বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষার প্রশ্নপ্রত্র ফাঁসে গ্রেফতার বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীকে গ্রেফতারের পর প্রশ্নফাঁসে তার স্বীকারোক্তি, লেবাস ও অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ আল্লাহর রাস্তার দান করা নিয়ে তুমুল আলোচনা সমালোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে। তাকে বাটপার আখ্যায়িত করে অনেকেই পোস্ট দিচ্ছেন ধার্মিকরা বাটপার হয় না, বাটপাররাই ধার্মিক সাজে।
এখানে কয়েকটি শব্দ নিয়ে আগে আলোচনা করবো। পরবর্তীতে এ বিষয়ে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে কী বলা আছে এবং ইসলামে এর ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করবো।
ধর্ম শব্দটির আভিধানিক অর্থ, ‘যা ধারণ করে।’ ধৃ ধাতু + মন্ (প্রত্যয়) মিলেই ধর্ম । ধৃ ধাতুর অর্থ ধারণ করা। তাহলে ধর্ম অর্থ যা দাঁড়ায় তা হলো, মানুষের হৃদয় বা মন যা ধারণ করে তাই-ই ধর্ম। অর্থাৎ বাইরের লেবাস ধর্ম নয়।
বাটপাররা বাটপারি করতে গেলে একটি বিশ্বাসযোগ্যতার প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে তারা লেবাসকে ব্যবহার করে। এতে করে বাটপারি করার পথ সহজ হয়। এতে করে প্রকৃত ধার্মিকরা বিব্রত হন। কেননা শার্ট-প্যান্ট, স্যুট পরে দুর্নীতি করলে কেউ পোষাকের দোষ দেয় না, কিন্তু জুব্বা-পাঞ্জাবী পরে দুর্নীতি করলে পোষাকের দোষ হয়।
বাটপার শব্দের অর্থ - প্রতারণা করা, ডাকাত, লুটেরা, চোখের উপর যে চুরি করে। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে চোরের উপর বাটপারি। অর্থাৎ বাটপাররা চোর থেকেও ভয়ংকর। বাংলা একাডেমির সহজ বাংলা অভিধানের ২৬৬ পৃষ্ঠায় বাটপার অর্থ বলা আছে প্রতারক, ঠগ, লুটেরা।
ধর্ম সংস্কৃত শব্দ। আরবিতে ধর্মকে ‘দ্বীন’ বলা হয়। ইসলামি শরিয়াতে পরিভাষায় ‘দ্বীন’ হলো এক আল্লাহ তায়ালার প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্বাস রেখে তাকওয়া ও পরহেজগারিতা অর্জন করাকে ‘দ্বীন’ বলে।
ধোঁকা দেওয়া বা প্রতারণা করা ইসলামে নিষিদ্ধ তথা হারাম। প্রতারণার বিষয়ে ইসলাম খুবই কঠোর। একাধিক হাদিসে হযরত মুহম্মদ (স.) বলেছেন, ‘যে আমাদের ধোঁকা দেয় তথা প্রতারণা করে সে আমার উম্মতের দলভূক্ত নয় (মুসলিম, তিরমিজি, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ) ।
প্রশ্নফাঁস না হলে হয়তো ওই চাকুরিটি অন্যজনের হতে পারতো। সেক্ষেত্রে প্রশ্নপত্র ফাঁস অপরাধটি হলো হক্কুল ইবাদ বা বান্দার অধিকার হরণের শামিল। ইসলামের দৃষ্টিতে এটি ভয়ংকর এক অপরাধ। যে অপরাধ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ক্ষমা না করলে স্বয়ং আল্লাহও ক্ষমা করেন না।
প্রশ্নফাঁসে আবেদ আলী গ্রেফতারের পর সাংবাদিকদের বলেন, প্রশ্নফাঁসে অর্জিত অর্থ তিনি আল্লাহ রাস্তার দান করেছেন। ধোঁকা বা প্রতারণার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ দিয়ে দান-সহযোগিতা, ধর্মীয় কাজ কুরবানি, মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ, জনসাধারণের জন্য রাস্তাঘাট-কালভার্ট নির্মাণ কোনোটিই বৈধ নয়। আর এতে সাওয়াবও মিলবে না।
কেননা দান-সহযোগিতা, সমাজ সংস্কারসহ জনকল্যাণমূলক কাজ কোনো ব্যক্তির জন্য আবশ্যক নয়। আর ধোঁকা বা প্রতারণা ইসলামে হারাম ও নিষিদ্ধ কাজ।
প্রতারণা রাষ্ট্রীয় আইনেও জঘন্য অপরাধ। বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৪১৫ ধারায় প্রতারণার সংজ্ঞা ও ৪২০ ধারায় এ অপরাধের শাস্তি বর্ণনা করা হয়েছে। যা সর্বোচ্চ ৭ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়াও একই আইনের ৪০৬, ৪০৮ এবং ৪০৯ ধারায় বিশ্বাস ভঙ্গের অপরাধের শাস্তির কথা বর্ণিত আছে। দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারাটি বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশনের সিডিউলভূক্ত। এ অপরাধে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
সম্প্রতি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের আয়োজন চলছে। এজন্য সরকারীভাবে নীতি প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে। কোনটা আগে কোনটা পরে সংস্কারের আওতায় আসবে তা নিয়ে নানা মতামত ও পরামর্শ শোনা যাচ্ছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের জন্য সবার আগে দাবি রাখে কোন ক্ষেত্রগুলো তা নিয়ে অনেকটা হিমশিম খাবার মতো অবস্থা তৈরী হয়েছে।
সংস্কারের আগেই বিভিন্ন দাবি পূরণের জন্য দল বেঁধে মাঠে নেমে যাচ্ছে বঞ্চিত মানুষ। ফলে প্রতিদিন সূর্যের আলো ফোটার আগেই নানা সেক্টরে নতুন করে সমস্যার কথা শোনা যাচ্ছে। যেন সবার ভেতরে এত বছর ধরে শুধু সমস্যার পাহাড় জমা হয়েই ছিল। কেউ এতদিন তাদের সমস্যাগুলো মুখফুটে কারো কাছে প্রকাশ করার সুযোগ পায়নি বলে মনে হচ্ছে। তার মূল কারণ সব সেক্টরে বিভেদের দৌরাত্ম্য এতটাই ফাঁরাক তৈরি করেছিল যে, একটি বঞ্চিত শ্রেণি চরম হতাশ হয়েও তাদের কষ্টের কথা সাহস করে বলতে পারেনি। একটি ইতিবাচক পরিবেশের অভাব ও অজানা ভয় তাদেরকে সবসময় তাড়িয়ে বেড়িয়েছে।
