বিতর্কের মধ্যেই সোমবার শুরু হচ্ছে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির গণশুনানি
সোমবার (২১মার্চ) শুরু হচ্ছে গ্যাসের আকাশচুম্বি দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি। অনেক বিকল্প থাকলেও সেদিকে না গিয়ে করোনা মহামারির সময়ে দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের কঠোর সমালোচনার মধ্যেই গণশুনানি শুরু হচ্ছে।
রাজধানীর বিয়াম অডিটরিয়াম গণশুনানি গ্রহণ করবে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। দিনের শুরুতে পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের যৌক্তিকতা তুলে ধরা হবে। এরপর কমিশন তাদের মূল্যায়ন রিপোর্ট পেশ করবে। কমিশনের মূল্যায়ন রিপোর্ট শেষে ইতিমধ্যে যারা তালিকাভুক্ত করেছেন তারা আলোচনায় অংশ নেবেন। সবশেষে উন্মুক্ত আলোচনা পর্বে অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকবে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের। বিধান রয়েছে গণশুনানির পর ৯০ কর্মদিবসের মধ্যে সিদ্ধান্ত জানাতে হবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, জ্বালানি বিভাগের হাতে একাধিক বিকল্প ছিল। তারা সেদিকে না গিয়ে দাম বাড়ানোর মতো জটিল পথে পা দিয়েছে। গ্যাস সরবরাহ আসছে প্রধানত দু’টি উৎস থেকে। একটি হচ্ছে দেশীয় গ্যাস ফিল্ড থেকে উত্তোলন, দ্বিতীয়টি হচ্ছে বিদেশ থেকে আমদানি। আমদানি দুই ধরণের চুক্তির আওতায় আনা হচ্ছে। একটি হচ্ছে জিটুজি ভিত্তিতে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায়, আর স্পর্ট মার্কেট (দরপত্রের মাধ্যমে বর্তমান দর) থেকে। দেশীয় উৎসের গ্যাসের দাম বাড়েনি, জিটুজি ভিত্তিতে আনা গ্যাসের দামও বাড়েনি। দাম বেড়েছে শুধু স্পর্ট মার্কেট থেকে আনা গ্যাসের। যার পরিমাণ সামান্যই।
বর্তমানে দৈনিক ২৯৫৬ এমএমসিএফ (৭ মার্চ ২০২২) গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। একই দিনে স্পর্ট মার্কেট থেকে আমদানি করা গ্যাসের পরিমাণ ছিল মাত্র ১০১.৬৭ এমএমসিএফডি। যার অনুপাত বের করলে দাঁড়ায় মাত্র ৪ শতাংশের মতো।
ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম বার্তা২৪.কম-কে বলেন, দাম বেড়েছে স্পর্ট মার্কেট থেকে আনা কমবেশি ৫-৬ শতাংশ। সিস্টেমের ৫-৬ শতাংশের দাম বেড়েছে বলে পুরো গ্যাসের দাম ১১৭ শতাংশ বাড়াতে হয় এটা বিশ্বাসযোগ্য! তারা গোঁজামিল দিয়ে হিসাব দেখাচ্ছে, এসব হিসাব বাস্তব সম্মত না। প্রয়োজন হলে ওই পরিমাণ এলএনজি আমদানি না করার পক্ষে আমরা। তবুও দাম বাড়ানো উচিত হবে না।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছে, পেট্রোবাংলার ওয়েব সাইটের তথ্য অনুযায়ী দেশীয় গ্যাস ফিল্ডগুলোর দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা ১১’শ ৪৫ এমএমসিএফডি, সেখানে ১৮ মার্চে উত্তোলন করা হয়েছে মাত্র ৮২৯ এমএমসিএফডি। অর্থাৎ আরও ৩১৬ এমএমসিএফডি গ্যাস উত্তোলন বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এই সুযোগটাই কেন কাজে লাগানো হচ্ছে না। এই পরিমাণ গ্যাস উত্তোলন বাড়ালে স্পর্ট থেকে ১৫০ এমএমসিএফডি আমদানি করতে হয় না। আর স্পর্ট মার্কেট থেকে আমদানি না করলে দাম বাড়ানোর প্রয়োজনও পড়ে না। এই সহজ সমাধানটি কেন করা হচ্ছে না। এই মুহুর্তে কোনভাবেই দাম বাড়ানো উচিত হবে না। এমনিতেই করোনার কারণে ভোক্তাদের অবস্থা নাকাল। গ্যাসের দাম বাড়ালে গণপরিবহনসহ পণ্যবাহী পরিবহনের ভাড়া বাড়বে। এতে করে দ্রব্যমূল্যের দামও বেড়ে যাবে।
সূত্রটি জানিয়েছে, ২০১৮ সাল থেকে বসে রয়েছে রশিদপুর ৯ নম্বর কূপটি। এখান থেকে সহজেই ১২ এমএমসিএফডি গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব। এখানে পাইপলাইন নেই দুই-তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ৭ নম্বর কূপের সঙ্গে হুকিং করা গেলেই হয়। সেই কাজটি কেনো ৩ বছর ধরে করা গেলো না। কারা গাফিলতি করে এই কাজটি ঝুলিয়ে রেখেছে। নাকি সংকট তৈরির জন্য ইচ্ছা করেই কাজটি করা হচ্ছে না, এটাই এখন বড় প্রশ্ন।
