হাঁসের প্যাকপ্যাক আর বিদ্রুপের হাসিতে ভরপুর আমেরিকার নির্বাচনী বিতর্ক

  • মাহমুদ মেনন, শিক্ষক ও সাংবাদিক
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিস

ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিস

গতরাতে এখানে তখন ৯টা। বাংলাদেশ থেকে মেয়ের ফোন, ‘বাবা কী করো?’

-বিতর্ক দেখবো বলে লিংক খুঁজছি।
-ও আমিতো দেখছি কেবলই শুরু হলো।
- লিংকটা দাও।
- চলো একসাথে দেখি। আমি স্ক্রিন শেয়ার করছি।

বিজ্ঞাপন

এরপর যোগাযোগ প্রযুক্তির কল্যাণে টানা দেড়ঘণ্টা ভূগোলকের দুই প্রান্তে বসে বাবা-মেয়ে একসাথে দেখলাম যুক্তরাষ্ট্রের ৬০তম প্রেসিডেন্সিয়াল লড়াইয়ে দুই প্রার্থীর বিতর্ক।

সে যেনো এক অসম লড়াই। একদিকে তথ্যবহুল সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনায় সমৃদ্ধ ও যুক্তিনির্ভর উপস্থাপনা। আরেক দিকে একই কথা বারবার বলে যাওয়া। একই চর্বিত চর্বন। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখনই কথা বলছিলেন, আমার কাছে হাঁসের প্যাকপ্যাক ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছিলো না। সেটাই যখন ভাবছিলাম- মেয়ে বললো, ‘লোকটার মধ্যে ব্যবল সিনড্রম প্রকট। কি বলে কিছুই বোঝা যায় না। সব প্রশ্নেই যেনো তার একটাই উত্তর।’

বিজ্ঞাপন

বিতর্কের শুরুটাই হয় অস্বাভাবিকতা দিয়ে। বিতর্ক মঞ্চে যখন ঘোষিত হলো দুই প্রার্থী অর্থাৎ সাবেক প্রেসিডেন্ট ও রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্প ও বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ডেমোক্র্যাট কমলা হ্যারিসের নাম, আর দুজন ঢুকলেন মঞ্চে, তখন রীতিমাফিক নিজের পোডিয়াম ছাড়িয়ে এগিয়ে গেলেন কমলা, উদ্দেশ্য প্রতিপক্ষের সাথে করমর্দন। কিন্তু ট্রাম্প তার পোডিয়ামেই দাঁড়িয়ে থাকলেন। অগত্যা কমলা এগিয়ে গেলেন ট্রাম্পের পোডিয়ামের কাছে আর হলো একটা অসম করমর্দন। একই ছাদের নিচে দুই প্রার্থীর প্রথম মোলাকাতটা ছিলো রীতিমতো বেখাপ্পা। মেয়ে বললো, ‘বাবা এটাতো রীতিমতো অভদ্রতা’।

তবে মোটের ওপর এবারের বিতর্কে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অপেক্ষাকৃত ভদ্রোচিত থাকতে দেখা গেছে। কটুকাটব্য একটু কমই করেছেন। কমলাও ছিলেন মার্জিত। কেবল ছুড়ে মারছিলেন বাঁকা হাসির তীক্ষ্ণ তীর। ধন্যবাদ দিতে হবে মাইক মিউটেড রাখার সিদ্ধান্তকে। তবে সে হাসি দেখে ট্রাম্পের যে পিত্তি পুড়ে যাচ্ছিলো তা তার মুখভঙ্গিতেই ছিলো স্পষ্ট। মনে পড়ছিলো সেই টিকটক ভিডিওটির কথা! মাইক খোলা থাকলে ট্রাম্প হয়তো বলেই ফেলতেন- ‘তুই হাসছ ক্যারে! তুই হাসছ ক্যারে’!! মেয়ে বললো, ‘বাবা কমলা কিন্তু পাঁজি আছে… দেখো কেমন অর্থপূর্ণ বাঁকা হাসি দিচ্ছে।’