মোটাদাগে, সেই বিভাজনটা চরম আয় বৈষম্যের। কোন কাজকর্ম না করে শুধু তোষণ-তোয়াজের মাধ্যমে কেউ টাকার পাহাড় গড়েছেন। কেউবা দলীয় লেজুড়বৃত্তি করে নিজের দুর্নীতি, জালিয়াতি ইত্যাদিকে আড়াল করে বিত্তশালী হয়ে উঠেছেন। অপরদিকে অবৈধ মজুতদারি, কালোবাজারি, দ্রব্যমূল্যস্ফীতি ঘটিয়ে একশ্রেণির ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফা হাতিয়ে নিয়ে নিম্নশ্রেণির মানুষকে শোষণের যাঁতাকলে নিষ্পেষণ করেছেন। যার প্রভাব সমাজে এখনও বিদ্যমান।
এর সাথে তাল মিলিয়ে বেড়ে গেছে অবৈধ ‘উপরি কামাই’ করার প্রবণতা। বিশেষ করে সরকারি চাকুরীজীবিদের অনেকের মধ্যে অবৈধ উপরি কামাই লিপ্সা এতটাই বেড়ে গেছে যে, তারা নিজেদের দায়িত্ব ভুলে গিয়ে বৈধ বেতনের পাশাপাশি আরো কতিপয় অবৈধ আয়ের পথ সৃষ্টি করে মানুষকে হেনস্থা শুরু করে দিয়েছিল। নিয়োগ, বদলি, প্রমোশনের ক্ষেত্রে কোটি কোটি টাকা আয়ের গোপন সুড়ঙ্গ তৈরির কথা নতুন করে লিখে বলার অবকাশ নেই।
বিভিন্ন নির্মাণ কাজে কমিশনের নামে অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের পরিমাণ জাতিকে হতবাক করে তুলেছে। এর পাশাপাশি প্রতিটি সেবা ক্ষেত্রে কর্মচারীদেরকে খুশি করার নামে ঘুষ তথা অবৈধ আয়ের আঞ্জাম করে না দিলে কাজ সম্পন্ন করা দুষ্কর হয়ে উঠেছিল। এগুলোই ঘুষ-দুর্নীতি বা উপরি আয়ের রুট হিসেবে বিবেচিত। এর বৃহত্তর রূপের আবির্ভাব হয়েছিল জরুরি সরকারি ক্ষেত্রগুলোতে অসংখ্য ‘হোয়াইট কলার ক্রাইম’ নামে। যেটা আমাদের দেশে মেগা দুর্নীতিবাজ খেতাবে পরিগণিত হয়ে মানুষে-মানুষে আয়বৈষম্যকে পরিহাস করতে শুরু করেছে। যার প্রভাবে সামাজিক বৈষম্য চরমে উঠে গিয়ে একটি সুসংগঠিত সামাজিক আন্দোলন সূচিত হয়েছিল। কিছুদিন আগে সেসকল বৈষম্য ঠেকাতে সাধারণ মানুষ সামাজিক ‘ফায়ারওয়াল’ বা অগ্নিদেয়াল তৈরি করে বিদ্রোহী হয়ে রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছিল।
এর একমাস না পেরুতেই বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনসৃষ্ট সংস্কারকগণ মাঠে নামার সুযোগ পেয়ে গেছেন। যারা সংকল্পবদ্ধ হয়েছেন বিভিন্ন জরাজীর্ণতাকে মেরামত করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একটি গতিশীল সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে উপহার দেবার। কিন্তু অতিদ্রুত কীভাবে সেটা সম্ভব?
সেজন্য বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা-পর্যালোচনা শুরু হয়ে গেছে। এর পক্ষ-বিপক্ষ যাচাই-বাছাই করে বক্তব্যও শোনা যাচ্ছে। দেশের সংসদীয় নীতি নির্ধারকগণ ৫ আগষ্টের পর পদ হারিয়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন। তবে দেশের বিজ্ঞ গবেষক ও অভিজ্ঞ পরামর্শকগণ মন খুলে কথা বলা, মতামত ও পরামর্শ দেবার সুযোগ পাবার সুবাদে সেমিনার সিম্পোজিয়াম সোচ্চার হয়ে উঠছে। এটাই মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা লাভের দ্বার উন্মোচন করে দিয়েছে। এরসাথে বিভিন্ন গণমাধ্যমের কোণঠাসা গুণী ব্যাক্তিগণ হাফ ছেড়ে বেঁচেছেন বলে মনে হচ্ছে।
মাত্র একমাস পূর্বে একদল ‘গুণী’ সাংবাদিক তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে নানা পরামর্শ দিতে গিয়েছিলেন। সেসব কথা এখানে আর নতুন করে বলার অপেক্ষা নেই। সম্প্রতি নতুন অন্তবর্তী সরকারের সাথে আরেকদল ‘গুণী’ সাংবাদিক তাদের মনের কথা প্রকাশ করতে পেরেছেন। কেউ কেউ প্রশ্ন করছেন-সেই ত্রিশজন কে ছিল আর এই ত্রিশজন কারা? এখন ‘সেই’ আর ‘এই’ নিয়ে বিতর্ক করার সময় নয়। তবে পরের দৃশ্যটি জাতিকে নতুন করে আশার আলো জাগাতে যাচ্ছে বলে বিশ্লেষকগণ মনে করছেন। পরবর্তী ত্রিশজনের কথা কিছুটা হলে এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করা যাক।
অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক সভায়, ‘গণমাধ্যমকে সরকারের ভুলগুলো ধরিয়ে দেবার আহবান করেছেন।’ তিনি ভুলগুলো ধরিয়ে দিয়ার পাশাপাশি সেগুলো শুধরানোর জন্য উপায় বাতলে দেয়ার পরামর্শ চেয়েছেন। কারণ, আমরা জানি কোন কিছুর ভুল ধরা না হলে সেটা শুধরানোর প্রশ্নই আসে না। ভুল চিহ্নিত করাটাই হলো সমাধানের প্রথম পদক্ষেপ।
এতদিন ভুল যাতে কেউ না ধরে সেজন্য কঠিন পর্যবেক্ষণ চলতো। ভুল চোখে পড়তে পারে এমন ঘটনা বা অবস্থার প্রচারণা যাতে না হতে পারে সেজন্য গণমাধ্যমের উপর নজরদারি করা হতো। এমনকি সব ধরনের বড় সমস্যা থেকে রাষ্ট্রের কর্ণধারকে গোপনে-আড়ালে রাখার ব্যবস্থা হতো। এজন্য বহু অভিজ্ঞ সম্পাদক, গণমাধ্যমকর্মী সদা ভয়ে ভয়ে কাজ করতেন বলে জানা যেত। সবচেয়ে দুর্দিন গেছে মাঠ ও চারণ সাংবাদিকগণের ক্ষেত্রে। কেউ একটু বেশী নড়চড় করলে তার উপর নেমে আসতো ভয়ংকর রকমের চাপ, নির্যাতন আর হতাশা।
