ভুট্টোর ফাঁসি ও বিচারের বাণী

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ভুট্টোর ফাঁসি ও বিচারের বাণী

ভুট্টোর ফাঁসি ও বিচারের বাণী

জুলফিকার আলী ভুট্টো (৫ জানুয়ারি ১৯২৮-৪ এপ্রিল ১৯৭৯)। কারো কাছে তিনি নায়ক, কারো কাছে খলনায়ক। পাকিস্তানের রাজনীতির বহু ঘটনা-দুর্ঘটনার অনুঘটক তিনি। সামরিক-বেসামরিক রাজনীতির কুশলী খেলোয়াড় হিসেবে দখল করেন পাকিস্তানের ক্ষমতা। আবার ক্ষমতার খেলায় হেরে জীবন দেন ফাঁসিকাষ্ঠে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গণহত্যার দায় তিনি কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না। জাতিসংঘে গিয়েছিলেন বাংলাদেশ বিরোধী তৎপরতায়। গণতান্ত্রিক নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় যেতে দেননি ভুট্টো। পাকিস্তানের সামরিক নেতাদের সঙ্গে চক্রান্ত করে নিজেই কব্জা করেন মসনদ। অবশেষে প্রাণ হারান ফৌজি শাসকের আক্রোশে।

বিজ্ঞাপন

পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের লারকানার জমিদার জুলফিকার আলী ভুট্টো রাজনীতিতে এসে ১৯৫৮ সালে মাত্র ৩০ বছর বয়সে মন্ত্রী হন। গুরুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান ১৯৬৩ সালে। আইয়ুব খানের মন্ত্রিসভা ত্যাগ করে ১৯৬৭ সালে নিজে আলাদা দল গঠন করেন। যার নাম পাকিস্তান পিপলস্‌ পার্টি (পিপিপি)।

১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে তার দল পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ সার্বিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা সত্ত্বেও তাদের উপর ক্ষমতা অর্পণে ভুট্টো আপত্তি তুলেন।

বিজ্ঞাপন

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর ভুট্টো ইয়াহিয়া খানের স্থলে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি হন। ১৯৭৩ সালে দেশের সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন। ১৯৭৭ সালে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই জেনারেল জিয়াউল হক দ্বারা সংঘটিত এক সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন। এক ব্যক্তিকে হত্যার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৯৭৯ সালে সামরিক আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে।

ষড়যন্ত্রের পথে উত্থান হলেও রাজনীতিতে ভুট্টো করুণ পরিণতির শিকার হন। নিষ্ঠুর পতন ও ফাঁসি তার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটায়। কেউই স্বপ্নেও ভাবেনি যে, পাকিস্তানের জমিদার পরিবারের সন্তান, অক্সফোর্ড পড়ুয়া জুলফিকার আলী ভুট্টোর এমন হাল হবে। চালচলন-বেশভূষায় পাশ্চাত্য স্টাইল তিনি বহু বিপদ পাড়ি দিয়েছিলেন। ধোপদুরস্ত কেতা আর অহমিকায় জিতেছেন রাজনীতির খেলায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি ধরা খান তারই বিশ্বাসভাজন জেনারেল জিয়াউল হকের কাছে।

ঘটনাটি ১৯৭৭ সালের। সেবছর ভোটে আবার নির্বাচিত হয়েও ভুট্টোর পক্ষে ক্ষমতায় থাকা সম্ভব হয়নি। বেলুচ সংকট, রাষ্ট্রের ভিতরে নানামুখী অন্তর্ঘাতে সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতায় আসেন সেনাপ্রধান জিয়াউল হক। বিশ্বাস ও আস্থাভাজন হিসেবে জিয়াউল হককে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব দিয়েছিলেন স্বয়ং ভুট্টো। বাংলার কসাই টিক্কা খানের উত্তরাধিকার হিসেবে জিয়াউল হককে এ দায়িত্ব দিতে পাঁচজনকে ডিঙাতে হয়েছিল।

কিন্তু ইতিহাসের হিসাব ছিল অন্য রকম। আর তা ছিল বড়ই নিষ্ঠুর হিসাব। ভুট্টো সে নিষ্ঠুরতা থেকে রেহাই পাননি। তার শেষ পরিণতি হয়েছিল করুণ। এমন পরিস্থিতির জন্য তিনি তৈরি ছিলেন না। লে. কর্নেল রাফিউদ্দিন উর্দু ভাষায় এ নিয়ে একটি বই লেখেন। বইটির নাম ‘ভুট্টো কা আখেরি ৩২৩ দিন’। এ বইতে অনেক কিছু উঠে এসেছে।

রাওয়ালপিন্ডি জেলের নিরাপত্তা ব্যাটালিয়ন কমান্ডার ছিলেন রাফি। অবসরের পর ভুট্টো অধ্যায় নিয়ে বই লিখে সাড়া জাগান। ভুট্টো নিজেও মৃত্যুর আগে কারাগারে বসে লিখেছিলেন স্মৃতিকথার কিছু অংশ। তাতে তিনি দাবি করেছিলেন, তাকে ষড়যন্ত্রমূলক বিচারে ফাঁসি দেওয়া হবে। ভুট্টোর অনুসারীরা সবসময় তার ফাঁসিকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলেছে। আর ভুট্টোর ফাঁসির ৪৫ বছর পরে রায় দিল পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট: 'স্বচ্ছ বিচার হয়নি’।

১৯৭৭ সালে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউল হক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন ভুট্টোকে। তার কিছু দিনের মধ্যেই তাকে গ্রেফতার করে ফাঁসি দেয় পাকিস্তানের সেনা সরকার। এখন আনুষ্ঠানিক রায়ে ভুট্টোর বিচারকে ‘স্বচ্ছ ও যথাযথ আইনি পদ্ধতি’ মেনে হয়নি বলছে সে দেশের সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ। মার্চের প্রথম সপ্তাহে এক সর্বসম্মত রায়ে এ কথা জানিয়ে সর্বোচ্চ আদালত। সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত ভুট্টো একটি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় ১৯৭৯ সালে তার ফাঁসি হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে আনা হয়েছিল এক রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে খুনের অভিযোগ। পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)-র প্রতিষ্ঠাতা ভুট্টো সেই মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। কিন্তু গোড়া থেকেই তার পরিবার এবং দল ‘রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে’র অভিযোগ তুলেছিল জিয়া সরকারের বিরুদ্ধে।

সাড়ে চার দশক আগেকার সেই রায়ের পুনর্মূল্যায়ন করে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি কাজি ফয়েজ ইশার নেতৃত্বাধীন ন’জন বিচারপতির বেঞ্চ। টিভিতে সম্প্রচার করা হয় সেই বিচারপর্ব। সর্বসম্মত রায় ঘোষণা করে প্রধান বিচারপতি ফয়েজ বলেন, ‘‘স্বচ্ছ এবং যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া মেনে সে দিন বিচার হয়নি। এই মামলায় বিস্তারিত রায় আমরা পরবর্তী সময়ে প্রকাশ করব।’’ প্রসঙ্গত, ভুট্টোর কন্যা বেনজির পরবর্তী সময়ে পাক প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। বেনজির-পুত্র বিলাবল বর্তমানে পাকিস্তানের শাসকজোটের অন্যতম নেতা।