স্মিথ, ওয়ার্নারের মতোই দাপুটে প্রত্যাবর্তন হোক সাকিবের
ক্রিকেটে নিষিদ্ধ সাকিবএকটা নির্ঘুম রাত কাটলো বাঙালির। ঘুমোতে না পেরে কী সব ভাবনা মাথায় আসছিল। এর মধ্যে একটা কথা মনে দাগ কাটার মতো। চলতি বছর ক্রিকেট বিশ্বকাপে সর্বাধিক ৬০৬ রান এবং ১১ উইকেট নিয়ে যখন সাকিব আল হাসান অনন্য, ঠিক সেসময় চায়ের কাপে কয়েকজন বন্ধু বলেছিল, ‘ইশ! বাংলাদেশ দলে যদি দুই, চারজন সাকিব থাকতো তাহলে আজ হয়ত বিশ্বকাপ থেকে খালি হাতে ফিরতে হতো না আমাদের। কাপটা জিতেই ঠিক ফিরতে পারতাম।’
সাকিব তো আর দুই/চারজন নেই। তিনি একজনই। তিনি একজন সারা বাংলাদেশে, তিনি একজন সারা বিশ্বে। তার উপমা তিনি নিজেই। কী বোলিং, কী ব্যাটিং! সব্যসাচী বটে। আর কবে নাগাদ এমন একজন মিস্টার সেভেনটি ফাইভ আসবেন তাও বলা যায় না। সবার প্রিয় এই ছেলেটিকে নিয়ে তাই তো মনের কোণে ছন্দ খেলা করে, ‘বাংলাদেশের জান, বাংলাদেশের প্রাণ, সাকিব আল হাসান, সাকিব আল হাসান।’
দেশের ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়ের সাজার খবরে (সব ধরনের ক্রিকেট থেকে এক বছরের নিষেধাজ্ঞা) রাতে ঘুম না আসাটাই স্বাভাবিক। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে করতে মাথায় এলো মাশরাফি বিন মুর্তজার কথা। তিনিও নিশ্চয় ঘুমহীন। মধ্য রাত হওয়ার আগেই তিনি অকপটে বলেছেন, ‘দীর্ঘ ১৩ বছরের সহযোদ্ধার এমন করুণ ঘটনায় নিশ্চিতভাবেই কিছু বিনিদ্র রাত কাটবে। তবে কিছুদিন পর এটা ভেবেও শান্তিতে ঘুমাতে পারবো যে, তার নেতৃত্বেই ২০২৩ সালে আমরা বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলবো। কারণ নামটি তো সাকিব আল হাসান!’
সাকিব বলেই ভরসা পাওয়া যায়। সাকিব বলেই বিশ্বাস জাগে অন্তরে। কোটি বাঙালির কেউই অবিশ্বাস করে না এই ছেলেটাকে। মাগুরার এই সন্তান ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল ছাপিয়ে সারা পৃথিবীর ক্রিকেটের বিস্ময় হননি তো আর এমনি এমনি। অলরাউন্ডার হিসেবে তার ধারেকাছে নেই বাঘা বাঘা ব্যক্তিত্বরা। তবে আফসোস, নিষেধাজ্ঞার কারণে পিছিয়ে গেলেন তিনি। তারও চেয়েও বেশি পেছালো বাংলার ক্রিকেট। আগামী বছরের টি-২০ বিশ্বকাপেও যে সাকিব খেলতে পারছেন না! এ ক্ষতি পূরণ হবে কী করে! তবে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে খেলবেন ২০২৩; ৫০ ওভার বিশ্বকাপ। সেখানে কি তিনি তার প্রতি এমন নিষেধাজ্ঞার চাপা উত্তর দেবেন না? তিনি কি প্রমাণ করবেন না? চোখে আঙুল দিয়ে কিছু দেখাবেন না? অবশ্যই! কেন নয়। তাকে কাছ থেকে চেনেন মাশরাফি নিজেই এমন মতামত প্রকাশ করেছেন। ক্রিকেট বোর্ড সংশ্লিষ্টরাও বলছেন, সাকিব আরও শাণিত হয়ে ফিরে আসবেন। সে আসলে এমনই ছেলে। তীক্ষ্ণ জবাবই যার হাতিয়ার।
আর সাকিবের ভাষায়, ‘ভালোবাসার খেলা থেকে নিষিদ্ধ হওয়ায় খুব কষ্ট লাগছে। কিন্তু যে শাস্তি পেতে হচ্ছে তা আমি মাথা পেতে নিচ্ছি। আইসিসি ও আকসু দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে লড়াই করছে তাতে খেলোয়াড়দের বড় ভূমিকা থাকে। কিন্তু আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে পারিনি।’