সেই চাপ ও কঠিন অবস্থা আর ফিরে চান না কোন মুক্তমনের গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ত্বগণ। সেসব নীতির দ্রুত অবলোপন চান তারা। অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা গণমাধ্যমের উপর যে উদার দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছেন তা একটি সত্যিকারের মুক্ত, গতিশীল, সক্রিয় বা ‘ভাইব্রান্ট’ গণমাধ্যম কাঠামো তৈরিতে সহায়ক হতে পারে। যেটা দেশের প্রশাসনিক সংস্কার ও নানা ক্ষেত্রে চলমান বৈষম্য নিরসনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রশ্ন হলো এই মূহুর্তে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কোনগুলো? কোন কোন সংস্কার দেশকে দুর্নীতির রাহু থেকে মুক্তি দিয়ে আর্থ-সামজিক বৈষম্য নিরসনে দ্রুত সাহায্য করতে পারে? অবশ্যই সংস্কার হতে হবে টেকসই ধরণের। এর জন্য নানা কমিশন গঠনের পদক্ষেপ চলছে। একজন রাষ্ট্রচিন্তাবিদ বলেছেন, সবার আগে প্রয়োজন সংবিধান সংস্কার। একটি সুঠাম আইন ও সাংবিধানিক কাঠামোর উপস্থিতি ব্যতিরেকে রাষ্ট্রীয় সংস্কার কাজে হাত দেয়া মুষ্কিল। অতীতের সকল কালাকানুন বিলোপ ছাড়া নতুন পরিবর্তন চাওয়া অবান্তর।
এর পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, পরিবেশ সুরক্ষা কমিশন, অর্থ ও সামাজিক নিরাপত্তা কমিশন পুনর্গঠণ করা প্রয়োজন। সামাজিক নিরাপত্তা কমিশনের আওতায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, তথ্যসুরক্ষা, চাকুরি, যুব-নারী-শিশু উন্নয়ন, সামাজিক অপরাধ, পরিবহন, স্থির দ্রব্যমূল্য, বয়স্ক কল্যাণ, বীমা, পেনশন ইত্যাদি সবকিছু অর্ন্তভূক্ত করা যেতে পারে। উন্নত বিশ্বে এসব কিছুই মানুষের কল্যাণে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে আওতায় বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
উল্লিখিত সবকিছুর মধ্যে জনগণকে নিজ নিজ কর্মঘন্টা নষ্ট না করার জন্য সজাগ ভূমিকা পালন করতে হবে। নিজ কাজের জবাবদিহিতা নিজেকেই নিশ্চিত করে অপরের ‘হক’ বা অধিকার ক্ষুন্ন না করার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। সকল প্রকার অবৈধ লোভ-লালসাকে জলাঞ্জলি দেবার মাধ্যমে অবৈধ উপায়ে ‘উপরি কামাই’ গ্রহণ থেকে বিরত থাকার জন্য প্রতিজ্ঞা করতে হবে।
অবৈধ ‘উপরি কামাই’ গ্রহণ থেকে সমাজে আয়বৈষম্য সৃষ্টি হয়, দ্রব্যমূল্যস্ফীত হয় এবং ভোগবৈষম্য ঘটে। কারণ সৎমানুষ উপরি কামইকে ঘৃণা করে। অসৎদের সাথে তুলনায় সৎ ব্যক্তির আয় কমে যাবার ফলে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সঞ্চয়, নিরাপত্তা ইত্যাদি সবকিছুতে হযবরল তৈরি হয়। উপরি কামই উপভোগকারীদের বিপরীতে চরম বৈষম্যের ঘেরাটোপে সৎ, দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ দীর্ঘদিন যাবত ভূগছেন। তাই একটি টেকসই সংস্কার সূচিত হোক সকল শ্রেণির মানুষের কল্যাণে।
লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন
ইমেইল: [email protected]
অসুস্থ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসা নিয়ে আলোচনা চলছে দীর্ঘদিন। সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আইনের দোহাই দিয়ে তাকে বিদেশ পাঠানো হয়নি। তখন তিনি ছিলেন আদালতের রায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত, এবং দণ্ডপ্রাপ্তের বিষয়ে আইনি সীমাবদ্ধতা বারবার তোলে ধরতে চেয়েছেন সাবেক সরকারের দায়িত্বশীলতা। তখনকার আলোচনা যতটা ছিল আইনি, তারচেয়ে বেশি ছিল রাজনৈতিক। আওয়ামী লীগ আইনের দোহাই দিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসায় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে—এটাও ছিল যেমন রাজনীতি, তেমনি আইন সামনে এনে তাকে বিদেশ যেতে না দেওয়াও ছিল আওয়ামী লীগের রাজনীতি।
এখন বেগম খালেদা জিয়া মুক্ত। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে তার সাজা মওকুফ করেছেন। এক-এগারোর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক আমলে দায়ের দুই মামলার রায় হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় পাঁচ বছরের সাজা পেয়ে কারাগারে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। ওই বছরের অক্টোবরে হাইকোর্টে আপিল শুনানি শেষে সাজা বেড়ে হয় ১০ বছর। এরপর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আরও সাত বছরের সাজা হয় বিএনপি চেয়ারপারসনের। আদালতের রায়ে সাজা হলেও সবশেষ কয়েক বছর ধরে অবশ্য কারাগারে থাকতে হয়নি তাকে। পরিবারের আবেদনের প্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের বাসায় সাজা ভোাগের সুযোগ দিয়েছিলেন। এবং এটাও আইনি প্রক্রিয়া ধরে হয়েছে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরদিন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার দণ্ড মওকুফ করেন। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বিভিন্ন দলের বৈঠকে সকল দল রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ জানালে তিনি এই সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করেন।
আওয়ামী লীগের আমলে বিএনপি রাজনৈতিক ভাবে ছিল কোণঠাসা এবং গণমামলা ও গণগ্রেফতারে জর্জর। সরকারবিরোধী কোন কর্মসূচিকে সহ্য করা হতো না। বিদেশে নিয়ে খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসা বিষয়ক সকল আলোচনা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল, এবং প্রতিবারই আইনের দোহাই দেওয়া হয়েছে। ওই সময় বিদেশে খালেদা জিয়ার চিকিৎসার আবেদন এবং সরকারের প্রত্যাখ্যান দুটোই বিএনপির রাজনীতির জন্যে সহায়ক হয়েছে।