কৈলাশটিলা ২ ও ৩ নম্বর কূপে পানি চলে আসায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পাশের ৬ নম্বর কূপ থেকে ৪০মিটার নিচ থেকে গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২ ও ৩ নম্বর কূপের উপরের স্তর থেকে গ্যাস উত্তোলন শেষ হয়েছে। হোল লগিংয়ের মাধ্যমে সহজেই যাচাই করে, নিচের স্তর থেকে গ্যাস উত্তোলন করা যায়। কয়েকদিনের এই কাজটিও করা হয়নি। অথচ কূপ দু’টি দিয়ে ৪০ এমএমসিএফডি গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব। এমন আরও অনেক সিদ্ধান্তহীনতার নজির রয়েছে, যেগুলোতে সামান্য উদ্যোগেই গ্যাস পাওয়া সম্ভব। সেদিকে না গিয়ে আমদানির দিকে ঝুঁকে রয়েছে জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলা। তাদের এই কাজ না করার মানসিকতাই আজকের এই সংকটের প্রধান কারণ।
এছাড়া স্বচ্ছতা এবং চুরি ঠেকিয়েও দাম অপরিবর্তিত রাখা যায়। প্রায় ২৯’শ এমএমসিএফডি গ্যাস সরবরাহের বিপরীতে সিস্টেম লস প্রায় ৮ থেকে ১০ শতাংশ। ৫ শতাংশ সিস্টেম লস কমানো গেলেও চড়া দামে ১৫০ এমএমসিএফডি আমদানি করতে হয় না। বিদ্যুতে এক সময় ৪৭ শতাংশ সিস্টেম লস ছিল, সেখানে এখন এক সংখ্যায় নেমে এসেছে শুধুমাত্র মিটার স্থাপন করায়। কিন্তু গ্যাস সেক্টরে মিটার স্থাপন করা হচ্ছে ঢিমেতালে। আবার অনেক জায়গায় মিটার স্থাপন করা হলেও সেগুলো কার্যকর করা হচ্ছে না রহস্যজনক কারণে। মাঝে মধ্যেই গ্যাসের চোরাই পাইপ উচ্ছেদ করার খবর পাওয়া যায়। কিন্তু এর সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শাস্তির খবর আসে না। তাই দ্বিগুণ উৎসাহে গ্যাস চুরিযজ্ঞ চলছে। যা সিস্টেম লসের নামে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
গ্যাসের দাম দ্বিগুণের বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। একচুলা ৯২৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০০০ টাকা, দুই চুলা ৯৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২১০০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আবাসিকে প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারি গ্রাহকদের প্রতি ঘনমিটারের বিদ্যমান মূল্য ১২.৬০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৭.৩৭ টাকা, সিএনজি প্রতি ৩৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৬.০৪ টাকা, হোটেল-রেস্টুরেন্টে ২৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৯.৯৭ টাকা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে ১৭.০৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৭.০২ টাকা, ১০.৭০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৩.২৪ টাকা, ক্যাপটিভ পাওয়ারে ১৩.৮৫ টাকা থেকে ৩০.০৯ টাকা, চা শিল্পে ১০.৭০ টাকা বাড়িয়ে ২৩.২৪ টাকা করার প্রস্তাব করেছে। অন্যদিকে বিদ্যুৎ ও সার কারখানায় থাকা বিদ্যমান দর ৪.৪৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯.৬৬ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বাড়তি বিদ্যমান গড় ৯.৩৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০.৩৫ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। অতীতে কখনই এতো বেশি পরিমাণে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়নি। যে কারণে একে নজিরবিহীন বলে উল্লেখ করেছে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।
পেট্রোবাংলা তার লিখিত প্রস্তাবে বলেছেন, রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্স ও সিলেট গ্যাস ফিল্ডের গ্যাসের প্রতি ঘনমিটারের গড় ক্রয়মূল্য পড়ছে ১.২৬ টাকা, শেভরনের থেকে কিনতে হচ্ছে ২.৮৯ টাকা, তাল্লো থেকে ৩.১০ টাকা করে। অন্যদিকে এলএনজির প্রকৃত ক্রয়মূল্য ৩৬.৬৯ টাকা অন্যান্য চার্জ দিয়ে ৫০.৩৮ টাকা পড়ছে। দৈনিক ৮৫০ মিলিয়ন ঘন ফুট এলএনজি আমদানি বিবেচনায় এই দর।