যাক জোক্‌স অ্যাপার্ট। আসুন দেখি বিতর্কটাই কেমন ছিলো। আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে- এই বিতর্কে কমলারই জয় হয়েছে। তারই ঝোলায় ঢুকেছে বিতর্কের সিংহভাগ সুফল। যার প্রমাণ আমরা দেখেছি বিতর্ক পরবর্তী এবিসি জরিপেও। দেখানো হয়েছে সুইং স্টেটগুলোর ছয়টির মধ্যে এক জর্জিয়া ছাড়া বাকি সবগুলোতেই নীলকে এগিয়ে দিয়েছেন জরিপে অংশগ্রহণকারীরা। কারণ একটাই- বিতর্কের মোক্ষম মূহূর্তগুলোর সুবিধা কমলা হ্যারিস নিয়ে নিয়েছেন একচ্ছত্রভাবে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কমলা হ্যারিসের পারফরম্যান্স ছিলো নান্দনিক, মনকাড়া ও গোছানো। নারীর শরীরে নারীর অধিকার, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার দাবি ও যৌক্তিকতা তুলে ধরে গর্ভপাতের অধিকার বিরোধী ট্রাম্পকে সত্যিকার অর্থেই ঘায়েল করতে পেরেছেন তিনি। ট্রাম্প অবশ্য পই পই করে বলে যাচ্ছিলেন, সাত মাস, নয় মাসেও নাকি গর্ভপাত হচ্ছে, তাই এটা নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন।

আলোচনায় অবধারিতভাবে এসেছে বর্ণবাদ প্রসঙ্গ। যা নিয়ে কথা বলতে কমলাকে আবেগতাড়িত হতে দেখা গেছে বারবার। নিজেকে বর্ণবাদী নন প্রমাণ করার ব্যর্থ চেষ্টা ছিলো ট্রাম্পের।

এসবে অবশ্য তার আগ্রহও ছিলো না। বার বার তিনি কথা বলতে চেয়েছেন অর্থনীতি আর অভিবাসন নিয়ে। আর অদ্ভুত এক গল্প, যা আগে কেউ শোনেনি। বলেছেন তার কাছে নাকি তথ্য আছে- নব্য অভিবাসীরা নাকি মানুষের কুকুর বেড়াল চুরি করে খেয়ে ফেলছে!!! পাল্টা একটি কথাও বলেননি কমলা। শুধুই হেসেছেন। কারণ তিনি জানেন, ফ্যাক্ট চেকেই ধরা পড়বে এ এক ঢাঁহা মিথ্যাচার।

দুই প্রার্থীই একে অন্যকে দোষারোপ করেছেন এই বলে যে, আমেরিকাকে বিভক্ত করে দেয়া হচ্ছে। সেতো হচ্ছেই। মূলত যুক্তরাষ্ট্র রেড আর ব্লুতে বিভক্ত। এখানকার অঙ্গরাজ্যগুলোকে রেডস্টেট আর ব্লুস্টেট বলেই চেনে সকলে। গুটিকয় যে রয়েছে সুইং স্টেট, সেগুলোকে লাল কিংবা নীল রঙ দেওয়ার জন্যই প্রতি চার বছর অন্তর লড়াই। তবে কিছু বিষয় থাকে যা গোটা আমেরিকার। যেমন গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত, বাজার দর, অর্থনীতি, যুদ্ধ কিংবা যুদ্ধে সহযোগিতা, স্বাস্থ্যসেবা, অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ এসবই গুরুত্ব পায় বিতর্কে।