অনেকেই রহস্যের গন্ধ খুঁজে বলছেন, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ-বিপিএলে ঢাকা ছেড়ে আইকন হিসেবে সাকিব আল হাসান যোগ দেন রংপুর রাইডার্সে। এটা নিয়েও ক্লাব কর্তাদের ক্ষোভ থাকার দাবি অনেকের। এছাড়া ক্রিকেটারদের ১৩ দফা আন্দোলনে নেতা হয়েও নিজের সর্বনাশ করেছেন সাকিব। তিনি নিজের জন্য আন্দোলন করেননি, করেছেন অন্য ক্রিকেটারদের জন্য। যেন কখনও জাতীয় দলের সীমানায় আসতে না পারলেও, লিগ খেলে জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন ক্রিকেটাররা। এমন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার পর, হুট করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল-আইসিসি’র সিদ্ধান্ত। ক্রিকেট–আমুদেরা দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানোর চেষ্টা করছেন বৈকি। কিন্তু বিষয়টি এমন নয়। অবশ্য কাকতালীয়ভাবে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে মিলেও গেছে।
অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটারদের ইউনিয়ন-এসিএ ২০১৭ সালে ক্রিকেটারদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন করে। তাদের দাবির অন্যতম ছিল, ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার মুনাফার একটা অংশ সব ক্রিকেটারের মাঝে ভাগ করে দিতে হবে। আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন অধিনায়ক স্টিভ স্মিথ ও সহ-অধিনায়ক ডেভিড ওয়ার্নার। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া প্রথমে জোরালোভাবে এর বিরোধিতা করে। কিন্তু সরকার, ক্রিকেটারসহ সব মহলের চাপে তারা শেষ পর্যন্ত দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। এরপর ২০১৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের তৃতীয় ম্যাচে বল টেম্পারিংয়ে অভিযুক্ত হন স্মিথ, ওয়ার্নার, ব্যানক্রফটরা। স্মিথ-ওয়ার্নারের জন্য এক বছরের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া। ব্যানক্রফট নিষিদ্ধ হন নয় মাসের জন্য। গুণতে হয় জরিমানা এবং নামের পাশে যোগ হয় ডিমেরিট পয়েন্টও। যদিও ইতিহাস বলে, বল টেম্পারিং অস্ট্রেলিয়ানদের ক্রিকেটে পরিচিত ঘটনা। তাদের অনেক কিংবদন্তিও এই ঘটনা ঘটিয়েছেন। কিন্তু দেশটির ক্রিকেট বোর্ড তাদের বিরুদ্ধে এমন কঠোর হয়নি কখনও। তাহলে স্মিথ, ওয়ার্নারদের বেলায় কেন কঠোর হতে হলো? শাস্তি কাটিয়ে চলতি বছর (২০১৯ সাল) মার্চে স্টিভ স্মিথ ও ডেভিড ওয়ার্নার ফিরে আসেন মাঠে। জুনে বিশ্বকাপের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফের যাত্রা শুরু করেন তারা। দাপুটে ভঙ্গিতেই ফিরে আসেন দুই বন্ধু। ফিটনেস সংকট, রান খরা, দীর্ঘদিন মাঠের বাইরে থাকার জের- কোনোটাই ছুঁতে পারেনি তাদের। উল্টো আরও তন্দরুস্ত হয়ে ফেরেন তারা। দলের জয়ে অবদান রাখেন, এখন তারা নিয়মিত সদস্যও।
দেখতে দেখতে বছরটা কেটেছে তাদের। নিষেধাজ্ঞা তাতে কি, অনুশীলন চলেছে ঠিকই। সাকিব আল হাসানও তাই করবেন আশা রাখি। স্মিথ, ওয়ার্নারের মতোই দাপুটে প্রত্যাবর্তন হবে। বয়স কেবল সাড়ে ৩২। তার ফিটনেস এমনিতেই ভালো, সেটাকে ধরে রাখতে পারলে দলে ফিরেই মাঠ কাঁপানো তার জন্য কোনো ব্যাপার না। তখন আর ২০২৩ বিশ্বকাপ নয়, ফিরে আসার ক্ষণ থেকেই ২২ গজে উত্তর দেবেন সবার প্রিয় ‘ময়না’। ছন্দের সুরে বলতে হয়, বছর পারে ফিরবে তুমি/ সেরা সাহসে ফের/ কারণ তুমি বাংলা মায়ের/ সেই গর্জে ওঠা শের।
আরও অন্তত বছর চারেক দেশের সেবা করতে পারবেন। কারণ একজন সাকিব দলে থাকা মানে একাই দুটো ক্রিকেটারের সমান কাজ করে দেয়া। তার মতো আর কেউ নেই দলে। তাই গুণাবলি নিয়ে আত্মপ্রত্যয়ী হলে, অন্য ক্রিকেটাররাও ভালো করবেন। তখন হয়ত সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন বাংলাদেশ বিশ্বকাপ ঘরে তুলতে পারবে।
সৈয়দ ইফতেখার: সংবাদকর্মী ও লেখক।