জালিয়াতির নিয়োগের পর এটিএম সেলিমের সম্পদের পাহাড়

  • সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

জালিয়াতির নিয়োগের পর এটিএম সেলিমের সম্পদের পাহাড়

জালিয়াতির নিয়োগের পর এটিএম সেলিমের সম্পদের পাহাড়

নিয়োগটাই তার জালিয়াতির মাধ্যমে। অথচ চাকরিতে যোগদানের পর থেকে বেপরোয়া দুর্নীতি করে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন বিপিসির (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন) হিসাব বিভাগের মহাব্যবস্থাপক এটিএম সেলিম।

দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগের সূত্র ধরে এটিএম সেলিমের বেপরোয়া দুর্নীতির তথ্য সামনে আসতে শুরু করেছে। দুদকে দেওয়া অভিযোগে বলা হয়েছে, সংস্থার হিসাব ও স্বার্থ রক্ষার কথা থাকলেও বরাবরই ব্যক্তিগত হিসেবটাই এটিএম সেলিমের কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পেয়েছে। তিনি বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ফয়েস লেক আবাসিক এলাকায় হাজী আবদুল হামিদ রোডে ৬ তলা ভবনে (জোৎস্না-২/এ) স্ত্রী ও ছেলে মেয়ে নিয়ে থাকেন এটি এম সেলিম। ৭ কাঠা জমির উপর নির্মিত মনোরম ডিজাইনের ওই বাড়িটির নাম রাখা হয়েছে জ্যোৎস্না নামে। অন্যান্য দুর্নীতিবাজদের মতোই এটি এম সেলিমও বাড়িটি শ্বশুরের বলে প্রচার করে থাকেন। আর ভবনের নাম রেখেছেন শাশুড়ির নামে। প্রকৃত ঘটনা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করা টাকায় নির্মাণ করা এ বাড়িটি হালাল করার জন্যই এই কৌশল নিয়েছেন এটি এম সেলিম। এই ভবনেই সপরিবারে থাকেন বিপিসির ওই কর্মকর্তা। বিপুল পরিমাণ কালোটাকা বিনিয়োগ করলেও লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতে শ্বশুরের বলে প্রচার করেন। স্থানীয়রা জানিয়েছে জমির কাগজ কার নামে রয়েছে বলা কঠিন তবে নির্মাণ থেকে সবকিছু করেছেন এটিএম সেলিম।

বিজ্ঞাপন

চান্দগাঁও থানার খালাসী লেকের বিপরীত দিতে ৪ ইউনিটের ৬ তলা বিশিষ্ট বিশাল একটি ভবনের মালিক। নগরীর চকবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে নামে বেনামে একাধিক দোকান। শুধু চট্টগ্রাম নয় দুর্নীতির টাকায় এটি এম সেলিমের সম্পদের সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে রাজধানী ঢাকাতেও। ঢাকার অভিজাত এলাকা বনানীতেও নামে বেনামে একাধিক ফ্ল্যাট কিনেছেন এটিএম সেলিম। এছাড়া অস্ট্রেলিয়াতে বন্ধু আবদুল করিমের কাছে টাকা পাচার করে কিনেছেন বাড়ি ও গড়ে তোলেছেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে পরীক্ষা ছাড়াই বিপিসিতে চাকরি পান এটিএম সেলিম। ১৯৯৯ সালে ৪ জন সহকারী ব্যবস্থাপক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিপিসি। নিয়োগ বোর্ড হিসাব বিভাগে কাজী শহীদুর রহমান, বাণিজ্য বিভাগে আবুল কালাম আজাদ, এমআইএস বিভাগে মোঃ সোয়েব আহমেদকে ও পরিকল্পনা বিভাগে মোঃ মনিরুল ইসলাম নিয়োগ দেয়। নিয়োগ পাওয়ার ৩ মাসের মাথায় মোঃ মনিরুল ইসলাম চাকরি ছেড়ে পূর্বের কর্মস্থল সিলেট গ্যাস ফিল্ডে যোগদান করেন। এতে একটি সহকারী ব্যবস্থাপক পদ শূন্য হয়ে পড়ে। তখন বিপিসির কম্পানি সচিব ছিলেন এটিএম সেলিমের চাচা কামাল উদ্দিন। তার চাচা কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ও আইন না মেনে, বিধি বহির্ভূতভাবে নিয়োগ বোর্ড কিংবা প্যানেল ছাড়াই অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে জালিয়াতির মাধ্যমে শূন্য হয়ে পড়া সহকারী ব্যবস্থাপক পদে এটি এম সেলিমকে নিয়োগ দেন।

