসে উঠতে পারে। যেটা তাদেরকে সামরিক জান্তার মুখোমখি দাঁড় করিয়ে ভবিষ্যতে আবারো নৃশংস গণহত্যার মুখে ঠেলে দিতে পারে। শুরুতেই তাদেরকে এনআইডি না দেয়ায় নিজ দেশে পরবাসী হবার হতাশাকে উস্কে দিতে পারে।

নিজের ভিটায় নিজের পৈত্রিক নিবাস ধ্বংস করে মডেল ভিলেজের মাধ্যমে আবারো ক্যাম্পের জীবনে ফিরে যাওয়াকে তারা মনে প্রাণে মেনে নিতে পারছে না বলে প্রতিনিধি দলের পরিদর্শণ থেকে ফিরে অসন্তুষ্টির প্রকাশের মাধ্যমে সেটা হয়ে স্পষ্ট হয়ে গেছে। এটাকে তারা নিজেরে আত্মমর্যাদার পরিপন্থী হিসেবে মনে করছেন। তাই এটাকে তারা ভালভাবে গ্রহণ না করে ‘গরু মেরে জুতা দান’ মনে করছেন। নিজ দেশে ফিরে আবারো পরবসীর মতো বেঁচে থাকতে আগ্রহী নন তারা।

এছাড়া মংডু এলাকার বাইরে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা কম বা না থাকায় মডেল ভিলেজ প্রকল্পে অবশ্যই ধরিগতি বা অসাড়তা তৈরি হয়ে যেতে পারে যে কোন সময়। এজন্য মিয়ানমারের উচিত শুধু মডেল ভিলেজ প্রকল্পের উপর জোর না দিয়ে রোহিঙ্গাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ বা সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে শিক্ষা, কর্মদক্ষতা ও পারিবিারিক ঐতিহ্যকে যাচাই করে ক্যাটাগরি করা উচিত। এর মাধ্যমে নিজ নিজ পৈত্রিক ভিটায় বা আবাসে অতি দ্রুত ফেরার নিশ্চয়তা দেবার ব্যবস্থা করা উচিত। আর যাদের রাখাইনে তেমন কিছু বিত্ত-বৈভব ছিল না শুধু তাদেরকে আমাদের দেশের আবাসন প্রকল্পের মতো মডেল ভিলেজের ঘর বরাদ্দ দিলে তাদের অসস্তুষ্টি কম হবে। এভাবে সকল রোহিঙ্গা শরণার্থীর মধ্যে একটি মানসিক শান্তির আবেশ জাগিয়ে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে জোরদার করতে পারলে বিষয়টির ক্ষোভ নিষ্পত্তি সহজ হবে এবং বার লক্ষ উদ্বাস্তুকে দ্রুত ফিরিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করা সহজ হবে বলে মনে করা যায়।

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

 

;

তীব্র তাপপ্রবাহের কারণ ও করণীয়



মো. বজলুর রশিদ
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

তীব্র প্রবাহকে ব্যতিক্রমীভাবে তাপ তরঙ্গের উচ্চ তাপমাত্রা এবং দীর্ঘায়িত সময়কাল দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। এটি একটি বর্ধিত সময়ের জন্য স্থায়ী হতে পারে, প্রায়ই এক সপ্তাহ বা তার বেশি। টেকসই চরম তাপের কারণে তীব্র তাপ তরঙ্গ প্রায়শই মানব স্বাস্থ্য, কৃষি এবং অবকাঠামোর উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে।

বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের মতো বাংলাদেশ এখন ঘন ঘন তীব্র বা চরম তাপপ্রবাহের সম্মুখীন হচ্ছে। বাংলাদেশে তীব্র বা চরম তাপপ্রবাহ সংঘটিত হওয়ার পেছনে অবদান রাখতে পারে এমন কিছু কারণ রয়েছে।

বিশ্বব্যাপী চরম তাপপ্রবাহের প্রাথমিক চালক হল জলবায়ু পরিবর্তন। ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক তাপমাত্রা, বর্ধিত গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের ফলে, আরও ঘন ঘন এবং তীব্র তাপ প্রবাহে অবদান রাখে। বাংলাদেশ, একটি জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হওয়ায়, চরম উত্তাপের ঘটনা সহ উষ্ণায়ন জলবায়ুর প্রভাব অনুভব করে।

বাংলাদেশে স্বতন্ত্র ঋতু পরিবর্তন রয়েছে এবং নির্দিষ্ট আবহাওয়ার ধরণ তীব্র তাপপ্রবাহে অবদান রাখতে পারে। গ্রীষ্মের মাসগুলিতে, উচ্চ বায়ুমণ্ডলীয় চাপ, মেঘের আচ্ছাদন হ্রাস এবং সীমিত বৃষ্টিপাতের মতো পরিস্থিতি গরম এবং শুষ্ক আবহাওয়া তৈরি করতে পারে, যা চরম তাপ ঘটনার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলতে পারে।

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানও তীব্র তাপপ্রবাহে ভূমিকা রাখতে পারে। দেশটি ভারত মহাসাগর এবং বঙ্গোপসাগর দ্বারা প্রভাবিত একটি অঞ্চলে অবস্থিত। বৃহৎ জলাশয়ের সান্নিধ্যের ফলে উচ্চ আর্দ্রতার মাত্রা হতে পারে, যা অস্বস্তি বাড়ায় এবং চরম তাপের সাথে যুক্ত স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়ায়।

বাংলাদেশের শহুরে এলাকা, যেমন শহর এবং ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল, শহুরে তাপ দ্বীপের প্রভাব অনুভব করে। কংক্রিট কাঠামো, অ্যাসফাল্ট এবং সীমিত সবুজ স্থানের উপস্থিতি সহ নগরায়ন তাপ শোষণ এবং ধরে রাখার দিকে নিয়ে যায়। এই প্রভাবটি শহরাঞ্চলে তাপ তরঙ্গকে তীব্র করতে পারে, যা আশেপাশের গ্রামীণ অঞ্চলের তুলনায় তাদের আরও গরম করে তোলে।

এল নিনো-সাউদার্ন অসিলেশন (ENSO) হল একটি প্রাকৃতিক জলবায়ুর ঘটনা যা বিশ্বব্যাপী আবহাওয়ার ধরণকে প্রভাবিত করতে পারে। এল নিনোর ঘটনার সময়, যা প্রতি কয়েক বছরে অনিয়মিতভাবে ঘটে, নিরক্ষীয় প্রশান্ত মহাসাগরে সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়, যা বিশ্বব্যাপী আবহাওয়ার ধরণকে প্রভাবিত করে। এল নিনো বাংলাদেশে শুষ্ক এবং উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে অবদান রাখতে পারে, সম্ভাব্য তাপ তরঙ্গের তীব্রতা বৃদ্ধি করতে পারে।

