গ্যাসের দাম বাড়াতে চাতুরতার আশ্রয় নিয়েছে পেট্রোবাংলা!
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ধাক্কা সামলে না উঠতেই গ্যাসের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে জনমনে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করছে, দাম বাড়াতে চাতুরতার আশ্রয় নিয়েছে পেট্রোবাংলা। তারা যে হিসেবে দিয়েছে তা কোনভাবেই সঠিক হতে পারে না।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, জনগণকে বোকা বানানোর চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় এবং স্পর্ট মার্কেট থেকে এলএনজি (তরলীকৃত প্রকৃতিক গ্যাস) আনছে। দাম বেড়েছে স্পর্ট মার্কেট থেকে আনা ৫-৬ শতাংশের।
সিস্টেমের ৫-৬ শতাংশের দাম বেড়েছে বলে পুরো গ্যাসের দাম ১১৭ শতাংশ বাড়াতে হয় এটা বিশ্বাসযোগ্য! তারা গোঁজামিল দিয়ে হিসেব দেখাচ্ছে, এসব হিসাব বাস্তব সম্মত না। প্রয়োজন হলে ওই পরিমাণ এলএনজি আমদানি না করার পক্ষে আমরা। তবুও দাম বাড়ানো উচিত হবে না। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর জনগণের নাভিশ্বাস উঠেছে। এই অবস্থায় গ্যাসের দাম বৃদ্ধি কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না।
তিনি বার্তা২৪.কম-কে বলেন, এই মুহূর্তে আমাদের অর্থনীতি ভর্তুকি বৃদ্ধি কিংবা দাম বৃদ্ধি কোনোটার জন্য প্রস্তুত নয়। বরং রেশনিং করে ওই পরিমাণ এলএনজি আমদানি কমিয়ে দেওয়া উচিত। জনগণের ১০-১২ ঘণ্টা লোডশেডিং ভোগ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। যারা কিছুটা ছাড় দিতে চায়, তবু পকেট কাটার বন্দোবস্ত বন্ধ করা হোক।
এমনিতেই সংকট চলছে তার উপর যদি আরও আমদানি কমানো হয় তাহলে তো সংকট বেড়ে যাবে। এমন প্রশ্নের জবাবে শামসুল আলম বলেন, দেশে সার উৎপাদন করার চেয়ে আমদানি করলে কম দাম পড়ে। তাহলে দেশে কেনো সার উৎপাদন করবো। যে সার কারখানাগুলো দক্ষ নয় সেগুলো বন্ধ করে দিলেই হয়।
তিনি বলেন, জনগণের কোম্পানির মালিকের আসনে এখন আমলারা বসে গেছে। তারা তাদের সুযোগ সুবিধা বাড়ায়, ডেভেলপমেন্ট প্লান করে না। আমদানি করলে কমিশন বাণিজ্য হয় তাই আমদানির দিকেই তাদের নজর বেশি। দেশীয় গ্যাসের অনুসন্ধান ও উত্তোলন কার্যক্রম সেভাবে করা যায়নি। যে কারণে আজকে এই সংকট। আগে থেকে পরিকল্পনা থাকলে এই সংকট তৈরি হতো না। জনগণ এক সময় গ্যাস রফতানির বিপক্ষে রাস্তায় নেমেছে। এখন আমদানির বিরুদ্ধে রাস্তায় নামার সময় এসেছে।
কোম্পানিগুলো গ্যাস না দিয়েও দাম নিচ্ছে। অবৈধ গ্যাস সংযোগের পয়সা কোথায় যাচ্ছে। সুশাসন নিশ্চিত করতে না পারলে এই সংকট দূর হবে না। ছাতক ও ভোলার গ্যাস থাকলেও এতোদিন কেনো আনা গেলো না। কোম্পানিগুলো অযৌক্তিক ব্যয়ের বোঝা জনগণের কাঁধে চাপানো হচ্ছে। কোম্পানিগুলো আমলা মুক্ত করতে হবে এরাই দেশকে আমদানি নির্ভর করে ফেলেছে।
গ্যাসের দাম দ্বিগুণের বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। একচুলা ৯২৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০০০ টাকা, দুই চুলা ৯৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২১০০ টাকা করার প্রস্তাব জমা দিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে(বিইআরসি)।