বিজ্ঞাপন

মংলা অয়েল ইনস্টলেশন প্রকল্পে পরতে পরতে দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে। এই প্রকল্পটি এটি এম সেলিমের সার্বিক তত্ত্বাবধানে বাস্তবায়ন হয়। ঠিকাদারের বিলসহ সব পেমেন্ট দেওয়া হয় বিপিসির হিসাব বিভাগ থেকে। প্রকল্পের শুরুতেই শূন্য শতাংশ অগ্রগতিকে ৫০শতাংশ অগ্রগতি দেখিয়ে ম্যাক্সওয়েল ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস ও পাইপলাইন লিমিটেডকে বিল দেওয়ার মতো জালিয়াতি উঠে এসেছে অডিট রিপোর্টে। প্রকল্পটির আরডিপিপির (সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) অনুমোদিত ব্যয় ছিল ২০৫ কোটি ৪৬ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। খরচ করা হয়েছে ২০৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এ কারণে অডিট প্রতিষ্ঠান খান ওয়াহাব শফিক রহমান এন্ড কম্পানি ২০২০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি আপত্তি দিয়ে রেখেছে। প্রকল্পটির বেশ কিছু ভাউচারের হদিস পায়নি অডিটর। ভাউচারের বিষয়ে অডিট প্রতিষ্ঠান আপত্তি উত্থাপন করলে প্রকল্প পরিচালক (মোছাদ্দেক হোসেন) তার বক্তব্যে বলেছেন বিপিসির হিসাব বিভাগ থেকে বিল প্রদান করা হয়। তাই বিপিসির কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। পরে হিসাব বিভাগেও ভাউচার খুঁজে পায়নি অডিট প্রতিষ্ঠান।


এদিকে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার বছর পার না হতেই অফিস ও আবাসিক ভবনের প্লাস্টারে শ্যাওলা জমেছে, বেশ কয়েকটি ভবনের বারান্দায় ফাটল ধরেছে। সিড়িং রেলিং স্টেইনলেস স্টিলের দেওয়ার কথা থাকলে তা দেওয়া হয়নি, মরিচা ধরে বিবর্ণ আকার ধারণ করেছে রেলিং। এসবের মূলে আছেন এটি এম সেলিম।

দুদকের অভিযোগে আরো বলা হয়, বিপিসির অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারী লিমিটেডের এসপিএম (সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং) প্রকল্পে জমি অধিযাচনে দুর্নীতি ও লুটপাটের বিস্তর অভিযোগ উঠেছে। ধান ক্ষেতের একর প্রতি মূল্য ৩ লাখ, আর পানের বরজের মূল্য ৬৩ লাখ নির্ধারণ করে জমি অধিযাচনের সিদ্ধান্ত হয়। অথচ এসপিএম প্রকল্পে যারা এটিএম সেলিমকে টাকা দিয়েছেন তাদের ধান ক্ষেতকে দেখানো হয়েছে পানের বরজ, আবার যারা টাকা দেননি তাদের পানের বরজকে ধান ক্ষেত দেখানো হয়েছে। এখানে প্রায় ৯৬ লাখ ৬০ হাজার ১৫০ টাকার দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে খোদ দুদক। ২০২০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ঘুষের টাকা ভাগাভাগির সময় ৬৬ লাখ ৭৫ হাজার ৫৫০ টাকাসহ ১ জনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। তার সূত্র ধরেই এ বিষয়ে দুদকের অনুসন্ধানে দুর্নীতির ঘটনা উঠে আসে। যদিও এর মূল হোতা এটি এম সেলিম রয়েছেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

