দক্ষিণ এশিয়ায় বিভাজন ও বৈচিত্র্য, বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা

  • ড. মাহফুজ পারভেজ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

দক্ষিণ এশিয়ায় বিভাজন ও বৈচিত্র্য, ছবি: সংগৃহীত

দক্ষিণ এশিয়ায় বিভাজন ও বৈচিত্র্য, ছবি: সংগৃহীত

প্রণব বর্ধন তাঁর ‘যুক্তরাষ্ট্র এখন অতীত’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন, বিশ্বব্যাপী শাসকদের যে মন্ত্র ‘এক দেশ, এক সব কিছু’, দীর্ঘমেয়াদে তা দেশের ঐক্যের ক্ষতি করবে। এই সব এক-এক মন্ত্র, যেমন বিরোধীমুক্ত ‘এক দেশ, এক দল’ বা ‘এক দেশ, এক নেতা’ আসলে স্বৈরাচারের দুর্গন্ধে ভরা একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা।

অনুরূপভাবে, একনায়কতন্ত্র ‘আমার, আমার’ ধ্বনি দিয়ে এক সময় গায়ের জোরে ক্ষমতাসহ সবকিছু দখল করে। গণতান্ত্রিক পরিসরে জনগণকে সন্মোহিত করেই ক্রমশ একক কর্তৃত্ব বিস্তার করা হয়। গণতন্ত্রের আঙিনাতেই ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে একনায়কতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ। এমনকি, গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত একটি সরকার, গণতান্ত্রিক সংস্থাগুলোকে দাবিয়ে, ধীরে ধীরে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করে। ইতিহাস এমন অনেক উদাহরণের সাক্ষী। এগুলো বৈচিত্র্যময় গণতান্ত্রিক দেশের পক্ষে একেবারেই অচল এবং ভয়ঙ্কর।

বিজ্ঞাপন

সব কিছু ‘আমার ও আমাদের’ কব্জায় নিয়ে নেওয়া সামাজিক ও রাজনৈতিক বিন্যাসে সত্যিই দুরূহ এবং অসম্ভব। দক্ষিণ এশিয়ায় দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। এখানে রয়েছে নানামুখী বিভাজন ও বৈচিত্র্য। যদিও একেক দেশে বিভাজন ও বৈচিত্র্য আলাদা, তথাপি বিভাজন ও বৈচিত্র্যই বাস্তবতা। যদিও ‘আমার ও আমাদের’ বলে সবকিছু দখল করা বাস্তবে সম্ভব নয়। যারা দখলদারিত্ব কায়েম করে কর্তৃত্ববাদী হতে চেয়েছে বা হয়েছে, তাদের পরিণাম ছিল ভয়াবহ ও মারাত্মক। আর যারা বিভাজনকে সহ্য করে বৈচিত্র্য মেনে নিয়ে সবাইকে একসাথে নিয়ে চলেছে, তারা তুলনামূলকভাবে হয়েছেন সফল।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর রাজনৈতিক গতিপথে ‘আমার ও আমাদের’ স্লোগান দিয়ে একক কর্তৃত্ব কায়েম করার প্রচেষ্টা বার বার ব্যর্থ হয়েছে। বিভাজিত ও বৈচিত্র্যপূর্ণ দক্ষিণ এশিয়া হলো বহুত্ববাদী এক অঞ্চল। এখানে কর্তৃত্ববাদ ও ফ্যাসিবাদের বদলে সমন্বয় ও সবাইকে নিয়ে চলাই উপযুক্ত পন্থা। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য এমন উদারপন্থী ও সর্বজন গ্রহণীয় আদর্শ দিয়ে চলাই উত্তম, যার মাধ্যমে সংখ্যাধিক্যের মতাদর্শ বা সংখ্যাধিক্য-কেন্দ্রিক মতাদর্শকে কর্তৃত্ববাদী ও ফ্যাসিবাদী হওয়ার প্রবণতা ঠেকানো যায়।