নজিরবিহীন উচ্চমূল্যের এই প্রস্তাবটি সোমবার (১৭ জানুয়ারি) কমিশনে জমা পড়েছে সূত্র নিশ্চিত করেছে। বৃহত্তর নোয়াখালী, কুমিল্লা ও চাঁদপুর জেলায় বিতরণের দায়িত্বে রয়েছে কোম্পানিটি। অন্যান্য কোম্পানিগুলোকেও অভিন্ন প্রস্তাব জমা দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে পেট্রোবাংলা থেকে। দু’একদিনের মধ্যে প্রস্তাব জমা পড়তে যাচ্ছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
বাখরাবাদ তার প্রস্তাবে আবাসিকে প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারী গ্রাহকদের প্রতি ঘনমিটারের বিদ্যমান মূল্য ১২.৬০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৭.৩৭ টাকা, সিএনজিপ্রতি ৩৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৬.০৪ টাকা, হোটেল-রেস্টুরেন্টে ২৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৯.৯৭ টাকা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে ১৭.০৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৭.০২ টাকা, ১০.৭০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৩.২৪ টাকা, ক্যাপটিভ পাওয়ারে ১৩.৮৫ টাকা থেকে ৩০.০৯ টাকা, চা শিল্পে ১০.৭০ টাকা বাড়িয়ে ২৩.২৪ টাকা করার প্রস্তাব করেছে। অন্যদিকে বিদ্যুৎ ও সার কারখানায় থাকা বিদ্যমান দর ৪.৪৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯.৬৬ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বাড়তি বিদ্যমান গড় ৯.৩৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০.৩৫ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। অতীতে কখনই এতো বেশি পরিমাণে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়নি। যে কারণে একে নজিরবিহীন বলে উল্লেখ করেছে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।
পেট্রোবাংলা তার লিখিত প্রস্তাবে বলেছেন, রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্স ও সিলেট গ্যাস ফিল্ডের গ্যাসের প্রতি ঘনমিটারের গড় ক্রয়মূল্য পড়ছে ১.২৬ টাকা, শেভরনের থেকে কিনতে হচ্ছে ২.৮৯ টাকা, তাল্লো থেকে ৩.১০ টাকা করে। অন্যদিকে এলএনজির প্রকৃত ক্রয়মূল্য ৩৬.৬৯ টাকা অন্যান্য চার্জ দিয়ে ৫০.৩৮ টাকা পড়ছে। দৈনিক ৮৫০ মিলিয়ন ঘন ফুট এলএনজি আমদানি বিবেচনায় এই দর।
কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব দেওয়ার আগে পেট্রোবাংলা একটি চিঠি দিয়ে গ্যাসের দাম বাড়ানোর আবেদন করেছিল বিইআরসিতে। পেট্রোবাংলার সেই প্রস্তাব আইনসম্মত না হওয়ায় ফেরত পাঠানো হয়। ভোক্তা পর্যায়ে দাম বাড়ানোর আইনি প্রতিষ্ঠান বিইআরসি। তারা প্রস্তাব পেলে প্রথমে যাচাই-বাছাই করে দেখেন। আবেদন যৌক্তিক হলে গণশুনানির মাধ্যমে দর চুড়ান্ত করে থাকেন।
গ্যাসের সংকট মোকাবিলায় বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানির প্রক্রিয়াটি শুরু থেকেই ব্যাপক সমালোচিত। কাতার ও ওমান থেকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে আনা এলএনজি রিগ্যাসিফিকেশন করা হচ্ছিল মহেশখালীতে অবস্থিত দুটি এফএসআরইউ (ফ্লোটিং স্টোরেজ রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট) দিয়ে। মুরিং পয়েন্ট ছিঁড়ে যাওয়ায় একটি এফএসআরইউ এখন বন্ধ রয়েছে। অন্যদিকে কাতার ও ওমান জানিয়েছে, আগামী বছর এলএনজির সরবরাহ কমিয়ে দেবে দেশ দুটি।
আরও পড়ুন: গ্যাসের দাম দ্বিগুণের প্রস্তাব, দুই চুলা ২১০০ করতে চায়