এটি লক্ষ করা গুরুত্বপূর্ণ যে এই কারণগুলি একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতে পারে এবং তীব্র বা চরম তাপ তরঙ্গের নির্দিষ্ট কারণ এবং বৈশিষ্ট্যগুলি ঘটনা থেকে ইভেন্টে পরিবর্তিত হতে পারে। তীব্র তাপ তরঙ্গের কারণ এবং অবদানকারী কারণগুলি বোঝা তাদের প্রভাবগুলি প্রশমিত করার জন্য কার্যকর কৌশলগুলি তৈরি করার জন্য এবং বাংলাদেশে চরম তাপের স্থিতিস্থাপকতা বাড়ানোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

চরম তাপ মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য উল্লেখযোগ্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এটি তাপ ক্লান্তি, হিটস্ট্রোক, ডিহাইড্রেশন এবং অন্যান্য তাপ-সম্পর্কিত অসুস্থতার কারণ হতে পারে। দুর্বল জনসংখ্যা, যেমন বয়স্ক, শিশু এবং প্রাক-বিদ্যমান স্বাস্থ্য অবস্থার ব্যক্তিরা বিশেষভাবে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তাপ তরঙ্গের সময় স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবা এবং সংস্থানগুলির বর্ধিত চাহিদা স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে চাপ দিতে পারে।

তীব্র তাপপ্রবাহ কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। উচ্চ তাপমাত্রা, সীমিত বৃষ্টিপাত এবং খরা পরিস্থিতির সাথে মিলিত হওয়ার ফলে ফসলের ফলন কমে যেতে পারে, শুকিয়ে যেতে পারে এবং এমনকি ফসল নষ্ট হতে পারে। গবাদি পশুর উপর তাপের চাপ তাদের স্বাস্থ্য ও উৎপাদনশীলতাকেও প্রভাবিত করতে পারে।

তাপপ্রবাহ বাংলাদেশে পানির ঘাটতির সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। উচ্চ তাপমাত্রা বাষ্পীভবনের হার বাড়িয়ে দেয়, যার ফলে পানির প্রাপ্যতা কমে যায়, বিশেষ করে নদী, হ্রদ এবং জলাশয়ে। এটি কৃষির জন্য সেচ, বিশুদ্ধ পানীয় জলের অ্যাক্সেস এবং জলবিদ্যুৎ উৎপাদনকে প্রভাবিত করতে পারে।

তীব্র তাপ তরঙ্গ প্রায়শই শীতল করার উদ্দেশ্যে, বিশেষত এয়ার কন্ডিশনার জন্য শক্তির চাহিদা বৃদ্ধি করে। এই বর্ধিত চাহিদা বিদ্যুৎ সরবরাহে চাপ সৃষ্টি করতে পারে এবং বিদ্যুৎ বিভ্রাট বা লোডশেডিং হতে পারে যদি শক্তির পরিকাঠামো উচ্চতর লোডের সাথে মানিয়ে নিতে না পারে।

বাংলাদেশের শহুরে অঞ্চলগুলি, উচ্চ জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং কংক্রিট অবকাঠামো দ্বারা চিহ্নিত, তীব্র তাপ তরঙ্গের সময় শহুরে তাপ দ্বীপের প্রভাব অনুভব করতে পারে। সবুজ স্থানের অভাব এবং তাপ-শোষণকারী পৃষ্ঠের প্রাচুর্য শহুরে তাপ দ্বীপের প্রভাবকে তীব্র করে তুলতে পারে, শহরগুলিকে আশেপাশের গ্রামীণ এলাকার তুলনায় আরও গরম করে তোলে এবং মানুষের স্বাস্থ্য এবং আরামের উপর প্রভাবকে বাড়িয়ে তোলে।

তীব্র বা চরম তাপ তরঙ্গের প্রভাব মোকাবিলা করার জন্য, তাপ তরঙ্গ প্রস্তুতি এবং প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনা, জনসচেতনতা প্রচার, প্রাথমিক সতর্কতা ব্যবস্থা, শীতল কেন্দ্র স্থাপন, শহুরে তাপ দ্বীপের প্রভাব প্রশমিত করার জন্য নগর পরিকল্পনার উন্নতির মতো পদক্ষেপগুলি বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।জলবায়ু-স্থিতিস্থাপক কৃষি অনুশীলনের উন্নয়ন করা।

গরম আবহাওয়ায় হাইড্রেটেড থাকার জন্য প্রচুর পানি এবং তরল পান করুন। ক্যাফিনযুক্ত বা অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় এড়িয়ে চলুন কারণ তারা ডিহাইড্রেশনে অবদান রাখতে পারে।

দিনের উষ্ণতম সময়ে, সাধারণত দুপুর থেকে শুরু করে বিকাল পর্যন্ত বাড়ির ভিতরে বা ছায়াযুক্ত এলাকায় থাকুন। বাড়িতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা না থাকলে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পাবলিক স্পেস যেমন শপিং মল, লাইব্রেরি বা কমিউনিটি সেন্টারে যাওয়ার কথা বিবেচনা করুন। গ্রামাঞ্চলে গাছ বা ছায়া ঘেরা জায়গায় অবস্থান করুন।

বসার জায়গা ঠান্ডা করতে ফ্যান বা পোর্টেবল এয়ার কন্ডিশনার ইউনিট ব্যবহার করুন। সরাসরি সূর্যালোক আটকাতে দিনের বেলা পর্দা বা খড়খড়ি বন্ধ করুন। আপনার শরীরের তাপমাত্রা কমাতে ঠান্ডা ঝরনা বা গোসল করুন।

হালকা ওজনের, ঢিলেঢালা ফিটিং এবং হালকা রঙের পোশাক পরুন যা আপনার শরীরকে শ্বাস নিতে দেয় এবং তাপ অপচয়ে সাহায্য করে। রোদ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে টুপি, সানগ্লাস এবং সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন।

দুর্বল ব্যক্তিদের উপর নজর রাখুন, যেমন বয়স্ক, শিশু এবং যারা আগে থেকে বিদ্যমান স্বাস্থ্যগত অবস্থার সাথে। সহায়তা অফার করুন এবং নিশ্চিত করুন যে তারা শীতল এবং হাইড্রেটেড রয়েছে।