গবেষক নীতি নায়ারের হার্ট সেন্টিমেন্টস বইটি এসব বিষয় বিশদ আলোচনা করেছে। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নকালীন নানা মত ও পথের বিতর্ক, বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক আইনি ও বিচারালয়-কেন্দ্রিক বক্তব্য বইটিকে সমৃদ্ধ করেছে। নিপুণ রচনাশৈলী অথচ তথ্যসমৃদ্ধ পদ্ধতিতে লেখিকা ধর্মনিরপেক্ষতার এক নতুন ব্যাখ্যা হাজির করেছেন যার মূল কথা হল, রাষ্ট্রের রাষ্ট্রিক আচরণ ও ধর্ম— এই দুইয়ের মধ্যে প্রাচীর টানলে হবে না, বা এই পার্থক্য টানা যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়ের (এবং অবশ্যই বিভিন্ন মতাদর্শী গ্রুপের) সহাবস্থান ওধ সম্প্রীতির পরম্পরায় ফিরে যেতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার অর্থ হল, স্বীয় সম্প্রদায় ও জাতির অন্তর্গত হওয়া নির্ভীক ভাবে। একই সঙ্গে অন্য সম্প্রদায় ও জাতির অস্তিত্ব ও অবস্থানকে সম্মান ও স্বীকৃতি দান করা। এই মনোভাব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের পাশাপাশি রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা আবশ্যক।

কিন্তু বাস্তবতা অবশ্যই ভিন্ন। নানা প্রচেষ্টার পরেও সমাজের বিভাজন ও বিরোধ এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব মেটেনি। অপেক্ষাকৃত সংখ্যাগরিষ্ঠদের কর্তৃত্ববাদী ও ফ্যাসিবাদী হওয়ার প্রবণতা পুরোপুরো রোধ করা যায় নি। রাষ্ট্রের আচরণ নিরপেক্ষ, বহুত্ববাদী ও সমন্বয়মূলক থাকেনি। সঙ্কটকালে সতাদর্শের লড়াই, নেতৃত্বের দ্বৈরথ ও জাতিদাঙ্গার চরম মুহূর্তের রক্তপাত দৃশ্যমান হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশে দেশে। দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে শাসনের কাঠামো ও প্রশাসনের প্রাচীর ভেঙে পড়েছে। ভারতে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সেই মাসগুলোতে যে ভয়াবহ দাঙ্গা হয়, তাতে প্রশাসনিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা প্রকট হয়ে উঠেছিল। সেখানে ভিন্নমত ও সংখ্যালঘুরা প্রতিনিয়ত আক্রান্ত। শ্রীলঙ্কায় সরকার বদলের সময় চরম রক্তপাত হয়েছে। বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলন থেকে সরকার পতনের লড়াই রক্তাক্ত রণক্ষেত্রের রূপ নিয়েছিল। পাকিস্তানে থেমে থেমে চলছে প্রতিপক্ষ ও বিরোধী মত নিপীড়নের নৃশংসতা।

ফলে বিভাজন ও বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে চলমান দক্ষিণ এশিয়ায় সহাবস্থানের আদর্শ আক্রান্ত। সমন্বিত ও সম্মিলিত রাজনৈতিক পথরেখা আরও বিয়োগান্ত এবং রক্তরঞ্জিত। ভারতের গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ ভাবাদর্শকে ধর্মীয় কর্তৃত্ববাদের মোকাবিলা কালে প্রতিদিন অশ্রুপাত করে নিজের অসহায়ত্ব জাহির করতে হচ্ছে। পাকিস্তানে দলীয় ও সামরিক কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের এক বুক তৃষ্ণা নিয়ে কাতর হয়ে আছে জনতা। শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও মালদ্বীপে চলছে দলগত প্রতিযোগিতার উগ্র প্রদর্শনী, যার সঙ্গে এসে মিশেছে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তির শাঠ্য-ষড়যন্ত্র।