এখন মুক্ত খালেদা জিয়ার রাজনীতি করা এবং বিদেশে চিকিৎসার জন্যে যাওয়ায় কোন বাধা নেই। চাইলেই তিনি যে কোন দেশে যেতে পারেন। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় বিএনপি যেভাবে তার বিদেশে চিকিৎসা নিয়ে তৎপর ছিল, এখন সে তৎপরতায় অনেকটাই ভাটা পড়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের এক মাস পার হয়ে গেলেও খালেদা জিয়া বিদেশ যাচ্ছেনই এমন সুস্পষ্ট বার্তা এখনো আসেনি। এনিয়ে কিছু আলোচনা চলমান যদিও, তবু তিনি যে বিদেশ যাচ্ছেনই এমনটা মনে হচ্ছে না। তার চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা বিশেষজ্ঞরা এখন বলছেন, তিনি বিমানে চড়ার মতো ফিট এখনো নন। অথচ আগে যখন জোর আলোচনা চলছিল, তখন তার শারীরিক অবস্থা ছিল এখনকার চাইতেও খারাপ।
তিনি ফিট না থাকলেও তার বিদেশ যাওয়া নিয়ে আলোচনার খবর বার্তা২৪.কম, সমকালসহ একাধিক গণমাধ্যমে এসেছে। এরবাইরে আরও খবর হচ্ছে, ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার সারাহ ক্যাথরিন কুক গুলশানের বাসায় গিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ। খালেদা জিয়ার প্রয়াত ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান সিঁথি গত বৃহস্পতিবার লন্ডন থেকে ঢাকায় এসেছেন। এগুলো খালেদা জিয়ার যুক্তরাজ্যে যাওয়ার ইঙ্গিত বলে মনে করছেন অনেকেই। বিএনপি চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও মেডিকেল বোর্ডের সমন্বয়ক অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেছেন, ‘আমরা যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের কয়েকটি হাসপাতালের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। ওইখানে হাসপাতাল নির্বাচনসহ আরও কিছু প্রক্রিয়া রয়েছে। ম্যাডামের কন্ডিশন এখনও বিমানে ট্রাভেল করার মতো নয়। ইউকেতে নেওয়া হলে আট থেকে ১৩ ঘণ্টা সময় লাগে অথবা ইউএসএ নিতে হলে ১৮ থেকে ২১ ঘণ্টা ফ্লাইং আওয়ার লাগবে। কাজেই এই যাত্রার জন্য শারীরিক সুস্থতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই কিছুটা সময় লাগবে। বেশ কিছু জটিল চিকিৎসা করাতে অনেকটা সময় ম্যাডামকে বিদেশে থাকতে হবে।’ মেডিকেল বোর্ডের সদস্য ডা. আল-মামুন বলেছেন, ‘বিমানে ভ্রমণের জন্য শারীরিকভাবে তিনি এখনও পর্যন্ত ফিট নন। আরও কিছুটা সময় লাগবে। যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যে যেতে হলে স্বাভাবিকভাবেই দীর্ঘ সময় বিমানে থাকতে হবে। এসব নানা বিষয় নিয়ে আমরা চিন্তাভাবনা করছি। উনার জন্য দেশের বাইরে থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স আনা হবে।’ অর্থাৎ খালেদা জিয়ার বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত না হলেও এর প্রক্রিয়া চলমান।
খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে। প্রয়োজনে তিনি বিদেশ যেতে পারেন, এখানে এখন কারো আপত্তির কিছু নাই। তবে তিনি আগের মতো শারীরিক অবস্থার মধ্যে নন বলে ধারণা করা যায়। অন্তত আগে যেখানে তাকে সকাল-বিকাল বাসা-হাসপাতাল করতে হতো এখন তার দরকার পড়ছে না। এমন অবস্থায় তার দেশত্যাগে রয়েছে রাজনৈতিক ঝুঁকি।
শেখ হাসিনার সরকারের পতন এবং তার দেশত্যাগের পর অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দমননীতি চালিয়ে যাচ্ছে, গণমামলা ও গণগ্রেফতারকে যেভাবে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে, গণমাধ্যমে দলটিকে নিয়ে যেভাবে প্রচারণা চলছে তাতে সহসা রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগের ফিরে আসা কঠিন। এমন অবস্থায় স্বাভাবিক ভাবেই দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপি রাজনীতির এই শূন্যস্থান পূরণের কথা থাকলেও এখানে তৃতীয় পক্ষের ইঙ্গিত মিলছে। বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং সরকারের বিভিন্ন অংশের মধ্যে একাত্তরের ভূমিকার কারণে বিতর্কিত জামায়াতে ইসলামীকে হাজির করা হচ্ছে তাতে তারা কিংস পার্টিরই মর্যাদা পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। এর পাশাপাশি আছে ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন দল-উপদলের সরব উপস্থিতি। আওয়ামী লীগ-বিএনপি এক দল বাদে আরেক দল দেশ চালিয়েছে, এখন নতুন কেউ দরকার এমন একটা আওয়াজ তোলার চেষ্টাও চলছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই বিএনপি খুশি। আওয়ামী লীগকে শেষ করে দেওয়ার নানামুখী চেষ্টায় বিএনপি সরাসরি না থাকলেও প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছেন। আওয়ামী লীগ বিহীন রাজনীতির মাঠে বিএনপিই স্বাভাবিকভাবেই একমেবাদ্বিতীয়ম, কিন্তু এর বাইরেও যে অন্য কথা থাকতে পারে, এটা সাম্প্রতিক রাজনীতির গতিচিত্র মনে করিয়ে দিচ্ছে। গণমাধ্যমে এখন বিএনপির চাইতে জামায়াতের কভারেজ বেশি, বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের সঙ্গে জামায়াত নেতাদের সাক্ষাতের চিত্রও সামনে আসছে, আন্দোলনের হতাহতদের আর্থিক সহায়তা নিয়ে বাড়িবাড়ি যাচ্ছেও জামায়াত। তাদের নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিএনপির চাইতে বেশি হচ্ছে।