চরম তাপ তরঙ্গের সময়, বিশেষ করে দিনের উষ্ণতম অংশগুলিতে কঠোর বহিরাঙ্গন ক্রিয়াকলাপগুলি হ্রাস করুন। আপনার যদি বহিরাঙ্গন ক্রিয়াকলাপগুলিতে জড়িত হওয়ার প্রয়োজন হয়, তাপমাত্রা শীতল হলে সকালের বা শেষ সন্ধ্যার জন্য সেগুলি নির্ধারণ করুন।

পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং প্রতিবেশীদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ বজায় রাখুন যাতে তাদের সুস্থতা সম্পর্কে জানা যায় এবং তাপ তরঙ্গ নিরাপত্তা সম্পর্কে তথ্য শেয়ার করা যায়।

তাপ তরঙ্গের সময় ত্রাণ এবং সহায়তা প্রদান করে এমন সম্প্রদায়ের উদ্যোগে অংশ নিন বা সমর্থন করুন, যেমন শীতলকরণ কেন্দ্র স্থাপন বা প্রয়োজনে জল বিতরণ করা।

তাপ প্রবাহের অন্তর্নিহিত কারণগুলিকে মোকাবিলা করার জন্য জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন এবং অভিযোজন ব্যবস্থাগুলির জন্য অ্রাডভোকেসি কার্যক্রম জোরদার করতে হবে৷ পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি, শক্তি দক্ষতা, এবং টেকসই নগর পরিকল্পনা গ্রহণ করে এমন উদ্যোগগুলিকে সমর্থন করুন।

মনে রাখবেন, এই পরামর্শগুলি সাধারণ নির্দেশিকা। বাংলাদেশের তাপপ্রবাহ পরিস্থিতির জন্য নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের স্থানীয় সুপারিশ এবং নির্দেশনা অনুসরণ করা গুরুত্বপূর্ণ।

মো. বজলুর রশিদ: সহকারী অধ্যাপক, সমাজ বিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।

;

জীবন ও পরিবেশ রক্ষার্থে প্লাস্টিক দূষণ রুখতে হবে



ড. মতিউর রহমান
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ইউনাইটেড নেশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউএনইপি) কর্তৃক প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ৪০০ মিলিয়ন টনেরও বেশি প্লাস্টিক উৎপাদিত হয়, যার অর্ধেক শুধুমাত্র একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়। উৎপাদিত প্লাস্টিকের ১০ শতাংশেরও কম পুনর্ব্যবহারযোগ্য। বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক পণ্যের তিন-চতুর্থাংশ ল্যান্ডফিল বা প্রাকৃতিক পরিবেশে জমা হয়। সারা বিশ্বে বছরে আনুমানিক ১৯-২৩ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য হ্রদ, নদী, সাগর এবং সমুদ্রে মিশে যায়, যা প্রায় ২,২০০টি আইফেল টাওয়ারের ওজনের সমান। উল্লেখ্য যে, আইফেল টাওয়ারের মোট ওজন ১০,১০০ টন।

এমনই এক প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির উদ্যোগে এ বছর সারা বিশ্বে উদযাপিত হচ্ছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস। নেদারল্যান্ডের সহায়তায় পশ্চিম আফ্রিকার দেশ আইভরি কোস্ট এ বছর দিবসটির আয়োজক দেশ হিসাবে নির্বাচিত হয়েছে। এ বছর দিবসটির থিম বা প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে “Solutions to Plastic Pollution”। আর স্লোগান ঠিক করা হয়েছে “Beat Plastic Pollution”। বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক বাংলায় নির্ধারিত প্রতিপাদ্যহলো “প্লাস্টিক দূষণের সমাধানে সামিল হই সকলে” আর স্লোগান হলো “ সবাই মিলে করি পণ, বন্ধ হবে প্লাস্টিক দূষণ”।

এখানে উল্লেখ্য যে, এ বছরই বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদযাপনের পঞ্চাশ বছর পূর্তি হয়েছে। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (UNEP)এর নেতৃত্বে ১৯৭৩ সাল থেকে প্রতি বছর ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদযাপিত হয়ে আসছে। বিশ্ব পরিবেশ দিবসে, ব্যক্তি, সম্প্রদায় এবং সরকারকে পরিবেশগত উদ্যোগে সম্পৃক্ত করার জন্য বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন কার্যক্রম এবং অনুষ্ঠান হয়। কিছু সাধারণ কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে বৃক্ষ রোপণ অভিযান, পরিচ্ছন্নতা অভিযান, শিক্ষামূলক কর্মসূচি, পরিবেশগত প্রদর্শনী, এবং টেকসই অনুশীলনের বিষয়ে সেমিনার। এই ক্রিয়াকলাপগুলির লক্ষ্য পরিবেশ সংরক্ষণ, দূষণ কমানো, টেকসই জীবনযাত্রার প্রচার এবং পরিবেশগত সমস্যাগুলোর সমাধানে সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানদের চাপ প্রয়োগ এবং সচেতনতা বাড়াতে ব্যক্তি ও সংস্থাকে পদক্ষেপ নিতে অনুপ্রাণিত করা।

আলেকজান্ডার পার্কস ১৮৫৫ সালে প্রথম মানবসৃষ্ট প্লাস্টিক আবিষ্কার করেন এবং এর নাম দেন পার্কসিন। এটি নাইট্রিক অ্যাসিডের সাথে উদ্ভিদ সেলুলোজ বিক্রিয়া করে তৈরি করা হয়েছিল। ১৯০৭ সালে, লিও বেকেল্যান্ড একটি সম্পূর্ণ সিন্থেটিক প্লাস্টিক আবিষ্কার করেন এবং এর নাম দেন বেকেলাইট। তিনিই প্রথম প্লাস্টিক শব্দটি ব্যবহার করেন। ক্রম বির্বতনের ধারায় প্লাস্টিকের বহু রূপ ও ধরন আজ আমাদের নিত্য সঙ্গী।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্লাস্টিক হল মনুষ্যসৃষ্ট পলিমার, যা মূলত রাসায়নিকভাবে জীবাশ্ম জ্বালানি বা প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে তৈরি হয়। প্লাস্টিক সাধারণত নমনীয়, ক্ষয় প্রতিরোধী, টেকসই এবং সস্তা। মাটি, পানি, বায়ুমণ্ডল, বন্যপ্রাণী, জীববৈচিত্র্য এবং মানব স্বাস্থ্যের উপর দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব ফেলে বিধায় একে সাধারণত প্লাস্টিক দূষণ বলা হয়।