বিপিসির রন্ধে রন্ধে থাকা দুর্নীতি বন্ধে অটোমেশনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া থামিয়ে রেখেছে এটিএম সেলিম চক্র। অটোমেশন হলে দুর্নীতি লুটপাট অনেকাংশে বন্ধ হয়ে যেতো। বিশেষ করে তেল বিক্রি ও মজুদ এক ক্লিকেই দেখা যেতো। তাতে করে অধীনস্থ কম্পানিগুলো (পদ্মা, মেঘনা, যমুনা) ব্যাংকে টাকা ফেলে রেখে ব্যক্তিগত সুবিধা নিতে পারত না। স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েলে এই ধরণের একটি বড় দুর্নীতির ঘটনা ঘটে। বিপিসি ওই কম্পানিটির শেয়ার হোল্ডার। আর বিপিসির পক্ষ থেকে তদারকি করতেন এটি এম সেলিম নিজে। প্রায় ৩০০ কোটি টাকা লোকসান হয় টাকা নির্ধরিত সময়ে আদায় না করায়। ওই ঘটনায় মামলা হলেও মূল হোতা এটি এম সেলিম রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিস্তারিত দুদক অনুসন্ধান করলেই বেরিয়ে আসবে।

বন্দরনগরী চট্টগ্রামের প্রাণকেন্দ্র চকবাজারের একটি মার্কেটে ইডিইএস নামের একটি কাপড়ের দোকান (দ্বিতীয় তলায় দোকান নম্বর#২২) রয়েছে। যেটি তার স্ত্রী ও আপন ছোট ভাই দেখাশুনা করেন। যেটির বর্তমান মূল্য প্রায় কোটি টাকাও বেশি। যা তার আয়ের সঙ্গে মোটেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

সরকার যখন জ্বালানি সাশ্রয়ের কথা বলছে, তখনও বেপরোয়া এটিএম সেলিম। অফিসের গাড়িটি সারাদিন পারিবারিক কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। সকালে তাকে অফিসে নামিয়ে দিয়ে চলে যায় ছেলে- মেয়েকে স্কুলে আনা নেওয়ার জন্য। দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েটি কখনও চট্টগ্রাম ক্লাবে, কখনও র‌্যাডিসন হোটেলে সাঁতার কাটতে যায়। বিগত কয়েকমাস মাস ধরে চলছে সেই রুটিন। মেয়ের সাতার শেখার ফাঁকে স্ত্রীকে দোকানে আনা নেওয়া করে এ গাড়ি। গাড়ির মাইল মিটার চেক করলেই এসব ধরা পড়বে।

নিজের পকেট ভারি করতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিপিসিকে ঠেলে দিয়েছেন লোকসানের দিকে। ব্যাংকে কয়েক হাজার কোটি টাকা আমানত থাকা অবস্থায় (এসএনডি ও এফডিআর) প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন ব্যাংক ঋণ নিয়ে। এতে দেখা গেছে, আমানতের বিপরীতে প্রাপ্ত সুদের চেয়ে ঋণের বিপরীতে পরিশোধিত সুদের পরিমাণ ২৭৮ কোটি টাকা বেশি। অর্থাৎ ঋণ না নিয়ে নিজেদের আমানত থেকে বিপিসির একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে ২৭৮ কোটি টাকা সাশ্রয় হতো। সবকিছু জেনেও শুধু নিজের মুনাফার ধান্দায় সেই কাজটি করে বিপিসিকে ডুবিয়েছেন এটি এম সেলিম। এই দুর্নীতির বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছে জাতীয় সংসদের সরকারি প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি। ২৩আগস্ট বৈঠক শেষে কমিটির সভাপতি আসম ফিরোজ সাংবাদিকদের বলেন, বিপিসিতে অনেক ঘাটতি রয়েছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি কম। তাদের অনিয়মের চিত্র দেখে কমিটি ‘শকড’ (স্তম্ভিত)। বিভিন্ন কেনাকাটা ও নিরীক্ষায় যেসব আপত্তি এসেছে, তাদের সেগুলো সমন্বয় করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তারা কিছুই করেনি।

আসম ফিরোজ বলেন, নিরীক্ষা প্রতিবেদনে অনেকের নাম উল্লেখ করে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু বিপিসি কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা, দুদকের কথাও তারা শোনেনি।

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য একাধিক দফায় ফোন দিলেও এটিএম সেলিম মোবাইল রিসিভ করেন নি।