ত্রাণ বিতরণে দরকার সমন্বয় ও পুনর্বাসন নিয়ে ভাবনা
বরাবরের মতো এবারও মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে মানুষ। বন্যা উপদ্রুত এলাকায় মানুষ ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছে। অনেকেই যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ব্যক্তি পর্যায়ে, প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে, গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে ত্রাণের জন্যে মানুষের কাছে সাহায্য চাইছে, অন্যরাও দিচ্ছে এর জবাব, সহযোগিতার। গত দুইদিনে সামাজিক মাধ্যম ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে যে চিত্রের দেখা পেলাম আমরা, তাতে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত চিত্র চোখে পড়েছে। দুর্যোগ-দুর্বিপাকে আক্রান্ত মানুষেরা যে একা নয়, এই বার্তাই ওঠে এসেছে মানবিকতার এই ত্রাণ কার্যক্রমে।
এবারই প্রথম নয়, এরআগেও একাধিকবার বন্যা আক্রান্তদের পাশে দাঁড়িয়েছিল মানুষ। প্রকৃতির প্রতিকূলতা সত্ত্বেও কেবল ত্রাণ নয়, উদ্ধার কার্যক্রমেও অংশ নিচ্ছে সাধারণ মানুষ। ব্যক্তি পর্যায়ের এই উদ্যোগের পাশাপাশি আছে কিছু সাংগঠনিক উদ্যোগ, আছে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর উদ্যোগ। সেনা-নৌ-বিমান-বিজিবি-ফায়ারসার্ভিস-পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর কার্যক্রম চোখে পড়েছে অনেকের। ব্যক্তি পর্যায়ে অনেকের যারা উদ্ধার কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছেন, তাদের বেশিরভাগেরই নেই পূর্বঅভিজ্ঞতা অথবা প্রশিক্ষণ, তবু স্রেফ মানবিক ডাকে তাদের সাড়া দিতে দেখছি আমরা। এই সময়ে অনেকের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার শঙ্কা থাকে, প্রাণহানির শঙ্কা থাকে; এমন শঙ্কা সত্ত্বেও মানুষের এই এগিয়ে আসাকে বাহবা দিতেই হয়।
সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য বলছে, এবারের বন্যায় এখন পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা ৪৯ লাখ ৩৮ হাজার ১৫৯ জন। এসব জেলায় বন্যাকবলিত হয়ে মারা গেছেন ১৮ জন। শনিবার দুপুরে সচিবালয়ে নিয়মিত ব্রিফিংয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব কামরুল হাসান এ তথ্য জানান।
সরকারি তথ্যে জানা যাচ্ছে, আকস্মিক বন্যায় দেশের ফেনি, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব জেলার ৭৭টি উপজেলা এবং ৫৮৭টি ইউনিয়ন বা পৌরসভা প্লাবিত হয়েছে। এই ১১ জেলায় মোট ৯ লাখ ৪৪ হাজার ৫৪৮ পরিবার পানিবন্দি। যাতে মোট ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা ৪৯ লাখ ৩৮ হাজার ১৫৯ জন। নিহত ১৮ জনের মধ্যে কুমিল্লায় ৪, ফেনি ১, চট্টগ্রাম ৫, নোয়াখালী ৩, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ১, লক্ষ্মীপুর ১ ও কক্সবাজার ৩ জন। মোট ৩ হাজার ৫২৭টি আশ্রয়কেন্দ্রে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৮৮৮ জন লোক এবং ২১ হাজার ৬৯৫ গবাদি পশুকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। ১১ জেলার ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য মোট ৭৭০টি মেডিকেল টিম চালু রয়েছে।
সরকারি তথ্যের বাইরে থাকে বেসরকারি তথ্য এবং এর বাইরেও থাকে প্রকৃত পরিস্থিতি। অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি সরকারি-বেসরকারি তথ্যের বাইরের পরিস্থিতি থাকে কঠিন। এবারের বন্যার ধরন, বন্যা মোকাবিলায় পূর্ব-প্রস্তুতি না থাকা এবং মানুষের অসহায়ত্বের চিত্র স্বাভাবিকভাবেই অন্য কথা বলে। তবে সবকিছুর বাইরের বাস্তবতা হলো দেরিতে হলেও এবারও মানবিকতার বিশাল জাগরণ ঘটেছে, এবং বরাবরের মতো এটা শুরু হয়েছে সামাজিক মাধ্যম থেকে।
বন্যার্তদের সাহায্যের জন্যে প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে অর্থ গ্রহণ করা হচ্ছে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, সেবামূলক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান খুলেছে ত্রাণ তহবিল; ওসব জায়গায় দেশে-বিদেশের মানুষ সাধ্যমত সহায়তা করে যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনী থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বেতনের অর্থ ত্রাণ তহবিলগুলোতে অনুদানের ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। রেডক্রিসেন্ট, প্রচেষ্টা ফাউন্ডেশন, আসসুন্নাহ ফাউন্ডেশন, কবিসাহিত্যিকদের