প্লাস্টিক আমাদের দৈনন্দিন জীবন যাপনের একটি অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। বিশ্বে মানুষ প্রতি মিনিটে প্রায় এক মিলিয়ন প্লাস্টিকের বোতল ক্রয় করে এবং প্রতি ঘন্টায় এক বিলিয়ন প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার করে । স্বল্প খরচ, স্থায়িত্ব, প্রক্রিয়াকরণের সহজতা, হালকা ওজন এবং উচ্চ তাপ ও বৈদ্যুতিক নিরোধক প্লাস্টিককে ব্যক্তি এবং বিপুল সংখ্যক শিল্প খাতের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। প্লাস্টিকের অসংখ্য সামাজিক সুবিধা অনস্বীকার্য হওয়া সত্ত্বেও, এটি আমাদের পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্লাস্টিক বর্জ্য দ্রুত বাড়ছে এবং পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছে। এটি ইতিমধ্যে বাস্তুতন্ত্র, মানব সম্প্রদায়, প্রানীকুল এবং পৃথিবীর জলবায়ু ব্যবস্থাকে একটি গুরুতর হুমকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।

ইউরোপ্লাস এর তথ্য অনুযায়ী, প্লাস্টিক বেশিরভাগই "পলিমারাইজেশন বা পলিকনডেনসেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেলুলোজ, কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস, লবণ এবং অপরিশোধিত তেলের মতো প্রাকৃতিক উপকরণ থেকে" তৈরি করা হয়। প্লাস্টিক বর্জ্যগুলি পচতে দীর্ঘ সময় নেয় কারণ পণ্যগুলিতে ব্যবহৃত উপাদানগুলি আমাদের পরিবেশে বিদ্যমান নেই, এবং প্রাকৃতিকভাবে এমন কোন জীবানু কণা নেই যা তাদের কার্যকরভাবে নষ্ট করে ফেলতে পারে। প্লাস্টিক পণ্যগুলি নষ্টের সময় তাদের ধরন এবং গাঠনিক অবস্থা বিবেচনা করে আলাদা হতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ, একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ ১০ থেকে ১,০০০ বছরের মধ্যে পচে যেতে পারে। আবার একটি প্লাস্টিকের বোতল যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ, এটি ক্ষয় হতে ৪৫০ বছর পর্যন্ত সময় নিতে পারে । অপরিশোধিত প্লাস্টিক বর্জ্য আমাদের পরিবেশে বিষাক্ত পদার্থ যোগ করে এবং মানুষের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে, বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস করে এবং বন্যপ্রাণীর ক্ষতি করে।

স্তূপ করা প্লাস্টিক বর্জ্য খুবই উদ্বেগজনক কারণ এটি মারাত্মক পরিবেশগত পরিণতি সৃষ্টি করতে পারে। যখন সূর্য এবং এর তাপের সংস্পর্শে আসে, তখন এগুলি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত করতে পারে। এটি অবশ্যই ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে অবদান রাখে যা ইথিলিন এবং মিথেনসহ আরও ক্ষতিকারক গ্যাস তৈরিতে সহায়তা করে যা তাপমাত্রাকে আরও বেশি বৃদ্ধি করে ধ্বংসের একটি দুঃস্বপ্নের চক্র তৈরি করে।

সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল ল, ২০১৯ এর তথ্য অনুযায়ী প্লাস্টিক আমাদের পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলীয় অবস্থাকেও প্রভাবিত করছে। মোট প্লাস্টিক পণ্যের প্রায় ৯৮ শতাংশ জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে উৎপাদিত হয় যা গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন করে, যা বিশ্বব্যাপী জলবায়ু সংকটের একটি প্রধান কারণ। অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) জানিয়েছে যে বর্তমানে বিশ্বের কার্বন বাজেটের ৩.৪ শতাংশ প্লাস্টিক রয়েছে এবং আগামী বিশ বছরে তা পাঁচগুণ বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।

প্লাস্টিক বর্জ্য পোড়ানোর ফলে ২০১৯ সালে বায়ুমণ্ডলে ৮.৫ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইড যোগ হয়েছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর ১০ থেকে ১৩ শতাংশ ঘটছে প্লাস্টিক বর্জ্য পোড়ানোর কারণে । ২০২২ সালে পরিচালিত এক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে ভেসে যেতে পারে এবং মেঘের গঠনকে প্রভাবিত করতে পারে এবং তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত এবং এমনকি দীর্ঘমেয়াদী জলবায়ু পরিবর্তনকে প্রভাবিত করতে পারে।

সামুদ্রিক পরিবেশ প্লাস্টিক দূষণের সবচেয়ে বড় শিকার। প্লাস্টিক দূষণের ফলে প্রতি বছর ১ মিলিয়ন সামুদ্রিক পাখি এবং ১০০,০০০ সামুদ্রিক প্রাণী মারা যায়। বিজ্ঞানীরা হিসাব করেছেন যে বর্তমানে সমুদ্রে ৫.২৫ ট্রিলিয়ন মাইক্রো এবং ম্যাক্রো প্লাস্টিক কণা জমা রয়েছে। প্রতি বর্গমাইল সমুদ্রে প্লাস্টিকের ৪৬,০০০ কণা জমা হয়েছে। সাগরে জমে থাকা প্লাস্টিকের মোট ওজন দুই লাখ ৬৯ হাজার টন। প্রতিদিন ৮ মিলিয়ন টুকরো প্লাস্টিক বর্জ্য সাগরে জমা হচ্ছে। এভাবে সাগরে প্লাস্টিক বর্জ্যের বিশাল অংশ জমেছে।