বেগম খালেদা জিয়া বিএনপির প্রধান ব্যক্তি। তারেক রহমান খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও তিনি একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন আদালতে দায়ের মামলাগুলো শুক্র-শনিবার নির্বিশেষে প্রত্যাহার হলেও সাজা মওকুফ হয়নি। সাজা মওকুফ করতে বা আইনি প্রক্রিয়ায় মুক্তি পেতে তাকে দেশে আসতে হবে, কিন্তু তার পাসপোর্ট নবায়ন হয়নি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাসেও তারেক রহমানের পাসপোর্ট নিয়ে নতুন কোন খবর নেই। ফলে তার দেশে ফেরা এখনো অনিশ্চিত।
নিম্ন আদালত থেকে একের পর এক মামলা প্রত্যাহার হলেও মূল মামলা ও সাজা মওকুফ হয়নি তারেক রহমানের। রাষ্ট্রপতি সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে তার দণ্ড মওকুফ করতে পারলেও এটা নির্ভর করছে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। কিন্তু সরকার এখন যে পথে এগুচ্ছে তাতে বিষয়টি যত সহজে চিন্তা করা যাচ্ছে, বাস্তবায়ন তত সহজ বলে মনে হচ্ছে না। ফলে বেগম খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্যে বিদেশ গেলে এবং তারেক রহমান দেশ ফিরে আসতে না পারলে সুবিধাজনক রাজনৈতিক অবস্থায় বেশ অসুবিধায় পড়ে যেতে পারে বিএনপি।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগে রাজনীতিতে ‘মাইনাস-ওয়ান’ হয়ে গেছে; খালেদা জিয়া যদি চিকিৎসার জন্যে বিদেশ যান, সেটা কি তবে ‘মাইনাস-টু’? এক-এগারোর সরকার অনেক চেষ্টা করে ‘মাইনাস-টু’ করতে পারেনি বিশেষ করে খালেদা জিয়া দেশ ত্যাগ না করায়, ওই সময়ও শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগ করেছিলেন। আগের মতো রাজনীতিতে ‘মাইনাস-ওয়ান’ ইতোমধ্যে হয়ে গেছে; এবার খালেদা জিয়া বিদেশ গেলে হয়ে যেতে ‘মাইনাস-টু’ও! আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন দেশ শাসন করলেও বিকল্প নেতৃত্ব গড়তে পারেনি বা আগ্রহ দেখায়নি; বিএনপির মধ্যে তারেক রহমানের মাধ্যমে বিকল্প নেতৃত্ব থাকলেও আইনি বাধায় তিনি দলে থেকেও দেশের বাইরে। ফলে খালেদা জিয়ার বিদেশ গমনের রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়ে নির্ভার থাকা বুদ্ধির কাজ হবে না।
এখানে তবে মুখোমুখি হয়ে পড়েছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও রাজনৈতিক ঝুঁকি। স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিরসনে বেগম খালেদা জিয়াকে বিদেশ পাঠানোর পাশাপাশি রাজনৈতিক ঝুঁকি যাতে ভয়াল রূপ পরিগ্রহ না করে সেদিকেও লক্ষ্য রাখা উচিত বিএনপির।
বাংলাদেশের ব্যাংক খাত দীর্ঘদিন ধরেই নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটতরাজ, বিচারহীনতা আর রাজনৈতিক আজ্ঞাবহতার শিকলে বাধা। অতীতে এই খাতকে সংশ্লিষ্ট সকলে মিলেমিশে পরিকল্পিতভাবে মগের মুল্লুক বানিয়েছে। এর ফলে রক্ষক ভক্ষক হয়েছে, আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে বহু অযাচিত ব্যক্তি, সৃষ্টি হয়েছে এস আলম ও সালমানের মতো অর্থনৈতিক ডনদের। এভাবে গুটি কয়েক ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের হাতে কুক্ষিগত ব্যাংক খাত দেশের সামগ্রিক এবং সুষম অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে ভুমিকা রাখতে পারছেনা। মগের মুল্লুকে পরিণত হওয়া ব্যাংক খাতের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থাও এখন প্রায় শুন্যের কোঠায়। যে কয়েকটি পেশা বা পেশাজীবীর প্রতি মানুষের অশ্রদ্ধা এবং ঘৃণা কাজ করে, তার মধ্যে এখন ব্যাংকাররাও অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। তবে আশার বাণী হচ্ছে- বাংলাদেশে দীর্ঘদিনের বৈষম্য, দুর্নীতি এবং অর্থনৈতিক অসমতা দূর করতে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যাপক সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করছে, সচেতন ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের কাছ থেকেও আসছে নানা ধরনের সংস্কার প্রস্তাব ও দাবি।
এটা অনস্বীকার্য যে ব্যাংক খাত দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। তাই এর সংস্কারও অত্যন্ত জরুরি, যা সরকারের শীর্ষ তিন অগ্রাধিকারের একটি হওয়া উচিত। এই সংস্কারের জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর রোডম্যাপ। এই প্রেক্ষিতে, ব্যাংক খাতের সংস্কারের জন্য কিছু প্রস্তাব তুলে ধরছি, যা স্বচ্ছ ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং বৈষম্যহীন ও সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরদের মূল্যায়নে আস্থা ভোট চালুকরণ
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরদের যোগ্যতা, কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে প্রতি ২ বছর পরপর সব তফসিলি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমডি/সিইওদের মাধ্যমে আস্থা/অনাস্থা ভোট চালু করা উচিত। এই ভোটের মাধ্যমে গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরদের স্ব স্ব পদে থাকার উপযুক্ততা নির্ধারণ করা হবে, যা ব্যাংকিং খাতে কার্যকর নেতৃত্ব ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।
