৪০ টাকার পানিতে বোরো আবাদ!

  • শরিফুল ইসলাম, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, নড়াইল, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

উজিরপুর অর্গানিক বহুমুখি সমবায় সমিতির ব্যবস্থাপনায় মাত্র ৪০ টাকায় পানি পাচ্ছেন স্থানীয় কৃষকেরা/ ছবি: বার্তা২৪.কম

উজিরপুর অর্গানিক বহুমুখি সমবায় সমিতির ব্যবস্থাপনায় মাত্র ৪০ টাকায় পানি পাচ্ছেন স্থানীয় কৃষকেরা/ ছবি: বার্তা২৪.কম

সাধারণত বোরো আবাদের সময় জমিতে প্রত্যেক কৃষককে নিজের জমিতে যেকোনো স্যালো বা মোটরচালিত পাম্প থেকে প্রয়োজনমতো পানি নিয়ে নিতে হয়। নড়াইলে জমি আবাদ থেকে শুরু করে ধান পাকা পর্যন্ত সেই পানি মাত্র ৪০ টাকায় পাচ্ছেন কৃষকেরা। এই ব্যবস্থা করেছে নড়াইলের উজিরপুর অর্গানিক বহুমুখি সমবায় সমিতি।

স্থানীয়রা জানান, নড়াইল সদর উপজেলার পৌরসভার কাড়ার বিলে এলাকার কৃষকদের জন্য ‘বৃহত্তম খুলনা-যশোর-কুষ্টিয়া সমন্বিত কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প’র আওতায় বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) সহযোগিতায় ২০০৭ সালে এই পদ্ধতি চালু করা হয়। এটির পাম্প নির্মাণসহ পুরো প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রায় ২ কোটি টাকা ব্যয় হয়। মোট খরচের ৮৫ ভাগ যোগান দেয় বিএডিসি এবং ১৫ ভাগ ব্যয় করেন এই সমিতির সদস্যরা।

বিজ্ঞাপন

চিত্রা নদীতে বিদ্যুৎ চালিত তিনটি পাম্প স্থাপন করে তিন কিলোমিটার পাকা ড্রেন নির্মাণ করে ৪৬০ একর জমিতে এই প্রকল্প চালু করা হয়। প্রকল্পটি দেখভাল করা হয় সমিতির পক্ষ থেকে। প্রতি বছর তিনটি পাম্পের জন্য ২০ হাজার টাকা করে মোট ৬০ হাজার টাকা দেয়া হয় বিএডিসি কর্তৃপক্ষকে।

এই প্রকল্পের আওতায় সুবিধা পাচ্ছেন এলাকার প্রায় এক হাজার কৃষক। এখানে আটজন বেতনভুক্ত কর্মচারি কাজ করেন। কোন জমিতে কতটুকু পানি দরকার, সেটা বুঝে পরিমানমতো পানি দেন তারা।

বিজ্ঞাপন

শুধু বোরো মৌসুমেই নয়, সারা বছর পর্যাপ্ত পরিমান পানি দেয়, আর সেই পানি দিয়ে প্রান্তিক কৃষকেরা আমন, বোরো ও শীতকালীন ফসলসহ বছরে তিনটি ফসল ফলান। এমন সুযোগ করে দিয়েছে নড়াইল উজিরপুর অর্গানিক বহুমুখি সমবায় সমিতি। গত এক যুগ যাবৎ এমন সুযোগ পেয়ে লাভবান হয়েছেন কৃষকেরা। এতে সেচ ও সার খরচ কমেছে, জমিতে আগের তুলনায় শ্রমিক কম লাগছে, ঝুঁকিমুক্তভাবে  ফসল ফলাচ্ছেন তারা। আগের থেকে ফসল উৎপাদন বেড়ে গেছে, উৎপাদন খরচও কমে যাওয়ায় লাভবানও হচ্ছেন বেশ। এতে সংসারে সচ্ছলতা এসেছে এই কৃষকদের।

কৃষকদের চাহিদা অনুযায়ী, চিত্রা নদী থেকে সারা বছর পলিযুক্ত পানি দেয়া হয়। সেই পানি দিয়ে এলাকার এক হাজার কৃষক ফসল ফলিয়ে লাভবান হচ্ছেন। প্রকল্পের এলাকায় আমন, বোরো, সরিষার আবাদ করেন কৃষকেরা।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Feb/01/1549028056155.jpg

সাধারণত, বোরো মৌসুমে পানির চাহিদা বেশি থাকে। আমন মৌসুমে এবং সরিষার জন্য খুব বেশি পানির প্রয়োজন হয় না। জমিতে পানির প্রয়োজন হলেই পর্যাপ্ত পরিমান পানি দেয়া হয়।