বর্তমানে, প্রশান্ত মহাসাগরে প্লাস্টিক বর্জ্য প্যাচ প্রায় ১.৬ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার। প্লাস্টিক বর্জ্যের অনুরূপ জমা অন্যান্য মহাসাগর ও সাগরেও তৈরি হয়েছে। শুধু সমুদ্রের তলদেশই নয়, ভূপৃষ্ঠের সমুদ্রের পানির কমবেশি ৮৮ শতাংশ প্লাস্টিক দূষণে দূষিত। প্লাস্টিক বর্জ্যে সবচেয়ে মারাত্মক দূষণ ঘটাচ্ছে প্লাস্টিক ব্যাগ বা পলিথিন ব্যাগ। প্রতি মিনিটে আমরা ১ মিলিয়ন প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহারের পরে ফেলে দিই। প্রতি বছর আমরা অজান্তে সমুদ্র সৈকতে ৮.৩ বিলিয়ন প্লাস্টিকের ব্যাগ এবং প্লাস্টিকের টুকরো নিক্ষেপ করি। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, ২০২৫ সালের মধ্যে সমুদ্রে প্লাস্টিক পণ্য ও কণার সংখ্যা মাছের সংখ্যার চেয়েও বেশি হবে। বর্তমানে সাগরে ধরা পড়া প্রতি তিনটি মাছের মধ্যে একটির পেটে প্লাস্টিক রয়েছে। প্লাস্টিক পণ্যে মাইক্রোবিড থাকে, যা সহজেই পরিবেশকে দূষিত করতে পারে।

বাংলাদেশে প্লাস্টিক উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং শিল্পটি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। প্লাস্টিক হল বিদেশী রপ্তানি বাণিজ্য থেকে আয়ের ১২তম সর্বোচ্চ উৎস এবং আমাদের তৈরি পোশাক সেক্টর, স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বয়ংচালিত শিল্পে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে ৫,০০০ প্লাস্টিক তৈরি কারখানা রয়েছে এবং এর মধ্যে ৯৮ শতাংশই ছোট ও মাঝারি কারখানা। এসব কারখানায় প্রায় ১২ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। বাংলাদেশের প্লাস্টিক পণ্য স্থানীয় ও বৈশ্বিক উভয় বাজারে সময়ের সাথে সাথে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এবং প্লাস্টিক উৎপাদনের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ প্লাস্টিক রপ্তানি থেকে বাংলাদেশ ১১৫.১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করবে বলে আশা করছে।

বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলছে, গত ১৫ বছরে, বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহার ২০০৫ সালে ৩ কেজি থেকে তিনগুণ বেড়ে ২০২০ সালে ৯ কেজি হয়েছে। শুধু ঢাকাতেই বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহার ২২.২৫ কেজি হয়েছে। সংখ্যাটি শহরাঞ্চলের জাতীয় গড়ের তিনগুণ বেশি। ঢাকায় ২০০৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে দৈনিক প্লাস্টিক বর্জ্য ১৭৮ টন থেকে ৬৪৬ টন পর্যন্ত বেড়েছে। ঢাকার প্লাস্টিক বর্জ্যের মাত্র ৩৭.২ শতাংশ রিসাইকেল করা হয়।

বাংলাদেশে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চিত্র হতাশাজনক। বিশ্বব্যাংকের ২০২১ সালের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, অপর্যাপ্ত প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণে প্লাস্টিক দূষণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলির মধ্যে একটি। লাইটক্যাসল পার্টনার্সের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্লাস্টিক বর্জ্যের অব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দশম স্থানে রয়েছে। কভিড-১৯ মহামারী প্লাস্টিক দূষণকে আরও খারাপ করেছে।

যদিও বাংলাদেশে মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার অন্যান্য অনেক উন্নয়নশীল এবং প্রতিবেশী দেশের তুলনায় কম, তবে প্লাস্টিক বর্জ্যের অব্যবস্থাপনা এমন একটি সমস্যা যা আমাদের দেশকে বৈশ্বিক অবস্থানে দশম স্থান দিয়েছে । বিশ্বব্যাপী অব্যবস্থাপিত প্লাস্টিক বর্জ্যের ২.৪ শতাংশের জন্য বাংলাদেশ দায়ী।

টেকসই প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশে একটি ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ যা আমাদের সামগ্রিক বৃদ্ধি ও উন্নয়নকে চ্যালেঞ্জ করছে। দেশে প্রতিদিন প্রায় ৩,০০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হচ্ছে এবং শুধুমাত্র ঢাকা শহরে একই সময়ে প্রায় ১৪ মিলিয়ন পিস পলিথিন ব্যাগ ব্যবহৃত হয়। ব্যবহৃত প্লাস্টিক পণ্যগুলির বেশিরভাগই তাদের প্রথম ব্যবহারের পরে ফেলে দেওয়া হয় এবং ভুল বা অব্যবস্থাপনার কারণে সেগুলি রাস্তা, ড্রেন, খাল, নদী এবং রাস্তার পাশের খোলা জায়গায় অপরিশোধিত থেকে যায়।

বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক ব-দ্বীপ এবং এই নির্দিষ্ট ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে ভূমিভিত্তিক প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে জমা হতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে, প্রতিদিন প্রায় ৭৩,০০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য পদ্মা, যমুনা এবং মেঘনা নদীর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ে যা আমাদের জলজ বাস্তুতন্ত্রের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

প্লাস্টিক বর্জ্যের অব্যবস্থাপনার ফল ভোগ করছে বাংলাদেশ। প্লাস্টিক পণ্যগুলি কখনই সম্পূর্ণরূপে পচে যায় না বরং কণা আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণাগুলো খুব অল্প দূরত্ব অতিক্রম করে মানবদেহে প্রবেশ করে এবং মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি ঘটাতে পারে। অন্যদিকে, পোড়ানো প্লাস্টিক সামগ্রী থেকে উৎপন্ন বিষাক্ত গ্যাস ও কণা মানুষের নিঃশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে ক্যান্সারসহ জটিল রোগব্যাধি তৈরি করে। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের মানুষের বার্ষিক মৃত্যুর প্রায় ৩২ শতাংশ পরিবেশগত অবনতির সাথে জড়িত। বিশেষ করে বাইরের বায়ু দূষণ, অপর্যাপ্ত পানি, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি মান এবং প্লাস্টিক দূষণের মাধ্যমে সীসার আধিক্য এই মৃত্যুর কারণ।
বিশ্ব ব্যাংক আরো উল্লেখ করেছে ২০১৯ সালে পরিবেশগত কারণে স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য আনুমানিক বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৪.৪ ট্রিলিয়ন টাকা। প্লাস্টিক বর্জ্য ড্রেনেজ সিস্টেম ধ্বংস করে, জলাবদ্ধতা তৈরি করে যা মশার প্রজনন ক্ষেত্র তৈরির অন্যতম কারণ যা ডেঙ্গুর মতো ভেক্টর বাহিত রোগের ঘটনা ঘটায়। এছাড়াও, চিকুনগুনিয়া, কলেরা, ডায়রিয়া এবং ম্যালেরিয়ার মত রোগের প্রার্দুভাবের জন্য প্লাস্টিক দূষণ অনেকাংশে দায়ী।