শীর্ষ ব্যাংকারদের নিয়োগ ও পদোন্নতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ
ব্যাংকের এমডি নিয়োগের মতো এমডির অধস্তন আরো ৪ পদ পর্যন্ত ব্যক্তিদের এবং প্রধান কার্যালয়ের সকল বিভাগীয় প্রধান, বিভাগীয় শহরের সব শাখার ম্যানেজারদের নিয়োগ ও প্রমোশন বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক পরিচালিত / অনুমোদিত হতে হবে।
প্রমোশন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিতকরণ
যারা ৬ মাস, ১ বছর বা ২ বছরের ব্যবধানে ত্বরিত প্রমোশন পেয়েছেন, তাদের প্রমোশন পাওয়ার পেছনে কী কারণ ছিল, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। যদি কোনো ব্যাংকার যোগ্যতা ছাড়াই প্রভাব খাটিয়ে বা চাপ তৈরি করে প্রমোশন পেয়ে থাকেন, তবে তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ব্যাংকগুলোতে ভিন্ন ভিন্ন স্যালারি স্কেল এবং প্রমোশন eligibility টাইম স্প্যান থাকার ফলে ব্যাংক খাতে বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে। কিছু ব্যাংকে প্রমোশন জন্য ২ বছর সময় বিবেচনা করা হয়, আবার কিছু ব্যাংকে ৩ বছর সময় ধরা হয়। কেউ কেউ আবার ৫ বছরেও প্রমোশন প্রদান করে না। তাই প্রমোশনের জন্য সব ব্যাংকেই এক অভিন্ন টাইম স্প্যান বিবেচনা করা উচিত, এবং প্রমোশন প্রক্রিয়া নিয়মিত রেখে প্রতি বছর যোগ্যদের প্রমোশন প্রদান করা উচিত। তাছাড়া পারফরম্যান্স মূল্যায়ন যেহেতু ডিসেম্বর ভিত্তিক, সেহেতু প্রমোশনগুলো জানুয়ারির ১ তারিখ থেকেই কার্যকর করা উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংককে এ বিষয়ে নজরদারি রাখতে হবে। এর মাধ্যমে যোগ্য কর্মীদের মধ্যে মনোবল এবং বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে, যা একটি কার্যকর এবং ন্যায়সঙ্গত ব্যাংকিং সংস্কৃতি গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।
নিরপেক্ষ সিলেকশন কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ
সরকারি ব্যাংকের নিয়োগ প্রক্রিয়ার অনুসরণে বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যম ও নিচের সারির কর্মকর্তাদের নিয়োগও ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির মাধ্যমে হতে হবে। নিয়োগ কার্যক্রম ত্বরানিত করতে কমিটিতে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকার, বিআইবিএম এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। তাছাড়া কমিটির নিরপেক্ষতার স্বার্থে ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির একজন সদস্যের মেয়াদ সর্বোচ্চ ৫ বছর করা যেতে পারে।
প্রকৃত আর্থিক অবস্থা উন্মোচন
সরকারি খরচে আগামী ৩-৬ মাসের মধ্যে আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা ফার্ম দ্বারা প্রতিটি ব্যাংকের বিশদ নিরীক্ষা করে প্রকৃত আর্থিক অবস্থা নির্ণয় করে ব্যাংকগুলোকে ৩ বা ৪টি গ্রেডে ফেলে সংস্কার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়াও নিয়ম করা যেতে পারে- নিয়মিত নিরীক্ষার অতিরিক্ত হিসেবে ৫ বছর পরপর প্রতিটি ব্যাংককে বিদেশি নিরপেক্ষ নিরীক্ষা ফার্ম দ্বারা নিরীক্ষা করাতে হবে।
ঋণ অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা
ঋণ অনিয়মের সাথে জড়িত প্রমাণিত ব্যাংকার ও বোর্ড সদস্যদের অনতিবিলম্বে সাসপেন্ড করে আগামী ৬ মাসের মধ্যে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। এছাড়াও, আইন করে ঋণ জালিয়াতির শাস্তি হিসেবে সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা, আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং ক্ষেত্র বিশেষে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা প্রয়োজন।
ঋণ খেলাপিদের অধিকার খর্বিত করে সামাজিকভাবে বর্জন
ঋণ খেলাপিদেরকে ঋণ খেলাপি বলার পাশাপাশি আরও অসম্মানজনক কোনো সম্বোধন করা যেতে পারে এবং তাদেরকে তীব্রভাবে বয়কট ও একঘরে করে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন- তাদের পাসপোর্ট ও ভিসায় ঋণখেলাপি সিল মেরে দেওয়া, বাসা-বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ঋণখেলাপির সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়া যেতে পারে। তাদের মৌলিক অধিকারের অতিরিক্ত সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া যেতে পারে, যেমন- বাসায় ও অফিসে এসির ব্যবহার অনুমোদন না করা; বিমানের ভিআইপি টিকেট না দেওয়া; জমি-প্লট-ফ্ল্যাট ও গাড়ির রেজিস্ট্রেশন করতে না দেওয়া; মূল্যবান জুয়েলারি ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ করা; ব্যবসায়িক লাইসেন্স ইস্যু বা নবায়ন না করা; রাজনীতি, ব্যবসা, ধর্মীয় বা সামাজিক সংগঠনের কোনো পদে না রাখা; সভা-সমিতির প্রধান না করা ইত্যাদি। কোনো ভিজিটর তাদের ওয়াবসাইটে ভিজিট করলেই “আমি ঋণখেলাপি” এই পপ-আপ ম্যাসেজ দেখতে পাওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে হবে। না হলে তাদের ওয়েবসাইট ব্লক করে রাখতে হবে। তাদেরকে কেউ ফোন করলে, কলার যেন ওয়েলকাম টিউন হিসেবে শুনতে পায়, “আপনি একজন ঋণখেলাপিকে কল করেছেন”!