১০ সেপ্টেম্বরের বিতর্ক ভিন্ন কিছু ছিলো না। পেনসিলভেনিয়ার ফিলাডেলফিয়ার ন্যশনাল কনিস্টিউশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত এই বিতর্কে কোনো লাইভ দর্শক ছিলো না। ফলে হাততালি শোনা যায়নি। কিংবা আসেনি কো দুয়ো ধ্বনি। এবারের বিতর্কে নতুন কিছু নিয়মও বেঁধে দেওয়া হয়েছিলো যার অন্যতম ছিলো মাইক মিউটেড রাখা। একজন কথা বললে অন্যজন মাঝপথে কিছু বলতে পারবে না। তাও একবার কড়া ভাষায় কমলাকে স্মরণ করে দিয়েছেন ট্রাম্প, তিনি কথা বলছেন, তো মাঝে কথা বলা যাবে না। শুনে বিষ্ময়ের হাসি হাসেন কমলা। বস্তুত তিনি কিছু বলছিলেনও না। ফলে পুরো বিতর্কটি ঝঞ্ঝামুক্তভাবে শেষ হতে পেরেছে। কিন্তু স্বভাবসুলভ ভাবে কিছু ঘৃণা ছড়িয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। মার্জিত উপায়ে কম ঘৃণা ছড়াননি কমলাও।

তবে পুরো বিতর্কে সবচেয়ে নোংরা হয়ে এসেছ হাইতিয়ান অভিবাসীদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা যে তারা প্রতিবেশীদের কুকুর বেড়াল চুরি করে খেয়ে ফেলছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের এমন বক্তব্যের একটা কড়া প্রতিবাদ প্রত্যাশিত ছিলো কমলা হ্যারিসের পক্ষ থেকে, যা অবশ্য দেখা যায় নি। তবে ভালো লেগেছে বিতর্কের উপস্থাপকের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে- না এ কথা সত্য নয়। সিটি মেয়রের বরাত দিয়ে তিনি বলেছেন, এমন কোনো ঘটনার কথা কারোই জানা নেই।

অর্থনীতি নিয়েই ট্রাম্পের আক্রমণটা ছিলো বেশি। বাইডেন প্রশাসন দেশের অর্থনীতিকে যে ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় নিয়ে গেছে সে কথা তুলে ধরেছেন। কমলা অবশ্য প্রতিবাদে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের এবারের প্রতিদ্বন্দ্বী বাইডেন নন, স্বয়ং তিনি। আর তার রয়েছে 'অপরচুনিটি ইকোনমি' নামের নতুন এক পরিকল্পনা যা, মধ্যবিত্তকে ঘিরে তৈরি। তাদের জীবন-জীবিকা নিশ্চিত করাই এর মূল লক্ষ্য। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ইনকাম ট্যাক্সে সহযোগিতা ছাড়াও সার্টআপে উৎসাহিত করতে প্রণোদনা প্যাকেজের সরাসরি ঘোষণা ছিলো কমলার।

যুদ্ধপ্রসঙ্গ খুব স্পষ্ট করেই এসেছে। সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে গাজা যুদ্ধ নিয়ে। এখানে রাজনীতি করার চেষ্টা দুই প্রার্থীর পক্ষ থেকেই ছিলো। যাতে ইসরাইলকে পক্ষে টানার চেষ্টা ছিলো। ট্রাম্পতো বলেই ফেললেন, কমলা প্রেসিডেন্ট হলে ইসরাইলের অস্তিত্বই থাকবে না। যেনো তিনিই একমাত্র ইসরাইলের রক্ষাকর্তা। আর কমলা যেভাবে এই বক্তব্য প্রতিহত করলেন, ‘না না না আমি ইসরাইল বিরোধী নই’, তাতেই স্পষ্ট হলো এই যুদ্ধে দুই পক্ষই প্যালেস্টাইন বিরোধী। কমলা যে এই যুদ্ধে বাইডেন নীতিই আপহোল্ড করবেন তা তিনি স্পষ্ট করেই বললেন, শুধু মিন মিন করে এইটুকু জানাতে চেষ্টা করলেন যে, প্যালেসটাইনে মানবতা ভুলণ্ঠিত হচ্ছে যার অবসান তিনি চান।