এমত পটভূমিতে বাংলাদেশে প্রতিদিন এই সত্য স্মরণ করতে হচ্ছে যে, দেশ ও সমাজের অন্তরে বিরাজমান বিভাজন মোটেও মেটেনি। রাজনৈতিক সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুর মধ্যকার অনাস্থা ও অবিশ্বাস জাতি গঠনের সামনে আজও এক বড় অন্তরায়। দলীয় অবস্থান, নেতৃত্বের বিরোধ, মতাদর্শের লড়াই এবং স্বার্থের দ্বন্দ্ব শান্তি ও স্থিতিশীলতার পথে বড় বিঘ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিভাজন ও বৈচিত্র্যকে সমন্বিত করার কোনও দৃশ্যমান প্রচেষ্টা নেই। বরং ক্ষমতার পালাবদলের পরও অতীতের রেশ ধরে পদ-পদবী ও ক্ষমতা হাসিলের উদগ্র প্রতিযোগিতা ছড়িয়ে পড়েছে প্রশাসন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত। নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য প্রার্থীর জায়গা দখল করছে রাজনৈতিকভাবে বিজয়ী শক্তি, যা প্রকারান্তরে সব কিছু ‘আমার ও আমাদের’ করে নেওয়ার কর্তৃত্ববাদী ও ফ্যাসিবাদী অতীতের প্রেতাত্মা মাত্র।

অতীত-প্রেতাত্মার ছায়া প্রলম্বিত হলে কর্তৃত্ববাদের বিপদ ও ফ্যাসিবাদের আপদ থেকে মুক্ত ও ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রয়াস কতটুকু সফল হতে পারবে? জাতিগঠনের কর্মসূচি কতটুকু নিরাপদ থাকতে পারবে? এসব খুবই জরুরি প্রশ্ন। বিশেষত বিভাজন ও বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য ও সমন্বয়ের বহুত্ববাদী পথকে সামাজিক পথ হিসাবে গড়ে তোলা সম্ভব না হলে সংখ্যাগুরুর দাপট চলতেই থাকবে এবং কর্তৃত্ববাদ ও ফ্যাসিবাদের বিপদ ক্রমান্বয়ে বাড়তেই থাকবে। রাজনৈতিক বা মতাদর্শিক সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরুর বিভাজনকে দূর করতে না পারলে এবং বিশ্বাসযোগ্য নৈকট্যে আনতে না পারলে সংস্কার ও ইতিবাচক পরিবর্তনের মহৎ উদ্দেশ্য সফল করা সহজ ও সম্ভব না-ও হতে পারে।

এ কথা অবশ্যই ঠিক যে, দীর্ঘ ও জটিল সমস্যার শেকড় অনেক গভীরে প্রোথিত হলে তা দূর করা কঠিন। বিশেষ করে বিভাজন ও দ্বন্দ্বের মতো বিষয় সমাজের স্তরে স্তরে বিরাজমান হলে তা একদিনে দূর করাও অসম্ভব। বরং সাংস্কৃতিক উন্নতি ছাড়া কেবল খাতাপত্রের গণতন্ত্র সকলের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে পারে না। অন্তত উদারনৈতিক সংসদীয় গণতন্ত্রে সহাবস্থানের একটি পরিবেশ তৈরি হলেও তাকে নানা দিক থেকে আরও এগিয়ে নেওয়ার দরকার হয়। কারণ, সহাবস্থান নির্ভর করে সমাজের কথাবার্তা, আলোচনা ও সংলাপী অভ্যাস ও মনোভাবের উপর। সেই কথাবার্তার সূচনার জন্য শক্ত রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা ও উদারনৈতিক মনোভাব প্রয়োজন। সব কিছু দলগত বিবেচনায় দখল করার মনোভাবের বদলে কী ভাবে সহাবস্থানকে সামাজিক ভাবে দৃঢ় করা যায়, তার প্রতি মনোযোগী হওয়া সঙ্কুল পরিস্থিতিতে আসলেই গুরুত্বপূর্ণ। রাজনীতি ও সমাজে বন্ধুত্ব ও শত্রুতার ইতিহাসকে পর্যবেক্ষণ করে ঐক্য ও সহানস্থানের নতুন প্রচেষ্টা নেওয়া হলেই রাজনীতিতে সহাবস্থান ও স্থিতিশীলতা শক্তিশালী করা সহজ ও সম্ভব হতে পারে।

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।