আয়কর রিটার্নের সম্পদ ও দায়ের চূড়ান্ততা
টিআইএনধারী ঋণ গ্রহীতাগণ রিটার্নে নিজেদেরকে মিসকিন আর ঋণ প্রস্তাবে নিজেদেরকে রাজা হিসেবে উপস্থাপন করেন। তাই এই দ্বৈত আর্থিক বিবরণী রোধ করতে, টিআইএনধারীদের ব্যাংক ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে রিটার্নে প্রদর্শিত সম্পদ, দায়, আয়-ব্যয়কেই চূড়ান্ত হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। ব্যাংকগুলোকে রিটার্নের ফিন্যান্সিয়াল বিবরণীর উপর ভিত্তি করেই ঋণগ্রহীতার ক্রেডিট ওয়ার্দিনেস অ্যাসেস করতে হবে।
মোবাইল ব্যাংকিং হিসাবের লেনদেনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা
আয়কর রিটার্নে মোবাইল ব্যাংকিং হিসাবের লেনদেন এবং স্থিতিকে উল্লেখ করার বা বিবরণী সংযুক্ত করার বাধ্যবাধকতা না থাকার কারণে, মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্টগুলো ঘুষ গ্রহণের অন্যতম নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাগণ। তাই প্রত্যেক মোবাইল ব্যাংক একাউন্টের লেনদেনে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে এ হিসাবের লেনদেনকেও আয়করের আওতায় আনতে হবে। একজন ব্যক্তির নাম বা আইডি দিয়ে একের অধিক মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব খুলাও নিষিদ্ধ করতে হবে।
ব্যাংকারদের সম্পদ রিপোর্টিং ও সঞ্চয়ী হিসাব সীমাবদ্ধতা
একজন ব্যাংকারের নামে ২টির বেশি সঞ্চয়ী হিসাব থাকতে পারবে না। প্রতি বছর ব্যাংকারদেরকে তাদের ব্যাংক ব্যালেন্স এবং জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট, অলংকার, গাড়ি ইত্যাদি সম্পদ ও দায়ের হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিতে হবে। এছাড়া, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা তাদের নিজেদের হিসাব অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে রিপোর্ট করবেন। এছাড়াও ৫ বছর পরপর প্রত্যেক ব্যাংকার তাদের স্ত্রী/স্বামী এবং সন্তানদের সম্পদ ও দায়ের হিসাবও জমাপ্রদান করবেন। ব্যাংকের পরিচালকদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম বা আরও কড়া নিয়ম করা যেতে পারে।
ব্যাংকিং খাতে অভিন্ন পদসোপান ব্যবস্থা
সব ব্যাংকে সর্বোচ্চ ১০টি পদসোপান রেখে একটি অভিন্ন hierarchical designation প্রবর্তন করা উচিত (functional designation ভিন্ন হতে পারে)। এই ব্যবস্থা ব্যাংকিং সেক্টরে পদ ও দায়িত্বের স্বচ্ছতা ও সামঞ্জস্য নিশ্চিত করবে, যা পরিচালন ও প্রশাসনিক কার্যক্রমকে সহজতর করবে। অভিন্ন পদসোপান কাঠামো ব্যাংকগুলোর মধ্যে পার্থক্য দূর করবে এবং ক্যারিয়ার উন্নয়ন ও মূল্যায়নে এক ধরনের সামঞ্জস্য বজায় রাখবে।
ডিজিটাল লেনদেনের বাধ্যবাধকতা
অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা নিশ্চতকল্পে ও দুর্নীতি রোধে no-frill ক্যাটাগরির ব্যক্তিগণ বাদে অন্যদের ক্ষেত্রে ৫ হাজার টাকার অধিক লেনদেন ডিজিটাল চ্যানেলের মাধ্যমে সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা জরুরি। এই পদক্ষেপ টাকা ছাপানোর খরচ কমাবে এবং নগদ অর্থের অনিয়ন্ত্রিত ও ট্রেসলেস প্রবাহ কমিয়ে এনে লেনদেনের যথাযথ ট্র্যাকিং এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে।
এক ব্যক্তি, এক পরিচয়পত্র নীতি
একজন ব্যক্তির নামে একাধিক পরিচয়পত্র, যেমন- একইসাথে জন্ম নিবন্ধন, এনআইডি, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স ইত্যাদি থাকার সুযোগে একজন ব্যক্তি একাধিক সেভিংস একাউন্ট খুলতে পারছে এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে নামে-বেনামে সেবা গ্রহণ করতে পারছে। ফলশ্রুতিতে, ঘুষ, দুর্নীতি এবং মানি লন্ডারিং অনেকটাই সহজ এবং অলিখিতভাবে রাষ্ট্রীয় অনুমোদনপ্রাপ্ত হয়ে গেছে। বেনজীরের তো পাসপোর্টও আছে একাধিক! এইসব অপরিপক্ক রাষ্ট্রনীতির কারণে দুর্নীতিবাজরা একেক ব্যাংকে একেক পরিচয়পত্র দিয়ে হিসাব খুলতে পারছে এবং বিভিন্ন অবৈধ সম্পদ গড়তে পারছে। পরিচয়পত্রের নম্বরের ভিন্নতার সুযোগে এবং ব্যক্তির নামের বানানে ও শব্দে ভিন্নতার কারণে প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের এই স্বর্ণযুগে এসেও রিয়েল টাইমে একজন ব্যক্তির সম্পদ ও দায়ের সার্বিক চিত্র উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই একজন ব্যক্তির নামে একাধিক পরিচয়পত্রের বিধান বাতিল করতে হবে। একজন ব্যক্তির নামে কেবল একটিমাত্র পরিচয়পত্র থাকবে। জন্ম নিবন্ধন এবং এনআইডি— একজন ব্যক্তির নামে একসাথে দুইটি পরিচয়পত্র থাকার কোন প্রয়োজনীয়তা নাই। শিশু থেকে বৃদ্ধ– সবার পরিচয়পত্র হিসেবে শুধু এনআইডি বিবেচিত হবে। জন্ম নিবন্ধন / জন্ম সনদ বাতিল করে দিতে হবে। নিয়ম করতে হবে- শিশুর জন্মের এক মাসের মধ্যেই বাধ্যতামূলকভাবে তার নামে এনআইডি গ্রহণ করতে হবে এবং সকল ব্যাংক হিসাব খোলা থেকে শুরু করে সকল নাগরিক সেবা এই একটি এনআইডির বিপরীতেই সে গ্রহণ করতে পারবে। শুধু পাসপোর্ট, বিভিন্ন পেশাদার সনদ (যেমন- ড্রাইভিং লাইসেন্স) বা অন্য কোনো পরিচয়পত্র দিয়েই কোনো রাষ্ট্রীয় সেবা গ্রহণ কিংবা ব্যাংক একাউন্ট খুলা যাবে না। এগুলো এনআইডির অতিরিক্ত হিসেবে কাজ করতে পারে, কিন্তু বিকল্প হতে পারবে না।
এক ব্যবসা, এক BIN
ব্যক্তির একক পরিচয়পত্রের মতো প্রত্যেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকেই বাধ্যতামূলকভাবে Business Identification Number (BIN) গ্রহণ করতে হবে, যা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পরিচয়পত্র হিসেবে কাজ করবে। পাশাপাশি, প্রতিটি গ্রুপ অব কোম্পানির জন্য একটি অভিন্ন বিজনেস গ্রুপ আইডি থাকা উচিত। এই গ্রুপ আইডি নম্বরগুলো সরকারি ডেটাবেজে সংরক্ষণ করা হবে এবং তা মালিকদের এনআইডি ও সহযোগী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের BIN এর সাথে লিংকড করা থাকবে।