সুতরাং, প্লাস্টিক দূষণ বিশ্বব্যাপী একটি জটিল সমস্যা; যা পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, অর্থনীতি ও মানব স্বাস্থ্যের জন্য বিরাট হুমকি হিসাবে দেখা দিয়েছে। বিশ্বের ৫১ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য, যা পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ, শুধুমাত্র এশিয়ার দেশগুলিতে উৎপাদিত হয়। আগেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পরিবেশে প্রতিদিন প্রায় তিন হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য যুক্ত হচ্ছে, যা সব ধরনের বর্জ্যের ৮০ শতাংশ।

এমন পরিস্থিতিতে, জাতিসংঘের পরিবেশ উন্নয়ন কর্মসূচি এ বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবসে সব সদস্য রাষ্ট্রকে প্লাস্টিক দূষণের হাত থেকে পরিবেশ, প্রতিবেশ ও সামগ্রীক জীব বৈচিত্র্য রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহবান জানিয়েছে। ইউএনইপি’র একটি নতুন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যদি দেশ ও কোম্পানিগুলো সঠিক নীতি ও বিদ্যমান প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাজার পরিবর্তন করে তাহলে ২০৪০ সালের মধ্যে প্লাস্টিক দূষণ ৮০ শতাংশ কমে যেতে পারে।

“Turning off the Tap: How the world can end plastic pollution and create a circular economy” শীর্ষকএই প্রতিবেদনে বিশ্ব কীভাবে প্লাস্টিক দূষণের অবসান ঘটাতে পারে এবং একটি বৃত্তাকার অর্থনীতি তৈরি করতে পারে তার বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে সঠিক অনুশীলন, বাজারের পরিবর্তন এবং নীতিগুলির সমাধান-কেন্দ্রিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে যা রাষ্ট্র বা সরকারগুলিকে চিন্তাভাবনা এবং ব্যবসায়িক পদক্ষেপ সম্পর্কে অবহিত করতে পারে।

ইউএনইপি বলছে, প্লাস্টিক প্রাকৃতিকভাবে বায়োডিগ্রেডেবল নয়, প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য একমাত্র উপায় হল একটি বৃত্তাকার অর্থনৈতিক মডেল গ্রহণ করা। প্লাস্টিকের সার্কুলার ব্যবহারের উপর জোর দিয়ে, 3R কৌশলের (রিডুস, রিইউজ, রিসাইকেল) উপর ভিত্তি করে এর ব্যবহার কমিয়ে আনা। এর ফলে প্লাস্টিক দূষণজনিত সামাজিক ও পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সহজ হবে।

শুধুমাত্র একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক মডেলের মাধ্যমেই আমরা প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনার 3R পদ্ধতিকে সত্যিকার অর্থে গ্রহণ করতে এবং একটি জাতি হিসেবে আমাদের প্লাস্টিক দূষণ কমাতে সক্ষম হব। এই পরিস্থিতিতে, ক্রমবর্ধমান প্লাস্টিক দূষণ মোকাবিলা করতে এবং সবুজ বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে প্লাস্টিকের টেকসই ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বব্যাংকের একটি নতুন প্রতিবেদনে(Towards a Multisectoral Action Plan for Sustainable Plastic Management in Bangladesh) বলা হয়েছে, বাংলাদেশে টেকসই প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনার জন্য মাল্টি সেক্টরলাল কর্ম পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে যেখানে প্লাস্টিক দূষণ মোকাবিলায় স্বল্পমেয়াদী, মধ্য-মেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা অর্ন্তভুক্ত রয়েছে।

এ কথা সত্য যে, প্লাস্টিক পণ্যগুলি মানুষের জীবনকে আরও স্মার্ট করে তুলেছে কিন্তু একই সময়ে, প্লাস্টিকের অব্যবস্থাপনা আমাদের এমন পরিস্থিতিতে নিয়ে গেছে যেখানে আমাদের গ্রহ ব্যবস্থা দীর্ঘস্থায়ী পরিবেশগত প্রভাবের সম্মুখীন হচ্ছে। বাংলাদেশের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি, আগামী বছরগুলিতে প্লাস্টিকের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে যার ফলে পরিবেশগত বিপর্যয় আরো বাড়বে, মানব জীবন এবং অন্যান্য জীবিত প্রাণীকে প্রভাবিত করবে। কাজেই এখনই সচেতন হতে হবে।

আমাদের দেশে নীতি ও আইন প্রণয়নের চর্চা থাকলেও সেসবের কার্যকর প্রয়োগ এখনও অপ্রতুল। সরকারের কার্যকরী প্রবিধান ও প্রয়োগের উদ্যোগ ছাড়াও, ব্যক্তি, গোষ্ঠী, ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের সচেতনতাও এই সমস্যা মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সুতরাং, বিশ্ব পরিবেশ দিবসের এই দিনে আমরা সবাই মিলে প্লাস্টিক দূষণের সমাধানে সামিল হই এবং আমাদের এই সুন্দর পৃথিবীকে, ভবিষ্যত প্রজন্মকে রক্ষায় “সবাই মিলে করি পণ, বন্ধ হবে প্লাস্টিক দূষণ”।

ড. মতিউর রহমান: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী

 

;

ভাসানচর- এক টুকরো পরিকল্পিত বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ সাময়িক আশ্রয়



ব্রি. জে. (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন ও দমন অভিযানের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ শুরু থেকেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।এই প্রক্রিয়া এখনও শুরু না হওয়ায় বর্তমান পরিস্থিতিতে সামিয়কভাবে রোহিঙ্গারা যাতে নিরাপদে থাকতে পারে, সে কারণে ভাসানচরে তাদের জন্য নতুন ঘরবাড়ি ও অন্যান্য স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে।

সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ বিপর্যয় এবং কক্সবাজারের আশ্রয় শিবিরগুলো থেকে চাপ কমাতে বাংলাদেশ সরকার ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর কার্যক্রম হাতে নিয়েছে যা একটি দূরদর্শী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ।

জাতিসংঘ শুরুতে এর বিরোধিতা করেছিল এবং ২০১৯ সালের মার্চ মাসে, জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক তদন্তকারী কর্মকর্তা জাতিসংঘের মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ দূত ইয়াংহি লি কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া ২৩ হাজার রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে সরিয়ে নেওয়ার পরকিল্পনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে জানিয়েছিল যে, এই দ্বীপ মানুষের বসবাসের উপযোগী হতে পারে না। রোহিঙ্গাদের সেখানে সরিয়ে নেওয়া হলে তা নতুন সঙ্কট তৈরি করতে পারে।