উজিরপুর গ্রামের কৃষক সুকান্ত গাইন জানান, আমি প্রায় ২৫ বছর যাবৎ কৃষিকাজ করি। এই প্রকল্পের আওতায় তাদের সেচ খরচ অনেক কমে গেছে। অন্য এলাকায় শুধু বোরো আবাদ করতে সেচ খরচ বাবদ প্রতি শতকে তাদের খরচ হয় ১২০-১৫০ টাকা পর্যন্ত। আর এখানে (এই প্রকল্পের আওতায়) তারা প্রতি শতকে মাত্র ৪০ টাকায় সারা বছর পানি পাচ্ছেন। এই টাকার বিনিময়ে তারা বছরে তিনটি ফসল উৎপাদন করতে পারছেন, এতে তাদের অনেক সুবিধা হয়েছে।

কৃষক অধির বিশ্বাস জানান, আগে মাটির নিচ থেকে সেচ পাম্প দিয়ে পানি তোলা হতো, ফলে প্রতি বছরই পানির লেয়ার আস্তে আস্তে নিচে নেমে যেতো। বোরো মৌসুমে মাটির নিচ থেকে অল্প পানি উঠতো। অনেক সময় মাটি খুড়ে ১০-১৫ ফুট নিচে পাম্প বসিয়ে পানি উত্তোলন করতে হতো। কখনো কখনো জমিতে পানি দিতে না পেরে জমির ধান পানির অভাবে নষ্ট হয়ে যেত। এই প্রকল্প গ্রহণের ফলে এখন পানির জন্য আর তাদের হাহাকার নেই।

কৃষক আয়ুব হোসেন বলেন, এখানে জমিতে নদী থেকে সরাসরি পানি দেয়া হয়। ফলে নদীর পানির সাথে ক্ষেতে পলি আসে। এতে তাদের ফসল অনেক ভালো হয়। উৎপাদন আগের থেকে বেড়ে গেছে, খরচও কমে গেছে।

কৃষক রবিউল ইসলাম বলেন, মাটির নিচ থেকে জমিতে কয়েক বছর পানি দিলে জমিতে লোনা ধরে, জমির উপরে লালচে হয়ে যায়। তখন জমিতে সার অনেক বেশি লাগে। অনেক সময় জমির ফসল নষ্ট হয়ে যায়। এতে কৃষকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। চিত্রা নদী থেকে এই প্রকল্পের মাধ্যমে পানি দিলে মাটির উর্বরতা বেড়ে যায়, ফলে সার কম প্রয়োজন হয়। এতে তাদের উৎপাদন খরচও অনেক কম হয়।

কৃষক অরুণ দাস বলেন, প্রকল্পের বাইরে এক একর জমিতে ৪৮-৫৫ মন ধান উৎপাদন হয় এবং প্রকল্পের মধ্যে যে জমি আছে সেখানে প্রতি একর জমিতে ৫৫-৬০ মন ধান উৎপাদন হয়। পলিযুক্ত পানি ব্যবহার করায় প্রতি একরে ৫-৬ মন ধান বেশি উৎপাদন হয়।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Feb/01/1549028015408.jpg

উজিরপুর অর্গানিক বহুমুখি সমবায় সমিতি সাধারণ সম্পাদক খন্দকার শাহেদ আলী শান্ত বলেন, বিভিন্ন কার্যক্রমের পাশাপাশি এলাকার কৃষকদের কথা চিন্তা করে এই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। সমিতির পক্ষ থেকে কৃষকদের সর্বোচ্চ সেবা দেয়ার চেষ্টা করছি। তবে, প্রকল্প এলাকার প্রায় ৫০ একর জমিতে পানি দিতে একটু সমস্যা হচ্ছে। সেখানে একটি ড্রেন নির্মাণ করা প্রয়োজন। উচু এই ৫০ একর জমিতে নতুন করে ড্রেন নির্মাণের জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে।

নড়াইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক চিন্ময় রায় বলেন, এক কেজি ধান উৎপাদন করতে জমিতে তিন হাজার লিটার পানির প্রয়োজন হয়। ধান আবাদের কৃষকদের পানির চাহিদা ও খরচ দিন দিন বাড়ছে। অল্প টাকায় পানি পেয়ে এই প্রকল্পের আওতায় কৃষকেরা বেশ লাভবান হচ্ছেন। সারা বছর তারা পর্যাপ্ত পরিমান পলিযুক্ত পানি পাচ্ছেন। এতে কৃষকদের উৎপাদন খরচ অনেক কমে গেছে।

তিনি আরও বলেন, নড়াইলে বিভিন্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি নদী রয়েছে। সরকারি এবং বেসরকারিভাবে এ রকম আরও কিছু প্রকল্প গ্রহণ করলে এলাকার অনেক কৃষক লাভবান হবেন।