সিআইবি রিপোর্টে সম্পদের এক্সপোজার অন্তর্ভুক্তকরণ
ঋণ দেওয়ার সময় একজন ব্যাংকারের তার ঋণগ্রহীতার দায়ের পরিমাণ জানার অধিকার থাকলে ঋণগ্রহীতার সম্পদের পরিমাণ জানারও অধিকারও থাকা উচিত। তাই সিআইবি রিপোর্টে লোন এক্সপোজারের পাশাপাশি সম্পদের এক্সপোজারও সন্নিবেশিত করতে হবে। একই সাথে সিআইবি রিপোর্টের স্টেকহোল্ডার বাড়িয়ে সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, জুয়েলারি সেলার, কার সেলার, সঞ্চয় অধিদপ্তর, ডাকঘর, এনবিআর, দুদককসহ সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
ঋণের দ্বৈততা রোধকরণ
এক ব্যাংকে ঋণ থাকাবস্থায় যদি একজন ঋণগ্রহীতাকে দ্বিতীয় আরেকটি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ দিতে চায়, তাহলে দ্বিতীয় ব্যাংকটিকে প্রথম ব্যাংকের অনাপত্তিপত্র গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় দ্বিতীয় ব্যাংক ঋণ দেওয়ার পর প্রথম ব্যাংকের ঋণটি খেলাপি হয়ে পড়লে, দ্বিতীয় ব্যাংক সেই ঋণ পরিশোধ করার জন্য দায়বদ্ধ থাকবেন।
বন্ধককৃত জামানতের ডেটাবেজ তৈরি ও নির্দায় সনদের অর্থবহতা নিশ্চিতকরণ
একই সম্পদের দ্বৈত বন্ধক রোধে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে বন্ধককৃত সকল জামানতের একটি ডেটাবেজ তৈরি করে নির্দায় সনদকে (Non-Encumbrance Certificate) অর্থবহ করা উচিত।
৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল করা
৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট ব্যাংকে জমা প্রদানের ১৫ দিন সময় দিয়ে বাতিল বলে ঘোষণা করা যেতে পারে। এই সময়ে মোট এক কোটি টাকার অধিক অংকের নগদ জমার ক্ষেত্রে উৎস সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত হয়ে (প্রামাণিক ডকুমেন্ট গ্রহণ) জমা গ্রহণ করতে হবে এবং মোট ১০ লক্ষ বা তদোর্ধ টাকার জমার ক্ষেত্রে শর্ত থাকবে যে, আমানতকারী পরবর্তী এক মাসের মধ্যে আয়কর রিটার্ন জমা প্রদান করবেন। এছাড়াও শর্ত থাকবে- এই জমা কোনো নতুন একাউন্ট খোলে জমা করা যাবে না—নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত খোলা CASA (কারেন্ট এন্ড সেভিংস) ধরনের একাউন্টেই জমা রাখা যাবে। এও শর্ত থাকবে- উক্ত ১৫ দিন সময়ে মোট জমাকৃত টাকা এক কোটির বেশি হলে এক কোটির অতিরিক্ত টাকা পরবর্তীতে আর নগদে উত্তোলন করা যাবে না, কেবল একাউন্ট টু একাউন্ট ট্রান্সফার বা ডিজিটাল চ্যানেলে ট্রান্সফার করা যাবে।
ব্যাংক হিসাবের আবগারি শুল্ক বাতিলকরণ
আমানতের সুদের বিপরীতে আয়কর প্রদানের পরেও ব্যাংক হিসাব থেকে আবগারি শুল্ক কর্তন করা পরিষ্কার জুলুম, যা মানুষের ব্যাংক-বিমুখতা বাড়িয়েছে। সাধারণ মানুষকে ব্যাংক ব্যবস্থার প্রতি আকৃষ্ট করতে এবং ব্যাংকিং সেবার ব্যবহার বাড়াতে ব্যাংক হিসাবের উপর আরোপিত আবগারি শুল্ক অবিলম্বে বাতিল করা উচিত।
যে ব্যাংক খাতের সর্বাঙ্গে ব্যথা, তার কোন অঙ্গে আগে ওষুধ দেওয়া উচিত– এই সিদ্ধান্ত নেয়া খুবই দুষ্কর। তবে আমাদের দেশের ব্যাংক খাত সাধারণ কোনো ব্যথায় আক্রান্ত নয়, বরং এটি মারণব্যাধী ক্যানসারে আক্রান্ত। তাই এর চিকিৎসাও হতে হবে বিশেষ ও বড় রকমের। আর ক্যানসারের চিকিৎসা যত দ্রুত শুরু করা যায়, আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা ততোই বেশি হয়। অতএব, আর কালক্ষেপণ না করে ব্যাংকিং খাতে প্রস্তাবিত সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করা হলে, দেশের ব্যাংক খাতে প্রাণ ফিরে আসা শুরু হবে বলে বিশ্বাস করা যায়।
মোশারফ হোসেন: লেখক ও ব্যাংকার
একের পর এক রাষ্ট্রের সাংবিধানিক পদ শূন্য হচ্ছে। হাসিনা জমানার সর্বশেষ শূন্য হলো নির্বাচন কমিশন। বৃহস্পতিবার কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের এই কমিশন পদত্যাগ করে বাড়ি চলে যায়। আগের দুই কমিশন মেয়াদ পূর্ণ করলেও আড়াই বছরের মাথায় কলঙ্কের বোঝা নিয়ে হাবিবুল আউয়াল কমিশনকে ফিরতে হয়। এর আগে অনেকগুলো সাংবিধানিক পদ শূন্য হয়। প্রধান বিচারপতি ও স্পিকার এদের মধ্যে অন্যতম। এই পটভূমিতে বাকি আছেন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন ও দুর্নীতি দমন কমিশন। প্রেসিডেন্টকে ঘিরে নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে। বলা হচ্ছে, তিনিও হয়তো সরে দাঁড়াবেন। যদিও এর কোনও সত্যতা মেলেনি।
নীতি-নির্ধারকদের তরফে কিছু বলা হয়নি। প্রেসিডেন্ট হাউস থেকেও এমন কোনও আভাস-ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।
বলা হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট যদি পদত্যাগ করেন তাহলে কী হবে। সাংবিধানিক কোনও সংকট ? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর কোনও সম্ভাবনা নেই। কারণ প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ করলে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস একই সঙ্গে দুটো দায়িত্ব পালন করবেন। যেমনটা করেছিলেন জরুরি জমানায় প্রেসিডেন্ট ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদ।
উল্লেখ্য যে, গত ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার নজিরবিহীন বর্ষা বিপ্লব বাংলাদেশের রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দেয়। পদত্যাগ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এখন তিনি ভারতেই রয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভারতীয় বার্তা সংস্থা পিটিআইকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তাকে চুপ থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।
সৌজন্য: মানবজমিন