বাংলাদেশ সরকার ২০২১ সালের মার্চ মাসে জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের ১৮ সদস্যের একটি দলকে ভাসানচরে চার দিনের সফরে নিয়ে যায়। সেখানকার উন্নয়ন কার্যক্রম সরেজমিনে দেখার পর জাতিসংঘ ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের ‘মানবিক সহায়তা ও সুরক্ষার চাহিদার’ স্বীকৃতি দেয় এবং ভবিষ্যতের অপারেশনাল কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা করতে সম্মত হয়। পরবর্তীতে ২০২১ সালের ১৮ মে, ইউএনএইচসিআর এবংআন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা ভাসানচর পরিদর্শন করে সেখানকার পরিস্থিতি, সুযোগ-সুবিধা এবংসার্বিক অবস্থাস ম্পর্কে অবগত হয়।

পরিদর্শন শেষে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় জাতিসংঘের সম্পৃক্ততা বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সাথে ইউএনএইচসিআর ৯ অক্টোবর ২০২১, একটি সমঝোতা স্মারকে সই করে। চুক্তি অনুযায়ী, ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের খাদ্য ও পুষ্টি, সুপেয় পানি, পয়ঃনিষ্কাশন, চিকিৎসা, মিয়ানমারের পাঠ্যক্রম ও ভাষায় অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং জীবিকা সংস্থানের ব্যবস্থা করতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে জাতিসংঘ যৌথভাবে কাজ করতে সম্মত হয়। জাতিসংঘের সঙ্গে চুক্তির পর ভাসানচরে বিদেশি অর্থায়ন শুরু হয়েছে।বর্তমানে ভাসানচরে স্থানান্তরিত রোহিঙ্গাদের জীবন ও জীবিকা স্বাচ্ছন্দ্যময় করতে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) কার্যালয়ের সঙ্গে ইউএনএইচসিআর, ডব্লিউ এফ পি ও অন্যান্য এন জি ও সেখানে তাদের কার্যক্রম সুন্দরভাবে পরিচালনা করছে।

কক্সবাজার থেকে এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তরের লক্ষ্যে ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ সরকার আশ্রয়ণ-৩ নামের এই প্রকল্প হাতে নেয় এবং বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে এটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়। নৌ বাহিনী সফলতার সাথে এই প্রকল্প সম্পন্ন করে। প্রকল্পে রোহিঙ্গাদের জন্য বসবাসের জন্য ১২০টি ক্লাস্টার এবং ১২০টি শেলটার স্টেশন রয়েছে। ভাসানচরের ক্লাস্টার হাউজ ও শেল্টার স্টেশনগুলো ভূমি থেকে চার ফুট উঁচু করে কংক্রিটের ব্লক দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি ক্লাস্টারে আছে ১২টি হাউজ। এখানে সব মিলিয়ে ১,৪৪০টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি ঘরে ১৬টি কক্ষ রয়েছে এবংপ্রতিটি কক্ষে দুটো ডাবল বাঙ্কার বা দোতলা খাট আছে যাতে একটি পরিবারের চারজন থাকতে পারে। পরিবারে সদস্য সংখ্যা চারজনের বেশি হলে তাদের জন্য দুটো কক্ষ বরাদ্দ করার ব্যবস্থা রয়েছে। জাতিসংঘের আদর্শ মান অনুযায়ী আবাসনের ক্ষেত্রে মাথাপিছু ৩৭ বর্গফুট জায়গা দরকার, এসব কক্ষে তার চেয়ে বেশি জায়গা রাখা হয়েছে। প্রতি ৮টি কক্ষের জন্য তিনটি টয়লেট এবং দু'টি গোসলখানা রয়েছে, নারী-পুরুষদের জন্য রয়েছে আলাদা গোসলখানা ও টয়লেট। রান্নার জন্য প্রতিটি পরিবারের জন্য একটি করে চুলার জায়গা বরাদ্দ করা আছে।সেখানে সিলিন্ডারে এল পি জি গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে।রান্নায় গ্যাস সাশ্রয়ের জন্য একটা এন জি ও বিশেষ বাক্সের ব্যবস্থা করছে। রান্নাঘর, গোসলখানা এবং টয়লেটে পানির সরবরাহ রয়েছে। প্রতিটি হাউজের ওপরে রয়েছে সৌর বিদ্যুতের প্যানেল।

প্রতিটি ক্লাস্টারের জন্য আছে একটি করে শেল্টার স্টেশন। ভাসানচরে বড় ধরনের ঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসের সম্ভাবনা মোকাবিলায় গত ১৭১ বছরের ঘূর্ণিঝড় সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনা করা হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে ব্যবহার করার জন্য ভাসানচরে পাঁচ তলা বিশিষ্ট ১২০টি শেল্টার স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। ঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার গতিবেগের ঘূর্ণিঝড় হলেও টিকে থাকতে সক্ষম এই শেলটার স্টেশন। ভাসানচরে কর্মরত ইউএনএইচসিআর ও আরআরআরসি’র প্রতিনিধি জানায় যে, কিছুদিন আগে সাইক্লোন মোখার সময় দুই ঘণ্টার মধ্যে ভাসানচরের সবাইকে সাইক্লোন শেল্টারে নেওয়া হয়েছিল, এবং তারা সবাই নিরাপদ ছিল, এটা ভাসানচরের জন্য একটা বড় অর্জন।