উদ্যোগ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উদ্যোগে টিএসসিতে গণত্রাণ কর্মসূচিসহ প্রতিষ্ঠান-গোষ্ঠীবদ্ধ ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ এরইমধ্যে চোখে পড়েছে। এখানে কে কোন ধর্মের, কে কী আদর্শ ধারণ করছেন, সেদিকে দৃষ্টির সুযোগ থাকছে না। সবার একটাই উদ্দেশ্য মানুষের সহযোগিতা। প্রতিবন্ধী এক ভিক্ষুকের ত্রাণ তহবিলে অনুদানের চিত্র সামাজিক মাধ্যমে এসেছে, এসেছে ছোট্ট শিশুর অনুদানের চিত্রও। অনেককে বলতে দেখেছি ফেসবুক থেকে উপার্জিত অর্থ, বই বিক্রি থেকে উপার্জিত অর্থ ত্রাণের জন্যে অনুদানের কথা। এসব আসলে মানবিক বাংলাদেশের চিত্র।
নানা পর্যায় থেকে প্রাপ্ত অর্থগুলোর সবটাই যে মানুষের কল্যাণে ব্যয়িত হয়ে যাবে, এমন সরল বিশ্বাস করার পর্যায়ে আমরা এখনো পৌঁছে যাইনি। মানবিক অগুনতি মানুষের ভিড়ে কিছু মানুষ এসময়েও সুযোগের সন্ধানে থাকেন। বন্যার সহযোগিতার নামে তারাও যে মাঠে নাই, সেটা কে বলবে! তবু বিশ্বাস করতে চাই এরা সংখ্যায় সীমিত, তবু মানবিকতার বিশাল কর্মযজ্ঞে তাদের নিয়ে সতর্ক থাকাও উচিত আমাদের। এ সতর্কতার জন্যে তাই আমাদের বাছাই করতে হবে নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। অনুদানের সময়ে এটা খেয়াল রাখা সম্ভব হলে প্রাপ্ত টাকাগুলো যথাস্থানে, পরিকল্পনামাফিক ব্যয়িত হবে।
সরকারি তথ্য বলছে, এই মুহূর্তে দেশের অন্তত ১১ জেলা বন্যায় আক্রান্ত। তবে আলোচনা ফেনী নিয়ে বেশি বলে সকল পর্যায়ের আহরিত অর্থ ও ত্রাণের প্রাথমিক গন্তব্য হয়ে পড়েছে এই জেলাটি। এছাড়া যারা ত্রাণ বিতরণের জন্যে যাচ্ছে, তারা যাকে সামনে পাবে তাকেই দেবে বলে বন্যাদুর্গত অনেকের পক্ষে এই ত্রাণ সংগ্রহ করা সম্ভব হবে না। সিলেটের বন্যার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি, প্রত্যন্ত ও দুর্গম এলাকাগুলোতে ত্রাণ বিতরণের জন্যে স্বেচ্ছাসেবীরা কম যায়, অথবা যেতে পারে না অথবা সে খবর পায় না; ফলে ওই সব এলাকা ত্রাণের আওতার বাইরে চলে যায়। অনেকেই ত্রাণ বিতরণের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক মাধ্যমে প্রচারণার বিষয়টিকেও মাথায় রাখে, ফলে তারা যতটা না দুর্গম এলাকাগুলোর দিকে আগ্রহী, তারচেয়ে বেশি আগ্রহী অনুকূল যোগাযোগ ব্যবস্থার এলাকাগুলোর দিকে। এতে করে কোনো নির্দিষ্ট এলাকা ত্রাণ বেশি পায়, আর অনেক এলাকা হয়ে পড়ে বঞ্চিত; অথচ এই দুর্দিনে তাদেরও দরকার সহায়তার।
অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ত্রাণ সংগ্রহ ও বিতরণের লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নামলেও তাদের অধিকাংশের এই মুহূর্তের মনোযোগ নির্দিষ্ট কিছু এলাকা। এতে করে সহায়তার প্রকৃত উদ্দেশ্য অনেক সময় বাধাপ্রাপ্ত হবে বলে ধারণা করছি। এখানে তাই দরকার সমন্বয়ের, বিশেষ করে তথ্যগত সহায়তার। এক্ষেত্রে প্রত্যেকটা দল স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা নিতে পারে, এবং স্থানীয় প্রশাসন এনিয়ে একটা কর্মপরিকল্পনাও হাতে নিতে পারে। যদিও ত্রাণের উল্লিখিত বিষয়গুলো বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত এবং সরকারি খবরদারি-নজরদারির বাইরে, তবু এক্ষেত্রে দুর্যোগ ব্যবস্থা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নিয়ে তাদেরকে সহায়তা নিয়ে ভাবতে পারে। এটা যদি সম্ভব হয়, তবে সব এলাকার লোকজন ত্রাণ পাবে বলে ধারণা।
প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিল এবং স্বেচ্ছাসেবী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অনেক অর্থ জমা পড়বে। এই অর্থ কেবল ত্রাণ বিতরণ নিয়েই সীমিত রাখলে চলবে না। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর খাবার-পানি এবং বাসস্থান নিয়ে যে সংকট তৈরি হবে, সে দিকটাও মাথায় রাখতে হবে। বন্যা উপদ্রুত এলাকার মানুষদের খাওয়ানোর পাশাপাশি তাদের পুনর্বাসন নিয়ে এখন থেকেই চিন্তাভাবনা শুরু করতে হবে। পানি নেমে যাওয়ার পর মূলত মানবিক বিপর্যয় নেমে আসে, এদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
যারা বন্যা আক্রান্তদের ত্রাণের জন্যে অর্থ সংগ্রহ করছেন, ত্রাণ বিতরণ করছেন তারা এই মুহূর্তে বিক্ষিপ্ত হলেও তাদের উচিত হবে মাঠে সহায়তার জন্যে যাওয়া সকলের সঙ্গে যথাসম্ভব যোগাযোগ রাখা। এটা বিস্তৃত পরিসরে যদিও অনেক কঠিন এক কাজ, তবু এর চেষ্টা থাকলে পরিকল্পনা অনুযায়ী কিছুটা হলেও ত্রাণ বিতরণ সম্ভব হবে।