স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে প্রশ্ন ছিলো কমলার কিছু নিজস্ব পরিকল্পনা আছে যা তিনি বলেছেন। আর ওবামাকেয়ারতো রয়েছেই ডেমোক্র্যাটদের জন্য। কিন্তু ট্রাম্প ওবামাকেয়ারের ঘোরবিরোধী সে কথা বললেন। প্রশ্ন ছিলো তোমার কি পরিকল্পনা রয়েছে? ট্রাম্পের উত্তর- আমরা ভালো ভালো পরিকল্পনা হাতে নেবো। এখনই কিছু বলতে পারছি না।

এসবে হাসির পাত্র হয়েছেন ট্রাম্প। কিন্তু হাসার কেউ ছিলো না। কারণ দর্শক ছিলো না। দুই উপস্থাপক তো হাসতে পারেন না। কেবল হেসেছেন কমলা। নানাভাবে হেসেছেন, নানা মুখোভঙ্গিতে। তাতে ট্রাম্পের প্রতি কখনো সন্দেহ, কখনো অবজ্ঞা, কখনো উপহাসই প্রকাশ পেয়েছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের দিক থেকে একটাই এক্সপ্রেশন ছিলো- চরম অবজ্ঞা। যেনো তিনি কমলার দিকে তাকাতেই নারাজ ছিলেন। পুরো ভিডিও আরেকবার দেখলে দেখা যাবে খুব কমই দৃষ্টি বিনিময় হয়েছে দুই তার্কিকের। ট্রাম্পের চোখবন্ধ, শুণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা কিংবা নীচের দিকে তাকিয়ে থাকার দৃশ্যটাই বেশি মনে পড়ে। ফলে কোন উচ্চবাচ্য ছিলো না।

সবমিলিয়ে একটি নির্ভেজাল সাবলীল বিতর্ক হয়েছে একথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু কতটা গভীরের আলোচনা হয়েছে? দুই পক্ষ আগামী চার বছর তাদের রাজনৈতিক দর্শন কী হবে তা কতটা তুলে ধরতে পারলেন? তা স্পষ্ট হলো না। কিংবা বিতর্কটি কি আদৌ বুদ্ধিদীপ্ত কিছু ছিলো? কমলার কাছে কিছু প্রত্যাশা ছিলো কিন্তু তা কি পূরণ হলো?

মেয়ে বললো, 'বাবা প্রতিপক্ষ শক্ত না হলে তুমি কখনো বুদ্ধিদীপ্ত কিছু তুলে ধরতে পারবে না।' হয়তো ওর কথাই ঠিক। কিন্তু আরেকটি প্রশ্ন তো থেকেই যায়- বিতর্কের এই সুযোগ কতটুকুই নিতে পারলেন কমলা হ্যারিস। সকলেতো ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথা আগে থেকেই জানেন, কিন্তু কমলাকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে নতুন করে দেখছেন। তার সুযোগ ছিলো নিজের কথাগুলো বলার।

তাই প্রশ্ন- হতে পারে এই বিতর্কে কমলা হ্যারিসের জয় হলো, কিন্তু এর প্রভাব কি নভেম্বরের নির্বাচনে আদৌ পড়বে? সেকথা সময়ই বলে দেবে। আমেরিকানদের সে জন্য ৫ নভেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

বাই দ্য ওয়ে- এবারে কিন্তু আর কোনো বিতর্ক হবে না। এরপর সরাসরি ভোট। শিগগিরই শুরু হয়ে যাবে আগাম ভোট। সুতরাং কমলা হ্যারিস নাকি ডোনাল্ড ট্রাম্প এই নিয়ে আগামী কিছুদিন ভোটের মাঠ গরম থাকবে তাতে সন্দেহমাত্র নেই।