ভাসানচরে শিশুদের জন্য দুটি খেলার মাঠ, এতিমখানা, ডে-কেয়ার, সুপারশপ, সেলুন, মসজিদ ও বাজার আছে। সেসব বাজারে নোয়াখালী হাতিয়া ও অন্যান্য জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা এসে ব্যবসা করছে এবং প্রায় সব প্রয়োজনীয় জিনিস সেখানে পাওয়া যায়। প্রকল্প এলাকায় পুকুর এবং লেক কাটা হয়েছে। রোহিঙ্গারা এখানে মাছ ধরে এবং এখানে মাছের চাষ হচ্ছে। প্রতিটি ক্লাস্টারে ও ১০ ফুট গভীর একটি পুকুর আছে। এসব পুকুরের পানি গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রতিটি ক্লাস্টার একই আকৃতিতে বানানো হয়েছে, এখানকার সব ঘর দেখতে একই রকম। ঘরের পাশের অল্প ফাঁকা জায়গায় মহিলারা শাক সবজি চাষ করছে। প্রতিটি ঘরের সামনে ২০ থেকে ২৫ ফুট চওড়া পাকা রাস্তা রয়েছে। বাংলাদেশের সব গ্রামে এত সুন্দর মজবুত ও পরিচ্ছন্ন রাস্তা দেখা যায় না। প্রকল্পের ভেতরে পানি নিষ্কাশনের জন্য ড্রেন এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কেন্দ্রীয় সংরক্ষণাগার আছে। এনজিওদের তত্ত্বাবধানে রোহিঙ্গারা সমস্ত আবর্জনা সেখানে এনে জমা করছে। এর ফলে এলাকা পরিচ্ছন্ন থাকছে এবং এই আবর্জনা থেকে জৈব সার তৈরি করে তা কৃষি জমিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। ভাসান চরে ৪৩২ একর জমিতেরোহিঙ্গাদের আবাসন ও অন্যান্য স্থাপনানির্মিতহয়েছে।ভবিষ্যতে প্রকল্পের সম্প্রসারণ ও বনায়নের জন্য বাঁধের ভেতর ৯১৮ একর এলাকা খালি রাখা হয়েছে।

ভাসানচরে দুটি ২০ শয্যার হাসপাতাল এবং চারটি কমিউনিটি ক্লিনিক আছে। প্রকল্প এলাকায় সরকারি কর্মকর্তা, জাতিসংঘ প্রতিনিধি, আরআরআরসি প্রতিনিধি, রেডক্রস, আন্তর্জাতিক এনজিও প্রতিনিধি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্যও আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের থাকার জন্য যেসব ঘর নির্মাণ করা হয়েছে, সেগুলো কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর তুলনায় অনেক টেকসই ও উন্নতমানের। কক্সবাজারের ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের ঘরগুলোতে বিদ্যুতের সরবরাহ না থাকলেও ভাসানচরে সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে আলোর ব্যবস্থা রয়েছে।

ভাসানচরে জোয়ার ও জলোচ্ছাসের ঝুঁকি থেকে নিরাপদ করতে ১৭০২ একর জমির চারপাশে ৯ ফুট উঁচু বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এই বাঁধ ১৫ ফুট পর্যন্ত উঁচু করা হবে। ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা করার জন্য প্রায় তিন কিলোমিটার জুড়ে তীর রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সমুদ্রের যে পাশ থেকে ঢেউ চরে আঘাত করে, সেই পাশেই শোর প্রোটেকশন দেওয়া হয়েছে। শোর প্রোটেকশন থেকে ৫০০ মিটার ভেতরে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। অনেক শক্তিশালী ঝড় এই চরের উপর দিয়ে গেলে ও মানুষের জীবন বিপন্ন হবে না।

১৩,০০০ একরের এই দ্বীপে সারাবছর সুপেয় পানি, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ, কৃষি জমি, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, দুটি হাসপাতাল, চারটি কমিউনিটি ক্লিনিক, মসজিদ, গুদামঘর, টেলিযোগাযোগ পরিষেবা, একটি পুলিশ স্টেশন, বিনোদন ও শিক্ষা কেন্দ্র, খেলার মাঠ এবং আরও অনেক কিছু রয়েছে।ভাসানচরে ডব্লিউএফপি খাদ্য সহযোগিতা দিচ্ছে, পাইলট প্রকল্প আকারে ই ভাউচারের মাধ্যমে এখন ৫০০০ রোহিঙ্গা কে খাদ্য সহায়তা দেয়া হচ্ছে, ভবিষ্যতে সবাইকে এই সুবিধার আওতায় আনা হবে। ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলি থেকে রোহিঙ্গাদেরকে ভাসানচরে স্থানান্তরিত করা শুরু হয়। ভাসানচরে আসা রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের চেয়ে ভাসানচরে নিরাপদ আর স্বস্তিতে আছে। স্বাস্থ্যসেবাসহ ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের আধুনিক সুযোগ-সুবিধাগুলি রয়েছে যা বাংলাদেশের সব জায়গায় পাওয়া যাবে না।

রোহিঙ্গারা বর্তমানে ভাসানচরের জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্যময় ও কক্সবাজারের নিরাপত্তাহীনতা থেকে মুক্তির সুবাতাস হিসেবে দেখছে। ভোর থেকেই ভাসানচরে কর্মচাঞ্চল্য শুরু হয়ে যায়। রোহিঙ্গাদের কেউ সাগরে কিংবা চরের ভেতরের পুকুর বা লেকে মাছ ধরতে যায়। কেউ ভ্যান কিংবা রিকশা নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। কেউ তাদের জন্য বরাদ্দ কৃষি জমিতে চাষ করতে চলে আসে। কিছু রোহিঙ্গা তাদের পশুদের চড়াতে বের হয়। এক সময়ে জাতিসংঘ ও অন্যান্য দাতা সংস্থা যে ভাসানচরের উপর তাদের আস্থা রাখতে পারেনি আজ সেখানেই নিরাপদে উন্নত পরিবেশে বসবাস করছে রোহিঙ্গারা যা বাংলাদেশ সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বের একটা গুরুত্বপূর্ণ অর্জন।

ভাসানচরে রোহিঙ্গারা এখন গবাদিপশু লালন পালন, মাছধরা ও চাষাবাদের মত জীবিকা নির্বাহের সুযোগ আছে। ভাসানচরে কাজ করা এনজিওগুলো সেলাই, পাটজাত পণ্য তৈরি, ব্লকের কাজ, স্কিন প্রিন্ট, সূচিকর্ম এবং আরও অন্যান্য ভোকেশনাল ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করেছে। এখানে পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, জীবিকার নিশ্চয়তা, মৌলিক অধিকার নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করা হচ্ছে। ভাসানচরের স্কুলগুলো এখন কলরব মুখর, শিশুরা সকাল বেলা সেখানে যাচ্ছে এবং সামনে তাদের কেন্দ্রিয়ভাবে পরীক্ষা নেওয়া হবে পরবর্তী ধাপে যাওয়ার জন্য। ভাসানচরে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের ভাষায় পাঠ্যক্রম অনুসরণ, দক্ষতা বৃদ্ধি কার্যক্রম ও জীবিকা অর্জনের সুযোগ পাচ্ছে।

সবশেষে বলা যায় যে, পরিকল্পিতভাবে নির্মিত এক টুকরো বাংলাদেশ এই ভাসানচর যা এখন রোহিঙ্গাদের নিরাপদ সাময়িক আশ্রয়।

;