মুন সিনেমা হলের মালিককে ৯৯ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছে সরকার

  • আসিফ শওকত কল্লোল, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

সচিবালয়-সংগৃহীত।

সচিবালয়-সংগৃহীত।

মালিকানা মানহানি মামলায় মুন সিনেমা হলের মালিককে ৯৯ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছে সরকার। গত সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের পক্ষে এ অর্থ ছাড় করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

জানা গেছে, পুরান ঢাকার ওয়াইজঘাটে অবস্থিত মুন সিনেমা হলের মালিকানা নিয়ে মামলা করা হয়। ২০০৫ সালে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করেন হাইকোর্ট। পরে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগেও একই রায় বহাল ছিল। ওই রায়ের তিন বছর পরও সিনেমা হল ফেরত না পেয়ে সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ করেন হলের মালিক। সর্বশেষ গত জুলাই মাসে মুন সিনেমা হলের মালিক ইতালিয়ান মার্বেল ওয়ার্ক লিমিটেডকে ৯৯ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টকে  নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু এই টাকা দেয়ার সামর্থ্য না থাকায়  ট্রাস্টের পক্ষে এ অর্থ পরিশোধ করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ জন্য আর্থিক বছরের প্রথম দিকে বাজেট থেকে এ অর্থ ছাড় করা হয়।

বিজ্ঞাপন

আদালতে মুন সিনেমা হলের পক্ষে শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন সিনিয়ার আইনজীবী আজমালুল হোসেন ।

প্রসঙ্গত, ইতালিয়ান মার্বেলস ওয়ার্কস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাকসুদুল আলম ছিলেন মুন সিনেমা হলের মালিক। মুক্তিযুদ্ধের সময় সম্পত্তিটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে মালিকানা দাবি করে মাকসুদুল আলম আইনের আশ্রয় নেন। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২০১০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে দেওয়া হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন। পাশাপাশি ৯০ দিনের মধ্যে মুন সিনেমা হল বাংলাদেশ ইতালিয়ান মার্বেলস ওয়ার্কস লিমিটেডকে ফেরত দিতে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টসহ সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশ দেন।

পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক শাসনামলের সব আদেশ, ঘোষণা ও দণ্ডাদেশের বৈধতা দেন সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। এছাড়া খন্দকার মোশতাক, বিচারপতি সায়েমের শাসনামলের কর্মকাণ্ডেরও বৈধতা দেন তিনি। এ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, বিসমিল্লাহসহ বিভিন্ন স্পর্শকাতর বিষয় যুক্ত করা হয়।

জানা গেছে, ‘পাক ইতালিয়ান মার্বেল ওয়ার্ক লিমিটেড’ পূর্ব পাকিস্তানের জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে ১৯৬২ সালে প্রাইভেট কোম্পানি লিমিটেড হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। ১৯৬৪ সালে কোম্পানিটির মালিকানায় ১১ ওয়াইজঘাট, ঢাকায় মুন সিনেমা হল প্রতিষ্ঠা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবণতি হলে হলটির সম্পত্তিটি জোরপূর্বক দখল করা হয়। ১৯৭১ সালের ৩০ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির এক আদেশ অনুযায়ী শিল্প মন্ত্রণালয় পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে ওই সম্পত্তিটি দখলে নেয়। ১৯৭২ সালের ২৮ নভেম্বর জয়েন্ট স্টক কোম্পানির এক আদেশে কোম্পানিটির নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ ইতালিয়ান মার্বেলস ওয়ার্কস লিমিটেড’ রাখা হয়।

১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশ ১৬-এর ৫ ধারার ক্ষমতা ব্যবহার করে শিল্প মন্ত্রণালয় সম্পত্তিটি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের অধীনে ন্যাস্ত করে। ১৯৭২ সালের ২৮ এপ্রিল বাংলাদেশ ইতালিয়ান মার্বেলস ওয়ার্কস লিমিটেড সম্পত্তি ফেরত চেয়ে আবেদন করে। এরই প্রেক্ষিতে পরিত্যক্ত সম্পত্তি সেল থেকে তদন্ত করা হয়। তদন্ত শেষে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ১৯৭৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সম্পত্তিটি পরিত্যক্ত সম্পত্তি নয় উল্লেখ করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। পরে ওই তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে ঢাকার অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার এক স্মারকে ১৯৭৫ সালের ৬ জানুয়ারি সম্পত্তিটি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকা থেকে মুক্ত করতে সুপারিশ করেন। কিন্তু শিল্প মন্ত্রণালয় ১৯৭৫ সালের ২৭ জানুয়ারি সম্পত্তিটি অর্পিত সম্পত্তিভুক্ত হওয়ায় তা মুক্ত করা সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেয়।

১৯৭৫ সালের ১৭ জানুয়ারি শিল্প ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা পরিষদের কাছে সম্পত্তি ফেরত পেতে আবেদন করে মালিকপক্ষ। তবে কোনো ফল না পেয়ে ১৯৭৬ সালে হাইকোর্টে মামলা করা হয়। মামলার শুনানি শেষে হাইকোর্ট ১৯৭৭ সালের ১৫ জুন মুন সিনেমা হলকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে জারি করা প্রজ্ঞাপন অবৈধ ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে মুন সিনেমা হল ছেড়ে দিতে শিল্প মন্ত্রণালয় ও সচিবের প্রতি নির্দেশ দেন। রায় অনুযায়ী, শিল্প মন্ত্রণালয় ১৯৭৭ সালের ২৪ আগস্ট একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে পরিত্যক্ত তালিকা থেকে মুন সিনেমা হলকে বাদ দেয় এবং সচিবকে ওই সম্পত্তি কোম্পানির অনুকূলে বুঝিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়।

এ সময়ের মধ্যে সম্পত্তিটি বুঝিয়ে দিতে একজন ম্যাজিস্ট্রেটকেও দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন (সিভিল পিটিশন) দায়ের করে এবং ওই রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ পেয়েছে দাবি করে ওই সম্পত্তিটির দখল বুঝিয়ে দিতে অস্বীকার করে। এরই মধ্যে ১৯৯৭ সালের ৭ অক্টোবর ‘মার্শাল ল’ রেগুলেশন জারির মাধ্যমে পরিত্যক্ত সম্পত্তির সম্পূরক বিধান জারি করা হয়। ওই বিধানে ১৯৭৭ সালের ১৫ জুন হাইকোর্টের দেওয়া রায়কে বাতিল করা হয়। পরে ‘মার্শাল ল’ রেগুলেশন প্রত্যাহারের দাবিতে কোম্পানিটি ১৯৯৪ সালে হাইকোর্টে একটি রিট মামলা দায়ের করে। ১৯৯৪ সালের ৭ জুন হাইকোর্ট ওই রিট আবেদনটিও খারিজ করে রায় দেন।

এরপর কোম্পানিটি ২০০০ সালে ৫ম সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ও মুন সিনেমা হল ফেরতের দাবিতে হাইকোর্টে রিট মামলা দায়ের করে। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ও বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর ২০০৫ সালের ২৯ আগস্ট দেওয়া রায়ে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করেন এবং মুন সিনেমা হল ৬০ দিনের মধ্যে ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেন। পরবর্তী সময়ে আপিল বিভাগ এ রায় কিছুটা সংশোধন সাপেক্ষে বহাল রাখেন। এছাড়া মুন সিনেমা হল ছেড়ে দিতে ৯০ দিনের সময় দেন।