এক লিটারে ডিজেলে ভ্যাট-ট্যাক্স ২৪ টাকা!
আন্তর্জাতিক বাজারে ডিজেলের দাম বৃদ্ধির কথা বলে তুলে ৬৫ টাকা দরে (লিটার) বিক্রি হওয়া ডিজেলের দাম একলাফে ৮০ টাকা করা হয়েছে। এই টাকার মধ্যে ২৪ টাকাই ভ্যাট-ট্যাক্সের নামে যাবে সরকারের পকেটে।
ভ্যাট-ট্যাক্স কমানো গেলে তেলের দাম বাড়ানোর কোনো প্রয়োজন পড়তো না বলে মনে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের লোকজন।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের জেনারেল ম্যানেজার (হিসাব) এটিএম সেলিম বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, বর্তমানে জ্বালানি তেলে ডিউটি রয়েছে ১০ শতাংশ, ভ্যাট ১৫ শতাংশ, টি-ভ্যাট ও ট্যাক্স মিলে আরও ৫ শতাংশ অর্থাৎ সব মিলিয়ে ৩০ শতাংশের মতো হয়। লিটার ৮০ টাকায় বিক্রি হলে ব্রেক ইভেনে চলবে।
বিপিসির এই কর্মকর্তা ভারতে পাচারের শঙ্কাকে বেশি করে দেখতে চাইছেন। তিনি বলেন, ভারতে লিটার প্রতি ১০২ রুপি দরে বিক্রি হচ্ছে। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় ১২২ টাকার উপরে। এখনও লিটারে প্রায় ৪০ টাকার মতো কম রয়েছে। ভারতে ডিজেল পাচার হওয়ার যথেষ্ট শঙ্কা রয়েছে। সে কারণেই দাম বাড়ানো হয়েছে। সব পণ্যের দাম বাড়লেও গত ৫ বছরে ডিজেলের দাম বাড়েনি।
তিনি বলেন, ২০১৬ সালে যখন তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ৫০ ডলার ছিল তখন কমিয়ে ৬৫ টাকা করা হয়। এখন সেই ডিজেল ৯৭ ডলার দিয়ে কিনতে হচ্ছে।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বর্তমান ক্রয় মূল্য বিবেচনা করে বাংলাদেশ পেট্টোলিয়াম কর্পোরেশন ডিজেলে লিটার প্রতি ১৩.০১ এবং ফার্ণেস অয়েলে লিটার প্রতি ৬.২১ টাকা কমে বিক্রয় করায় প্রতিদিন প্রায় ২০ কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছে। অক্টোবর ২০২১ মাসে বাংলাদেশ পেট্টোলিয়াম কর্পোরেশন বিভিন্ন গ্রেডের পেট্টোলিয়াম পণ্য বর্তমান মূল্যে সরবরাহ করায় মোট ৭২৬.৭১ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা এই মতের সঙ্গে একমত হতে পারছেন না। তারা বলেছেন, এখন ৯৭ ডলারের কথা বলে দাম বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু করোনাকালে তেলের দাম ৪০ ডলারের নিচে নেমে এসেছিল। তখনতো তারা দাম কমায় নি। তখন কতো আয় করেছে সেই টাকা সমন্বয় করুক। করোনার ধাক্কা মানুষ এখনও সামলে উঠতে পারেনি। তেমন একটি সময়ে হঠকারি সিদ্ধান্ত কেনো নিতে হলো। আর সরকারকে কেনো এখান থেকে এতো বেশি করে ট্যাক্স-ভ্যাট নিতে হবে।
বিপিসি সূত্র জানিয়েছে বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর ডিজেলের দাম মোট ৬ দফায় ৩৯ টাকা বাড়ানো হয়েছে। আর এক দফায় ৩ টাকা হারে কমানো হয়েছে। তবে কখনই একসঙ্গে এতো বেশি পরিমাণে দাম বাড়ানো হয় নি। ২০১৩ সালের ৩ জানুয়ারি ৭ টাকা হারে বাড়ানো ছিল সর্বোচ্চ রেকর্ড। বর্তমান সরকারের সময়ে সর্বশেষ ২০১৩ সালের ৩ জানুয়ারি ডিজেল-কেরোসিন লিটার প্রতি ৭ টাকা বাড়িয়ে ৬৮ টাকা করা হয়। এর আগে ২০১১ সালে ৪ দফায় দাম বাড়ানো হয় সর্বসাধারণের ব্যবহৃত এই পণ্যটি। প্রথম দফায় ৬ মে লিটারে দুই টাকা ৪৬ টাকা করা হয়, দ্বিতীয় দফায় ১৯ সেপ্টেম্বর ৫ টাকা বাড়িয়ে ৪৯ টাকা, ১১ নভেম্বর ৫ টাকা বাড়িয়ে ৫৬ টাকা এবং ৩০ ডিসেম্বর লিটার প্রতি ৫ টাকা বাড়িয়ে ৬১ টাকা করা হয়। আর ২০১৬ সালের এপ্রিলে ৩ টাকা কমিয়ে ৬৫ টাকা করা হয়।
ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বার্তা২৪.কমকে বলেন, অনেক বিকল্প ছিল দাম না বাড়ানোর। জ্বালানি তেলের দাম এভাবে বাড়ানো সম্পূর্ণ বেআইনি। তেলের দাম বাড়ানো-কমানোর এখতিয়ার বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের। সেখানে গেলে আমরা যাচাই-বাছাই করে দেখতাম আসলেই লোকসান হচ্ছে নাকি লোকসান দেখানো হচ্ছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির প্রেসিডেন্ট মসিউর রহমান রাঙ্গা বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, এতো বেশি দাম বাড়ানোর ঘটনা নজির বিহীন। আমি আমার জীবনে দেখিনি। এমনিতেই করোনার কারণে পরিবহন সেক্টরের অবস্থা ভঙ্গুর। তার উপর এই দাম বৃদ্ধি ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সরকার জানে তেলের দামের প্রভাব কেমন পড়ে। তেলের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সেটি সমন্বয় করে দিতে পারতো। এখন সারাদেশ থেকে আন্দোলনের চাপ আসছে। আমরা ভাড়া সমন্বয় অথবা ডিজেলের দাম কমানোর প্রস্তাব দিয়েছি। জবাব পেলে সেভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, রংপুর থেকে কুড়িগ্রাম শহরের দূরত্ব ৬০ কিলোমিটার। একটি মিনিবাস যাতায়াত করতে ২৫ লিটারের মতো ডিজেল লাগে। এতে ৩৭৫ টাকা খরচ বাড়বে।
বিপিসি জানিয়েছে, জ্বালানি তেলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে ডিজেল। ২০১৯-২০ অর্থবছরে জ্বালানি তেলের চাহিদা ছিল ৫৫ লাখ ৩ হাজার ৯১ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ৪০ লাখ ২৩ হাজার ৪০৯ মেট্রিক টন ছিল ডিজেল। ওই বছরে কৃষি খাতে ডিজেলের প্রক্কলিত চাহিদা ছিল ১৬ লাখ ৮৪ হাজার ৮ মেট্রিক টন।